মৃতদেহ
দারোগাবাবু ও যেন অতঃপর কেমন সব গোলমাল হয়ে যায়।
কিছুক্ষণ চিন্তা করে তিনি বললেন, চলুন না সুব্রতবাবু–আমার সঙ্গে একটিবার সেই শালবনে; কোথায় আপনি মৃতদেহ দেখে এসেছিলেন, exact locationটা দেখাবেন।
নিশ্চয়ই, চলুন।–
সকলে নদী পার হয়ে শালবনের দিকে এগিয়ে চলল।
প্ৰভাতের সোনালী রোদ শালবনের গাছের পাতার ফাঁকে ইতস্ততঃ উঁকি দিচ্ছে।
শীতের প্রভাতের ঝিরঝিরে হাওয়া শালবনের গাছে সবুজ কচিপাতাগুলিকে মৃদু মৃদু শিহরণ দিয়ে বহে যায়।
সকলে এসে শালবনের মধ্যে প্ৰবেশ করল।
কোথায় দেখেছিলেন কাল রাত্রে সেই মৃতদেহ সুব্রতবাবু? দারোগাবাবু প্রশ্ন করলেন।
ওই শালবনের দক্ষিণ দিকে।
গতরাত্রের সেই জায়গায় সকলে সুব্রতর নির্দেশ মত এসে দাঁড়াল।
আশেপাশে কয়েকটা বড় বড় শালগাছ ছোট একটা জায়গাকে যেন আরো ছায়াচ্ছন্ন ও নির্জনতার করে ঘিরে রেখেছে।
এই সেই জায়গা দারোগাবাবু, সুব্রত বললে।
সেই জায়গার মাটিতে তখনও রক্তের দাগ জমাট বেঁধে শুকিয়ে আছে দেখা গেল।
সুব্রত সেই জমাটবাঁধা রক্তের দাগগুলোর দিকে অঙ্গুলি তুলে বলল, এই দেখুন দারোগাসাহেব, আমি যে গত রাত্রে স্বপ্ন দেখিনি বা আমার চোখের দৃষ্টিবিভ্রম ঘটেনি। তার প্রমাণ। এই মাটির বুকে এখনও রক্তের দাগ রয়েছে।
সকলে তখন এক এক করে রক্তের দাগগুলো পরীক্ষণ করে দেখল এবং সুব্রতর কথা যে মিথ্যা নয়। এরপর সেটাই সকলে মেনে নিতে বাধ্য হলো।
তাই তো স্যার, এ যে তাজব ব্যাপার। দারোগাবাবু, বলতে লাগলেন; কিন্তু মৃতদেহটা। তবে কোথায় গেল?-
সুব্রত তখন চারিদিকে ইতস্তত অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে চেয়ে কী যেন দেখছিল, দারোগাবাবুর কথার কোন জবাবই দিল না।
এদিক ওদিক চেয়ে দেখতে দেখতে সহসা একসময় সুব্রতর চোখের দৃষ্টিটিা উজ্জ্বল হয়ে উঠল এবং সহসা সে চীৎকার করে বলে উঠলঃ ইউরেকা! ইউরেকা! সম্ভবতঃ আপনাদের লাস পাওয়া গেছে। দরোগা সাহেব। কিন্তু একটা শাবলের যে দরকার।
সুব্রতর উৎফুল্ল চীৎকারে সকলেই সুব্রতর দিকে ফিরে তাকাল।
ব্যাপার কী সুব্রতবাবু? শংকর বললে।
লাস পাওয়া গেছে শংকরবাবু? সুব্রত হাসতে হাসতে বললে।
লাস পাওয়া গেছে? আপনার মাথা খারাপ হলো নাকি সুব্রতবাবু? দারোগাবাবু বললেন।
দয়া করে একটা শাবল আনিয়ে দিন। আমি এখনই প্ৰমাণ করে দিচ্ছি।
তখনি বিমলবাবুকে খনিতে পাঠিয়ে দেওয়া হলো একটা শাবল নিয়ে আসবার জন্য।
অল্পক্ষণের মধ্যেই বিমলবাবু ছোট একটা মাটি খোঁড়া শাবল নিয়ে ফিরে এলেন। এই নিন স্যার শাবল।
সুব্রত বিমলবাবুর হাত থেকে শাবলটা নিয়ে একটা বড় শালগাছের গোড়া থেকে একটা ছোট শালগাছের চারা একটান দিয়ে অনায়াসেই শিকড় শুদ্ধ তুলে ফেলে দিয়ে ক্ষিপ্ৰ হস্তে মাটি খুঁড়তে লাগল। বেশি মাটি খুঁড়তে হলো না, খানিকটা মাটি উঠে আসবার পরই একটা মানুষের হাত দেখা গেল।
এই দেখুন দারোগাসাহেব, আমার কথা ঠিক কিনা?
এই দেখুন লাস।… সুব্রতর সমগ্র শরীর ও কণ্ঠস্বর প্রবল একটা উত্তেজনায় যেন কাঁপছে।
তারপর অল্প অনায়াসেই মাটি থেকে মৃতদেহ খুঁড়ে বের করা হলো। মৃতদেহ পরীক্ষা করে দেখা গেল, সুব্রত যা বলেছিল, ঠিক তাই। মৃতদেহের পাঁজরায় গুলির ক্ষতিও রয়েছে।
দারোগাবাবু এতক্ষণ একটি কথাও বলেন নি, যেন বোকা বনে গেছেন। এমন ব্যাপার যে একটা ঘটতে পারে এ যেন ইতিপূর্বে তাঁর ধারণার অতীত ছিল। তিনি একজন দারোগা। এক আধা বছর নয়, প্ৰায় দীর্ঘ এগার বছর এই লাইনে চুল পাকাচ্ছেন। অথচ এই সামান্য সম্ভাবনাটা তার মাথায় খেলে নি। খেলল। কিনা সামান্য একজন সখের গোয়েন্দার সহচরের মাথায়।
দারোগাবাবু একটু গম্ভীরই হয়ে গেলেন।
এবার বিশ্বাস হয়েছে তো স্যার আমার কথার পুরোপুরি? সুব্রত দারোগাবাবুর মুখের দিকে চেয়ে মৃদু হাসতে হাসতে প্রশ্ন করল।
এখনও আর না বিশ্বাস করে কেউ পারে নাকি সুব্রতবাবু? বললে শংকর। কিন্তু আপনার তীক্ষ্ণ বুদ্ধির প্রশংসা না করে আমি পারছি না। সুব্রতবাবু।
বুদ্ধির কিছু নয়-common sense শংকরবাবু; বুদ্ধি যদি বলেন সে আমার বন্ধু ও শিক্ষাগুরু কিরীটী রায়ের আছে, সুব্রত বললে। শেষের দিকে তার কণ্ঠস্বর শ্রদ্ধায় যেন রুদ্ধ হয়ে এল।
কিন্তু কেমন করে বুঝলেন বলুন তো সুব্রত বাবু, যে লাস এখানে লুকান আছে?
বললাম তো common sense। এই গাছটা লক্ষ্য করে দেখুন। গাছের পাতাগুলো যেন নেতিয়ে গেছে। এটাই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, বাকীটা আমার অনুমান-চারিদিকে চেয়ে দেখুন, চারা গাছ আরো দেখতে পাবেন, কিন্তু কোন গাছেরই পাতা এমন নেতান নয়। প্রথমেই আমার মনে হলো, ঐ গাছের পাতাগুলো অমন নেতিয়ে গেছে। কেন? তখনি গাছটার পাশে ভাল করে চাইতেই মাটির দিকে নজর পড়ল। একটু ভাল করে লক্ষ্য করে দেখলেই বোঝা যায় পাশের মাটিগুলো যেন কেমন আলগা। মনে হয় কে যেন চারপাশের মাটি খুঁড়ে আবার ঠিক করে রেখেছে। যেই এ কাজ করে থাকুন না কেন, লোকটার যথেষ্ট প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব আছে বলতেই হবে। মাটি খুঁড়ে মৃতদেহ পুঁতে এই গাছটি অন্য জায়গা থেকে উপড়ে এনে এখানে পুঁতে দিয়ে গেছে যাতে করে কারও নজরে না পড়ে এবং স্বাভাবিক বলে মনে হয়। কিন্তু গাছটি অন্য জায়গা থেকে উপড়ে আনার ফলে এক রাত্রেই নেতিয়ে উঠেছে আরো ভেবে দেখুন এক রাত্রের মধ্যে যেখানে গাড়ি, মোটর বা ট্রেনের তেমন কোনো ভাল বন্দোবস্ত নেই সেখানে একটা লাসকে সরিয়ে ফেলা কত কষ্টসাধ্য। তাছাড়া একটা মৃতদেহ অন্য জায়গায় সরােনও বিপদসংকুল ব্যাপার! একে তো সকলের নজর এড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে, তার উপর ধরা পড়বার খুবই সম্ভাবনা। অথচ মৃতদেহটা এভাবে ফেলে রাখাও চলে না-তাই সরােনই এক মাত্ৰ বুদ্ধিমানের কাজ এবং আসে পাশে কোথাও পুঁতে ফেলতে পারলে সব দিকই রক্ষণ হয় এবং ব্যাপারটাও সহজ সাধ্যকর হয়ে যায়।
যা হোক সকলে তখন লাসের একটা বন্দোবস্ত করে বাংলোর দিকে ফিরল। কারও মুখেই কোন কথা নাই। সকলে নির্বাকভাবে পথ অতিক্রম করছে।
সকলে এসে বাংলোয় প্ৰবেশ করল।
বিমলবাবু বাংলো পর্যন্ত আসেন নি, খনির দিকে চলে গেছেন মাঝপথ থেকে বিদায় নিয়ে। W
টেনে বসল। দারোগাবাবুই প্রথম কথা বললেন, সুব্রতবাবু। ময়না তদন্তের রিপোর্টগুলো পড়েছেন নাকি?
হ্যাঁ, কাল রাত্রেই পড়ে ফেলেছি। কি বুঝলেন? সামান্যই। তার থেকে কোন সিদ্ধান্তে উপস্থিত হওয়া চলে না। আচ্ছা দারোগাসাহেব, এই Case গুলোর Chemical examination এর report গুলো আপনার কাছে আছে কি?
না। তবে যদি বলেন তো চেষ্টা করে আনিয়ে দিতে পারি হেড়ু কোয়ার্টার থেকে; দরকার আছে নাকি?
হ্যাঁ, পেলে ভাল হতো। একটা কাজ করতে পারবেন দারোগাসাহেব?
বলুন।
একটু অপেক্ষা করুন। সুব্রত ঘরের মধ্যে চলে গেল এবং পরক্ষণেই কাগজে মোড়ান। গত রাত্রের সেই তীরটা হাতে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এল।
ব্যাপার কী? ওটা কী আপনার হাতে? দারোগাবাবু সুব্রতর হাতের কাগজে মোড়া তীরটার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে জিজ্ঞাসা করলেন।
কাগজের মোড়কটা খুলতে খুলতে সুব্রত বললে, এটা একটা তীর। এর ফলায় আমার মনে হয় কোন মারাত্মক রকমের বিষ মাখান আছে; দয়া করে এটা ধানবাদের কোন কেমিস্টের কাছ থেকে একটু একজামিন করে কি বিষ আছে জেনে আমায় জানাতে পারেন?
চেষ্টা করতে পারি, তবে কতদূর সফল হবো বলতে পারি না। তার চেয়ে কলকাতায় পাঠিয়ে দিই না কেন? এক হস্তার মধ্যেই Chemical Examination এর report পেয়ে যাবেন।
দেখুন যদি ধানবাদে সুবিধা না হয়, তবে কলকাতায়ই পাঠাবেন।
তখনকার মত চা ও জলখাবার খেয়ে দারোগাবাবু বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
শংকর খাদের দিকে রওনা হল। সুব্রত চেয়ারটার ওপরে গা এলিয়ে দিয়ে সমস্ত ঘটনাটা চিন্তা করতে লাগল।