৬২
আগের মতো সুস্থ থাকলে এমন চৈত্র শেষের ভোরে জঙ্গলের ভিতরে কোনও পাহাড়ী নদীর রেখা ধরে হাঁটতে যেত পৃথু।
পয়লা বৈশাখ যদিও চলে গেছে, তবু স্কুলের বাঙালি টিচাররা স্কুলের হলে রবিবার সন্ধেবেলায় নববর্ষ উপলক্ষে একটি প্রীতি সম্মিলনীর আয়োজন করেছেন। সমস্ত বাঙালীদের কাছ থেকে সাধ্যমত চাঁদা তুলেছেন ওঁরা।
কুর্চি গান গাইবে। স্কুলের টিচার, সেই অদেখা মিস্ কে. রায়ও গাইবেন। আবৃত্তি করবেন শ্যামল বোস আর হারাধন হোড়। নিধু মণ্ডল গীটারে পল্লীগীতি বাজাবেন। কুর্চি খুব ধরেছে যে, পৃথুকেও গাইতে হবে। পৃথু যে গান একদিন গাইত তা আজ আর মনেই পড়ে না। তাছাড়া সভায় গাওয়ার মত গানও গাইতে জানে না। অগণিত বাথরুম সিঙ্গারদের দলেই পড়ে ও।
ঠুঠা বাইগার খসখসে পায়ের শব্দ শোনা গেল গেটের কাঁকরের কাছে। কুর্চিকে পাহারা দিয়ে ফিরে এল ঠুঠা। রোজই যায়। আজকাল ওর কথা একেবারেই কমে গেছে। কথা মোটেই বলেই না সারা দিনে। দাড়ি-গোঁফ কামায় না, চুল কাটে না। ওর সামনে ঝুঁকে-পড়া ভালুকের মতো চুলে ওকে এখন প্রাগৈতিহাসিক কোনও মানুষ বলেই মনে হয়। চোখ দুটোর উজ্জ্বলতা বেড়ে গেছে অনেক। জানোয়ারের চোখের মতো চকচক করে চোখ দুটো। যখন চুট্টায় টান মারে, তখন ওর চোখ দুটো আরও জ্বলে ওঠে। জ্বলজ্বল করে। ভয় করে তখন ওর চোখের দিকে চাইতে। একদিন কুর্চিও বলেছিল, পৃথুদা নাইই বা পাঠালেন আপনি ঠুঠাদাকে। আমাদের কেমন ভয় ভয় করে।
আমাদের মানে? পৃথু শুধিয়েছিল।
মানে, কুন্তীরও। কুন্তী বলছিল, লোকটাকে দেখে মনে হয় ভাল্লুক। ওকে ভয় করেই সারারাত ঘুম হয় না। রাতে বাইরে যেতে পারি না। তার চেয়ে অন্য জানোয়ার ছিল ভাল। চোর-ডাকাতও। বাইরের চোর ডাকাতের ভয়ে শেষে কী ঘরের ডাকাতের হাতে সব খোয়া যাবে?
পৃথু হেসেছিল।
বলেছিল, তোমরা এই মেয়েরা এক আশ্চর্য জাত। পুরুষমাত্রই কি জানোয়ার? এই ভয়, তোমরা শিশুকাল থেকেই বুকে করে বড় হও বোধহয়। ঠুঠা আমাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে। ও ঈশ্বরের মতো ভাল।
অত শত জানি না। ভয় করে, তা কী করব। পুরুষ তো শত হলেও। বিশ্বাস করি কী করে?
ঠুঠা একবার তাকাল পৃথুর দিকে। নিবে-আসা চুট্টাটা ফেলে দিল ছুঁড়ে। সুন্দর একটি ব্ৰমেলিয়াড-এর টবের মধ্যে গিয়ে পড়ল সেটা। বিরক্ত হয়ে, পৃথু উঠে সেটাকে তুলে নিয়ে নোংরা ফেলার জায়গায় ফেলল। যেখান থেকে পাহাড়ি ঝাড়ুদার পরিষ্কার করে নেবে।
পৃথু লক্ষ করল যে, ঠুঠা দাঁড়িয়ে পড়ে পৃথুকে দেখছে জ্বলজ্বলে চোখে। ওর ফেলে-দেওয়া চুট্টাটার প্রতি অপমানকে যেন নিজের প্রতিই অপমান বলে মনে করল ও। এরকম ছিল না ঠুঠা। কেমন যেন হয়ে গেছে।
ঠুঠা খসখসে পায়ে জানোয়ারেরই মতো শব্দ করে উঠে এল মোজাইক করা বারান্দায়। একটা চিঠি বের করে পকেট থেকে যে বেতের চেয়ারে পৃথু বসেছিল তার সামনের টেবলে ফেলে দিল।
চিঠিটা খুলল পৃথু। কুর্চি লিখেছে।
পৃথুদা। আমি কাল সারা রাত ঘুমতে পারিনি। অতি নির্লজ্জর মতো লিখছি এ চিঠি।
আমি আর পারছি না পৃথুদা।
আপনাকে আমি একটুও বুঝতে পারি না।
আমি এ কী ভুল যে করলাম জীবনে! আপনি যা করেছেন, আমি যা করেছি; সবই কি ভুল?
—ইতি আপনার অবিন্যস্ত কুর্চি
ভুল। ভুল। হয়তো সবই ভুল। ভাবল পৃথু।
“লোকে বলে ভুল, আর আমিও কী জানি না যে ভুল?
তবু তার মাঝখানে ডুবে আছি, যে ভাবে মহিষ
নিজেকে নিহিত রাখে নিরুপায় জ্যৈষ্ঠের ডোবায়
বাতাস শুয়েছে যার অবল চোখের অলসতা।”
কী করে পৃথু? কী যে করে, ও নিজেই জানে না।
কখনও কখনও এমনই হয়। ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’, শঙ্খ ঘোষের এই কবিতাগ্রন্থখানির একটি কবিতা মনে এলেই পর পর কেবলই অন্য কবিতাও মনে আসতে থাকে।
সত্যিই কি অন্যায় করেছে ও কুর্চির প্রতি? ভেবে দেখার সময় হয়েছে বোধহয়। অন্যায় নিজের প্রতিও করছে না কি?
“প্রগাঢ় অন্যায় কোনও ঘটে গেছে মনে হয় যেন
কিছু কী দেবার কথা কিছু কী করার কথা ছিল?
থেমে-থাকা বৃষ্টিবিন্দু হাড় থেকে টলে পড়ে ঘাসে
ভেজা-বিকেলের পাশে ডানা মুড়ে বসে আছে আলো।”
বিগু এসে বলল, নাস্তা লাউ?
প্রচণ্ড বিরক্ত হল ও।
সেদিন থেকে ঠিক ছ’দিন পর:
কিবুরু বাংলোর বারান্দায় বসে ছিল পৃথু আর কুর্চি। আজ হাটবার। কুন্তীকে দিয়ে ছিটের ব্লাউজ আর শায়া বেচতে পাঠিয়ে ছিল কুর্চি। হাটে। ওরা সকালের বাসে চলে এসে পথে নেমে গেছিল। পথ থেকে সোয়া মাইল মতো ভিতরে বাংলোটা। সেগুনের বন, গভীর। অন্য গাছের মধ্যে সাহাজ করম, আর বয়রা আছে। চাঁর গাছ আছে বড় বড়। আরও নানা হরজাই গাছ। রাতটা এখানেই থাকবে ওরা। কাল ভোরের বাসে ফিরে যাবে সীওনীতে।
এখন বিকেল। শেষ বিকেল। বাংলোর হাতায় মস্ত শিমুলের অসংখ্য সমান্তরাল নরম হাতে কমলারঙা রোদ লেগেছে। পশ্চিমের আকাশে লাল সূর্য। পুবের আকাশে ফানুসের মতো চাঁদ। বনের গভীর থেকে ময়ূর আর তিতির আর একটি ভয়-পাওয়া কোটরা হরিণের ডাক ভেসে আসছে।
দুপুরে মুরগির ঝোল আর ভাত রেঁধেছিল কুর্চি। রাতে চৌকিদার খিচুড়ি করবে। ডিম আর আলুও ভেজে দেবে বলেছে। সঙ্গে শুকনো লংকা ভাজা।
কুর্চি বলল, যাবেন না?
