৬১
এই নতুন কাজে কিন্তু বেশ মন লেগে গেছে। হাটাচান্দ্রাতে শুধুই একজন এঞ্জিনীয়ার ছিল ও। “মাস্টার অফ ওয়ান ট্রেড”। আর এখানে এখন “জ্যাক্ অফ ওল্ ট্রেডস্, মাস্টার অফ নান্”।
“জ্যাক্” হওয়াতে যে এত আনন্দ, সে সম্বন্ধে ওর কোনও ধারণাই ছিল না। অনেকরকম কাজ একটু একটু করে করার মধ্যে যে বৈচিত্র্যর ঘনঘটা তা একই কাজ অনেকক্ষণ ধরে করার মধ্যে একেবারেই নেই। এ এক নতুন আবিষ্কার। কাহলিন গিব্রানেরই ‘দ্যা প্রফেট’-এ আছে না? কাজ সম্বন্ধে কিছু কথা?
“ওয়ার্ক ইজ লাভ মেড ভিজিবল্”।…এন্ড ইফ উ্য ক্যানট ওয়ার্ক উইথ লাভ বাট ওন্লী উইথ ডিস্টেস্ট, ইট ইজ বেটার দ্যাট উ্য শুড লীভ ইওর ওয়ার্ক এণ্ড সিট অ্যাট দ্যা গেট অফ দ্যা টেম্পল্ এন্ড টেক্ আল্মস্ অফ দোজ হু ওয়ার্ক উইথ জয়”।
“ওয়ার্ক ইজ ওয়রশিপ্”। কথায়ই বলে। কাজ যদি আনন্দই না হয়ে ওঠে, যদি ব্রত না হয়, না হয় পুজো তাহলে সে কাজে সিদ্ধি তো আসেই না, উল্টে এক গভীর ঘৃণাই ক্রমশ অবচেতনে জমতে জমতে নিজেকে কুরে কুরে খেয়ে যায়।
কাজ করাটা, যতটা মালিকের জন্যে তার চেয়েও অনেকই বেশি যে নিজেরই ভালর জন্যে, মানুষ হিসেবে আত্মসম্মান নিয়ে, মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার জন্যে; এই কথাটা অনেকেই বোধহয় পুরোপুরি বোঝেন না।
দিসাওয়াল সাহেবের অফিস ঘরের দরজার কাঁচে একটি পোস্টার আছে। তাতে লেখা “নাথিং ক্যান ডিসটার্ব মী, বাট মাইসেল্ফ্”। কী চমৎকার কথাটা। সত্যিই তো! মানুষকে সে নিজে ছাড়া অন্য কেউই বিরক্ত বা বিব্রত বা ব্যতিব্যস্ত করতে কি পারে? যদি মানুষের মতো মানুষ হয় সে।
কোথায় যেন পড়েছিল, কোনও মনস্তত্বর বইয়েই বোধহয় যে, মানুষ যখন একেবারে একা থাকে তখন সে যে-মানসিক স্তরে থাকে, সে আসলে ঠিক সেই স্তরেরই মানুষ। অর্থাৎ, যে মানুষ একা হলেই ঈশ্বরচন্তিা করে সে ধার্মিক। যে প্রেমিকার কথা ভাবে, সে প্রেমিক। যে ছেলেমেয়ে স্ত্রীর কথা ভাবে সে সংসারী। যে খাওয়ার কথা ভাবে সে পেটুক। টাকার চিন্তা যে করে, সে বৈষয়িক। যে বলাৎকারের কথা ভাবে সে বলাৎকারী। আর যদি কেউ লেখক হবার কথা ভাবে, পৃথু ঘোষের মতো, সে লেখকই। মানুষের বাইরে আবরণ, তার পেশা, তার বাহ্যিক ব্যক্তিত্ব যাই-ই হোক না কেন। নির্জনের অবকাশের একাকি ব্যক্তিত্বটাই তার আসল ব্যক্তিত্ব।
এত কথা ভাবছিল পৃথু, কুর্চির বাড়ির দিকে একা একা হেঁটে যেতে যেতে।
সন্ধে হয়ে গেছে। জায়গাটা এতই নির্জন যে, সন্ধের পর কেউই বিশেষ বের হয় না বাড়ি থেকে এদিকে। ক্রাচ নিয়ে, হাতে টর্চ নিয়ে হাঁটতে অসুবিধে হয় একটু। পরে, অভ্যেস হয়ে যাবে।
দূর থেকে পা-মেশিনের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল। ঝরঝর।
খুবই পরিশ্রম যায় কুর্চির। ওকে আর্থিক সাহায্য সহজেই করতে পারে পৃথু, কিন্তু করে না। অবশ্য কুর্চি গ্রহণ করবে না জানে বলেই করে না। খুবই ভাল লাগে ওর কুর্চির এই নরমহাতের জীবন-সংগ্রামকে, খুব কাছ থেকে দেখতে। রুষা আর কুর্চি দুই মেরুর নারী। কিন্তু এক জায়গায় ওদের খুবই মিল। ওরা দুজনেই এক নতুন প্রজন্মের নারী। নারীরা যে শুধুই কাব্য করার নয়, আদর করার রাবার-ডল নয়, বাবা বা স্বামীর আশ্রিত এবং শাসিত দম-দেওয়া কলের খেলনা নয়; তারাও যে আলাদা মানুষ এবং মানুষের মতো বাঁচার অধিকার শরীরে এবং মনে তাদেরও যে পুরোপুরিই আছে এই জানাটা ওরা দুজনেই জেনে গেছে। ওরা দুজনেই ভারতবর্ষের আগামী প্রজন্মর নারী। যে নারীদের নিয়ে বহু সহস্র বছরের বদভ্যাসে-অভ্যস্ত পুরুষমাত্ররই সমূহ বিপদ ঘটবে। অথচ উদার পুরুষেরা এমন নারীদের চিরদিনই সম্মান করে এসেছে এবং করবে। ঔদাৰ্য্যর মুখোস-পরা পুরুষ নয়; প্রকৃতই যারা উদার মনের পুরুষ।
পৃথুর পায়ের শব্দ পেয়ে কুকুরটা ভুক ভুক করে উঠল। কুকুরটাকে সেদিন লক্ষ্য করেনি।
কুর্চি বলেছিল, হাটের দিনে হাটে অনেকই লাল কালো সাদা যুবতী কুকুরী আসে। তাইই যতক্ষণ হাট থাকে, ততক্ষণ সেখানেই কুকুরটা মজা করে, কুকুরদের আড্ডাবাজি, কাঁকড়া-কাঁকড়ি করে তারপর বাড়ি ফেরে। কুকুরটার নাম ‘বেটা’। কুন্তীর কুকুর।
পৃথু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডাকল, কুন্তী। কুর্চি!
