৫৫
ঘুম নেই। অনেকই ঘুমিয়েছে হাসপাতালে এ কদিন। ঘুমের মধ্যে ঘুমকে, স্মৃতির মধ্যে স্মৃতিকে এতদিন কাঁথা কম্বলেরই মতো জড়িয়ে শুয়েছিল দিন রাত। “স্লেপ্ট ইন মী স্লীপ দ্যাট ওজ এভরীথিং/ট্রীজ আই হ্যাড ওলওয়েজ লাভড দ্যা আন্রিভীলড্ ট্রেডেবল্ ডিসট্যানসেস, দ্যা ট্রডেন ফীল্ড অ্যান্ড ওল্ মাই স্ট্রেনজেস্ট ডিস্কভারিজ”।
দুখীকে ঘুম ভাঙিয়ে ডেকে, দরজাটা বন্ধ করতে বলে, বেরিয়ে পড়ল পৃথু।
দুখীর আপত্তি ছিল। আতঙ্কও ছিল। যে মানুষ, ড্রইংরুম-এর সিঁড়ি উঠতে গিয়েই পড়ে যাচ্ছিল বিকেলবেলা সে এই গভীর রাতে কোথায় যাবে?
বলেছিল, সাব! কাঁহা যা রহেঁ আপ?
কাঁহা?
বলে, একমুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়েছিল।
কোথাওই যাবার নেই। যে-মানুষ নিজের কাছ থেকে নিজে পালিয়ে যেতে চায়, চেনা আলো থেকে যেতে চায় অজানা অন্ধকারে তার জবাবদিহি করার থাকে না কিছুই, কারও কাছে।
দুখীকে বলেছিল, এইসেহি। জারা ঘুম-ঘাম্কে আরহা হ্যায়।
তিন ত বাজই গ্যয়া। উজ্লা হোনেকা বাদহি নিক্লিয়ে সাব!
নেহী রে বেটা।
নিজেরই বেটার মতো দুখী, যতক্ষণ না পৃথু তার চোখের আড়ালে চলে গেল, ততক্ষণ দরজা খুলে দাঁড়িয়েই রইল। খোলা দরজা দিয়ে আলোর হাত লম্বা হয়ে এসে পড়েছিল বাগানে, পথে। দুখী দেখল, পৃথুর কাঁধটা একবার নামছে আর একবার উঠছে। কেমন ভুতুড়ে অচেনা দেখাচ্ছিল তার চেনা সাহেবকে।
আলোর হাতছাড়া হতেই অন্ধকারটা গভীরতর হল।
চলতে লাগল পৃথু। পথের কুকুরগুলো ভুক্ ভুক্ করে ডাকতে ডাকতে ওর পেছন পেছন আসতে লাগল। একটা ঝগড়াটি মাদি কুকুর হঠাৎ ওর সামনে এগিয়ে গিয়েই ঘুরে এল দৌড়ে ডান পায়ে কামড়াবে বলে। ও ডান পায়ে লাথি ছুঁড়তে গেল। কাটা পা-টা ঝনঝন করে উঠল যন্ত্রণায়। ভুলেই গেছিল যে। তার ডান পাইই নেই, কুকুরী কামড়াবে কিসে?
সিস্টার জনসন বলে দিয়েছিলেন যে, এই রকমই মনে হবে বহুদিন। পঁয়ত্রিশ বছরের সঙ্গী যে ছিল, তাকে কি অত সহজে ভোলা যায়? সার্জনদের ভাষায় এই সীম্পটম্-এর নাম “ফ্যান্টাম-লিম্ব”।
সহজে ভোলা কিছুই যায় না। তবে, সময়ে হয়ত সবই যায়। রুষা, মিলি, টুসু, হারানো পা সবই এখন ফ্যান্টম্। সবাইই ভূত! ভালই!
হেঁটে যাচ্ছে পৃথু নিস্তব্ধ ঘুমন্ত হাটচান্দ্রার লাল ধুলো আর নুড়ি ভরা পথে। শুধু তার ক্রাচ-এর শব্দে সেই নিস্তব্ধতা ছিদ্রিত হচ্ছে।
মাথার ওপরে আদিগন্ত আকাশ। এখন গরম। ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে। মধ্য গগনে মিথুন রাশি আর কালপুরুষ। দক্ষিণের আকাশকে নরম উজ্জ্বলতায় ভরে দিয়ে, অসভ্যর মত ঘুমন্ত নারী পৃথিবীর বুকে লুব্ধ চোখে তাকিয়ে আছে এই মাঝরাতে লুব্ধক এবং অগ্যস্ত। তাদের উত্তরে বদ্ধহৃদয়। ছায়াপথ উড়ে গেছে স্বর্গের নারীর স্বচ্ছ শাড়ির আঁচলের মতে, দক্ষিণ-পুব থেকে উত্তর-পশ্চিমের আকাশে।
ক্লান্ত লাগছে পৃথুর। দু বগলে বড় লাগছে। ঘা হয়ে যাবে বোধ হয়। কাটা পাটা দুলতে থাকায় গরম রক্ত সোচ্চার হচ্ছে সেখানে। উষ্ণ রক্তর জীব না হয়ে সাপের মতো ঠাণ্ডা রক্তর জীব হলে বেশ হত। মনে হল ওর। রক্তর উষ্ণতা বড় সর্বনেশে।
টুসু যে শালবনের কুঁয়োর সামনে একদিন আত্মহত্যা করতে গেছিল, সেই শালবনের কাছে এসে একটি কালভার্টের উপর বসল পৃথু।
“আজ তারায় তারায় দীপ্ত শিখায় অগ্নি জ্বলে, নিদ্রাবিহীন গগনতলে”/পুবাকাশে সিংহ রাশির উত্তরফাল্গুনী, পূর্বফাল্গুনী। তার পশ্চিমে কর্কটরাশির পুষ্যা। তারও একটু উত্তর-পশ্চিমে মিথুনরাশি। সমস্ত আকাশময় শিশুমার, ধ্রুবতারা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু, কৃত্তিকা, রোহিণী, প্রশ্বন্ এবং আরও কত অসংখ্য নামা ও অনামা তারা চাঁদোয়ার মতো ঘুমন্ত পৃথিবীর মাথার উপরে। কত অসংখ্য আলোকবর্ষ দূরে আছে তারা। তবু, কত কাছে বলে মনে হয়।
ধ্রুবতারা উত্তর আকাশে দাঁড়িয়ে সব পথ-ভোলা পথিককেই চিরদিন পথ দেখিয়ে এসেছে। কিন্তু পৃথুর পথের নির্দেশ সেই উজ্জ্বল চিরন্তন তারার কাছেও নেই। জীবনে এমন দিশেহারা কখনও বোধ করেনি আগে। তার ডান পাটার সঙ্গে পঁয়ত্রিশ বছরের জীবনটাও যেন কাটা গেছে। ফ্যান্টম্ লিম্ব্-এর মতো। এর ফেলে আসা জীবনটাও যেন ফ্যান্টম্ হয়ে গেছে। মাঝে মাঝেই ভুল করে মনে হয় যে, আছে। কিন্তু পরক্ষণেই অপ্রিয় সত্যটাকে মেনে নিতেই হচ্ছে।
রিল্কের কবিতা এখন ওকে পুরোপুরি আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। একজন কবিই শুধু অন্য কবির এবং কবিতা-মুগ্ধ সব মানুষের ব্যথিত হৃদয়কে এমন ভাবে আচ্ছন্ন করতে পারেন। কবি যদি কবির মতো কবি হন তাঁকে আবিষ্কার করে একই পাঠক, তার জীবনের বিভিন্ন সময়ে মরকত মণির দ্যুতির মতো বিভিন্ন রঙে।
“ইফ সামটাইমস্ হ্যাপীনেস ফাউন্ড আস, নো-ওয়ান পজেসড ইট, হুজ ক্যুড ইট বী?”