চলো। বলল, পৃথু।
তারপর বাংলোর বারান্দার সিঁড়ি বেয়ে নেমে, লালমাটির পথ বেয়ে, ওয়াইন গঙ্গা নদীর শাখা নদীটার বুকে নেমে এল ওরা। এপাশ দিয়ে জল চলেছে। মাঝেও জল আছে কোথাও কোথাও। বড় বড় কালো পাথর, নদীর বুকের মাঝে। পৃথুর পা থরথর করে কাঁপছিল। ক্রাচ দুটি শক্ত করে চেপে ধরল ও। ভয়ে কাঁপছিল এবং চাপা উত্তেজনাতেও।
পৃথু কিন্তু চায়নি। কুর্চিই চেয়েছিল। কাঙালের মতো চেয়েছিল।
একটু এগোতেই দূরাগত এক এঞ্জিনের বনাঞ্জা এয়ারোপ্লেনের মতো একটা আওয়াজ শুনল। কাছে পৌঁছেই দেখে হাজার হাজার বাসন্তী রঙা প্রজাপতি উড়ছে এক জায়গায়। তাদের ফিনফিনে ডানার সমষ্টিগত আওয়াজকেই দূর থেকে প্লেনের শব্দ বলে মনে হচ্ছিল। নদীর ভিজে বালিতে মুখ ছুঁইয়ে আর তুলে, তুলে আর ছুঁইয়ে ডানা তিরতির করে তারা জল খাচ্ছিল। ওই দৃশ্যের চমৎকারিত্ব ওদের দুজনকেই বিস্মিত করে দিল। কুর্চিকে, বিশেষ করে। ও তো নগ্ন নির্জন বনের অন্তরঙ্গ রূপ পৃথুর মতো দেখেনি কখনও!
অন্ধকার হবে না আজ। সুর্যের হাত থেকে লাল শিখাটা তুলে নিয়ে চাঁদ তার হলুদ নরম ফানুস-আলো ইতিমধ্যেই জ্বেলে দিল পৃথিবীর বুকে। একটা টিটি পাখি চাঁদের দেশ থেকে উড়ে এসে তার লম্বা পা দুটি দুলোতে দুলোতে যেন ডুবন্ত সূর্যকে ধাওয়া করেই তার মধ্যে সেঁধিয়ে গেল। সুর্যের উত্তাপে যেন গলে গিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। ভ্রষ্ট হওয়ার দুঃখেই বোধহয় সুর্যও তক্ষুনি নিভে গেল।
আরও একটু এগিয়ে গেল ওরা। নদীর বুকে বর্ষায় ভেসে আসা একটা আস্ত জাম গাছ পড়ে আছে। তার মাথাটা আটকে গেছে একটা পাথরের স্তূপে। পায়ের দিকটা নদীটা নদীর বুকে। তার। পা ধুয়ে দিয়ে যাচ্ছে নদীর ধারা।
প্রথম গ্রীষ্মের সন্ধের বনের গায়ে আদিবাসী নারীর মতো এক রকম তীব্র কটুগন্ধ থাকে। সন্ধের মুখে সেই গন্ধটাই হঠাৎ শাড়ি-সরিয়ে-নেওয়া উদলা স্তনের গন্ধরই মতো উড়ে আসতে থাকে সান্ধ্য হাওয়ায়। ঝিমঝিম করে ঝিঁঝিঁ ডাকে। নেশা ধরে যায় তখন।
একটা বড় পাথরের উপর বসল ওরা। ক্রাচ দুটো আর বগলের হোলস্টার থেকে পিস্তলটাকে খুলে, পাশে রাখল পৃথু। মরে-যাওয়া সাদারঙা একটা চিলবিল গাছে একজোড়া ময়ূর বসে আছে। উদভ্রান্তর মতো। যেন পৃথু আর কুর্চিই। পৃথুর মস্তিষ্কও উড়ে গিয়ে বসল তাদের পাশে। বসে, পৃথুকে দেখতে লাগল সম্পূর্ণ বিষাক্ত হয়ে গাছের ডাল থেকে।
জ্বর জ্বর লাগছে পৃথুর। কামজ্বর কি? পরকীয়া প্রেমে কী এমনই হয়?
একদিন কুর্চিকে এক পলকের জন্যে অনাবৃত দেখার বড় সাধ ছিল। স্বপ্ন দেখত, ওকে নিজের হাতে চান করিয়ে দিচ্ছে সোহাগভরা আঙুলে। আজকে সেই সব স্বপ্ন, স্বপ্নমঞ্জরীর সবই সত্যি হতে যাচ্ছে। কিন্তু কত অপরাধবোধ! কত দ্বিধা। শংকা, কতরকম! টুসুর মুখ মনে পড়ছে। মনে পড়ছে, মিলির মুখ। রুষা, তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিদীপ্ত চোখে চেয়ে আছে পৃথুর মুখে যেন। তার ঠোঁটের ভঙ্গিতে বিদ্রূপের হাসির আভাস। মোটা-সোটা গবেট ভাঁটুও যেন চেয়ে আছে জঙ্গলের গভীরের ঝোপ ঝাড়ের ফাঁকফোঁক দিয়ে তাদের দিকে। যেন বলছে, লেহ্ লট্কা।
থার্মোফ্লাস্কটা বের করে, প্লাস্টিকের গ্লাস দুটো বের করে কফি ঢালল কুর্চি। কুর্চির কোনও দ্বিধা নেই, পাপবোধ নেই, ভয় নেই কোনওরকম। অধীর আগ্রহে ও অপেক্ষা করছে এমন কিছু পাওয়ার, যার জন্যে দাম দিয়েছে সে তার জীবন দিয়ে। অপরাধী পৃথুই। ঘর ভেঙেছে কুর্চির সেইই। অথচ যে অভিলাষে ঘর ভাঙা, তাইই আর চরিতার্থ হওয়ার মুহূর্তে অনুশোচনার শেষ নেই যেন পৃথুর।
সত্যিই এক অজীব্ আদমী এই পৃথু ঘোষ।
কুর্চি লাল আর কালো একটা ডুরে শাড়ি পরেছিল। লাল ব্লাউজ। চুল খোলা। শিকাকাই ঘষেছে মাথায়। চুল ফুলে ছড়িয়ে আছে পিঠময়। আরও কী সব প্রসাধনের গন্ধ মিশে ওর শরীরের গন্ধ বনের রাতের গন্ধের সঙ্গে মিশে গেছে। নানারকম মিশ্র গন্ধর উৎসারে ম ম করছে পৃথুর চারপাশ। পৃথু তার নিজের গায়ের খস্স্ আতরের গন্ধই পাচ্ছে না নাকে। কে জানে, কুর্চি পাচ্ছে কী না। চাঁদের আলোয় কুর্চির শাড়ি জামা সব কালো দেখাচ্ছে।
কফির গ্লাসটা হাতে ধরে বসে-থাকা পৃথুর মনে হচ্ছে কফিটা না ফুরোলেই যেন ভাল হত। কফিটা ফুরিয়ে গেলেই তো এক নতুন অনাস্বাদিত মুহূর্তর মুখোমুখি হবে সে। আনন্দে কী মরে যাবে ও? না কি দুঃখে? তবে, নিজেকে বলল, দ্যাখো পৃথু ঘোষ! এই প্রথম এইই শেষ! এ প্রতিজ্ঞার যেন অন্যথা না হয়।
কফি খাওয়া শেষ হল ওদের। কুর্চি গ্লাসদুটো ও ফ্লাক্সটা পাশে সরিয়ে রেখে বলল, আমি কী সাহায্য করব?
পৃথু মাথা নাড়ল।
মনে মনে বলল খোলা সোজা; পরা কষ্টর। তারপর, কষ্ট করে অনাবৃত করল নিজেকে। ততক্ষণে কুর্চিও, অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ অনাবৃত করেছে নিজেকে, কালো পাথরের উপর সে তার নিতম্বে-নামা চুল নিয়ে নগ্ন হয়ে দাঁড়াল, তখনও মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে সবে সন্ধে-নামা-বনের পটভূমিতে।
স্তব্ধ বিস্ময়ে গ্রীষ্মবনের এক উষ্ণ-অনুষঙ্গের মতো কুর্চির নিভৃত নগ্নতায় নিমগ্ন হল পৃথু।
পৃথুর মনে হল, সব নারীর শরীরই বাহ্যত এক। অ্যানাটমিকালি এক। কিন্তু কত আলাদা তারা, এক একজন। কী বিচিত্র তাদের আসা এবং যাওয়া, তাদের অভিব্যক্তি, তাদের কামনার ধরন, তাদের আদর খাওয়া এবং আদর করার ঢং।
ভাঁটু কি দেখছে তাদের? জেলখানার লোহার গরাদের মধ্যে তার কুমড়োর মতো নীরেট মাথাটি রেখে? ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে আছে কি? প্রতিহিংসার চোখে? রুষাও কী দেখছে দূর থেকে? জাইসের বাইনাকুলার দিয়ে।
আনন্দম্। আনন্দম্। আনন্দম্!
