2 of 2

৬৮. ইদুরকার ড্রেসিং টেবলের সামনে বসে

৬৮

ইদুরকার ড্রেসিং টেবলের সামনে বসে টাই বাঁধছিল। আজ জবলপুরে যাবে ও। ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের সঙ্গে মিটিং আছে নাকি ক্লাবে।

বেড-রুমের মধ্যে সোফায় বসে রুষা চেয়েছিল ওর দিকে।

টাইটা পরে, ওয়াড্রোব খুলে কোটটা বের করে পরল ইদুরকার।

বলল, তোমার জন্যে কিছু কি আনব জবলপুর থেকে? হানি?

না।

আমি কিন্তু মিলিকে নিয়ে যাচ্ছি সঙ্গে। আজ তো স্কুল ছুটি। রবিবার।

মিলি? কোথায় যাবে? কাজে যাচ্ছ তো তুমি।

গেলে কী? ও দুপুরে জ্যাকসন হোটেলে থাকবে। বিকেলে আবার চলে আসবে আমার সঙ্গে। এনজয় করবে খুব। লং ড্রাইভ। ওকে বলে রেখেছি। এতক্ষণে নিশ্চয়ই তৈরি হয়ে গেছে।

না। ও যাবে না।

রুষা বলল, দাঁড়িয়ে উঠে। কঠিন গলায়। আমি জানলাম না, আর মেয়ে তৈরি হয়ে গেল কী রকম? আমি কি মরে গেছি? হাউ ডেয়ার উ্য?

এমন সময় মিলি একটি সিল্কের লাল ম্যাক্সি পরে দরজায় এসে দাঁড়াল।

মিলিকে দেখে আতঙ্কিত হল রুষা। কত লম্বা দেখাচ্ছে ওকে হাই হিল জুতো পরে। মনে হচ্ছে। কোনও পঁচিশ বছরের মেয়ে।

মিলি বলল আই অ্যাম রেডি আংকল।

শ্যানেল নাম্বার ফাইভের গন্ধ বেরুচ্ছিল ওর গা থেকে। পনি টেইল করেছে চান করে উঠে। শ্যাম্পু করেছে। ওর দু-চোখে স্বচ্ছল জীবন-জনিত এবং জীবন-তৃষ্ণার গভীর এক ঘোর। এই বয়সটাই নষ্ট হবার বয়স। ভিনোদ ওকে পুরোপুরিই নষ্ট করে দিতে চাইছে।

একটা প্রি-মনিশান হয়েছিল রুষার। আজ যে এরকম ঘটতে পারে তা ভুচুকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল কালকেই, সন্ধ্যায় বাজারের প্রভিশন-এর দেকান থেকে। ভুচু বলেছিল, ও কালই ভোর পাঁচটায় ফিরে এসেছে টুসুকে পৌঁছে দিয়ে। ওর মনও ভাল বলছিল না। বলেছিল, ইদুরকার যদি কথা না-শোনে, তবে একটা ফোন করে দেবেন। আমরা ফিরিয়ে আনব মিলিকে। এবং তাহলে কালই আপনাদের শিফট করাব পুরনো বাড়িতে।

মিলি, আমি বলছি তুমি যাবে না।

দাঁড়িয়ে উঠে শাসনের গলায় বলল রুষা।

আমি কি ছোট মেয়ে মা? আমি যাব। তুমি না করার কে? আই অ্যাম গ্রোন-আপ ন্যাও। উ্য কান্ট কীপ-অন বসিং এনি মোর।

বলছি, না, মিলি।

উ্য কীপ কোয়ায়েট।

রুষার গালে যেন থাপ্পড় মেরে বলল মিলি।

মিলি আবার বলল, উ্য আর জেলাস্‌।

হো-য়া-ট? বলে, সোফায় বসে পড়ল রুষা। মাথা ঘুরছিল ভীষণ।

ভিনোদ হাসছিল। রুষার দিকে চেয়ে দু কাঁধ শ্রাগ করল। বলল, ওয়েল! পরে আবার বোলো না তোমার মাইনর মেয়ের উপর আমি জোর খাটিয়েছিলাম।

মিলি! তুমি যাবে না।

আমি যাবই।

রুষা দরজার কাছে গিয়ে ঠাস করে এক চড় লাগাল মিলির গালে।

হতবাক হয়ে গেল মিলি। তার মা তাকে কখনও গলা তুলে বকেনি কোনওদিনও। ওয়েস্টার্ন কায়দায় মানুষ করেছিল ইংরিজি শিক্ষায় শিক্ষিত রুষা তার ছেলে-মেয়েকে।

কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে মিলি বলল, দেখি তুমি কী করে আটকাও আমাকে। আই সেইড ইট ওলরেডী! আই অ্যাম আ গ্রোণ-আপ গার্ল। উ্য উইল হ্যাভ টু রিপেন্ট দিস মাম্মী। উ্য উইল সী। আই লাভ আঙ্কল ইদুরকার। ইয়েস্। আই লাভ হিম!

রুষার হাত-পা থরথর করে কাঁপছিল। ভিনোদের বাহুতে তার হাত জড়িয়ে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল মিলি। মিলির দিকে চেয়ে বিশ্বাস হচ্ছিল না রুষার যে, মিলি তারই মেয়ে। তার চেয়েও সুন্দরী, লম্বা, ভরন্ত গড়নের যে মেয়েকে দেখে মুগ্ধ হবার কথা ছিল মায়ের, তাকে ঘৃণা করতে লাগল ও ওর সমস্ত অন্তর দিয়ে। তাকে অভিশাপ দিতে লাগল। ভাবতে লাগল, প্রত্যেক মেয়ের মধ্যেই কি মায়ের প্রতিদ্বন্দ্বী থাকে একজন? সে যে কখন বাইরে আসবে তা কেউ জানে না।

ওরা নেমে গেলে মিলির প্রতি তার সমস্ত ঘৃণাটুকু তার নিজের বুকেই ফিরে এল। নিজেকেই অভিশাপ দিতে লাগল রুষা। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল সোফাটার উপর। মিলির প্রতি ঘৃণা বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে।

মার্সিডিস গাড়ির হর্ন শোনা গেল গেটের কাছে। দারোয়ানেরা গেট খুলে দিল। রুষা দৌড়ে গিয়ে নাইটি-পরা আলুথালু বেশে ফোনের ডিজিটাল রিসিভারটা তুলে নিয়ে বাঁ হাতের তেলোতে রেখে তাড়াতাড়ি ডায়াল করল। উত্তেজনায় রং-নাম্বার হল একবার। ওপাশ থেকে একজন বলল, কত নাম্বার চান তা না জিজ্ঞেস করেই ভুচুকে চাইছেন? অদ্ভুত লোক তো? এখানে ভুচু বলে কেউ থাকে না। পরের বার পেল ভুচুকে।

ভুচু?

