উধম সিং সাহেব বললেন, ভেবে দ্যাখো। ওঁরা যা বলেন তার উপরে আমারও কিছু বলার আছে পৃথু। এরকম হঠকারী সিদ্ধান্ত নিও না।
দেখেছি ভেবে।
টাকাও বা কত পাবে? এমন কিছু তো নয়! প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্রাচুইটি, কমপেনসেশান সব নিয়ে লাখ আড়াই। মানে, মাসে দু’হাজারের একটু বেশি আয়। ফিক্সড ডিপোজিটেই রাখো কি ইউনিটই কেনো।
যাদের জন্যে টাকার দরকার ছিল তারাই যখন নেই, তখন টাকা দিয়ে করব কী আমি? দিন, কাগজ দিন। লিখে দিই রেসিগনেশান।
বোকা কোথাকার। তুমি রেসিগনেশান দিলে ওরা তোমাকে কমপেনসেশান দেবে ভেবেছ? কাল ফোনে কথা হয়েছে আমার লাণ্ডা-এর সঙ্গে। কমপেনসেশান না পেলে তুমি মোটে দু লাখ পাবে। আমি তোমার বড় ভাই-এর মতো। কথা শোনো আমার।
পৃথু ভাবল একটু। তারপর বলল, ঠিক আছে। তাই-ই হোক। তবে, কাগজ দিন, আপনাকেই দায় দিয়ে যাচ্ছি। পঁচিশ হাজার টাকা আমি নেব বাকি টাকা আপনারই হেফাজতে থাক। ফিক্সড ডিপোজিট করে মাসে মাসে যা সুদ হয় তার অর্ধেক রুষাকে পাঠিয়ে দেবেন। অর্ধেক জমা থাকবে ইকুয়ালি, মিলি ও টুসুর নামে। টুসুর পড়াশুনোর খরচ। মিলির বিয়ে। এই টাকা তখন যেন রুষা খরচ করে।
আমাকে এর মধ্যে জড়াবে? আমি তো বাইরের লোক পৃথু।
বাইরের লোকই মানুষের সবচেয়ে আপন লোক সিং সাহেব। আপনরা যখন পর করে দেয় তখন পরই হয় সবচেয়ে আপন। রুষাকে আমি চিঠি লিখে সব জানিয়ে দেব। আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলে দেব ওকে।
পৃথু, তুমি মানে, তোমার জন্যে আমি কি কিছু করতে পারি?
নাঃ। কী করবেন? কেউই কারও জন্যে কিছু করতে পারে না সিং সাহেব। করার মতো যা-কিছু সব নিজেরই করতে হয় একা একা।
তোমার কোনও ইচ্ছা কি আমি পূরণ করতে পারি না পৃথু?
ইচ্ছা?
হ্যাঁ।
হাসল পৃথু।
বলল, আমি যেন ফাঁসির আসামী! আমার শেষ ইচ্ছা পূরণ করার জন্যে সবাই এখন খুউবই। ব্যগ্র।
ওরকম করে বোলা না। তুমি আমার ভাইয়ের মতো। মতো কেন, ভাই-ই।
একটা ইচ্ছা ছিল। পূর্ণ হল না।
কী? কী? সেটা কী? আমাকে বলল।
টুসুকে একবার দেখতে বড় ইচ্ছে ছিল। জানতে ইচ্ছে ছিল, ও-ও কি আর দেখতে চায় না আমাকে একবারও?
স্তব্ধ হয়ে গেলেন সিং সাহেব।
বললেন, এ আর এমন কথা কি? ডিভোর্স তো আজকাল ঘরে ঘরেই হচ্ছে। সেপারেশান। তাছাড়া, টু বী ফ্র্যাঙ্ক, তুমি তো ইদুরকারের বিরুদ্ধে অ্যাডালটরীর কেসও আনতে পারো। রুষাকে ডিভোর্স না-ও দিতে পারো। তুমি তো কোনও জোরই খাটালে না। আইন তো তোমার দিকেই। আশ্চর্য মানুষ তুমি! ইদুরকারকে এমন করে ছেড়ে দিলে লোকে তোমাকেই ভিতু ভাববে। যে মানুষ ডাকু মগনলালকে মারতে পারে একা একা তাকে কি সবাই ভিতু বলেই জানবে?
সাহসের ডেফিনিশান প্রত্যেকের কাছে আলাদা আলাদা। মন যখন মন থেকে সরে যায় তখন আদালতে গিয়ে সরে যাওয়া মনকে ফিরিয়ে আনার দরবার করা, কি আইনের জোরে অন্যকে শিক্ষা দেওয়াতে আমি বিশ্বাস করি না। রুষা তো আমার বিবাহিতা স্ত্রী, মিলি টুসু তো আমারই ছেলেমেয়ে। ওরা যদি কেউই আমাকে না চায় তাহলে আমি যে খারাপ এতে আমার নিজের অন্তত কোনও সন্দেহ নেই। তাই-ই আদালতে যাব কোন মুখে? আর যাবই বা কেন? সব আইন সকলের জন্যে নয়।
টুসুকে দেখতে পাওয়ার অসুবিধা কী? তুমি চলে যাও এক্ষুনি আমার গাড়ি নিয়ে। অজাইব সিং তো অসুস্থ।
গেছিলাম কাল ভোরে।
গেছিলে?
উত্তেজিত হয়ে উঠলেন সিং সাহেব।
তারপর? গেছিলে, তবু, দেখা হল না?
দারোয়ানেরা আমাকে ঝাঁঝি বস্তির ছেলেধরা বলে মারতে এসেছিল, ঢুকতেই দিল না।
এ তোমার মিথ্যে অভিমান। চোরের উপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়ার মতো। জোর যেখানে খাটাবার, সেখানে জোর খাটাতে হয় পৃথু।
দারোয়ানরা তোমাকে ঠেকিয়ে রাখবে কী এত সাহস তাদের? তুমি বললে না কেন ইদুরকারকে ডাকতে?
