বোতাম
মৃগাঙ্কমোহন বলে, করালীচরণ যে ঠিক খুন হয়েছে, তা আমার মনে হয় না। মিঃ রায়। কেউ তাকে হত্যা করেনি, সে নিজেই আত্মহত্যা করেছে। দারোগীবাবুর মত অবিশ্যি তা নয়।
আমাকে ব্যাপারটা আগাগোড়া বলুন মৃগাঙ্কবাবু।
মৃগাঙ্কমোহন আবার বলতে শুরু করে, দাদার শরীরটা আজ কিছুদিন থেকে খারাপ যাচ্ছিল। তাই তিনি ও বৌদি শিলং বেড়াতে গেছেন। এই সময় এই বিপদ।। দাদাকে টেলিগ্ৰাম করেছি, হয়ত আজ কালই তিনি এসে পৌঁছবেন। করালী আজ আমাদের বাড়ীতে প্ৰায় কুড়ি বছরেরও উপর আছে-যেমন বিশ্বাসী তেমনি অত্যন্ত নিরীহ প্রকৃতির। তার মত লোকের যে এ সংসারে শত্রু থাকতে পারে এইটাই আশ্চর্য।
কান্নায় মৃগাঙ্কমোহনের স্বর বুঁজে এল।
কিন্তু আপনি যে বলছেন আত্মহত্যা করেছে সে, তাই বা কেন বলছেন? কিরীটী প্রশ্ন করে এবার।
তা ছাড়া আর কি হতে পারে বলুন। হাতে ভেজালী ছিল ধরা।
সেটা এমন কিছু একটা বড় কথা নয়।
কিন্তু আত্মহত্যারও তো একটা কারণ থাকা দরকার। সেরকম কিছু–
না। সে রকম কিছু অবিশ্যি আমি দেখতে পাচ্ছি না—
তবে?
তবে একটা কথা আছে মিঃ রায়।
কি বলুন?
ইদানীং মাস দুই ওকে যেন কেমন বিষন্ন, চিন্তিত মনে হতো।
কারণ কিছু কখন জিজ্ঞাসা করেছেন?
করেছিলাম—
কি জবাব দিয়েছিল?
কিছুই বলেনি। আমাকেও না দাদাকেও না। দাদা ওকে সঙ্গে করে শিলং নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, তাও ও গেল না।
হুঁ। আচ্ছা চলুন-মৃতদেহটা একেবার দেখে আসা যাক।
চলুন।
সকলে তখন মালির ঘরে পাশে ছোট ঘরটায় যার মধ্যে মৃতদেহ পুলিশ প্রহরায় রাখা ছিল সেখানে এসে দাঁড়াল।
ওরা আসতেই প্রহরী সরে দাঁড়ায়, ওরা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে।
ছোট একটা ঘর।
করালীর মৃতদেহটা মেঝের ওপরে একটা চাদর ঢাকা ছিল। চাদরটা তুলে নেওয়া হলো কিরীটীর নির্দেশে।
ষাটের কাছাকাছিই প্রায় বয়স বলে মনে হয়। মাথার চুল পাতলা এবং সবই প্ৰায় পেকে সাদা হয়ে গিয়েছে।
দুটো চোখ খোলা এবং সে দৃষ্টি স্থির হয়ে থাকলেও মনে হয় তার মধ্যে একটা ভীতি রয়েছে যেন।
ভয়ে বিস্ফারিত।
চিৎ করে শোয়ান ছিল মৃতদেহ-কিরীটীর নির্দেশেই আবার দেহটা উপুড় করে দেওয়া হলো ক্ষত চিহ্নটা পরীক্ষা করে দেখবার জন্য।
ঘাড়ের ডান দিকে কানের তল ঘেঁষে আড়াই ইঞ্চি পরিমাণ একটা গভীর ক্ষত চিহ্ন।
ক্ষত চিহ্নের দুপাশে কালো রক্ত শুকিয়ে আছে। নীচু হয়ে মৃতদেহ পরীক্ষা করতে করতে হঠাৎ মৃতের মুষ্টিবদ্ধ ডান হাতটার প্রতি নজর পড়ল কিরীটীর।
মুঠিটা পরীক্ষা করতে গিয়ে ভাল করে দেখা গেল তার ভিতর কি একটা বস্তু যেন চক চক করছে।
কিরীটী তারপরও আরো কিছুক্ষণ মৃতদেহটা পরীক্ষা করে উঠে দাঁড়াল এবং বলল, চলুন, যে ঘরে ওকে মৃত পাওয়া গিয়েছিল সেই ঘরে চলুন।
