2 of 2

৭২. ভুচু চান-টান করে অপেক্ষা করছিল

৭২

ভুচু চান-টান করে অপেক্ষা করছিল উদ্বিগ্ন হয়ে। গেল কোথায় খোঁড়া মানুষটা?

ফিরতে দেখেই বলল, কোথায় গেছিলে তুমি? সাতসকালে? না বলে কয়ে? রীতিমত চিন্তায়ই ফেলে দিয়েছিলে।

গেছিলাম, সাবীর সাহেবের কবরে।

আমাকে বললে না কেন? এতখানি পথ হেঁটে গেলে?

কিছু কিছু জায়গাতে তো শুধুমাত্র হেঁটেই যেতে হয় ভুচু! কী একটা হিন্দি ছবির সেই গান ছিল না? ‘সজনরে ঝুঠ মত বোলো, খুদাহকি পাস যানা হ্যায়, না হাতি হ্যায় না ঘোড়া হ্যায়, হুঁয়া তো পায়দলহি যানা”

“ঝুঠ মত বোলো’ কথাটা ভুচুকে একটু বিচলিত করল। ত্রস্ত চোখে চাইল পৃথুর মুখে। পৃথুর কথাটা যে দ্ব্যর্থক সেটুকু বুঝল। কিন্তু দুটি অর্থের কোনওটাই প্রাঞ্জল হল না ওর কাছে।

কী খাবে বলো নাস্তায়?

অনেকদিন তোমার হাতের চিঁড়ের পোলাও খাইনি। খাওয়াবে? আর লাড্ডুর দোকানের রাবড়ি। আছে কেমন সে?

কেমন আর থাকবে? বলির পাঁঠার মতো। বিয়ের তারিখ তো এগিয়ে আসছে। আজ রাতে তো দেখা হবেই নূরজেহান আর হুদার বিয়েতে। খুব বড় ম্যায়ফিল বসাবে ও। ভোপাল থেকে নামী উস্তাদ, উজ্জ্বয়িন থেকে হুরী-পরী বাইজি আনাবে। তুমি ওর বিয়েতে না থাকলে ও কিন্তু খুব দুঃখ পাবে।

তোমার বিয়েতে যদি আমি না থাকি তাহলে তুমিও কি দুঃখ পাবে? না কি, আনন্দিত হবে?

হঠাৎই বলল পৃথু দুম করে। বোমার মতো আওয়াজ হল কথাটাতে ভুচুর কানে। ও বলল, তোমার কথার আজকাল কোনও মাথামুণ্ডু নেই। এবারে চান করে এসো। চিঁড়ের পোলাও বানিয়ে ফেলছি। লাড্ডুর দোকানে পাঠাচ্ছি কাউকে রাবড়ির জন্যে। দুপুরে কোথায় খাবে? তোমার বাড়িতেই নিশ্চয়ই?

আমার বাড়ি? আমার তো কোনও বাড়ি নেই ভুচু।

তোমার এই হেঁয়ালি সব সময় ভাল লাগে না পৃথুদা। তুমি তো এ রকম ছিলে না!

তুমিও কি এরকম ছিলে? হেসে বলল, পৃথু। তাছাড়া, এর মধ্যে হেঁয়ালিটা কী দেখলে? হাটচান্দ্রার চামারটোলির রুষা সেনের বাড়ি নিশ্চয়ই আমার বাড়ি নয়।

তবে, তোমার বাড়ি কোথায়? সীওনীতে?

নাঃ। সেখানেও নয়।

তবে?

আমার বাড়ি স্বপ্নে আছে। এ জীবনে স্বপ্নেই থাকবে। ‘বাড়ি’ বলতে যা বোঝায় তা থাকার মতো যোগ্যতা নিয়ে যে এই জন্মে এখানে আসিনি।

তোমার স্বপ্নের বাড়িটার রকমটা কেমন?

বিদ্রূপের গলায় বলল, ভুচু। বলেই বলল, তুমি অনেকই বদলে গেছ পৃথুদা, কিছুদিন হল।

হাসি-হাসি মুখেই পৃথু বলল, ভাগ্যিস বদলে যাই আমরা।

আমরা মানে?

মানে, আমি, তুমি, আমরা সকলেই। বদলের আরেক নামই তো বেঁচে থাকা। তাই না? নিজেকে যে নবীকৃত করতে না পারে প্রতি মুহূর্ত, সে তো থেমেই আছে। চলা থামলে, না বদলালে; থাকা-না-থাকা সমান।

ভুচুর মুখে বিদ্রূপের হাসিটা তখনও কৃষ্ণপক্ষর শেষ রাতের চাঁদের মতো পুরু ঠোঁট দুটি থেকে ঝুলে ছিল। বলল, তোমার জীবনটা, তোমার কথা আর তোমার কাজ বড়ই বেশি গোলমেলে। একটা জীবনে তুমি আঁটলে না। অথচ জীবন তো সব মানুষেরই একটাই!

ঠিক। ঠিকই বলেছ তুমি। এই একটিমাত্র রঙচঙে ঝলমলে যাত্রার পোশাকেরই মতো জীবনকে যারা অনুক্ষণ গায়ে চড়িয়ে না রাখতে পারে, হয় তারা জীবনে আঁটে না, নয় জীবন তাদের গায়ে আঁটে না।

তুমি? তুমি কি সুপারম্যান?

ভুচু বলল, একই সুরে।

না। আমি লেসারম্যান। অনেকগুলো জামা আমার। যখন যেটা খুশি পরি। কিন্তু তুমি যেহেতু বয়সে ছোট, খুব দেখেশুনে পা ফেলো। আমারই মতো নষ্ট হয়ে যাবে তা না হলে। অনেকগুলো জামা পরতে গিয়ে শেষে জীবনের বাদল-দিনে পৌঁছে উদলা গায়ে থেকো না। তোমার মধ্যে আইডিয়াল হাজব্যান্ডের সব এলিমেন্টসই আছে। যাকে ভাল লাগে তাকে বিয়ে করো, ঘরসংসার করো, সুখী হও। তোমার সুখের পথে কোনওই বাধা আসবে না। তবে বিয়ের পর আমার মতো ডিস্টার্বিং ডিসরাপটিভ মানুষের সঙ্গে আর কোনও সংস্রব রেখো না। আমার মধ্যে শুধু নিজেকে নষ্ট করার প্রবণতাই নেই, আমার কাছাকাছি যারা থাকে তাদেরও নষ্ট করে দিই আমি অজানিতে। আবার বলছি ভুচু, এবার বিয়ে করো, যাকে পছন্দ তোমার তাকেই…নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দেব আমি।

কাকে পছন্দ আমার?

প্রায় ধরা-পড়া, কম্পমান গলায় ভুচু বলল।

তা আমি কী করে জানব? কখন যে কার কাকে ভাল লেগে যায় তা কে বলতে পারে? মানুষের মন বলে কথা! যাই। চানটা করেই আসি।

চান করতে করতে বাথরুমের ক্লোজেটটা খুলে লুকিয়ে যেন পরস্ত্রীকেই দেখছে, এমন করে রুষার ফোটোটি দেখল আরও একবার। সত্যি! রুষার মতো সুন্দরী লক্ষে মেলে। কী ব্যক্তিত্ব! শারীরিক সৌন্দর্য অনেক বোকা-বোকা মেয়েদেরও থাকে। রুষা, রুষাই; ক্লিওপেট্রার মতো।

ঠুঠা বাইগা এল ভুচুর রান্নাঘরে, গিরিশদার বাড়ি থেকে তার চিঠি হাতে করে। ভুচু চিঠিটা খুলে দেখল গিরিশদা লিখেছেন পৃথুকে, ব্রাদার! যদি তুমি দুপুরে অন্যত্র না খাও, তবে আমার সঙ্গেই খাবে। ঠুঠাকেও নিয়ে আসবে। রাতে সকলে এখান থেকেই নুরজেহানের শাদিতে যাওয়া যাবেখন।

কাল রাতে খুবই জমেছিল। তুমি থেকে গেলেই পারতে! আমার কবিতা পড়ে সকলে অভিভূত!—ওলওয়েজ ইওরস। গিরিশদা।

ইডিয়ট।

মনে মনে বলল ভুচু। পৃথুদা এতদিন পরে এসেছে, কী করে ভাবলেন গিরিশদা যে, রুষা বৌদির ওখানে খাবে না সে? তাছাড়া রুষা বৌদি আর পৃথুদার সম্পর্ক কি মোড় নেয় না নেয় তার উপর নির্ভর করছে ভুচুর সমস্ত জীবন। পৃথুদা কি থেকেই যাবে এখানে? ইসস, কী যে কষ্ট ভুচুর! কেন যে এমন হল! কী যে হল! ছিঃ ছিঃ! কোনও সুস্থ মানুষ ইচ্ছে করে এমন অসুস্থ হয়! ভুচুর মতো!

চান করে উঠে বাইরে এসে যখন জামাকাপড় পরছে তখন পৃথুর পাঞ্জাবির বুকপকেট থেকে হঠাৎ কুর্চির চিঠিটা মেঝেতে পড়ে গেল।

ভুচু বলল, কী যেন পড়ে গেল।

কুর্চির চিঠি।

এখানে লিখেছেন মিসেস রায়?

না সীওনীতে বাসে ওঠার আগেই পাঠিয়েছিল।

পড়লে না?