কুর্চি কাঁদছিল।
ঝিঁঝিঁর ডাকের সঙ্গে তার কান্না মিশে গেছিল। আনন্দে মানুষ কাঁদে, একথা শুনেছিল পৃথু। আজ প্রথম দেখল।
ভিজে বালির মধ্যে উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদছিল কুর্চি।
পৃথু বলল, ওঠো কুর্চি। গরমের দিন। সাপ আছে নানারকম। বিছে আছে। অমন করে শুয়ে থেকো না বালিতে।
মনে মনে বলল, সাপিণীকে সাপে কেটেছে। বিষ ছড়িয়ে গেছে সারা শরীরে। এই দংশিতা কী বাঁচবে আর?
ঠিক সেই সময়ই চিলবিল গাছ থেকে উড়ে এসে পৃথুর মস্তিষ্কটা খুলির মধ্যে বিনা-নোটিশে অবিবেচকের মতো সেঁধিয়ে গেল। মস্তিষ্কর ডানা কেমন কে জানে? সে ডানার চেহারা দেখা গেল না। বাদুড়েরই মতো কি? নাইটজার পাখির মতো?
তার ডানার আওয়াজেই বোধহয় ময়ুর দুটি উড়ে গেল তাদের ডানার সপ সপ শব্দ তুলে। গ্রীষ্মবনের তীব্রগন্ধী রাতের ঝাঁঝকে পিচকিরির মতো বিবসনা আদম আর ঈভের দিকে ছুঁড়ে দিল ময়ূর, দূরে গিয়ে ক্কেঁয়া! ক্কেঁয়া! ক্কেঁয়া! রবে। আরও দূরে হনুমানের দল হুপ্ হুপ্ হুপ্ হুপ্ করে ডেকে ইঠল। যেন, বলে উঠল, হিপ্ হিপ্ হুর্রে। হিপ্ হিপ্ হুররে! পৃথুর একটি এবং কুর্চির দুটি নগ্ন পায়ের নিচে খয়েরী আর কালো আর লাল মুচমুচে শুকনো পাতার মতো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল বহুশতাব্দীর সংস্কার, ভণ্ডামি আর ভান।
গান গেয়ে উঠল ঝিঁঝিঁরা।
মনে মনে যাকে ভালবাসা যায় গভীর ভাবে; একমাত্র তাকেই যেন যতনে আদর করা যায় শুধু। রুষা এবং বিজ্লীও তার আদর খেয়ে খুশি হত কিন্তু পৃথু নিজে এত খুশি কখনও হয়নি। হয়তো, ওরাও কুর্চির মতো খুশি হয়নি কখনওই। আসলে মনটাই সব। শরীরটা কিছুই নয়। মন ছাড়া, শরীরের দাম নেই কানাকড়ি। রতি যদি দুজনকে নিঃস্বই না করল, তার চেয়ে আত্মরতিও অনেকই বেশি সম্মানের!
ছিঃ ছিঃ! এত বয়স হল, অথচ জীবনের এমন এক গভীর গোপন পরম সত্য তার আজ অবধি জানা ছিল না? নিজেকে অভিসম্পাত দিচ্ছিল মনে মনে পৃথু। সংস্কারের দাসী, মধ্যবিত্ত মানসিকতার এই সামান্য কুর্চিই, হারিয়ে দিল শেষকালে অত্যাধুনিক রুষাকে, দেহপসারিণী বিজ্লীকে। আসলে, শরীরেরও হয়তো কোনও বিকল্প নেই।
বাংলোয় যখন ফিরে এল ওরা, তখন প্রায় নটা বাজে। সাড়ে তিনঘণ্টা? এতক্ষণ সময় কেমন করে কাটল? ভেবেই পেল না পৃথু।
চৌকিদার লণ্ঠন নিয়ে এল। সেটাকে সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে নিয়ে যেতে বলল পৃথু। এমন রাত আজ বাইরে। কোনও সাপেরই মতো পৃথু ওর পঁয়ত্রিশ বছরের পুরনো খোলসটাকে ওয়াইনগঙ্গা নদীর নাম-না-জানা শাখা-নদীর বালুরেখায় ছেড়ে এল এই মাত্র। দ্বিজ হল।
কুর্চি বলল, আমি চান করে আসছি। এক্ষুনি আসব।
এসো।
পৃথু বলল।
কুর্চি চেয়ার ছেড়ে উঠতেই মনে মনে বলল যাও। আমার বুকের আতরের গন্ধ, আমার শরীরের গন্ধ, তোমার শরীরের এখন যা কিছুই আমার; সব ধুয়ে এসো। স্মৃতি, উষ্ণতা; সবকিছু। তিক্ততাও যদি কিছু থেকে থাকে। ধুয়ে যাবার পরও যদি বাকি থাকে কিছু, তবেই বোঝা যাবে এই মিলনে ভালবাসা ছিল!
পৃথুও উঠে নিজের পাশের ঘরের বাথরুমে গেল। বাথরুমের জানালা খোলা। পর্দা বা গরাদ নেই তাতে। বনবাংলোর চানঘর। তা দিয়ে, চন্দ্রালোকিত বনপথ আর প্রান্তর দেখা যাচ্ছিল। কমোডের সামনে দাঁড়িয়ে বাইরে চেয়ে হঠাই পৃথুর মন ঘেন্নায় ভরে গেল নিজের প্রতি। ছিঃ!
তবে?
কী তুমি চেয়েছিলে পৃথু ঘোষ? কুর্চিও তাহলে তোমার নারী নয়? না, তুমিই কোনও নারীর যোগ্য নও?
কে যেন বলে উঠল তাকে। তার ভিতর থেকে।
কাকে বলবে, কেমন করে বলবে পৃথু? কে বুঝবে তাকে? সে যে কবি? বনলতা সেনের মতো, তারও মনের কোণে কোনও নারী ছিল, যাকে সে তিলতিল করে গড়ে তুলেছিল তার কল্পনা দিয়ে। প্রথম প্রেম বোধের প্রথমতম যৌনতাবোধের দিন থেকে। কিন্তু তার জীবনের কোনও নারীর সঙ্গে যে মিল হল না তার মানসীর। সে যে বড় সুন্দরী, বড় রুচিশীলা, বড় নরম, বড় লাজুক। তাকে কোথায় পাবে পৃথু? কোথায় সে থাকে? কোন নীল সমুদ্রর জলের তলার গোলাপী কোরাল রীফ্সএ? না কী সে থাকে আফ্রিকার রুয়েঞ্জোরী রেঞ্জের চাঁদের পাহাড়ে? কুর্চিও তো নয় সে? সে তবে কে? সে কী এই মর্তলোকের বাসিন্দা নয় তবে?
কুর্চি খুশিতে ডগমগ হয়ে গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে বারান্দায় এসে কর্কশ শব্দ করে চেয়ার টেনে বসল। এই কুর্চিকে চিনত না পৃথু। বাইরের স্নিগ্ধ নিক্কণিত নির্জনতা খান খান হয়ে গেল চেয়ার-টানার শব্দে। বিরক্ত হল পৃথু। ঘেন্না হতে লাগল কুর্চির উপর।
বুঝতে পারল, কবি যাকে ভালবাসে, কখনওই তাকে শরীরে পেতে নেই। শরীর বড় স্থূল, রক্ত মাংস, আঁচড় কামড়। ছিঃছিঃ। মানসী যে, তাকে চিরদিন মনেই রাখতে হয় যে! এমন সুগন্ধি রাতে শুধু স্বপ্নে অথবা কল্পনায়ই তার সঙ্গে মিলিত হতে হয়। বনলতা সেনেরা কোনওদিনও রক্তমাংসর নারী হয়ে উঠলে কবিদের অথবা তাঁদের কবিতারও মৃত্যু ঘটত অনেকদিন আগে।
ভাল করে গান শেখাবে কুর্চিকে, ওস্তাদ রেখে। নিজেও শুরু করবে নতুন করে। চুপ করে রাম-এর গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে, কুর্চির চান করে-ওঠা শরীরের সাবানের গন্ধে বুঁদ হয়ে ও ভাবছিল। র্শাদ্যঁর কাছে ভালবাসা ছিল তিনটি শব্দের সমষ্টি। পুরুষ, নারী আর ঈশ্বর। রবীন্দ্রনাথেরও কাছে ভালবাসার মনে প্রায়ই একই। আমি, তুমি আর গান। গান, মানুষের এইসব জীবনে যে কত বড় জিনিস, কী বিপুল ব্যাপ্তি তার, কী মুক্তি তার ভিতরে তা যারা জানল না তাদের জন্যে বড় দুঃখ হয় পৃথুর।
রাত ছমছম করছিল বাইরে।
চওড়া বারান্দাতে থামের ছায়া পড়েছিল দুধলি চাঁদের আলোয়। এখন চাঁপা-ফুল-হলুদ ভাবটা কেটে গিয়ে কাশফুল-সাদা হয়েছে চাঁদের আলো।
পৃথু বলল, কুর্চিকে, এখন? কী?