সাড়া নেই।
কুন্তীর কুকুর ভুকে এল ওকে তাড়া করে।
ভেতর থেকে এবারে কুর্চির গলা শোনা গেল। “বেটা। বেটা!”
তারপর দাওয়ায় দাঁড়িয়ে কুর্চি বলল, কওন্?
আমি! কুর্চি আমি।
পৃথু বলল।
ও আসুন! আসুন! বলেই, কুকুরটাকে বলল, এই বেটা! আমাদের লোক। আমার লোক। চুপ কর্। একদম চুপ। চিনে রাখ ভাল করে।
লণ্ঠন হাতে করে পৃথুকে সঙ্গে করে ঘরে গেল কুর্চি।
কুন্তী কোথায়?
আর বলবেন না। কী ঝামেলায় যে পড়েছি না! রমেশ শুক্লা তার সব কামিনদের জন্যে ব্লাউজ আর সায়ার অর্ডার দিয়েছেন। মুনাফাও ভালই থাকবে। দিতে হবে তিনদিনের মধ্যে। মেয়ে দুটি আর আমি তো সারা দিন কাজ করিই। তারপর রাতের বেলাও কাজ করতে হয় আমাকে। ওরা বেলাবেলি চলে যায়। তারপর কি আর কার রাঁধতে ভাল লাগে? বলুন? ও থাকলে, যা হয় একটু নেড়ে চেড়ে দিত। তাছাড়া, নিজের জন্যে কোনও মেয়েরই রাঁধতে ভাল লাগে না। কেউ সেই রান্না তারিফ করার থাকলে, তবেই না…।
পৃথুকে বসার জন্য চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলল, কুন্তী আজ বিকেলে হুট্ করে চলে গেল। বলল, পরশু দিন ফিরবে ওর ঘরে নাকি কি গণ্ডগোল হয়েছে।
তাহলে? আজ খাবে কি?
খাব না কিছুই। দুধ আছে। এক গ্লাস গরম করে খেয়ে শুয়ে পড়ব।
বাঃ। এমন করলে, শরীর থাকবে?
শরীর? শরীর কি আছে নাকি আমার?…তবে শরীর নাইই বা থাকল, মন তো থাকবে।
কথার খোঁচাটা বুঝল পৃথু।
একটু চুপ করে থেকে বলল, আজকে তাহলে তুমি একাই রাত কাটাতে এখানে? ভয় করত না?
নাঃ। কেন? বেটা আছে তো!
সত্যিই কি ভয় করত না? শুধুমাত্র বেটার ভরসায় এখানে থাকতে তো আমারও ভয় করত।
পৃথু বলল।
সত্যি বললে বলব, করত ভয়। কিন্তু আমি তো একা নই পৃথুদা। আমার মতো এবং আমার চেয়েও অনেক বেশি অসহায় অবস্থায় অনেক মেয়েই আছে। ভয় করার যাদের উপায় নেই; তাদের ভয় করার বিলাসিতা কি মানায়?
তুমিই না লিখেছিলে, চুরি হয়ে গেছিল সব একবার?
হ্যাঁ। তবে সব মানে? সম্পত্তি? হ্যাঁ! তা গেছিল। আপনার লেখা চিঠিগুলোও। সেটাই সবচেয়ে বড় ক্ষতি আমার। জানি, এই জীবনে এরকম চিঠি আর আপনি লিখতে পারবেন না। আমিও পারব না লিখিয়ে নিতে।
একটু চুপ করে থেকে বলল, জানেন? পরে সে চোর ধরাও পড়েছিল। এখানে কোতোয়ালীর দারোগাসাহেব খুব জবরদস্ত মানুষ। চোরকে দেখে কিন্তু আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেছিল।
তোমার? কেন?
পৃথু শুধোল।
চোরটা কী ভাল আর নির্দোষ যে দেখতে! কী বলব আপনাকে! ও চুরি করতেই পারে না কিছু, কারও মন ছাড়া।
বাঃ শুনতেও ভাল। চোরকে ভাল দেখতে, তাতে তোমার মন খারাপ হবে কেন?
পৃথু হেসে বলল।
হবে না? আমি যে একা-ঘরে ঘুমিয়ে ছিলাম। সেই হ্যান্ডসাম হতভাগার কাছে আমার মতো একজন ঘুমন্ত নারীর চেয়েও ছিট-কাপড়ের গাঁটরিটার দামই বেশি হল? অপমান করুক সে তো চাইনি তবে আমাকে না জানিয়েও আমার ঘুমন্ত সৌন্দর্যর সম্মান তো দেখাতে পারত একটু!
