হারিয়ে যাওয়া ছেলে
হরিঘোষ স্ত্রীটের একটা মেস বাড়ি।
সকাল সাতটা সাড়ে সাতটা হবে, মধ্যবয়সী একজন লোক সেদিনকার দৈনিকটা খুলে গভীর মনোযোগের সঙ্গে কী যেন পড়ছে। বিজ্ঞাপনের নিরুদ্দেশের পৃষ্ঠায় একটা বিজ্ঞাপন বের হয়েছে।
“হারিয়ে যাওয়া ছেলে। হারিয়ে যাওয়া ছেলে।”
ছেলেটিচুরি হয়ে গিয়েছিল, যেদিন সে জন্মায় সেইদিনই। তারপর ঘটনাচক্রে সে মানুষ হয় এক অনাথ আশ্রমে। এগার বছর যখন তার বয়স তখন সে নিরুদেশ হয়ে যায় আবার সেই অনাথ আশ্রম থেকে আশ্রমের নাম ‘হরমোহিনী আশ্রম”। ছেলেটি দেখতে ক’লো—দোহারা চেহারা—প্রকৃতি চঞ্চল-তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ধরে এবং ছেলেটির ডান ক্রর নীচে একটা জরুল আছে। যদি কেউ নিম্নলিখিত ঠিকানায় ছেলেটির সংবাদ দিতে পারে তবে সে বিশেষ পুরস্কার পাবে।
এস. রায়
নং আমহাস্ট স্ট্রীট,
কলিকাতা
রোগা লিকলিকে একজন লোক এসে ঘরে প্রবেশ করল।
লোকটার গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। একমাথা রুক্ষ চুল। ময়লা ধূতি পরিধানে, গায়ে একটা ময়লা তালি দেওয়া ডোরাকাটা সিস্কের সার্ট।
কিশোরী-রোগা লোকটি ডাকে।
উঁ।
বলি কি ব্যাপার?
উঁ।
বলছি হঠাৎ খবরের কাগজ এমন কি গোপন হীরার সন্ধান পেলি?
এতক্ষণে কিশোরী আগন্তুকের দিকে সংবাদপত্র থেকে মুখ তুলে তাকায়। কে? জগন্নাথ, আয়। আজকের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন বের হয়েছে দেখকিসের বিজ্ঞাপন?
একটী ছেলের?
ছেলের?
হ্যাঁ, হারানো ছেলের সন্ধান দিতে পারলে পুরস্কার।
কত দেবে?
তা-কিছু লেখেনি। তবে–
কি তবে–
ব্যাপারটা শাঁসালো মনে হচ্ছে।
কিসে বুঝলি?
বুঝেছি।
দেখি বিজ্ঞাপনটিা।
কিশোরী দৈনিকটা এগিয়ে দিল জগন্নাথের দিকে।
কই? কোথায়?–
এই যে। কিশোরী আঙ্গুল দিয়ে ছেলে হারানোর বিজ্ঞাপনটা দেখায় জগন্নাথাকে।
জগন্নাথ বিজ্ঞাপনটারি উপরে বুকে পড়ল।…
একটা বিড়ি ধরিয়ে কিশোরী ঘন ঘন টান দিতে লাগল পাশে বসে।
জগন্নাথ বিজ্ঞাপনটা আগাগোড়া পড়ে চোখ তুলল।
পড়লি?
হুঁ—আমার মনে হচ্ছে তোর অনুমানটা হয়ত মিথ্যে নয় কিশোরী–তাহলে?
বল কি করতে হবে?
শোন, আজই হরমোহিনী আশ্রমে গিয়ে একটা খোঁজ খবর নিতে হবে। আর এদিকে বাকী-কথাটা কিশোরী জগন্নাথের কানের কাছে মুখ নিয়ে চাপা গলায় বললে।
আনন্দে জগন্নাথের চোখের মণি দুটো অস্বাভাবিক এক উজ্জ্বলতায় ঝাক ঝক করে উঠল।
কিন্তু ভায়া একটা কথা আছে। জগন্নাথ বললে।
কী?
বুঝতে পারছে না?
না। কি বলতে চাস খুলে বল।
মানে, ঐ বিজ্ঞাপন হচ্ছে ফেউ, ওর পিছনে বাঘ আছে।
বাঘ।
হুঁ। বুঝতে পারছে না এখনো। ঠিকানাটা কোথাকার?
আমহাস্ট স্ট্রীট থেকে দেওয়া হয়েছে না?
তা হয়েছে–
নম্বরটা মনে হচ্ছে সুব্রত রায়ের বাড়ি।
বলিস কি?
তাই-অতএব ঐ বিজ্ঞাপনের পশ্চাতে নিৰ্ঘাৎ তিনি আছেন।
কে?
কে আবার। শ্ৰীল শ্ৰীকিরীটী রায়–
কোন কিরীটী?
রহস্যভেদী কিরীটী রায়। আবার কোন কিরীটী রায়–
তা হোক। যা জানাবার আছে তা আজই দুপুরে ঐ লোকটার কাছ থেকে সব জেনে আসবি।
দিন পাঁচেক পরে দুপুরের দিকে বাইরের রোদটা বেশ চড়চড়ে হয়ে উঠেছে।
অসহ্য গরমে বাইরের তপ্ত হওয়া গায়ে জ্বালা ধরায়। দরজা জানালা আটকে সুব্রত দ্বিপ্রহরে একটা সুখনিদ্রা দেবার চেষ্টা করছে, এমন সময় ভৃত্য এসে জানাল কে একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক ওর সঙ্গে একটা জরুরী কাজের জন্য একটিবার দেখা করতে চান।
ভদ্রলোককে বাইরের ঘরে বসা, আমি যাচ্ছি। সুব্রত বলে।
তৃত্য চলে গেল।
সুব্রত বাইরের ঘরে এসে দেখে একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক চুপচাপ একটা সোফা অধিকার করে দরজার দিকে উদগ্ৰীব হয়ে চেয়ে আছেন।
নমস্কার।
নমস্কার, সুব্রত একটা সোফা অধিকার করে বসল।
ভদ্রলোক জামার বুক পকেট থেকে সেদিনকার খবরের কাগজের কাটিংটা বের করলেন, এই বিজ্ঞাপনটা আপনিই দিয়েছেন? মানে আপনার নামই তো এস, রায়?
হ্যা, কিন্তু আপনি?
মানে, আমি বোধহয় আপনাদের সেই হারানো ছেলেটির খোঁজ দিতে পারব।–
আপনার নাম? কোথা থেকে আসছেন?
শ্ৰীীরঘুনাথ ঘোষাল। অবিশ্যি এখানেই এই শহরেই থাকি-মানে চেতলায়।
যে ছেলেটির কথা বলছেন সে ছেলেটি কোথায় আছে?
আমার কাছেই আছে।
আপনার কাছে।
হ্যাঁ–
তা এই যে সেই ছেলে তা আপনি বুঝলেন কি করে?
সে বলতে পারব না-তবে এই ছেলেটির ডান ভ্রূর নীচে একটা জরুল আছে আর–
আর?
আর ছেলেটি আমার কেউ নয়-বছর চারেক ধরে প্রতিপালন করছি মাত্র–
প্ৰতিপালন করছেন!
তাই-রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে দেখে আমি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে আমার বাড়িতে স্থান দিই। সেই থেকে আমার কাছেই আছে। এবং ছেলেটিকে দেখলে সহজেই বোঝা যায়। সাধারণ ঘরের ছেলে সে নয়-কোন ধনীর সন্তানই হবে। সুন্দর চেহারা–
ছেলেটিকে যখন আপনি পান। তখন তার বয়স কত হবে?
তা ধরুন দশ-এগার তো হবেই–
নাম কি বলেছিল!
সুধীর—
এখুনি আপনার ওখানে গেলে ছেলেটিকে কি একবার দেখা যেতে পারে!
কেন যাবে না-তবে একটা কথা আছে।
কি বলুন!
আপাততঃ সে কলকাতায় নেই–
কোথায় আছে?
ছেলেটি এখন মীরাটে আমার স্ত্রীর কাছে আছে।
কবে তাক এনে দেখাতে পারবেন। ছেলেটিকে
তা মনে করুন দিন দশেক তো লাগবেই।
বেশ-তবে সেই ব্যবস্থাই করুন।
আচ্ছা।
একটা কথা।
বলুন।
ছেলেটির কোন ফটো আপনাদের কাছে আছে?
সুব্ৰত ঘাড় নেড়ে বলে, না–
তবে! তবে ছেলেকে সনাক্ত করবেন কি করে?
সে ব্যবস্থা হবে–
কি করে?
হরমোহিনী আশ্রমে গেলেই সেখানকার হেড মাস্টার চিনতে পারবেন–
বেশ-তবে সেই কথাই রইলো। আমি তাহলে এখন উঠি।
আসুন।
ভদ্রলোককে বিদায় দিয়ে সুব্রত আর এক মুহুর্ত দেরি করে না। সঙ্গে সঙ্গে জামা কাপড় পরে টালীগঞ্জে কিরীটীর বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়ে।