বলুন বৌদি। ফোনের কাছেই ছিল ভুচু সকাল থেকে।

এইমাত্র ওরা চলে গেল ভুচু! বাঁচাও তুমি আমার মেয়েকে। আমাকে বাঁচাও। প্লীজ!

ঠিক আছে। কোনও চিন্তা নেই আপনার। আপনি গোছগাছ করে নিয়ে তৈরি থাকুন। ইদুরকারের বন্দোবস্ত করেই আমি আপনার কাছে আসছি। কোনও ভয় নেই বৌদি। গাড়িটা কী? কী রঙের?

সাদা রঙের। মার্সিডিস। ওইই চালাচ্ছে।

ফোনটা নামিয়েই ভুচু গিরিশদাকে ফোন করল। শামীম ওখানেই বসে ছিল সকাল থেকে। ওদের খবরটা দিয়েই ফোনটা রেখে ডাকল, হুদা!

হুদা দৌড়ে এল। বলাই ছিল ওকে।

বলল, বলো।

হুদা দৌড়ে গিয়ে জীপে বসে জীপটা গারাজ থেকে বার করে আনল। কাল রাতেই সার্ভিস করিয়ে ফুল ট্যাঙ্ক তেল নিয়ে রেডি করে রেখেছিল।

ঘাড় ঘুরিয়ে কম্বল আর বেতের লাঠিদুটো পেছনে আছে কি না একবার শিওর হয়ে নিল সে সম্বন্ধে। হুদাই জীপ চালাচ্ছিল। ভুচু বসেছিল পাশে। খুব জোরে চালিয়ে হাটচান্দ্রা থেকে যে পথটি জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে মান্দলা হয়ে জব্বলপুরের দিকে গেছে সে পথে মাইল পাঁচেক গিয়ে একটা বাঁকের মুখে জীপটাকে পথের বাঁ দিকে একটি ফরেস্ট রোড-এ ঢুকিয়ে ব্যাক করে রাস্তার দিকে মুখ করে রাখল। কয়েক মিনিট পরই দেখল গিরিশদার অ্যাম্বাসাডার খুব জোরে ছুটে বেরিয়ে গেল। তারও মিনিট পাঁচেক বাদে ইদুরকারের সাদা মার্সিডিস গেল। গাড়িটা এগোতেই হুদা জীপের এঞ্জিন স্টার্ট করে পথে এসে উঠে ফলো করতে লাগল গাড়িটাকে একটু দূরত্ব রেখে।

ড্রাইভার নেয়নি ইদুরকার আজকে। নেয়নি ইচ্ছে করেই। সামনের ডানদিকের সীটে মিলি বসেছিল লেফট হ্যান্ড ড্রাইভ মার্সিডিসে রাজকুমারীর মতো। মিলিকে যে ভাবে তার মা মানুষ করেছিল তাতে এই রকম ঐশ্বর্যর জীবনই তার একমাত্র কাম্য ছিল। ভাল-থাকা, ভাল-খাওয়া ছাড়াও মানুষের জীবনে যে আরও অনেক কিছু চাইবার থাকে সে সম্বন্ধে মিলি একেবারেই অনবহিত। সুখ আর ঐশ্বর্য ওর কাছে সমার্থক। শুধু ওর কাছেই নয়, এই বয়সী, এইরকম ভাবে ট্যাঁশ-সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা বেশির ভাগ মেয়েরই কাছে হয়তো।

প্ল্যান আগে থেকেই ছকে নিয়েছিল ভুচু গিরিশদা আর শামীম। হুদাও জানত। পথটাতে, একটা হেয়ার-পিন বেন্ড আছে। তাতে যে-কোনও গাড়ির গতিই ড্রাইভার কম করতে বাধ্য। এমনকী পৃথু এবং ভুচুর মতো ড্রাইভারকেও স্পীড কমাতে হয়ই এখানে এসে। তাছাড়া, ইদুরকার জয়-রাইডেই বেরিয়েছিল। ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের সঙ্গে মীটিংটা মিথ্যা কথা। জঙ্গলের মধ্যেই কোনও বন-বাংলোয় উঠত গিয়ে ও মিলিকে নিয়ে। যেতই না জব্বলপুর অবধি।

পৃথুদার মেয়ে মিলিকে! তারপর…

হেয়ার পিন বেণ্ডটা আর সাত-আট মাইল আছে। এ পথে প্রাইভেট গাড়ি বা জীপ খুব কমই যাওয়া-আসা করে। দিনে রাতে গোটা ছয়েক বাস আপ-ডাউনে যায়। আর গোটা বারো ট্রাক। প্রতিদিন গড়ে। নইলে, রাস্তা নির্জনই থাকে। বেণ্ডটার কাছাকাছি আসতেই জীপের গতি বাড়িয়ে দিল হুদা। বেণ্ডটার ঠিক আগেই একটি কাঁচা, লালমাটির ফরেস্ট-রোড বেরিয়ে গেছে ডানদিকে। অন্ধ-পথ। শেষ হয়েছে গিয়ে হাঁলো নদীর সামনে। পথটা কেটে গেছে নদী। সেখানে নদীর উপর একটি কজওয়ে তৈরি করছিল ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট। গত বছরই শুরু হয়েছিল, কিন্তু ফান্ডস-এর অভাবে কাজ অবাণ্ডাণ্ড হয়ে গেছে। এখনও নদীতে যথেষ্ট জল আছে। ট্রাক পেরোতে পারে না এখন নদী। নদী যদি বা কেউ পেরোতে পারতও তাহলেও ওদিকে যেতে পারবে না আর। পথই তৈরি হয়নি। বড় বড় পাথরে ভরা অগম্য সেই কাঁচা রাস্তা। একমাত্র জীপ যেতে পারে। অতি কষ্টে। তাও, মে মাসের গোড়া থেকে জুনের শেষ অবধি। যতদিন বৃষ্টি না নামে।

ইদুরকারের মার্সিডিস খুব আস্তে হেয়ার-পিন বেণ্ডটাকে নেগোশিয়েট করল। করেই, থেমে গেল।

সরু পথের উপর আড়াআড়ি করে দাঁড় করানো আছে গিরিশদার অ্যাম্বাসাডর। বনেট খুলে শামীম যেন গাড়ি মেরামত করছে। গিরিশদা ড্রাইভিং সীটে। ড্রাইভারকে ইচ্ছে করেই আনেননি।