তাড়া কিসের? পড়া যাবে ধীরেসুস্থে। সবাই তো রুষা নয়। অন্য মেয়েরা কি লিখবে তার আন্দাজ পাওয়া যায়ই।

ভুচুর খুব ইচ্ছে করল চিঠিটা চুরি করে পড়ে। তাহলে জানা যেত কুর্চি আর পৃথুদার সম্পর্কটা কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। এবং তা থেকে রুষার সঙ্গে সম্পর্কটা অনুমান করাও সহজ হত।

নাস্তায় বসল ওরা। ঠুঠাকেও ডাকল পৃথু।

ঠুঠা একটা সংক্ষিপ্ত আওয়াজের ও তার কুৎসিত মুখের প্রসন্ন ভঙ্গিমার মাধ্যমে বুঝিয়ে দিল যে, সে ডাটকে নাস্তা করেই এসেছে। ভুখ নেই।

খেতে বসে আর বিশেষ কথা হল না দুজনের। দুজনেই নিজের নিজের ভাবনাতে বুঁদ ছিল। পৃথু মাঝে মাঝে চাইছিল ভুচুর মুখে। প্রেম, ভুচুকে এক দৃপ্ত ঔজ্জ্বল্য দান করেছে। কখনও কখনও অন্ধকারও দেয় প্রেম, যখন গভীরে গড়িয়ে যায়; চোখের নীচে কালি পড়ে তখন; গোলাপি আভা মরে গিয়ে। খুব মজা লাগছিল পৃথুর। কিছুদিন আগে পর্যন্ত এই ভুচুই পৃথুর জন্যে নিজেকে মেরেও ফেলতে পারত। এমন সখা, এমন বন্ধু, এমন মহৎ ছেলে আর দেখল কই! কিন্তু যেই স্বার্থ এল, এল স্বার্থর সংঘাত অমনি এতদিনের সম্পর্ক কী রকম উল্টেপাল্টে গেল। স্বার্থর রোদ লাগলেই জবরদস্ত দোস্তিও আইসক্রীমেরই মতো গলে যায়। দোস্ত-এর সঙ্গে এই যুদ্ধ পরিহার করে যে হেরে গেছে বলে সরে আসতে পারে সেই-ই বোধহয় প্রকৃত দোস্ত। পারবে কি পৃথু? সাধারণ পৃথু ঘোষ কি পারবে অসাধারণ হতে? পৃথু অনেকই সয়েছে। হয়তো আরও সইতে পারবে। কিন্তু বেচারি ভুচু বড় ছেলেমানুষ। বড়ই বঞ্চিত শিশুকাল থেকেই। এ ভেঙেই যাবে হয়তো। সুখী হোক ভুচু। সুখী হোক।

হঠাৎই প্লেট থেকে মুখ তুলে ভুচু বলল, আচ্ছা পৃথুদা! বিয়ে ব্যাপারটা সম্বন্ধে তোমার ধারণাটা কী?

হঠাৎ এই প্রশ্ন? বিয়ে মানে? তোমার বিয়ে?

আঃ। আই মীন, বিয়ে ইন জেনারাল।

সে সব পণ্ডিতেরাই বলতে পারবেন। তোমাদের খ্রিস্টান ধর্মের কথা আমি জানি না। তবে জানি যে, আমাদের শ্বেতকেতুই প্রথম নাকি বিবাহ-প্রথা চালু করেছিলেন।

তিনি আবার কে?

উদ্দালক বলে এক ঋষি ছিলেন, তাঁরই ছেলে।

হঠাৎই শ্বেতকেতু? কী কারণে?

কারণ একটা ছিল। শ্বেতকেতু যখন শিশু তখন একদিন তিনি দেখলেন যে, তাঁর মাকে আরেকজন ব্রাহ্মণ এসে নিয়ে চলে গেলেন। অবাক হয়ে তিনি বাবা উদ্দালককে জিজ্ঞেস করাতে, উদ্দালক বললেন, বৎস! নারী আর গাভীতে তো সকলেরই সমান অধিকার। যে-কেউই যে-কোনও নারীকে নিয়ে গিয়ে সহবাস করতে পারেন। শ্বেতকেতু গাভীরই মতো তাঁর মায়ের এক অপরিচিত মানুষের সঙ্গে অমনভাবে স্থানান্তরে চলে যাওয়াতে খুবই মর্মাহত হলেন। বড় হয়ে তাই উনিই বিবাহ প্রথা চালু করলেন। সেদিন থেকে নারীর কৌমার্য দলিত করার অধিকার শুধুমাত্র পতিতেই বর্তাল। বিবাহ অনুষ্ঠানেরও চল হল।

মানে, সেদিন থেকেই এক নারী এবং এক পুরুষের কনসেপ্ট চালু হল বলছ?

তা হল, কিন্তু পুরোটা শোনোই। এই শ্বেতকেতুই পরবর্তী জীবনে নন্দীর হাজার অধ্যায়ের কামশাস্ত্রকে ছোট করে পাঁচশ অধ্যায়ের একটি কামশাস্ত্র রচনা করলেন।

তোমাদের এই শ্বেতকেতু কি কোনও কাল্পনিক মানুষ? মীথিকাল কেউ?

ইন্টারাপ্ট করল ভুচু।

না, না। কাল্পনিক চরিত্র নন। আমাদের তৈত্তিরীয়সংহিতা, উপনিষদের ছান্দোগ্যোপনিষৎ এবং বৃহদারণ্যকোপনিষৎও এই শ্বেতকেতুর উল্লেখ করেছেন। মজাটা হল এই-ই যে, নারীর চরিত্র যাতে নির্মল এবং অকলুষিত থাকে সে জন্যে এক নারীকে এক পুরুষের সঙ্গেই আজীবন বাঁধা থাকতে বলা হল কিন্তু যে কটি কামশাস্ত্র রচিত হল তার সবকটিতেই একটি করে অধ্যায় যুক্ত হল, তাতে পুরুষ কোন প্রক্রিয়ায় অন্যর স্ত্রীকে বশে এনে তার সঙ্গে সহবাস করতে পারে তারই বিস্তারিত প্রেসক্রিপশন থাকল। কোনও কামশাস্ত্র সেই বিশেষ অধ্যায়ের নাম দিল ‘পারদারিক’। আমাদের বাৎস্যায়নের কামশাস্ত্র তার নাম দিল “পরদারিকাধিরণস্য”। মানে, পরের স্ত্রীকে অধিকার করার কায়দাকানুনের ফিরিস্তি আর কী!

ভুচুকে একটু চঞ্চল দেখাল। হঠাৎ বলল, পৃথুদা, তুমি চা না কফি?

মজা পেল পৃথু। গীলটি-কনসাস ভুচুর দিকে চেয়ে।

বলল, কফি। কিন্তু তুমিও পড়েছ না কি বাৎস্যায়ন?

রেগে গেল ভুচু। বলল, যা বলছিলে বলো না। শেষ করো।

ব্যাপারটা কী দাঁড়াল দেখো। প্রত্যেক পুরুষ তার নিজের স্ত্রীকে সতী-সাধ্বী থাকতে বলল। সমাজও তাই বলল। টিকিওয়ালা পেটমোটা পণ্ডিতেরা, সামান্য এদিক ওদিক হলেই নারীদের ‘অসতী’, ‘কুলটা’ এসব বলে তাদের জন্যে সবরকম সম্ভাব্য এবং অসম্ভাব্য শাস্তির বিধান দিল এবং সেই সমাজপতিরাই পুরুষদের ‘পারদারিকাধিকরণস্য’ সম্বন্ধে প্রবল উৎসাহে কখনও বাধা দিল না। হিন্দু পুরুষদের ভণ্ডামির এতবড় প্রমাণ আর কিছুই হতে পারে না বোধ হয়।

প্রত্যেক পুরুষই হয়তো পলিগ্যামাস। বেশিরভাগ স্বাভাবিক স্বাস্থ্যবান পুরুষমাত্রই হয়তো তার রক্তের মধ্যে বহুচারণার প্রবৃত্তি নিয়েই জন্মায়। এক নারীতে কোনওদিনই সে সন্তুষ্ট নয়।

ভুচু বলল।

অথচ মেয়েদের কথাটা কেউ ভাবল না পর্যন্ত?

পৃথু বলল, এখন সময় এসেছে কোনও মহিলার কামশাস্ত্র লেখার। তাতে পরপুরুষ শিকারের প্রেসক্রিপশন থাকবে।

ভুচু হেসে বলল, তুমি হিন্দুদেরই দোষ দিচ্ছ আর মুসলমানেরা? তাদের ধর্মই তো বিধান দিচ্ছে পুরুষের এই স্বাভাবিক প্রবৃত্তিকে স্বীকার করে নিয়েই। আমাদের সাবীর সাহেব, শামীম, মৌলভী গিয়াসুদ্দিন এদের সকলেরই তো একাধিক স্ত্রী আছে।

পৃথু বলল, তা আছে। কিন্তু তারা তো হিন্দুদের মতো ভণ্ড নয়। কোরানের ফরমান মেনেই হয়তো ভোগ করেন তাঁরা। তাঁরা সম্মানের। তবে চুরি করে, ঘোমটার তলায় খেমটা নাচ দেখার দরকার হয় না মুসলমানদের। পরস্ত্রীর দিকে হাত না বাড়িয়ে নিজে একাধিক বিয়ে করাটাই তো’ অনেক শান্তির। এবং শাস্ত্রসম্মত। যে ব্যক্তিগত আইন বা সামাজিক প্রথাকে যথেষ্ট সম্মান দেখানো না যায়, বা যা পুরোপুরি মানা না যায়; তা রেখে লাভ কী? আমাদের বিয়ের কনসেপ্টটাকে আগাগোড়া খতিয়ে দেখে এর খোল-নলচে পাল্টাবার দিন এসে গেছে বলে মনে হয়। যত শাস্তি, যত কুৎসা আজকেও ওই পুরুষশাসিত সমাজে মেয়েদেরই মাথা পেতে নিতে হয়। মহান, পবিত্র পুরুষদের গায়ে কোনও কলঙ্কই লাগে না। এই সমাজে রুষা সেনরাই চিরদিন কলঙ্কিনী হয় আর পৃথু ঘোষরা নির্দোষ। সমাজের সব সমবেদনা থাকে তারই দিকে। তাই-ই না?

এমন সময় রামচন্দর রাবড়ি না পেয়ে ফিরে এল। এসেই ঘরে ঢুকে বলল, দশটার পরে গেলে পাওয়া যাবে।

ভুচু বলল, পাঠিও কাউকে দশটার পরেই। ভুলে যেও না আবার। খেতে চেয়েছেন পৃথুদা, খাওয়াতে হবেই।

রামনন্দর চলে গেলে ভুচু বলল, তুমি এত কথা বললে বটে পৃথুদা, কিন্তু “অ্যাফেয়ার” তো কখনও একজনের হয় না। তাতে একজন পুরুষ এবং একজন নারীর দরকার হবেই। পরস্ত্রী রাজি হলে তবেই না পরপুরুষ অ্যাফেয়ার করতে পারে? কথায়ই বলে “যব মিঞা বিবি রাজী তব কেয়া করে কাজি?”

