2 of 2

৬৫. বেশ গরম পড়ে গেছে

৬৫

বেশ গরম পড়ে গেছে। তবে সীওনীতে গরম অসহ্য লাগে না। তবু, ক্রাচ-এ ভর করে এতখানি হেঁটে এসে ক্লান্ত বোধ করে আজকাল।

অফিস থেকে ফিরে আসতেই বিগু চিঠি দিল একটা। ভুচুর চিঠি। হাত মুখ ধুয়ে এসে বারান্দায় বসে চিঠিটি খুলল পৃথু।

পৃথুদা,

বিকেলে হঠাৎ রুষা বৌদি এসেছিলেন আমার গ্যারাজে। ওঁর বাঁ গালে পাঁচটি আঙুলের স্পষ্ট দাগ বসেছিল। ফর্সা গালে আগুনের মতো ফুটেছিল কোনও পুরুষের আঙুলের ছাপ। কিসের দাগ, জিগগেস করতে, উনি এড়িয়ে গেলেন। বললেন, তোমাকে একটা চিঠি দিয়েছিলেন, কোনও জবাব পাননি। আমি তোমার কোনও খবর জানি কিনা জানতে এসেছিলেন। আমি যা জানি, তাই-ই বললাম।

কুর্চির কথাও কিন্তু লুকোইনি। বললাম, তোমার সঙ্গে তার দেখা হয়েছে। আমরা যেদিন গেছিলাম সীওনীতে সেদিন এসেছিলেন। গানও গেয়েছিলেন অনেক।

রুষা বৌদির মুখ দেখে মনে হল জানতে চাইছেন তুমি কুর্চির সঙ্গেই আছ কি না! আমি নিজেই বললাম যে, তোমরা আলাদাই থাক তবে দেখা হয় প্রায়ই।

রুষা বৌদিকে এও বললাম, যে, নুরজাহানের বিয়েতে সম্ভবত তুমি আসবে এখানে। শুনে, উনি বললেন, টুসু খুব বাবা বাবা করছে এবং উনি নাকি চান না যে, টুসু ইদুরকারের কাছে আর একদিনও থাকুক। কী হয়েছে তা খুলে কিছুই বললেন না। জোর করে ওঁর কাছ থেকে যে কিছু জানা যাবে, এমন চরিত্রের মানুষ তিনি নন বলেই মনে হল। বললেন, আমি যদি টুসুকে তোমার কাছে পৌঁছে দিয়ে আসতে পারি তাহলে খুবই ভাল হয়। ক’দিন স্কুল কামাই হলেও, হবে। তুমি যখন নুরজাহানের বিয়েতে আসবে পনেরোদিন পর তখন টুসুকে সঙ্গে নিয়ে এসো।

একটু ইতস্তত করে, এও বললেন যে, ইদুরকারের বাড়িতে তোমার যেতে হবে না। এখানে যখন আসবে তখন টুসুকে পৌঁছে দিতে তুমি তোমার পুরনো বাড়িতেই একবার যেও। রুষা বৌদির সঙ্গে দেখাও করে আসতে পারবে। তোমার সঙ্গে কথা আছে ওঁর। ওঁর কথা শুনে যা মনে হল, খুব সম্ভব তুমি এখানে আসার আগেই উনি ফিরে যাবেন ওই বাড়িতে।

পৃথুদা, রুষা বৌদিকে খুবই বিপন্ন এবং আতঙ্কিত দেখাল। আমি আমার আর গিরিশদার ফোন নাম্বার দিয়ে ওঁকে বলেছি যে, কোনওরকম দরকার হলে যেন একটুও দ্বিধা না করে আমাদের ফোন করেন। গিরিশদাকেও সব বলে রেখেছি।

সত্যি কথা বলতে কী পৃথুদা তুমি রুষা বৌদিকে ভালবাসো বলো বটে, আমি কিন্তু ওঁর ব্যবহারের জন্যে ওঁকে ক্ষমা করতে পারিনি। একটা সময় অবশ্যই ছিল যখন তোমার প্রতি ওঁর ব্যবহার আমরা, যারা তোমাকে ভালবাসি তারা কেউই ক্ষমা করতে পারতাম না। অস্বীকার করব না সে কথা। কিন্তু সেদিন ওঁকে দেখে বড়ই খারাপ লাগল। একেবারেই অন্য মানুষ হয়ে গেছেন। ঝড়ে ডানাভাঙা পাখিরই মতো অবস্থা। কোথায় গেছে সেই ঔদ্ধত্য, কোথায় গেছে তাঁর সবজান্তা ভাব; সেই গুমোর!

আমি বললাম, সত্যি করে বলুন তো বৌদি, ইদুরকারই কি মেরেছে আপনাকে? একবার মুখ ফুটে বলুন শুধু! শালাকে শিখিয়ে দিয়ে আসছি। পৃথুদা এখানে না থাকতে পারেন, আমরা এখনও আছি। আপনি এখনও পৃথুদার বিবাহিত স্ত্রী। ডিভোর্স তো হয়নি আপনাদের! আপনার মান-সম্মানের সঙ্গে এখনও পৃথুদার এবং আমাদের সকলের মান-সম্মানের প্রশ্নই জড়িত আছে। আপনার কোনওরকম অপমান আমরা বেঁচে থাকতে হতে দেব না।

রুষা বৌদি যে গালে আঙুলের দাগ ছিল সেই গালটা ফিরিয়ে মুখ নিচু করে বললেন, এ সবের কোনওই দরকার নেই ভাই। অন্যর হাতের মার তো এ নয়, আমার নিজেরই হাতের মার এ। ভাগ্যেরই মার। যে ভাগ্যকে আমি কোনওদিন অস্বীকার করিনি। তবে, এর জন্যে পৃথুর বা তোমাদের কারও কাছেই আমি কোনওরকম সাহায্য চাই না। আমার কোনওরকম অপরাধবোধও নেই। নিজের ভার আমি নিজেই বইতে পারব। প্রত্যেককেই নিজের কৃতকর্মের ফল ভোগ করতেই হয়। যে-সমস্যা আমার নিজেরই তৈরি করা তার সমাধান আমাকে একাই করতে হবে। ও নিয়ে তোমরা ভেবো না। তবে সেরকম প্রয়োজন যদি হয়ই তবে জানাতে দ্বিধা করব না। তোমার দাদাকে এসব কথা জানাবে না। শুধু টুসুকে ওঁর কাছে পৌঁছে দিলেই হবে।

বৌদির কথামত আমি আগামী সপ্তাহে টুসুকে নিয়ে যাব তোমার কাছে। আজ তো বুধবার। ইদুরকারের বাড়ি গিয়ে ভোরবেলা টুসুকে নিয়ে আসতে বলেছেন আমাকে। বলেছেন, ইদুরকারের সঙ্গে আমি যেন কোনওরকম খারাপ ব্যবহার না করি। তাঁর আসল ভয়, নাকি টুসু বা তাঁর নিজের জন্যেও নয়, মিলির জন্যে। মাঝে এক রাতে ইদুরকার নাকি মিলির সঙ্গে অশোভন ব্যবহার করেছিল।

একথা শুনে অবধি আমার তো মাথায় আগুন লেগে আছে। গিরিশদা ছাড়া আর কাউকেই আমি এসব বলিনি। কিন্তু তুমি যদি একবার অনুমতি দাও তাহলে আমাদেরও কারওই কিছু করতে হবে না। তোমার কাছে শামীমের যে ঋণ জমা আছে তা সেই একাই শোধ করতে পারলে খুশি হবে।

