আসল নকল
পরমেশবাবুর মুখে নিজের সমস্ত জন্মবৃত্তান্ত শুনে পানু। কিন্তু পাথরের মত স্তব্ধ হয়ে রইল।
রামা সেই ঘরেই জানালার একটা শিক ধরে নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
—আজ তার চোখের জলও বুঝি শুকিয়ে গেছে। নিঃশব্দ পদসঞ্চারে পানু। মার কাছে উঠে এল।
দুই হাতে মাকে জড়িয়ে ধরে শুধু বললে, না মা, জন্ম থেকে মার কোন পরিচয় পাইনি এবং শিশু বয়সে যে পালিতা মার সামান্য কয়দিনের জন্য ভােলাবাসা পেয়েছিলাম, সেও একদিন অক্লেশে আমায় ভুলে গেল। তাই আজ বুঝতে পারছি কেন সে আমায় ভুলে গিয়েছিল… সে আমার নিজের মা নয় বলেই। জ্ঞান হবার পর জীবনে সত্যিকারের মাতৃস্নেহ তোমার কাছে থেকেই পেয়েছি। তুমিই আমার সত্যিকারের মা। তোমায় ছেড়ে কোথাও যাব না মা। তার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই–
কিন্তু পানু-তারা যে তোর আপনজন—
না। কেউ নয়। তারা আমার। কেউ আজ আমাকে তোমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না।
রুমার দু’চোখের কোল বেয়ে ফোটা ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল।
নীরবে গভীর স্নেহে রমা পানুর মাথায় হাত বুলোতে লাগল।
পরমেশবাবুরও চোখে জল।
দুতিন দিন ধরে ক্রমাগত পরমেশবাবু পানুকে সমস্ত ব্যাপারটা বোঝাতে লাগলেন। এবং আরো বললেন বিবেচনার যে আরো একটা দিক আছে। আইন। সেটাকে যে সকলেরই মেনে চলতে হবে। অগত্যা পানুকেও মত দিতে হলো।
অশ্রু সজল চোখেরমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পানু একদিন পরমেশবাবুর সঙ্গে কিরীটীদের ওখানে এসে উঠল।
শশাঙ্কবাবুকে আসবার জন্য কিরীটী আগে থেকেই ফোন করে রেখেছিল।
শশাঙ্কবাবু এলে কবচসহ আসল ছেলেকে কিরীটী তার হাতে তুলে দিল।
কবচটি পানুর হাতে বাঁধা ছিল-রূপার চ্যাপটা কবচ। কবচের ভিতরেই ছোট্ট একটা কাগজে লেখা ছিল–সুধীর শ্ৰীপুরের জমিদার শশাঙ্কমোহন চৌধুরীর ছেলে।
শশাঙ্কমোহন ছেলেকে বুকে টেনে নেন।
তারপর পুত্রসহ শশাঙ্ক চৌধুরী শ্ৰীপুর ফিরে এলেন।
শ্ৰীপুর জমিদার গৃহে হুলস্থূল পড়ে গেল।
আত্মীয়স্বজন, দাসদাসী, গোমস্ত কর্মচারী সকলেই ফিসফিস করে কােনাকনি করতে লাগল। এই সেদিন একজনকে এনে বললে, জমিদারের মেয়ে হয়নি। ছেলে হয়েছিল। ঐ তার ছেলে। আজ আবার বলছে সে ছেলেও নকল। আসল ছেলে এই।
শ্ৰীলেখাও চমৎকৃত হল।
মৃগাঙ্গমোহন ক্রুর হাসি হেসে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন।
আর আগেকার সুধীর।
স্তব্ধ হয়ে পানু একটা ঘরে বসে তার আকস্মিক ভাগ্য বিপর্যয়ের কথাই ভাবছিল।
আসন্ন সাঁঝের আঁধারে ধরণীর বুকখানি আবছা হয়ে আসছে।
ঐ বাড়ির সকলেই যেন তাকে সন্দেহের চোখে দেখছে, একমাত্র শশাঙ্ক চৌধুরী ও বিভাবতী ছাড়া।
নিঃশব্দে পানুরই সমবয়সী ফিট্ফটু একটি ছেলে ঘরে এসে ঢুকল।
পানু চমকে মুখ তুলে তাকাল, কে?
আমি এক নম্বর সুধীর। একটা চাপা হাসির শব্দ শোনা গেল। তারপর যাদু, কোন গগন থেকে নেমে এলে মাণিক। দুই নম্বর–
বলতে বলতে ছেলেটি হাত বাড়িয়ে সুইচটা টিপে ঘরের আলোটা জেলে দিল। মুহুর্তে ঘরের আবছা অন্ধকার সরে গিয়ে আলোর ঝরণায় ঘরটি হেসে উঠল।
কিহে চুপ করে আছ কেন? ছেলেটি আবার প্রশ্ন করলে, বল না সোনার চাঁদ। তা’ দেখ বাপু। এসেছে বেশ করেছে। কিছু নিয়ে রাতারাতি সরে পড়। না হলে প্ৰাণ নিয়ে কিন্তু টানাটানি হবে। শোন বলি-ফটিকচাঁদ সব সহ্য করতে পারে, শুধু ভাগের বিখরা সহ্য করতে পারে না।
পানু ফ্যাল ফ্যাল করে ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। এখানে আসবার আগে ওর নাম ভাঁড়িয়ে আর একটি ছেলে যে এখানে এসেছে তাও আগেই শুনেছিল, তাহলে এই সে।
কিহে, চুপ করে রইলে কেন? জবাব দাও। অসহিষ্ণু ভাবে ফটিকচাঁদ বললে।
বাইরে শশাঙ্কমোহনের চটির শব্দ শোনা গেল।
ফটিকচান্দ পালাবার চেষ্টা করলে কিন্তু পারলে না। থমকে শশাঙ্ক মোহনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেল।
দেখ তোমার নাম কি বলত? শশাঙ্কমোহন প্রশ্ন করলেন।
আজ্ঞে সুধীর চৌধুরী, ভয়ে ভয়ে ফটিকচাঁদ জবাব দিল।
থাম ছোকরা। শশাঙ্কমোহন বিরাট এক ধমক দিয়ে উঠলেন, আমি তোমার আসল নাম জানতে চাইছি।
আজ্ঞে ওটাই তো আসল নাম। মানুষের নামের আসল নকল থাকে নাকি?
বাঃ? এর মধ্যেই যে বেশ পরিপক্ক হয়ে উঠেছে দেখছি।
আজ্ঞে–
যাক-শোন, তোমার কোন ক্ষতি আমি করতে চাই না। শুধু যারা তোমাকে এখানে সুধীর সাজিয়ে এনেছিল তাদের সত্যকার নামধামটা জানতে চাই–
আমি জানিনা কিছু–
জান-আর এখানে ভালয় ভালয় সব কথা না বললে থানায় গিয়ে সবই বলতে হবে জেনো—
থানা?
ফটিকচাঁদের চোখ গোল গোল হয়ে ওঠে।
তা থানা ছাড়া কোথায় তুমি যাবে। জোচুরী করে মিথ্যা পরিচয়–
আজ্ঞে-দোহাই আপনার আমাকে পুলিশে দেবেন না-সব কথা আমি বলব।
বেশ চলে। তবে আমার ঘরে।
ফটিকচাঁদকে নিয়ে শশাঙ্কমোহন ঘরে থেকে বের হয়ে গেলেন।