হুদা, জীপটা আর না-এগিয়ে, ডানদিকের সেই অন্ধ-গলির এপাশে পিচ রাস্তার মধ্যে জীপটা আড়াআড়ি করে রেখে জীপের বনেট খুলে দিল। দু পাশ থেকেই কোনও গাড়ি এলেও ঢুকতে পারবে না। মার্সিডিজও যেতে পারবে না। এই দুই ব্যুহ ভেদ করে।

ইদুরকার গাড়ি দাঁড় করিয়ে খুব জোরে হর্ন বাজাল কয়েকবার। তারপর দরজা খুলে গালাগালি করতে করতে গিরিশদার গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। গিরিশদা গাড়িকে স্টার্ট-এ রেখে, তাঁর দোনলা শটগানটি নিয়ে নেমে এসে ইদুরকারের দিকে তুলে ধরলেন। শামীমও বনেট বন্ধ করে পিস্তল নিয়ে দৌড়ে গেল ওর দিকে।

প্রথমে ও বুঝতে পারেনি। পরক্ষণেই শামীম এবং গিরিশদাকে চিনে ফেলল ও। চিনতে পেরেই প্রাণপণ দৌড়ে নিজের গাড়িতে উঠে গাড়ি ব্যাক করল তিন চারবার এগিয়ে পেছিয়ে অনেক কষ্টে। তারপর জোরে অ্যাকসিলারেটরে চাপ দিয়ে হাটচান্দ্রার দিকে ফিরে যেতে গিয়েই দেখল একটা জীপ আড় করে লাগানো আছে পথে। উইশফুল থিংকিং-এ ও ভেবেছিল এটা একটা দুর্ঘটনা। কিন্তু ঠিক সেই সময় ভুচু জীপের মধ্যে থেকে নেমে এল হাতে পিস্তল নিয়ে।

কথা বেশি বলে না ভুচু। এবং ওর মুখের ভাব এবং চোয়ালের দৃঢ়তা দেখে ইদুরকার কী করবে প্রথমটা বুঝে উঠতে পারল না। পাঁচ-দশ সেকেন্ড ভেবে নিয়ে দৌড়ে গাড়িতে ফিরে গিয়েই ডানদিকের দরজা খুলে এক হ্যাঁচকা টানে মিলিকে পথের উপর ছুঁড়ে ফেলে দিল। ওর সিষ্কের ম্যাক্সি উঠে গেল উরু অবধি। নুড়ি ছড়ানো ধুলোর মধ্যে সে ভূলুণ্ঠিত হয়ে পড়ে ভয়ে কেঁদে উঠল। এবং চিৎকার করে উঠল, বাবা! বাবা! বাঁচাও।

ওই অবস্থাতেও হাসি পেল ভুচুর। এত লোক থাকতে, বাবা!

ততক্ষণে গিরিশদার অ্যাম্বাসাডর ফিরে এসেছে। ওই গাড়িকেও ফিরে আসতে দেখে ওর বিরুদ্ধে যে একটি সুপরিকল্পিত চক্রান্ত হয়েছে তা আর বুঝতে বাকি রইল না ইদুরকারের। যেমন ঘটবে ওরা ভেবেছিল, তাইই ঘটল। সামনে ও পিছনের পথ আগলানো দেখে সে প্রায় মিলির গায়েরই উপর দিয়ে জোরে গাড়ি চালিয়ে নেমে গেল ডানদিকের সেই কাঁচা অন্ধ বন পথে। ওই পথ যে হাঁলো নদীর সামনে গিয়ে ফুরিয়ে গেছে তা ওই ইদুরকারের জানার কথা নয়। জঙ্গলের পোকা ভুচু এবং শামীম যা জানে শহরের সুখী “ভদ্রলোক” ইদুরকারের তা জানার কথা ছিল না। ওকে এ পথেই যেতে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল ওদের।

গিরিশদা মিলির হাত ধরে বললেন, এসো মা। উঠে এসো, এই গাড়িতে। আমি তোমার বাবার বন্ধু।

মিলি দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে কী যেন বলতে গেল। শোনা গেল না ভাল।

ভুচু বলল, ওঠো, গিরিশজেঠু তোমাকে নিয়ে যাবেন। আমি তোমার মাকে সঙ্গে নিয়ে আসছি। তোমার কাছে। একটু পরে।

কোথায়? মিলি শুধোল।

তোমাদের পুরনো বাড়িতে। তোমাকে আজ মেরেই ফেলত ইদুরকার। মায়ের কথা না শুনলে, এমনই বিপদে পড়তে হয়।

মেরে ফেলত? কেন?

ঘোরের মধ্যে বলল মিলি।

ভুচু মনে মনে বলল, মেয়েদের মৃত্যুর নানা রকম হয়। নুরজেহান যেমন মরেছিল।

মুখে কিছু বলল না।

হুদা জীপটা একপাশ করল। এমন সময় দূর থেকে একটা বাসের এঞ্জিনের আওয়াজ শোনা গেল। সঙ্গে সঙ্গে অ্যাম্বাসাডর এবং জীপ দুইই ডানদিকের বনপথে ঢুকিয়ে দিল ওরা অনেকখানি যাতে বাসের নজরে না পড়ে। বাসটা চলে যেতে, গিরিশদার গাড়ির স্টিয়ারিং-এ এসে হুদা বসল। গিরিশদা মিলিকে নিয়ে পেছনের সীটে। শামীম এসে জীপে উঠল। ভুচু স্টিয়ারিং-এ।

অ্যাম্বাসাডর ব্যাক করে বড় রাস্তায় উঠে চলে গেল। হাটচান্দ্রার দিকে। ভুচু, হাত নাড়ল মিলিকে। মিলি হাসবার চেষ্টা করতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল। এই গিরিশবাবু আর ভুচুই হয়তো মেরে ফেলবে ওকে। কে জানে?