যেদিনই যাই না কেন, সন্ধের সময় পৌঁছব টুসুকে নিয়ে। রাতটা থেকে, পরদিনই ফিরে আসব।

তুমি যাই-ই বলো আর তাই-ই বললো, অমন করে আমাদের পর্যন্ত না জানিয়ে হাটচান্দ্রা থেকে তোমার পালিয়ে আসাটা একেবারেই ঠিক হয়নি। সব মানুষের জীবনেই সমস্যা আছে; থাকে। তুমি অন্যদের কত বড় বড় সমস্যার মোকাবিলা নিজের জীবনের ঝুঁকি পর্যন্ত নিয়ে করেছ অথচ নিজের সমস্যা থেকে মুখ ফিরিয়ে পালিয়ে গেলে যে কেন, এই কথাটা আমার মোটা বুদ্ধিতে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারিনি। পালাতে কে না চায়? আমার নিজের তো তেমন কোনও সমস্যাই নেই, তবু আমারই সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে মাঝে মাঝেই পালিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়। পালানোর মধ্যে কোনও লজ্জা নেই। ক্লান্ত ও বিরক্ত হয়েও পালায় অনেকে, অনেকে পালায় অভিমানে, তাও জানি। হয়তো তুমিও সে কারণেই পালিয়েছিলে অমন করে। কিন্তু সমস্যার মোকাবিলা করতে ভয় পেয়ে পালানোটা হান্ড্রেড পার্সেন্ট ভীরুতা। তোমার অমনভাবে পালিয়ে যাওয়াটা আমাদের সকলের কাছেই আশ্চর্য ঠেকেছিল। এখন তো বুঝছ যে, তুমি এখানে থাকলে ব্যাপারটা এতদূর হয়তো গড়াত না। হাটচান্দ্রায় থাকতে চাইলে সীওনীতে যে চাকরি করছ তার চেয়ে বেশি মাইনের চাকরিও সহজে তুমি পেতে। সীওনীতে যাবার আর কী কারণ কিছু ছিল না?

ভুল মানুষমাত্ররই হয়। তাছাড়া ধোয়া-তুলসীপাতা তো তুমিও নও! বিজ্‌লী বাঈজির সঙ্গে তোমার কোনও ব্যাপার থাকতে পারে, আর ইদুরকারের সঙ্গে রুষা বৌদির থাকতে পারে না? রুষা বৌদির ব্যাপারটা প্রথম প্রথম নিছক একটা অ্যাফেয়ারই ছিল। ‘অ্যাফেয়রে’র মধ্যে আমি কোনও দোষ দেখি না। যদিও, তুমি বলতে পারো, আমি এসবের কী বুঝি? আমি নিজে তো বিয়েই করিনি।

বিয়ে না করতে পারি, কিন্তু আমি তোমার মতো রূপোর চামচ মুখে করে জন্মাইনি যে! আমার এই বয়সে জীবনের নানাদিক আমি যতখানি দেখেছি, অন্য বহু মানুষের জীবনে, ইচ্ছা বা অনিচ্ছাতেও যত গভীরভাবে ঢুকেছি তাতে আমার অভিজ্ঞতাও নেহাৎ কম হয়নি। ‘অ্যাফেয়ার’ হয়তো শতকরা ষাট ভাগ বিবাহিত মানুষের জীবনেই থাকে। জীবনের কোনও-না-কোনও সময়ে। তা নিয়ে এতকিছু ঘটে যায় না। আমার তো মনে হয় একটি দুটি অ্যাফেয়ারই হয়তো বিবাহিত জীবনের একঘেয়েমিকে ভরিয়ে তুলে সেই সম্পর্ককে পরিপূর্ণ করে তোলে। ওই ‘অ্যাফেয়ার’ যেন বারান্দার মতো। ঘর হচ্ছে দাম্পত্য। মাঝে মাঝে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে চাঁদ, রোদ, পাখির ডাক, বসন্তর হাওয়া এসব একটু গায়ে লাগিয়ে গেলে ঘরটাকেই হয়তো সুন্দর করে তোলা হয়। নতুন চোখে দেখা যায় তাকে। ফিকে-হয়ে-আসা ভাল লাগাকে রিনিউ করা যায়।

পৃথুদা, আমরা তোমার বন্ধু, তাই তোমার পক্ষ সমর্থন করা আমাদের কর্তব্য। দোস্তির জন্যে দোস্ত জান-কবুল করতেও রাজি থাকে। তুমি যেমন নুরজাহানের কারণে, শামীমের জন্যে করেছিলে। কিন্তু তা বলে তুমি তো একথা অস্বীকার করতে পারো না যে, তুমি অনেকদিন থেকেই কুর্চিকে ভালবাসতে। রুষা বৌদির মত বুদ্ধিমতী মহিলার কী সেটুকু বুঝে নিতে অসুবিধা হত বলে মনে করেছিলে তুমি? তোমার উইশফুল থিংকিং-এ? আমার মতো মোটা-মাথার মানুষই যদি তা প্রথম দিন কুর্চিকে দেখেই বুঝে থাকতে পারে তখন শিক্ষিতা রুষা বৌদির বুঝতে দেরি হয়েছিল বলে তো আমার মনে হয় না। যে যত গভীর, যার আত্মসম্মান যত বেশি তাকে বাইরে থেকে বোঝা হয়তো ততই কঠিন। রুষা বৌদিকে তোমার আশ্চর্য ব্যবহারে যে তুমিই ধীরে ধীরে ইদুরকারের দিকে ঠেলে দাওনি তা কী তুমি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারো পৃথুদা?

একজন স্ত্রী আর একজন পুরুষ অনেকই কল্পনায় ঘর বানায়। আর খাটাশের মতো শেয়ালের মতো ইদুরকারেরা সেই ঘর ভাঙবার জন্যে ছুক ছুক করে ঘুরে বেড়ায়। সাপের মতো সেই ভালবাসার বাসায় পৌঁছে অনেক সাধ দিয়ে তৈরি ডিম খেয়ে যায়। তাদের থাবার হাঁচোর-পাঁচোর আঁচড়ে বাসা ভেঙে যায়।

আমি তো বলব, দোষ সব তোমারই। তুমি রাগই করো আর যা-ই করো।

তুমি যখন সবসময় সঙ্গে থাকতে, আমি তখন তোমারই ছায়া হয়ে ছিলাম। তোমার মধ্যেও যে কোনও দোষ থাকতে পারে, তা বিশ্বাস করা তো দূরের কথা, বোঝার ক্ষমতাও পর্যন্ত ছিল না আমার। তুমি আমাকে এমনইভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।

অবশ্য এ কথাও ঠিক, তুমি হয়তো এমন হয়ে যেতে না যদি না সাবীর সাহেব, শামীম, আমি গিরিশদা এবং দিগা গাঁড়ে এমনকি ঠুঠা বাইগাও না থাকত বা থাকতাম। সাবীর সাহেব তাঁর একাধিক বিবি নিয়ে ঘর করেছেন। শামীম এখনও করছে। তাদের জীবন উপচে-পড়া জীবন। স্বাধীনতাহীন বোরখা-পরা বিবিদের সঙ্গে আর তাঁদের বাড়ির আসবাবের সঙ্গে কোনও তফাৎই ছিল না। তোমার দাম্পত্যর ব্যাপার আর ওদের ব্যাপার আলাদা আলাদা। কিন্তু রুষা বৌদি তো আর তেমন বিবি নন তোমার।

আমি, গিরিশদা, ঠুঠা এবং লাড্ডু সকলেই আজও ব্যাচেলার। তোমার জঙ্গলের শখ, তোমার বাউন্ডুলেপনাকে আমরা হয়তো শুধু উস্কেই দিয়েছি। হয়তো, শুধু ক্ষতিই করেছি তোমার। না-বুঝে। তুমি যে একজন শিক্ষিতা, ব্যক্তিসম্পন্না মহিলার স্বামী, দুই ছেলেমেয়ের বাবা একথা সম্বন্ধে তুমি নিজে যতখানি না অচেতন ছিলে আমরা তোমাকে তার থেকেও বেশি অচেতন এবং কাণ্ডজ্ঞাহীন করে দিয়েছি। এটা আমাদেরই দোষ।