অতঃপর সকলে ভৃত্যদের মহলে যে ঘরে করালীচরণ থাকত ও যে ঘরে তাকে নিহত অবস্থায় গতকাল প্ৰত্যুষে পাওয়া গিয়েছিল সেই ঘরে সকলে এসে প্রবেশ করল—ঘরের দরজায় তালা দেওয়া ছিল, সেই তালা খুলে।
ঘরের মেঝেতে প্রথম দৃষ্টি পড়ে কিরীটীর। ছোট একটা তক্তপোশের সামনে মেঝেতে তখনও চাপ চাপ রক্ত কালো হয়ে শুকিয়ে আছে।
দারোগা সাহেব স্থানটা দেখিয়ে বলেন, ঐখানে করালীচরণকে মৃত পড়ে থাকতে দেখা যায় মিঃ রায়–
কিরীটী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার ঘরটার চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিল। ছোট্ট অল্প পরিসর একখানি ঘর। ঘরের মধ্যে মেটমাট দুটি জানালা। জানালার মধ্যে একটা ভিতর থেকে বন্ধ। অন্যটার একটা পাল্লা খোলা–বাকীটা বন্ধ।
জিনিসপত্রের মধ্যে একটা পুরানো ট্রাঙ্ক ও একপাশে একটা বিছানা তক্তপোশের উপর গোটান অবস্থায় রয়েছে। কিরাট তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারিদিক দেখতে লাগল।
কিরীটী দারোগাবাবুর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, কোথায় ঠিক মৃতদেহ ছিল দারোগা সাহেব?
ঠিক যেখানে দেখছেন মেঝেতে এখনো রক্ত কালো হয়ে জমাট বেঁধে আছে ঐখানেই ছিল–
হুঁ-আচ্ছা ঠিক আছে-এক সেকেণ্ড আমি একটু বাইরে মানে ঐ যে জানালাটা ঘরের বন্ধ আছে সে জায়গাটা বাইরে গিয়ে দেখে আসি।
কথাটা বলে কিরীটী ঘর থেকে বের হয়ে গেল। কিন্তু যেখানে যাবে বলেছিল। সেখানে গেল না। গেল সোজা যে ঘরে মৃতদেহ রয়েছে সেই দিকে।
কনেস্টবলটা দরজার বাইরে তখনো দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে। কিরীটীকে ফিরতে দেখে বিস্মিত হয়ে ওর মুখের দিকে তাকাল।
কিরীটী মৃদু একটু হেসে বললে, জেরা মেহেরবাণী করকে কেয়ারী ঠো খোল দিজিয়ে সাব। হামারা একঠো চিজ ঘরকা অন্দরামে গির পড়া।
কনেস্টবল দরজাটা খুলে সরে দাঁড়াল।
কিরীটী ঘরের মধ্যে ঢুকে ক্ষিপ্ৰ হস্তে মৃতের মুষ্টিবদ্ধ হাতের মধ্য থেকে সেই একটু আগে দেখা রঙিন চকচকে বস্তুটি খুলে নিল।
সেটা একটা রঙিন কাঁচের সুদৃশ্য বোতাম।
তাড়াতাড়ি সেটা পকেটে ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। কিরীটীকে পুনরায় ঘরে এসে ঢুকতে দেখে দারোগা সাহেব শুধালো, কিছু দেখতে পেলেন?
হ্যাঁ।
কি? একটা কাঁচের বোতাম—
বোতাম! কথাটা বলে দারোগা সাহেব যেন বোকার মতই কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।
কিরীটী বলে, চলুন এবার, যা দেখবার দেখা হয়েছে, বাইরে যাওয়া যাক।
চলুন।
সকলে এসে বাইরের ঘরে জমায়েত হলো পুনরায়।
দারোগা সাহেবই এবার প্রশ্ন করে, সব তো দেখলেন, আপনার কি মনে হচ্ছে কিরীটীবাবু?