ইদুরকারের সঙ্গে আমার কী? আমি তো টুসুকেই শুধু দেখাতে চেয়েছিলাম।
ঠিক আছে। আমি ফোন করছি এক্ষুনি। রুষা অথবা ইদুরকার নিশ্চয়ই জানেই না যে, তুমি গেছিলে।
হয়তো জানে না।
অপারেটরের কাছে লাইন চাইলেন সিং সাহেব।
হ্যালো! আই অ্যাম উধাম সিং। ভেরী গুড মর্নিং ভিনোদ। আই অ্যাম সেভিং পৃথু ডাউন টু ইওর প্লেস। হী ওয়ান্টস টু সী টুসু।
আই সী! হী ইজ ইন দ্যা স্কুল ন্যাউ? হোয়াট টাইম উইল হী বী ব্যাক? ফোর ও ক্লক?…হোয়াট? টুসু ডাজনট ওয়ান্ট টু সী হিম?
উধম সিং সাহেবের মুখটা রাগে লাল হয়ে গেল।
বললেন, লুক ভিনোদ, উ্য শু্যড নো হুম আর ইউ টকিং টু। আই অ্যাম নট পৃথু ঘোষ দ্যাট উ্য ক্যান টেক মী ফর আ রাইড। উ্য সান অফ আ বি। উ্য লেচারা, নাস্টী ডগ। হ্যাড আই বীন পৃথু আই উড হ্যাভ শট উ্য!
হ্যালো! হ্যালো! হ্যালো!
হু? রুষা? আমি, অ্যাম উধাম সিং। পৃথু ওয়ান্টস টু সী টুসু বিফোর হী লীভস দিস লাউজী প্লেস্।
হোয়াট? হী, কান্ট? হাউ ড়ু য় মীন? কান্ট হী সী হিজ সান্?
আই সী! আই সী।…
বলেই ঘটাং করে রিসিভার নামিয়ে রেখে দিলেন উধাম সিং।
চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠে বলেন, লুক পৃথু। এক্সকিউজ মাই সেয়িং সো, দিস ওয়াইফ অফ ইওরস্ ইজ আ বিচ। উ্য মাস্ট টিচ হার আ লেসস। আমাকে তুমি একবার “হঁা” বল, আমি ভোপালে ফোন করছি। নয় তো বম্বেতেই। কালকেই মিঃ কোলাকে আনাব আমি। তারপর শিক্ষা কাকে বলে তা আমি দেখাচ্ছি ওদের দুজনকেই। তুমি এইভাবে ভীরুর মতো যা তোমারই, তা ছেড়ে চলে যেতে পারো না। উ্য কান্ট। আই উড নট আলাও উ্য টু ড়ু দ্যাটু।
পৃথু জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে ছিল।
অনেকক্ষণ পর, সিং সাহেব একটু ঠাণ্ডা হলে বলল, আপনার প্রেসার হাই। আমার কারণে অযথা উত্তেজিত হবেন না সিং সাহেব। আপনার স্বাস্থ্যর জন্যে আমার চিন্তা হয়।
ড্যাম ইট পৃথু। স্বাস্থ্য! টাকা-পয়সা! ইফ দিস ক্যান হ্যাপেন টু উ্য টুডে, দিস ক্যান হ্যাপেন টু এনীওয়ান টুমরো। ড়ু উ্য থিংক উই উইল টেক দিস্ লায়িং ডাউন?
তা বলিনি আমি। আমার মতো সবাই-ই কেন হবে?
কিন্তু না কেন? হোয়াট নট? উ আর নট আ ম্যান পৃথু। উ্য আর নো বিগ-গেম হান্টার। উ্য; উ্য উ্য আর অ্যান…
আই নো। আই নো, হোয়াট আই অ্যাম্।
বলেই উঠে দাঁড়াল পৃথু।
স্যাক মী মাই বস্। উইল উ্য প্লীজ ড়ু মী দিস্ ফেভার? গিভ মী দ্যা স্যাক অ্যান্ড ফরগেট মী। প্লীজ।
উধম সিং আবার চেয়ারে বসে পড়ে দুটি হাত মাথায় দিয়ে বললেন, উ্য রিয়্যালী ফর আ স্ট্রেঞ্জ পার্স। মাচ মোর স্ট্রেঞ্জ দ্যান আই এভার থট অফ।
আই অ্যাম্।
পৃথু বলল।
তারপর ক্র্যাচ দুটি পাশের চেয়ার থেকে তুলে নিয়ে আস্তে আস্তে সিং সাহেবের কাছে গিয়ে তাঁর পিঠে হাত রেখে বলল, আপনি আমাকে সত্যিই ভালবাসেন সিং সাহেব। আমার দাদা নেই। কিন্তু আপনাকে দেখে বুঝতে পারছি যে, না থেকেও তিনি আছেন। আমার জন্যে কষ্ট পাবেন না আর। ভাবীজীকে আমার নমস্কার দেবেন। কাল যদি আমাকে পাঁচ হাজার টাকা ক্যাশ দেন তো ভাল হয়। পরে, আমার ঠিকানাতে বাকি কুড়ি হাজার টাকার অ্যাকাউন্ট-পেয়ী ড্রাফট পাঠিয়ে দেবেন একটা। আর বাকি টাকাটা…যেমন বললাম……
বলেই, প্যাডটা টেনে নিয়ে, সাদা প্যাডের চার পাঁচটি পাতার নিচে সই করে দিল, তারিখ দিয়ে।
বলল, রইল সই করা। যা কিছু লেখার লিখে নেবেন।
তুমি ব্ল্যাঙ্ক কাগজে সই করে দিলে? আমি যদি মেরে দিই টাকাটা?