আর তোমার দোষ হচ্ছে, তুমি মিলি-টুসুর বাবা, রুষা বৌদির স্বামী হয়েও কোনওদিনও বুঝতেই চাওনি যে, বিবাহিত মানুষের জীবনযাত্রায় অনেক বাধা-নিষেধ থাকে। বাবার সম্মান ও ভালবাসা পেতে হলে তাকে অনেক কিছু ছাড়তেও হয়। বিয়ে মানেই, নিজের নিজস্বতার খেলায়খুশির অনেকখানিই সারেন্ডার করে দেওয়া, তাই-ই না যে-কারণে বিয়ে করার কথা হয়তো ভাবতেও ভয় করে আমার। তুমি বিবাহিত হয়েও অবিবাহিতই ছিলে। মনে করতে, টাকা দিলেই সব কর্তব্য করা হয়। তুমি কুর্চিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে। সেই-ই তোমার সব ছিল। এতই যদি ভালবাসতে তাকে তো প্রথমেই বিয়ে করলে না কেন? রুষা বৌদির কী দোষ? তাকে তো তুমি সম্বন্ধ করেই বিয়ে করেছিলে। তুমি তো কুর্চির স্বপ্ন নিয়েই থাকতে পারতে কবি হিসেবে। কবিদের ব্যাপার-স্যাপার তো আলাদা হয়। কিন্তু শুধু কুর্চিতেও তো তোমার কুলোল না। বিজ্‌লীর মতো রাণ্ডির কাছেও তো তুমি যেতে। তোমাকে বোঝা আমার সাধ্য নয়। শুধু আমারই বা কেন, কারওরই সাধ্য নয়!

তোমার মতো কমপ্লিকেটেড, কনফিউজড মানুষ আমি আরও দু-একজনকে দেখেছি আমার জীবনে। যাদের জীবনে শিশুকাল থেকে কোনও সত্যিকারের সমস্যা থাকে না, তারাই এমন সমস্যা তৈরি করে নিতে ভালবাসে। তোমাদের বিলাসটা, বেদনারই বিলাস। বাস্তবের সঙ্গে এর কোনও মিলই নেই। ভেবে দ্যাখো, কুর্চিকেই বা তুমি কোন সুখটা দিলে? সে তোমাকে ছোটবেলা থেকে ভালবাসত, তুমিও বাসতে তাকে; তবু যে মানুষটার দশ বছর বয়স থেকে বাঘ-মারার সাহস ছিল তার একটি মেয়েকে বিয়ে করার সাহস হল না পরিবারের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে? কুর্চির যদিবা বিয়ে হল, খারাপ হোক, যাই-ই হোক, তার স্বামীকে নিয়ে তো সাদা-মাটা সুখে ঘর সে করছিল। তুমি তার সব সুখকেও নষ্ট করে দিলে। নষ্ট করে দিলে তার জীবনও। তোমাকে টেক্কা মারার জন্যে বেচারি ভাঁটু স্মাগলিং শুরু করল। এবং জেলে গেল। তাকে জেলে পাঠাবার জন্যেও তুমিই পরোক্ষভাবে দায়ী। ভাঁটুকে জেলে পাঠিয়ে, রুষাবৌদিকে ইদুরকারের কাছে ঠেলে দিয়ে, তুমি এখন কুর্চির সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক পাতালে। এবং সম্পর্কটা শুধুমাত্র মনেরও নয়। তোমাদের শারীরিক সম্পর্কও আছে বলে আমার দৃঢ় ধারণা। সীওনীতে কুর্চির চোখ দেখেই আমার সে কথা মনে হয়েছিল। শারীরিক সম্পর্ক তোমার সঙ্গে না হলে তার চোখে অমন নির্ভরতা আর খুশির ভাব থাকত না।

আমি যদি ভুল বলে থাকি, তাহলে আমাকে ক্ষমা করো।

তুমি হয়তো আমার উপর বিরক্ত হতে পারো। রাগও করতে পারো। কিন্তু আমার কিছুই করার নেই। তোমাকে আমি আমার আদর্শ পুরুষ বলে মেনে নিয়েছিলাম। সব দিক দিয়েই। এখানে থাকতে, তোমার ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে কোনও আলোচনা করার মতো সাহস বা প্রবৃত্তিও আমার হয়নি কখনও। কিন্তু আজ তোমার পারিবারিক বা ব্যক্তিগত জীবন তো আর তোমার একার নেই। নুরজাহানকে যেদিন মগনলালরা তুলে নিয়ে গেছিল শামীমের ব্যক্তিগত জীবন যেমন তার অজানিতে এবং তার বিনা অনুমতিতে আমরা নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে আমাদের মনোমত ফয়সালা করেছিলাম আজ তেমনই তোমার জীবনও হাতে তুলে নেবার সময় এসেছে আমাদের। রুষা বৌদির গালে যদি ইদুরকারের হাতের আঙুলের ছাপ দেখি, যদি শুনি যে, টুসুর পক্ষে এখানে থাকা বিপজ্জনক, যদি জানি যে, সেই শুয়োরের বাচ্চা মিলির প্রতিও লোভ দেখাচ্ছে তবুও আমরা বেঁচে থাকতে তোমার মতো একজন অপদার্থ মানুষের হাতেই কি তোমার ব্যক্তিগত জীবনের ভার ছেড়ে রাখা আমাদের উচিত? তুমি আমাদের অবস্থায় পড়লে কী করতে? মানুষ, সে যত ক্ষমতাবান ব্যক্তিই হোক না কেন, তার জীবনের সব সমস্যার মোকাবিলা একহাতে হয়তো কোনও মানুষই করতে পারে না। করা, অসম্ভব বলে। এবং সেই কারণেই তার বন্ধু-বান্ধব, এবং সমাজকে প্রয়োজন হয়ে পড়ে কখনও কখনও। আমি তো এইই বুঝি।

যাই-ই হোক, চিঠি অনেকই লম্বা হয়ে গেল। এ চিঠি পড়ে তোমার খুশি হবারও কথা নয়। তবু, এটুকু জানো যে, যেদিন তোমাকে নিন্দা করবার মতো একজন মানুষও থাকবে না তোমার জীবনে, সেদিনের মতো দুর্দিন আর নেই। বন্ধুত্ব বা আত্মীয়তাকে আমি যেটুকু জেনেছি, তা হচ্ছে মুখোশেরই কারবার। যে সব বন্ধু বা আত্মীয় তোমার সামনে তোমার প্রশংসাই করে শুধু, অথবা তোমার সবকিছু সম্বন্ধেই উদাসীন থাকে তারা তোমার কেউই নয়। তাদের চেয়ে খোলাখুলি শত্রুরাও ঢের ভাল, মানে যাদের তুমি শত্রু বলে চিনতে পারো। সেই শত্রুদের জানা যায়। তারা সৎ। বন্ধুবেশী শত্রুদের কাছ থেকে বিপদটা অনেক বেশি। তুমি ভাগ্যবান, যে আমাদের মতো বন্ধু তোমার এখনও কয়েকজন আছে।

শেষ করলাম। আগামী সপ্তাহে দেখা হবে।

ইতি, ভুচু।

পি. এস.-এ সপ্তাহেই টুসুকে নিয়ে যেতাম। হাতে কতগুলো জরুরি কাজ পড়ে আছে। হুদাও জ্বরে পড়ে আসছে না। তাই-ই—।

বিগু চা রেখে গেছিল টি-পটে করে। ঢেলে দেখল পৃথু, ঠাণ্ডা হয়ে গেছে একেবারে। দড়ি টেনে ঘণ্টা বাজাল। বিগু এলে, তাকে আবার ও চা আনতে বলল।

বিগু বলল, পরোটাও তো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। গরম করে আনব?

নাঃ। ওগুলো নিয়ে যা। ঠুঠা আর তুই খেয়েছিস?