মনে হচ্ছে ব্যাপারটা হত্যাই–
হত্যা! মৃগাঙ্কমোহন কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।
হ্যাঁ–করালীচরণকে যতদূর মনে হচ্ছে আমার, হত্যাই করা হয়েছে মৃগাঙ্কবাবু। অর্থাৎ আপাততঃ আমার অনুমান তাই।
কিন্তু-মৃগাঙ্কমোহন কি যেন বলতে চায় কিন্তু দারোগা সাহেব বাধা–
বলে, না মৃগাঙ্কবাবু, এর মধ্যে আর কোন কিন্তু নেই। কারালীচরণকে কেউ হত্যাই করেছে। আমি তো আগেই আপনাকে বলেছিলাম।
মৃগাঙ্ক বলে, আপনারা বলছেন বটে, কিন্তু আমার এখানো বিশ্বাস হয় না-প্রথমতঃ, কে তাকে হত্যা করবে-আর কেনই বা করবে।–দ্বিতীয়তঃ, তার হাতের মধ্যে ভেজালী যে ধরা ছিল সে ব্যাপারটা আপনারা কেউ ভাবছেন না কেন?
কে বললে ভাবছি না-কিরীটী বলে, কিন্তু ক্ষত চিহ্ন দেখে কেউ বলবে না ঐ ভাবে কেউ নিজের গলায় ভেজালী বসাতে পারে। absurd–অসম্ভব।
কিন্তু—
না-মৃগাঙ্কবাবু, করালীচরণ আত্মহত্যা করেনি—তাকে কেউ নিষ্ঠুরভাবে হত্যাই করেছে।
দারোগা সাহেব মাথা দুলিয়ে নিঃশব্দে যেন কিরীটীকে সায় দেয়।
আরো কিছুক্ষণ পরে।
দারোগা সাহেব মৃতদেহ ময়না তদন্ত করবার ব্যবস্থা করে ফিরে গিয়েছেন।
ঘরের মধ্যে মৃগাঙ্কমোহন, সুব্রত ও কিরীটী।
কিরীটী বলে, বেলা সাড়ে তিনটার স্টীমারেই আমি ফিরে যেতে চাই মৃগাঙ্কবাবু।
চলে যাবেন?
হ্যাঁ।
কিন্তু যে জন্য আপনাকে ডেকে এনেছিলাম। সে সম্পর্কে কোন কথাই তো আমাদের হলো না মিঃ রায়।
একটা কথা মৃগাঙ্কবাবু, সত্যি সত্যিই করালীচরণ আত্মহত্যা করেনি–তাকে হত্যা করা হয়েছে জেনেও ব্যাপারটির একটা নিস্পত্তি চান?
বাঃ! নিশ্চয়ই, সেই জন্যই তো আপনাকে ডাকা—
বেশ-তবে তাই হবে। দু-একদিনের মধ্যেই হয়। আবার আমি আসব না হয় কি করছি না করছি। খবর আপনি পাবেন।
আপনার পারিশ্রমিকের ব্যাপারটা–
সে একটা স্থির করা যাবে পরে—এখন ও নিয়ে মাথা ঘামাবেন না।
ফিরবার পথে স্টীমারে কিরীটী বোতামটা হাতের উপর নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল।
সুব্রত হঠাৎ প্রশ্ন করল, তখন কি যেন বলছিলি-বোতাম না কি?
কিরীটী মৃদুকণ্ঠে বলল, হ্যাঁ একটা জামার বোতাম।–এই বোতামটার কথাই বলছিলাম—
কোথায় পেলি?
জানালার বাইরে কুড়িয়ে। বোতামটি বেশ, না সুব্রত?
সত্যই বোতামটা দেখতে ভারী সুন্দর। রঙিন কাঁচের বোতামটা, একদিকে গোল ডিম্বাকৃতি। অন্যদিক চ্যাপ্টা।
সাদা বোতামটার গা থেকে একটা ঈষৎ লালচে আভা ঠিকরে বেরুচ্ছে।
কি ভাবছিস বলত? সুব্ৰত জিজ্ঞাসা করল।
কই? কিছুনা।
মৃদু হেসে কিরীটী বোতামটা জামার পকেটে রেখে দিল।
অপরাহ্নের স্নান আলোয় চারিদিক কেমন যেন বিষণ্ণ মনে হয়।
আকাশে আবার মেঘ করছে।