তা ঠিক। কিন্তু আমি বলছিলাম অন্য কথা। মেয়েদেরও যে কিছু চাওয়ার আছে, তারাও যে মানুষ, তারাও যে, যে-কোনও একজন পুরুষের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে বলেই সারাজীবন তাকেই দেবতাজ্ঞানে পুজো করে জীবন কাটিয়ে দেবে, চোখ বন্ধ করে রাখবে তার স্বামীর চেয়ে সুন্দর শরীর অথবা সুন্দর স্বভাবের অথবা বেশি গুণের কোনও পুরুষকে দেখবে না বলে; নাক বন্ধ করে রাখবে ফুলের আর ধূপের সুবাস যেন নাকে না আসে? কান বন্ধ করে রাখবে যাতে পরপুরুষের গলার স্বর কানে মিষ্টি না লাগে? এটাই বা কোন নিয়ম?

কফি খাও পৃথুদা। ঠাণ্ডা হয়ে গেল। ভুচু বলল। জানতে চাইলাম বিয়ের কথা। আর তুমি কত জ্ঞানই না দিয়ে দিলে!

এই জ্ঞান দেওয়াটাই হচ্ছে সেনিলিটির লক্ষণ। কেউ কেউ অল্প বয়সেই সেনাইল হয়ে যায় আমার মতো।

এতদিন পরে হাটচান্দ্রায় ফিরে কোথায় এতক্ষণে নিজের বাড়িতে গিয়ে…তা না, কালকে কবি সম্মেলন থেকে পালিয়ে এসে আজ ভোরে ধর্ম-সম্মেলন বসালে তুমি। অজীব আদমী বটে।

কফিতে চুমুক দিয়ে পৃথু বলল, জানো ভুচু, ধর্মের কথাই যখন বললে তখন বলব যে এই পুরনো পৃথিবীতে এক নতুন ধর্মর সূচনা করার দিন এসে গেছে অনেকদিনই। সে ধর্মে বিত্ত দিয়ে ভেদ সৃষ্টি করা যাবে না মানুষের মধ্যে মানুষের, গায়ের রং দিয়েও যাবে না, প্রত্যেক নারী ও পুরুষ যে ধর্মে সমান মান মর্যাদা সুখ এবং স্বাধীনতা পাবে।

তুমিই কি তাহলে এই নতুন ধর্মর স্রষ্টা হবে?

ঠাট্টার গলায় বলল ভুচু।

আমি কে? স্রষ্টারা আসছে। ওই টুসুদের প্রজন্ম। ওরা আমাদের কাউকেই ক্ষমা করবে না এই ভান-ভণ্ডামির জন্য। সব উড়িয়ে পুড়িয়ে দেবে। এখনও যাদের বয়স পনেরোর চেয়ে কম, তুমি দেখো, তারাই আমাদের সব মুখোশ ছিঁড়ে দেবে। মানুষকে, মানুষের মতো সুস্থ, স্বাভাবিক, সুখী হয়ে বাঁচতে বলবে ওরা এই একটামাত্র জীবনে। আমাদের বারুদ আর অ্যাটমের গোরস্থানে ওরাই সাদা ফুল ফুটোবে।

একসময় বলল, নাও সিগারেট খাও একটা।

চলো এবার উঠি। তোমার বাড়িতে যাব তো এবারে? দশটা বাজতে চলল।

ভুচু বলল।

বাড়ি নেই। তবে যাব। রুষার কাছে। চলো যাই। মিলিটাকেও দেখিনি অনেকদিন।

আমি? আমি কী করতে যাব? তোমাদের কত কনফিডেন্সিয়াল কথা থাকবে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে। কাবাবমে হাড্ডি হবার কোনও ইচ্ছেই আমার নেই।

পৃথু একবার তাকাল ভুচুর দিকে। তারপর কী ভেবে বলল, আচ্ছা!

বলেই এগোল।

দাঁড়াও, দাঁড়াও। গাড়ি নিয়ে যাও। কাউকে দিয়ে দিচ্ছি, চালিয়ে নিয়ে যাবে। দুপুরের প্রোগ্রাম তাকে দিয়েই আমাকে জানিয়ে দিও। নইলে, ওদিকে সে বুড়ো হাঁচোর-পাঁচোড় করে মরবে। গাড়িটা সারাদিনই সঙ্গে রেখো। ছেড়ে দিও না। গাড়ি ছাড়া চলে?

সব ছাড়াই চলে যায় ভুচু। জীপ ছাড়া চলে, রুষা ছাড়া চলে, এমনকী ভুচু ছাড়াও চলে। প্রথম প্রথম কষ্ট হয়, হবে হয়তো একটু। এই-ই যা! তারপর আর মনেই হবে না যে জীবন কিছু অন্যরকম ছিল। মানুষের মতো মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন জানোয়ার বিধাতা আর তো বানাননি। বোধহয় একমাত্র আরশোলা ছাড়া।

সবাই-ই তো আর তুমি নয়। ভুচু বলল। একটা ট্রান্সপোর্টের খুবই দরকার কিন্তু রুষা বৌদির। বড়ই অসুবিধে হয় ওঁর? এত বছরের অভ্যেস। তুমি কী বলো? একটা গাড়ির বন্দোবস্ত করে দিই? গারাজেই তো পড়ে আছে একটা অ্যাম্বাসাডর। সিক্সটি-ফাইভ মডেলের। অ্যাক্সিডেন্টের গাড়ি কিনে বানিয়ে নিয়েছিলাম। সাজিয়েও নিয়েছি। সাদা রং-এ। ঘড়ি আছে। ক্যাসেট-প্লেয়ার।

পৃথু, দাঁড়িয়ে পড়ে ভুচুর চোখে সোজা তাকিয়ে বলল, রুষাকে তুমি খুবই ভালবাসো, না ভুচু? ব্যাপারটা অতি-সম্প্রতিই ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে। তাই-ই না? ভালবাসা, অবশ্য এমন হঠাৎই হয়ে যায়। করোনারি অ্যাটাকের মতো।

পৃথুর সোজা অথচ দরদী দৃষ্টি থেকে ভুচু চোখ নামিয়ে নিল।

বলল, তুমি বড় মীন পৃথুদা। রুষা বৌদি তোমার স্ত্রী। তোমাকে এত ভালবাসি আর তাকে ভালবাসব না?

পৃথু ওর মুখের ভাব লক্ষ্য করে হেসে ফেলল।

বলল, তাহলে দিও গাড়িটা। পৃথুদার বউ বলে কথা! রুষার কষ্ট তো নিশ্চয়ই হয় গাড়ি ছাড়া! কিন্তু ওর গাড়ি নেই বলে তোমার যে কষ্ট, তা আরও বেশি। ইডিয়ট! একেই ভালবাসা বলে। একমাত্র ভালবাসাই মানুষের নিজের কষ্টর চেয়েও পরের কষ্টর জন্যে বেশি দুঃখিত করতে পারে তাকে।

ভুচু ধরা-পড়া মুখটি অন্যদিকে ফিরিয়ে বলল, তোমার মতো অত বুঝি না আমি।

ভুচুর নির্দেশে একজন লোক একটি সাদা অ্যাম্বাসাডর গাড়ি ভিতর থেকে বের করে নিয়ে এল। পৃথু ঠুঠাকে ডাকল। ঠুঠা মাথা নাড়ল। অমানুষিক শব্দ করল আবার।

ভুচু বলল, ও আর আমি শামীমের বাড়ি যাব। কাজ আছে অনেক। ডেকরেটর কাল রাত থেকেই কাজ করছে। মধ্যপ্রদেশ বিড়ি ফ্যাক্টরীর মাঠটা পেয়েছে শামীম। প্রায় দুশো লোক হবে তো। মস্ত শামিয়ানা হচ্ছে।

এত লোককে খাওয়াচ্ছে কী করে শামীম?

ও কোত্থেকে খাওয়াবে? গরীব মানুষ! খাওয়াচ্ছি আমিই। বরকর্তা না কি বলো না তোমরা? আমি তো তাই-ই!

আমাকে একবার সোনা-চাঁদির দোকানেও যেতে হবে ভুচু। ভুলেই গেছিলাম। বলে, গাড়িতে উঠল পৃথু। ভুচু বলল, লছমন শাহুর দোকানেই যেও। ওর কাছে নূরজেহানের হাতের ও গোড়ালির মাপ আছে।

কথাটা শুনে হাসি পেল পৃথুর। নুরজেহানকে হুদার খাটে হামাগুড়ি দিয়ে পাঠাবার কোনও ইচ্ছা ওর নেই।

শালবনটার পাশ দিয়ে গাড়িটা যাচ্ছে এখন। পেরিয়ে গেল বনের মধ্যেই সেই কুয়োটা, যার সামনে টুসু একদিন আত্মহত্যা করতে গেছিল। তারপর দূর থেকে বাড়িটাও দেখা গেল। এই বাড়িতেই কাটিয়েছিল এতগুলো বছর? রোজই এই বাড়ির দরজা দিয়ে বেরিয়ে আবার এতেই এসে ঢুকত? চেনা দৃশ্য, চেনা গন্ধ, সকাল থেকে রাত? অথচ আজ মনে হচ্ছে এ যেন অসংখ্য পরিচিত জনেরই একজনের বাড়ি। বিশেষ কোনও টান অনুভব করল না। কোনও বিশেষ দাবীও নয়।

গাড়ির শব্দ শুনেই খান্ডেলওয়াল সাহেবের বাংলো থেকে অ্যালসেশিয়ান কুকুরের গম্ভীর ঘাউ-ঘাউ ডাক শোনা গেল। দুটি কেন? তারপরই মনে পড়ে গেল জবলপুরের হাসপাতালে টুসু বলেছিল যে, সাদা কুকুরটার বিয়ে হয়েছে। কিন্তু ঝাঁপাঝাঁপি করা বড় কুকুরটা তো সাদা নয়! সাদা কুকুরটা কোথায় গেল? এই জন্যেই গলার স্বরটা অচেনা মনে হচ্ছিল। কালো কুচকুচে, ঘাড়ে কেশর-ওয়ালা রাগী-রাগী টগবগে যৌবনের অন্য একটা কুকুর এটা। বদলে গেছে বাড়ি, বদলে গেছে বাড়ির চারপাশ, পরিবেশ, অনুষঙ্গ। যে, একদিন এই বাড়িতে বাস করত বদলে গেছে সেই পৃথুও। বদলে গেছে রুষা। ভাল। ভাল!