গিরিশদা বললেন, তোমার বাবাকে চিঠি লিখো একটা ভাল করে। টুসুকে নিয়ে ফিরে আসতে বলো এখানে।

মিলি দু চোখ দু হাতে ঢেকে বসে রইল।

অ্যাম্বাসাডরটা চলে যেতেই ভুচু আগে বাড়াল জীপ। অনেকদিন পর রক্ত দাপাদাপি করতে লাগল। কপালের দু পাশে ঝুনুক ঝুনুক করে। ভাল লাগতে লাগল ওর।

শামীম তার পাঞ্জাবির পকেট থেকে পানের শালপাতামোড়া প্যাকেট বের করে পান দিল ভুচুকে, উত্তেজনাহীন, ঠাণ্ডা হাতে। তারপর মীর্জা গালিবের একটা গজল বেসুরে গাইতে লাগল গুনগুন করে। বেসুরো গান শুনে মাথা ধরে যায় ভুচুর। ধমক লাগিয়ে গান বন্ধ করতে বলল ওকে।

মোড়ে গীয়ার বদল করতে করতে, ভুচু বলল, পেছনে আছে বেতের লাঠিদুটো, আর কম্বল। কম্বলে মুড়ে ভাল করে পেটাতে হবে। যাতে জীবনের মতো শিক্ষা পায়। গায়ে দাগও না হয়।

হুঁ।

শামীম বলল।

তারপর বলল, দেখি।

আতঙ্কিত হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল ভুচু ওর মুখে। বলল অ্যাই শামীম ভাই! জানে মেরো না কিন্তু। আর কদিন পরেই নুরজেহানের বিয়ে। মগনলালকে নিয়ে অনেকই ঝামেলা হল। আর ঝামেলা বাড়িও না।

দেখি, কী করি। তুমি যে মাদ্রাসায় লেখাপড়া শিখেছ ভুচু, আমি তো সেই মাদ্রাসাতে লেখাপড়া করিনি। আমাদের দিমাগ কুছ্‌ অলগ অলগ।

ভুচুর ভীষণই ভয় করতে লাগল এই কথাতে। শামীমের মধ্যে এক দারুণ নিষ্ঠুরতা আছে। দিগা পাঁড়ের কুঁড়ের কাছে সেই জংলি-কুকুরে চোখ খুবলে-নেওয়া বারাশিঙাটাকে যেমন করে গুলি করেছিল তেমন করেই ও হঠাৎ হঠাৎ নানা কাণ্ড করে বসে। সেইসব মুহূর্তে ও ওর নিজের মালিক থাকে না। ওর মধ্যে সাক্ষাৎ শয়তান এসে বাসা বাঁধে। নুরজেহানের ঘটনাটা ঘটার পর থেকে শামীম আরও নিষ্ঠুর হয়ে গেছে। চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে চেপে বসে থাকে। মনে হয়, যেটুকু মায়াদয়া ছিল ওর মধ্যে, তাও মুছে গেছে নির্মূল হয়ে।

মাইল দুয়েক যেতেই দেখা গেল মার্সিডিস গাড়ি ফিরে আসছে। কিন্তু জীপটাকে আসতে দেখেই গাড়ি থামিয়ে দিল ইদুরকার। তারপর ওদের চিনতে পেরে, গাড়ির দরজা খুলে নেমে দাঁড়াল, টাই ঠিক করতে করতে। গাড়িটার গায়ে হেলান দিয়ে অন্য দশজন বড়লোকের মতো আত্মবিশ্বাস এবং ছোটলোকদের সাহসের প্রতি বিরক্তি ফুটিয়ে থুতনি উঁচু করে চেয়ে রইল আগন্তুক জীপের দিকে। ভাবটা, যেন, “আই উইল গিভ দেম আ বিট অফ মাই মাইন্ড।” অত দামি গাড়িটার সঙ্গে গা লাগিয়ে বৈভব ও সাহসকে ওর শরীরের সঙ্গে “আর্থ” করিয়ে রাখল। বেশির ভাগ বড়লোকদের সাহসের বেশিটাই হয়তো তাদের সম্পত্তিসম্ভূত।

ভাবল, ভুচু।

শামীম নামল। ভুচুও নামল।

ইদুরকার বলল, তোমাদের সাহস তো কম নয়!

সাহসের এখনই কী দেখলে? শালে চুহাকি বাচ্চে!

শামীম বলল।

বলেই, ওর টাই ধরে এক হ্যাঁচকা টান লাগাল।

কী, কী হচ্ছেটা কী?

ধমক লাগাল ইদুরকার। হতভম্ব হয়ে।

শামীম এক চড় মারল ওর গালে।

নার্ভাস হয়ে গেল ইদুরকার। ওর মতো মার্সিডিস-গাড়ি চড়া মানুষকে বাজারের একটা সামান্য ঘড়ি-সারাইওয়ালা যে চড় মারতে পারে, ভাবতে পর্যন্ত পারেনি ও।

ভুচু পিস্তলটা বার করে বলল, জামা-কাপড় সব খোলো।

কেন? কেন? টাকা চাও? উ্য স্টিংকিং মেকানিক! এই নাও আমার পার্স। দু হাজারের উপর টাকা আছে এতে।

একটু চুপ করে থেকে ও বলল, কার সঙ্গে লাগতে এসেছ জানো না। তোমাদের কপালে অশেষ দুঃখ।

শামীম বলল, নিজের কপালের লিখন ঠেকাও আগে, তারপর আমাদের কপাল নিয়ে ভেবো।

ভুচু আবারও বলল, জামা-কাপড় সব খোলো।

ভুচুর চোখে কী দেখল কি জানে, ইদুরকার। লক্ষ্মী ছেলের মতো জামা কাপড় সব খুলে ফেলল। পায়ে জুতো-মোজা, আর আণ্ডারওয়্যার পরে দাঁড়িয়ে রইল হাস্যকর ভঙ্গিতে।

ভুচু বলল, গাড়ি ঘোরাও। পালাবার মতলব ছাড়ো। গাড়ি ব্যাক করে নিয়ে নদীর দিকে চলো।

ইদুরকার গাড়িতে গিয়ে বসেই এঞ্জিন-স্টার্ট করল। অত পাওয়ারফুল এঞ্জিন! গমগম করে উঠল দুপাশের জঙ্গল। হঠাৎই ভুচু লক্ষ্য করল যে, ব্যাক না করে, এঞ্জিন রেস করছে ইদুরকার। পরক্ষণেই বুঝল যে, ক্লাচ টিপে এঞ্জিন রেভ-আপ করে হঠাৎই ক্লাচ ছেড়ে দিয়ে ও এক ঝটকায় ওদের জীপটাকে ধাক্কা দিয়ে পথ থেকে সরিয়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। একথা ভাবার সঙ্গে সঙ্গেই যা ভাবল, তাইই ঘটল। এবং সঙ্গে সঙ্গে ভুচু ওর গাড়ির টায়ার লক্ষ্য করে দুটি গুলি করল। কিন্তু তারই মধ্যে মার্সিডিস গাড়িটা প্রচণ্ড জোরে গিয়ে জীপটাকে ধাক্কা মারল। জীপটা এক দমকে পেছিয়ে গেল অনেকটা। কিন্তু পেছিয়ে গিয়ে ঢালুতে গড়িয়ে এমনই আড়াআড়িভাবে পথের উপর অনড় হয়ে দাঁড়াল যে, মার্সিডিজ গাড়ির পথও একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল। জীপের হেডলাইট দুটো আর গাড়ির হেডলাইট সাইড লাইট সব চুরমার হয়ে গেল। অত জোরে ধাক্কা লাগল অথচ গাড়িটার রেডিয়েটরের কিছুই হল না। অ্যাম্বাসাডর হলে এতক্ষণে সব জল পড়ে যেত পথে।

পালাবার পথ বন্ধ হওয়াতে এবার ঘাবড়ে গেল ভীষণ ইদুরকার।

ভুচু পিস্তল হাতে, ইশারাতে আবারও গাড়ি ব্যাক করতে বলল। রাগ হয়ে যাচ্ছিল ভুচুরও। ইদুরকার জানে না, শামীমের হাতে ওকে ছেড়ে দিলে কী করবে শামীম!