মনে পড়ল পৃথুর।
হাসপাতালের বিছানাতে শুয়ে শুয়ে ভেবেছিল রুষা আর ছেলেমেয়েদের নিয়ে এবার মাণ্ডুতে যাবে। দিন সাতেক থাকবে মাণ্ডুর ট্যুওরিস্ট লজ্-এ। অতীত সেখানে কথা বলে। কতদিন আগে আফ্রিকা থেকে নিয়ে এসে লাগানো বাওবাব গাছগুলি প্রাচীনতার সংজ্ঞার মতো ঘিরে আছে এই দুর্গকে। স্থানীয় লোকেরা বলে “খুরসান্ ইমলি”। অনেকে বলেন “দ্যা আপসাইড ডাউন ট্রীজ।” কুমুদিনী আর পদ্ম ফোটে মাণ্ডুর জেহাজ মেহালের সামনের তালাও-এ। জলপিপি আর ডুবডুবা হাঁসেরা ইলিবিলি সাঁতারে অলস হাওয়া আর মেঘলা দুপুরকে ঠোঁটে করে উড়িয়ে নিয়ে যায় রূপমতী মেহালের দিকে। জলভরা ধূসর মৃদুগতি মেঘের গন্ধে তাদের ডানার আঁশটে গন্ধ মুছে নিয়ে তারা উৎসাহে ওড়াউড়ি করে।
হল না, হল না যাওয়া। “কাছে যবে ছিল পাশে হল না যাওয়া, চলে যবে গেল তারি লাগিল হাওয়া।। যবে ঘাটে ছিল নেয়ে তারে দেখি নাই চেয়ে, দূর হতে শুনি স্রোতে তরণী-বাওয়া।”
“আসলে এবার কোনো সমুদ্রে বেড়াতে যাওয়া ছিল। গেস্ট হাউসের ঘর ছিল, রিটার্ন টিকিট কাটা ছিল। ভি আই পি স্যুটকেস ছিল, নরম এয়ারপিলো ছিল অথচ হলো না। সঙ্গে ভালোবাসা যাবে কথা ছিল। সে কখন একা একা আঙুল ছাড়িয়ে চলে গেছে।” সুরজিৎ ঘোষ।
অনেকক্ষণ পর উঠল পৃথু। ঠক্ ঠক্; ঠক্ ঠক্ শব্দ করে বাজারের দিকে যেতে লাগল। ওর নিজের পায়ের পাতা ফেলার প্রায় নিঃশব্দ শব্দ আর কখনও শুনবে না জঙ্গল-পাহাড়; শুনবে না সে নিজেও। বড় রাস্তায় এসে উঠতে উঠতেই অন্ধকার ফিকে হয়ে এল। ইদুরকারের বাড়ির দিকে এগোল ও। ঠক্-ঠক্, ঠক্-ঠক্ শব্দ করে তার অহং লজ্জা-শরম, মানের মাথা ও জোড়া ক্রাচের তলায় গুঁড়ো করে দিতে দিতে। চলতে হবেই ওকে যতক্ষণ না সেই সব একদা-প্রিয় বোধ মিহি ধুলোর সঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে মিশে যায়।
পৌনে এক মাইল মতো একটানা গিয়ে ওর মনে হল এবার পড়ে যাবে। বগলের নীচের নরম মাংস যেন কেটে গেছে। ডান-পাটাতে রক্তের দপ্দপানি বেড়ে গিয়ে নার্ভগুলো যেন দলা পাকিয়ে উঠেছে। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে পায়ে। তবু, সে যন্ত্রণা তার মনের যন্ত্রণার কাছে কিছুই নয়।
একটি ছোট্ট চা-ফুলুরির দোকানে ঝাঁপ খোলা হচ্ছিল। ফরসা হয়ে যাবে একটু পরই। পাখিরা সবে জেগে গেছে। কাকলিমুখর হয়ে উঠছে হাটচান্দ্রার সকাল। একটা কালোরঙা কুকুর দোকানের সামনে শুয়েছিল। সে উঠে একটু সরে গিয়ে আবার শুল। কুকুরটারও সামনের ডান পাটা নেই। না থাকলেও, অন্য তিনটে পা ঠিকই আছে। প্রথমে ও সমব্যথীর বেদনা অনুভব করল কুকুরটার দিকে চেয়ে। পরক্ষণেই ঈর্ষা হল। একটা গেলেও তিনটে তো আছে!
চায়ে হোগা?
হোগা বাবু।
কিত্না দেড় লাগেগী?
চুল্লা জ্বাল্নেমে যিত্না টাইম লাগতা। মগর দুধ নেহি হ্যায়। আহীর আয়েগা জারা বাদ।
পৃথুর তাড়া নেই। সকাল একটু বয়স্ক না হলে ইদুরকারের বাড়িতে যাওয়াও যায় না। গিয়ে লাভও নেই। ওরা সবাই ঘুমিয়েই থাকবে হয়তো এখন। দ্বিতীয় মধুচন্দ্রিকার সুখ হয়তো প্রথমের থেকে অনেক বেশি গাঢ়।
পৃথু বলল, দোকানীকে, ম্যায় ইন্তেজার করুঙ্গা। ইত্মিনান্সে বানাও।
দোকানি বলল, প্যায়ের ক্যায়সা কাট্ গ্যয়া। মালুম হোতা জাদা দিন নেহী হুয়া?