গাড়ি থেকে নামতে না নামতেই টুসু দরজা খুলে, মা! বাবা এসেছে! বাবা এসেছে! বলতে বলতে দৌড়ে এসে পৃথুর পায়ের উরুতে মুখ গুঁজল। যেন, বাবার গন্ধ নেবে বলে। পৃথুর মনে হল যেন টুসু নয়, তার যৌবনের শিকারের সঙ্গী প্রিয় ল্যাব্রাডর গান-ডগটিই! গলে যেতে লাগল পৃথুর ভিতরটা। এই ছেলেটাই তার মুক্তির পথে একমাত্র প্রতিবন্ধক। নইলে, তার আর দিগা পাঁড়ের মধ্যে তফাৎ আজ আর বেশি নেই। রুষার উপর থেকে যেমন করে একদিন হঠাৎই সব দাবি তুলে নিয়েছিল, কুর্চির উপর থেকেও নিতে পারে। যে-কোনও সময়েই। কখনও নেবেও হয়তো। জীবনকে নেড়েচেড়ে ঝাড়াই-বাছাই করে ঝাড়া-হাত-পা হয়েছে এখন। কোনও কিছুই আর তার কাছে আবশ্যিক নয়। সব কিছুই ঐচ্ছিক। মনের মধ্যে এক ধরনের আনন্দ বোধ করে সে। পাখির মতো হালকা হয়ে ভেসে যেতে ইচ্ছে করে জীবনের আকাশে। এই আশ্চর্য পরিবর্তনটা ঠিক কবে কখন যে ঘটে গেল, তা নিজেও ঠিক জানে না। চরম পূর্ণতা অথবা অপূর্ণতা থেকেই বোধ হয় জীবন সম্বন্ধে এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি জন্মায়।

রুষারই মতো কুর্চিও পৃথুকে নিজস্ব মালিকানার ব্যক্তিগত সম্পত্তি করে রাখতে চায়। পৃথুর মতো মানুষদের ছেড়ে রাখাই যে ধরে রাখার সহজ উপায় এ কথাটা ওরা কেউই বুঝল না। কোনও নারীর সান্নিধ্যে অথবা আলিঙ্গনেই বেশিক্ষণ থাকলেই যেন দম বন্ধ হয়ে আসে ওর।

পৃথু ঘোষের স্ত্রী রুষা সেন খোলা দরজার সামনে পরস্ত্রীর মতোই মধুর আমন্ত্রণী হাসি মুখে মেখে খোলা দরজায় দাঁড়িয়েছিল।

কেমন আছ? রুষা হেসে বলল। রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ-দেখা হয়ে যাওয়া পুরনো প্রেমিকার মতো।

ভাল। বলল, পৃথু। আর তুমি?

রুষা অপলকে পৃথুর দিকে চেয়ে ছিল। কী রোগা হয়ে গেছে পৃথু! চেনা যায় না। পা-হারা অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকা পৃথুকে তো আগে দেখেনি! হঠাৎই রুষার বুকের মধ্যের শক্ত করে কুলুপ-আঁটা দরজা-জানালাগুলি ভেঙ্গে কি এক গভীর যন্ত্রণার আর অনুশোচনার বোধ সাইক্লোনের মতো ধেয়ে এসে ওকে ছিন্নভিন্ন করে উড়িয়ে দিল। মনের পায়ে জোর পাচ্ছিল না। পৃথু যেমন পায় না শরীরের পায়ে। পরমুহূর্তেই, শিক্ষিতা, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, আত্মসম্মানজ্ঞানসম্পন্না, ভাবাবেগবর্জিতা আধুনিকা এক নারী তার মধ্যে ফিরে এসে মনের হাল ধরল আবার শক্ত হাতে।

উত্তর না পেয়ে পৃথু আবারও শুধোল, তুমি কেমন আছ?

সম্বিৎ-ফেরা রুষা বলল, ওঃ আমি? আমি ফাইন। অ্যাবসল্যুটলি ফাইন। নাথিং টু কমপ্লেন অ্যাবাউট। এসো, এসো। ভিতরে এসো। ধরব না কি তোমাকে? পারবে? একা একা সিঁড়ি চড়তে?

পৃথু বলল, না না, ঠিক আছে! পারব।

না বলে, বলল, উঠতে উঠতে: জীবনের সব সিঁড়িতেই তো একা একাই উঠতে হয়।

মনে পড়ে গেল পৃথুর যে, জবলপুরের হাসপাতাল থেকে যেদিন ও ফিরল তার আগেই রুষা চলে গেছিল ইদুরকারের বাড়িতে। মনে পড়ল, দূর থেকে সেই আলো-নিবোনো দরজা-জানালা-বন্ধ ঘরগুলির দিকে চোখ পড়ায় তার বুকের মধ্যে কেমন ভূমিকম্প ঘটেছিল! কিন্তু সে সব বলার কথা নয়। অনুযোগ, অভিযোগের একটা সময় থাকে, বয়স থাকে। প্রাপ্তবয়স্ক, প্রাপ্তমনস্ক মানুষদের ও সব ছেলেমানুষী মানায় না।

মেরী এসে ড্রয়িংরুমে ঢুকেই বলল, গুড মর্নিং স্যার। ওয়েলকাম হোম স্যার!

পৃথু বলল, ভেরী গুড মর্নিং মেরী। কেমন আছ তুমি?

ভাল ভাল। আপনি কেমন স্যার? বলেই, পৃথুর দিকে অনুকম্পার চোখে চাইল।

যা ভয় করেছিল, পৃথু এবারে তাইই হল। মেরী একনিশ্বাসে বলল, ব্রেকফাস্টে কী খাবেন স্যার? কর্নফ্লেকস না পরিজ? কটা ডিম স্যার? ডিমের কী স্যার? পোচ না স্ক্রাম্বল, ফ্রাই না ওমলেট? ওয়াটার-পোচ কী স্যার? চা না কফি? স্যার?

হেসে ফেলল পৃথু।

বলল, কিছুই খাব না ম্যাডাম। আমি খেয়ে এসেছি। তুমি ঠিক একই রকম আছ মেরী। একটুও বদলাওনি।

তাইই? আপনিও একটুও বদলাননি স্যার। মানে পাটা ছাড়া।

তাইই? বলল, পৃথু।

মনে মনে বলল, বাইরেটা দেখে মানুষের ভিতরের বদলটা বোঝা যায় না।

চা কিংবা কফি কিছু তো খাবে? লাঞ্চ-এ কী খাবে?

রুষা জিগগেস করল।

কিছুই খাব না।

মুখ কালো হয়ে গেল ওর। চোখ নামিয়ে নিচুস্বরে বলল, খাবে না? কেন? এতদিন পরে দেখা হল। খেয়েই যাও আমাদের সকলের সঙ্গে।

বলতে কষ্ট হল যদিও কিন্তু তবুও পৃথু বলল, নাঃ। দুপুরে গিরিশদা নেমন্তন্ন করেছেন।

রুষা বলতে না-চেয়েও বলে ফেলল, গিরিশদাই তোমার স্ত্রী-ছেলে-মেয়ের চেয়ে বড় হল?

পৃথুর মুখে ম্লান হাসি ফুটে উঠল। জবাব দিল না।

ঘরে চল।

রুষা বলল, টুসু ও মেরীর দিকে চেয়ে, মুখ নামিয়ে।

কোন ঘরে?

আমার শোবার ঘরে।

ড্রইংরুমেই বসি। মিলি কোথায়?

দিদিকে ডেকে নিয়ে এসো টুসু। যাও। আর তুমি খেলো গিয়ে বাগানে। বাবার সঙ্গে আমার কথা আছে।

মিলি এল। হাতে একটি পড়ার বই। অপরাধী অপরাধী মুখ করে বলল, হাই। বাবা! তুমি কেমন আছ? আই মিসড উ্য ভেরী মাচ।

মিলিকে দেখে অবাক হয়ে গেল পৃথু। কী সুন্দর আর কত লম্বা হয়ে গেছে মিলি। একটা বয়সে মাত্র কয়েক মাসেই মেয়েদের কী অসম্ভব পরিবর্তনই না ঘটে যায় শরীরে। এই সুন্দরী, যে কৈশোর আর যৌবনের ঘর দুটির মাঝের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছে, সে যে তারই মেয়ে এ কথা বিশ্বাসই হচ্ছিল না। মুগ্ধ গলায় পৃথু বলল, হাই! ইয়াং লেডি! কেমন আছিস তুই?

আমি খারাপ বাবা। আমি খুব খারাপ। উ্য শুড ডিসওন মী।

বলেই অনুতাপমিশ্রিত ঔদ্ধত্যর সঙ্গে দাঁড়িয়ে রইল ও। চোখে জল ছিল না। জ্বালা ছিল রুষারই মেয়ে।

আসার আগে ঠিক করেই এসেছিল যে, মিলির সঙ্গে রূঢ় ব্যবহার করবে। যে মেয়ে বাবাকে অমন চিঠি লিখতে পারে, যে মেয়ে মায়ের প্রেমিকের সঙ্গে প্রেম করতে চায় তাকে সত্যি সত্যিই ও ডিসওওনই করবে। পেয়ে বলে স্বীকারই করবে না। কিন্তু সেই পৃথুই ক্রাচ-এ ভর দিয়ে দুটি লাফে এগিয়ে গিয়ে মিলিকে বুকে জড়িয়ে ধরল। ওর ইচ্ছে করল, সদ্য যুবতী মেয়ের সমস্ত দুঃখটুকু নিজের বুকে শুষে নেয়। নিঃশেষে।

মিলি, পৃথুর বুকের মধ্যে কুঁকড়ে গিয়ে রাতভর ঝুলিয়ে রাখা গুলি করে মারা জংলি হাঁসের মতো শক্ত হয়ে গেল।

টুসু বলল, ডোন্ট বী সিলি! দিদি।

রুষা বলল, টুসু, তোমাকে বাগানে গিয়ে খেলতে বলেছি না আমি। আই ডোন্ট ওয়ান্ট উ্য হিয়ার।

টুসুর হাতে একটা সাদা-কালো চৌখুপী ফুটবল ছিলই। সেটা নিয়ে ও চলে গেল।

পৃথুর বুকের মধ্যে মুখ রেখে মিলি বলল, আমি খারাপ।

পৃথু মিলির পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ভাবল, ভুল সকলেই করে। ভুল করলেই যদি খারাপ হয়ে যেত কেউ তাহলে…আর ভুল করে যদি ভুল করেছিস বলে বুঝতেই পেরে থাকিস তবে আর দুঃখ কিসের? সব তো মিটেই গেল! ভুল করে ভুল স্বীকার করতে পারে কজন মানুষ রে মিলি? মুখে বলল না কিছু।

মিলি বলল, বাবা! তুমি চলে যেও না। আমাদের সঙ্গে থাকো বাবা।

মাথা ঘুরতে লাগল পৃথুর। স্ত্রী ও মেয়ের কাছ থেকে এত আঘাত পেয়ে যে সচেতন নিষ্ঠুরতা সে মনের মধ্যে তিলতিল করে পাহাড়ের মতো জমিয়ে তুলেছিল সেই পাহাড়েরই ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরিতে অগ্ন্যুৎপাত ঘটে গেল হঠাৎই। বুঝতে পারল, ওর এই উদাসী নির্মোকও আজও ওর মধ্যে অনেকই দয়া, ক্ষমা, মায়া-মমতা এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে। বুঝতে পারল, অপত্য স্নেহের চেয়ে গভীরতর বোধ আর কিছুই নেই একজন মানুষের জীবনে। সন্তানের মুখ চেয়েই মানুষ মানুষী আবহমানকাল ধরে নিজেদের ঠকিয়ে এসেছে; নষ্ট করেছে একটামাত্র জীবন।

মিলি আবারও বলল, বাবা। বল? তুমি থাকবে তো?

পৃথু বলল, আয় আয় আছে আয়। আয় আমরা এখানে বসি, সোফাটাতে। ক্যাডবারী খাবি? মিলি?

বলেই মনে পড়ল যে, সে তো সঙ্গে করে কিছুই আনেনি মেয়ের জন্যে। শুধু আজই নয়। গত পনেরো বছরে কিছুমাত্রই আনেনি হাতে করে। কোনও ছেলেমেয়ের জন্যেই। আজ যা-কিছুই পাচ্ছে তার কিছুই প্রাপ্য নয় ওর।

বলল, রাবড়ি খাবি? দাঁড়া, রাবড়ি আনাচ্ছি আমি।

তারপর, যে লোকটি গাড়ি চালিয়ে এনেছিল তাকে ডাকতে বলল রুষাকে। সে এলে, তাকে বলল, ভুচুবাবুকে বলে দিও গিরিশবাবুকে খবর দিতে যে, দুপুরে আমি এখানেই খাব। আর রাবড়ি নিয়ে এসো তো লাড্ডুর দোকান থেকে। এই নাও টাকা।

টাকা ভুচুবাবু দিয়ে দিয়েছেন।

নাও। ভুচুবাবুর টাকা রেখে দাও। ফেরত দিও বাবুকে। রাবড়ি আর ভাল কালাকাঁদও এনো। খাবি মিলি? কালাকাঁদ?

মিলি জবাব দিল না কোনও। পৃথুর পাশে ঘন হয়ে বসেছিল ও।

রুষা বলল, তোমার গাড়িটা নিয়ে আমি কি একটু বাজারে যেতে পারি? তুমি খাবে, এতদিন পরে। বাড়িতে কিছুই নেই অতিথিকে খাওয়ানোর মতো। ভুচুকে তাইই বলেছিলাম, ভাল হত, আগে জানলে…

গাড়িটা তো ভুচুরই। নিশ্চয়ই নিয়ে যেতে পারো তুমি। আর এই নাও টাকা। বাজারের।

আমার কাছে আছে। তাছাড়া, আমিও রোজগার করি। একবেলার অতিথির কাছ থেকেও কি কেউ টাকা নেয়?

রুষা চলে গেল।

টুসু বাগান থেকে ফিরে এসে বলল, বাবা, খেলবে?

মিলি বলল, বোকা বোকা কথা বোলো না। কী করে খেলবে বাবা? বাবা কি আগের মতো আছে?

পৃথু ভাবল, ঠিকই বলেছে মিলি! বাবা আগের মতো আর নেই।

আজ আমি সারাদিন এখানে থাকব তোমাদেরই সঙ্গে। মজা করব। তবে সন্ধেবেলায় শামীমের বাড়ি যেতে হবে। ওর মেয়ের বিয়ে তো।

টুসু বলল, জানি। নুরজেহান! যার নামে টাজমেহাল, আগ্রার, তাই না?

হেলে ফেলল পৃথু। কিন্তু ও কিছু বলার আগেই টুসু বলল, ওই নুরজেহানের জন্যেই তো ডাকু মগনলালের সঙ্গে ফাইট করলে, তাই না?

পৃথু হেসে বলল, হ্যাঁ। তাইই তো!

মিলি বলল, বাবা আমি যাই আমার ঘরে? তুমি থাকবে তো এখানে? চলে যাবে না তো সীওনীতে?

কী করে থাকব রে? এখানে চাকরি তো ইস্তফা দিয়ে দিয়েছি। আমি এখন খোঁড়া মানুষ। ইচ্ছে করলেই কি আর যেখানে সেখানে চাকরি পাব? একটা চাকরি পেয়েছি তো সীওনীতে। মাইনে দিচ্ছে, আমার এখনকার যোগ্যতার তুলনায় বেশিই। সুন্দর বাংলো। অনেক ফুল, প্লান্টস, ক্যাকটাই, অর্কিত, সাকলেন্টস। ছবির মতো একেবারে। আমি ওখানেই থাকব। মাঝে মাঝে না হয় আসব তোদের এখানে। তোরাও ছুটিতে ওখানে যাবি বেড়াতে। মাকেও নিয়ে আসিস। আমি তো’ তোদের জন্যে কিছুই করিনি কোনওদিন। টাকা রোজগার করা ছাড়া আর কিছুই করিনি। তোদের মা-ইই তোদের সব। মাকে কখনও দুঃখ দিস না তোরা। এমন ভাল মা, সকলের হয় না।

এখানে কোনও চাকরি তোমাকে দেবে না কেউ বাবা?

মিলির “বাবা” ডাকটা পৃথুকে, টুসুর “বাবা” ডাকেরই মতো বড়ই এলোমেলো করে দিচ্ছিল বার বার। যতদিন একসঙ্গে ছিল একবারও বুঝতে পারেনি যে, সে যে-থাকাকে না-থাকা বলেই জানত তাইই ছিল এত-বড়-থাকা। গ্রীষ্মর দাবদাহের পত্রহীন গাছের ন্যাংটো ডালপালার মধ্যেও যে প্রাণ সুপ্ত থাকে, প্রথম রাতের বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই যে সেই সব রিক্ত ডালই কচি-কলাপাতা-সবুজ কিশলয়ের সহস্র গুঁড়ি গুঁড়ি কুঁড়িতে ভরে উঠে প্রমাণ করে যে, তারা প্রচণ্ডভাবেই ছিল। কিন্তু লুকিয়ে ছিল। একথা ও জানত।

কিন্তু কথাটা যে তার নিজের জীবনের বেলাতেও প্রযোজ্য তা জানত না। নিজের জন্যে, রুষার জন্যে, মিলি ও টুসুর জন্যে এক গভীর বেদনা অনুভব করতে লাগল ও। ওর আমিত্ব, ব্যক্তিত্ব, অহং সবই যেন তার ছেলেমেয়ের কচি-গলার “বাবা” ডাক একেবারে তছনছ করে দিল। ওদেরও উপর গভীর অভিমানে নিজেকে সরিয়ে রেখেছিল। বড় বেশি দূরে। এখন যে মধ্যের সাঁকোটি পর্যন্ত ভেসে গেছে। ফিরবে কী করে?

কিন্তু এত কথা ওদের বুঝিয়ে বলে, সে ক্ষমতা ওর নেই। বলতে গেলেও ওরা হয়তো বুঝবেও না।

পৃথু বলল মিলিকে, তুমি পড়ছিলে?

আচ্ছা বাবা। কোনও দরকার থাকলে ডেকো।

টুসু, যাও তুমিও খেলো গিয়ে।

তুমি তো খেলছ না! একা একা কি খেলা যায়?

পৃথু বোবা চোখে তাকাল ছেলের চোখে। বলতে চাইল, টুসুবাবা, যখন বড় হবি, জীবনের সব নিষ্ঠুর ঝড় আর আঁধি আর চোখ-জ্বালা-করা “লু”-এর মধ্যে গিয়ে পৌঁছবি তখন জানবি যে, সারাটা জীবন একা একাই খেলতে হয় রে, প্রত্যেক মানুষকেই। চারধার অনেকে ঘিরে থাকে বটে, সুন্দর সব নারী আর পুরুষ কিন্তু তারা বড়-দোকানের কাঁচের শো-কেসের মধ্যের মডেলেরই মতো সবাই। পুতুল-মানুষ সব। তোকে পাস দেয় না, তোর পাস নেয় না। চারিদিকে মাথা-উচু প্রাচীরের মতো, সারি সারি তক্তা-পাতা বিশাল গ্যালারিতে থাকে মৃত্যুর গা-ছমছম নিস্তব্ধতা। নির্জন, বড় নির্জন সেই মাঠ। সে মাঠে গোল দিয়েও একটুও আনন্দ হয় না কারণ গোলপোস্ট আগলে ঝাঁপা-ঝাঁপি করে না কোনও লম্বা-মোজা আর জার্সি-পরা গোলকীপার। তোকে আটকাবার জন্যে থাকে না একজনও। কিন্তু কবে, কখন, কোন মুহূর্তে যে সত্যি-খেলার অদৃশ্য রেফারির বাঁশি বেজে ওঠে সেই মিথ্যে-খেলারই গা-ছমছম ভুতুড়ে মাঠে, তা আগের মুহূর্তেও বোঝা যায় না। পুতুল-মানুষরা সব জ্যান্ত হয়ে ওঠে। গ্যালারিতে লক্ষ দর্শক কানে-তালা-লাগানো চিৎকারে চেঁচিয়ে উঠে হঠাৎই মাথা খারাপ করে দেয়। বল পায়ে তোর দৌড়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে তোর ধমনীর রক্তর দপদপানির সঙ্গে তাল মিলিয়ে তারা চিৎকার করে ওঠে গো-ও-ও-ও-ও-ও-ল। মনে হবে করার মতো কিছু করলি জীবনে। গোল খেতেও হয় একা একাই। তখন আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে।

কিন্তু সেসব মুহূর্ত দু একবারই আসে। সারাটা জীবন একা একাই খেলে যেতে হয়। মিথ্যে-মাঠে। বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দের ছায়াকে ধাওয়া করে, হাঁফিয়ে যেতে হয়, ভিজে যেতে হয় ঘামে! যা বাবা! এখন থেকেই একা একা খেলা খেলতে শেখ।

টুসু মনমরা হয়ে চলে গেল।

পৃথু নিজের ঘরের দিকে গেল। তারপর লেখার টেবলে বসল গিয়ে।

অবাক হয়ে দেখে যে, কাজের লোকজন নেই, অথচ ধুলো পড়েনি টেবলে। যেসব বই রেখে গেছিল সেসব পরিষ্কার আছে, অগোছালোও নেই কিছু।

জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েই পৃথুর দু চোখ অজানিতে ভিজে উঠল। সেই প্রাগৈতিহাসিক ন্যক্কারজনক ভাবাবেগ!