এবারে বাক্যব্যয় না করে গাড়ি ব্যাক করল ইদুরকার। দু তিনবার চেষ্টা করে।

হঠাৎ একটি খসখস আওয়াজ শুনে চমকে তাকাল ভুচু শামীমের দিকে। দেখল, শামীম পিস্তল বের করছে।

ভুচু দৌড়ে গেল শামীমের দিকে। চিৎকার করে উঠল। এবং সঙ্গে সঙ্গে হাত ধরে ফেলল শামীমের।

শামীমের মুখচোখ অপ্রকৃতিস্থ হয়েছিল।

ভুচু জোর করেই পিস্তলটা কেড়ে নিল শামীমের কাছ থেকে।

ইদুরকার হাঁটু গেড়ে বসে হাতজোড় করে শামীমকে বলল, সব নিয়ে নাও শুধু জীবনটা নিয়ো না। আমি কথা দিচ্ছি, হাটচান্দ্রা ছেড়ে দিয়ে চলে যাব।

হেসে ফেলল, শামীম।

বলল, শালে কুত্তা, মওত্সে ইত্‌না হি ডরতা তু? কামিনে? তু মরদ, ইয়া আওরৎ?

ভুচুর মনে পড়ল, পৃথু একদিন বলেছিল ওকে যে, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে নামের একজন আমেরিকান লেখক বলেছিলেন যে, মানুষের পয়সা যে অনুপাতে বাড়তে থাকে ঠিক সেই অনুপাতেই তার জীবনের মায়াও বাড়তে থাকে। যাদের পয়সা কম তাদের জীবনের মায়াও কম। কথাটা হয়তো ঠিকই!

ভুচু ইদুরকারকে গাড়ি চালিয়ে আগে আগে যেতে বলল নদীর দিকে।

মারধোর যা করার নির্জনের গভীরে গিয়েই করা ভাল। দেখতে দেখতে পৌঁছেও গেল নদীর সামনে। এখানে পথটা খাড়া নামে গেছে নদীতে। হ্যাণ্ডব্রেক লাগিয়ে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ইদুরকার তাড়াতাড়ি জামা কাপড় পরে ফেলল আবার। বলল, খালি গায়ে থাকলে সুড়সুড়ি লাগে আমার।

ভুচু একটা অর্জুন গাছের নীচের ছায়ায় পাথরের উপরে বসে দুদিকে দু পা ছড়িয়ে শামীমের পিস্তলটা হাতে নিয়ে হাসল।

শামীম বলল, ঠিক আছে। খালি হাতেই যা পারি করব।

আমার আপত্তি নেই। কিন্তু ঠিক আমাদের হাতে সময় বেশি নেই। চলো এই মস্ত শেঠকে গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে দিয়ে যাই। এদিকে কেউই আসে না। কোনও বস্তিও নেই ধারে কাছে। লেবার জোগাড় হল না বলেই তো কজওয়ের কাজ অ্যাবানডানড হয়ে গেল। গাছে-বাঁধা অবস্থাতেই শুকিয়ে মরুক ও।

ইদুরকার এদিক ওদিক দেখছিল দৌড়ে পালাবার মতলবে। ভুচু পিস্তলটা তুলে বলল, একদম না। প্রাণ তবে কিন্তু সত্যিই যাবে।

কত সময় আছে তোমার?

শামীম বলল।

পাঁচ মিনিট থেকে দশ মিনিট। যা করবার করো। বেতের লাঠি দুটো বের করো। শুধু কথাতেই তো সময় যাচ্ছে।

তুমি কিন্তু কাছেও আসবে না আমার। যা করার আমি একাই করব।

শামীম বলল ভুচুকে।

ভুচু বলল, ইদুরকারকে, যা বলবে শমীমভাই তাইই করবে। ত্যাণ্ডাই-ম্যাণ্ডাই করলে আমার গুলিতেই প্রাণ যাবে।

ঠিক আছে। ঠিক আছে। বলল, ইদুরকার। দু হাত দুপাশে তুলে।

শামীম ইদুরকারকে নিয়ে গাড়ির মধ্যে গিয়ে বসল। পেছনের সীটে।

কী করবে? সিগারেট লাইটার দিয়ে ছ্যাকা দেবে কী? যা খুশি করুক। প্রাণে না মারলেই হল। যা করতে চায় করে, পৃথুদার কাছে মৌলবীর কাছে ওর ঋণ শোধ করার বৃথা চেষ্টা করুক। যদি আনন্দ পায় তাতেই তো পাক।

ভাবল ভুচু।

রুষার মুখটি কেবলই মনে পড়ছিল ভুচুর। কাল রাতে রুষার চিঠিটি ওকে পড়তে দেওয়া উচিত হয়নি পৃথুর। যেদিন রুষা বৌদি কারখানাতে এসেছিলেন, ওর ঘরে বসেছিলেন সেদিন থেকেই একটা ঘোরে আছে ভুচু। মনের এই রকম অবস্থা আগে কখনওই হয়নি। তাই ইদুরকারকে হেনস্থা করতে পেরে ও একধরনের ব্যক্তিগত আনন্দও পাচ্ছে, অথচ যে-আনন্দর স্বরূপ সম্বন্ধে ওর স্পষ্ট কোনও ধারণাও নেই।

রুষা বৌদিকে কাছ থেকে এর আগে মাত্র একদিনই দেখেছিল। পৃথুদার বাড়িতে। সেই মানুষটি আর এই মানুষটির মধ্যে অনেকই তফাত। সে ছিল একজন গর্বিত, দাম্ভিক, সুন্দরী, চোখ-ঝলসানো নারী। আর তার কারখানায় দেখা রুষা বৌদিকে বড় করুণ, অসহায় বলে মনে হয়েছিল। পামেলার মুখের মধ্যে যেরকম একটি ভাব ছিল, সেই রকম এক ভাব দেখেছিল সেদিন। কখন যে কোন নারীর মুখের ভাব কোন পুরুষের বুকে কী ভাব জাগায় তা বিধাতাই জানেন বোধহয়! বেচারি ভুচু! মানুষের মনের কারবারী ও কখনওই ছিল না। নারীর মনের তো নয়ই। কী যে হল তার! কিছুই ভাল লাগছে না আর সেদিন থেকে। খেতে নয়, কাজ করতে নয়। শুধুই শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। নয় তো একা একা বনে বনে ঘুরতে। কেবলই রুষা-বৌদির মুখটা ভাসে চোখের সামনে। মনে মনে কত কথা বলে ওঁর সঙ্গে। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, তিন চারদিন আগের এক রাতে কল্পনায় রুষা বৌদিকে খুব আদরও করে দিয়েছিল।

ছিঃ ছিঃ। পৃথুদা জানলে কী ভাববে!

কল্পনায় কাউকে আদর করাও কি দণ্ডনীয় অপরাধ? ইন্ডিয়ান পেনাল কোডে কোনও ধারা কি আছে? কে জানে?

অবাক হয়ে দেখল ভুচু যে, শামীম ইদুরকারকে নিখুঁতভাবে জামা-কাপড় পরাচ্ছে। টাই বাঁধতে সাহায্য করছে। বড় আদরে। ছেলে, যেন নিকাহ করতে যাবে, এমনই ভাব।

জামাকাপড় ঠিকঠাক হলে, গাড়ির দরজা খুলে ইদুরকারকে বসতে বলল শামীম, স্যুটেড-ব্যুটেড হয়ে। তারপর নিজেই বসল স্টিয়ারিং-এ। গাড়ির কাঁচ নামিয়ে ভুচুকে বলল, জীপে গিয়ে জীপ স্টার্ট করতে এবং মুখটা ঘুরিয়ে রাখতে। ও আসছে এখুনি।

ইদুরকার শামীমেরই নির্দেশে চাবি ঘুরিয়ে শামীমকে দিয়েই গাড়ি স্টার্ট করাল। তারপর চাকার সামনে রাখা পাথরগুলো নেমে সরাতে লাগল। ভুচু গিয়ে জীপে বসে, জীপ ব্যাক করে ঘুরিয়ে রাখছিল। জীপের বিশেষ ক্ষতি হয়নি। রেডিয়েটরেরও ক্ষতি হয়নি। শুধু হেডলাইট দুটোই গেছে। গ্রিলটাও মেরামত করতে হবে। হঠাই ভুচুর মনে পড়ল শামীম তো গাড়িই চালাতে জানে না। সে মার্সিডিজের স্টিয়ারিং-এ বসে কী করছে?

কথাটা মনে হতেই ভুচু স্টার্ট বন্ধ করে জীপ থেকে নামতেই দেখল, মার্সিডিজটা একেবারে নদীর ধারে গড়িয়ে গেছে। একটু হলেই জলে পড়বে। ইদুরকার গাড়ির সামনের সীটেই বসে আছে। শামীমকে এখন আর দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ ইদুরকার মাথা নিচু করে ফেলল।

ভুচু, সন্দিগ্ধ চোখে ওদিকে এগিয়ে যেতেই মার্সিডিজের এঞ্জিনটা প্রচণ্ডভাবে গর্জন করে উঠল এবং সঙ্গে সঙ্গেই অতবড় গাড়িটা জল ছিটিয়ে হাঁলো নদীর মধ্যে গিয়ে পড়ল। গাড়িটা জলে নেমে যেতেই দেখতে পেল, শামীম পথের বাঁ দিকে চিৎপটাং হয়ে পড়ে আছে।

ব্যাপারটা কী যে ঘটল তা বুঝতে না পেরে ঢালু বেয়ে দৌড়ে গেল ভুচু। জলের মধ্যে তখনও জল ও বালি তোলপাড় করে গাড়িটা ক্রমশ গভীর জলে এগিয়ে যাচ্ছিল। এক সময় অদৃশ্য হয়ে গেল গাড়ি। জলের নিচ থেকে এঞ্জিনের আওয়াজ আর শোনা গেল না। আলোড়নও নয়। অনেকক্ষণ বুড়বুড়ি উঠল। তেল-মবিল ভেসে উঠল জলের উপর। কিন্তু নদীর স্রোত সঙ্গে সঙ্গে তা ধুয়ে নিয়ে গেল। এখন হাঁলোর দিকে চাইলে বোঝাই যাবে না যে, তার গর্ভে একটি পাঁচ লাখ টাকা দামের সাদা রঙা সুন্দর মার্সিডিজ শুয়ে আছে। জলে টইটম্বুর হয়ে।

ইদুরকার কোথায়?

উত্তেজিত, অবাক-হওয়া ভুচু শামীমকে শুধোল, দু পাশের গাছ গুলোর দিকে চেয়ে। কোনও গাছ থেকে নাইলনের দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দিল কি শামীম তাকে? জলজ্যান্ত লোকটা হাপিস হয়ে গেল?

শামীম নিজের কুর্তা পাজামা থেকে ধুলো ঝাড়তে লাগল মনোযোগের সঙ্গে ভূপতিত অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে। ওর কনুই ছড়ে গিয়ে রক্ত বেরুচ্ছিল। বলল, দেখেছ! কোনও মানে হয়? ঝুঠঠো!

অধৈর্য গলায় ভুচু বলল, আরে ইদুরকারকে কী করলে? কোথায় সে?

শামীম একবার হাসল। পৈশাচিক হাসি। তারপর জলের দিকে আঙুল দেখাল।

বলল, গাড়ির মধ্যেই আছে। গুলি কিন্তু করিনি আমি।

রাগে, চিৎকার করে উঠে দৌড়ে গেল ভুচু জলের দিকে। তারপর নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। যতখানি হেঁটে যাওয়া যায়, গেল। তারপর সাঁতরে গেল। একটু পরেই পায়ের নীচে শক্ত মতো কী যেন ঠেকল। বুঝল, মার্সিডিসের ছাদ। ছাদে দাঁড়িয়েও ওর কোমর জল সেখানে। ডুব সাঁতার দিয়ে, গাড়ির গায়ে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে দরজা কোন দিকে তার হদিশ করতে লাগল। একটা হ্যান্ডেলে হাত লাগল। হ্যান্ডেলের গোড়ার বোমও টিপল। কিন্তু দরজা কিছুতেই খুলল না। মনে হল, হাজার মন ওজন হয়ে গেছে সবকটি দরজার। ঘোলা জলে কিছু দেখাও গেল না। দম নেবার জন্যে উঠে এল একবার উপরে। বুক-ভরে দম নিয়ে আবারও ডুব দিল। তারপর আরও একবার। নাঃ। কিছুই করার নেই।

ক্লান্ত, ক্রুদ্ধ ভুচু চুপচুপে ভিজে যখন নদীর পাড়ে উঠল, দেখল শামীম জীপের ড্যাশবোর্ড খুলে পান খাচ্ছে।

ভুচু কাছে আসতেই পান জর্দা এগিয়ে দিল ওর দিকে।

হাতের এক ঝটকায় ফেলে দিল সেগুলো ভুচু।

হিঃ হিঃ করে হাসল শামীম।

বলল, তুনে বোলাথা, পিস্তল বেগর যো-কুছ কর না ম্যায় করনে শকতা। আভ্‌ভি গোসসা কিস লিয়ে হো রহা হ্যায়?

ভুচু পুরো ব্যাপারটার অভাবনীয়তায় স্তম্ভিত হয়ে ছিল তখনও।

বলল, কী করে করলে? করলেটা কী?

সামনের চাকার বড় পাথরগুলো এক এক করে সরিয়ে দিতে বললাম ওকে। একটু হলে গাড়ির নীচে নিজেই চাপা পড়ে মরতাম। ওর কাছ থেকে গাড়ি স্টার্ট করা দেখে নিলাম। গীয়ারে দিলাম। তারপর দরজা খোলা রেখে অ্যাকসিলারেটরের উপরে একটা পাথর চাপিয়ে দিলাম।

ইদুরকার বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেনি?

করেছিল তো!

তবে?

শামীম তার কুর্তার নিচ থেকে একটা ছুরি বের করল। নিজের গলা আর জিভ দিয়ে শব্দ করল “খিশ-শ-শ” করে। বলল, অ্যাকসিলরেটরে পাথর চাপাবার আগেই…

গা ঘিনঘিন করে উঠল ভুচুর।

এই সব খুনী বদমাসদের সঙ্গে আর নয়। যারা খুন করার আনন্দর জন্যেই খুন করে তাদের সঙ্গে আর সম্পর্কই রাখবে না কোনও। জীবনে কত সুন্দর সব অনুভূতির শরিক হওয়ার কথা ছিল এতদিনে! ভালবাসা, ছেলেমেয়ে, সুখ, শান্তির ঘর-সংসার। এই পৃথুদাটাই যত নষ্টের গোড়া! তার চামচেগিরি করেই নিজের জীবনটা বরবাদ্‌ হয়ে গেল। এই দলের মধ্যে মাত্র একটা লোকই ছিল মানুষের মতো মানুষ। সে হচ্ছে দিগা পাঁড়ে। বড়ই অশান্তি ভুচুর মনে। কয়েকদিন থেকেই ছিল। ইদুরকারকে এই ভাবে মারতে দেখে সেটা আরও বেড়ে গেল। ভাবল, কাল সে দিগা পাঁড়ের কাছে যাবেই একবার।

জীপ চালিয়ে যাচ্ছিল খুব আস্তে আস্তে ভুচু। হয়তো মনের অশান্তিকে স্তিমিত করার মিথ্যে চেষ্টাতেই আস্তে চালাচ্ছিল। জঙ্গলের মধ্যে পথের দুপাশে পাতা ঝরে যাচ্ছে; উড়ছে, মধ্যদিনের হাওয়ায়। পত্রহীন আমলকি গাছে আমলকি ফলে আছে থোকা–থোকা। গাছটা দেখে ভাল লাগল খুব। পাতা নেই একটিও, সবুজের চিহ্ন নেই; তবু ফলে নুয়ে আছে। ভাবল, কত রকম মানুষ, কত রকম গাছ আছে এই যেশাস ক্রাইস্টের পৃথিবীতে!

শামীম আবারও দুটো পান এগিয়ে দিতে গেল ভুচুর দিকে।

ভুচু সঙ্গে সঙ্গে এক থাবায় ওর হাতটি ধরে জীপ চালাতে চালাতেই ভীষণই জোরে মুচড়ে দিল। নিষ্ঠুর হয়ে উঠল ওর মুখ। বলল, শোনো শামীম ভাই! তোমার জান একদিন আমার হাতেই যাবে। জেনে নিও। হুদার সঙ্গে তোমার মেয়ের বিয়ে ঠিক করে বোধ হয় আমি ভুলই করেছি। নুরজেহানের গায়ে তো তোমারই রক্ত থাকবে কিছু। নিজেকে বদলাও শামীম। নইলে, তোমার মওত আমিই বয়ে আনব।

কাফিরের কাছে জ্ঞান নিই না আমরা।

শামীম ঘৃণায় ঠেটি বেঁকিয়ে বলল।

নিও না। তবে কথায় কথায় ছুরি বের করে লোকের গলা না-কেটে, সেই ছুরি দিয়ে তোমার নিজের অন্দরমহলের বোরখার কালো কাপড়গুলো কাটো তো দেখি! তো বুঝি কিছু করলে!

কাফির, ক্রীশ্চান, ভুচু। তোমার সঙ্গে আমি এইসব আলোচনা করতে চাই না। কোনও আলোচনাই নয়। তুমি দোস্ত। তোমাকে শেষবারের মতো সাবধান করে দিচ্ছি।

তুমি জাহান্নমে যাও। কবরের অন্ধকারেই বেঁচে থাক তুমি। তোমার দোস্তিতে দরকার নেই। আমার। পুলিশে জিজ্ঞেস করলে, আমি তোমাকে ধরিয়ে দেব। দেখো তুমি!

পুলিশ তো জিজ্ঞেস করবে একমাস পরে। যদি আদৌ করে। জল যখন কমবে নদীর, যখন গাড়িটা মাথা-উঁচু করবে। কিন্তু প্রমাণ করবে কী করে? সাক্ষী কে ছিল?

আমি ছিলাম!

ভুচু বলল, বিরক্ত গলায়।

পারবে না ভুচুবাবু। তুমি তো পিরথুদাদারই চেলা! চাইলেও, ক্ষতি করতে পারবে না কারওই।

একটু চুপ করে থেকে বলল, পৃথুদাদার কাছে যে আমার অনেকই ঋণ ছিল! শোধ করার এমন মওকা আর পেতাম না।

ভুচু কিছু বলল না। কথাটা হয়তো মিথ্যে নয়।

শামীম বলল, হিন্দুঁস্তাতে আইন এখনও বড়লোকদেরই জন্যে। গরীবের কথা, আদালতে ট্যাঁকে না। যার পয়সা আছে আইনের তামাশা শুধুমাত্র তারই জন্যে। উকিল, ব্যারিস্টার, জজসাহেব সবাই তার দিকে। তেমন দরকার পড়লে, আইন নিজে হাতে না তুলে যে উপায় নেই!