মারলে, মারবেন। যদি পারেন। কেউ কেউ ঠকায়। কারণ ঠকানোই তাদের ধর্ম। কেউ কেউ সুযোগ থাকলেও ঠকাতে পারে না। সেটাই তাদের ধর্ম বলে। আপনি ঠকানোর দলের নন সিং সাহেব। ঠকার দলে।
একটু চুপ করে, দরজার দিকে এগোতে এগোতে বলল, ভাবলে অবাক লাগে যে, যারা কাউকেই ঠকায় না কখনও, তারাই সবচেয়ে বেশি ঠকে যায় এখানে। আশ্চর্য নিয়ম? তাই-ই না?
সিং সাহেবের দু’চোখের কোনায়ই জল চিকচিক করে উঠল। চেয়ার ছেড়ে উঠে পৃথুর পাশে এসে তার দুকাঁধে দু হাত রেখে বললেন, আই রিয়্যালী অ্যাম্ সরী ফর উ্য পৃথু। জানি না, তুমি কোথায় যাবে, কী করবে জীবিকা হিসেবে, কোথায় থাকবে? তবে, আমার বাড়ি আর তোমার ভাবীজির স্নেহ তোমার জন্যে থাকবে চিরদিন। তুমি তো জানো! আমি যদি নাও-ও থাকি, তবুও থাকবে। ডোন্ট ফর গেট দ্যাট উ হ্যাভ আ হোম, ফুল অফ ওয়ার্মর্থ, ফর দ্যা রেস্ট অফ ইওর লাইফ।
উধম সিং সাহেবের ড্রাইভার পেছনের দরজা খুলে দিল গাড়ির।
পৃথু বারণ করল। বলল, হেঁটেই যাবে।
হেঁটে যাবে? হোয়াই?
ভীষণ রেগে গেলেন সিং সাহেব।
বিড় বিড় করে বললেন, হাঁটার ক্ষমতাও যদি থাকত! হোয়াট আ পিটী! কী দিনকাল হল। সংসার কী হয়ে গেল!
উধম সিং সাহেব বললেন, আর কথা না বলে গাড়িতে ওঠো। আমাকে আর রাগিও না বলে দিচ্ছি।
আমি ভুচুর গারাজে যাব। গাড়ি কী হবে?
তুমি যে জাহান্নামেই যাও। আমার গাড়িতেই যাবে। ডোন্ট ইন্টারপট মী পৃথু। আই হ্যাভ মাই রিভলবার ইন মাই ড্রয়ার। আই উইল শু্যট উ্য ইফ উ্য ডিসওবে মী। আর…অসহায়ের মতো বললেন; অর আই উইল শু্যট মাই সেল্ফ। আই বিলঙ টু দ্যা পাস্ট জেনারেশান। তোমাদের এই প্রজন্মর নারী বা পুরুষ কাউকেই বোঝার ক্ষমতা পর্যন্ত আমার নেই। আই ফীল রেচেড়। রিয়্যালী রেচেড়।
এঞ্জিন স্টার্ট করে বাহাদুর বলল, কাঁহা যাইয়েগা সাব?
অজাইব সিংকা ঘর মালুম হ্যায় বাহাদুর?
জী সাব।
হুঁয়াই চলল।
জী সাব।
অজাইব সিং-এর যে কী হয়েছে তা কেউই নাকি ডায়াগনাইজ করতে পারছে না। পেটে অসম্ভব ব্যথা। জ্বরও থাকে। খিদে নেই। ঘুম নেই। ভীষণ রোগা হয়ে গেছে নাকি! কোম্পানীর ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছিল পৃথু সকালে। ডাক্তার সন্দেহ করছেন, ক্যান্সার বলে। টিউমারটা বেশ বড়ও হয়েছে। অপারেট করলেই যতটুকু আয়ু আছে তাও শেষ হয়ে যাবে বলে জবলপুরের সার্জন-এর ধারণা।
এমনিতে কতদিন বাঁচবে আর?
মাস তিনেক। তবে, কষ্ট পাবে বড়।
হুঁ। বলেছিল পৃথু।
গাড়িটা বাজারের দিকে যাচ্ছে। লাড্ডুর দোকানে যেতে বলল পৃথু। পঁচিশ টাকার লাড্ডু কিনে নিয়ে যাবে অজাইব সিং-এর জন্যে। চাকরিতে ঢোকার প্রথমদিন থেকে অজাইব সিং-ই ওর গাড়ি চালিয়েছে। চমৎকার ড্রাইভার। শুধু গীয়ারেই গাড়ি চালাতো, মোড় নিত গীয়ারের উপর। ক্লাচ্-এ কখনও পা ছোঁয়াত না গীয়ার চেঞ্জ করার সময় ছাড়া। আর ব্রেক-এও ছোঁয়াত না অ্যাসিডেন্ট সামলানো ছাড়া। কে কোন কাজ করে, কার কোন জীবিকা, কে কত বড় শিক্ষিত তাতে কিছুই আসে যায় না। যে, যে কাজটা করে, সেই কাজে যদি সে গর্ব বোধ না করে; যদি না চেষ্টা করে যে তার কাজটি ঠিক তার মতো ভাল আর খুব কম লোকই করতে সক্ষম, তবে সে মানুষই নয়। অজাইব সিং সেই জাতের মানুষ ছিল, যার কাছে তার জীবিকাটা শুধুই অন্নসংস্থানের উপায় নয়, তার চেয়ে আরও বড় কিছু। এই কারণেই পৃথু, চিরদিন ওকে শ্রদ্ধা করে এসেছে। ওর গাড়িতে রুষা, মিলি টুসুকে পাঠিয়ে কখনও ওর চিন্তা হয়নি এক মুহূর্তও।
লাড্ডু ছিল না। তার কর্মচারী পয়সা নিতে চাচ্ছিল না। পৃথু বলল, নেব না তাহলে। মারীজ আমীর জন্যে লাড়ু নিয়ে যাচ্ছি, তার অমঙ্গল হবে বিনা-পয়সার মিষ্টি নিয়ে গেলে।
শেষে রাজি হল লাড্ডুর লোক।
অনেক দুর অজাইব সিং-এর বস্তি। ও কোয়ার্টারে থাকত না। ওর বউকে নিয়ে কী একট গোলমাল হয়েছিল কোয়ার্টারে। এতদূর থেকে ও সাইকেলে করে রোজ সকাল আটটাতে শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষায় কী করে যে পৃথুর বাংলোতে ডিউটিতে আসত, তা ভাবলেই অবাক লাগছে। গাড়িতে পৌঁছতেই প্রায় মিনিট কুড়ি লেগে গেল। কে জানে, হয়তো কোনও শর্টকাট রাস্তাতে আসত, জঙ্গল-টাঁড় পেরিয়ে।
বাহাদুরই দেখিয়ে দিল বাড়িটা। গাড়ি দেখে কয়েকটি কৌতুহলী বাচ্চা এগিয়ে এল। অজাইব সিং-এর সারাটা দিন কাটে গাড়ির মধ্যে বসে অথচ তার বাড়ির মানুষদের এবং প্রতিবেশীদেরও গাড়ি সম্বন্ধে অদম্য কৌতুহল। আজকে পৃথুর মনে হল, একদিনের জন্যে গাড়িটা অজাইব সিংকে ধার দিলেও হয়তো পারত। ওর বউ-বাচ্চাদের নিয়ে গাড়ি চড়িয়ে আনতে পারত ও। এরকম অনেক কিছু করণীয় কাজের কথাই মনে যখন পড়ে, তখন হয়তো অনেকই দেরি হয়ে যায়; পৃথুর সংসারী হওয়ার কর্তব্যরই মতো।
একজন সুন্দরী মেয়ে ঘর থেকে বাইরে এল। ছিপছিপে শরীর। গায়ের রঙ ফর্সা। সবচেয়ে বড় কথা, মুখে তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধির প্রসাধন। সে বাহাদুরের উর্দী দেখেই এবং গাড়ি দেখেই বুঝল এক ঝলকে, যে, কোম্পানী থেকে এসেছে কোনও সাহেব।
মেয়েটি বলল, সেলাম সাহা। বলেই, পা-হারানো পৃথুর দিকে এমনভাবে তাকাল তাতে পৃথু বুঝল পৃথুকে চিনেছে ও। ওর চোখে সম্রম এবং অনুকম্পাও ফুটে উঠেছিল। খারাপ লাগল পৃথুর।
পৃথু বলল, সালাম! অজাইব সিং কাঁহা হ্যায়?
লেটা হুয়া হ্যায় সাহাব। উঠনে নেহি শক্তা।
ম্যায় জারা মিলনে শক্তা?
জরুর! কাহে নেহি সাহাব। ম্যায় উসকো জানানা।
বলেই, পৃথুকে নিয়ে গেল ঘরে। অজাইব সিং চৌপাইতে শুয়েছিল লাল আর সবুজ চেক চেক একটা লুঙি পরে। গেঞ্জি গায়ে। চেহারার বিশেষ পরিবর্তন দেখল না পৃথু। কেবল রোগা হয়ে গেছে বেশ আর পেটটাই যেন শরীরের সব হয়ে উঠেছে।
পৃথুকে দেখেই, ভূত দেখার মতো চমকে উঠল অজাইব সিং। তড়াক করে উঠে বসতে গিয়েই পেট ধরে শুয়ে পড়ল আবার। হাসপাতালের দিনগুলোর কথা মনে পড়ল পৃথুর। শুয়ে শুয়েই সেলাম করল অজাইব সিং ওকে। পৃথু, লাড্ডুর প্যাকেটটা ওর স্ত্রীর হাতে দিয়ে চৌপাইরই এক। কোণাতে ক্রাচ দুটো বাঁ কাঁধের উপর শুইয়ে রেখে বসল।
কৈসা হ্যায়? অজাইব সিং?
অজাইব সিং পেট দেখিয়ে বলল, বহুৎই দর্দ সাহাব।
বলেই বলল, আপ কৈসা হ্যায় হুজৌর?
ম্যায় ফারস্টক্লাস। তুমকো জলদি ঠিক হো যানা চাইয়ে অজাইব সিং।
অজাইবের বুকের মধ্যে প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছিল। সেই মুহূর্তে ওর পেটের ব্যথার চেয়েও যেন বুকের ব্যথাটাই বেশি তীব্র হয়ে উঠল। ইশারায় ও তার স্ত্রীকে বাইরে যেতে বলল। সে বাইরে চলে গেলে, পৃথুর ডান হাতটা টেনে নিয়ে নিজের পেটের উপর রেখে বলল, ইয়ে মেরী পাস্কা নতিজা হুজৌর।
তুমহারা পাপ? কওসা পাকা বারেমে কহ রহা তুম?
হুজৌর!
বলেই, থেমে গেল অজাইব সিং। কী এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় তার মুখ বিকৃত হয়ে গেল।
বোলো অজাইব সিং। বোলো, ক্যা তুম বোলনে মাংগতা বোলো।
হুজৌর, ম্যায় সবকুছ জানতা থা ইদরকার সাল্কা বারেমে, মগর, ম্যায় আপকো কুছভি বাতায়া নেহী। ওহি পাপসে ম্যায় ঈ বিমারিসে পরিসান। ভগোয়ানে মুঝপর থুক দিয়া। মেরী মওঙ্কা ওয়াক্ত আ চুকা হ্যায়।
ক্যা ফালতু বকবকাতা তুম। আরাম করো। সব ঠিক হো যায়েগা। মারীজকো তলিফ হোতাহি হ্যায়, মগর উত্সকো মতলব ঈ নেহী ওয়াক্ত আ চুকা হ্যায়। ঈ সব গলদ বাঁতে বিলকুল মত শোনা।
অজাইব সিং পৃথুর হাতটা শক্ত করে পেটের উপর চেপে ধরে বলল আমার মৃত্যুর জন্যে আমি ভয় করছি না। আমার ভয়, আপনার জন্যে। বলেই পা-হীন পৃথুর দিকে চেয়ে বলল, আপনার এই অবস্থা, তার উপর আপনাকে এই সময়ে মেমসাব ছেড়ে চলে গেলেন ছেলেমেয়েকে নিয়ে। আমি বিছানাতে শুয়ে। আর কখনও উঠব না। আপনিও হয়তো আর কোনওদিনও গাড়ি চালাতে পারবেন না। কী হবে হুজৌর আপনার এখন?
আমি ঠিক আছি অজাইব সিং। তুমি ভাল হয়ে উঠে তোমার গাড়ি আবার চালাবে। তুমি তো কোম্পানীর লোক। আমার ডিউটি না করে অন্য কোনও সাহেবের ডিউটি করবে। কোনও চিন্তা নেই। আমার জন্যে কোনও চিন্তা করতে হবে না তোমার। ঠিক আছি আমি। ফারস্টক্লাস আছি।
ফা-র-স্ট-ক্লা-শ?
কথাটা টেনে টেনে পুনরাবৃত্তি করল অজাইব সিং আস্তে আস্তে। তারপর বলল, সবহি আদমী নে আপকো পাগলা সাহাব এইসেই নহী কহতে থে। পাগলা আপ তো সাচমুচই হ্যায় সাহাব।
পৃথু ওর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ওর স্ত্রীকে ভিতরে আসতে বলল। ঘটার মধ্যে আলো-হাওয়া খেলে না মোটে। এই এপ্রিলের সকাল এগারোটাতেই অন্ধকার। অথচ পৃথু ঘোষের বাংলো কত চমৎকার। আজ অবধি একদিনও খেয়াল, হয়নি পৃথুর, অজাইব সিং কেমন ঘরে থাকে তা দেখে আসবার। যে তার জন্যে এত করে, এতবছর এত করল, তার জন্যে পৃথুরও যে কিছুমাত্র করণীয় ছিল, তা সত্যিই মনেও হয়নি একবারও। কোম্পানীর দেওয়া টেরিলীনের উনিফর্ম আর টুপী আর হাতের এইচ-এম-টি ঘড়ি দেখেই মনে হত, অজাইব সিংও পৃথুর মতই ভাল থাকে, ভাল খায়।
মনটা হঠাৎই বড় খারাপ হয়ে গেল।
বলল, লাড্ডু খাও একটা। আমি দেখি।
ওর স্ত্রী বলল, আপনি খাবেন না একটা?
পৃথু হেসে বলল, তোমার ঘরে এসেছি, তোমাদের জিনিসই খাব আমি। ঘরে কী আছে?
ঘরে?
লজ্জায় পড়ল অজাইব সিং-এর বউ।
বলল, যবের ছাতু।
ফারস্টক্লাস। তাই-ই দাও এক গ্লাস শরবৎকরে। নুন আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে। গরম তো পড়েই গেল, কী বল? তার আগে তোমরা লাড়ু খেয়ে নাও। ছেলেমেয়েরা সব কোথায়?
ছেলেমেয়ে? লজ্জা পেল অজাইব সিং-এর বউ।
অজাইব সিং-এর ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে, ওর পেছনে শয্যাশায়ী মানুষটার ওর প্রতি মঙ্গল কামনার দৃষ্টিকে অনুভব করল ও। কী যেন বলল বিড়বিড় করে অজাইব সিং। ঠিক বুঝতে পারল না। সেই সাংকেতিক ভাষা শুনে ওর বউ ঘরে ফিরে গিয়েই আবার ফিরে এল হাতে একটি সস্তা ক্যাসেট নিয়ে।
এটা কী?
অবাক হয়ে বলল পৃথু।
অজাইব্-এর স্ত্রী বলল, এটা ও আপনাকে দিল হুজৌর। কখনও মন খারাপ হলে, শুনবেন।
অবাক হয়ে ক্যাসেটটা বুক পকেটে রাখল পৃথু।
বাহাদুর গাড়ির দরজা খুলে দিল। গাড়িতে উঠতে উঠতে বলল, অজাইব ভাল হলেই যেন ডিউটিতে আসে। আমি অপেক্ষা করে থাকব ওর জন্যে। ওকে বোলো সে কথা।
গাড়িটা ছেড়ে দিতেই, পৃথুর দুটি চোয়াল শক্ত হয়ে এল। এইভাবে, ওর পক্ষে হাটচান্দ্রায় থাকা আর সম্ভব হবে না। প্রত্যেকটি মানুষের এত ভালবাসা এবং অনুকম্পার এক কণাও ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা যে ওর নেই। এখান থেকে না-পালালে নিজের কাছে নিজে মুখ দেখাতে পারবে না আর।
হঠাৎই বিদ্যুৎচমকের মতো মনে পড়ল কথাটা। সেই কথাটাই জিজ্ঞেস করা হল না অজাইব সিংকে।
বাহাদুরকে বলল, গাড়ি ঘোরাতে।
অবাক হয়ে হঠাৎ ব্রেক করে, গাড়ি ঘুরিয়ে নিল বাহাদুর। বাহাদুর বড় সাহেবের ড্রাইভার বটে কিন্তু অজাইব-এর মতো নিখুঁত হাত নয় তার। গাড়িকে বড় কষ্ট দিয়ে গাড়ি চালায় ও। পৃথুর বাবা বলতেন, গাড়িও, ঘোড়ারই মতো। এঞ্জিনেরও প্রাণ আছে। তাকে ভালবাসিস, সেও তোকে ভালবাসবে। অজাইব সিং এই কথাটা বুঝত, যেমন বোঝে ভুচুও।
ওকে ফিরতে দেখে অবাক হল অজাইব-এর বউ।
পৃথু বলল, একটা কথা ভুলে গেছি।
গাড়ি থেকে ঘরটা কতটুকু পথ, সেটুকু; আগের দিন হলে দৌড়ে চলে যেত কিন্তু ক্রাচে ভর দিয়ে যেতে অনেকই সময় লাগল।
অজাইব সিং-এর দুচোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছিল। কতখানি তার নিজের জন্যে, আর কতখানি পৃথুর জন্যে কে জানে তা। সবটাই অজাইব সিং-এর নিজের জন্যে হলেই খুশি হত পৃথু।
করুণা কোরো না। করুণা কোরও না। মনে মনে বলেছিল ও।
হুজৌর?
অজাইব সিং, আখৃী কাম যো দিয়াথা তুমকো, ইয়াদ হ্যায়?
হুজৌর?
যেন অনেক দূর থেকে বলল অজাইব সিং। কিছুই মনে পড়ল না ওর। মাথাও কি কম কাজ করছে? কে জানে?
কিছুক্ষণ ওর মুখে তাকিয়ে থেকে পৃথু বলল, ঠিক হ্যায়। তুম আরাম করো। বলেই, বেরিয়ে আসতে যাচ্ছিল যখন, সেই সময় অজাইব সিং বলল, জি হাঁ। হাঁ হুজৌর। তালাস কিয়া থা। পড়া ইয়াদ।
মিলা নেই?
মিলাথা হুজৌর।
মিলাথা?
স্তব্ধ হয়ে গেল পৃথুর দিশেহারা ক্লান্ত হৃৎপিণ্ড।
অজাইব সিং বলল, সীওনী।
সীওনী? ও? সাওনী। মগর, পাত্তা ক্যা?
পুরা পাত্তা নেহি মিলা হুজৌর। স্রিফ সীওনী।
বহুত মেহেরবানী অজাইব সিং।
নহী হুজৌর। কুছ নহী।
তারপরই অজাইব সিং পৃথুকে বলল, হুয়াই আপকি যানা চাহিয়ে হুজৌর।
বলেই, ভাবল, ধৃষ্টতা হল।
তাড়াতাড়ি বলল, টুসুবাবাকে সাথ লেকর যানা চাহিয়ে হুজৌর। বহুতই পেয়ার হ্যায় উ বাচ্চোঁকা দিলমে, আপকো লিয়ে।
পৃথু আর কিছু না বলে, আরেকবার ওর মাথায় হাত রেখে চলে এল।
ঘরের বাইরেই একফালি উঠোন। ঘন ম্যাজেন্টা রঙা বোগোনভোলিয়া ফুটেছে। পুটোলেকার দল আগুন লাগিয়ে দিয়েছে দেওয়ালের পাশে পাশে। কে জানে হয়তো পৃথুর মালির কাছ থেকেই নিয়ে এসেছিল বীজ। ঘুঘু ডাকছে মস্ত কৃষ্ণচূড়া গাছের ছায়ায় বসে। ঘুঘুরররর্-ঘু-ঘু-র্-র্-র্-র যেখানে শৌখীন নারী, সেখানেই গাছ, সেখানেই ফুল; পাখি। পৃথুর বাড়িও এরকমই ছিল।
একদিন!
ছিল!
গাড়িটা জোরে ছুটে চলেছে। ভুচুর কাছে পৌঁছে এ গাড়ি ছেড়ে দেবে। ভুচুর কাছেই খাবে আজ দুপুরে। রাতে আজ একবার বিজ্লীর সঙ্গে দেখা করে আসবে। রাতটা তার একার। অনেককিছু ভাবার। রুষাকে চিঠি লেখার। তারপর ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে পড়বে ও এ জায়গা ছেড়ে। চোরের মতোই যাবে। অনেকদিন তো হল একই জায়গায়।
দিগা প্রায়ই একটা দোঁহা বলত তুলসীদাসের মানসমুক্তাবলী থেকে।
“মাগি মাধুকরী খাত তে সোরত গোড় পসারি
পাপ প্রতিষ্ঠা বরি পরী তাতে বাড়ী বারি”
মানে, যতদিন মাধুকরী করে খেত, ততদিনই ছিল ভাল। নিশ্চিন্তে ছিল। পা ছড়িয়ে শুত। কিন্তু এদিকে পাপময়ী প্রতিষ্ঠা বাড়ল, তাতে শুধু ঝঞ্জাটই বাড়ল। বড় বেশি নিশ্চিন্ত আরামে ছিল পৃথু এতদিন। চাকরি, গাড়ি, সুস্থতা, স্ত্রী, বাড়ি, প্রতিষ্ঠা। ভালই হল, যা হল। দিন আনবে, দিন খাবে। অঙ্গহীন, প্রেমহীন, আরামহীন, অনিশ্চিত জীবনই তো আসল জীবন। প্রতি মুহূর্তে জীবনের নতুন নতুন মানে খুঁজে পাবে। মুহূর্ত থেকে মুহূর্তে বাঁচবে এবার। জিহ্নু কৃষ্ণামূর্তির জীবনদর্শনের স্বাদ পাবে। ঈশ্বর হয়তো যা কিছুই করেন, মঙ্গলের জন্যেই। “সত্য মূল সব সুকৃত সুহাত্র।” সমস্ত সুন্দর সুকৃতের মূলই সত্যই থাকে? যা মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে তাকে জীর্ণ বস্তুর মতো ছেড়ে ফেলে তার নিজের জীবনের সত্যকে এবার দেড়খানা পায়ে হেঁটে হেঁটে খুঁজে বেড়াবে বাকি জীবন। দিগাই বলেছিল, দুঃখ কিসের? রোদ আছে, চাঁদ আছে, ফুল আছে, পাখি আছে। জীবনে এখনও অনেকই সুন্দর কিছুকে অনুভব করার, প্রত্যক্ষ করার বাকি আছে। পৃথু বলল, নিজেকে। তাই-ই তো! সেই প্রকৃত সুন্দরের ধ্যানে নিজেকে নিয়োজিত করো। একজন সামান্য নারীর দেওয়া দুঃখ অথবা অন্য একজন সামান্য নারীর কাছ থেকে প্রত্যাশার আনন্দর আকাঙক্ষার চেয়েও অনেক অনেক বড় কিছু পাওয়ার আছে জীবনে। জীবনের মূলে চলে যাও, অনুভূতির মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে।
আনন্দ। আনন্দ। আনন্দম্।
আনন্দম কথাটির প্রকৃত অর্থ এতদিনে যেন ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে তার কাছে। দাবি আর কর্তব্য আর দৈনন্দিনতার ভারে চাপা-পড়া ইট-চাঁপা ফ্যাকাশে জীবন নয়। “আকাশ ভরা সূর্য তারা বিশ্বভরা প্রাণ”-এর আভাস যেন পেতে আরম্ভ করেছে পৃগু ইতিমধ্যেই একটু একটু করে। “তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান, বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান। কান পেতেছি, চোখ মেলেছি, ধরার বুকে প্রাণ ঢেলেছি, জানার মাঝে অজানারে করেছি সন্ধান, বিস্ময়ে তাই জাগে, জাগে আমার গান…আকাশ ভরা সূর্য তারা, বিশ্বভরা প্রাণ…”
ভুচু রান্না ঘরেই ছিল। খিচুড়ি রাঁধছিল। বুকে অ্যাপ্রন লাগিয়ে। বাবুর্চির মত। ভুনি খিচুড়ি। পৃথু ভালবাসে বলে। পৃথু যেতেই বলল, আমার মন বলছে, তোমার চোখ দেখেই যে; তুমি কোনও ফন্দি আঁটছ পৃথুদা।
কিসের ফন্দি?
পালাবার ফন্দি। আমাদের সকলকে ফাঁকি দিয়ে পালাবার ফন্দি। বলল, ঠিক বলছি কিনা?
পৃথু, ক্রাচ দুটো রেখে, ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে বলল, এত ভালবাসা, এত আদর ছেড়ে পালানো কি সোজা ভুচু?
সোজা হয়তো নয়। কিন্তু তোমার অসাধ্য কিছুই নেই। তবু, তোমার তো পালিয়ে যাবার জো আছে পৃথুদা। আমাদের কথা কখনও কি ভেবেছ? তুমি না থাকলে, আমার কী হবে? আমার যে আর কেউ নেই। ছেলেবেলায় বাবা মাকে হারিয়েছি। তোমাকে পেয়ে, সব শূন্যতাই ভুলে ছিলাম। তুমিও এখন বদবুদ্ধি আঁটছ। পৃথু চুপ করে রইল। মনে মনে বলল, বহাওয়া লেগেছে তার গায়ে, পাখি কখন উড়ে যায়?
বলল, যেখানেই যাই না কেন, ঠিকানা একটা তো থাকবেই। না থাকলেই হয়তো ভাল হত। তবু, থাকবে। আর থাকলে, সেটা তোমার অজানা থাকবে না। নিজের ক্ষতি করেছি কি ভাল, সেটা এখনও জানার সময় আসেনি। তবে, তোমাদের সকলেরই যে ক্ষতি করেছি, সেটা বুঝি। এবার পামেলাকে বিয়ের কথাটা বলল। একটু গুছিয়ে বসো এবারে। অনেকদিন তো বাউণ্ডুলেপন করলে। রোজগারও কম করনি এবং করছ না।
ভুচু বলল, দাঁড়াও পৃথুদা। ফ্রিজ-এ বীয়ার রেখেছি; নিয়ে আসি। খিচুড়ির সঙ্গে বীয়ারই জমে ভাল।
বলেই, ভুচু চলে গেল।
পৃথু চলে-যাওয়া ভুচুর দিকে চেয়ে বলল, দাও। শেষ-খাওয়া খেয়ে নি। এর পরে তো ডাল-ভাতই জুটবে কিনা ঠিক নেই। এসব আর পাব কোত্থেকে? তুমি, গিরিশদা, সাবীর সাহেব, তোমরা সব অভ্যেসই খারাপ করে দিয়েছ আমার।
ফেনাসুদ্ধ বীয়ার নিয়ে এল ভুচু দুটি বীয়ার মাএ করে। একটা তেপায়া এনে রাখল পৃথুর জন্যে ইজিচেয়ারের ডানদিকে। যাতে বার বার ওকে কষ্ট করে না উঠতে হয়। নিজের বীয়ার মাগটা কোলে নিয়ে বসল চেয়ারে। মুখখামুখি।
চীয়ারস্।
ভুচু বলল।
চীয়ারস্। কিন্তু তুমি আমার কথাটা এড়িয়ে যাচ্ছ ভুচু। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার পর এ নিয়ে আমি বার তিনচার তোমার বিয়ের কথাটা ওঠালাম। তুমি অ্যাভয়েড করছ।
বিয়ে হচ্ছে। হুদার সঙ্গে নুরজেহানের। তোমাকে বলিনি। সময়মত দাওয়াও পাবে। বেচারি সাবির সাহেব হয়তো থাকবেন না ততদিন। কিন্তু আমি থাকব। আমিই তো বরকতা। আর শামীম; ন্যাচারালী, কনে-কর্তা।
এই সম্বন্ধ আবার কবে হল?
যেদিন তোমার পা হারালে তুমি, সেই রাতেই হুদা পেল নুরজেহানকে। মানে, কথা পাকা হল। জবলপুরের হোটেলে। কারও সর্বনাশ, কারও পৌষমাস। হুদা খুব ভালবাসে নুরজেহানকে।
তা না হয় হল, তোমার বিয়েটা ঠেকছে কিসে?
দাঁড়াও, মনোমত পাত্রী পাই; তবে তো! না হয়, তুমিই একটি দেখে শুনে দাও। আসলে, তোমাকে চোখের সামনে দেখে, বিয়ে করার কথাতেই, হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে আজকাল পৃথুদা। বিয়ের এত দিন পরে তোমার মতো স্বামীকেও ছেড়ে দিতে যে জাতের পাঁচ মিনিট সময় লাগে, আর যাই হোক তাদের বিয়ে করার কথা ভেবে দেখতে হয় নতুন করে। সত্যিই সাহস হয় না।
পৃথু বলল, ভুচু, তোমাকে একটা কথা বলব। রুষার সম্বন্ধে আমার আড়ালে তোমরা যা খুশি তাইই বলো; আমি শুনতে আসব না। কিন্তু আমার সামনে ওরকম করে বোলো না। একটা কথা মনে রেখো, আমি রুষাকে ভালবাসি। ওর মতো মেয়ে হয় না। দোষ, সবই আমার। সব দোষ। বিবাহিত জীবনের যোগ্য আমি নই।
অবাক চোখে তাকাল ভুচু পৃথুর দিকে কিছুক্ষণ। তারপর বলল, সরি পৃথুদা। বলেই, এক চুমুকে বীয়ার শেষ করে দিল নিজের।
বলল, দাঁড়াও। বীয়ার আনি। অনেক আছে। ভাল করে খাও তুমি। ফ্রিজ খুলতে খুলতে নিজের মনেই বলল, ভুচু, সাধে কি লোকে বলে, পাগলা ঘোষ্ষা! ভাবা যায়। একজন হারামজাদি মেয়ের জন্যে এখনও এত প্রেম! সব মেয়েই হারামজাদি।
ভুচু ফিরলে, পৃথু বলল, মেয়ে দেখার কথা উঠছে কিসে? পামেলা কি এক্ষুনি বিয়ে করতে রাজি নয়।
বীয়ারের বুড়বুড়িকাটা হলুদরঙা মা-এর গভীরে চোখ রেখে ভুচু বলল, পামেলার বিয়ে হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, শী ইজ ইন দ্যা ফ্যামিলি ওয়ে। দুমাস হল প্রোস্টও হয়েছে। আ ফার্স্ট ওয়াকার। চমকে উঠে পৃথু, সোজা হয়ে বসল। বলল কী? সে কী?
হ্যাঁ। তাইই। মনে কোরও না যে এ পৃথিবীতে তুমিই একমাত্র শকঅ্যাবজর্বার। তোমার এই চেলাও কম যায় না।
কাকে বিয়ে করল?
একজন আই এ এস ছেলেকে। ওদের স্বজাতি। মুণ্ডা। রাঁচীর কাছেই বাড়ি।
এই সাড়ে তিন মাস কি কম সময় পৃথুদা? এরই মধ্যে তো তুমি কত কিছু হারালে। ক্রীসমাস ঈভের রাতে তোমাকে হাসপাতালে রেখে আমি হোটেল থেকে অনেকই চেষ্টা করেছিলাম ট্রাঙ্ক কল-এ ওর সঙ্গে কথা বলবার। জবলপুর থেকে লাইন কিছুতেই পেলাম না। ক্রীসমাস ঈভের পার্টিতেই ওর সঙ্গে প্রথম আলাপ পামেলার। তাছাড়া আমার এই ডাকাত-ফাকাতদের সঙ্গে এনকাউন্টার, ওর পক্ষে প্রচণ্ড ডিসটার্নিং ছিল। ওর মায়েরও আপত্তি ছিল ভীষণ। কোথায় ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের বউ আর কোথায় অশিক্ষিত এক মোটর-মেকানিকের বউ। আমাকে তোমরা ভালবাসো, তোমাদেরই গুণ সেটা। সমাজে আমার দাম আর ক’ পয়সা?
পৃথু স্তব্ধ হয়ে রইল।
ভুচু বলল, আসলে, সকলে তো বাইরেটাই দেখে পৃথুদা। জেলাস ভিতর অবধি নজর চলে এমন চোখ তো সকলকে দেনও না আর ক্রাইস্ট। দিলে কি, রুবৌদি তোমাকে ফেলে ভিনোদ ইদুরকারের কাছে চলে যেতে পারত? তাঁর তুলনায় পামেলা তো অতি সাধারণ মেয়ে!
বীয়ার মাগ-এ চুমুক দিয়ে পৃথু বলল, আসলে হয়তো বেশিরভাগ মেয়েই সাধারণ। কবি-সাহিত্যিকরাই তাদের কল্পনা দিয়ে তাদের আহামরি করে তোলে। কিন্তু সে যাই হোক, তোমার এই ট্রাজেডির জন্যেও আমি দায়ী। ক্রীসমাস ঈভ-এ তুমি থাকলে, এটা হয়তো ঘটত না, ডাকাত ফাকাতের সঙ্গে জড়িয়ে না পড়লেও…
ঘটত। যা ঘটার তা ঠিকই ঘটত। সবই প্রি-ডেসিটনড পৃথুদা। তাছাড়া, বিশ্বাস করো, তোমার দুঃখই যদি তোমাকে অভিভূত না করে থাকে, তাহলে আমার এই সামান্য দুঃখ…। কোনও ব্যাপারই নয়। তাছাড়া, দুঃখই বা বলব কেন? বলব, আনন্দই। যে মেয়ের মন অত সহজে সরে যায়, তার মন তো রুষা বউদির মতো বিয়ের অনেক বছর পরও সরতে পারত। এসব কথা বরং থাক। অন্য কথা বলল। আর কী খাবে বলো? ওমলেট ভেজেছি, কড়কড়ে করে আলুভাজা, বেগুন-ভাজা আর শুকনো লংকা ভাজা। আচারও আছে সঙ্গে। লেবু আর বড় লংকার।
অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল পৃথু। জবাব দিল না কোনও।
ভুচু বলল, ভাবছ কী অত? খাও। ভাল করে বীয়ার না খেলে আমার রান্না কি মুখে দিতে পারবে?