কী? গান?
কুর্চি বলল। আপনি গাইবেন।
শুধুই গান? আর কিছু না?
নাঃ। লজ্জা-পাওয়া গলায় বলল কুর্চি, মুখ ফিরিয়ে।
এত লজ্জা যে কোথায় ছিল ওর কিছুক্ষণ আগে, কে জানে?
কি? বল কিছু?
আমি জানি না।
বলে, আবার মুখ ঘুরিয়ে নিল কুর্চি।
ওর মুখের তীব্র কামনা মেশানো তীব্রতম লজ্জার মুখটিকে ভাল করে দেখতে পাওয়ার আগেই চৌকিদার বলল, আপনারা রাতের বেলায় জঙ্গলে কী করছিলেন?
জঙ্গল দেখছিলাম।
রাতের বেলা! পায়ে হেঁটে?
হুঁ। তোমার নাম কী?
পৃথু বলল।
সুরজ নারায়ণ ঝা।
দেশ কোথায়?
বিহারের মধুবনীতে।
এখানে কী করে এলে? এতদূর?
জীবনই নিয়ে এল। কোনও মানুষই কি আর পায়ে হেঁটে কোথাও যেতে পারে? অথবা, বাসে বা ট্রেনে? সে যাওয়াটা আসলে যাওয়া নয়। আপনারা আজ যেমন এসেছেন? এটা কী আসল আসা? আসলে যার জীবন যাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেখানে পৌঁছে ছেড়ে দেয় সেইখানেই থিতু হয়ে বসতে হয়।
ওরা দুজনে দুজনের দিকে চাইল।
এখন এখানেই। এখানেরই মেয়েই বিয়ে করেছি। তার বাবাও জঙ্গলেরই মানুষ।
সূরজ নারায়ণ ঝা বলল।
তোমার কী মজা না? এমন জঙ্গলের মধ্যে থাকো।
কুর্চি ঈর্ষার গলায় বলল।
মজা? মজাক্ উড়াচ্ছেন আপনি মেমসাব?
কুর্চিকে বলল, ঝা।
বাঃ রে। মজাক্ কেন উড়াব?
অপ্রস্তুত গলায় কুর্চি বলল।
জঙ্গলে মানুষ থাকে? না সিনেমা, না টিভি, না কিছু। থাকার মধ্যে এক টারান্জিসটার। তাও ব্যাটারী খতম হয়ে গেছে কাল। আনব গিয়ে, আপনারা চলে গেলেই।
পৃথু ইংরিজিতে বলল, থ্যাংক গড।
কুর্চি হাসল। বলল, যা বলেছেন। আইন করে দেওয়া উচিত জঙ্গলে কেউ ট্রানজিস্টার বাজাতে পারবে না। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের স্থায়ী বাসিন্দারাই শুধু বাজাতে পারবেন। তাও খুবই আস্তে।
ঠিক বলেছ। কথাটা পারিহার সাহেব আর লাওলেকার সাহেবের কানে তুলে দিতে হবে। তবে নিয়ম এরকম একটা আছেই, আইন আছে কি না তা অবশ্য বলতে পারব না।
কুর্চির কি অপরাধবোধ আছে কিছু? ওর মুখে বারান্দার থামের ছায়া পড়েছে। মুখটা দেখা যাচ্ছে না। চান করে ও একটা হালকা হলুদ-রঙা সিল্কের শাড়ি পরেছে। আরও সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে চাঁদের আলোয়।
ভাবল, কথাটা বলে, পরিবেশটা, মুহূর্তটা নষ্ট করবে না। তবুও মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল কথাটা।
পৃথু বলল, কি? ভাঁটুর কথা মনে পড়ছে?
হ্যাঁ।
স্পষ্ট গলায় বলল কুর্চি।
অপরাধবোধ?
নাঃ। আমার তো কোনও অপরাধবোধ নেই। আমার ছেলেমেয়েও হয়নি। তাছাড়া, আমার বাবার আর্থিক সঙ্গতি ছিল না এবং আপনি তখন আমাকে বিয়ে করলেন না বলেই ভাঁটু আমাকে বিয়ে করতে পেরেছিল। ও, সে কথা ভাল করেই জানত। অর্থ না থাকার জন্যে আমার জীবনটা ওকে দিতে হয়েছিল আমায়। আমার শরীরটাই। মন অবশ্য পায়নি কোনওদিনও। আমি তো সব কিছুই করেছিলাম ওর জন্যে। ও যা খেতে ভালবাসে রেঁধে খাওয়াতাম, ও যখনই আদর করতে চাইত আদর করতে দিতাম। দেব না কেন? ও যে আমাকে খেতে-পরতে দিত। কোনও মেয়ে শুধু খাওয়া-পরার বিনিময়েই নিজেকে বিকিয়ে দেয়, কেউ বিকোয় শাড়ি, গয়না ভি সি আর এর জন্যে।
এদেশের সব বিবাহিতা মেয়েই কম বেশি একই রকম, মানে, যাদের আর্থিক স্বাধীনতা নেই।
দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল।
কুর্চি বলল, আর কেউই না জানুক, আপনি অন্তত জানেন যে, যতদিন ভাঁটুর ঘরে ছিলাম, ভাঁটুরই কৃপাপ্রার্থী হয়ে, আপনার জন্যে আমার মনে যাইই থাকুক না কেন; কখনও এমন কিছুই করিনি, যাকে বিশ্বাসঘাতকতা বলা চলে। বেশ মজার দেশ কিন্তু আমাদের। প্রায় প্রতি রাতেই আপনাকে, আমি স্বপ্ন দেখতাম। ভাঁটু, যখন আমাকে আদর করত, তখন চোখ বন্ধ করে আপনার কথাই ভাবতাম। তাতে কোনও দোষ হত না। সমাজের বাজপাখি এসব দেখে না। কিন্তু আপনার হাতে যদি হাত রাখতাম একবারও তাতেই দোষ। শরৎবাবুর দিন থেকে আমাদের সমাজ কিন্তু খুব বেশি এগোয়নি। রুষা বৌদিকে আমি এই জন্যেই সম্মান করি। উনি কিন্তু প্রথম থেকেই অন্যরকম। শুধু স্বাধীন নন, স্বাধীনচেতাও। যা হয়ে গেল, তা হয়ে গেল আমাদের সময় অবধিই। এর পরের প্রজন্মর এদেশি মেয়েরা আমাদের মত নষ্ট করবে না নিজেদের জীবন। রুষা বৌদির সাহস খুবই। আপনি যতই দোষী করুন তাঁকে। তাঁর দিকটাও তো ভেবে দেখবার। একজন মানুষের স্বাধীনতা, স্বাতন্ত্র্য, স্বকীয়তা বেড়ে ওঠার পথে যদি বাধা পায় তবে মানুষ হয়ে জন্মানোই বা কেন?
তোমাকে কে বলেছে যে, দোষী করেছি আমি। এতে দোষগুণের কী আছে? একজন মানুষকে অন্য জনের যে সারাজীবন ভাল লাগতেই হবে তারই বা মানে কী? তাকে অন্যজনের ভাল লাগে। আমারও অন্য কাউকে ভাল লাগে। এই অবস্থায় একসঙ্গে থাকাটাই তো একটা ভণ্ডামি। তবে…
তবে কী?
ছেলে মেয়েদের কথাটা ভেবেই…
ছেলেমেয়েরা যখন বড় হবে তখন কি আমাদের যৌবন, এই মন, এই রাত ফিরিয়ে দেবে আমাদের? কী দেবে, বদলে ওরা? বুড়ো বাবা-মাকে কেমন ভাবে দেখবে, এখনই যারা যুবক-যুবতী তাদের দেখে বোঝেন না? আমাদের ছেলেমেয়েরা ভবিষ্যতে আমাদের দেখবে তাইই কী ভাবেন আপনি?
ওরা দেখুক আর নাইই দেখুক, বাবা মা হলে একটা অন্য ব্যাপার, অন্য একটা ফীলিং হয় কুর্চি। জানি না, তোমাকে বললে তুমি ঠিক বুঝবেও না হয়তো। কিছু কিছু বোধ থাকে কুর্চি যা নিজে বাবা অথবা মা না হলে বোঝা যায় না। ওরা করুক আর নাইই করুক, ওদের জন্যে করতে পারলেই দারুণ আনন্দ হয়।
আপনি তো কিছুই করেননি ছেলেমেয়েদের জন্যে। আপনি এই আনন্দর কথা জানলেন কী করে?