আমরা তো অনেকই দেরি করে খাই দুপুরে। খিদেই পায় না বিকেলে।

তবু, আজ এগুলো তোরা খেয়ে নে। শুধু চা-ই নিয়ে আয় আমার জন্যে।

বিগু চলে গেলে, পৃথু বাইরের অন্ধকারে চেয়ে রইল। আগুন লেগেছে দূর পাহাড়ে। দাবানলমালার মতো জড়িয়ে আছে আগুন পাহাড়গুলোর গায়ে। কোথাও বা ছেঁড়া-মালার মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে; গড়িয়ে যাচ্ছে পাহাড়চুড়ো থেকে উপত্যকার দিকে। হাওয়া ছুটে যাচ্ছে সেদিকে। শূন্য পূর্ণ করার জন্যে। তাতে আরও জোর হচ্ছে আগুন। বনের জানোয়াররা ছুটে পালাচ্ছে। আগুনের বেষ্টনীর মধ্যে আটকা পড়ে যাবার ভয়ে। তাদের ভয়ার্ত সেই দৌড়-ঝাঁপ এতদূর থেকে দেখা যাচ্ছে না কিন্তু অনেকবারই খুব কাছ থেকে দেখেছে এই দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য পালানো ওঁদের। তাই স্পষ্ট অনুমান করতে পারছে পৃথু।

পৃথুর নিজেরও চারপাশে যেন জীবনের আগুন মালারই মতো ঘিরে ফেলেছে ওকে ধীরে ধীরে। কিন্তু ও যেহেতু জানোয়ার নয় তাই দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে না ছুটে, ভাববার চেষ্টা করছে চুপ করে বসে। জঙ্গলের দাবানলের বলয় থেকে জানোয়ারেরা মুক্তি পায় সহজেই কিন্তু মানুষের জীবনের নানা ধরনের কষ্টর আগুনের লেলিহান শিখা থেকে পালানো অত সোজা নয়। জীবনের কোনও না কোনও সময়ে প্রত্যেক মানুষকেই সেই আগুনে ঝলসেই যেতে হয়। একবারও না পুড়ে জীবনে বেঁচেছে এমন ভাগ্যবান মানুষ খুব বেশি নেই। চিতায় যখন পোড়ে তখন তো বোধ থাকে না কোনও। জীবন্ত অবস্থায় এই অদৃশ্য আগুনের হাতে দগ্ধ হওয়া বড়ই যন্ত্রণার। মানুষ ছাড়া অন্য কোনও জানোয়ারই এই আগুনের কথা জানে না।

আশ্চর্য! ভুচুটাও এত কিছু ভাবে! এমন করে বলতে পারে তার ভাবনার কথা। অথচ স্কুল-কলেজে লেখাপড়া সে শেখেইনি। জীবন থেকে মানুষ যা শেখে, যার শেখার ইচ্ছা আছে, সুযোগের অভাব সেই সব মানুষের পথে বোধহয় কখনওই প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারে না।

লজ্জা হল পৃথুর ভুচুর চিঠিটা পড়ে। একটু রাগও যে হল না তাও নয়। তাহলেও ক্ষমা করে দিল ভুচুকে। ভুচু তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ধরে। এই চিঠি, ভুচু নিজের কোনও স্বার্থসিদ্ধির জন্যে লেখেনি, পৃথুকে ভালবাসে বলেই লিখেছে। আজকের পৃথিবীতে অন্যর ব্যাপার নিয়ে এমন আলোড়িত হতেই বা কজন মানুষ চায় বা পারে? বন্ধুভাগ্যে পৃথু সত্যিই ভাগ্যবান। তবু, অনেক জানা থাকে, যা শুধুমাত্র বুদ্ধি বা অভিজ্ঞতা দিয়েই জানা যায় না। যে সব ব্যাপার ভুচুর বোঝাবুঝির বাইরে। শুধু ভুচুরই বা কেন? হয়তো অনেকেরই বোঝাবুঝির বাইরে।

দাম্পত্য একটা এমনই সম্পর্ক যে, সেই সম্পর্কর পূর্ণতা বা শুন্যতা তারা দুজন ছাড়া এক বাড়িতে থেকেও অন্যের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। ভুচু অনেকই বোঝে। কিন্তু সব বোঝে না।

দিগা পাঁড়ের তুলসীদাসী ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়: “কর্মঠ পীঠ জামহি বরু বারা?” কচ্ছপের পিঠে কী কখনও চুল গজায়? যেমন গজায় না; পৃথু ঘোষের মস্তিষ্কেও তেমন অন্য দশজন মানুষের মতো সহজ, সাধারণ, সুস্থ বুদ্ধি গজাবে না। ও যে সহজে সুখী হতে পারল না। মোটামুটি খেয়ে পরে, সন্ধেবেলায় টি.ভি.-র সামনে স্ত্রীর সঙ্গে বসে, চাকরির উন্নতির চিন্তা, ছেলেমেয়ের ভবিষ্যতের আলোচনা, নিজের রিটায়ারমেন্টের পরের সুখী জীবনের জল্পনা কল্পনা ওর দ্বারা এসবের কিছুই তো হল না। ও মানুষপদবাচ্যই নয় হয়তো। ও নিজেকেই বোঝে না ভাল করে, ও যে কী তা অন্যকে বোঝাবে কী করে?

ইদুরকারকে যদি শিক্ষা দিতে হয় তো ভুচুরাই দিক; রুষা নিজেই দিক। রুষাকেও যদি শিক্ষা দিতে হয়, তবে রুষা নিজেই তা দিক নিজেকে। পৃথুর ব্যক্তিগত ফায়দার জন্যে, ওর আমিত্বর অবমাননার জন্যে সে নিজে কারও বিরুদ্ধেই জেহাদ ঘোষণা করবে না। ঈশ্বর আছেন কী নেই তা ও জানে না। থাকলে, তাঁকে বলত, ঈশ্বর! তুমি সাক্ষী; যা-কিছুই আমার জীবনে ঘটেছে, পাওয়া বা হারানো, পেয়ে-হারানো বা হারিয়ে-পাওয়া সে সবই তোমারই ইচ্ছায়। জীবন যেমন যেমন তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তেমনইভাবে সে তাকে গ্রহণ করেছে। জীবনকেও হাতুড়ি-ছেনি দিয়ে গড়েপিটে নেয়নি, নিজেকে তো নয়ই! জীবনের আবর্তে এই অবগাহন স্নানে আনন্দ যেমন; দুঃখও তেমনই। আর তো ফিরে আসবে না এখানে। একবারই মাত্র। “ওনলী ফর ওয়ান্স”। সায়ানাইড কেমন খেতে তা যেমন যাঁরা খেয়েছেন তাঁদেরই কেউই নাকি বলে যেতে পারেননি, জীবনের স্বাদও যে ঠিক কেমন তাও বোধহয় সঠিক কেউই বলতে পারেননি আজ অবধি; অন্যর অবগতির জন্যে। জীবনর সঙ্গে সব মানুষই অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। জীবনের সঙ্গে এক ধরনের পার্থক্য রেখে, দূরত্ব রেখে, জীবনের স্বরূপ খোঁজারই চেষ্টা করে এসেছে পৃথু চিরদিন। দোষ সবই তার। অস্বীকার করে না। কারণ, সে অন্য দশজনের মতো নয়। তবে, তার এই দৃষ্টিভঙ্গিতে জীবনকে তার চোখ দিয়ে দেখার নতুন এক চেষ্টাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মর কিছু মানুষ হয়তো জীবন সম্বন্ধে নতুন করে ভাববেন। জীবনের ভারে চাপা পড়ে, জীবনের স্রোতে অপারগ হয়ে হাবুডুবু খাওয়া আর নিজের ইচ্ছায়, নিজের শর্তে বেঁচে থাকাটা যে সমার্থক নয়, তা আগামী প্রজন্মের মানুষরা নিশ্চয়ই বুঝবেন।

