অনাথ আশ্রম
আজ থেকে চার বছর আগেকার কথা।
টালীগঞ্জ গঙ্গার ধারে ‘হরমোহিনী অনাথ আশ্রম’। মা বাপ হারা আতুরের দল, যাদের এ দুনিয়ায় কেউ নেই তাদের জন্য এই আশ্রম।
চারপাশে দু’মানুষ উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা প্ৰকাণ্ড কম্পাউণ্ড। কম্পাউণ্ডের একদিকে হলঘর, অন্যদিকে ছাত্রাবাস ও মাস্টারদের থাকবার ঘর।
অনাথ আশ্রমের সুপারিনটেণ্ডেন্ট মিঃ কে, সিংহ। দেখতে তিনি যেমন কালো, মোটা তেমনি হাতীর মত। আসল নাম কুলদা সিংহ। হাতীর মত না। হলেও কান দুটো মিঃ সিংহের একটু বড়ই ছিল। দিদিমা আদর করে নাম দিয়েছিল, ‘কুলদা’।
শোনা যায় ছেলে বেলায় খেলার সাথীরা কুলদা নামের একটা চমৎকার ভাবার্থ বের করে একটি কবিতাও বানিয়েছিল।
কুলোর মত দুটো যার কান,
কুলদা তাহার নাম।
মিঃ সিংহ ছিলেন যেমন বদরাগী তেমনি সন্দেহ বান্তিকগ্ৰস্থ। কাউকেই তিনি ভাল চোখে দেখতে পারতেন না। সামান্য একটু দোষ ত্রুটি হলে আর রক্ষা ছিল না।
শাস্তির বহরটিও ছিল তার বিচিত্র।
আশ্রমের এক কোণে অন্ধকার ঘর বলে এক কুঠুরী ছিল। সেই কুঠুরীর একটি মাত্র দরজা, আর ছোট ছোট দুটি জানালা। তাও একমানুষ সমান উঁচুতে।
আশ্রমের ছেলেদের মধ্যে যদি কেউ কোন দোষ করত। তবে তাকে দশ ঘা বেত মেরে সেই দিন রাতে না খেতে দিয়ে সেই অন্ধকার ঘরে’ বন্ধ করে রাখা হতো।
অন্ধকার ঘর ছেলেদের কাছে ছিল একটা পরিপূর্ণ আতঙ্ক।
মিঃ সিংহ ছাড়া সেখানে থাকতেন আরো তিনজন মাস্টার, দুজন চাকর, একজন দারোয়ান ও একজন ঠাকুর।
ছাত্রদের সংখ্যা মোটমাট ত্রিশ থেকে পঁয়ত্ৰিশ।
তার মধ্যে পাঁচ ছয় থেকে পনের ষোল বছরের পর্যন্ত ছেলে ছিল। এ আশ্রমের নিয়ম ছিল, ম্যাট্রিক পর্যন্ত পাশ করিয়ে দিয়ে ছেলেদের একটা ব্যবস্থা করে দেওয়া হতো।
সুধীর এই আশ্রমেরই একজন ছেলে।
সুধীর এখন তো বেশ বড় হয়ে গিয়েছে।
এগার বছর বয়স তার। কিন্তু এখানে এসেছিল খুব ছোট যখন সে-মাত্র ছয় বছরের বালক।
মা তাকে এখানে রেখে গিয়েছিল একদিন ঘুমের মধ্যে। ঘুম ভেঙ্গে দেখে এই আশ্রমে ও রয়েছে।
ঘুম ভাঙ্গার পর কেঁদেছে-তারপর আরো কত কেঁদেছে।
কিন্তু মা আর আসেনি। মাকে আর ও দেখতে পায় নি।
সুধীরের গড়নটা ছিপছিপে। গায়ের রঙ কালো, বাঁশীর মত টিকেল নাক। স্বপ্নময় দুটি চোখ। দোহারা চেহারা।
তাহলে কি হবে? সুধীরের মত দুরন্ত ছেলে সমস্ত আশ্রমের মধ্যে আর নেই।
দৌড়, ঝাঁপ, সাঁতার, দুষ্টুমিতে সব বিষয়েই ও সকলকে ডিঙ্গিয়ে চলে, এমন কি, লেখাপড়াতেও কেউ ওর সঙ্গে পেরে ওঠে না।
অন্যান্য ছেলেরা ওকে ভয়ও যেমন করে, ভালবাসেও ঠিক তেমনি।
সুধীরের সব চাইতে গোঁড়া ভক্ত ‘ভিখু’।
ভিখু সুধীরের চাইতে বছর খানেকের হয়ত ছোট হবে।
ভিখু কিন্তু সুধীরের ঠিক বিপরীত।
চেহারার দিক দিয়ে গােটা গোট্টা বলিষ্ঠ চেহারা। খুব ফর্স গায়ের রং। কুতকুতে চোখ দুটি মেলে ফিক ফিক্ করে হাসে। এক পাটি মুক্তার মত দাঁত ঝক ঝক করে।
ছায়ার মতই ভিখু সুধীরের পিছন পিছন ঘোরে।
ভিখুর যখন বছর চারেক বয়েস, তখন ওকে কুম্ভ মেলায় এই আশ্রমের এক মাস্টার কুড়িয়ে পান।
ওর পরিচয় জিজ্ঞাসা করা হলেও ও শুধু কঁদতে কাঁদতে বলেছিল, ওর নাম ভিখু। ও আর কিছুই বলতে পারেনি।
মাস্টার এখানে এনে ওকে ভর্তি করে দিল।
সেই থেকে ও এইখানেই আছে।
গ্ৰীষ্মের বেলা দ্বিপ্রহর।
চারিদিকে রোদ ঝাঁ ঝাঁ করছে।
সিংহীর কড়া হুকুম, যে যার ঘরে বসে পড়াশুনা করবে।
আশ্রমের দুজন চাকরের মধ্যে শিবু সিংহীর অত্যন্ত প্রিয়পাত্র।
লোকটা জাতে উড়িয়া। একটা চোখ কানা। মাথায় তেল চপ চাপে লম্বা টেরী।
সিংহীর সে ছিল গুপ্তচর। আশ্রমের যেখানে যা ঘটে সব গিয়ে সিংহীর কাছে রাত্রে শোবার আগে বলে আসত।
সুধীর ওকে দু’চোখে দেখতে পারত না।
বলত–আমার বন্দুক থাকলে ওকে গুলি করে মারতাম। বেটা কানা শয়তান।
শিবুও কেন যেন ওকে দেখলেই পাশ কাটিয়ে পালাত।
আর সুধীরের নামে সিংহীর কাছে বিশেষ কিছু লাগাতও না।
সব চাইতে শান্ত-গো-বেচারা একটু মোটা বুদ্ধির ছেলে শ্যামল ঐ আশ্রমে।
শ্যামল বাংলা বইটা খুলে দুলে দুলে পড়ছিল।
“আমরা ঘুচাব মা তোর কালিমা,
মানুষ আমরা নাহি তো মেষ।”
ওপাশে বসে কানু, আশ্রমের আর একটি ছেলে রবারের গুলতি তৈরি করছিল। গভীর গলায় বলে উঠলো, মেষ নস, তুই একটা আস্ত গাধা।
ঘরের অন্যান্য ছেলেরা সব হো হো করে হেসে উঠল।
সুধীর বলতে লাগল, দেখ শ্যামল। এখন না হলেও মেষ হয়ত আমাদের শীগগির হতে হবে। দিনরাত পড়া আর পড়া। এই, তোরা এত বোকা কেন বলত। দিবারাত্ৰ গাঁ গা করে বই খুলে চেঁচালেই বুঝি একেবারে বিদ্যে ভুড়ীভূড়ী হওয়া যায়।
পড়ার সময় পড়বে শুধু, খেলার সময় খেলা
সকল সময় পড়লে জেনো বিদ্যা হবে কলা।
বুঝলে গোবৰ্দ্ধন?
গোবৰ্দ্ধন বসে বসে বইটা সামনে খুলে রেখে ঝিমুচ্ছিল। সুধীর তার মাথায় একটা ‘উড়ন চাঁটি’ দিয়ে কথাটা বললে।
গোবৰ্দ্ধন তাড়াতাড়ি চমকে উঠে আবার পড়া শুরু করে দিল।
ত-র-আর-রণী, তরণী, তরণী মানে নৌক।
যে নৌকায় চড়ে আমরা বর্ষাকালে যাতায়াত করি।
ত-র-আর-রণী—
সুধীর ওর সাথে কণ্ঠ মিলাল। তরণী মানে নৌকা। যে নৌকায় চড়ে তুমি গোবৰ্দ্ধন ঘোড়া আর গাধার মত কান যার সেই সিংহী ভব-নদীর পারে যাবে।
ঘরের মধ্যে আবার একটা হাসির ঢেউ জাগল।
গোবৰ্দ্ধন কিন্তু ততক্ষণে আবার ঢুলতে শুরু করেছে চোখ বুজে।
অদ্ভূত ক্ষমতা ওর এমনি করে বসে বসে ঘুমোবার।
সেই জন্যই তো, সুধীর ওর নামের পদবী বদল করে নতুন পদবী দিয়েছে ‘গোবৰ্দ্ধন ঘোড়া।’-
সুধীর এক সময় বলে,–চল সব আজ রাত্রে জেলেদের নৌক চুরি করে গঙ্গার ভিতর খানিকটা ঘুরে আসা যাক। যাবি?
সুধীরের কথায় সকলে আনন্দে লাফিয়ে উঠল।
গঙ্গার বুকে নৌক ভাসিয়ে ঘুরে বেড়াতে সুধীরের বড় ভাল লাগে। যতীন বললে, কিন্তু আশ্রম থেকে বের হবে কি করে? রাত্রে গেট বন্ধ করে দারোয়ান শুয়ে পড়ে।
তুই যেমনি মোটা তেমনি তোর বুদ্ধিটাও দিন দিন মোটাই হয়ে যাচ্ছে। এত করে বলি রোজ রাত্রে অতগুলো রুটি গিলিস না তা শুনাবি নাতো আমার কথা, খা, কত খাবি খা। এরপর নামটাও দেখবি হয়ত মনে করতে পারছিস না। সুধীর বললে।
তারপর যতীনের পিঠে একটা মৃদু চাপড় দিয়ে স্নেহকরুণ স্বরে বললে, আচ্ছা রাত্রে দেখবি কেমন ‘চিচিং ফাক’ তৈরী করে রেখেছি।
আশ্রমে থাকবার ব্যবস্থাটা ওদের ভালই।
ইংরাজী ‘E’ অক্ষরের মত বাড়িটা, মাঝখানে প্রশস্ত আঙ্গিনা।–তার ওদিকে সুপারিনটেনডেন্ট সিংহীর কোয়ার্টার।
তার পিছনে রান্না ঘর-খাবার ঘর ও চাকরীদের মহল।
বাড়িটার পূর্ব দিকে গঙ্গা, ছোট ছোট সব পাটিশন দেওয়া ঘর।
এক একটি ঘরে দুজন করে ছেলে থাকে। সুধীরের ঘরে থাকে সুধীর ও ভিখু।