শ্লেষের গলায় বলল কুর্চি।
ঠিক। করিনি বলেই তো এখন তা পুষিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়। মিলি টুসু যে আমারই রক্তে তৈরি। অবশ্য, ওদের মায়ের রক্তও আছে। ওরা আমাকে ভালবাসে না, কারণ আমি ভালবাসতে দিইনি কখনও।
বাজে কথা পৃথুদা। আপনার স্ত্রী আপনার বাড়ি আপনার ছেলেমেয়ে কিছুই আপনার ছিল না। কোনওদিন হয়তো হবেও না। সব হওয়ারই সময় থাকে, সময় পেরিয়ে গেলে, হয় না আর কিছুই। যে-বাড়িতে একজনও অতিথি নিয়ে যাওয়ার অধিকার ছিল না আপনার, তাকে আপনি বাড়ি বলেন? সেই জীবনকে আপনি বিবাহিত জীবন বলেন? কারখানার ডিউটির পর যতটুকু সময়, যত ছুটি সব কি আপনি এমনিই ভুচু আর অন্যদের সঙ্গে শখ করে কাটাতেন? আমার শরীরের জন্যে দৌড়ে এসে কাঙালপনা করতেন কি শুধুই আমাকে ভালবাসেন বলে? নিজের শোবার ঘরে প্রত্যাখ্যাত, অপমানিত হয়েও কি নয়?
তা ঠিক নয়।
তবে কিসের জন্যে দৌড়ে আসতেন? আসতেন, আপনি সেক্স-স্টার্ভড বলে। যা আপনার সামান্যতম প্রয়োজন, যা মানুষ তো দূরের কথা; পশুরও প্রয়োজন তাও আপনি পেতেন না। ভালবাসাটাসা অনেকই বড় ব্যাপার পৃথুদা। আমার অপদার্থ স্বামীকে চোখ বুঁজে দিলেও যা থেকে আমি বঞ্চিত করিনি, রুষা বৌদি অতি-আধুনিকা বলেই, অতি-শিক্ষিতা বলেই তাও আপনাকে দিতেন না। আপনার অবস্থা আমি বুঝতাম, তাইই আপনাকে তখন কিছুমাত্রও দিয়ে আপনাকে অথবা আমাকেও অপমানিত করতে চাইনি আমি। দেখুন। ভাল তো আমিও কখনও বাসতে পারিনি ভাঁটুকে। বিশ্বাস করুন। একমুহূর্তের জন্যেও না। সেই শুভ দৃষ্টির মুহূর্ত থেকেই।
এখন এত কথা বলছ তুমি। তোমার চিঠিতে তো লিখেছিলে একেবারেই অন্য কথা।
পৃথু বলল।
আর কী লিখব চিঠিতে? আজকে আমি, আপনাকে যা বলতে পারি, গতকালও কি তা বলতে পারতাম পৃথুদা? এখন তো আমার আর আপনার মধ্যে কোনও আড়াল নেই। লুকোচাপা নেই কিছুই। আজকে সন্ধেবেলার এই ঘটনাই বলুন আর দুর্ঘটনাই বলুন; যাইই বলুন তা যে অন্যরকম। সেই ফ্রক-পরার দিন থেকে এত বছরের ঘনিষ্ঠতাতে আপনাকে যতখানি আপন না করতে পেরেছিলাম তার চেয়ে অনেকই বেশি আপন করে দিল যে এই রাত! রেখে-ঢেকে কিছু বলার আর দরকার কী?
পৃথু চুপ করে ছিল।
ভাবছিল, সঙ্গমে পরিতৃপ্ত হবার পর, মেয়েরা হয় ঘুমোয়; নয়তো বড় বেশি কথা বলে। কেন? কে জানে? মনস্তাত্ত্বিকরা জানবেন। শরীর-বিশেষজ্ঞরাও জানতে পারেন।
কুর্চি বলল, বড় বেশি কথা বললাম আমি, না?
হ্যাঁ।
পৃথু বলল।
জঙ্গলে এলে, চুপ করে থাকতে হয়। তোমাকে অনেক কিছুই শিখতে হবে এখনও। অবশ্য শিখে যাবে, আস্তে আস্তে। তোমার নিচুস্বরের গলাও দশটা ট্রানজিস্টারের মতো শোনায় রাতের নির্জন জঙ্গলে। একটা শুকনো পাতা খসে পড়ার আওয়াজকেও যদি স্পষ্ট এবং জোরে শোনা যায়, পট্কা ফাটার আওয়াজেরই মতো, তাহলে বুঝতেই পারো। যা বলাবলির, সব ফিরে গিয়েই বোলো, সীওনীতে। এখন শুধুই শোনার সময়। চুপ করে বোসো। জন ডান-এর সেই কবিতার কথা জানো? ডান না পড়লেও শেষের কবিতাতে নিশ্চয়ই পড়েছ। “ফর গডস সেক, হোল্ড ইওর টাঙ্গ অ্যান্ড লেশ মী লাভ।”
কুর্চি বলল, পড়েছি। কিন্তু এখন চুপও করব না বসবও না চলুন। বসব না আমি। বললাম, না!
কোথায় যাবে?
বাঃ রে।
মানে?
আমি জানি না।
জঙ্গলেই? আবার? না, ঘরে চলো।
না। দৃঢ় গলায় বলল কুর্চি।
বেশ। চলো, তাহলে।
মোহাবিষ্টর মতো বলল, পৃথু।
চাঁদে পেয়েছে তাকেও।
চৌকিদার ওদের বেরতে দেখেই হাঁ হাঁ করে দৌড়ে এল।
বলল, কোথায় যাচ্ছেন এত রাতে ল্যাংড়া সাহাব? বারোটা বাজে। পড়ে মরবেন যে!
কুর্চি বলল, জঙ্গলে।
পাগল নাকি আপনারা?
তারপরই দুটি হাত ভেঙে বুকের সামনে সমান্তরাল তুলে উচ্চতা দেখিয়ে বলল: এত উঁচু উঁচু বাঘ আছে এই জঙ্গলে। সাপ আছে। বিরাট বিরাট। শঙ্খচূড় কারাইত। চিতি। দাঁত-ওয়ালা খতরনাক শুয়োর। বুনো কুকুর। বাইসন। চিতাবাঘ। নেই কী!
ঠিক আছে।
কুর্চি বলল।
ঠিক আছে?
অবাক গলায় বলল চৌকিদার। কুর্চির দিকে মুখ ঘুরিয়ে।
পৃথু বাংলোর গেটের সামনে দাঁড়িয়েই রাম গেলাসে ঢেলে নিয়ে পাঁইটের বোতলটা চৌকিদারকে দিয়ে দিল। ইচ্ছে করেই, তাতে কিছুটা রেখে দিল।
বলল, যাও। তোমার কাছে মাদলটাদল নেই?
কুর্চি বলল, একটু গান-বাজনা করো না বাবা। আমরা না ফেরা পর্যন্ত। এমন চাঁদের রাত আজ! তুমি কী রকম বেরসিক মানুষ?
সুরজ নারায়ণ ঝা, বাঁ হাতে রাম-এর বোতলটা ধরে, ডান হাতের দ্রুত হিল্লোলে এই দুর্জ্ঞেয় নারী ও পুরুষটির উদ্দেশে একটি অসহিষ্ণু ভঙ্গিমা প্রকাশ করল।
পৃথু বলল, পা ফেলবে সাবধানে, দেখে। সাপের মাথায় ফেলো না আবার।
ঠাট্টার গলায়।
পৃথুর ক্রাচ পাথরে লেগে শব্দ করছিল। জঙ্গলে নিঃশব্দে পা ফেলে ঘুরতে শিখেছিল ছোটবেলায়। সবই ফেলা গেল। নিঃশব্দে, জীবনের সব জঙ্গলেই ওর প্রবেশ বুঝি নিষেধ হয়ে গেছে।
সাবধান কুর্চি। সত্যিই সাবধান।
বড় কালো পাথরটার উপরে দৌড়ে গিয়েই দাঁড়িয়ে পড়ে, কুর্চি বলল, বড় বেশি সাবধানী আপনি! বড় বুড়ো বুড়ো ভাব আপনার। একটু বিপজ্জনকভাবে বাঁচতে শিখুন পৃথুদা, লক্ষ্মীটি! আগেও তো বলেছি। পুতু পুতু করে বেঁচে কী লাভ?