আপাতত সব অপরাধ, সব অনুযোগ, সব দোষই মাথা পেতে মেনে নিচ্ছে সে। সে সম্পূর্ণই নির্গুণ। জাগতিকার্থে কোনও কিছু পাওয়ারই যোগ্যতা হয়তো তার নেই। হয়তো আকাঙক্ষাও নেই। তার কথা, সে শুধু নিজেই জানে। অন্যর কাছে নিজেকে পূর্ণ আলোয় প্রতিভাত করার ইচ্ছেও বোধ করেনি কখনও। তা করার ক্ষমতাও রাখে বলে মনে হয় না। যে যতটুকু জানল, জানল; যে চেহারায় তাকে দেখল বা যে আলোয় বুঝল তাই-ই যথেষ্ট। যার যতটুকু প্রয়োজন, তার অন্তরঙ্গ একাকি সত্তার গা থেকে, ঝুলিয়ে রাখা ভেড়ার মৃতদেহর মতো এক একজনে তাকে টুকরো করে কেটে নিয়ে গেছে চেখে পরখ করে দেখার জন্যে। মৃত, অখণ্ড ভেড়াটারই মতো, সম্পূর্ণ মানুষটাকেও এই জীবনের খুচরো ক্রেতাদের কারওই প্রয়োজন হয়নি। রান্না করে যার যার নিজের পাত্রে তা পরিবেশন করে বলেছে: মাটন। কেউ ঝাল দিয়ে রেঁখেছে, কেউ মিষ্টি নিয়ে; কেউ বা স্ট্যু বানিয়েছে রোগীর পথ্যরই মতো। সেইটুকু খেয়েই ভাল বা মন্দ ভেবেছে। অখণ্ড, সম্পূর্ণ মানুষটা সম্বন্ধে কোনও ধারণার কাছাকাছি কেউ আসেনি। এই বাজারে পাইকাররা অনুপস্থিত। সবই খুচরো খদ্দের। অংশই পূর্ণ বলে চলে এখানে।

খসস খসস শব্দ করে অন্ধকার বারান্দায় ভালুকের মতো ছায়া ফেলে ঠুঠা এসে দাঁড়াল।

পৃথু বলল, বোসো, ঠুঠা বোসা। বলে, সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে দিল ওকে।

অন্য দিন ঠুঠা বসে না। আজ কেন যেন বসল।

বিগু চা নিয়ে এল।

আরও একটা কাপ আনতে বলল, বিগুকে।

বিগু কাপ না এনে একটা কলাইকরা গ্লাস নিয়ে এল।

পৃথু বিগুকে বলল, কাপ আনতে বললাম যে!

ঠুঠা দুদিকে মাথা নাড়ল।

বিগু বলল, আমরা চা খাই খুবই গরম। কষে, দুধ চিনি দিয়ে। গ্লাসে খেলে, চা অনেকক্ষণ গরম থাকে।

পৃথু আর তর্ক করল না। বিগু বলল, ঠুঠাদার চা আমি আলাদা করে বানিয়ে এনে দিচ্ছি। আপনার এই ট্যালটেলে চা খেয়ে কোন সুখ হবে তার।

ছেলেটা বড় বেশি সপ্রতিভ। কথার ফুলঝুরি ফুটোয় সে সব সময়। তবু, এই বাড়িতে, কথা বলার লোক তো এখন একমাত্র বিগুই। ঠুঠা তো কথাই বলে না। পৃথুও নিজের সঙ্গেই বলে। সেকথা শোনা যায় না।

চা খেতে খেতে পৃথু বলল, কেমন আছো ঠুঠা? ঠিক করলে কিছু? দেবী সিং-এর গ্রামে গিয়ে থাকলে কী তুমি বেশি খুশি হও? যাবে সেখানে? আমার জন্যে তোমার সমস্ত জীবনটাই তো খোয়া গেল।

অত বেশি কথা ঠুঠা বাইগা পছন্দ করে না। আঙুল দিয়ে চিঠিটাকে দেখাল। ওর চোখ দুটো লণ্ঠনের আলোয় ঝকঝক করে উঠল, মাংসাশী কোনও জানোয়ারের চোখের মতো।

বলল, কী আছে ওতে?

স্তম্ভিত হয়ে গেল পৃথু। লণ্ঠনের আলোতে ও যখন চিঠিটা পড়ছিল তখন ওর মুখের ভাব নিশ্চয়ই লক্ষ্য করবে ঠুঠা। এই স্বল্প আলোয় তার থেকে কম করে চার মিটার দূরে-বসা ঠুঠা কি দেখল ওর মুখে সে ঠুঠাই জানে। কিন্তু একমাত্র নিজের মা বা ঠুঠার পক্ষেই পৃথুর জন্যে এই উদ্বেগ সম্ভব ছিল।

অভিভূত হয়ে গেল পৃথু।

প্রথমে ভাবল, বলবে না। কী হবে ঠুঠাকে এসব বলে?

তারপরই ভাবল, ঠুঠাকে বলবে না তো কাকে বলবে?

সংক্ষেপে বলল পৃথু যা বলার। এও বলল যে, টুসুকে নিয়ে আগামী সপ্তাহে ভুচু আসছে। এখানে।

ঠুঠা একটু কেশে নিল। তারপর পরিষ্কার গলায় বলল, ভুচু এলে, ভুচুর সঙ্গে সেও ফিরে যাবে হাটচান্দ্রায়।

কেন? হাটচান্দ্রায় কেন? সেখানে আবার কেন?

প্রথম কারণ, ঠুঠা গম্ভীর গলায় বলল, পাহারা দেব রুষাকে। রুষা তোমার বউ। এখনও বউ। তারপর মিলিও আছে। রুষাকে বলব যে, তার নিজের বাড়িতে ফিরে আসতে। ওই ইতরটার বাড়ি ছেড়ে।

চুপ করে রইল, পৃথু কিছুক্ষণ। কী বলবে ভেবে পেল না।

তারপর বলল, দ্বিতীয় কারণ?

এখানে পেত্নী আছে।

পেত্নী? কোথায় এই বাংলোয়?

না। ওই বাড়িতে।

কোন বাড়িতে?

কুর্চি মেমসাহেবের বাড়িতে।

ঠুঠার কথা শেষ হতে না হতেই গেটের কাছে একটি সাইকেল এসে থামল। কিরকির করে উঠল সাইকেলের উল্টো ঘুরোনো চেন এবং ছরররর শব্দ করে মোরামের ওপর গড়িয়ে গেল হঠাৎ-ব্রেক-কষা পেছনের চাকাটা।

সাব।

বলল, আগন্তুকটি।

কওন?

লোকটি কথা না বলে, গেট খুলে ভিতরে এল সাইকেল ঠেলে। তারপর সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে, সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসে সেলাম করে একটি চিঠি দিল হাতে।

হাতের লেখা দেখেই পৃথু বুঝল যে, কুর্চির চিঠি।

বলল, তুম কওন হ্যায় ভাই?

কুন্তীকি মরদ।

ওঃ। তুমহি হ্যায়।

জী সাব।

ঠুঠা যেমন চেয়ারে বসেছিল, বসেই রইল। কুন্তীর বর ঠুঠার দিকে খুব কটমট চোখ করে তাকাল সেলাম করে চলে যাওয়ার আগে। ঠুঠা কিন্তু লোকটাকে পাত্তাই দিল না। ঠাণ্ডা, উদাসীন চোখে ওর চলে-যাওয়া দেখতে লাগল।

চিঠিটা খুলল পৃথু।

কুর্চি লিখেছে:

পৃথুদা,

আজ থেকে ঠুঠাদাদাকে আর রাতে পাঠাবেন না। কুন্তীর খুবই আপত্তি। বলছে, রাতে ঠুঠা এখানে থাকলে তো কাজ ছেড়ে দেবে। আজকে বিকেলে ওর বরও এসেছিল। ওদের মধ্যে কী সব কথাবার্তা হল। তারপরই আমাকে বলল, আপনাকে এই চিঠি লিখতে।

ব্যাপারটা ভাল করে জানবার জন্যে আমি কুন্তীর বরকে বাজার থেকে ঘুরে-ঘারে আসতে বলেছিলাম। একটা মুরগিও আনতে পাঠালাম বস্তি থেকে খুঁজে-পেতে, আপনি তো কাল রাতে আসবেনও বলেছেন। তাইই।

ও চলে যেতে, কুন্তীকে জেরা করে জানলাম যে, কাল রাতে ঠুঠাদাদা নাকি কুন্তীকে দেওয়ালের সঙ্গে ঠেসে ধরে তাকে এমনই জোরে কামড় দিয়েছে যে, বেচারির ঠোঁটই কেটে গেছে। ঠুঠার গায়ে অসম্ভব জোর। কুন্তী নিজের চেষ্টায় ছাড়াতে পারেনি নিজেকে, ঠুঠাদাদা যখন নিজে ছেড়ে দিয়েছে তখনই ছাড়া পেয়েছে। ভয়ে রাতে আমাকে জাগায়ওনি।