যাবে কি ফিরে সীওনীতে? মিলি ও টুসুকে ছেড়ে? ওরা যে আত্মজ-আত্মজাই। পারবে যেতে শেষ পর্যন্ত? অন্য কোথাওই চলে যাবে কি?

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত কবিতা মনে এল ওর।

“এখন খাদের পাশে রাত্তিরে দাঁড়ালে

চাঁদ ডাকে; আয় আয় আয়

এখন গঙ্গার তীরে ঘুমন্ত দাঁড়ালে

চিতাকাঠ ডাকে; আয় আয় আয়

যেতে পারি

যে-কোনও দিকেই চলে যেতে পারি

কিন্তু কেন যাব?

সন্তানের মুখ ধরে একটি চুমো খাব”

স্তব্ধ হয়ে রইল পৃথু অনেকক্ষণ।

গাড়িটা ফেরার শব্দ হল বাইরে। রুষা এসে প্রথমে বাবুর্চিখানায় গেল। তারপর পৃথুর কাছে এসে বলল, একটু বোসো, প্লীজ। মেরীকে বুঝিয়েই আসছি। ও তেমন ভাল রান্না করতে পারে না। আজকের রান্না আমিই করব। মাঝেমাঝেই করতে হয় এখন। আসছি এক্ষুনি।

তুমি রান্না করো? রান্না করতে জানো তুমি?

হাসল রুষা। বলল, রান্না করা কী আর এমন কঠিন কাজ? তোমারই বেয়ারা-বাবুর্চি যতদিন ছিল ততদিন বড়লোকি করে নিয়েছি। আজ যখন নেই, তখন রাঁধছি। সেদিন পৃথু ঘোষ সাহেবের বউ নিজে হাতে রাধলে লোকে কী বলত? তাছাড়া তুমিই তো চিরদিন তুলোর মধ্যে করে রেখেছিলে আমাকে। এবং ছেলেমেয়েদেরও। পরীক্ষার দরকার না থাকলে, কেই বা পরীক্ষাতে বসতে চায় বল? পরীক্ষা না দিয়েই তো অনেকই ডিগ্রি পেয়েছিলাম সেদিন। রুষা ঘোষকে সেদিন বাইরের জগতের দরকার ছিল, হাটচান্দ্রার সমাজ আমাকে ছাড়া অসম্পূর্ণ থাকত; তাইই বাইরেরই হয়ে ছিলাম। আজ যখন ভিতরে ডাক পড়েছে তখন অন্য দশজন সাধারণ মেয়ে যা করে, তাইই করছি। অসাধারণ যারা, তারা সাধারণের চেয়ে বড় বলেই অসাধারণ। অসাধারণরা ইচ্ছে করলেই সাধারণ হতে পারে কিন্তু যারা সাধারণ, তারা শত চেষ্টাতেও অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে না। তোমাকে একদিনও খিচুড়িও রেঁধে খাওয়াইনি বলেই চিরদিন অনুযোগ করে এসেছ তুমি পৃথিবীর সকলেরই কাছে। আমার জীবনের সব কিছু যে তোমাকেই ঘিরে ছিল, তোমার জন্যে গর্বিত হয়ে, এবং তোমাকে নিয়েই; সেটুকু বোঝার মতো সময় বা বুদ্ধি তো তোমার কোনওদিনও হল না! আজ তোমাকে সত্যিই চাইনিজ রান্না করে খাওয়াব। খেয়েই দ্যাখো, রাঁধতে পারি কি না।

পৃথু বিস্ময়ে চেয়ে রইল চলে-যাওয়া রুষার দিকে।

নিজেকে বড় বোকা, অসহায়; উদভ্রান্ত বলে মনে হল।

একটু পরই রুষা ফিরে এসে বলল, চল, শোবার ঘরে।

কেন?

কফি রেখে এসেছি আমাদের। ওখানে চল। কথা আছে।

ক্রাচ তুলে নিয়ে পৃথু ওর পেছনে-পেছনে শোবার ঘরে গেল। এই ঘর থেকেই একদিন রুষার শরীর চাওয়াতে রুষা তাকে ঘেন্নায় বের করে দিয়ে বলেছিল, “কুর্চির কাছে যাও। যেখানে খুশি যাও।” বিজলীর কাছে তার পরই প্রথম যাওয়া ওর। কুর্চির প্রতি আকর্ষণটাও তীব্রতর দীপ্তি পেয়েছিল সেই ঘটনাতেই।

রুষা বলল, কফিটা খাও। তারপর মনে করো, আমি যেন পরস্ত্রী। তোমার বিবাহিতা স্ত্রী নই। মনে করো, তোমার বিজলীরই মতো আমিও একজন নষ্ট মেয়ে। নষ্টই অবশ্য। তারপর সাধ মিটিয়ে আদর করো আমাকে। পরখ করেই দ্যাখো, আমি বিজলীর চেয়েও ভাল আদর করতে পারি কি না?

ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল পৃথু ঘোষ।

বলল, কী বলব জানি না।

এখন কিছুই বলার সময় নয়। করার সময়। হাজব্যান্ডিং-টাইম এখন। শরীরের সঙ্গে শরীরের কথার সময়। মুখকে নিবিয়ে দাও আপাতত। মনকেও। কী করে মন নিবোতে হয় তা তো তুমি জানোই। এমনকী গলা টিপে মারতেও জানো।

কফিটা শেষ করেই রুষা বেডরুমের দরজা লক করে জানালার পর্দা টেনে রট-আয়রনের ড্রেসিং-টেবলটার সামনের কমলারঙা গোল গালচেটার উপরে এসে দাঁড়িয়ে একে একে সব পোশাক খুলে ফেলল। কমলারঙা পর্দার মধ্যে দিয়ে রোদের আভা ঘরটিকে কমলা-রঙা করে তুলল। আর রুষার শরীরের রঙ তত কমলাই।

দুই কোমরে দু হাত রেখে প্যারিসের ফ্যাশান শোর মডেলদের মতো উদ্ধত গ্রীবা তুলে দাঁড়িয়ে বলল, ভাল করে চেয়ে দেখে বল, আমি তোমার বিজলী অথবা কুর্চির চেয়ে অনেকই বেশি সুন্দরী কি না? শরীর ছাড়াও যে একজন মেয়ের অনেক কিছু থাকতে পারে তা তো কোনও পুরুষই স্বীকার করে না!

পৃথু খাটের কোণায় বসেই রইল। কথা বলল না কোনও। ও ভাবছিল, কত্ব বদলে গেছে রুষা।

পেঁপে গাছে বসে দাঁড়কাকগুলো হঠাৎই ডাকাডাকি শুরু করল। দিনের বেলায় ও নগ্ন হলেই কী করে যেন বুঝতে পারে কাকগুলো। ভারী অসভ্য।

ভাবল, রুষা।

একটুক্ষণ সময় কেটে গেল। পৃথু নড়ল না। রুষাও তেমনই দাঁড়িয়ে রইল। অদৃশ্য একসারি বিচারকের সামনে ও যেন নিজেকে অনাবৃত করে বিজলী আর কুর্চিকে প্রতিযোগী ভেবে বিচারের রায়ের অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়েছিল। দাঁতে-দাঁত চেপে রুষা পৃথুকে বলল, আমাকে হারাতে পারে এমন কেউই নেই। শুধুমাত্র শরীরের প্রতিযোগিতাতেও নয়।

এমন সময় মেরীর গলা শোনা গেল দরজার কাছে। মেরী বলল, ম্যাডাম নুডলস সেদ্ধ হয়ে গেছে।

আসছি আমি। বলেই, জামাকাপড় তুলে নিয়ে পরতে লাগল।

পৃথু বলল, যাও! নুডলস সেদ্ধ হয়ে গেছে।

রুষা ওর দিকে অবাক চোখে চেয়ে বলল, সত্যিই তুমি চাও না?

পৃথু হাসল, বলল, তোমার শরীরের চেয়ে এখন নুডলসই আমার বেশি প্রিয়।

সশব্দে দরজা খুলে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে রুষা ভাবছিল, অনেকই বদলে গেছে এই ক’মাসে মানুষটা। যার যেমন যোগ্যতা, তার প্রাপ্তিও সেই রকমই হয়। ও কুর্চিরই যোগ্য, তার কাছেই ফিরে যাবে হয়তো!

খাওয়া দাওয়ার পর পৃথু বলল, মিলি-টুসুকে; এবারে যাচ্ছি।

কোথায় যাচ্ছ এখন বাবা?

ভুচুর কাছে যাব।

রাতে ফিরে আসবে না? আমি কিন্তু তোমার কাছে শোব বাবা। টুসু বলল।

তুমি নয়। আমি শোব আজ। সেই কবে বাবার কাছে শেষ শুয়েছিলাম, ভাল করেই মনেই পড়ে না।

ওক্কে। এখন যাও তোমরা। এনাফ ইজ এনাফ। রুষা বলল। বাবা যাবার সময়ে আবার এসো।

ওরা চলে গেলে রুষা বলল, ওদের কিছু বলে যাবে না?

কী?

উপদেশ, শাসন, ভালমন্দ দুটো কথা, সব বাবারা তাদের ছেলেমেয়েদের যেমন বলে, যেমন বলে এসেছেন চিরদিন!

নাঃ।

না কেন?

কোনও কারণ নেই। আমি ওদের আদরই করতে পারি, ভালবাসতে পারি কাছে পেয়েছি বলে। ওরা তো কোনওদিনও আমার ছিল না। তুমি তো স্বয়ংসম্পূর্ণা। ওদের বাবাকে কোনও দরকার নেই। টাকা তো পাঠাবই। এ ছাড়া আর কিছু করতে পারিনি, করতে তুমি দাওওনি। এখন আর হয় না। বড়ই দেরি হয়ে গেছে। তবে, চিঠি লিখব ওদের। তোমাকেও। ইচ্ছে হলে তুমিও লিখো।

একটু চুপ করে থেকে পৃথু বলল, ভুচু ছেলেটা ভারী ভাল। তোমার জন্যে আমার কোনও ভাবনা রইল না যে, এটাই মস্ত বড় কথা।

তার মানে?