পৃথু, থেমে দাঁড়াল ক্রাচে ভর করে। রাম-এর গ্লাসটা নিঃশেষ করে, তাকাল চোখ তুলে কালো পাথরের উপর দাঁড়িয়ে-থাকা কুর্চিকে আদিগন্ত চন্দ্রালোকিত রাতের পটভূমিতে সুন্দরভাবে ফ্রেমিং করে অনেকক্ষণ ধরে নিজের চোখের জোড়া লেন্স দিয়ে দেখল ও। প্রার্থনা করল, এই ছবিটি, তার চোখদুটি; যখন চিতার আগুনে গলে যাবে, তার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত যেন এই মুহূর্তরই মতো অম্লান থাকে। নাকে যেন থাকে এই উড়াল রাতের গন্ধ। কানে সব রাত-পাখির ডাক, ঝিঁঝিঁর রুমঝুমি। তার সমস্ত শরীরের চামড়াতে, তার পরমাণুতে থাকে যেন কুর্চির সমস্ত শরীরের পরশ, উত্তাপ। এই সমস্ত দৃশ্য, গন্ধ শব্দ, স্পর্শকে বাইরে খোলসের মতো ফেলে রেখে সেদিন রাতের শঙ্খচূড় সাপটারই মতো একদিন এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। একদিন। যে-কোনওদিন!
তাড়া নেই কোনও। জীবন এইই তো শুরু হল সবে! বেঁচে থাকা কী সুন্দর এক অভিজ্ঞতা!
বন্দুক-রাইফেল হাতে বনে বনে ঘোরাকেও এক ধরনের বিপজ্জনক ভাবে বাঁচা বলে জেনে এসেছিল, মগনলালের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার মতো নানারকম দুঃসাহসিক কাজকে অবহেলায় হাতে তুলে নিয়েও। অথচ, নিজের নিভৃত, ব্যক্তিগত জীবনের একেবারে কেন্দ্রবিন্দুর মধ্যেও যে এরকম বিপজ্জনকভাবে বাঁচা যেত, তা একবারও মনে হয়নি ওর আগে। হারিয়ে দিল কুর্চি তাকে। সত্যি! কে যে কখন কেমন করে হেরে যায় কার কাছে এই জীবনে!
প্রথমে ইদুরকারের কাছে হেরেছিল। তারপর রুষার কাছে। তারও পর ভাঁটুর কাছে। বিজ্লীর কাছেও। আর আজ রাতে, কুর্চির কাছে। হেরে যাওয়ার মধ্যেও যে এমন গভীর আনন্দ সুপ্ত থাকে তা পৃথু ঘোষের কল্পনারও বাইরে ছিল।
সোঁদা গন্ধ, সিক্ত, জঙ্গলঘেরা দুধ্লি চাঁপাফুল-রঙা বালির মধ্যে, দুটি সোঁদাগন্ধ, সিক্ত, দৈব-আশীর্বাদে ঋদ্ধ, উপোসী শরীর এক গভীর নিবিড় আশ্লেষে একাত্ম হয়ে গেল। শরীরের আনন্দর মধ্যে যে কোনও পাপ নেই বরং তীব্র একধরনের পুণ্যই আছে, তা যেন পৃথু এই প্রথমবার জানল। কত কিছুই জানে না ও। আরও কত কিছু জানার আছেও হয়তো এখনও!
কপারস্মিথ পাখির দোসর দূরের চাঁদ-ভাসি বিধুর বন থেকে সাড়া দিতে লাগল; টাকু-টাকু-টাকু-টাকু-টাকু-টাকু!
পৃথু ভাবছিল, জীবন যদি এতই আনন্দর হতে পারে, তবে পৃথিবীর সকলেই কেন এই মুহূর্তের পৃথু আর কুর্চির মতই বাঁচে না? না কি, এই “সুপ্ত” আনন্দর কথা, “বিপজ্জনকভাবে বাঁচার” কথা, কুর্চির মতো করে কেউই বলেনি তাদের? অন্ধ হয়ে অথবা বাধ্য হয়ে যা স্বতঃস্ফূর্ত যা সুন্দর, যা স্বাভাবিক তাকে বর্জন করে চলার আরেক নামই কী সভ্যতা? বিবেক? যাত্রাদলে গান-গাওয়া বিবেকেরই মতো? যে বলার জন্যেই অনেক ভাল ভাল কথা বলে যাত্রার নায়ক নায়িকারা তাতে কর্ণপাতও করে না। অথচ জীবনের নায়ক-নায়িকারা এই বিবেকের ভয়েই জবুথবু। মুক্তি হয়তো অনেকরকমের থাকে। বড় ধরনের মুক্তি সে সব। অর্থনৈতিক মুক্তি, রাজনৈতিক মুক্তি।
কিন্তু একঘেয়েমি, অভ্যেস ও সংস্কারের হাত থেকে একজন মানুষ যদি নিজেকে প্রথমে মুক্ত না করতে পারে, তবে তার জীবনের অন্য সব মুক্তিই বোধহয় মূল্যহীন হয়ে যায়।
কুর্চি বলল, কী ভাবছেন? উঁ?
কিছু না। চলো এবারে। পৃথু বলল।
খিচড়ি বন্ গ্যয়া সাব। ফিরতেই, চৌকিদার বলল।
খিচ্ড়ি?
জীবনটাই খিচুড়ি হয়ে গেল একটা।
কী ভাবছেন?
আদুরে গলায় কুর্চি বলল। পৃথুর দু চোখে চেয়ে।
পৃথু বলল, মনে মনে, চুপ করে থাকো। নির্লজ্জ পাজি মেয়ে। অসভ্য, বাজে মেয়ে। নোংরা মেয়ে। কবিদের নষ্ট ভ্রষ্ট করো তোমরা। কল্পনা আর কাব্যকে লাল পিঁপড়ের মতো খাও কুরে কুরে।
মুখে বলল, কিছু না।
আপনি খুশি তো? পৃথুদা?
হুঁ।
দায়সারা গলায় অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল পৃথু।
শুধুই, হুঁ?
আর কী?
পৃথু বলল।
কুর্চি বলল, একটা গান শোনান না পৃথুদা। কতদিন গান শুনি না আপনার!
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে ও বলল, বরং তুমিই গাও।
আমি?
হ্যাঁ।
হয়তো একমাত্র গানই এখন ওর মস্তিষ্ক এই জট খোলাতে পারে। গান এবং পরম তৃপ্তির মিলনও। জট খোলে যেমন, মাঝে মাঝে, পাকিয়েও তোলে।
ভাবল পৃথু।
কুর্চি ধরল হঠাৎ।
এই গানটি যে ও ধরবে ভাবতেও পারেনি। আজ থেকে প্রায় পনেরো বছর আগে এই গানটি তার কাছ থেকেই শিখেছিল কুর্চি। নিধুবাবুর গান।
“মিলনে শতেক সুখ মননে তা হয় না।
প্রতিনিধি পেয়ে সই নিধি ত্যাজা যায় না॥
চাতকীর ধারা জল তাহাতে হয় শীতল
সেই বারি বিনা অন্য বারি চায় না॥”
নিধুবাবুর (‘রামনিধি গুপ্ত’) সম্ভবত অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে রচিত এই গানটি প্রায় একবিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় দাঁড়ানো এক মননশীল দ্বিধাগ্রস্ত মানুষের মনের ভার যেন মুহূর্তেই হালকা করে দিল। পৃথু স্তব্ধ বিস্ময়ে চেয়ে রইল কুর্চির মুখে।
পৃথু ভাবছিল, তৈইয়ার দ্যা র্শাদ্যাঁর কথা। রবীন্দ্রানুরাগিণী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো রবীন্দ্রনাথকে মনে করার সময় র্শাদ্যাঁরও মনে করেছিলেন। র্শাদ্যাঁর বলেছিলেন: “নিজেকে যদি বিশ্ব পরিধিতে বাড়িয়ে না নিতে পারে মানুষ, তবে সে আলিঙ্গনও করতে পারে না তার প্রিয়াকে। নারীর মধ্যে দিয়ে পুরুষ তার ছিন্নতা থেকে, তার সংকীর্ণ গণ্ডি থেকে মুক্তি পায়।”
র্শাদ্যাঁর এই কথা ও পড়েছিল, কবি শঙ্খ ঘোষের লেখা ‘এ আমির আবরণ’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে। “রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গান” নামের একটি প্রবন্ধ সংকলনে। কুর্চিই তাকে রায়নায় থাকতে বইটি উপহার দিয়েছিল।
চুপ করে গেলেন যে! গান ভাল লাগল না?
