ঝোড়ো হাওয়া
একদিন সুনীল পানুকে বলে, দেখা পানু, কত লোক কত কি পায়, আমি দৈবাৎ যদি হাজার দেড়েক টাকা পেয়ে যেতম কোন রকমে।
পানু হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করে, আজকাল কি তুমি দেশ ভ্রমণের কথা ভুলে গিয়ে টাকা পাওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। দাদা?
রামচন্দ্র। টাকার স্বপ্ন দেখবে সুনীল সেন? Never-অর্থাৎ কোন দিনও দেখেনি, দেখেও না। ভবিষ্যতেও দেখবে না। কিন্তু কি করব বল? দাদুকে এত করে জানালাম, but he is deaf-একেবারে কলা। অথচ টাকার অভাবে একটা মোটর বাইক আমার কেনা হচ্ছে না।
এতক্ষণে পানুর কাছে ব্যাপারটা সহজ হয়ে আসে—
দুটো দিন অপেক্ষা কর না দাদা, দাদুর টাকা তো সব আমাদেরই হবে। আজকাল পানুও যেন একটু একটু করে সুনীলের দলে ভিড়তে শুরু করে দিয়েছে।
হবে? অর্থাৎ হতেও পারে না হতেও পারে? এদিকে সময় যে ফুরিয়ে যাচ্ছে। এ তুই দেখে নিস পানু, সুযোগ যদি একটা মিলে যায়। তবে হেলায় হারাচ্ছি না। সত্যি আর এমনি করে জীবনটাকে অতি যত্নে মুঠোর মধ্যে নিয়ে ঘরের কোনে চুপটি করে শান্ত শিষ্ট হয়ে বসে থাকতে পারছি না।
“দূর হতে শুনি যেন মহাসাগরের গান,
ডাকে যেন-ডাকে যেন সিন্ধু মোরে ডাকে যেন?”
রবি ঠাকুরের সেই কবিতাটা মনে নেই? ঐ যে,
“শিখর হইতে শিখরে ছুটিব
ভূধর হইতে ভূধরে লুটিব
হেসে খল খল গেয়ে কল কল
তালে তালে দিব তালি?
তটিনী হইয়া যাইব বহিয়া,
নব নব দেশে বারতা লইয়া,
হৃদয়ের কথা কহিয়া কহিয়া
গাহিয়া গাহিয়া গান।”
দাদার কথার সুরে সুরে পানুরও সমস্ত হৃদয় অশান্ত হয়ে ছুটে যেতে চায়।
দুর্মদ চলার বেগ, যেন তার দেহের রক্ত বিন্দুতে বিন্দুতে গভীর উল্লাসের উদামতায় ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
সুনীল যেন ঝড়ো হাওয়া।
হু হু শব্দে চারিদিক ওলট পালট করে বয়ে যায়। অফুরন্ত প্ৰাণ যেন তার সমগ্ৰ দেহ বয়ে উপচে পড়ে।
কী উল্লাস, কী উদ্দামতা।
হঠাৎ সেদিন সুনীল কোন এক বন্ধুর মোটর বাইকটা চেয়ে নিয়ে এসে হাজির।
পানু খেয়ে দেয়ে কাপড় জমা পরে কলেজে বেরুবার জন্য প্ৰস্তুত হচ্ছে, দমকা হাওয়ার মতই সুনীল এসে ঘরে ঢুকল।
পানু, পানু।
দাদা?
বেড়াতে যাবি তো শীগগির আয়, দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি।
বেড়াতে, এখন? পানু আশ্চর্য হয়ে সুনীলের মুখের দিকে তাকায়।
হাঁ বেড়াতে।
কোথায়?
কোথায়? তা তো জানিনা, যেদিকে দু’চোখ যায়। চলতো বেরিয়ে পড়া যাক।
পানুকে একপ্রকার টানতে টানতেই সুনীল মোটর বাইকে এনে তুলে গাড়ি স্টার্ট দিল।
হু হু শব্দে গ্রাণ্ডট্রাঙ্ক রোড ধরে মোটর বাইক সুনীলের ছুটে চলেছে। দু’পাশের গাছ থেকে খসে পড়া শুকনো পাতাগুলি গাড়ির গতিবেগের সঙ্গে সঙ্গে ছুটে ছুটে আবার পিছিয়ে পড়ে।
কোথায় আমরা চলেছি দাদা? পানু জিজ্ঞাসা করল।
গাড়ীর স্পিডোমিটারের সরু নিড়লটা ৪০।৫০ এর ঘরে ওঠা নামা করছে। সেই দিকে চেয়ে সুনীল বলে, আপাততঃ এই ট্র্যাঙ্ক রোড ধরে, যতক্ষণ না পেট্রোল ফুরায়। অফুরন্ত চলার বেগে আমি আজ ছুটবো।
“হৃদয়ে আমার নাচেরে আজিকে
ময়ুরের মতো নাচেরে।
হৃদয়ে নাচেরে”
কালো কুচকুচে পীচ-ঢালা রাস্তা কখনো সোজা বরাবর কখনো এঁকেবেঁকে কোথায় কোন অজানায় আপনাকে হারিয়ে ফেলেছে। আপন মনে সুনীল ড্রাইভ করে চলেছে।
মাঝে মাঝে দু একটা মালবাহী গরুর গাড়ি কিম্বা লরী বা মোটর পাশ কাটিয়ে যায়। দু একটা পথিক পথের মাঝে হয়ত দেখা যায়।
কোথাও পথের দু’ পাশে অনুর্বর জমি, দু একটা গরু ঘুরে বেড়ায়।
সুনীলের মোটর বাইক ছুটে চলে ঝড়ের বেগে যেন।
দুপুরের দিকে ওরা এসে এক জায়গায় গাড়ি থামাল। একটা ছোট খাবারের দোকান। সামনেই একটা টলটলে দীঘি। কয়েকজন মেয়ে পুরুষ স্নান করছে।
গাড়ি থেকে নেমে সুনীল ও পানু পুকুরের ঠাণ্ডা জলে বেশ করে আগে হাত মুখ ধুয়ে নিল।
দোকান থেকে কিছু দই, মিষ্টি ও চিড়ে নিয়ে দুজনে খেতে বসে গেল।
আঃ কি তৃপ্তি!
ফিরবার পথে আকাশে মেঘ দেখা দিল।
হাওয়া বইতে শুরু হলো। হয়ত ঝড় উঠবে। তা উঠক।
দেখতে দেখতে প্ৰচণ্ড ঝড় জল শুরু হলো।
উঃ সেকি হাওয়া। মোটর বাইক ঠিকভাবে চালানোই কঠিন।
বৃষ্টির ছাঁট সর্বাঙ্গ সাপ সাপ করে ভিজিয়ে দিল।
মাঝে মাঝে মেঘের গর্জন, কড়-কড়-কড়ৎ-কানে তালা লাগার জোগাড়।
পথের দুপাশের গাছগুলো হাওয়ায় মড় মড় করে ওঠে। ক্রমে অন্ধকার হয়ে আসে।
সুনীল গাড়ির হেডলাইট জ্বলিয়ে দিল।
পানু বললে, গাড়ি থামিয়ে একটু কোথাও দাঁড়ালে হতো না দাদা?
সুনীল হাসতে হাসতে বলে, ভয় করছে বুঝি?
চোখের মণি দুটো জ্বল জ্বল করে জ্বলে। পানু বললে, ভয় আমার কোন দিনও নেই দাদা।
সুনীল বললে, That’s like a good boy.
“ওগো আজ তোরা যাসনে গো তোরা
যাসনে ঘরের বাহিরে।
আকাশ আঁধার বেলা বেশী আর নাহিরে।
ঝর ঝর ধারে ভিজিবে নিচোল,
ঘাটে যেতে পথ হয়েছে পিছল,
ওই বেনুবন দুলে ঘনঘন
পথ পাশে দেখি চাহিরে
ওগো অন্ধ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।”