জী।
টেরাক্কা নিচুমে গীড়া থা ক্যা? উও শালেলোগ অ্যাহিসেহি টেরাক চালাতেঁ যো দিল্ কর তা কি ডাণ্ডা সে উলোগোঁকা শর্ ফাড় দুঁ।
পৃথু চুপ করে রইল।
বাল-বাচ্চা ত হোগা বাবুকো? বিবি?
চম্কে উঠল পৃথু।
ভাবল, ভারতীয়রা বড়ই কৌতূহলী জাত। প্রথম পরিচয়েই তাদের সবই জানা চাই। পশ্চিমের দেশে এইরকম অসভ্য কৌতূহল থাকে না কারওই।
সব্বে মর্ গ্যয়া ক্যা? ও হি টেরাকে ইক্সিডেন্টমেহি?
পৃথু মাথা নেড়ে জানাল, হ্যাঁ।
মনে মনে বলল, তোমরা কি সবসময়ই কলকল করে কথা বলবেই?
এখনও দিন ভাল করে ফোটেনি! এখন থেকেই?
আস্তে আস্তে মানুষের যাতায়াত আরম্ভ হল। তিনজন সাইকেল রিকশাওয়ালা তাদের রিকশা নিয়ে দোকানে এল। রিকশাগুলো দোকানের সামনে রেখে দোকানীর কাছ থেকে লেড়ে-বিস্কুট চাইল। গোগ্রাসে খেতে লাগল তারা।
দোকানী পৃথুকে বলল, আপকো?
পৃথুও আটটি বিস্কুট নিয়ে চারটি পা-হারানো কুকুরটিকে দিয়ে আর চারটি নিজে খেল। দাঁত মাজেনি, চোখে জল দেয়নি, চোখের পাতা এক করেনি কাল রাতে। অবসন্নও লাগছিল। হাসপাতালে এই কমাস এত নিয়মে থাকার পরের দিনই এত অত্যাচার সহ্য হবার কথাও নয়। বিস্কুট খেয়ে খোঁড়া কুকুরটা পৃথুর পায়ের কাছে এসে বসে লেজ নাড়তে লাগল। হাসি পেল পৃথুর। ভাবল, শ্রেণী ভেদকে কোনওদিনও ওঠানো যাবে না এ দেশ থেকে। পা-হারানো কুকুরও পা-হারানো মানুষের সঙ্গে একজোট হয়ে এক নতুন শ্রেণী তৈরি করে।
একজন রিকশাওয়ালাকে শুধোল, তাকে ইদুরকারের বাড়ি নিয়ে গিয়ে আবার তার বাড়িতে ফেরত দিতে কত নেবে? সে বলল, বউনি করবে এই সকালে। দরটর করবে না। যা দেবে পৃথু, খুশি হয়ে; তাইই নেবে।
পৃথু ভাবল, খুশিরই দিন বটে।
একমাথা চুল আর একমুখ দাঁড়ি-গোঁফ সমেত পৃথুকে চিনতে কেউই পারল না। আহীর এসে দুধ দিয়ে গেল সাইকেলে চড়ে। মগনলালের কথা মনে পড়ে গেল ওর। তার গানের কথাও। “প্রীত্ ভইল্ মধুবনোঁয়া রামা, তোরা মোরা।”
কতকগুলো ভূতের মত দেখতে বাচ্চা বাচ্চা ছেলে পথের কাছের ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে এল হল্লা-গুল্লা করে। তারপর পৃথুকে দেখতে পেয়েই সকালের প্রথম বিনি-পয়সার এন্টারটেইন্মেন্টে মেতে গেল।
ছেলেগুলোর মধ্যে যে বয়সে ছোট, সেইই ওদের নেতা বলে মনে হল। সে সঙ্গীকে বলল, রে গিরধারী, এহি না উও ল্যাংড়া, যো একরাম্কো মাকো।…
বলতেই, অন্য ছেলেগুলো বলল, আররে! ওহি ত!
নেতা বলল, মার্ শালেকো।
তার কথা শেষ না হতেই পথ থেকে নুড়ি কুড়িয়ে নিয়ে ফটাফট্ পৃথুকে লক্ষ্য করে ছুঁড়তে লাগল ওরা। পৃথুর বুকে, গায়ে, মাথায় এসে লাগতে লাগল নুড়িগুলো। একটা লাগল এসে ঠিক নাকের উপরে। বেশ চোট লাগল নাকে। দরদর করে রক্ত ঝরতে লাগল নাক থেকে, ঠোঁট চিবুক চুঁইয়ে।
দোকানি ধমকাল ওদের। রিকশাওলারাও চেঁচিয়ে উঠল। কতটা যে পৃথুকে রক্ষা করার মহৎ তাগিদে আর কতটা তাদের সম্পত্তি বাঁচাবার জন্যে, তা ও বুঝল না।
কিন্তু ওদের চেঁচামেচিতে ছেলেগুলো পাথর মারা বন্ধ করল। বন্ধ করে ওইখানেই দাঁড়িয়ে যে অমূলক অভিযোগ পৃথুর বিরুদ্ধে এনেছিল তাইই, চেঁচিয়ে বলতে লাগল বারবার।
রিকশাওয়ালা এবং দোকানি মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। অভিযোগটা সাংঘাতিক।
পৃথু প্রমাদ গুনল। যদি বড়রাও একবার ক্ষেপে ওঠে তাহলে তাকে পাথর মেরেই এই ধুলোর মধ্যে ফেলে শেষ করে দেবে। একবার ও ভাবল, ক্রাচ-এ ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ওর পরিচয় দেয় এইসব ফালতু লোকদের কাছে। বলে যে, সেইই হচ্ছে হাটচান্দ্রা শেল্যাক কোম্পানীর পৃথু ঘোষ। পুলিস সুপারকে বলে এক্ষুনি তাদের সে থানায় নিয়ে যেতে পারে। ভাবল বলে, ওইই হচ্ছে ডাকু মগনলালকে খতম-করা হাটচান্দ্রার সেই হিরো!
না। কিছুই বলল না পৃথু। সে পৃথু ঘোষ, আর নেই। সেও কাটা গেছে আধখানা। আজ থেকে নতুন জীবন শুরু করবে অতীত মুছে ফেলে। সেই পৃথু ঘোষের কাছ থেকে কোনওরকম সাহায্য বা দয়াই এই আধখানা মানুষটা চায় না।
যে-কারণেই হোক কিছুক্ষণের মধ্যেই দোকানি এবং অন্যরা বুঝল যে, ছেলেদের কোথাও ভুল হয়েছে। ইদুরকার সাহেবের বাড়ি যাবে শুনে এও হয়তো ভাবল ওরা যে, এই ছন্নছাড়া পাগলের মতো ল্যাংড়া মানুষটার কানেকশানস বেশ ভাল। নইলে ইদুরকার সাহেবের মতো এত পয়সাওয়ালা মানুষকে এই বাউণ্ডুলে চিনল কী করে?