না, ভাবছিলাম, এক একটি গান কেমন করে পুরোপুরি নতুন হয়ে ওঠে কোনও কোনও গায়ক গায়িকার গায়কীতে, তাদের শিক্ষার গুণে, গানের প্রতিটি কথার প্রকৃত তাৎপর্যর গভীরতা হৃদয়ঙ্গম করার যোগ্যতাতেও। আমি যার কাছে এ গান শিখেছিলাম, তাঁর যোগ্য মর্যাদা হয়তো হত না এ গান যখন আমি নিজে গাইতাম। কিন্তু তুমি এই গানকে একেবারে গলিয়ে নিয়েছ নিজের গায়কীর গুণে। তোমার হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশ থেকে উঠেছে বলেই তা এমন করে আমার হৃদয়কে ভাল লাগায় স্তব্ধ করে দিল। নিধুবাবুর নিজেরও হয়তো দুর্ভাগ্য যে, তাঁর এমন গানখানি তোমার মতো গায়িকার গলায় শুনে যেতে পারলেন না নিজে। জানো, আমার মনে হয়, একজন কবি, গীতিকার বা লেখক তাঁর পাঠক-পাঠিকার এবং তাঁর গানের গায়ক-গায়িকার উপর নিজের পূর্ণতার ও সার্থকতার জন্যে অনেকখানিই নির্ভরশীল। একমাত্র তাঁরাই যোগ্য মর্যাদায় এবং যথার্থ অনুধাবনে তাঁর প্রাপ্য পরিপূর্ণ সম্মান দিতে পারেন। একমাত্র তাঁরাই! গায়ক-গায়িকা এবং পাঠক-পাঠিকারা না থাকলে মৃত্যুর পরেও তাঁদের বাঁচিয়ে রাখতেন কারা?
কুর্চি বলল, কী সুন্দর করে বলেন আপনি পৃথুদা! এমন করে কথা কেউ বলে না! আমাকে অন্তত নয়।
পৃথু হাসল, বলল, এমন করে কেউ শোনেও না আসলে তোমার মতো!
“যোগাযোগের” কুমুকে মনে আছে আপনার?
রবীন্দ্রনাথের ‘যোগাযোগ’-এর কথা বলছ?
হ্যাঁ!
পৃথু নড়ে বসল চেয়ারে তার দেড়খানা পা ঢিলে করে দিয়ে। বড়ই আনন্দ হতে লাগল ওর। প্রকৃতির মধ্যে এমন আপন-ভোলা চাঁদ-ভেজা, বে-আব্রু অথচ গা-সিরসির আদরের পর প্রায় ভুলে যাওয়া নিধুবাবুর টপ্পা, তারপর রবীন্দ্রনাথের ‘যোগাযোগ’-এর কুমুর কথা। আশ্চর্যই ‘যোগাযোগ’-এ। একজন পুরুষ একজন নারীর সঙ্গে তো শুধু শরীরী সহবাসের সুত্রেই গাঁথা থাকে না! মনের মিল, রুচির মিলটাই তো আসল! রুষার সঙ্গে বা বিজলীর সঙ্গে সহবাসের পর এমন আলোচনা, এমন পুরোপুরি বাঙালিপনার সুখ মধ্যপ্রদেশীয় পৃথু ঘোষের পক্ষে কল্পনারও বাইরে ছিল। নিজের মাতৃভাষা এবং নিজস্ব সংস্কৃতির কোনও বিকল্প বোধহয় নেই।
কুর্চি বলল, আমার মনে হয় যোগাযোগের কুমুর সঙ্গে আমার যেন অনেকই মিল।
তখন তো বলেছিলে, ‘তিনসঙ্গীর’ ‘শেষকথা’-র অচিরার সঙ্গে মিল?
হ্যাঁ। তাও বলেছিলাম। আপনারই মতো, আমিও তো একটিমাত্র মানুষ নই।
হাসল পৃথু।
বলল, ‘যোগাযোগ’ অনেকদিন আগে শেষবার পড়েছিলাম। আছে তোমার কাছে?
হ্যাঁ। রায়না থেকে নিজে এসেছিলাম একা, কিন্তু টেম্পো করে বই আনতে হয়েছিল পরে। যে বাঙালির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ সব সময় থাকেন না, ‘ক্ষণিকা’ থাকে না, তিনি কী বাঁচবেন? মানুষ কী বাঁচে? মনের যক্ষ্মা হলে?
তা জানি না। এবং এই দূরপ্রবাসের বাঙালিদের কথাই শুধু নয়, শুনতে পাই পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীরাও এখন ডাক্তার, এঞ্জিনীয়ার, অ্যাকাউন্ট্যান্ট, উকিল হবার পর, ভাল চাকরি করার পর, ধনী ব্যবসাদার হবার পর বাংলা বই, বাংলা গানের আর কদর করেন না। বাঙালির সাহিত্য, সংস্কৃতি এখন বাঁচিয়ে রেখেছেন শুধুই মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন-মধ্যবিত্তরা। অন্যরা তো দিব্যি বেঁচে আছেন।
সে রকম বেঁচে থাকাকে কী বেঁচে থাকা বলে পৃথুদা? বাঁচবেন কী তারা?
তাঁরা ঠিকই বাঁচবেন। তাঁদের বাঁচা বলতে যে শুধুই ভাল-থাকা, ভাল-খাওয়া; নিজেদের ছেলেমেয়েদের ভাল-থাকা এবং ভাল-পরার যোগ্য করে তোলার সাধনাতে মগ্ন থাকা। বাঙালি হয়তো বেঁচেবর্তে থাকবে আরও বহুদিনই কিন্তু বাঙালিয়ানা বোধহয় বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোথাওই বেঁচে থাকবে না।
বাংলাদেশ মানে?
বাংলাদেশ মানে, আগের পূর্ব-পাকিস্তান। তাঁরা তো ভাষাকে ভালবাসার জন্যে বুকের রক্ত, নারীর সম্মান সবই দিয়েছেন। রক্তর মুল্যে যা-কিছুই কেনা যায়; তা থাকেই। মণি চাকলাদারদের সঙ্গে তো আমার এই নিয়েই তর্ক লাগত। ওঁরা কেবল সার্ত্র, ক্যামু, ব্রেশটদের মহৎ বলে জানেন। ওঁদের মতে রবীন্দ্রনাথের নাকি সত্যিকারের কোনও প্রভাবই নেই পরবর্তী লেখককুলের উপর।
তাইই? তো ওঁরা নিজেরা কী লিখলেন?
সে ওঁরাই বলতে পারবেন। আমি তো অশিক্ষিত এঞ্জিনিয়র, বাংলা বানান পর্যন্ত শুদ্ধভাবে লিখতে জানি না। আমি কি তর্কে পারি ওঁদের সঙ্গে?
শুধুই বানান জানলে, বড়জোর কোনও স্কুলে বাংলা ব্যাকরণ পড়ানো যেতে পারে। শুধুমাত্র বানান জ্ঞানেই তো আর কেউ লেখক হন না!
যাকগে! যাক এসব কথা। তবে, এইটুকু জানি যে, আমার না শেখা হল লেখা; না ব্যাকরণ!
এমাঃ। দেখেছেন? একদম ভুলে গেছি। আপনাকে চমকে দেব বলে আপনার জন্যে আমি একটা জিনিস এনেছি। মানে,আনিয়েছিলাম, কুন্তীর বরকে দিয়ে।
কী?
রাম। ভালবেসে খান আপনি। ওয়াইন গঙ্গার কাছে বসেই তো ওয়াইন…
বোকা কোথাকার। রামটা ওয়াইন-এর মধ্যে পড়ে না। মনে মনে বলল, ভালবেসে তো তোমাকেও খাই। ভালবাসার জিনিস সবসময় খেতে নেই। ভালবাসা মরে যায় তাতে।
যাই, নিয়ে আসি। কত্ব যত্ন করে আনলাম, পুরনো শাড়ি মুড়ে, পাছে বাসের ঝাঁকুনিতে ভেঙে যায়!
বলেই, উঠল কুর্চি। চৌকিদারকে একটি গ্লাস এবং জলের জাগ দিতে বলে।
তুমি খাবে না?
আমি? আমি তো খাই না এসব।
একদিন খেয়ে দেখতে পারো।
তার জন্যে নয়, কত কিছুই তো খাই না। সব ব্যাপারেই আমাদের মিল থাকুক তা আমি চাই। বলে, ঘরে গেল।
পৃথু ভাবছিল। না খাওয়াই ভাল। রুষাও আগে কুর্চির মতোই ছিল। এখন, মনে হয়, যাকে বলে অ্যালকোহলিক তাইই হয়ে গেছে। নেশাকে মানুষ পেতে পারে কিন্তু কোনও নেশা মানুষকে পেয়ে বসবে এটা পৃথুর পছন্দ নয়। ও খায় না এমন বিষ নেই, অথচ এটা না হলে চলে না, ওটা না হলে নয়, এমন কোনও ব্যাপারই নেই।
কুর্চি ফিরে এল। রয়্যাল রিসার্ভ রাম-এর একটি ছোট বোতল নিয়ে।
খুলল পৃথু।
কুর্চি নাক কুঁচকে বলল, কী বিচ্ছিরি গুড় গুড় গন্ধ। খান কী করে এগুলো?
পৃথু হেসে উঠল বলল: ঢাক ঢাক; গুড় গুড়।
ওরা দুজনেই হো হো করে হেসে উঠল।
ভাঁটু কিন্তু এসব খেত না। কুর্চি বলল হাসি থামলে।
কী খেত ও?