একটু চুপ করে থেকে বলল, কত রকম পুরুষই যে থাকে! সত্যি। আচ্ছা আপনি যদি আমার ঘরে সিঁদ কেটে চুরি করতে আসতেন তবে প্রথমেই কি চুরি করতেন? ওই গাঁটরিই কি?
কথাটা ঠাট্টা হিসেবেই বলেছিল কুর্চি এবং ঠাট্টাই থাকার কথা ছিল। কিন্তু ঠাট্টা থাকল না।
পৃথু গম্ভীর হয়ে গেল। কুর্চিও মুখ নামিয়ে নিল।
হ্যারিকেনের আলোর বিপরীতে দাঁড়ানো কুর্চির খোঁপা, ওর মরালি গ্রীবা ছায়ার তুলিতে এমনভাবে মাটির দেওয়ালে আঁকা হয়ে গেল যে, জীবনানন্দর কবিতার লাইন মনে পড়ে গেল পৃথুর।
দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। ঝর্নাটা বয়ে যাবার কুলকুল শব্দ, জঙ্গলের ভিতর থেকে ভেসে আসছিল। সেই শব্দ আর উঠোনে শুয়ে-থাকা বেটার খচর-খচর করে পা-দিয়ে গা-চুলকানোর শব্দ ছাড়া এখন আর কোনওই শব্দ নেই। পিয়া শাল কাঠের টেবলের উপরের রাখা ছোট্ট টাইম-পিসটাই, শুধু ঝিঁক্ ঝিঁক্ ঝিঁক্ ঝিঁক্ শব্দ করে ক্ষুদে-দাঁতি করাতের মতো সময়কে চিরে চিরে ফালা ফালা করছিল।
হঠাৎই একটা পিউ-কাঁহা পাখি ওদের দুজনের মস্তিষ্করই মধ্যে যেন চিৎকার করে উঠল; পিউ-কাঁহা? পিউ-কাঁহা? পিউ-কাঁহা বলে। তারপরই, তার আওয়াজটা ফিকে হয়ে মিলিয়ে গেল পাহাড়তলির দিকে।
ব্রেইন্ফিভার।
স্বগতোক্তির মতো বলল কুর্চি।
ব্রেইন্ফিভারই বটে!
নিরুচ্চারে বলল, পৃথু।
পৃথু কুর্চির একটু আগেই বলা কথাটির খেই ধরে বলল, আমি কি কখনও কিছু চুরি করতে চেয়েছিলাম তোমার কাছ থেকে? মনে তো পড়ে না।
কুর্চি মোড়ার উপরে বসল এসে। চুড়ো করে চুল বেঁধেছে। হলুদ-সাদা ছাপা শাড়ি। খোঁপাতে হলুদ সোনাঝুরি ফুল। এবার তার ছায়াটা অন্যরকমভাবে পড়ল দেওয়ালে।
কুর্চি ভুরু তুলে বলল, ডাকাতরা কি ছিঁচকে চুরিতে বিশ্বাস করে? ডাকু মগনলাল? মগনলালকে যে ডাকাত মারল, ডাকু পৃথু? যাইই বলুন, আর তাইই বলুন, হৃতই যদি হতে হয় তবে ডাকাতের হাতেই হওয়া ভাল। এমনকি সর্বস্বহৃতও। সেই সুন্দর চোরটাকে দেখে এই কথা বলেই বুঝ্ দিলাম নিজেকে। তবু, চোরের দ্বারা হৃত হওয়ার আর মারুতি গাড়ি চাপা পড়ে মরা একই ব্যাপার। চাপা পড়ই যদি মরতে হয়, টাটার ট্রাকের নীচেই মরব। সবাই বলবে, আহা! বড্ড লেগেছিল গো!
মেয়েদের চোখে বোধহয় সব চোরই সুন্দর। রোম্যান্টিকতার সীমা একটা থাকা উচিত।
বলেই, হেসে উঠল পৃথু।
হেসে উঠল কুর্চিও।
ঠিক কতদিন পরে যে ওরা দুজনে এমন করে মুখোমুখি বসে হাসল তা মনে করতে পারল না দুজনের কেউই! হয়তো ভুলেই গেছিল বোধহয় ওরা। নিজের নিজের কারণে। আলাদা আলাদা কারণে।
পৃথু বলল, সেলাই রাখো এখন। চলো আমার সঙ্গে, আমার বাংলোতে। আজ ওখানেই খাবে। থাকবেও রাতে ওখানে।
না, না। তা হয় না। থাকব? আমার ভয় করে পৃথুদা। খুবই ভয় করে।
কেন? ভয় করে কেন? কিসের ভয়?
জানি না। করে। হয়তো নিজেকেই। তার চেয়ে বরং আপনিই থাকুন এখানে। কুন্তী নেই। একদম একা থাকতে ভয়ও করত।
তারপর মুখ নামিয়ে বলল, কিন্তু আপনি আমার সমস্ত সম্পত্তি আগলে রাখতে পারবেন তো?
তা না হয় সামলে-সুমলে আগলে রাখলাম। কিন্তু আমার লোভ? সেই সর্বনাশাকে কে আগলাবে?
যা আপনারই, তার প্রতি লোভ হবেই বা কেন? শিশুরাও তো নিজের বাড়ির ফ্রিজে-রাখা চকোলেট চুরি করে খায় না? কি? খায়?
পৃথু জবাব দিল না।
না বলে, বলল, বাধাটা সেখানে নয়। যখন বাধা ছিল, প্রচণ্ড বাধা ছিল তোমারই দিক থেকে, তখন সেই বাধা অতিক্রম করার জন্যে এক দুর্মর জেদ পৃথুকে কামড়ে খেত অনুক্ষণ, জংলী কুকুরেরই মতো। আর বাধাটাই যখন অপসারিত হয়ে গেল, কুর্চির সম্মতিতে তখনই প্রচণ্ড ভাবে ওকে পাওয়ার ইচ্ছা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আশ্চর্য! এই সামান্য পথটুকু অতিক্রম করতেই বড় দ্বিধা, ভয়, সংকোচ! কুঁড়েমিও লাগছে একধরনের। আসন্নপ্রসবা হরিণীরই মতো যেন শ্লথ হয়ে গেছে সেদিনের চকিতচিতার মত তীব্রগতি কামনা।
এখন কুর্চিকে পেতে তারই অনেক বাধা। ভিতরের বাধা। ভাবছিল, টুসু যদি তাকে আর কোনওদিনও বাবা বলে সম্মান না করে? যদি টুসু কোনওদিনও জানতে পেরে যায় কুর্চির সঙ্গে তার ওই সম্পর্কর কথা? জানতে পারলে, টুসুর চোখে রুষার সঙ্গে পৃথুর তফাৎ আর থাকবে কতটুকু? শরীরই তো মানুষের সব নয়! হয়তো অনেকখানি, তবুও কখনওই সব নয়। তার চাহিদা যতই থাকুক না কেন, মনের শাসন, মনের বক্তব্যর চেয়ে শরীরের ভূমিকা কখনওই বড় হলে চলে না কোনও মানুষেরই জীবনে। রুষা তার ব্যক্তি-স্বাধীনতার সঙ্গে পৃথুর অদ্ভুত জীবনযাত্রার বিরুদ্ধে বিদ্রোহর সঙ্গে তার শারীরিক সুখকে পুরোপুরি গুলিয়ে ফেলেছিল। কন্ফিউসড হয়ে গেছিল বেচারি। নইলে, অফ ওল্ পার্সনস্ ইদুরকারের কাছে সে যেত না।
কুর্চিকে সে মনে মনে এতই তীব্রভাবে ভালবাসে, আজও বাসে যে, শারীরিক সম্পর্ক সত্যি সত্যিই হয়ে গেলে, কুর্চির সঙ্গে সে জড়িয়ে পড়বে বাকি জীবনের মতো। বিজলীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক আর কুচির সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক হওয়া এক নয়। তাহলে, আবারও অন্য মিলি, অন্য টুসু, আবারও দুখী, মেরী, আবার সেই সংসার! নতুন করে। না। না। না। একবারেই যথেষ্ট হয়েছে। আর না! তাছাড়া, ও তো সংসারী টাইপ নয়। কুর্চিকে ভালবাসে বলেই ঠকাতে পারবে না ওকে পৃথু। এই কুর্চিকেও যেন একেবারে অচেনা, নতুন কোনও মানুষ বলে মনে হচ্ছে। নারীরা সাপেরই মতো। কখন যে তারা পুরনো জীবন, পুরনো স্মৃতি, এমনকী পূর্ব-মুহূর্তকেও খোলসের মতো ছেড়ে ফেলে নতুন জীবনের গর্তে সেদিনের রাতের শঙ্খচূড় সাপটারই মতো সেঁধিয়ে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়, তা তারাই জানে।
পৃথু চুপ করে ছিল। কুর্চি চেয়েছিল তার দিকে।
অনেকক্ষণ চুপচাপ। উঠোনের কোনও গাছ থেকে তক্ষক ডেকে উঠল।
পৃথু বলল, চলো। যাবে না?
কুর্চি গভীর দৃষ্টিতে তাকাল পৃথুর চোখে। বলল, যাব, খাবও। তবে রাতে থাকব না। আপনার ঠুঠা বাইগাকে বলবেন, আমাকে পৌঁছে দিয়ে যাবে।
না। যতদিন আমি সীওনীতে আসিনি, অন্য কথা ছিল। যখন এসেই গেছি, এই নির্জন কুঁড়েঘরে তোমাকে আমি একা থাকতে দিতে পারি না, চলো, আমার বাংলোয় থাকবে আজ রাতে। পার্মানেন্টলিও থাকতে পারো।
কুর্চি মুখ ঘুরিয়ে নিল অন্যদিকে। দেওয়ালে তার মুখের ছায়াটাও ঘুরল। ছায়াটাকে এখন একটি বাইসনের মুখের মতো দেখাচ্ছে। যেন কোনও গুহাচিত্র বা রক্-পেইন্টিং দেখছে পৃথু। আলো আর ছায়াই তো পৃথিবীর সব ছবি, সব ফোটোগ্রাফির মূলে!
অন্যমনস্ক হয়ে ভাবছিল পৃথু।
মুখ ঘুরোনো অবস্থাতেই কুর্চি বলল, কেন? পার্মানেন্টলি থাকব কেন? কিসের দাবি আপনার আমার উপর? যার দাবী নেই, তার তো দায়ও থাকার কথা নয় কোনও, নাঃ। আমি একাই থাকব এখানে। আমার জন্যে মিছে চিন্তা করতে হবে না আপনাকে। অনেক ধন্যবাদ!
ভীষণই ইচ্ছে করছিল পৃথুর যে, সেই মুহূর্তে কুর্চিকে একবার বুকে নেয়, তারপর তার অভিমানী ঠোঁট-দুটিকে নিজের ঠোঁটে নিষ্পেষিত করে তার যত দুঃখ, যত অভিমান সব শুষে নিয়ে ওকে নীল করে নীলপদ্মর মত ফুটিয়ে তোলে। হাত বাড়ালেই পরম ভালবাসার, পরম প্রার্থনার তীব্র ভাললাগাবাহী প্রিয়জনের শরীর। তবু, হাত বাড়াতে পারল না পৃথু।
কখনও কখনও সামান্য দূরত্ব অতিক্রম করাও অসম্ভব হয়ে ওঠে।
অনেকক্ষণ পরে গলায় হাল্কা সুর এনে কুর্চি বলল, রাতগুলো বড় বাজে, না? বিশেষ করে অন্ধকার রাত।
কেন? তারারা তো থাকেই। অনেকই আলো দেয় তারা।
পৃথু বলল।
হয়তো থাকে। তবে সকলকেই তারা তরিয়ে দেয় না। হয়তো কিছু ভাগ্যবানের চোখই সে আলো খুঁজে পায়। আপনার মতো।
হয়তো। তুমি তাহলে যাবে না সত্যি আমার সঙ্গে?
না।
দৃঢ় গলায় বলল কুর্চি।
এটা তোমার অন্যায় জেদ।
হয়তো।
কেন?
জানি না। আপনি তো জানেনই। আমি এইরকমই।
পরিবেশ হাল্কা করার জন্যে পৃথু বলল, তুমি জেদী না হলে তোমাকে ভালই বাসতাম না!
অনেকদিন তো ভালবেসেছেন। আর নাই-ই বা বাসলেন। ব্যাপারটা কী জানেন? যখন ভাঁটু ছিল আমার সঙ্গে, তখন আপনাকে আমার অদেয় অনেক কিছুই ছিল। অথচ এখন বুঝতে পারি দেবার সুবিধে ছিল তখনই সবচেয়ে বেশি। এ দেশে ‘ঘোমটার তলায় খেম্টা নাচা’টাই সবসময় সুবিধাজনক। এইটেই মেনে নেওয়া রীতি। এখন তো আমি একজন একা মেয়েমানুষ। নির্জনে, জঙ্গলে থাকি। আপনিও একা পুরুষমানুষ। দিসাওয়াল্ সাহেবের ম্যানেজার আপনি। ছোট্ট জায়গা এটা। হাটচান্দ্রা বা আমাদের রাইনার চেয়েও ছোট্ট জায়গা। পুরুষের গায়ে তো কলঙ্ক লাগে না। কলঙ্কর ভয় অবশ্য আমি করি না। কিন্তু এখানে আপনি আমার কাছে এমনভাবে এলে, অন্য দশটা বাজে লোকও আমাকে বিরক্ত করতে শুরু করবে। অশিক্ষিত এবং শিক্ষিত পয়সাওয়ালা মানুষের অভাব নেই এখানেও।
তবে? আমি তাহলে আর আসব না তোমার কাছে? কী বলতে চাও তুমি কুর্চি?
পৃথু বলল।
আপনাকে ভেবে দেখতে হবে পৃথুদা, আমরা দুজনে কীভাবে থাকব এখানে। যদি আদৌ কোনও সম্পর্ক থাকে আমাদের তবে তা কিরকমের হবে? ভাই-বোনেরই মতো হবে কি সেই সম্পর্ক?
ভাইবোনের মতো?
অবাক হয়ে পৃথু বলল।
হ্যাঁ। হয় ভাইবোনের মতো থাকতে হয়, নয় স্বামী-স্ত্রীর মতো। রুষা-বৌদি ইচ্ছে করেই চলে গেছেন। আর ভাঁটুও স্মাগলিং করে জেলে গেছে। তাদের অপরাধের জন্যে আমরা কেন নিজেদের কষ্ট দেব এমন করে? এই মুহূর্তে আমরা যখন দুজনকে দুজনে চাই-ই এবং আমরা যখন আমাদের নিজেদের কোনও দোষ ছাড়াই একা হয়ে গেছি, তখন আমাদের স্বামী-স্ত্রী হিসেবে থাকতে বাধাটাই বা কোথায়? আমি তো বুঝি না। বিয়ের দরকার নেই। একসঙ্গে থাকব শুধু। কারও সম্পত্তির ওপর অন্য কারো দাবি থাকবে না। দাবি যা, তা শুধু শরীর আর মনের ওপর। যখনই ইচ্ছে হবে, আলাদা হয়ে যাব আমরা, কোনও ঝগড়া, চিৎকার চেঁচামেচি না করেই। রাজি?
পৃথু চুপ করে রইল।
ভাবছিল, কী অসম্ভব বদলে গেছে তার চেনা রক্ষণশীল কুর্চি। অন্তত কথাবার্তায় ও তো রুষার চেয়েও বেশি আধুনিকা হয়ে গেছে! কী করে হল এমন?
হঠাৎই কুর্চি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল দু হাতে মুখ ঢেকে।
বলল, বাজে! একটা বাজে লোক আপনি! ভালবাসতেন না ছাই! ভালবাসাটা আপনার কাছে একটা খেলামাত্র। আপনাকে কেন যে ভালবাসতে গেলাম! বেচারা ভাঁটু! মিছিমিছি! আপনি কেন আমার ঘর ভেঙে দিলেন এমন করে? কী করেছিলাম আমি আপনার? আপনি কি পুরুষমানুষ?
ছিঃ! ছিঃ!
মাঝে মাঝে পৃথুর নিজেরও ঘোরতর সন্দেহ হয় যে ও পুরুষমানুষ কি না! রুষাও এরকম বলত। উধাম সিংও বলেছিলেন। এখন কুর্চিও বলছে। কে জানে, ও কেন পুরুষমানুষ হতে পারল না! কখনও কি হতে পারবেও না তা?
কুর্চি কাঁদছিল ফুপিয়ে ফুঁপিয়ে ফুলে ফুলে। চুড়ো করে বাঁধা চুল গ্রীষ্মদিনের সমুদ্রে ফণা-ধরা ঢেউয়ের মতো হঠাৎই ভেঙে পড়ে পিঠ এবং কাঁধময় ছড়িয়ে গেল। তার চুলের ঢেউয়ে ফসফরাসের মত কী যেন জ্বলতে লাগল। না কি পৃথুর চোখেরই ভুল?
নিজেকে সংযত করল পৃথু। এখন কুর্চির শরীরের কোথাও ওর হাত লাগলে কুর্চি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। ও নিজেও অঙ্গার হয়ে যাবে। আরও একটু ভাবতে হবে। জীবনে অনেকই ভুল করেছে ও। আর যাই-ই করুক, হঠকারিতা, আর নয়। ও-ও বদলে গেছে অনেক। তবে কুর্চি আর ওর বদলটা বিপরীতমুখী হয়ে গেছে।
পৃথু উঠে দাঁড়াল।
বলল, চলি।
আবারও ফুপিয়ে কেঁদে উঠল কুর্চি।
পৃথু ক্রাচ-এ ভর দিয়ে ঘরের বাইরে এল। ও যখন বেড়ার গায়ের দরজা অবধি চলে গেছে তখন এলোচুলে দৌড়ে এল কুর্চি। বলল, শুনুন। আপনি আর কখনও এখানে আসবেন না।
বলেই আবার দু হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠল।
পৃথু হাসল।
বলল, একশবার আসব। আমি এলে, তুমি ঠেকাবার কে?
‘বেটা’ এতক্ষণে পৃথুকে বন্ধু ভেবেছিল কুর্চির। কুর্চির ব্যবহারের হঠাৎ তারতম্যে সে দৌড়ে, ভুকে কামড়াতে এল পৃথুকে। ডান পায়ে জোর লাথি ছুঁড়ল একটা বেটার দিকে পৃথু। আধখানা পায়ে, ভুলবশত। আর অমনি এক কাঁপুনি এল সেই পায়ে। সঙ্গে, অসহ্য যন্ত্রণাও। থরথর করে কাঁপতে লাগল পাটা। সেই কাঁপুনি আর থামেই না। এ অবস্থায় ওর পক্ষে বসে-পড়া ছাড়া উপায় ছিল না কোনও। কিন্তু বসল না পৃথু। এখন এখানে বসলেই তার জীবনও হাঁটুমুড়ে বসে পড়বে কুর্চির এই পর্ণকুটিরে। একজন নারী একবার তার জীবন নষ্ট করেছে, বার বার তা হতে দেবে না ও। অনেকই হয়েছে। ঘরসংসার, ছেলেমেয়ে। আর নয়। আবার নয়। যা পেয়েছে; দিয়েছে তার চেয়ে ঢের বেশি।
এক ঝাঁকুনি দিয়ে লাফিয়ে বেরিয়ে পড়ল পৃথু। বেটা ওকে ভয় দেখাতে দেখাতে বেশ কিছুদূর এল পেছন পেছন। সে ফিরে যেতেই আর দু পা এগিয়েই ধ্বপ্ করে পড়ে গেল পথের ওপরে পৃথু ঘোষ।
কোনওদিনও কারও করুণা চায়নি। কারও কাছেই নয়। এই-ই প্রথমবার অসহ্য শারীরিক যন্ত্রণায় সদ্য-পরিচিত জায়গার অপরিচিত রাতে অসহায়ের মতো ধুলোর মধ্যে আধশোয়া হয়ে শুয়ে পড়ল, বড় করুণা হল নিজের; নিজেরই ওপর। এই নতুন বিড়ম্বনা, এই অনবরত থরথরানি আর শিরা-উপশিরা-স্নায়ু সব ফেটে যাবার মতো যন্ত্রণার নাম ও জানে না। নাম নিশ্চয়ই আছে একটা। হয়তো ওষুধও আছে।
ওরকমভাবে অর্ধচেতনে প্রায় আধঘণ্টা শুয়ে থাকার পর আস্তে আস্তে উঠে ওর বাংলোর দিকে চলতে লাগল পৃথু। আজ রাতেই যেন প্রথমবার ভুচুর অভাব, একটা জীপগাড়ির অভাব এবং নিজের সুস্থ শরীরটার অভাব দারুণভাবে অনুভব করতে লাগল ও।
মানুষের জীবন মানুষকে কোথায় না কোথায় নিয়ে যায়। রাজাকে ভিখিরি করে, ভিখিরিকে রাজা। সুস্থ স্বাস্থ্যোজ্জ্বল মানুষকে হঠাৎ পঙ্গু। এই-ই তো জীবন! জীবনের সঙ্গে, এই জীবনের স্রোতে অন্ধকারে দেড়খানা পায়ে লাফাতে লাফাতে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে তার নতুন জীবনের, নতুন বাসের দিকে এগিয়ে চলল পৃথু।
পৃথু চলে গেলে বাথরুমে গিয়ে মুখ ধুলো কুর্চি। ‘বেটা’ পৃথুর সঙ্গে অমন অসভ্য ব্যবহার করেছে বলে লাঠি দিয়ে তাকে বেদম পেটাল। কুকুরটা রেগে দিয়ে একসময় কুর্চিকেই কামড়াতে এল প্রায়।
আয়নার সামনে গিয়ে বসে হ্যারিকেনের আলোয় আবার চুল ঠিক করল ও। চোখে কাজল দিল নতুন করে। চান শেষ বিকেলেই করে নেয় রোজ। বহুদিনের অভ্যেস। তারপর কাগজ-কলম নিয়ে চিঠি লিখতে বসল পৃথুকে।
আমার পৃথুদা, রাগ করবেন না।
আমাকে ক্ষমা করবেন।
নানা কারণে আমার মাথার ঠিক নেই। আমার চোখের সামনে আপনার এই শারীরিক অবস্থা দেখে আমি বড় পীড়িত বোধ করি। নিজের উপরে রাগ হয়। কেন জানি না।
আপনি এখানে আসবেন যে, আমি জানতাম। সেই দিনের অপেক্ষাতেই এত মাস বসেছিলাম। যখন এলেন শেষ পর্যন্ত, তখন এই রকম ব্যবহার করলাম! যাই-ই হোক, কাল দিনের আলো ফুটলেই পুরো ব্যাপারটাকেই দুঃস্বপ্ন বলে মনে হবে। আমি জানি, আপনারও তাই-ই হবে। রাতকে আমি এই জন্যেই ভীষণ অপছন্দ করি।
আমরা সব মানুষই ভারী দূর্বল। আপনি চলে যাবার পর ভাবছিলাম সেই কথাই। ভাগ্যিস আপনি শক্ত হয়ে ছিলেন। কোন মানুষ কত সবল, তা দিয়ে তার জোরের বিচার হয় না। তাই না? কোন মুহূর্তে সে সবচেয়ে বেশি দুর্বল, সেই ক্ষণিক দূর্বলতা দিয়েই তার বলের বিচার হয়।
চিঠিটা লেখা শেষ হয়নি, এমন সময় বেটা আবার জোরে ভুক্ ভুক্ করে ডেকে উঠল।
রাত হয়েছে এখন। টর্চটা হাতে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কুর্চি বলল, কওন?
শালকাঠের বেড়ার মধ্যের দরজার ওপাশ থেকে একজন লোক গলা খাঁকরে বলল, ঠুঠা বাইগা!
কুর্চি গিয়ে দরজা খুলল।
হাতে টিফিন ক্যারিয়ার এবং একটি চিঠি। ঠুঠার কাঁধে একটি কম্বলও। অবুঝমারের বাইসন-হর্ন মারিয়াদের। বাইরে শুলে ঠাণ্ডা লাগবেই। রাতে এখনও বেশ ঠাণ্ডা এখানে।
ঠুঠা, কুর্চির অনুমতির অপেক্ষা না রেখেই দাওয়ায় বসল, পিয়া-শালের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে। লম্বা হাই তুলল একটা। তারপরই পকেট থেকে চুট্টা বের করে শজারু-মার্কা দেশলাই-জ্বেলে চুট্টা ধরাল।
কুর্চি ভিতরে গেছিল চিঠিটি পড়তে। টিফিন ক্যারিয়ারটা দাওয়ার ওপর রেখে।
‘বেটা’ এসে শুকল একবার।
ঠুঠা নিজের ভাষায় খারাপ গালাগালি দিল একটা। ‘বেটা’ বাংলা বোঝে না বটে কিন্তু এই ভাষা বুঝল। বুঝে, ঠুঠাকে সমীহ করে সরে গিয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধুলোর মধ্যে কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে স্বগতোক্তির মতো বিড় বিড় করে কী যেন বলে, ঘুমিয়ে পড়ল।
ঘরের মধ্যে গিয়ে চিঠিটা খুলল কুর্চি।
কুর্চি।
আমাদের দুজনের কেউই এই মুহূর্তে শরীরে মনে প্রকৃতিস্থ নেই। কিছুক্ষণ আগে যে-সব কথা হল তোমার সঙ্গে, সে সব ভুলে যেও।
ঠুঠাকে পাঠাচ্ছি। রাতে একা থাকা হবে না তোমার অমন নির্জন জায়গায় কোনওমতেই। ওর কাছে জোর দেখিও না। দেখালে, ও তোমাকে কাঁধে করেই নিয়ে আসবে আমার কাছে। যতই হাত-পা ছোঁড়ো আর চেঁচাও, নিস্তার পাবে না। ও হচ্ছে আমার “গলিয়াথ্”। বুঝেছ?
আজ বিগু, পাঁঠার মাংসর ঝোল, রুটি আর রায়তা করেছিল। পাঠালাম তোমার জন্যে। এতটুকু মেয়ে! খালিপেটে সারারাত থাকবে না। ভাল করে খাবে। ঠুঠা তোমাকে পাহারা দেবে। কোনও চিন্তা নেই। ভাল করে ঘুমোও। ঠুঠার সঙ্গে পিস্তল আছে। ডাকাত এলেও তার নিস্তার নেই।
আর হ্যান্ডসাম চোরের প্রাণ তো যাবেই।
একটা কথা!
সেই কথাটা, কখনও ভুলবে না। আমার আর তোমার মধ্যে যত ভুল বোঝাবুঝিই হোক না কেন! কথাটা হচ্ছে এই-ই যে, আমি তোমাকে ভালবাসি। তোমার মতো ভাল আমি জীবনে কাউকেই বাসিনি। এই কথাটা বিশ্বাস করে আমার ছোটখাটো খারাপ ব্যবহার, অপূর্ণতা, আমার খামখেয়ালিপনা নিজ গুণে ক্ষমা করে দিও।
প্রতি হাটবারে ভোরবেলা তুমি এখানে চলে আসবে। ডে-স্পেণ্ড করবে আমার সঙ্গে। যদি গাড়ি বা জীপ জোগাড়-করা যায়, নইলে বাসে করেই; কাছাকাছি বেড়িয়ে আসব আমরা। ফিরবে তুমি রাতে খাওয়াদাওয়ার পর। ঠুঠা তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে। তোমার কুন্তীরও নিমন্ত্রণ রইল। তোমার সঙ্গে। ঠুঠা তোমার কাছে রোজ রাতে শুতেও পারে। তাহলে আমি নিশ্চিন্ত হই।
এখানেই শেষ করি।
—ইতি তোমার পৃথুদা
চিঠিটা পড়া শেষ করে বারান্দায় বেরিয়ে এল কুর্চি লণ্ঠন হাতে। প্রসন্নতা, ওর মুখে প্রতিমার মুখের গর্জন-তেলের মতো চকচক করছিল। ঠুঠাকে বলল, চা খাবে না কি ঠুঠা দাদা?
ঠুঠা মাথা নাড়ল।
মুখে আজকাল খুবই কম কথা বলে ঠুঠা।
দুধ খাবে একটু?
আবারও মাথা নাড়ল ঠুঠা।
তুমি কিন্তু বাইরে শুয়ো না। ভিতরেই, পাশে অন্য একটি ঘর আছে। বিছানা আছে তাতে। বিছে বা সাপ কামড়াতে পারে বাইরের দাওয়ায় শুলে।
ঠুঠা মাথা নাড়ল আবারও।
অদ্ভুত লোক!
মনে মনে বলল, কুর্চি।
কুর্চি চলে গেলে, এক গাল চুট্টার ধুয়ো ছেড়ে ঠুঠা ভাবল, এই মেয়েটার সঙ্গে তার পৃথুর যদি বিয়ে হত, বেশ হত তাহলে। মেয়ে-মেয়ে আছে মেয়েটা। রুষার মতো মর্দানা নয়! অবশ্য রুষার মতো সুন্দরী এ না, অতরকম গুণও এর নেই। কিন্তু ঠুঠার দীর্ঘজীবনের অভিজ্ঞতায় ঠুঠা বাইগা দেখেছে যে, ভাল বউ পেতে হলে বিয়ে করতে হয় একেবারেই সাদামাটা মেয়ে। মোটামুটি সুন্দরী; মোটামুটি বিদ্যে-বুদ্ধি। সুন্দরী বউ হবে অন্যর। এমনকি শত্রুরও হতে পারে। যাতে নিজেদের দেখে সুখ হয়। শুয়ে সুখ হয়। অতি সুন্দরী, অতি গুণবতী কখনও ভাল বউ হয় না।
পৃথুর বিয়ে তো আর ঠুঠা দেয়নি। যা হবার তা হয়ে গেছে। এই কুর্চি মেয়েটার সঙ্গে বিয়ে দিতে পারলে পৃথু ছেলেটার বাকি জীবনটা বেঁচে যায়। দেড়খানা পায়ের মতো, দেড়খানা জীবন!
ঘটনা তো তাদের সমাজে আকছারই ঘটে। বনিবনা যে চিরদিনই হবে স্বামী-স্ত্রী দুজনের এমন কথা কি? বনল না তো বনল না! নতুন কারও সঙ্গে ঘর বাঁধো গিয়ে। ছেলেমেয়েগুলো ভাগ করে নাও শুয়োর মোরগার মতো! সে তো গাওয়ানই সভা ডেকে সব বিলিব্যবস্থা করে দেবে। কিছু দণ্ড দিতে লাগবে এই-ই যা!
এমনই তো ঘটে আসছে চিরদিন আদিবাসী, হরিজন এবং রাজা-মহারাজা অথবা পুরোপুরি সাহেবী, দিশি লোকদের সমাজে। মারা পড়ল এই মাঝামাঝিরা। বিয়ে একবার করল তো মরল। না পারল গিলতে; না পারল ফেলতে। দূর! দূর! এদের কোনও হিম্মৎই নেই। যেমন মেয়ে, তেমন ছেলে। মিষ্টি কথায় ফারাক হয়ে গিয়ে বাকি জীবনও তো বন্ধুর মতো থাকা যায়? যায় না কি? হাটে দেখা হলে এ ওর কাছ থেকে বিড়ি চেয়ে খায়, কেউ কাউকে মহুয়া খাওয়ায়। এর নতুন সঙ্গী, তার নতুন সঙ্গিনীর সঙ্গে ঠাট্টা-তামাশাও করে! আরে একটাই তো জীবন, ঠুঠার মতো সৃষ্টিছাড়া যারা, তাদের কথা অন্য। যারা বিয়ে করল, বিয়ে ভাঙল; আবারও বিয়ে করল তাদের দুঃখটা কোথায়? সারাদিন কাজ করে ঘেমেনেয়ে যাও। দুপুরে ঝরনার পাশে বসে শালপাতার দোনায় গাছতলায় কিছু খাবার, বাড়ি থেকে আনা খেয়ে নাও। তারপর সন্ধের পর মহুয়া খাও, নাচো, গাও। মাদলে আর ধামসাতে চাঁটি মারো। তারপর যার যার মেয়েছেলের নরম বুকে, সে নিজের বউই হোক, কি পরের বউইই হোক, হাত রেখে আরামে ঘুমিয়ে পড়ো। রোজ রোজ কি বাঁচবে শালা কেউ? না চিরদিনই বাঁচবে? এই সরল কথাটা এই লেখাপড়া জানা ইংজিরি জানা মানুষগুলোর মগজে ঢোকে না যে কেন, তা ঠুঠা বাইগার বুদ্ধিতে আসে না। এত ঝগড়া কিসের? ঝগড়াই করবে তো বাঁচবেটা কখন?
কুর্চি বলল, চুট্টা খাবে ঠুঠা দাদা? কুন্তীর বর খায়। তাই-ই ও হাট থেকে এনেছিল। কিন্তু তাড়াতাড়িতে নিয়ে যেতে ভুলে গেছে। খাবে? এনে দেব?
ঠুঠা বাইগা আবারও মাথা নাড়ল।
আচ্ছা লোক তো!
মনে মনে বলল, কুর্চি।