ওরা চুপ করে গেল।
চা খেয়ে, পৃথু রিকশাতে উঠতে গেল। সাবধানে উঠতে গিয়েও পারল না। আধখানা ডান পা আগে ওঠাল কিন্তু আস্ত বাঁ পাটা দড়াম্ করে গিয়ে ধাক্কা খেল পা-রাখার জায়গাতে। খুবই লাগল ওর। অন্য একজন রিকশাওয়ালা দৌড়ে এসে, পৃথুকে সাহায্য করল রিকশাতে বসতে।
খুব রাগ হয়ে গেল ওর। তারপরই নিবে গেল। বুঝতে পারল যে, যত বড় দাম্ভিক এবং স্বাবলম্বীই কেউ হোক না কেন, করুণা এবং সাহায্য কখনও কখনও প্রয়োজন হয়ই। মাথা নিচু করে বসে রইল ও।
রিকশা চলতে লাগল।
সুস্থ অবস্থায় কোনওদিনও সে রিকশা চড়েনি। অন্য মানুষে চালাবে আর সে তার ঘাড়ে বসার মতোই বসে থাকবে এ কথা ভাবলেই ঘেন্না হত। হাটচান্দ্রার ভিতরেও প্রয়োজন হলে পাঁচ মাইলও হেঁটেছে তবু রিকশা চড়েনি একটুক্ষণের জন্যেও।
মাথা আরও নিচু হয়ে গেল ওর।
দোকান পাট খুলছে এক এক করে। লোকজনের চলাচল আরম্ভ হয়েছে। নাক থেকে রক্ত পড়াটা বন্ধ হয়েছে যদিও কিন্তু জমাট বাঁধা রক্তে নাক বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড়। তার গোঁফ দাড়িতে, সাদা পাঞ্জাবিতে রক্ত ভরে গেছে। নীচের দিকে না চেয়ে ও সামনের দিকে চেয়ে রইল।
দুটো হাতি নিয়ে আসছে পথ বেয়ে দুজন লোক। হাতিদের মাথায় নানারঙা আলপনা কাটা। কোথায় যাচ্ছে কে জানে।
দূর থেকে ইদুরকারের বাড়ি দেখা যাচ্ছে। বাড়ি তো নয়, প্রাসাদ। চারদিকে উঁচু পাঁচিল ঘেরা। গেটের দুপাশে দুটো জ্যাকারাণ্ডা গাছ। এই বাড়িটা আসলে চম্পকলালের ছিল। খুব বড় বিড়িপাতার কারবারি। তার একমাত্র ছেলে আত্মহত্যা করায় সে এই বাড়ি ইদুরকারের কাছে বেচে দিয়ে চলে গেছে আহমেদাবাদে। ভিনোদ ইদুরকার নেওয়ার পর অবশ্য ভোলই পালটে ফেলেছে।
বাড়ির একটু আগেই পথটা বাঁক নিয়েছে। বাঁকের মুখে রিকশাওয়ালাকে রাখতে বলল রিকশা। তারপর রিকশা থেকে, রিকশাওয়ালারই সাহায্যে নেমে আস্তে আস্তে এগিয়ে চলল বাড়ির বড় লোহার গেটের দিকে। গেটের পাশেই দারোয়ানের ঘর।
কোঈ হ্যায়?
পৃথু বলল গেটটার সামনে দাঁড়িয়ে।
জবাব পেল না।
আবারও বলল, হ্যায় কোঈ?
এবার চায়ের অ্যালুমিনিয়ামের গ্লাস হাতে করে একজন পাঠানের মতো দারোয়ান ঘর থেকে বেরিয়ে এল। পৃথুকে ভাল করে দেখল একবার। তারপর বলল, কিস্কা মাঙ্গতা, তু?
টুসু বাবাকো।
উস্সে তুমহারা ক্যা মৎলব?
এইসাহি। জারা মিল লেতেঁথে। পাঁচ মিনট কা লিয়ে।
তু কোন হো?
ম্যায়…
আররে হাঁ কাম্ওক্ত। কোন হ্যায় তু?
মুসাফির। শব্দটা হঠাৎই বেরিয়ে গেল মুখ থেকে। মনে মনে খুশি হল ও। জবাব একটা খুঁজে পেয়েছে বলে।
এমন সময় দারোয়ানের ঘর থেকে আরও একজন লোক, খুব সম্ভব বড় দারোয়ান; বেরিয়ে এসে পৃথুকে দেখিয়ে প্রথম দারোয়ানকে বলল, লোকটাকে ছেলেধরার মতো দেখতে না? ঝাঁঝি বস্তি থেকে তিনটে ছেলে চুরি গেছে। এখনও তার কিনারা হয়নি। এ লোককে এক্ষুনি ভাগা। নইলে, ডাণ্ডা মেরে মাথা ফাটিয়ে দেব। ওর নাক ফাটল কী করে জিজ্ঞেস করো তো।
পৃথু বলল, কতগুলো বাচ্চা ছেলে ঢিল মেরে ফাটিয়ে দিয়েছে।
এই সাংঘাতিক সময়ে এই কথাটা পৃথু বুদ্ধিমান হলে চেপে যেত। বলতে পারত, ল্যাংড়া লোক, রিকশা থেকে পড়ে গেছে। অথবা, অন্য কিছু। কিন্তু সেই মিথ্যাচারের বুদ্ধি ওর মাথায় এল না। যে বুদ্ধি, যে মেধা বোর্ডরুমে, কী একটি মস্ত কারখানা ঠিকমত চালাতে লাগে, লাগে বৈজ্ঞানিক রিসার্চ-এ সে বুদ্ধি কোনও কাজে আসে না এদের কাছে, এমন এমন সময়। তা ছাড়া, মিথ্যা বলার ওর কোনও ইচ্ছাও ছিল না। যা হবার তা হোক।
এই দারোয়ানরা কি পৃথুকে এর আগে কখনও দেখেনি? ওর চেহারা দাড়ি-গোঁফ আর পা-হারানোর জন্যে এতই কি বদলে গেছে নাকি? না দেখলেই, ভাল। দেখলেও পৃথু মোটেই বলতে পারবে না যে, যে-রুষা এখন ইদুরকারের খাটে তাকে জড়িয়ে ঘুমুচ্ছে সে তারই স্বামী। অথবা, মিলি-টুসুর বাবা সে। এই চেহারায়, এই অবস্থায় তার প্রকৃত পরিচয় দিয়ে তার স্ত্রী অথবা ছেলেমেয়েদের ছোট করতে চায় না সে।
দারোয়ান দুজনই গেট খুলে বাইরে এসে ওকে শাসাল। বলল, টুসু হচ্ছে গিয়ে ইদুরকার সাহেবের ছেলে। তার সঙ্গে তোমার মতো লাফাঙ্গার কী দরকার হে?
ইদুরকার সাহেবের ছেলে?
অবাক হল পৃথু। ছেলেচোর আসলে তো ইদুরকারই। পৃথুকে মিথ্যে অপবাদ দিচ্ছে এরা।
বড় দারোয়ান বলল, হ্যাঁ। আমাদের মালিক, বাচ্চাওয়ালী জেনানা শাদী করেছেন। কিন্তু এত সব কথায় তো দরকার নেই। তুমি মানে মানে পালালে পালাও এখান থেকে। নইলে মালিক এক টেলিফোন ঠুকে দেবেন থানায় অথবা কোম্পানিতে, দেখবে তোমার কী হাল হয়। ভাগো হিঁয়াসে বদমাস্।
বলেই, এক ধাক্কা দিল পৃথুকে পিঠে।
টাল সামলাতে না পেরে ও পড়েই যাচ্ছিল। কোনওরকমে সামলে নিল ডান ক্রাচটা এগিয়ে দিয়ে।
পৃথু বলল, ম্যায় যা রহা হুঁ। মগর টুসু বাবাকা বোল না যো ম্যায় আয়া থা।
কোন হ্যায় তুম্, নাম ক্যা তুমহারা?
নাম নেহী হ্যায়, ম্যায় মুসাফির হুঁ। টুসু বাবাকে আমার চেহারার বর্ণনা দিলেই ও বুঝে নেবে আমি কে! আমাকে ও চেনে।
চেনে? টুসুবাবা? তোমাকে? অজীব বাঁতে কর রহে হেঁ তু।
সাচ্মুচ্। বলেই দেখো, চিনবে টুসু। তাকে বল যে একবার দেখতে এসেছিলাম তাকে। আমার চেহারার বর্ণনা দিলেই হবে।
ব্যসস্…?
ব্যস এইটুকুই।
বলেই, পৃথু ঘুরে দাঁড়িয়ে চলতে লাগল রিকশার দিকে।
কোনওরকমে উঠে বসল তাতে। চলতে লাগল রিকশা ক্যাঁচ-ক্যাঁচ করে। দারোয়ান দুজন পরস্পরের মধ্যে কী সব বলাবলি করছিল।
পৃথু ভাবছিল, মানুষের জামা-কাপড়, চেহারা, গাড়ি এই সবই তার পরিচয়। মানুষের নিজস্ব কোনও পরিচয় বোধ হয় হারিয়ে গেছে। ও যদি গাড়ি করে আসত, তাহলে এই দারোয়ান সেলাম করে গেট খুলে দিত। তার মালিকের শ্রেণীর মানুষ বলে মেনে নিত ওকে। এই দেশের চাকরদের মতো চাকর সত্যিই হয় না। মালিকদের সেবা করতে করতে একটা সময় তারা নিজেরা নিজেদেরই মালিক ভাবতে থাকে। এবং এই মিথ্যে হীনমন্যতার শিকার হয়ে স্বজাত, স্ব-স্বভাব এবং সম-অবস্থার অন্য মানুষদের সঙ্গেও অমানুষিক ব্যবহার করে।
টুসুটার সঙ্গে দেখা হল না। একদিক দিয়ে ভালই হল। টুসু তার এই রক্তাক্ত চেহারা দেখে আঁতকে উঠত। ছেলেটা বড় নরম প্রকৃতির হয়েছে। অশেষ দুঃখ ওর কপালে।
বাড়ি যখন পৌঁছল, তখন সকাল আটটা। দেখল, গেটের সামনে ভুচুর জীপটা দাঁড়িয়ে আছে। রিকশার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে বসবার ঘরে ঢুকে ভুচুকে দেখতে পেল না। দুখী, পৃথুকে দেখে ঘাবড়ে, গেল। মেরী চেঁচিয়ে উঠল। পেছনের কিচেন-গার্ডেনে ঘুরে-ঘারে ভুচু রুষার লাগানো গাছ-গাছড়া দেখছিল। দুখী গিয়ে খবর দিতেই দৌড়ে এল।
আঁৎকে উঠে ভুচু বলল, এ কি অবস্থা। কী হল?
পড়ে গেছিলাম।
দুখী কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আমি বলেছিলাম। আগেই বলেছিলাম।
কী ব্যাপার ভুচু? এত সকালে?
সকলের মনোযোগ অন্যত্র সরিয়ে দিয়ে বলল, পৃথু।
তোমার খবর নিতে এলাম। আর খবর দিতেও এলাম অন্য সকলের।
—কী খবর?
সাবীর সাহেবের অবস্থা ভাল না। দু’একদিনের মধ্যেই যা-কিছু ঘটতে পারে। ডাক্তাররা বলছেন। এখন ছেড়ে দিয়েছেন খুদাহর উপর। কিন্তু আশ্চর্য! দেখে মনে হচ্ছে, অসুখ সেরে গেছে। তোমাকে একবার দেখতে চেয়েছেন। বিশেষ করে যেতে বলেছেন।
ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটে রাখলে না কেন?
থাকলে তো! হাটচান্দ্রা ছেড়ে কোথাওই গিয়ে উনি মরতে রাজি নন। তোমাকে বারবার দেখতে চেয়েছেন।
নিশ্চয়ই যাব। এক্ষুনি চল।
না না। চানটান করে ব্রেকফাস্ট করো তারপর আমি নিয়ে যাব। তার আগে চলো, তোমার নাকটার একটু পরিচর্যা করি। ব্যথা করছে নিশ্চয়ই! আমি বরং ঝিংকু ডাক্তারকে চট করে নিয়ে আসি জীপটা নিয়ে গিয়ে।
কিছু দরকার নেই ভুচু।
দরকার নেই কি? রাস্তায় পড়ে গেছ। —অ্যান্টি-টিটেনাস ইন্জেকশান দিতে হবে।
কিচ্ছু হবে না। তুমি বোসো। আমি চান করে আসছি। একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট খাব। আমাদের জন্যে কিছু বানাতে বলে দাও তো লছমার সিংকে।
দুখী অফিস যাবার জামা-কাপড় বের করে দিল।
পৃথু বলল, পায়জামা পাঞ্জাবি দে। আজ অফিস যাব না। কাল।
চান করতে করতে পৃথুর মনটা আস্তে আস্তে শক্ত হয়ে এল। ডেটল পড়তেই নাকের ক্ষতটা যত জ্বলতে লাগল ওর মনও ততই জ্বলতে লাগল। রুষা থাকতে এ বাড়িতে ভুচু, সাবীর মিঞা, দিগা, শামীম, গিরিশদা ওদের কাউকেই একবেলার জন্যেও নেমন্তন্ন করে খাওয়াতে পারেনি পৃথু। এই সব মানুষদের সোনা দিয়ে ওজন করলেও এদের তুল্যমূল্য হয় না। এদের কাছ থেকে শুধু নিয়েই এল ও। এক-তরফা। বদলে, দিতে পারল না কিছুমাত্রই। এ বাড়ি তার নয়, এখানে কোনও মতই খাটেনি তার। ও যে ছন্নছাড়া, বোহেমিয়ান হয়ে গেছে তার মূল কারণ রুষা। সাধ ছিল, একটি স্বল্পশিক্ষিতা, নরম, মেয়েলি-মেয়ে তার স্ত্রী হবে। সে যখন লেখার টেবিলে বসে লেখাপড়া করবে তখন সে স্ত্রী তার পেছনে এসে দাঁড়াবে। আড়াল থেকে তার কবি-স্বামীকে দেখে সে গর্বিত হবে। কখনও বলবে, চা খাবে নাকি? বা সবসময় এত কী লেখা-পড়া করো? দেখো, একদিন তুমি খুব বড় কবি হবে।
খাবার টেবিলে এসে বসে দেখল, পুরী আর আলুর চোকা আর নরম ওমলেট বানিয়েছে লছমার সিং।
অবাক হয়ে ভুচুর দিকে চেয়ে বলল, এ সব কী?
কেন? আমি তো সাতটার সময় এসেই এই মেনু ঠিক করে বলে দিয়েছিলাম। তুমি এ সব ভালবাসো। কত্তদিন খাওনি। হাসপাতালে তো একই খাবার রোজ রোজ!
বুকের মধ্যে টনটন করে উঠল ওর। এ বাড়ির ডাইনিং-টেবিলে কোনওদিনও ব্রেকফাস্ট-এ এ সব দিশি খাবার দেখেনি ও।
ঠুঠার কোনও খবর জানো?
পৃথু জিজ্ঞেস করল ভুচুকে।
ঠুঠা তো প্রায় পাগলই হয়ে গেছিল। নাঙ্গা বাইগীন-এর আদেশ পেয়ে ও নাকি জঙ্গলের মধ্যের একটি মস্ত শিমূল গাছের ডালে ডালে দিন রাত পাথর বেঁধে বেড়াচ্ছিল। এমন সময় দেবী সিং তাকে আবিষ্কার করে। বানজার-বামনি বস্তি থেকে জায়গাটা নাকি কাছেই। মধ্যে শুধু নদী। দেবী সিং তো বলছিল, সময় মতো ভাগ্যক্রমে ও যদি গিয়ে না পৌঁছত তবে জংলী শকুনরাই ঠুঠাকে খেয়ে সাফ করে দিত।
তারপর?
তারপর আর কী। লোকজন নিয়ে গিয়ে প্রায় অচেতন অবস্থায় ওকে নিয়ে আসে নিজের বাড়িতে, মানে ওদের বস্তিতে। ঝাড়ফুক করা হয়। এখন নাকি অনেকটা সুস্থ। তবে দুবলা হয়ে গেছে খুবই। ভাল হয়েই সকলকে বলছে, তোমার কাছে যাবে। তোমার নাকি ঠুঠা বাইগা ছাড়া আর কেউই নেই এ সংসারে।
তাইই?
পৃথু বলল।
ওর হারানো গ্রাম? পেয়েছে খুঁজে?
হ্যাঁ। পেয়েছে তো।
এখন তাহলে অন্য কিছুর খোঁজে বেরোবে ঠুঠা। কিছু মানুষ থাকে, যারা খুঁজে বেড়াবার জন্যেই আসে এখানে। যা খুঁজছে, তা পেয়ে গেলে তাকে অবহেলায় ফেলে দিয়ে অন্য কিছুর খোঁজ শুরু করে। ঠুঠা এক আশ্চর্য মানুষ।
পৃথু বলল স্বগতোক্তির মতো।
ওরও, আমি ছাড়া কেউই নেই। আসবে কবে, মুক্কি থেকে?
যে-কোনওদিন এসে পড়তে পারে।
হুঁ।
পৃথু বলল, স্বগতোক্তির মতো।
সাবীর সাহেবের বাড়ি বোধহয় হাজারদিন নেমন্তন্ন খেয়েছে কিন্তু অন্দরমেহালে ঢোকবার সুযোগ হয়নি কখনও। কড়া পর্দা ছিল। আজ ওরা গিয়ে পৌঁছতেই ওঁর ন-নম্বরী ছেলে হায়দার, ওদের নিয়ে গেল দোতলাতে। একতলার উঠোনে, যেখানে প্রতি বছরই বক্রী-ঈদে কুরবানী দেওয়ার জন্যে প্রকাণ্ড দুধ-সাদা লম্বকর্ণ বাঁধা থাকত রাতের বেলা, সেই জায়গাটা নোংরা হয়ে আছে। শয্যাশায়ী মানুষের বাড়ির এইই হাল হয়। যতই অন্যরা থাকুন না কেন। সরু সিঁড়ি। পর্দা শুধু মনেই নেই, পরিবেশেও আছে বলে মনে হল। কেমন অন্ধকার, ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা থমথমে ভাব একটা। খোজা প্রহরী হঠাৎ তরোয়াল হাতে লাফিয়ে পড়লেও আশ্চর্য হত না।
অন্দরমহলের দুপাশের সার-সার ঘরের মধ্যের সরু করিডর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে পৃথু অনুভব করছিল বহুজোড়া কৌতূহলী চোখ আড়াল থেকে তাদের দেখছে। নিশ্চয়ই সুর্মাটানা চোখে বিস্ময় ফুটিয়ে বলছে, এই পিরথুবাবু? এহি হ্যায় ভুচুবাবু! কেউ বা বলছে, আহা। পাটা একেবারে গোড়া থেকেই কেটে দিয়েছে গো বেচারির।
হায়দার, সাবীর সাহেবের ঘরে ঢুকে বলল—আব্বা, দ্যাখো কে এসেছেন। কারা এসেছেন।
সাবীর সাহেব ধড়ফড় করে উঠে বসার চেষ্টা করলেন একবার। তারপরই হাকিম সাহেবের বাধাতে শুয়ে পড়লেন।
পৃথু কষ্ট করে তাঁর বিছানার একপাশে বসল। পৃথুকে কোনও সমবেদনা জানাবার আগেই পৃথু বলল, কবে ভাল হচ্ছেন বলুন? বনক্ষেতিতে বহুদিন যাওয়া হয় না। সকলে মিলে একবার যাওয়া দরকার, সেই আগেকার দিনের মতো, আপনার ক্ষেতি-জমিন দেখবার জন্যে। বড়কা বড়কা শুয়োর, শম্বর, বারাশিঙা, আর ঝুণ্ড্কে ঝুণ্ড মোরগা সব ফসল শেষ করে দিচ্ছে যে।
বনক্ষেতির সাংকেতিক ভাষা বুঝলেন সাবীর সাহেব। বনক্ষেতি নামটা শুনেই ওঁর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। হাসি ফুটে উঠল মুখে। কিন্তু সাবীর সাহেব কিছুই না বলে, মাথাটা বালিশের উপর এপাশ-ওপাশ করলেন দুবার। দু চোখের কোণ বেয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে গেল বালিশে। যেন, বলতে চাইলেন, পৃথুকে আমার সঙ্গে মজাক উড়িও না। আমি জানি যে, আর তা হবে না। আর নয়। এ জন্মে এই ঘর ছেড়ে আর কোথাওই যাবার উপায় নেই আমার।
প্রায় একঘণ্টা বসেছিল পৃথুরা। সাবীর সাহেবের কণ্ঠস্বর ক্ষীণ। অমন লম্বা-চওড়া শরীরটা একেবারে ছোট্ট হয়ে গেছে। ওই জবরদস্ত, জিন্দা-দিল, ইমানদার, দোস্তোকো লিয়ে—জান কবুলকরা মানুষটাকে বর্তমান অবস্থায় একেবারেই মানায় না। বড় দুঃখ হয়।
একসময়, পৃথু বলল, উঠি সাবীর সাহেব। আবারও আসব।
আবার যে আসবে না, তা পৃথু জানে।
গলার মধ্যে সেই দলাটা আবারও একবার পাকিয়ে উঠল। সাবীর মিঞার কাছে বিদায় নেবার সময়।
সাবীর মিঞা, ভুচু আর হাকিম সাহেবকে মিনমিনে গলায় করুণ আর্জি করলেন একবার দাঁড়িয়ে উঠে, তাঁর জঙ্গলকা দোস্ত পিরথুবাবুর সঙ্গে ছাতি মিলাবেন। ঈদের দিনের মতো।
কী ভেবে, হাকিম সাহেব ভুচুকে ইশারা করলেন। ওঁরা দুজনে মিলে আস্তে তুলে বসিয়ে দিলেন ওঁকে। দুজনের কাঁধে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন সাবীর সাহেব, কাঁপতে কাঁপতে। পৃথুও উঠে দাঁড়াল তার দুই ক্র্যাচে ভর দিয়ে। ও-ও কাঁপছিল, অনেকক্ষণ বসে থাকার পর হঠাৎ-ওঠাতে। সাবীর মিঞা দুটি হাত প্রসারিত করে পৃথুকে বুকে নিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। খুদাহর কাছে কী সব দরবার করলেন বিড়বিড় করে, স্বগতোক্তির মতো ফার্সী না আরবিতে বোঝা গেল না তার একবর্ণও। তারপরই খাটে বসে পড়ে, ক্র্যাচ-এ ভর দিয়ে দেড়পায়ে দাঁড়িয়ে-থাকা পৃথুর দিকে চেয়ে বড় গভীর স্নেহ-প্রীতির সঙ্গে বললেন, বেচারা! দীর্ঘশ্বাস পড়ল সাবীর সাহেবের।
সেই বে-চারা কথাটা পৃথুর বুকে যত না বাজল, তার চেয়ে তাঁর নিজের বুকেই বোধহয় বাজল অনেক বেশি করে। দু হাতে মুখ ঢেকে ফেললেন সাবীর সাহেব। পৃথু ওঁর হাতে হাত দিয়ে বলল, ফারস্ট ক্লাস হ্যায় সাবীর সাহেব। খুউব মজেমে হ্যায়। আপ্ কোঈ ফিক্কর মত কিজিয়ে। ম্যায় অব চলে। ফিন্ আউঙ্গা।
সাবীর সাহেব মুখ খুলে বললেন, হাঁ। হাঁ। আনা বহত্ই জরুরী হ্যায়। সুব্বা-সাম আনা।
তারপরই বললেন, খুদাহ হাফিজ্।
সাবীর মিঞার বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে পৃথুর মনে হল, যে কদিন আর আছে এখানে, সে কদিন এমনি করেই বিদায় নিতে হবে অনেকেরই কাছ থেকে। মনটা বড়ই বিষণ্ণ হয়ে এল।
মার্টিন লুথার কিং (জুনিয়রের) উপরে লেখা লেরোন বেনেট (জুনিয়র)-এর বই “হোয়াট ম্যানার অফ ম্যান’-এর কটি পঙ্ক্তি মনে পড়ে গেল ওর। “ইট ইজ গ্রেট আর্ট, পসিব্লী দ্যা গ্রেটেস্ট আর্ট, টু নো হোয়েন টু মুভ, হোয়েন টু ব্রেক রুটস্—অফটেন ইন পেইন অ্যাণ্ড টিয়ারস—টু শেক হ্যাণ্ডস্, অ্যাণ্ড সে গুডবাঈ, নট লুকিং ব্যাক, সীক দ্যা নিউ”।
চোয়ালটা শক্ত হয়ে এল পৃথুর।
জীপে বসে, ভুচু বলল, কোথায় যাব এবারে বল?
তোমার কারখানা কি তুলে দিয়েছ নাকি? আমার খিদমদ্গারি করে তোমার লাভ কী হবে? ব্যবসা যে সব নষ্ট হয়ে গেল তোমার।
ব্যবসা আর করবই না ভাবছি পৃথুদা।
সে কি? বলছ কী তুমি?
অবাক হয়ে বলল পৃথু।
প্রায় মনস্থ করেই ফেলেছি। ব্যবসা অবশ্য বন্ধ ঠিক করব না। বন্ধ করলে এতগুলো লোক বেকার হয়ে যাবে। হুদাই চালাবে। ওকেই কিছু শেয়ার দিয়ে ওয়ার্কিং পার্টনার করব। পার্টনারশিপ করে। কাজ আর করব না অমন পাগলের মতো। তুমি তো জানো, আমি কী থেকে কী হয়েছি। পয়সার লোভ আমার নেই।
তোমারও মাথা খারাপ হয়ে গেছে ভুচু। পাগলা ঘোষষার সঙ্গে থেকে থেকে।
বিরক্ত গলায় বলল পৃথু।
হয়তো তাইই।
পামেলা কিছু বলছে না? বিবাহিত মানুষ, অথবা যারা বিয়ে করতে যাচ্ছে এমন মানুষদের ওসব পাগলামি মানায় না ভুচু। বড় বেশি দাম দিতে হয় পরে। চোখের সামনে আমাকে দেখেও শিখলে না।
পৃথু উত্তরে কিছু বলার আগেই ভুচু বলল, পান খাও। বলেই, ড্যাশবোর্ড-এর ড্রয়ার খুলল।
পৃথু বুঝল, প্রসঙ্গ বদলাতে চায় ভুচু।
পান এগিয়ে দিতে দিতে ভুচু বলল, বল, কোথায় যাবে এবারে? অফিস তো আজ যাচ্ছ না?
না। চলো, বড়া মসজিদের কাছাকাছি যখন এসেই গেছি, শামীমের সঙ্গেও দেখা করে যাই একবার। তারপর চলো, লাড্ডুর দোকানে। সবশেষে গিরিশদার বাড়ি। সেখানেই লাঞ্চ খাওয়া যাবে। কী বল?
ফারস্ট ক্লাস। তবে তুমি এক মিনিট বোসো, আমি পেট্রল পাম্প থেকে একটা ফোন করে দিই গিরিশদাকে। গিরিশদা তোমাকে নেমন্তন্ন করেই রেখেছেন। এখন আমার শুধু কনফার্ম করতে হবে। দু একটা বেশি পদ হবে তাহলে।
ওর কথা শুনে হাসল পৃথু।
ভুচু বলল, হোম-কামিং লাঞ্চ বলে কথা। ভালমন্দ খাওয়াবেন না গিরিশদা? কনফার্ম না করলে আমার উপর রাগ করবেন খুউব।
হোম-কামিংই বটে!
পৃথু বলল, না বলে।
ভুচু পথের বাঁদিকে একটা পিপ্পল গাছের ছায়ায় জীপটাকে দাঁড় করিয়ে এক লাফে নেমে চলে গেল ফোন করতে। ওকে লাফিয়ে নামতে দেখেই নিজের জন্যে মনটা খারাপ হয়ে গেল।
সুস্থতার দান যে কত বড় দান ঈশ্বরের, তা সুস্থ থাকাকালীন কেউই বোঝে না। সুস্থ ও নিরোগ মানুষেরই বিধাতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি অনুযোগ এবং অভিযোগ থাকে। ফোন করে ফিরে এসে এঞ্জিন স্টার্ট করে বড়া মসজিদের জনাকীর্ণ ধূলিধূসরিত কাঁচা পথে জীপ ঢোকাল ভুচু। এক পাল ভেড়া নিয়ে যাচ্ছে ভেড়াওয়ালারা। পথ আটকে দিল তারা। উল্টো দিক থেকে একটা মাসির্ভিস ট্রাকও ঢুকল সেই সময়ই। আর যেন সময় পেল না।
বিরক্তিসূচক একটা শব্দ করে ভুচু জীপটাকে বাঁ পাশের কাঁচা নর্দমার মধ্যেই প্রায় নামিয়ে দিয়ে এঞ্জিন বন্ধ করে দিল। ভেড়ার পাল এবং ট্রাক চলে গেলে তবেই এগোনো সম্ভব হবে। ধুলোয় গা-মাথা ভরে গেল দুজনেরই।
ভুচু ভাল করে একবার পৃথুর দিকে চেয়ে বলল, তোমার এই চুল দাড়ি গোঁফ-এর একটা গতি করো পৃথুদা। তাকানো যাচ্ছে না তোমার দিকে।
পৃথু হাসল। বলল, এখন থাক। যে পৃথু ঘোষকে লোকে জানত সে তো আর নেই। ফিরবেও না কোনওদিন। এই পৃথু ঘোষকে, নানা কারণেই কারও না-চেনাই ভাল।
পানের পিক ফেলে পৃথু বলল, তোমার কখনও কি মনে হয় না ভুচু যে, যত মানুষ আমাদের চেনে, তার চেয়ে অনেক কম মানুষ যদি চিনত আমাদের, জীবনটা অনেক বেশি শান্তির এবং হয়তো সুখের হত? চেনা মানুষের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষকেই কোনও প্রয়োজন ছিল না আমাদের, তাদের মধ্যে খুব কম জনই আমাদের সত্যিকারের শুভার্থী, তবু এক জীবনে কত মানুষকেই না চিনতে হয়। ভিড়, ভিড়, ধুলো, আওয়াজ; মিছিমিছি…
কথাটা ভাবার মতো। যদিও আমি তোমার সঙ্গে পুরোপুরি একমত নই। তোমার বর্তমান মানসিক অবস্থাতেই বোধ হয় এমন মনে হচ্ছে তোমার।
না ভুচু। আমার মানসিক অবস্থা একই আছে। এ কথাটা আজই এখন ভাবছি না। বহুদিন থেকেই ভাবছি। তোমাকে একটা কথা বলব। উপদেশ বা জ্ঞান বলে নিও না, কারণ তা দেবার যোগ্যতা আমার নেই। তুমি বিয়ে করবে, সংসার করবে, তাইই বলা। এই ছোট্ট জীবনে যদি সুখী হতে চাও নিজের চেনা-জানার বন্ধুত্বর জগতকেও ছোট্ট করে রেখো। যারা তোমার কাছের মানুষ হবে, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর কোরো। পাঁচশ জন পরিচিত মানুষের চেয়ে পাঁচ জন কাছের মানুষ অনেকই বেশি দামি। মানে, কী করে বলব: আমি বলছি, একসটেনসিভ রিলেশানশিপের চেয়ে ইন্টেনসিভ রিলেশানশিপ অনেক জরুরি।
ভুচু একটা সিগারেট ধরিয়ে অন্য একটা পৃথুকে দিল। লম্বা একটা টান দিয়ে বলল, সেই পাঁচজনই যদি তোমাকে একদিন ডিচ করে? তুমি তো বলতে গেলে পাঁচজন নিয়েই ছিলে পৃথুদা। তবু দুঃখ কি ঠেকিয়ে রাখতে পারলে? কীসে যে কী হয়, বলা ভারী মুশকিল। জীবনে কোনও বাঁধা-ধরা নিয়ম বা সেট-ফরম্যুলা নিয়ে বাঁচা যায় না বোধহয়। এগোতে এগোতে যেমন যেমন দরকার তেমন তেমনই পথ বদলাতে হয়।
পৃথু উত্তর দিল না। ক্রাচ দুটিকে ডান কাঁধের উপরে রেখে ঘুরে ধুলো-উড়োনো ভেড়ার পালের দিকে চেয়ে বসে রইল চুপ করে। ভেড়ার গায়ের গন্ধ, পথের ধুলোর গন্ধ, গরুর মাংসর শিক-কাবাবের গন্ধে নাক ভরে গেল।