ঠুঠাদাদা সম্বন্ধে ও আমাকে আগেও বলেছিল। রাতে লণ্ঠন নিয়ে বাইরে যেত ও। উঠোনের এক কোণাতেই আড়াল নিয়ে বসে পড়ত। ঠুঠাদাদা নাকি সেই সময় উঠে বসে বারান্দা থেকে তাকে বিচ্ছিরি চোখে লক্ষ্য করত। জঙ্গলের মেয়ে ও। ছোটবেলা থেকে অনেক রকম পুরুষ-জাত বিপদ ওর জানা। অনেক বিপদ গায়ে-সওয়াও। কিন্তু ঠুঠার চোখে নাকি দানোর দৃষ্টি ছিল। গা-হিম হয়ে যেত ওর।

সে কথা শোনার পর আমি বলে দিয়েছিলাম, পাশের ঘরে যদিও ও শোবে, রাতে যেন দরজা খুলে বাইরে না যায়। প্রয়োজন হলে আমার ঘরের লাগোয়া বাথরুমেই যেন যায়।

কাল এতই ক্লান্ত ছিলাম যে খেয়ালই ছিল না। শোবার সময় আমার আর ওর ঘরের মধ্যে দরজাটাতে ভুল করে খিল তুলে দিয়েছিলাম। তাইই ওকে বাইরেই যেতে হয়েছিল।

পৃথুদা, কাল সাংঘাতিক কিছু ঘটে যেতে পারত। এবং ঘটে গেলে, কুন্তীর বর ঠুঠাদাদাকে কেটে ফেলত।

কুন্তী তার বরকে ডাহা মিথ্যে কথা বলেছে। হাঙ্গামা এড়াবার জন্যে। বলেছে যে, ও সেলাই-এর টেবলের নীচে বসে ঘর ঝাঁট দিচ্ছিল, হঠাৎ ওঠার সময় অতর্কিতে ওর ঠোঁটে টেবলের কোণা লেগে গিয়ে ওই কাণ্ড ঘটে যায়। বলেছে বটে, তবে ওর বর বিশ্বাস করেছে বলে মনে হল না তার চোখ দেখে। লোকটাও গুণ্ডা প্রকৃতির।

কাল আপনি রাতে আমার এখানে থাকবেন তাইই কুন্তীকেও ছুটি দিয়ে দেব কাল বিকেলেই সেই রাতের মতো। ঠুঠা দাদাকে কাল তো নয়ই অন্য কোনওদিনই আর পাঠাবেন না। কাল অবশ্যই আসবেন। না এলে, আমার একদম একা থাকতে হবে। ঠুঠাদাদার সঙ্গে আমিও একা থাকব না।

কাল যখন দেখা হবে, তখন বিস্তরিত বলব।

—ইতি কুর্চি।

কুন্তীর বর সাইকেল ঠেলে গেটের বাইরে পৌঁছে গেটটা বন্ধ করে সাইকেলে উঠতে যাচ্ছিল এমন সময় পৃথু ডাকল তাকে। তারপর দড়িতে টান দিয়ে গরুর গলার ঘণ্টা বাজাল। বিগু আসতেই চিঠির প্যাড আর কলমটা নিয়ে আসতে বলল।

দু লাইনের চিঠি লিখল কুর্চিকে; অনিবার্যকারণবশত কাল যেতে পারছি না। কুন্তীকে কালকে ছুটি দিও না। শনিবার রাতে থাকব তোমার কাছে। পৃথুদা।

পূঃ দেখা হলে সব বলব। মানে, কেন যাচ্ছি না কাল।

চিঠিটা কুন্তীর বরকে দিয়ে বলল, কুর্চিকে যেন এখনই নিয়ে যায়।

ও বলল, রাতে আমি ওইখানেই থাকব আজ। চিঠি ঠিকই পৌঁছে যাবে। আপনি বে-ফিক্কর থাকুন।

ও চলে গেলে, ঠুঠা আবারও তার ঘড়ঘড়ে কর্কশ গলায় কুর্চির চিঠিটাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল; কী? কী লিখেছে?

পৃথু বলল, ও আমার চিঠি। তোমার বিষয়ে কিছু নেই এতে।

ঠুঠা অপরাধী শিশুর মতো মুখ করে অনেকক্ষণ পৃথুর দিকে চেয়ে থেকেই দু হাতের পাতা দিয়ে নিজের কুৎসিত মুখটাকে ঢেলে ফেলল।

ভারী কষ্ট হল পৃথুর। এই প্রাপ্তবয়স্ক, অসহায়, প্রায় বোবা-হওয়া ঠুঠার জন্যে। কুন্তীর জন্যেও। প্রায় একই ধরনের কষ্ট হল রুষারও জন্যে। কুর্চির জন্যে। ভুচুর জন্যে। গিরিশদার জন্যে। এবং এমন কী ওর নিজের জন্যেও।

ভুচু বোধহয় সেদিন ঠিকই লিখেছিল তার চিঠিতে; পৃথুদা, ঠুঠার যা দরকার, তা একটি শক্ত-সমর্থ মেয়েছেলে।

সত্যিই কী তাইই?

হয়তো সত্যিই তাই।

কুর্চির সঙ্গে এখানে মিলিত হওয়ার পর জীবনের একটা নতুন দিক খুলে গেছে পৃথুর কাছে। হয়তো কুর্চিরও কাছে। কিন্তু ঠুঠা বাইগাও কী পৃথুরই মতো একজন ভঙ্গুর মানুষ?

সারাটা জীবনই, যা শুধু না পেয়েই নয়, যার সম্বন্ধে এক গভীর অসূয়াই সে চিরদিন পুষে এসেছে সেই নারী শরীরের কাছে এত পথ একা একা হেঁটে এসে শেষে কাল-বাঘ ঠুঠা বাইগাও হাঁটু ভেঙে পড়ল? গায়ের জোরে পেতে চাইল কুন্তীকে? পুরোপুরি পেলেও ব্যাপারটা স্বাভাবিক হত। জানোয়ারের মতো রক্তাক্ত কামড়ে কুন্তীর মতো প্রকৃত সুন্দরী মেয়ের ঠোঁট কামড়ে নেওয়া তো সুস্থতার লক্ষণ নয়। এ এক ধরনের বিকৃত-কামের প্রকাশ। ঠুঠা বাইগা জানত পুরোপুরিভাবেই, কুন্তীকে পেতে তার বাধা ছিল অনেক। নিজের ভিতরের বাধা, পৃথুর দিকের বাধা, কুর্চির দিকের বাধা এবং, কুন্তীর দিকের বাধা তো বটেই। এই সব বাধা সম্বন্ধে সচেতন, নিশ্চিত ছিল বলেই তার স্বাভাবিকতা বিকৃত হয়ে উঠেছিল।

নারী ছাড়া যদি বাঁচা নাইই যায় তবে জীবনভর এত বড় বড় বুলি কপচে গেলে কেন ঠুঠা বাইগা? অবশ্য ঠুঠা তো একাই নয়। পৃথু নিজেও তো কম বলেনি; কম ভাবেনি।

দিগা পাঁড়ের কাছে তুলসীদাসের মানস মুক্তাবলী শুনেছিল সে, সেই বাণীই তাহলে সত্যি হল? “জয় বিনু দেহ নদী বিনুবারী তৈসি অ নাথ পুরুষ বিনু নারী।” প্রাণ বিনা দেহ, জল বিনা নদী যেমন, নারী ছাড়া পুরুষও তেমনই। “কো জগ কাম নাচার ন জেহী”? জগতে কাম কাকে কামড়ায়নি? মানুষ আর মানুষের মাথার মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা এই প্রথম রিপুর চেয়ে বেশি বিষধর সাপ পৃথিবীর কোনও পাহাড় জঙ্গল সমুদ্র বা মরুভূমিতেও নেই। সাপের মতো যত বেশিদিন ও নিষ্ক্রিয় হয়ে ঘুমিয়ে থাকে, বিষ ততই বাড়ে। এর কামড়ে বড়ই জ্বালা। রুষার আজকের সমস্যা, ইদুরকারের সমস্যা, কুর্চির সমস্যা, তার নিজের সমস্যা সবই কি শুধুমাত্র এই রুখু উপোসী শরীরের জন্যেই? জানোয়ার হলে তো দুঃখ পেত না। শূকর হলে, যে-কোনও শূকরীতে উপগত হতে পারত। মানুষ যে যে-কোনও মানুষীতে যেতে পারে না। মানুষ অনেক কিছুই পারে না, যা জানোয়ারেরা সহজেই পারে। জীবনের মাঝামাঝি এসে পড়ে অনেক দম্ভ, গর্ব, অনেক জানাকে এমন করে ডুবন্ত জাহাজের মত মন থেকে জেটিসন করে দিতে যে হবে এ কথা ছ’ মাস আগেও জানত না। নিজের প্রেমিকার কাছে, নিজের বিবাহিতা স্ত্রীর কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে রাগের বশে নেশাগ্রস্ত হয়ে বিজ্‌লী বাঈজীর কাছে গিয়ে ও যা জেনেছিল, বিদ্যুৎ চমকের মতো, সেই শিক্ষাই ঠুঠা বাইগা বোধহয় আজ শিখল জীবনের সাঁঝ-বেলাতে এসে কুন্তী নামক একটি সুন্দরী গোঁদ যুবতীর কাছে।

শহুরে না হতে পারে, ইংরিজি না জানতে পারে, ঘোরতর জংলী হলেও ঠুঠা কিন্তু শূকর মোটেই নয়। প্রত্যেক পুরুষই শুধুমাত্র তার নিজের সমাজের, নিজের রুচির, নিজের পছন্দর কোনও নারীর কাছে এসে নিজের শরীরের বিদ্যুৎবাহী তারে হঠাৎ চৌম্বকত্বর সাড়া পায়। যে কোনও নারী, যে-কোনও পুরুষকে জ্বালাতে পারে না, যে-কোনও পুরুষও পারে না যে-কোনও নারীকে। এইখানেই মানুষের এত দুঃখ। তাইই সারা জীবন নারীকে ঘৃণা করে এসে ঠুঠাকে ভেঙে পড়তে হয় কুন্তীর শরীরের চৌকাঠে। পৃথুর মধ্যে তার নিজের তরঙ্গবাহী তার খুঁজে না পেয়ে ইদুরকারের কাছে যেতে হয় রুষাকে। কিন্তু বেচারি বড় দেরিতে বুঝতে পারে যে, শুধু শরীরের তরঙ্গ মিললেই একজন নারী আর একজন পুরুষ চিরদিন একসঙ্গে থাকতে পারে না খুশিতে। শরীরের তরঙ্গর চেয়েও মনের তরঙ্গর মিলের প্রয়োজন বেশি। তাই এত দাম দিয়ে স্বাধীনতা কিনেও রুষাকে শরীরের আলিঙ্গন ছাড়িয়ে আবার ফিরে আসবার আয়োজন করতে হয় পুরনো বাসে। সেই একই কারণে কুর্চিকে পেয়ে, এতদিন পরে পৃথু বুঝতে পারে যে, তার জীবনের মন এবং শরীরের সমান অংশীদার শুধুমাত্র কুর্চিই। রুষা নয়, বিজলী নয়; আর কেউই নয়। দুই-তৃতীয়াংশ জীবন খোঁজাখুঁজি করতেই কেটে গেল পৃথুর, ঠুঠার কেটে গেল পুরো জীবন তার বেয়ারিং কারেক্ট করতে। এর পরেও বাঁচার সময় কি আর বেশি থাকে বাকি?

ঠুঠা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল পৃথুর মুখে। অনেকক্ষণ সময় কেটে গেছিল। আলোর গতি এক লক্ষ ছিয়াশী হাজার মাইল। মানুষের ভাবনার গতি কত তা মানুষের এখনও জানার বাইরে। ভাবতে বসে উধাও হয়ে যায় পৃথু মনে মনে।

পৃথু বলল, বিয়ে করবে ঠুঠা? তোমার জন্যে পাত্রী দেখি? বাইগা মেয়ে। একটু বেশি বয়সী? বিধবা? কারও ছেড়ে-দেওয়া? অনেকই ভাল মেয়ে পাওয়া যাবে একটু খোঁজ করলেই। দিসাওয়াল সাহেবের কোম্পানীতেই এ রকম অনেক মেয়ে থাকবে। বলো তো চেষ্টা করি। বাকি জীবন তোমরা দু’জনে আমার সঙ্গেই থাকবে। আমার তো তুমিই সব। তোমার বউও কি আমার পর হবে? কত ভাল হবে তোমরা দু-জনে যদি আমার চোখের সামনে থাকো।

ঠুঠা আবার দু হাতে মুখ ঢেকে ফেলল।

পৃথু বুঝতে পারল চিঠিটাতে কী আছে তা অনুমান করেছে ঠুঠা।

ঠুঠা বলল, কালকে সকালের বাসে আমি হাটচান্দ্রাতে চলে যাব। কাল শেষ রাতে তোমার বাবাকে স্বপ্ন দেখেছিলাম আমি। তোমার বাবা যেতে বলেছেন সেখানে।

বাবাকে?

নরম হয়ে গেল পৃথুর গলার স্বর।

হ্যাঁ।

তা হাটচান্দ্রায় গিয়ে থাকবেটা কোথায়?

যেখানে ওরা থাকে। মিলি-টুসুরা।

সেখানে তোমার থাকা হবে না। তুমি ভুচুর কাছে বা গিরিশদার কাছে থাকতে পারো।

না। তা হবে না। আমি গেলে ওদের কাছেই থাকব। কাল ভোরেই আমি এ জায়গা ছেড়ে চলে যাব।

একেবারেই না।

ধমকের সুরে বলল পৃথু।

তারপর কথা ঘুরোবার জন্যে বলল, একটা চুট্টা দাও তো দেখি। বড় কিপ্টে হয়েছ আজকাল তুমি।

ঠুঠা উঠে দাঁড়িয়ে ওর ফতুয়ার পকেট থেকে চুট্টা বের করে শজারু-মার্কা দেশলাই জ্বেলে তা ধরিয়ে দিল। ওর দু হাতের তেলোর মধ্যে ধরে থাকা জ্বলন্ত কাঠির আগুনে চকিতে ঠুঠার মনের ভাব পড়ে নেবার চেষ্টা করল পৃথু। জন্মাবধি ঠুঠা বাইগাকে দেখছে পৃথু। পৃথুর মতো ভাল ঠুঠা বাইগাকে কম মানুষই চেনে। কিন্তু অতি পরিচিত বাহ্যত কুৎসিত কিন্তু আত্মিক সৌন্দর্যে সুন্দর সেই মুখখানির চোখ-দুটিতে কিছুই পড়তে পারল না পৃথু এই মুহূর্তে। দূর পাহাড়ের অস্পষ্ট দাবানলের আলোরই মতো এক অস্পষ্ট লালচে আভা দেখতে পেল শুধু। দু চোখের মণির মধ্যে দাবানলের মালা। মনে হল, আরও অনেকের সঙ্গে হাত-ধরাধরি করে, আগুনের শাড়ি ছিপছিপে কালো শরীরে আলতো করে জড়িয়ে কালো কুচকুচে কুন্তী যেন নাচছে ঘুরে ঘুরে ঠুঠার দু চোখের মণির ওপর। নেচে-নেচে চলে যাচ্ছে কাছ থেকে দূরে। ফিরে আসছে দূর থেকে কাছে। একবার দলছুট হয়ে যাচ্ছে হাত-ছড়িয়ে আবারও ফিরে আসছে দলে।

ঠুঠা আবার বলল, আমি কাল যাচ্ছি।

একদম না। যদি যেতেই হয় তো ভুচুর সঙ্গেই যেয়ো। একা জীপ চালিয়ে ছেলেটা ফিরবে অতদূর, ভালই হবে। তাছাড়া টুসুই তো আসছে। এখানে। তুমি যাবে কী করতে?

পৃথু বলল।

নাঃ। যাবই। যেতে হবে মিলির জন্যে আর রুষার জন্যে।

পৃথু বিপদে পড়ল। ঠুঠা যেন আবারও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। আগের বার নাঙ্গা বাইগীনকে স্বপ্ন দেখে ব্যাপারটা ঘটেছিল। এবার কুন্তীর সংস্পর্শে এসে। যে খিদে তার পূরণ হয়নি যা তীব্রভাবে জেগে উঠেছে যাই-যাই-বেলায়, সেই খিদে সুদ্ধু ঠুঠাকে কুর্চি বা রুষা বা মিলি কারও কাছেই ভরসা করে পাঠানো যায় না। এখন সুস্থ নেই ঠুঠা। মানুষ অসুস্থ হলে শূকর হয়ে যায়। হয়তো পৃথুও নেই। তফাৎটা শুধু এইটুকুই যে, পৃথু জানে যে, সে অসুস্থ; আর ঠুঠা জানে না সে কথা।

ঠুঠা তেমনই বসে রইল।

কী ঠিক করলে?

ওই।

ওই কী?

কাল যাব।

ঠাণ্ডা মাথায় ঠুঠার চোখের দিকে চেয়ে তার অপ্রকৃতিস্থতার মাত্রাটা বুঝে নেবার চেষ্টা করল পৃথু। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে টেবল থেকে ক্রাচ দুটো তুলে নিয়ে বলল, বেশ তাইই হবে। এখন চা-টা তো খাও।

বিগুর এনে দেওয়া চায়ের গ্লাসটা তুলে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল ঠুঠা। শ্লথ পায়ে। মোজাইকের টাইলস এর উপরে খসখস—খসখস শব্দ তুলে, পা ঘষে ঘষে।

পৃথু ঘণ্টা বাজাল।

বিগু দৌড়ে এল।

ফিসফিস করে ও বলল, ঠুঠার উপরে একটু চোখ রাখিস। আর দুটো গুলি দেব, এক্ষুনি ওর চায়ের সঙ্গে মিশিয়ে দে কোনও কায়দা করে। ঘুমিয়ে পড়বে তাহলে।

ওর পাগলামিটা বেড়েছে মনে হচ্ছে। খবরদার! জোর করিস না।

ঘরে গিয়ে দুটো পাঁচমিলিগ্রামের ঘুমের ওষুধ দিল বিগুর হাতে।

এখানের ডাক্তারসাহেবের সঙ্গে পরামর্শ করে আগে থেকেই ঠুঠার জন্যে এই ঘুমের ওষুধ আনিয়ে রেখেছিল ও। সম্ভব হলে, এই হাটবারেই ওকে নিয়ে যাবে রায়পুর জবলপুরে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে। কিন্তু সাইকিয়াট্রিস্ট কি নাঙ্গা বাইগীনের দর্শন পাওয়া মানুষের চিকিৎসা করতে পারবেন? কুন্তীর ব্যাপারটা সম্বন্ধে হয়তো পারবেন কিছু করতে। কে জানে, হয়তো বলবেন, সেক্সুয়াল স্টার্ভেশান থেকেই ওর সব-কিছু গোলমাল। নাঙ্গা বাইগীনের স্বপ্ন-টপ্নও তাইই।

হয়তো।

চান করে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে যখন আবার পৃথু বারান্দায় এল দেখল ঠুঠা বারান্দার তাকে বসে, থামে হেলান দিয়ে, মাতালের মতো টলছে। বিগু খাওয়াতে পেরেছে তাহলে ওষুধ চায়ের সঙ্গে মিশিয়ে। চালাক আছে ছেলেটা। কিন্তু ঠুঠা এইখানেই ঘুমিয়ে পড়লে পৃথু বা বিগুর পক্ষে তাকে আর ঘরে নিয়ে গিয়ে শোয়ানো খুবই মুশকিলের হবে। পৃথু নিজেই তো এখন পরনির্ভর। আগের পৃথু তো সে আর নেই! থাকা-না-থাকা সমান। এই সময় ঠুঠার পেটে কিছু খাবার পড়লেই ঘুমটা আরও ভাল হত। বলা যায় না ঘুমিয়ে ওঠার পর এই কুন্তী-জনিত শক-এর সেন্সটা হয়তো কেটেও যেত।

ঘণ্টা বাজিয়ে বিগুকে ডেকে, দুজনেই ঠুঠাকে দু দিকে ধরে বলল, চলো, খেয়েই শুয়ে পড়বে।

আমরা সকলেই আজ তাড়াতাড়ি খাব। কালকে তুমি হাটচান্দ্রায় যাবে, বাসে তুলে দিতে যেতে হবে না আমাদের? তাড়াতাড়ি উঠতে হবে তো সকলের, না, কি?

ঠুঠা মাথা নাড়ল। তারপর নিজেই টলতে টলতে রান্নাঘরের দিকে এগোল।

বিগু বলল, তুমি তোমার ঘরে যাও দাদা। আমি খাবার নিয়ে আসছি। আমারও ভীষণ ঘুম পেয়েছে। আমরা দুজনে একসঙ্গেই খেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ব।

কোনও কথাই বলল না ঠুঠা উত্তরে। টলতে টলতে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল।

পৃথু নিজের ঘরে গেল। রুষাকে আর ভুচুকে দুটি চিঠি লিখতে হবে। যে চিঠিদুটি সে লিখবে তা শুধু চিঠিমাত্রই নয়। জীবনের হিসাবনিকেশ। ট্রায়াল-বালানস। মিলবে না। জানে ও যে মিলবে না। তবে, ডিফারেন্সটা জমার দিকেই আসে না খরচের দিকে সেটাই দেখার এখন।

জানালা দিয়ে পাহাড়ের গায়ে গায়ে দাবানলের মালা এখন দেওয়ালীর রাতের প্রদীপের মালার মত দেখাচ্ছে। ঝড়ের মতো হাওয়ায় কাঁপছে মালাগুলো। গ্রীষ্মবনের রাতের বুক থেকে, মুচমুচে শুকনো পাতাদের দৌড়োদৌড়ি করে বেড়ানোর শব্দের আড়ালে এক বেদনার্ত দীর্ঘশ্বাস ওঠে। পোড়া-পোড়া গন্ধ ওঠে। ছেলেবেলায় দেউড়িতে যেমন পেটা-ঘড়ির আওয়াজে প্রহর হেঁটে যেত এখানে প্রহরে প্রহরে শেয়ালের ডাকে তেমন হাঁটে। সেই চিতাটা করাত-চেরা আওয়াজ করে পাহাড়ের কাঁধের কাছে হেঁটে যাচ্ছে। পাহাড়তলিতে এক চিলতে চাঁদের আলো আর গ্রীষ্মবনের ধোঁয়াশা মিলে এক আশ্চর্য ধূসরাভ মেঘের সৃষ্টি করেছে। এই রাতের বনের রহস্যময়তাকে গভীরতর করে তুলেছে পরিচিত পাখিটির গম্ভীর ঢাব-ঢাব-ঢাব-ঢাব-ঢাব শব্দ। হনুমানের দল হুপ-হুপ-হুপ-হুপ করছে। বোধহয় কোনও বড় বাঘ দেখে থাকবে গ্রীষ্মে পাৎলা-হয়ে-যাওয়া উপত্যকার জঙ্গলে।

পৃথু, বাইরের নেশাগ্রস্ত প্রকৃতি থেকে চোখ ভিতরে করল। মহুয়া আর করৌঞ্জ ফোটার সময় অন্যত্র শেষ। এখানে এখনও ফুটছে।

ঝলক ঝলক গন্ধ এল হাওয়াটা দিক বদলাতেই।

লণ্ঠনের আলোয় লিখল, পৃথু।

রুষা, কল্যাণীয়াসু, …

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *