৬৯
ভুচু একটা অ্যাম্বাসাডর গাড়ির নীচে ত্রিপল পেতে শুয়ে, ডিফারেন্সিয়ালের ক্র্যাক দেখছিল। দু ফোঁটা ডিফারেন্সিয়াল অয়েল পড়ল কপালে। বিরক্তিসূচক শব্দ করল ও একটা।
আজকাল নিজে এসব কাজ বিশেষ করে না। তবে গাড়িটা উধম সিং সাহেবের। হাটচান্দ্রা শেল্যাক কোম্পানিই তার প্রথম খদ্দের ছিল। ধীরে ধীরে হাটচান্দ্রা জায়গাটা যত বড় হয়ে উঠেছে এই কোম্পানির যত বাড়বাড়ন্ত হয়েছে ভুচুর কারখানাও তত বড় হয়েছে।
ত্রিপলটার উপরে আরও একটু নেমে শুলো ও। বাঁ হাতের তেলো দিয়ে ডিফারেন্সিয়ালের তেলটা মুছল কপাল থেকে। ওর বাঁ দিকে একটা কমলা-রঙা ছায়া পড়ল হঠাৎ। অথবা, কে জানে কেন, রোদের রঙ হঠাৎই হালকা কমলা হয়ে গেল।
ভুচু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, একজোড়া কোলাপুরি চটির উপর সুন্দর গড়নের ফর্সা একজোড়া মেয়েলি পা। পায়ের পাতাদুটি ঘিরে হাল্কা সবুজ জরির পাড়ে মোড়া কমলা রঙা ইড়িকালি শাড়ি। মধ্যে অতি-হাল্কা সবুজরঙা চেক। প্রিয়া তেণ্ডুলকার ঠিক এই রকম একটি শাড়ি পরে এসেছিলেন এখানে। গিরিশদার বম্বেবাসী এক বন্ধুপত্নী ছিলেন এখানে তখন। উনিই নামটি বলেছিলেন শাড়ির। মারাঠি শাড়ি।
পা দেখেই পায়ের মালিককে চিনল ভুচু। এমন পা রোজ পড়ে না এই কারখানায়। হুদা কী যেন বলল একটা। ওর কথা শেষ হবার আগেই হড়বড়িয়ে উঠতে গেল ভুচু। মাথাটা ঢুকে গেল ডিফারেন্সিয়ালের সঙ্গে। ততক্ষণে হুদাও উবু হয়ে বসে গাড়ির নীচে মুখ বাড়িয়েছে। ভুচুকে খবরটা দেওয়ার জন্যে। ভুচুর মাথাও ঠুকে গেল বলে একটু অবাক হল হুদা। উস্তাদকে অনেকদিন ধরেই দেখছে গাড়ির নীচে কাজ করতে। মাথা ঠুকে যেতে পারে কখনও যে ওস্তাদের তা ওর জানা ছিল না।
বাইরে বেরিয়েই কপালে হাত দিল ভুচু।
কী হল?
রুষা বলল।
নাঃ। ও কিছু না।
কিছু না কি ওস্তাদ? কেটে গেছে যে! ডেটল লাগাও। এই, রামু, দৌড়ে যা।
ভুচু বলল, কপালেরই দোষ।
রুষা হাসল। সে কথা শুনে।
রুষাকে নিয়ে ওর ঘরে এল। চেয়ারটা ঝেড়ে দিল ঝাড়ন দিয়ে। লজ্জিত গলায় বলল, যা ধুলো! ভদ্রলোকদের এখানে বসানো যায় না। পাখাটাকে ‘অন’ করে খুলে দিল। ততক্ষণে রামু ডেটলে তুলো-ভিজিয়ে নিয়ে এসেছে। ডেটল লাগানোর পর ব্যান্ড-এইডও লাগাল। ঘরের ড্রয়ারেই ছিল।
ভুচু বোকাবোকা ভাবে কিছু বলতে হয় তাইই বলল, পৃথুদা অন্যরকম ছিল তো। মানে, আমি তাঁকে ‘ভদ্রলোক’দের মধ্যে ধরতাম না। উনিও আমাকে ‘ছোটলোক’ ভাবতেন না।
হ্যাঁ। উনি মহৎ লোক ছিলেন।
রুষা বলল, মুখ নামিয়ে।
ভুচু বুঝল না, ‘মহৎ’ কথাটা ঠাট্টার, না সত্যিই প্রশস্তির।
রুষার মুখের দিকে তাকাল, চোখ দুটি খুঁজল, কিন্তু চোখ নামিয়ে বসেছিল রুষা। চোখ-ছাড়া মুখের মানে বোঝা যায় না, মানে হয়ও না হয়তো কোনও।
চুপ করে রইল ভুচু।
কালও সারা রাত ঘুমোতে পারেনি ভুচু। ছটফট করেছে বিছানায়। একবার বারান্দার চৌপাইতে এসে শুয়েছে আবার ঘরে গেছে। সারা শরীরে জ্বালা। দু বার চান করেছে রাতে। সন্ধেবেলা চান করা সত্ত্বেও। তবুও ঘুম হয়নি। শেষ রাতেই যা ঘুমিয়েছিল একটু। ভোর ছটার পর কারখানায় ঘুমোনো যায় না। দু শিফটে কাজ হয়। ছটা থেকে বারোটা, বারোটা থেকে ছটা। সকাল নটা আর বিকেল তিনটেয় চায়ের জন্যে পনেরো মিনিট কাজ বন্ধ থাকে শুধু।
সারা রাত গা-জ্বালা করেছে। ছটফট করেছে শুধু রুষারই মুখ ভেবে। চোখে ভেসেছে তারই হাসি। গলার স্বর কানে বেজেছে। রুষাময় যে রাত, তা পোয়ানোর পর রুষা নিজে এসে সামনে বসাতে কিন্তু তার জ্বালা নেই কোনওরকম। প্রলেপ লেগেছে ভাললাগার সব জ্বালারই উপরে।
রুষা বলল, কাল রাতে ভাল ঘুম হয়নি। হয়ইনি বলতে গেলে।
চমকে উঠল ভুচু। বলল, কার?
আমার।
রুষা বলল।
ওঃ। বলেই, কথা ঘুরিয়ে বলল, কী খাবেন বৌদি? নাস্তা করে এসেছেন?
হ্যাঁ হ্যাঁ। কিছু খাব না। ব্রেকফাস্ট করেই তো এলাম।
তা কি হয়? কিচ্ছু খান। চা অথবা কফি অন্তত। আমি করে দিচ্ছি এক মিনিটে। অতিথি কিছুই না খেলে গৃহস্থর অকল্যাণ হয়।
রুষা হেসে বলল, গৃহস্থই বটে! তারপর একদৃষ্টে ভুচুর চোখের দিকে চেয়ে বলল, তোমার কী ধারণা, আমি তোমার এখানে খেতেই আসি?
অপ্রস্তুত হয়ে গেল ভুচু। বলল, কী যে বলেন! না, না, সে কি, আমি…আপনি তো কাজেই আসেন। বলুন, আর কী করতে পারি আপনার জন্যে।
তাইই ভাবছি। কী আর করতে পার! পুরনো বাড়িতে এনে আবার নতুন করে তোমরাই বসালে। ভাগ্যিস ফার্নিচারটার কিছুই নিয়ে যাইনি। মনে মনে আমার একটা প্রিমনিশান ছিলই, জানো …
তাহলে, গেছিলেন কেন?
তাইই তো ভাবি। তোমরা তো শিকার করতে। এখনও হয়তো কর লুকিয়ে-চুরিয়ে। ভাল জানবে তোমরা আমার চেয়ে। কোনও কোনও হরিণী কি দ্যাখোনি? যারা জঙ্গলের গভীরের নিশ্চিন্ত-নিরাপদ অন্ধকার ছেড়ে শীতের সকালের রোদ-পড়া খোলা মাঠে ঘাস খেতে আসেই, শিকারির গুলি খেতে পারে যে তা জেনেও?
দেখেছি।
মুখ নামিয়ে ভুচু বলল।
আমিও সেরকমই। গুলি লাগাতে পারে তা জানতাম। তবে, লাগবেই যে, তা জানতাম না। অনেক হরিণীই তো বেরিয়ে আসে খোলা-মাঠে। সকলেই কি মরে? বলো ভুচু? অনেকে তো নিরাপদে ফিরেও যায়।
ভুচু একটা সিগারেট ধরাল লাইটার জ্বেলে। বলল, কফি খান বৌদি।
বলেই, উঠল।
রুষা বলল, আমাকে তুমি বৌদি বোলো না।
বলব না? কেন? তবে কী বলব? বৌদিই তো বলতাম!
আমার একটা নাম তো আছে। তোমার এক-সময়ের দাদার সঙ্গে যখন আমার আর সম্পর্ক নেই কোনও, তখন এই মিথ্যে সম্পর্কের বোঝা তুমি অথবা আমি বইবই বা কেন? তুমি আমাকে রুষা বলেই ডেকো। যা আমার নাম।
বেশ! ভুচু বলল।
কিচেনে গিয়ে গ্যাসটা জ্বালতে গিয়েই ভুচুর আঙুল পুড়ে গেল। এও জীবনে প্রথম। জীবনে “প্রথম” অনেক কিছুই ঘটছে আজ। সকাল থেকে। গ্যাসের নীলচে-কমলা আগুনের শিখার দিকে চেয়ে কেটলিতে জল ভরে বসাতে বসাতে ও ভাবছিল বৌদি, থুড়ি রুষা জানে না যে, রোদপড়া বিপজ্জনক কিন্তু বড় লোভনীয় খোলা মাঠে শুধু হরিণীরাই নয়, কিছু শিঙা হরিণও আসে জীবনের স্বাদু ঘাস খুঁটে খেতে। এবং কাছাকাছি শিকারি থাকলে তার বুকেই গুলি লাগে সবচেয়ে আগে। ভাল শিকারি “হরিণীকে” গুলি করেন না। মারা বারণ। আইনের বারণ; বিবেকেরও।
দু-কাপ কফি ও কুচো-নিমকি নিয়ে ও ঘরে এল। দেখল, রুষা ঘুরে ঘুরে তার ঘর দেখছে। দেওয়ালের ছবি, বেড-কভার, চেয়ার-কুশান ফায়ার-প্লেসের ম্যান্টেলের উপর রাখা টুকিটাকি। ওর শিশুকালের একটি দাঁত-ফোকলা ফোটো। মা বাবার বিয়ের ছবি। কালো হয়ে গেছে। স্মৃতির প্রায় সবই কালো হয়ে হারিয়েই গেছে ভুচুর, বিশেষ করে শৈশবের সুখস্মৃতি। এ ফোটো কটি যে কী করে এত ঝড়ের মধ্যে বেঁচে গেল, তা ভাবলেও অবাক লাগে।
বাঃ। এই ভদ্রলোক কে? কী সৌম্যশান্ত চেহারা। মনে হয় কোনও মিশনারী!
উনি আমার বাবা।
বাঃ! মুগ্ধ চোখে চেয়ে বলল, রুষা। তারপর চেয়ারে বসে, পাশের টেবল-ক্লথ মোড়া তেপায়া থেকে উজ্জ্বল হলুদ রঙা-পোর্সিলিনের কফির মাগ তুলে নিয়ে বলল, তোমার রুচি কিন্তু ভারী সুন্দর। সত্যি বলতে কি তোমার মতো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, টাইডী হ্যাবিট্স-এর এমন গোছানো স্বভাবের পুরুষ-মানুষ আমি দেখিনি আগে। অথচ তুমি ধুলো ময়লার মধ্যেই থাকো।
লজ্জা পেল ভুচু। বলল, গোছানো ওই বাইরেটাই। ভিতরে নয়।
ভিতরে মানে?
চোখ তুলে বলল, রুষা।
মানে, মনের কথা বলছি। সব এলোমেলো হয়ে আছে।
ও!
বলেই, চোখ নামিয়ে নিল রুষা।
কেমন হয়েছে? কুচো নিমকিগুলো?
ভুচু জিজ্ঞেস করল।
ও। বলতে যাচ্ছিলাম। দারুণ হয়েছে। রেসিপি কী?
হাসল ভুচু। হাঃ! কুচো নিমকির আবার রেসিপি! তবে, একটু বেশি ময়ান দিয়ে মাখতে হয় ময়দাটা। মধ্যে কালো জিরে, সামান্য শুকনো লংকার গুঁড়ো, কারিপাতা আর ধনেপাতা কুচিয়ে দিই। যখন মাখি। খাই তো একাই। অল্পই বানাই, শনিবার রাতে। সারা সপ্তাহ চলে যায়।
তাইই? বলে হাসল রুষা। বলল, তোমার মতো স্বনির্ভর পুরুষ বড় একটা দেখা যায় না। কোনও মেয়েই কখনও কষ্ট দিতে পারবে না তোমাকে। অন্য ভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, তোমার যে স্ত্রী হবে, সে খুব সুখী হবে।
ভুচু বলল, মোটর মেকানিকের আবার বিয়ে!
কেন? নয় কেন?
বোকার মত ভুচু বলল, নয়। এইই…
আচ্ছা। খাওয়া-দাওয়া তো হল। এখন বলি যে জন্যে আসা। দুটি কথাই বলতে এসেছি। আমি। ইন্ ফ্যাক্ট্, একটি জিজ্ঞেস করতে; অন্যটি বলতে।
বলুন।
ভুচু বলল দু হাতে কফির মাগটি বুকের কাছে তুলে ধরে।
ভিনোদ ইদুরকার কোথায়? কি করেছ তোমরা ওকে নিয়ে?
ভুচুর ভিতরটা ছটফট করে উঠল। মিথ্যা কথা বলতে গেলেই ভীষণ কষ্ট হয় ওর। ঘাড়ের কাছে ব্যথা করতে থাকে। মনে হয়, দম বন্ধ হয়ে যাবে। তবু, মাথা যতখানি নাড়া প্রয়োজন তার চেয়ে অনেকই বেশি এবং অনেক জোরে নেড়ে বলল, জানি না।
জাননা না?
রুষা স্থির চোখে চেয়েছিল ভুচুর দিকে।
ভুচু আবারও মাথা নাড়ল। এবার আরও জোরে।
কফি-মাগটা তেপায়াতে নামিয়ে রেখে রুষা বলল, ঠিক আছে। এ নিয়ে এখন আর কোনও প্রশ্ন করব না। শুধু এইটুকু বলো যে, ইদুরকারের কাছ থেকে আমার বা মিলির কোনও বিপদের আশংকা কি কখনও আছে?
প্রয়োজনের চেয়ে আবারও অনেক বেশি জোরে মাথা নেড়ে ভুচু বলল, না, না।
আর তোমার? কোনও বিপদের আশংকা কি আছে তোমার ওর কাছ থেকে? ওর লোকজনের কথা আমি বলছি না ভুচু, ওর নিজের কাছ থেকে বিপদ আছে কি না তাইই জানতে চাইছি।
না, না। কিছুই নেই। এবারে আরও জোরে মাথা নাড়ল ভুচু।
রুষা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। খুব দুঃখিত দেখাল ওকে এক মুহূর্ত। পরক্ষণেই মুখে স্বাভাবিক প্রশান্তি ফিরে এল। ভুচুর চোখে চোখ রেখে রুষা বলল, আমার প্রশ্নর উত্তর আমি পেয়ে গেছি। এতটার দরকার ছিল কি? পৃথুরই মতো সব কিছুই বাড়াবাড়ি করো তোমরা। এখন তোমার জন্যেও সব সময় দুশ্চিন্তা থাকবে ভুচু। খারাপ মানুষদের অনেকগুলো জীবন। তারা মরলেও পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় না। সুযোগ খোঁজে তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা।
আমার জন্যে ভাববেন না। ঠিক আছি আমি। আপনি কি দুঃখিত বৌদি?
নই। আবার হ্যাঁও। অনেকদিনেরই পরিচয়। এতটা না করলেও পারতে তোমরা। আমি বুঝিনি যে তোমরা…
উপায় ছিল না। আপনাদের বিপদ আরও বাড়ত।
আমার বিপদ বেড়েইছে। কমেনি।
কী বিপদ?
মিলিকে নিয়ে।
কী করেছে মিলি?
হয় যা এই বয়সে, সিনেমা স্টার, সাহিত্যিক, খেলোয়াড়দের সঙ্গে মনে মনে প্রেমে পড়ে মেয়েরা। মেন্টালী ডিসঅ্যারেড্ হয়ে যায়। হিস্টিরীক্। সেই রকমই। হাইট অফ ইনফ্যাচুয়েশন্। জানি না, শারীরিক কোনও ইনভলমেন্ট ছিল কি না। এখনও জানি না। মেয়ে তো মুখ বুজে আছে। তুমি তো জানো ভুচু যে, পৃথুর ফ্যামিলিতে পাগলামি ছিল। আমি খুবই ভয় পেয়ে গেছি। আমাকে হেল্প করো। তোমার পৃথুদাকে লেখো। শুনলে আমাকে মেরে ফেলবে সে।
অন্য কাউকেই মারবার লোক পৃথুদা নয়। ডাকু মগনলালের বেলায় একসেপশান হয়েছিল। তাও তো নিজের জন্যে মারেনি। মারলে, একদিন নিজেকেই মারবে। তাকে আমি চিনি। আপনার কোনওই ভয় নেই। তবে, মিলির জন্যে সত্যিই চিন্তার কারণ আছে। দেখি, গিরিশদার সঙ্গে পরামর্শ করে যা করার করছি। তাছাড়া, পৃথুদা তো আগামী সপ্তাহে আসছেই। বলেছে, জানাবে কবে আসবে। নেক্সট রবিবারের মধ্যে আসছে। টুসুকে নিয়ে। টুসুর স্কুল কামাই হবে তা উনি চান না। এখন তো অসুবিধেও নেই।
কার অসুবিধে?
অন্যমনস্কর মতো বলল রুষা।
না, মানে পুরনো বাড়িতে তো এসেই গেছেন আপনারা!
হ্যাঁ।
অন্য কী বলবেন? কথাটা বললেন না?
ও হ্যাঁ। আমি তোমার এই কারখানায় আসি, সেটা ভাল দেখায় না। অবশ্য লোকভয়ের আমার আর কীইই বা আছে। কিন্তু আমি চাই তুমিই দিনে কম করে একবার আমার কাছে আসো। বেশিবার আসলেও আমার আপত্তি নেই। জানো ভুচু, ইদুরকারের বাড়ি ছেড়ে পরশু সকালে যখন চলে এলাম, ভেবেছিলাম একা একা পুরুষহীন হয়ে দিব্যি বেঁচে থাকা যাবে। উইওমন্স্ লিব্-এর চূড়ান্ত করব। কি জানি, হয়তো বম্বে ব্যাঙ্গালোর দিল্লি কলকাতায় হলেও হতে পারে, তবুও এই দেশে এই রকম জায়গায় এখনও মেয়েদের জীবনে অনেকই সমস্যা, কোনও পুরুষের সাহচর্য ছাড়া বাঁচা ভারী মুশকিল। হয়তো মিলিদের জেনারেশান পারবে। তখন অবস্থা অন্য রকম হবে।
একটু চুপ করে থেকেই রুষা বলল, তা বলে ভেবে বোসো না আবার যে তোমাকে অন্য কিছু বলছি। জাস্ট সাহচর্য।
বলেই উঠল। বলল, চলি।
এসেছেন কিসে?
রিকশায়।
যাবেন?
রিকশায়।
এখানে তো রিকশা পাবেন না। ছেড়ে দিয়েছেন?
হ্যাঁ মোড়ে গেলেই পাব।
কেন? আপনাকে হুদা ছেড়ে দিয়ে আসবে।
হুদা ফুদা জানি না, তুমি নিজে দেবে তো চল, নইলে রিকশাতেই যাব।
বোঝে না, এই মেয়েদের কিছুমাত্রও বোঝে না ভুচু। পামেলাকেও বোঝেনি।
জীপটা বাড়ির সামনে আসতেই রুষা বলল, বিকেলে এসো। গিরিশদাকে বলার আগে তোমার দাদাকে বলো। শ্রীরামচন্দ্রর লক্ষ্মণ ভাই তুমি। ব্যাপারটা তাকে জানানো দরকার।
ঠিক আছে। ভুচু বলল।
রুষা পোর্টিকোতে দাঁড়িয়ে সুন্দর সোনালি হাত তুলে হাত নাড়ল। ডান হাতে রিস্টওয়াচ বাঁ হাতে একটি মুক্তোর বালা। সৌন্দর্যর প্রতিমূর্তি যেন! হিন্দুদের সরস্বতী প্রতিমার মতো, নিরাভরণ কিন্তু মর্যাদায় মোড়া। এই মেয়ের সঙ্গেও ঘর করতে পারল না পৃথুদা! মানুষটা সত্যিই একটা অজীব আদমী। অনেকে বলে না! ঠিকই বলে।
জোরে গরম হাওয়া লাগছিল গায়ে। চোখে মুখে। জীপ চালাতে চালাতে ভুচু ভাবছিল, সৌন্দর্যর কোনও বিকল্প নেই। সৌন্দর্য শুধু তার নিজের জোরেই পৃথিবীর সব পাওয়া পাবার দাবি রাখে।
পানের দোকানে জীপটা রাখল। ছোঁড়াটা এনে দেবে পান, জর্দা, সব। জানে দোকানি। স্টিয়ারিং-এর উপর হাত, হাতের উপর থুতনি রেখে ভুচু ভাবছিল, কেন লেখাপড়া শেখার সুযোগ পেল না ও জীবনে? জুতো পালিশ করেই কেন শৈশব কাটাতে হল? ও-ও যদি অন্য দশজন ভদ্রলোকের মতো রেসপেক্টেবেল হত তবে তো আজ তার বুকে এত কষ্ট হতো না। রুষার মতো কোনও মেয়ে, বাস্তবে ভুচুর মত মোটর মেকানিকের স্বপ্নেই থাকে শুধু। সে যদি বহুভোগ্যা এবং পরিত্যক্তাও হয়। একটা ক্লাস-এর ব্যাপার তবুও থাকেই। এই “ক্লাসলেস সোসাইটির” দেশেও। রোজগারভিত্তিক ক্লাস এ নয়, মানসিক স্তরের বেড়ে ওঠার, শিক্ষার ক্লাস। ভেতরে ভেতরে কেউ অন্য ক্লাসের হয়ে উঠলেও বাইরের ছাপ আর তকমা না থাকলে তার দাম দেয় না কেউই। ভুচু শত চেষ্টাতেও পৃথু বা ভিনোদ হয়ে উঠতে পারবে না। সমস্ত শিক্ষিত ভদ্রলোক এবং মহিলারাই এই কমপ্লেক্সে ভোগেন। পৃথু ঘোষই ছিল একমাত্র ব্যতিক্রম। মানুষটার কাছে সব মানুষের সমান দাম ছিল। উধাম সিং আর ভুচু আর দিগা বা হুদার মধ্যে কখনও কোনও ভেদ করেনি সে। রুষা ইচ্ছে করলেও কি পৃথুর মতো হতে পারবে কখনও? মনে হয় না।
পানটা মুখে পুরে প্রথম পিকটা ফেলে দিয়েই রুষার প্রতি ঘেন্নায় গা গুলিয়ে উঠল ওর। ভুচু কি রুষার চাকর, না পৃথুদার চাকর? কেন সে সেবা করতে যাবে তাদের এমন করে? পৃথুদার চামচেগিরিতে জীবনের অনেকখানিই নষ্ট হয়ে গেছে। এখন ইনি এলেন হুরী-পরী। এটা করো সেটা করো। মারো গোলি! যাবে না ও আজ বিকেলে। ভারী বয়েই গেছে ভুচুর! অনেকই দেরী হয়ে গেছে। নিজের কথা ভাবার সময় হয়েছে এবারে।
দিসাওয়াল সাহেবের সঙ্গে পেঞ্চ পার্কে গেছে টুসু। দিসাওয়াল সাহেবের কাজ আছে। পরিহার সাহেবের সঙ্গে গতকাল সকাল থেকেই জ্বর হয়েছে পৃথুর। মনটাও একেবারেই ভাল নেই। মাঝে মাঝেই এমন হয়। দু তিন মাস পর পর। এক একটা স্পেল দিনসাতেক থাকে যখন বড়ই মন-মরা লাগে। কেবলই মনে হয় আত্মহত্যা করে। সেই সময় হাতের কাছে পিস্তলটাকে রাখতে চায় না। ভাবে, কারও কাছে জিম্মা দিয়ে আসে। কালই ভেবেছিল, দিসাওয়াল সাহেবকে দেবে। হয়নি দেওয়া। পিস্তলের খাঁজকাটা বাঁটটা আর নীলচে-কালো মসৃণ ছোট্ট নলটা এই রকম সময় ওর মুখে যেন চেয়ে থাকে। বড় ভালবাসতে ইচ্ছে করে সেটাকে। টুসুদের ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যাবে। দিসাওয়াল সাহেব তাঁর একার সংসারের বাক্স-পাঁটরা ঘেঁটে একটি ফিল্ড গ্লাস বের করে দিয়েছেন। ডিসপোজাল থেকে কিনেছিলেন জব্বলপুর থেকে। লেন্সে বোধহয় ফাঙ্গাস পড়ে গেছে। মুছেটুছে আহ্লাদে ডগমগ হয়েছে টুসু। পাখি দেখবে জঙ্গলে।
পৃথু শুয়েছিল। সুঠা বাইগা পাশে, মাটিতে বসে মাথার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছিল। একটু আগে ওডিকোলন ভিজিয়ে মাথায় পটিও দিয়েছিল। অসুখ-বিসুখ হয় না পৃথুর। কিন্তু হলে আটানব্বই জ্বরেও বড় কাবু করে। রুষা হাসত ওকে নিয়ে। বলত, আতুকী! বড়লোকের লালু ছেলে!
বাইরে দাঁড়কাক ডাকছিল। ক্যাকটাইগুলো অর্কিডস আর প্লান্টসগুলোকে বাঁচানোই এখন মুশকিল। মে এবং জুন মাসের তিন সপ্তাহ ওদের যত্ন লাগবে খুবই। কখনও কখনও জুনের শেষ অবধিও লাগে। বৃষ্টি না আসা অবধি। যদিও সীওনী অনেকই উঁচুতে, তবু এই দুটো মাস ওদের না দেখলে চলে না। রোদ পড়ে ঝকঝক করছে বারান্দাটা ফুলে আর পাতায় আর অর্কিডে আর ক্যাকটাইতে। দাঁড়কাক ডাকছে। কয়েকবার ডেকে উড়ে গেল। মৌটুসকি পাখি এসেছে। কিসকিস করে ডাকছে।
গেটটা খোলার শব্দ হল। আবার বন্ধ করার।
কে এল? পৃথু বলল।
কৌন জানতা? উদাসীন গলায় বলল ঠুঠা। পৃথিবীর সব কিছু সম্বন্ধেই ঔৎসুক্য চলে গেছে। মানুষটার। এই রকমভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে ও জঙ্গলে মরে গেলেই ছিল ভাল। সকলকেই যে বেশিদিন বেঁচে থাকতেই হবে তার মানেই বা কী আছে? দেওয়ার কিছু না থাকলে চলে যাওয়াই ভাল। পৃথুও সেই কথাটাই ভাবছে সকাল থেকে। এই রকম মন খারাপ যখন হয় তখন একা একা ভাবতে ভাবতে ওর দু চোখ জলে ভরে আসে। কত কীই যে মনে পড়ে তখন। বাবার কথা, মায়ের কথা, ছেলেবেলার কথা, রুষার সঙ্গে বিয়ের দিনের কথা, বিয়ের পর হাটচান্দ্রা চলে আসার আগে কুর্চির সঙ্গে শেষ দেখা হওয়ার দিনের কথা। কে জানে, কেন এমন হয়? ভাবে আর চোখ ভেসে যায় জলে। অথচ কাউকে কিছু বলতে বা বোঝাতেও পারে না।
কুন্তী এসেছে। ঠুঠা বলল।
কুন্তীকে দেখেই সে কেমন ছটফট করে উঠল। পৃথুর মাথায় রাখা তার হাতেও সেই চঞ্চলতার ছোঁয়া লাগল। কুন্তী কিন্তু ধীর স্থির, ঠুঠার দিকে তাকাল বটে একবার, কিন্তু সে যে ঘরে আছে তা যেন সে দেখেও দেখল না। পৃথুকে বলল, দিদিনে খাত্ ভেজিন।
তারপর চিঠিটা দিয়ে ঠুঠাকেই বলল, জ্বর কত?
আছে।
তুমি ভাল আছ?
ঠুঠা কুন্তীর এই প্রশ্নে একেবারে হকচকিয়ে গেল।
থতমত হয়ে বলল, আছি। ভালই।
তুমি?
আমি ভালই থাকি। সব সময়।
পৃথু চিঠিটা পড়ল। “পৃথুদা আমি সাবুর খিচুড়ি রেঁধে নিয়ে যাচ্ছি। সারা দুপুর থাকব। অত্যাচার করবেন না শরীরের উপরে। আমি খেয়েই যাব। বিগুকে ঝামেলা করতে মানা করবেন।”
—কুর্চি।
কুন্তীকে বলল, ঠিক আছে।
পৃথু ঠুঠাকে বলল, ঠুঠা খাওয়াও কুন্তীকে। বিগুর কাছে নিয়ে যাও। কী হলে তুমি!
না সাহাব। অনেক কাজ আছে আমার।
কাজ তো চিরদিনই থাকবে। কাজের মধ্যে মধ্যেই একটু আনন্দ করে নিতে হয়, নইলে কি আর করা যায়?
কুন্তী হাসল। বাঁ হাত দিয়ে সুন্দর অথচ ত্রস্ত ভঙ্গিতে বুকের ও মাথার আঁচল টানল। তারপর চলে গেল ঠুঠার সঙ্গে।
ঘোরের মধ্যে ঘুমিয়েই পড়েছিল পৃথু। হঠাৎ গেট খোলার শব্দে ঘুম ভাঙল। কুর্চি এল কি? না, কুন্তী গেল। এতক্ষণ কুন্তী কী গল্প করছিল ঠুঠার সঙ্গে কে জানে?
রোদ বেশ চড়া হয়েছে। বাথরুমে গিয়ে মাথা ধুলো এবং গা স্পঞ্জ করল। দাড়ি কামায়নি কাল। ইচ্ছে করল না আজও। গা-স্পঞ্জ করতেই খুব দুর্বল লাগল। ফিরে এসেই শুলো পৃথু। আবার ও ঘুমিয়ে পড়ল।
অনেকক্ষণ ঘুমোবার পর চোখ খুলেই দেখল কুর্চি পায়ের কাছে মোড়া পেতে বসে তার মুখের দিকে চেয়ে আছে। জানালার দিকে পৃথুর মাথা ছিল তাই জানালা দিয়ে এক আকাশ আলো এসে কুর্চির পবিত্র ঢলঢলে মুখটিতে পড়েছে।
কী? খুব ঘুমিয়ে ওঠা হল! কখন থেকে বসে আছি পায়ের কাছে। কখন বাবুর ঘুম ভাঙবে।
জাগাওনি কেন?
মাথা খারাপ! রেগে যেতেন যদি। মুখের ভাব দেখে মনে হচ্ছিল “আমি স্বপনে রয়েছি ভোর, সখী আমারে জাগায়ো না”।
পায়ে হাত রাখল চাদরের উপর দিয়ে কুর্চি। হাত বুলোল একটু।
ওর নরম হাতের পাতার ছোঁয়াতে গা সিরসির করে উঠল। কুর্চি ওর শরীরের যে কোনও অংশে হাত ছোঁওয়ালেই বিদ্যুৎতরঙ্গ খেলে যায় সঙ্গে সঙ্গে। সে কি শরীরেরই গুণ? না মনের? কে জানে?
খাবেন তো এবারে? দেখেছ! সাড়ে বারোটা বেজে গেল।
জ্বরটা দেখবে না একবার?
সকালে দেখেছিলেন?
নাঃ। বেশি তো নয়। তবু মনে হচ্ছে সকালের দিকে বাড়ে, বিকেলের দিকে কমে আসে। আবারও রাতে বাড়ে।
নিজের ডাক্তারী নিজে না করে ডাক্তার ডাকলেই তো হয়।
একগাদা কড়া কড়া ওষুধ দেবে। অসুখে যত না কাবু হয়েছে শরীর, ওষুধে তার চেয়েও বেশি হবে। তাইই যতক্ষণ পারি, না ডাকার চেষ্টা করি।
ভাল। থার্মোমিটার কোথায় আছে?
ওহো! থার্মোমিটারই তো নেই। একা মানুষের সংসার। দেখেছ! ভুলেই গেছিলাম। তোমার বাড়ি থেকে আনতে পাঠাও না ঠুঠাকে।
হাসল কুর্চি। আমারও আছে না কি? রায়নাতে ছিল। এখন আমারও তো একার সংসার।
চোখ নামিয়ে স্বগতোক্তির মতো বলল ও, কোনওদিন দোকার সংসার হলে, তখনই দেখা যাবে।
পৃথু উঠে বসতে বসতে বলল, ততদিন জ্বরটা না হওয়াই ভাল বলছ?
হ্যাঁ।
বলেই, হাসল কুর্চি।
লাগবে না থার্মোমিটার। ডাক্তারও লাগবে না। তুমি এসেছ, সাবুর খিচুড়ি করে এনেছ নিজে হাতে, জ্বরের সাধ্য কি যে, সে আর থাকে! ভালবাসার চেয়ে বড় ওষুধ কি আর আছে? বলো?
বলে, কুর্চির হাতটা নিজের হাতে তুলে নিল।
আদরিণী বেড়ালনীর মত লজ্জায়, ভাললাগায় কুর্চি মুখ রাখল পৃথুর আস্ত পাটির উরুর উপর। পৃথু আদরে ওর পিঠে ডান হাতটি রাখল। কালো ব্লাউজ, হলুদ তাঁতের শাড়ি, চোখে কাজল, কপালে কালো টিপ। হালকা কোনও প্রসাধনের গন্ধ উড়ছে। চান করে এসেছে। পিঠময় চুল ছড়ানো ভিজে চুলের তেলের গন্ধও মিশে গেছে প্রসাধনের গন্ধর সঙ্গে। ওর গলায় একটি সরু সোনার হার। লকেটটা এক পাশে ঝুলে নেমে এসেছে পৃথুর হাঁটুর পাশে। বারান্দা থেকে চড়াই ডাকছে। টালির ছাদের ছায়া থেকে কামাতুর কবুতর।
পৃথু মুখ নামিয়ে কুর্চির সিঁথিতে একটি আলতো চুমু খেল। গা সিরসির করে উঠল ওর। কুর্চিও ছটফট করে উঠল ভাললাগায়।
মনটা ভীষণই খরাপ হয়ে গেল পৃথুর। কুর্চির সঙ্গে যদি একসঙ্গে ঘর করে, রোজ রাতে একই খাটে শোয় পাশাপাশি; তবে কি একদিন রুষার সঙ্গে সম্পর্কটা যেমন করে ধীরে ধীরে ক্ষয়ে গিয়ে মরে গিছিল তেমনি করেই এ সম্পর্কও মরে যাবে? মরেই যদি যাবে; তবে নতুন করে তার জন্ম দেওয়া কেন? কে জানে? কী হবে? কোনও সম্পর্ক দারুণ ভাবে বেঁচে থাকে, কোনও সম্পর্ক মরে যায়। কোন্টা বাঁচবে আর কোনটা মরবে, সাদা জার্মান স্পিৎজ কুকুরের বাচ্চাদের মতো আগে থেকে তা বলা যায় না। যেটির যত্ন করা হল, সেটিই হয়তো মরে যায়, যাকে দেখাই হল না মোটেই, গাব্দা-গোব্দা হয়ে ওঠে।
আপনাকে না, আর আপনি বলতে পারছি না। পৃথুদা!
কুর্চি বলল, মুখটিকে পৃথুর উরুর উপরেই রেখে। তুমি বলব? এবার থেকে?
আপনিই ভাল।
উরু থেকে মুখ তুলে কুর্চি বলল, কেন? তুমি নয় কেন?
মনে হয় এই ‘তুমি’ সম্পর্কর উষ্ণতার মধ্যেই দুজন মানুষের সব শীত লুকোনো থাকে। দুজনেই ভাবে আমি তো ওরই ও-ও আমার। এবং এটা ভাবলেই যতখানি না উচিত তার চেয়েও বেশি ইনফর্ম্যাল হয়ে যায় দুজনে। মানে, মেনি থিংগস আর টেকন ফর গ্রান্টেড। আর তখন থেকেই বোধহয় সম্পর্কটার নিজেরই নষ্ট হয়ে যাবার একটা প্রবণতা দেখা যায়। আপনিই রাখো আমাকে, তাতেই বেশি আপনার হয়ে থাকব তোমার, বেশিদিন। একটু দূরে থাকাই ভাল।
যা আপনার ইচ্ছা!
কুর্চির মুখে অভিমানের ছায়া ঘনিয়ে এল।
একটা কথা বলব?
কুর্চি বিছানা থেকে উঠে মোড়াতে বসে বলল।
কী? বল!
ঠুঠাদার কাছে শুনলাম যে, আপনি আগামী সপ্তাহে টুসুকে নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন হাটচান্দ্রাতে। রুষা বৌদি নাকি ফিরে এসেছেন?
ঠিকই শুনেছ।
ও। ঠিকই তাহলে?
হ্যাঁ।
এখানের চাকরি কি ছেড়ে দিয়ে যাচ্ছেন?
না ত! তেমন তো ভাবিনি।
টুসুকে কি ওখানেই রেখে আসবেন, যদি ফিরে আসেন?
ভাবছি। ওয়াইল্ড-লাইফ ফোটোগ্রাফারই হোক আর যাইই হোক, স্কুলের পড়াশুনো অন্তত শেষ না করতে পারলে জীবনে তো কোনও ওপেনিংই পাবে না। ও যে সময়ে বড় হয়ে উঠবে, সেই সময় অনেকই ভাল ভাল ছেলে এই দেশে ওয়াইল্ড লাইফ আর ওয়াইল্ড-লাইফ রিসার্চ নিয়ে মেতে উঠবে। একটা নতুন জেনারেশান এসে গেছে কুর্চি! ওদের উপর আমার অনেকই ভরসা। ওরা…
তাহলে রেখেই আসবেন? ওকে?
বললাম তো! ভাবছি।
আপনি? নিজে কি ফিরে আসবেন?
পৃথু তার দু চোখের দৃষ্টি দিয়ে কুর্চির দুটি চোখের একটুও বাকি না রেখে ভরে দিয়ে বলল, তাও ভাবছি।
কুর্চি বলল, ও।
আর কিছুই না বলে মুখ নামিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, খাবেন তো এখন? যাই। বিগুকে ওগুলো গরম-টরম করতে বলি। খাওয়ার ঘরে যাবেন? না এখানেই নিয়ে আসব, ট্রলি করে?
এখানে আনলেই ভাল হয়। গায়ে হাতে পায়ে অসম্ভব ব্যথা। তুমি কেন কষ্ট করবে এত! বিগুকে বলো না!
কুর্চি উত্তর না দিয়েই চলে যেতে গিয়েও দরজার কাছে থেমে দাঁড়িয়ে মুখ ঘুরিয়ে একটু হাসল। বলল, সম্পর্ক “তুমি”তে নামিয়ে আনতে এত আপত্তি কেন এখন বুঝছি তা।
দারুণ দেখাচ্ছিল কুর্চিকে। ওর মরালি গ্রীবায় ঋজু হয়ে দাঁড়াবার ভঙ্গিতে ঠোঁটের কোণের দুর্জ্ঞেয় হাসিতে। একটা ক্যামেরা থাকলে কুর্চির এই প্রোফাইল ধরে রাখত ও। যে নারীর হাসির মানে বোঝা যায়, সে হাসি তো সস্তা, তার মধ্যে কোনও রহস্য নেই। সস্তা কোনও কিছুর প্রতিই কোনও আকর্ষণ ছিল না পৃথুর।
পৃথু অনুমান করেছিল আগেই যে, কুর্চি এইসব প্রশ্ন করবে তাকে। কিন্তু কুর্চিকে যথাযথ উত্তর এক্ষুনি দেবে কী করে? প্রথমত শেষ প্রশ্নটির যথার্থ তাৎপর্যই এখনও প্রাঞ্জল নয় ওর নিজেরই কাছে, হাটচান্দ্রা গিয়ে পৌঁছলে তারপরই তা প্রাঞ্জল হবে। এবং অর্থ প্রাঞ্জল হওয়ার পরও সেই প্রশ্নর উত্তর যে কী হবে, তাও এই মুহূর্তে পৃথুর একেবারেই অজানা। তাইই, কী করে জবাব দেবে পৃথু কুর্চিকে?
দেখা যাক। তারপর আধখানা জীবন আর একখানা পা পেছনে ফেলে রেখে এসেছিল একদিন হাটচান্দ্রা থেকে এখানে। এখানে যখন ফিরে আসবে আবার, যদি আসে; তবে আরও কি হারিয়ে আসবে কে জানে?
কুর্চি, বিগুকে সঙ্গে করে খাবারদাবার সুন্দর করে ট্রলিতে সাজিয়ে নিয়ে এল। একটি ছোট তোয়ালেকে ন্যাপকিন করে দিল। নিজে মোড়ায় বসে, প্লেটে খিচুড়ি বেড়ে দিতে দিতে বলল, খান। সাবুর খিচুড়ির মধ্যে পটল ফালি করে দিয়েছে। আলু, আঙুলের মতো কেটে। দারুণ স্বাদ হয়েছে। জ্বরের মুখেও উপাদেয় লাগছে।
পৃথু দেখল, কুর্চি মুখে-চোখে জল দিয়ে এসেছে। চোখের কাজল একটু লেগে গেছে গালে। কুর্চির গালে যে জায়গাটা কাজল লেগেছিল ঠিক সেইখানেই একটা চুমু খেতে ভীষণই ইচ্ছা করল পৃথুর। কিন্তু চুমু না খেয়ে, চামচ করে সাবুর খিচুড়ি খেল; ইচ্ছা পূরণের আনন্দর তীব্রতার চেয়েও অনেকই সময়ে অপূর্ণ-ইচ্ছার নিবিড় আনন্দ তীব্রতর হয় যে, এ কথাটা ও জানে বলেই।