বাঘিনীর মতো ঘুরে দাঁড়াল রুষা। পুরনো দিনের মতো। যে-রূপে, পৃথিবীর কোনও মেয়েকেই মেয়ে বলে মনে হয় না।

মানে নেই কোনও। ও আছে, লোকাল গার্জেন; ওইটেই বড় ভরসা। তুমি ওকে পুরোপুরি চেনো না। ওর মতো ছেলে হয় না। ছেলেবেলা থেকে অনেকই কষ্ট পেয়েছে। ওকে কখনও কষ্ট দিও না। পারলে, খুশি কোরো। ও খুশি হলে আমিও খুশি হব। এই আমার মনের কথা।

রুষা চুপ করে রইল।

পৃথু জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে বলল, এবার ডাকো ছেলেমেয়েদের। যেতে হবে। সময় হল। মিলি ও টুসু দুজনেই দরজা অবধি এগিয়ে দিল। দাঁড়িয়ে থাকল, দরজায় দুজনে। ওদের পেছনে মা, রুষা। তার মুখের ভাবে কোনও বিষণ্ণতা ছিল না। অথচ উদাসীনতাও নয়। কোন উপাদানে বিধাতা যে তাকে গড়েছিলেন, তা তিনিই জানেন।

সিঁড়ি থেকে নামবার সময় মিলি ও টুসুর মাথায় হাত দিয়ে মনে মনে বলল পৃথু ডিগ্রিধারী মার্কামারা শিক্ষিত হবার দরকার নেই তোদের। তোরা মানুষ হোস। ভালমানুষ। যে মানুষ, দুঃখ তাকে পেতেই হবে। নানারকম দুঃখ। কিন্তু দুঃখকে এড়াতে গিয়ে অমানুষ হোস না।

গাড়ির দরজা খুলে দিল ভুচুর লোক। লোকটার নাম জানে না। জিজ্ঞেস করল, নাম কী তোমার? ও বলল, অর্জুন।

আজ অর্জুনকে দরকার ছিল না পৃথুর। শ্রীকৃষ্ণর মতো সারথী হলে ভাল হত।

মিলি ও টুসু হাত তুলে বলল, টা! টা! বাবা!

রুষা একা গাড়ির কাছে এগিয়ে এসে বলল, এসো মাঝে মাঝে। ভাল থেকো। চোখের অযত্ন কোরো না। এনজয় ইওরসেল্ফ।

পৃথু বলল, সো ডু উ্য।

ছেলেমেয়েদের বোলো চিঠি লিখতে।

বলব। গলা নামিয়ে বলল, তবে ওদের নিয়ে চিন্তা নেই। ওরা আমাদের কেউই নয়। ওরা সব স্বার্থপরের ঝাড়। পা শক্ত হলেই নিজের নিজের পথে হেঁটে যাবে। যতদিন আছে, যতখানি ভাল করে পারি ট্রিট করব। এইই…

গাড়িটা ছেড়ে দিল।

পৃথু ভাবছিল ওই ‘টা টা’ কথাটার মানে কী? ও জানে না। ওই টা! টা! বলারই মতো অনেক কিছুই করে এল জ্ঞান হবার পর থেকে আজ অবধি অন্যর দেখাদেখি। মানে না বুঝে। না ভেবে। কাটিয়ে দিল এতগুলো বছর।

চাইনীজটা কিন্তু রীতিমতো ভালই রেঁধেছিল রুষা। চিকেন অ্যাসপারাগাস স্যুপ, চিকেন উইথ ব্যাম্বুশুটস এবং ভেজিটেবল ফ্রায়েড রাইস। আমেরিকান চপ-স্যুইও, লালচে, খুব ক্রিসপ করে। মিলি টুসু এতদিনে রুষার রান্না খেয়ে বোধ হয় অভ্যস্ত হয়ে গেছিল। ওদের বিস্মিত হতে দেখল না বোধ হয় তাইই!

পৃথুর বাহন সাদা অ্যাম্বাসাডরটা যখন লছমন শাহুর সোনা-চাঁদির দোকানের দিকে যাচ্ছিল সোনা-চাঁদি মহল্লাতে, ভুচু ঠিক তখনই থানা থেকে বেরিয়ে জীপ নিয়ে অন্য পথ দিয়ে শামীমের মেয়ের শাদীর জায়গাতে ফিরে যাচ্ছিল। সন্ধে হয়ে যাবে একটু পরই। অনেকই কাজ।

থানার দারোগার দরজা-বন্ধ ঘরে বসে ভুচু প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে নিজের জবানবন্দী নথীভুক্ত করিয়ে এল। রাজসাক্ষী হবে ও। শামীম কী করে ইদুরকারকে খুন করেছিল একা হাতে, ভুচুর প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও এবং পৃথু ঘোষের অজানিতেই তারই পূর্ণ বিবরণ দিচ্ছিল। আজই ছিল সবচেয়ে সুবিধেজনক দিন। কারণ শামীম আজকের মতো ব্যস্ত অনেক বছরের মধ্যেই আর থাকবে না। ভুচু দারোগাজীকে বলেছিল যে, এই কোল্ড-ব্লাডেড মার্ডারের জন্যে শামীমের ফাঁসি হওয়া উচিত। দারোগাজী বাঁহাতের দু-আঙুলে গোঁফে চাড়া দিতে দিতে বলেছিলেন, যে, “হবে”। মান্দলার বড় সাহেবের সঙ্গেও কথা হয়েছে তাঁর। জবলপুর থেকে ডি আই জি সাহেব রাতারাতি এসে সার্কিট-হাউসে ক্যাম্প করবেন। ভুচুরই অনুরোধে। বিয়েটা চুকে যাবার পরই শামীমকে অ্যারেস্ট করা হবে। জবলপুর থেকে ক্রেনও আসছে। হাঁলোর বুক থেকে মার্সিডিস গাড়িটা কাল তোলা হবে। পোস্ট মর্টেমের জন্যে পাঠানো হবে ইদুরকারের মৃতদেহ জবলপুরে।

জোরে জীপ চালিয়ে ফিরে আসছিল ভুচু। ওর চুল উড়ছিল হাওয়ায়। উড়ছিল ঘাড়ের কেশর। ভাবছিল, চিরদিনই ও একটি সুস্থ সুন্দর পুরুষালি জীবন চেয়েছিল। পৃথুদার চামচেগিরি করতে করতে ভুলেই গেছিল যে, একজন নারী ছাড়া কোনও পুরুষই সম্পূর্ণতা পায় না। শরীরের মধ্যে বড় ছটফটানি বোধ করে আজকাল। পামেলাকে একদিন চুমু খেয়েছিল শুধু। এ ছাড়া, তার ঊনত্রশ বছরের জীবনে নারীর সান্নিধ্য বলতে আর কিছুকেই ও জানেনি। শামীমকে ধরিয়ে না-দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না কোনওই। নইলে তার নিজের মাথার ওপরও খাঁড়া ঝুলত। মাথার ওপর খাঁড়া নিয়ে ঘর বাঁধা যায় না। পৃথুদা এখান থেকে কবে যাবে, তা জানে না ও। তবে, গেলেই এবার রুষার সঙ্গে একটা হেস্তনেস্ত করবে ভুচু। রুষাকে ছাড়া ও বাঁচবে না। অথচ এতদিন তাকে চিনেও কী করে যে বেঁচেছিল তা ভেবেই পায় না। কখন যে কী ঘটে যায় মনে মনে; আচানক!

ভুচু চলে যেতেই দারোগাজীর ফোন বাজল আবার। মান্দলা থেকে।

এস পি বললেন, ওই বাঙ্গালী মেকানিককেও শামীম মিঞার সঙ্গেই আরেস্ট করবে। ডি আই জি সাহেব বলে দিয়েছেন। অ্যাবেটমেন্টের চার্জ-এ।

ইয়েস স্যার। বলে, ফোন নামিয়ে রাখলেন দারোগাজী।

থানার উল্টোদিকে যে ছোট্ট পানের দোকানটা আছে বড় সেগুনগাছটার নীচে তার মালিকের নাম রহমতুল্লা। মেহেন্দি লাগানো চাপ-দাড়ি লোকটার। বনবেড়ালের মতো ছাই-রঙা চোখ। বয়স চল্লিশটল্লিশ হবে। ভুচুর জীপটা, থানায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর যেই চলে গেল তক্ষুনি রহমতুল্লা তার ছেলে সিদ্দিকিকে দোকানটা সামলাতে বলেই, গাছের গুঁড়িতে হেলান-দেওয়ানো সাইকেলটা তুলে নিয়ে জোরে প্যাডল করে চলল বিড়ি ফ্যাক্টরীর দিকে, যেখানে শামীমের মেয়ের শাদির শামিয়ানা পড়েছে। শামীম আগেই বলে রেখেছিল ওকে। শামীমের কাছে ভুচু নেহাৎই শিশু। ভালমানুষরা খলদের সঙ্গে কখনওই পেরে ওঠে না, এক সম্মুখযুদ্ধ ছাড়া। কিন্তু খল চরিত্রের মানুষরা কখনওই কারও সঙ্গে সামনাসামনি শত্রুতা করে না। পেছন থেকেই ছুরি মারে।

ঈত্বরদানে সবরকম ঈত্বর ইস্তেমাল করা হয়েছে। ফিরদৌস, শামীমা, রুহ খসস, গুলাব এবং আরও অনেক রকমের আতর। সেই সবেরই তদারকি করছিল তখন শামীম। এমন সময় রহমতুল্লা হাঁফাতে হাঁফাতে এসে পৌঁছল। শামীম তাকে দেখে এবং তার মুখের ভাব বুঝেই বিড়ি ফ্যাকটরির মাঠের এক কোণাতে নিয়ে গিয়ে সব শুনল। শামীম বলল, ওকে বিভ্রান্ত করার জন্যে; ভুচু যা করেছে তা করেছে। এর জন্যে কোনও চিন্তা নেই। কারণ কাল ভোরের আগেই পীরথু ঘোষই ওকে সাবড়ে দেবে।

কেন? ঘোষ সাহাব কেন?

রহমতুল্লা অবাক হয়ে শুধোল।

আরে তার বিবির সঙ্গে ভুচু লটরপটর করছে না। বিবির সঙ্গে লটর-পটর করলে পীরথুদাদা আর কী করবে?

রহমতুল্লা টাগরাতে জিভ ঠেকিয়ে একটা তাচ্ছিল্যসূচক শব্দ করে বলল, ওই আওরতে আর রাণ্ডিতে তফাৎ কি আছে?

তবু। যার আওরাত তার তো লাগেই! যদিও পিরথু ঘোষ এক অজীব আদমী আছে। নিজের বউকে অন্যের ভোগে লাগিয়ে নিজে আর একজনের বউকে ভোগ করছে। শালা রহিস আদমীদের কারবারই আলাদা!

রহমতুল্লা চলে যেতেই একটি গাড়ি ও একটি জীপ দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও, ছেলেদের ও শালাদের “একটু আসছি ঘুরে” বলেই, মোটর সাইকেলটা তুলে নিয়ে বড় মসজিদের পেছনের গলিতে ইমরান খাঁর বাড়িতে গিয়ে পৌঁছল শামীম। ইমরান-এর ভাই ইমরাতও ছিল। চৌপাইতে লুঙি তুলে বসে খটমল মারছিল খাটিয়ার পায়ার সঙ্গে টিপে টিপে। মিনিট পনেরো গুজগুজ ফুসফুস করল ওরা। ওরা দু’ভাই কথা দিল। শাদীর খানাপিনা সেরে আজ রাতেই যখন ফিরবে ভুচু তখন নিশ্চয়ই ও খুপরিয়ার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে শর্টকার্ট করে আসবে। তখন একটা পুরনো বেডফোর্ড ট্রাক দিয়ে পথ আটকে ভুচুকে সাবড়ে দেবে ওরা। পয়সা নিয়ে খুন করাই ওদের পেশা। হাত কাঁপে না, চোখের পাতা পড়ে না। দু’হাজার টাকা কবুলও করে এল শামীম। বিয়ের আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ যে দশ হাজার দিয়েছিল ভুচু তা থেকে পাঁচ আগেই সরিয়ে রেখেছিল ও। অন্য সব খরচ তো ভুচু এমনিতেই দিচ্ছে। ভুচুকে শামীম এমনিও সরাত। ভুচু না থাকলে তার দামাদ হুদাই হবে ভুচুর গারাজের মালিক। বাকি জীবনটা শামীম আর গর্তের মধ্যে বসে ভাঙা ঘড়ি সারাবে না, গাড়ি সারাবে এবার। তবে, ওই হুদাটাকেই বিশ্বাস নেই। ও শেষে শামীমকে পাত্তা নাও দিতে পারে। তবে সে সব পরের কথা। ইদুরকারের খুনের একমাত্র সাক্ষী ভুচু। সে না থাকলে, পুলিসের বাবার সাধ্য নেই যে, এই কেস ট্যাঁকায়। সে কারণেই এবং ভুচুর বিশ্বাসঘাতকতার জন্যেই তাকে যেতে হবে। হুদা ছোকরাটা এক নম্বরের বুদ্ধু। শরিফ আদমী মাত্রই বোধ হয় বুদ্ধু হয়।

শাদীর শামিয়ানা দেখা যাচ্ছিল। কাছাকাছি এসে গেছে। ভুচু ভাবছিল, মাথার উপর ইদুরকারের মার্ডারের ফাঁড়া নিয়ে সে রুষার দিকে এগোতে পারবে না। বাকি জীবনটা একেবারেই নিষ্কন্টকভাবে কাটাতে চায়। এই শামীরটা এক নম্বরের ক্রিমিন্যাল। বাকি জীবনটা সব কিছু ঠাণ্ডামাথায় ঘটিয়েছে তাতে ভুচু নিজে রাজসাক্ষী না হলে শামীমই তাকে ফাঁসিয়েই দেবে একদিন। ভুচুর এখন সুস্থ দেহে ভাল করে কারখানা চালাতে হবে। রুষাকে খুশি রাখতে অনেক টাকার দরকার। পৃথুদার ছেলেমেয়েদেরও ও খারাপ রাখবে না। তবে নিজেরও একটি ছেলে অথবা মেয়ে চাইই। রুষারই মত সুন্দরী হবে কি সেই মেয়ে? যদি মেয়েই হয়? কে জানে?

তবু, থানায় যাওয়ার জন্যে বড় অপরাধীই লাগছিল ওর। ভালমানুষের বড়ই কষ্ট। কখনও যে কারও ক্ষতি করেনি জীবনে।

শাদীর বরাত এসে পৌঁছল ঠিক সময় মতোই। ঈত্বর গুলাব আর নানারকম রহিসী উড়তে লাগল রাতের গ্রীষ্মাকাশে। মাঠের এক কোণায় আলাদা তাঁবুর মধ্যে পীনেওয়ালা আদমীদের জন্যে আলাদা ইন্তেজামও ছিল। শুধু খুশি ঔর পেয়ার ভাসছিল চারদিকে।

গোটা চারেক হুইস্কি চড়িয়ে সকলের অলক্ষ্যে ভুচু বেরিয়ে পড়ল জীপ নিয়ে।

টিকিয়া-উড়ান চালিয়ে গিয়ে পৌঁছল রুষা বৌদির বাড়ি। আজকেই একটা হেস্ত-নেস্ত করবে ভুচু। নুরজেহানকে দুলহীন-এর বেশে দেখে ওর মাথায়ও বিয়ের ভূত চেপে গেছিল। তর সইছে না আর।

বেল টিপতেই মেরী এসে দরজা খুলল। মিলি ও টুকু নিশ্চয়ই পড়ছিল।

মেমসাব কাঁহা? সেলাম দেনা।

বলল ভুচু।

মেরী চলে গেল।

রুষা বোধ হয় কিচেনে ছিল। শাড়ির উপর সাদা অ্যাপ্রন পরা বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছিল কপালে। অলক লেপ্টে ছিল গালে। তবুও, কী সুন্দর দেখাচ্ছিল রুষাকে!

রুষা বলল, কী ব্যাপার? আজ না বিয়ে নুরজেহানের? বরকর্তা এখানে কী করছে?

আপনাকে একবার ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করল। তাইই, হঠাৎই চলে এলাম।

রুষা বাঁহাতের আঙুল দিয়ে চোখ থেকে চুল সরিয়ে বলল, তাইই? তবে, দেখো।

খুবই ক্লান্ত ও বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল রুষা সেনকে।

কিচেনে কেন? একটু পরই খানা সবই পাঠিয়ে দিচ্ছি গরম গরম।

ভুচু বলল।

ওইসব ঘি-জবজব খানা আমি খাই না। ছেলে মেয়েরাও না। তুমি বোসো, যদি বসতে চাও। আমার রান্না এখনও বাকি আছে একটু। ছেলেমেয়েরা ঠিক নটায় খায় ডিনার। আসছি আমি।

বৌদি, যেও না।

ভুচু বলল।

রুষা অবাক হল, ভুচু ওকে তুমি বলে সম্বোধন করাতে।

বলল, বৌদি নই আমি। আমি রুষা। রুষা। এবং আপনি।

ভুচু এগিয়ে এসেই হঠাৎ রুষার সামনে হাঁটুগেড়ে বসে খুব জোরে ওপর কোমর জড়িয়ে ধরে দু-উরুর মাঝে মুখ রাখল। রুষার অপ্রনেও সুগন্ধ পেল ভুচু। সুগন্ধ-প্রত্যাশী নাক সুগন্ধ তৈরি করে নিতে জানে।

এক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইল রুষা। অতীত জ্বলে উঠল ফ্ল্যাশব্যাকে। পরমূহর্তেই ঠাস করে এক চড় মারল ডান হাত দিয়ে ভুচুর বাঁ গালে।

হতভম্ব ভুচু সঙ্গে সঙ্গে রুষাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ভুচুর কালো গালে রুষার পাঁচ আঙুলের বেগুনি ছাপ ফুটে উঠল। ও কিছু বলবার আগেই রুষা বলল, তুমি এ বাড়িতে আর কখনও আসবে না।

তারপরই গলা নামিয়ে বলল, নাউ, প্লীজ গেট আউট অফ দিস প্লেস। আর কখনও আমাকে জ্বালাতে এসো না।

জীবনে এত আঘাত ভুচু কখনও পায়নি। পামেলা ওকে ডিচ করাতেও নয়।

মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেল ভুচু। যখন এসেছিল, এই গ্রীষ্ম রাতকে বড় সুন্দর বলে মনে হচ্ছিল। যখন ফিরে যাচ্ছিল, আস্তে আস্তে জীপ চালিয়ে তখন ও ভাবল আজ রাতেই ও আত্মহত্যা করবে বাড়ি ফিরে। এই জীবন বয়ে আর লাভ নেই।

ভুচু চলে গেলে রুষা ওই অবস্থাতেই বেডরুমে গিয়ে পৃথু আর ওর বিয়ের ছবিটার সামনে দাঁড়াল দরজা লক করে দিয়ে। তারপর হাউ-হাউ করে কেঁদে উঠল। অবাক হয়ে গেল নিজেই। রুষাও কাঁদে দেখে। নিজেকে বলল, অহংকার যদি আমার একটু কম থাকত, সামান্য কম, তাহলেও জীবনটা কত অন্যরকম হতে পারত। চিরদিনই পৃথুকে মন যা বলতে চাইল; মুখ, ঠিক তার উল্টোটাই বলে এল। কিন্তু অহংকার যার নেই, সেও কি মানুষ?

শামীমের বাড়িতে ভুচু ফিরলে, পৃথু বলল, কোথায় হারিয়ে গেছিলে? বর-কর্তা? সকলেই যে খুঁজছে তোমাকে। এই নতুন ভুচুকে দেখে ভারী আনন্দ হচ্ছে পৃথুর। প্রেম মানুষের চোখের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয়?

আমি কোনও কাজ করতে পারব না। চলো পৃথুদা ওই তাঁবুতে যাই। আজ “পীকে বেহোঁস” হো যায়েগা।

ভুচু বলল।

কী হল তোমার হঠাৎ?

ভুচুর মুখে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে লাগল পৃথু। বলল, উমদা বিরিয়ানী তো জমিয়ে খেতে হবে। নেশা যেন না হয়। বেশি খেয়ো না ভুচু। নেশা কি ইতিমধ্যেই হয়েছে নাকি?

এখনও হয়নি। তবে হবে। আজ হতে পারে।

শামীম ওদের পাশেই দাঁড়িয়েছিল। ভুচুর কথা শুনে বলল, আজ তো নেশা করারই দিন! বিশেষ করে ভুচুবাবুর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *