৭৩
পূবের আকাশ সবে লাল হচ্ছে। বড়া মসজিদ থেকে ভোরের আজান ভেসে আসছে। পাতা-ঝরা এবং পাতাওয়ালা গাছেদের ডালে ডালে পাখিরা নড়ে-চড়ে বসতে শুরু করেছে কিচির মিচির করতে। সম্পূর্ণ ন্যাড়া একটি পেয়ারা গাছের মোটা ডালে একটি পুরুষ ঘুঘু ঠিক নামাজ পড়ারই মতো একবার মাথা ঝুঁকিয়ে আর একবার মাথা উঁচিয়ে সূর্যের দিকে চাইছে। যেন সত্যিই আজানের শব্দের সঙ্গে সেও নামাজই পড়ছে। বন্দেগী জানাচ্ছে খুদাতাল্লাকে এই সুন্দর হিম-হিম গ্রীষ্ম-উষাতে।
সেই আলখাল্লা-পরা বুড়োর একটি গানের প্রথম কটি কলি ক্রমশ জোর হতে-থাকা আজানের মূর্চ্ছনার সঙ্গে সঙ্গেই যেন ফুটছে পৃথুর মনে। আজই কেন? এত গান থাকতে কেন এই গান? “ওগো, দয়া দিয়ে হবে যে মোর জীবন ধুতে নইলে কি আর পারব তোমার চরণ ছুঁতে? তোমায় দিতে পূজার ডালি বেরিয়ে পড়ে সকল কালি পরাণ আমার পারি নে তাই পায়ে থুতে…
হেঁটে চলেছে পৃথু ক্রাচ-এ ভর করে। কিচিক কিচিক করে শব্দ উঠছে একটা, প্রায়-নিস্তব্ধ ভোরে। বাস স্ট্যান্ডটা গিরিশদার বাড়ি থেকে দু মাইল মতো হবে। আজই যে বেরিয়ে পড়বে ভোরে তা জানায়ওনি কাউকেই। ভেবেছিল, সাইকেল রিকশা পেয়ে যাবে। কিন্তু মোড়ে এসেই একজন আহিরের কাছে শুনল যে, কাল ঝামড়াতে কোনও রিকশাওয়ালাকে দোকানিরা মারধোর করাতে আজ সব রিকশাওয়ালা স্ট্রাইক করছে।
পিছনে পিছনে হেঁটে আসছিল ঠুঠা বাইগা। এইমাত্র বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গেল পৃথুকে পেছনে ফেলে। জীবনে প্রায় সকলেই পেছনে ফেলে গেল ওকে। পূবাকাশের লাল পটভূমিতে দু সারি শিরিষগাছের মধ্যের লালমাটির উঁচু-নিচু দোল-খাওয়া পথে সামনে সামনে যাওয়া ঠুঠা বাইগার কালো শ্যিলুট একবার ফুটে উঠছে, আবার মুছে যাচ্ছে।
কাউকে না জানিয়ে এসে ভালই করেছে। যেখানে শিকড় আলগা হয়ে গেছে সেখানে শোর তুলে চলা-ফেরা করতে নেই। ছেড়ে-যাওয়া আলগা নরম মাটিতে অন্যের থিতু হওয়া সহজ হয় তাহলে।
কাল রাতে ভুচুটা ড্রাঙ্ক হয়ে গেছিল। ওকে কখনও ড্রাঙ্ক হতে দেখেনি পৃথু। পৃথুর কথা ভেবে কি ওর বিবেক দংশন করছিল? কে জানে? বিবেকের অদৃশ্য সব সাপ বিছে কখন যে অলক্ষ্যে কাকে কামড়ায় তা অন্যর পক্ষে জানা সম্ভব নয়।
গিরিশদার গাড়িতেই ফিরেছিল পৃথু আর ঠুঠা, গিরিশদারই বাড়িতে। ভুচু তখনও ছিল। হয়তো একাই জীপ চালিয়ে ওই ফিরবে ওই অবস্থায়। নিশ্চয়ই শর্টকার্ট করবে খুপারিয়ার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। অনেকই ঘনঘন বাঁক সেই পথে। কোনও গাছের সঙ্গে মত্ত অবস্থায় ধাক্কা না লাগায়! চিন্তা হচ্ছিল ওর জন্যে। রাতে ওকে একা ওইভাবে ছাড়াটা ঠিক হয়নি। শামীমের কি আর অত খেয়াল হবে? মেয়ের বিয়ের সাতশ ঝামেলার মধ্যে?
বড় ভাল ছেলে এই ভুচু। রুষাও ভাল। একেকজন মানুষ একেক রকম ভাল, একেকরকম খারাপ। পৃথুর বাবা বলতেন: পৃথিবীতে একজনও খারাপ মানুষ নেই। “উ্য মাস্ট নো হাউ টু কালটিভেট দ্যা সানী সাইডস”। যে দিকে রোদ পড়ে, সেদিকে চাষ করলেই সোনা ফলবে।
একটি কবিতা মনে পড়ে গেল পৃথুর, ভুচু আর রুষার কথা ভাবতে ভাবতে।
“আমি তো থাকবই শুধু মাঝে মাঝে পাতা থাকবে সাদা,
এই ইচ্ছামৃত্যু আমি জেনেছি তিথির মতো…
আমি তো থাকবই তোমাদের দুঃখের অতিথি, আমি ছাড়া
দেবতার হাত থেকে কে খুলে পড়বে চিঠি,
কার রক্তের আদেশে মালা হয়ে উঠবে ফুল?
আমি দিয়ে যাব তোমাদের সঙ্গোপন গন্ধর্ব বিবাহ;
এই স্বেচ্ছামৃত্যু আমি নিজেই চেয়েছি।”
সমরেন্দ্র সেনগুপ্তর কবিতা।
রুষা এখন কী করছে কে জানে? ঘুম থেকে ওঠেনি বোধ হয়। দেরি করে ওঠে ও। বড় কষ্ট হয় রুষার জন্যে। সব মেয়েরা যা চায়, রুষাও তাইই চেয়েছিল ওর কাছ থেকে। একটু যত্ন, আদর, ভালবাসা, সাহচর্য। সব মেয়েরাই চায় স্বামী তাদের প্যাস্নার করুক। দু বাহু দিয়ে পৃথিবীর সব দুঃখ কষ্ট ধুলো-বালি থেকে তাদের ঢেকে রাখুক, সুগন্ধি বালাপোষের মতো। জানে পৃথু। ও একটি বাজে লোক। সারাজীবন যা করতে চাইল তা করতে পারল না। মন যা বলতে চাইল মুখ বলে এল ঠিক তার উল্টোটা। নিজেকে বড় বেশি ভালবেসে এসেছে ও চিরদিন। রুষার কাছ থেকে ছিন্নমূল হয়ে অজানা গন্তব্য ভেসে যেতে যেতে ভাবছিল যে নিজেকে একটু কম ভালবেসে রুষাকে একটু বেশি ভালবাসলে ওর জীবন হয়তো আজকের মতো হত না। রুষার মধ্যেও কুর্চি ছিল, যেমন কুর্চির মধ্যে রুষা আছে। বাইরের নির্মোক ছিঁড়ে, নিজের আমিত্বকে নতজানু করে রুষার কাছে পৌঁছতে পারল না বলেই রুষা আমিত্ব নিয়ে দূরে সরে গেল। হয়তো একদিন কুর্চিও যাবে। ‘আমিত্ব’ ছাড়া মানুষ হয় না অথচ আমিত্বকে অন্যর মধ্যে লীন করে দেবার মতো বড় মনুষ্যত্ব আর কিছুই নেই। বড় দেরি করে বুঝল ও এ কথাটা। সময়ের মধ্যে সময়ানুগ না হতে পারলে সব প্রাপ্তিই তামাদি হয়ে যায়। প্রত্যেক মানুষই তার নিজস্বতার জন্যেই সবচেয়ে বেশি দুঃখ পায়। অথচ মানুষ বলেই নিজস্বতা হারিয়ে নিঃস্ব হবার কথা একজন আধুনিক, শিক্ষিত মানুষ ভাবতে পর্যন্ত পারে না। বড় গোলমেলে: ধাঁধাঁর এই জীবন।
ঠুঠা বাইগা আগে আগে চলেছে। স্যাঙ্কো পানজা এগিয়ে গেছে অনেকটাই, ডন কীয়টে (Quixot) অফ লা মাঞ্চাকে ফেলে। সঙ্গে রোসিনান্তেও নেই। ক্রাচে ভর করে চলেছে কীয়টে।
কুর্চি, কী লিখেছিল চিঠিতে, কে জানে?
এখন সময় নেই। বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে, তারপরই কোথাকার বাস ধরবে তা ঠিক করবে। সীওনীতে কি যেতেই হবে? যদি অন্য কিছু লিখে থাকে কুর্চি? বিশ্বাস নেই। এখন কোনও মানুষকেই বিশ্বাস নেই। অথচ বিশ্বাস ছাড়া বেঁচেও থাকা যায় না!
ভোরের বাতাস, দ্রুত উড়ে-যাওয়া টিয়ার ঝাঁকের চাবুকের মতো ডাকে চমকে উঠে, পৃথুকে শুধোল, পৃথু ঘোষ? কে তুমি? তুমি কি বেঁচে আছ? চলেছ কোথায়? কোথায় যাবার ছিল?
জানি না। বিশ্বাস করো ভোরের বাতাস, সত্যিই জানি না। শুধু শিকড় আলগা করে ভাসিয়েই দিলাম নিজেকে।
দেখি…।
রাত-জাগা পৃথুর মুখ এক স্বর্গীয় হাসিতে ভরে উঠল। সেই মুখে ভোরের নরম রোদ এসে পড়েছিল। অনেকদিন না-কাটা চুল নেমে এসেছিল কপালে।
পামেলাদের চার্চ-এ ও যখন ভুচুর সঙ্গে প্রায়ই যেত তখন একটি গান বড় ভাল লাগত পৃথুর। রেসেশানাল হীমস থেকে গাইত পামেলা, নানদের সঙ্গে।
“It takes courage to answer a call,
It takes courage to give your all,
It takes courage to risk your name,
It takes courage to be true….
………………………………………………………………
To be ready to stake for another man’s sake,
It takes courage to be true…..”
আগে-আগে হেঁটে যাওয়া প্রাগৈতিহাসিক ঠুঠা বাইগা বনের জন্তুর মতো একটা আওয়াজ করে তার গলিত আঙুলের ডান হাতের অতি দ্রুত এক ভঙ্গিতে বোঝাল যে, আরও তাড়াতাড়ি হাঁটতে হবে। নইলে সীওনীর বাস ছেড়ে যাবে।
পৃথু নিজেকে বলল, সীওনীতেই যে যাবেই তার কোনও স্থিরতা নেই।
যত তাড়াতাড়ি পারে, চলতে লাগল পৃথু। ক্রাচ আঁকড়ে-থাকা দুটি হাত আর দু কাঁধের মধ্যে তার ঝুঁকানো মাথা নামিয়ে দিয়ে। বড়ই সাধ ছিল ওর যে বড় বাঘের মতো বাঁচবে এ জীবনে; স্বরাট সম্রাট হয়ে। হল না। হবে না।
কোনও নাজুক মানুষের পক্ষেই বড় বাঘের মতো বাঁচা সম্ভব হয় না। শুধুমাত্র বড় বাঘই অমন স্বনির্ভর বাঁচা বাঁচতে পারে, স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে। পৃথুরই মতো, প্রত্যেক সাধারণ পুরুষ ও নারীকে জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি অগণিত নারী, পুরুষ ও শিশুর হৃদয়ের এবং শরীরেরও দোরে দোরে হাত পেতে, ঘুরে ঘুরেই বেঁচে থাকতে হয়। প্রীতি, প্রেম, কাম, অপত্য, ভক্তি, শ্রদ্ধা, ঘৃণা, বৈরিতা, ক্রোধ, সমবেদনা এবং এমনকি ঔদাসীন্যরও বোধগুলিকে দেওয়ালির রাতের অসংখ্য প্রদীপের কম্পমান শিখারই মতো অনুভূতির দ্বিধাগ্রস্ত আঙুলে ছুঁয়ে ছুঁয়ে জীবনকে পরিক্রম করে যেতে হয়। এই পরিক্রমারই আরেক নামই কি মাধুকরী?
ঠুঠা বাইগা ঘুরে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে আবারও উৎকট একটা শব্দ করে তাড়া দিল পৃথুকে।
ও ঠুঠার দিকে ক্লিষ্ট মুখ তুলে, ক্রাচ দুটিকে আরও জোরে চেপে ধরে; গতি দ্রুততর করল। নিঃশব্দে বলল, অত তাড়া কোরো না ঠুঠা। পথে চলতে বড় লাগে।
চলতে বড়ই লাগে।
***