হুইস্কি। কী একটা স্পেশ্যাল যেন। ডিরেক্টরস স্পেশ্যাল।
যে স্পেশ্যালই হোক, দিশি হুইস্কি সহ্য হয় না আমার।
কুর্চি বলল, দাঁড়ান না, আমি তো বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে কনট্রাক্ট করছি। আমার ব্যবসা দাঁড়িয়ে যাবে অল্পদিনের মধ্যেই। বড়লোক হয়ে যাব আমি। তখন আমিই আপনাকে স্কচ খাওয়াব।
কোথায় পাওয়া যায় তা তো আমি জানি না। আমি টাকা দেব; আপনি জোগাড় করে নেবেন।
হাসল পৃথু। অভিভূত হয়ে।
এমন রাতে টুসুটা সঙ্গে থাকলে বেশ হত। রাতের পাখি চেনাত ওকে, ডাক শুনিয়ে শুনিয়ে। কিছু কিছু পাখি দিনে এবং রাতেও ডাকে। কিন্তু কিছু পাখি শুধুই রাতের।
ফিরে এসে কুর্চি বলল, পৃথুর রাম-এর গ্লাসে জল ভরে দিয়ে। যোগাযোগের কথা কেন বলছিলাম জানেন?
কেন?
যোগাযোগের বিপ্রদাস, কুমুকে কিছু কথা বলেছিলেন। আজ গানের মধ্যে দিয়ে, এই রাতের মধ্যে দিয়ে, আমার আর আপনার এই কাছাকাছি আসার মধ্যে দিয়ে কুমুকে আমি যেন আজ ছাপিয়ে গেলাম। ওর স্বপ্ন সত্যি হয়নি। আমারটা হল। ওর প্রার্থনার প্রিয়তমর কাল্পনিক আদর্শকে অন্তরের মাঝখানে রেখে কুমু তার নিজের হৃদয়ের খিদে মেটাতে চেয়েছিল, তাই-ই বোধহয় নানারকম পুজো, ব্রত, পুরাণ কাহিনী এই সমস্ত দিয়েই সে তার কল্পনার মূর্তিটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইত। তার প্রেম, গড়িয়ে গেছিল পূজোতে। কিন্তু তবুও তো হল না। অবশ্য সত্যিকারের ভালবাসা পেল না বলেই যে তার প্রেম ব্যর্থ হয়ে গেছিল তাও নয়। যদিও অনেকের ক্ষেত্রেই অবশ্য পাওয়া হয়ে উঠলেই, তার প্রেম ব্যর্থ হয়ে যায়।
একটু চুপ করে থেকে, কুর্চি বলল, দুঃখেরই বলব, কি আনন্দর বলব জানি না তা, কিন্তু কথাটা এইই যে, কুমু নিজে ভালবাসতে পারল না বলেই তার প্রেম ব্যর্থ হল। আমি কিন্তু পেরেছি ভালবাসতে। ভালবাসা কাকে যে বলে, তা না জেনেই পায় অনেকে কিন্তু ভালবাসতে কজন পারে, বলুন? সব আনন্দ তো ভালবাসতে পারারই মধ্যে। আমার মতো সুখী কজন হয়?
পৃথু, বাঁ হাত দিয়ে পাশে-বসা কুর্চির ডান হাতখানি টেনে নিল।
‘যোগাযোগ’ উপন্যাসে বিপ্রদাস কুমুকে বলেছিলেন, “তুই মনে করিস আমার কোনও ধর্ম নেই। আমার ধর্মকে কথায় বলতে গেলে ফুরিয়ে যায়, তাই বলি নে। গানের সুরে তার রূপ দেখি, তার মধ্যে গভীর দুঃখ আনন্দ এক হয়ে গেছে; তাকে নাম দিতে পারিনে।”
জানেন পৃথুদা, আসলে এইই ধর্ম হয়তো আপনারও। আপনি আর যা-কিছুই হোন না কেন, গান আর প্রকৃতি এই দুই নিয়েই আপনার আসল জীবন। এবং, হয়তো কবিতাও।
অথচ সারাজীবন…। বিপ্রদাস যোগাযোগেরই আরেক জায়গায় কুমুকে বলছেন “সংসারে ক্ষুদ্র কালটাই সত্য হয়ে দেখা দেয় কুমু, চিরকালটা থাকে আড়ালে; গানের চিরকালটাই আসে সামনে ক্ষুদ্র কালটা যায় তুচ্ছ হয়ে। তাতেই মন মুক্তি পায়।”
পৃথু চুপ করে রাম-এর গ্লাসে বড় চুমুক দিল একটা।
ওর মনে পড়ল, র্শাদ্যাঁরই মতো রবীন্দ্রনাথও বলতেন যে, “মানুষ মুক্তি পায় বিশ্বের দিকে, আর বিশ্ব তো কেবলই জায়মান, কেবলই সঞ্চরমান, অপূর্ণ কেবলই, তাই ভালবাসার জন্য মানুষের সামনে পড়ে থাকে নিরন্তর এক আত্মনির্মাণ। এই নির্মাণেরই জন্য হয়ত র্শাদ্যাঁও বলেছিলেন, আমাদের আহ্বান করছে বিশ্বের এক সংগীত, জাগিয়ে তুলছে আমাদের ভিতরকার এক সুর। এই সংগীতের নাম র্শাদ্যাঁর কাছে ছিল ওমেগা। এক আনন্দকিরণ। ওমেগা, ইন হুইচ ওল থিংগস্ কনভার্জ, ইজ রেসিপ্রোকালি দ্যাট; ফ্রম হুইচ ওল্ থিংগস র্যাডিয়েট্। নিজের নিজের সত্তার বিশেষ বিশেষ স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে এই “ওমেগার” বা এই আনন্দকিরণ বা বিকিরণের সঙ্গেই মিলতে চাই আমরা সকলেই।”
চুপ করে যে? কী হল আবার? আপনাকে নিয়ে পারি না। সত্যিই একটি পাগল আপনি। কি? হলটা কী আপনার?
ভাবছি।
ভাবনা কী দেখানো যায় না আমাকে? কোনওক্রমেই?
হাসল পৃথু।
এতদিন তার ভাবনা দেখানোর মতো যোগ্য মানসিকতার মানুষ সত্যিই একজনও ছিল না ওর জীবনে। তাইই বলত, ভাবনা দেখানো যায় না। এখন হয়তো তা বলবে না আর। ভাবনাও এখন থেকে দেখানো যাবে।
মুখে বলল, পরে বলব, কী ভাবছিলাম। এখন আর একটা গান শোনাও তো!
গান?
একটু ভেবেই বলল, অতুলপ্রসাদের গান গাই একটা?
কুর্চি ধরল: আমি বাঁধিনু তোমার তীরে, তরণী আমার/একাকী বহিতে তারে পারি না যে আর।
প্রভাত হিল্লোলে ভুলে দিয়েছিনু পাল তুলে/ভাবিনি সহসা হবে এমন আঁধার/আমি বাঁধিনু তোমার তীরে, তরণী আমার/…
এখনও যা কিছু আছে তুলে লহো তব কাছে/রাখো এই ভাঙ্গা নায়ে চরণ তোমার/
আমি বাঁধিনু তোমার তীরে তরণী আমার/
আবারও প্রকৃতি যেন উন্মুখ, উৎকীর্ণ, উৎসুক হয়ে উঠল এই ছমছমে নির্জনতায় কুর্চির গান শুনে। ঘাসের মধ্যে সাপ থামিয়ে দিল তার সর্পিল চাল। থমকে গেল গুঁড়ি-গোড়ায়, সাদা-রঙা সুন্দরী জংলি ইঁদুর। মুগ্ধ চোখ তুলে চাইল জাবর-কাটা মিষ্টি-গন্ধী হরিণী, জঙ্গলের গভীরের প্রান্তর থেকে, যেখানে নিশি-ডাকা গভীর রাতে জিন পরীরা খেলতে নামে। পৃথু, মন্ত্রমুগ্ধর মতো গান শুনছিল। ওর বিষণ্ণ, অনেকদিন ধরে বড় ক্লান্ত, অবসন্ন উদ্দেশ্যহীন মন ভাবছিল, সীওনী থেকে এবারে চলে যাবে অন্য কোনও জায়গায় কুর্চিকে নিয়ে, যেখানে কেউই আর তাদের খুঁজে পাবে না। এতদিন শুধুই নিঃশ্বাস ফেলেছিল আর প্রশ্বাস নিয়েছিল। এবারে বাঁচা যাকে বলে তেমন করেই বাঁচবে। ‘বেটার লেট দ্যান নেভার।’
রুষাও কি এমনই ভেবেছিল? কে জানে?