তবু, এমনভাবে, জ্যান্ত মানুষটাকে জলে ডুবিয়ে মারা? ভাবতে পারছি না আমি।

শামীম বলল, অজীব বাঁতে কর্‌ রহ্যা হ্যায় তু! উত’ আধামুর্দা বন গ্যয়ে থে ঈয়ে চাক্কুসে!

বলে, আবারও পান এগিয়ে দিল ভুচুর দিকে।

এবার ভুচু পান নিল। মুখটা শুকনো লাগছিল। ভয়ও লাগছিল। মিলিকে জেরা করলে তো মিলির কাছ থেকে পুলিস সবই জানতে পারবে। অবশ্য মিলি কিছুই জানে না। মিলিকে ওরা উদ্ধারই করেছে শুধু। উদ্ধার করেই ফিরে এসেছে। মিলি তাই-ই জানে। তারপর ইদুরকারের কী হয়েছে তা কে জানে?

পিচ রাস্তার কাছে এসে জীপটা দাঁড় করাতে বলল শামীম। জঙ্গলের ভিতরে রাখতে বলল।

ভুচু জীপটা রাখতেই শামীম নেমে গিয়ে কতগুলো পুটুসের ঝাড় কাটল ছুরি দিয়ে। তারপর পিচ রাস্তা থেকে মার্সিডিসের টায়ারের দাগ এই অন্ধ-বনপথের মধ্যে দুশো গজ মতো নির্মূল করে মুছে দিল ওই ডালপালা দিয়ে। যাতে, ওই মোড়ে দাঁড়িয়ে মার্সিডিস গাড়ি যে এই পথে আদৌ ঢুকেছে তা বোঝাও না যায়। পিচ রাস্তাতে পড়ে হাটচান্দ্রার দিকে মাইলখানেক যাওয়ার পর শামীম ভুচুকে আবার জীপ দাঁড় করাতে বলল। নেমে, বনেট খুলল। ভুচুকেও বলল, নেমে দাঁড়াতে পথের মাঝখানে।

কেন?

অবাক হয়ে ভুচু জিজ্ঞেস করল।

এক্ষুনি সার্ভিস পাস করবে। আপ-ডাউনে দুই-ই। তোমাকে সকলেই চেনে। আমাকে না চিনলেও। ডাউনের ড্রাইভারকে বলে দেবে তুমি যে, আমরা দেড়ঘণ্টার উপর এখানে পড়ে আছি। ফ্যানবেল্ট ছিঁড়ে গেছে। কারখানায় একটা ফোন করে দিয়ে যেন বলে, মোটর সাইকেল বা অন্য গাড়ি করে জীপের ফ্যানবেল্ট কেউ নিয়ে আসে।

লাভ?

ভুচু বলল, অবাক হয়ে।

লাভ? দু-বাসশুদ্ধ লোক সাক্ষী থাকবে যে আমরা দেড় ঘণ্টার উপর এই সময়ে, পথের এই জায়গাতেই অনড় পড়ে আছি। ওদের বলব, দৃজন ট্রাকওয়ালাকেও বলেছি, তারা বোধ হয় খবর দেয়নি। মানে দুজন ট্রাকওয়ালাও দেখেছে।

কামিনা কাঁহাকা!

বলে, ভুচু জীপটা থেকে নেমে দাঁড়াল। দাঁতে দাঁত চেপে।

শামীমের মাথাটা সত্যিই ক্রিমিনালের। অবশ্য ক্রিমিনাল তো ও নিশ্চয়ই।

শামীম হাসছিল। তখনও ওর ছুরিতে ইদুরকারের গলার গরম রক্ত লেগেছিল বোধ হয়। তবুও হাসছিল; পান খাচ্ছিল। এবং সেই বেসুরো গজলও গাইতে শুরু করল আবার।

থামো! থামো!

বলল, ভুচু।

নাঃ। খারাপ। বড়ই খারাপ হয়ে গেছে ভুচু। একটার পর একটা খারাবিতে ফেঁসে যাচ্ছি ক্রমশ। সবচেয়ে বড় খারাবি; এই রুষা-বৌদির প্রতি মনোভাবটা।

ওকি বাঁচবে? এই ব্ল্যাক-মেইলরদের দুনিয়াতে কোনও অন্যায়কারীই কি শেষে বাঁচতে পারে? সে অন্যায়, যতবড় ন্যায়ের জন্যেই করা হয়ে থাক না কেন!

যেমন বলেছিল শামীম, বিপরীতমুখী বাস দুটো একটু পরই এসে গেল পরপর। ড্রাইভাররা মুখ বার করে কথা বলল। ভুচুই বলল, যা বলার। শামীম বনেটের মধ্যে ঘাড় গুঁজে মনোযোগের সঙ্গে এঞ্জিন পরীক্ষা করছিল।

বাসগুলো পাস করে গেলে বলল, চলো।

ভুচু জীপটা স্টার্ট করতেই শামীম বলল, পুলিশ কোনও দিন জিজ্ঞেস করলেও তুমি আমাকে ফাঁসাতে পারবে না। কারণ এইখানে আমাকে কেউই দেখেনি। সবাই তোমাকেই দেখেছে। এবং জীপটাও তোমারই। তোমার সাহায্য ছাড়া আমি তো আর একা একা অত দূরে গিয়ে একা হাতে ইদুরকারকে মেরে তারপর এতকাণ্ড করতে পারি কেউই একথা বিশ্বাস করবে না। আমায় ফাঁসালে তুমিও ফাঁসবে। প্রেমে-পড়া পুরুষদের কিছু বিশ্বাস নেই। তাদের ঘুমন্ত বিবেক হঠাৎ হঠাৎ জেগে উঠে তড়পাতে থাকে ময়ূরের পেখমের মতো।

প্রেমে-পড়া পুরুষদের মানে?

ভুচু অবাক হয়ে মুখ ঘুরিয়ে বলল।

শামীমও মুখ ঘুরিয়ে তার দুচোখ ভুচুর দু চোখে স্থির রেখে বলল, ঠিকই বলেছি! প্রেমে-পড়া পুরুষদের!

ভুচু একটুক্ষণ শামীমের চোখে চেয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নিল।

মানুষ যারা ভাল, সৎ, তারা অন্যর চোখে চোখ রেখে মিথ্যা বলতে পারে না।

ও নিজে ভাল মানুষ বলে, নিজেকে অভিসম্পাত দিল ভুচু। ভালমানুষদের বড়ই কষ্ট, এই খারাপ মানুষে ভরা পৃথিবীতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *