পুরানো দিনের ইতিহাস
ষোল বছর আগেকার এক রাত্রি।
গভীর রাত্রি।
জমিদার শশাঙ্কমোহন তাঁর শোবার ঘরে অস্থির অশান্তপদে ইতস্ততঃ পায়চারি করে বেড়াচ্ছেন।
শশাঙ্কমোহনের দিকে তাকালেই বোঝা যায় যে, তিনি যেন আজ বড়ই চিন্তিত।
ছোট ভাই মৃগাঙ্ক এসে ঘরে প্রবেশ করল, দাদা?
মৃগাঙ্কের ডাকে শশাঙ্কমোহন মুখ তুলে ভাইয়ের দিকে তাকালেন।
বাড়ির ভিতরের খবর কি মৃগু?
এখনও কিছু হয়নি। তুমি এবারে শুয়ে পড়গে। দাইকে তো বলাই আছে যে ছেলে হওয়া মাত্রই শাঁখ বাজাবে।
কিন্তু আমার যে ঘুম আসছে না ভাই।
চিন্তা করে লাভই বা কি বল? রাত জগলে শরীর খারাপ হবে। আর আমি তো এদিকে আছিই। তুমি শুয়ে পড়গে। কথাগুলো বলে মৃগাঙ্ক ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
শশাঙ্কমোহন শ্ৰীপুরের জমিদার। তার জমিদারীর আয় বছরে প্রায় লাখ টাকা।
যদিও শশাঙ্কমোহনের খুল্লতাত ভাই ঐ মৃগাঙ্কমোহন—তবু সেটা বুঝবার উপায় নেই। ঠিক যেন সহোদর ভাই ওরা।
অত্যন্ত স্নেহ করেন শশাঙ্কমোহন মৃগাঙ্গমোহনকে। মৃগাঙ্কমোহনও দাদা বলতে অজ্ঞান।
বিবাহের পর আট বছর চলে গেল—
সবাই ভেবেছিল বিভাবতীর বুঝি কোন ছেলেপুলে হবেই না—
অনেকেই শশাঙ্কমোহনকে আবার বিবাহ করতে পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু শশাঙ্ক করো কথাতেই কান দেন নি।
তিনি হাসতে হাসতে বলেছেন, ভগবানের যা ইচ্ছা তাই হবে। সন্তান লাভ যদি আমার ভাগ্যে না থাকে। তবে একটা কেন দশটা বিবাহ করলেও আমার ছেলে হবে না।
তারপর দীর্ঘ আট বছর। বাপ অনঙ্গমোহনের মৃত্যুর দুই বছর পরে হঠাৎ একদিন শোনা গেল বিভাবতীর নাকি ছেলেপুলে হবে।
সমস্ত জমিদার বাটীতে আনন্দের স্রোত বইতে লাগল। দিবারাত্র অতিথি, কাঙ্গালী, আতুরের কলধ্বনিতে জমিদার বাটী গামগম করতে লাগল।
দেবালয়ে শঙ্খ-কাঁসির-ঘণ্টা বাজতে লাগল। পুজো—স্বস্ত্যয়ন—হোম—যাগ—যজ্ঞ।
তারপর একদিন এল সেই বহু আকাঙ্খিত দিনটি।
সেদিন আবার বাইরে কি দুৰ্যোগ।
কি ঝড়-কি বৃষ্টি।
বিভাবতী আঁতুড় ঘরে।
এখনো কোন সংবাদ পাওয়া যায়নি।
মৃগাঙ্ক স্বয়ং দাঁড়িয়ে সমস্ত খবরদারী করছে।
রাত্রি তৃতীয় প্রহর। বৃষ্টিটা তখন একটু কমেছে বটে। তবে আকাশ মেঘে মেঘে একেবারে কালো হয়ে আছে। থেকে থেকে সোনালী বিদ্যুতের ইশারা এবং সে সোঁ প্ৰবল হাওয়া। সহসা ঐ সময় শোনা গেল শঙ্খধ্বনি।
শশাঙ্কমোহনও ছুটলেন। অন্দর মহলের শেষ প্রান্তে আঁতুড়ঘর। আঁতুড় ঘরের দরজার গোড়াতেই বলতে গেলে প্ৰায় শশাঙ্কমোহনের মৃগাঙ্গর সঙ্গে দেখা হল।
কি হয়েছে মৃণ্ড-ছেলে না মেয়ে?—
মৃগাঙ্কর মুখখানা হাসি হাসি। সে বলে, ভেবেছিলাম ছেলেই হবে বৌদির কিন্তু–
কিন্তু কি—
মেয়ে হয়েছে–
থমকে যেন দাঁড়িয়ে পড়লেন শশাঙ্কমোহন। বিষণ্ণ স্বরে বল্লেন, মেয়ে?
হ্যাঁ–তাতে কি হয়েছে?
মেয়েই হলো–
ভগবান করুন। এখন ঐ বেঁচে থাক–
শশাঙ্কমোহন আঁতুড় ঘরের দিকে এগোচ্ছিলেন, কিন্তু মৃগাঙ্কমোহন বাধা দেয় না-দাদা। ওদিকে এখন যেওনা। লেডি ডাক্তার যেতে নিষেধ করেছে। ওদিকে এখন কাউকে-কারণ বৌদি এখনো অজ্ঞান হয়ে আছেন।
একটিবার দেখেই যদি চলে আসি মৃগু—
না-এখন যেও না–
কি আর করবেন শশাঙ্কমোহন।
লেডি ডাক্তার ওদিকে এখন কাউকে যেতে যখন নিষেধই করেছে! শশাঙ্কমোহন চিন্তিত মনে আপন শয়ন কক্ষের দিকে ফিরে গেলেন।
তারপর রাত্রি আরো গভীর হয়েছে।
একে দুর্যোগের রাত্রি, তাই আবার টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়েছে। মাঝে মাঝে হু হু করে জোলো হাওয়া গাছের পাতায় পাতায় শাখার শাখায় দোলা দিয়ে যেন শিপ্ শিপ্ করে ভুতুড়ে কান্না কাঁদছে।
কেউ কোথাও জেগে নেই।–
লেডি ডাক্তার চলে গেছে। বিভাবতী অঘোরে ঘুমিয়ে। ওষুধ দিয়ে তাকে ঘুম পাড়ান হয়েছে।
টুক টুক করে মৃগাঙ্কমোহনের ঘরের দরজায় টোকা পড়ল।
মৃগাঙ্কমোহন জেগেই ছিল, ঘর অন্ধকার-দরজা খুলে দিতেই একটি নারী মূর্তি ঘরে এসে ঢুকল।
কে! মৃগাঙ্ক চাপা গলায় শুধায়।
আমি–
শেষ করে দিয়েছ তো–
না–
সেকি?
হ্যাঁ–প্রয়োজন হয়নি, সত্যি সত্যি মেয়েই হয়েছে—
ঠিক আছে যাও–
নারী মূর্তি চলে গেল। যেমন নিঃশব্দে এসেছিল। তেমনি নিঃশব্দে।
আরো কিছুক্ষণ পরে আঁতুড় ঘরে।
বিভাবতী ঘুমের ঔষধের প্রভাবে তখনো অঘোর ঘুমে আচ্ছন্ন। ঘরের মধ্যে একটি মাত্ৰ মাটির প্রদীপ জ্বলছে–সেই প্ৰদীপের ক্ষীণ আলোয় ঘরের মধ্যে একটা আলোছায়া যেন লুকোচুরি খেলছে।
বাইরে দুর্যোগ তখনো থামেনি-প্রবল হাওয়ার সঙ্গে টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে।
টুক-টুক-টুক।
বদ্ধ দরজার গায়ে মৃদু সতর্ক টোকা পড়ল। ঠিক তিনবার।
দাই মঙ্গলা পা টিপে টিপে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল। অন্ধকার ছায়ার মত যেন কে একজন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে।
মঙ্গলা—এসেছি-ছায়ামূর্তি চাপা কণ্ঠে যেন ফিস ফিস করে বলে।
দাঁড়াও আমি আসছি–
মঙ্গলা আবার আঁতুড় ঘরে ঢুকে গেল এবং একটু পরে একটি নবজাত শিশুকে বুকে জড়িয়ে বের হয়ে এল–
তারপর ফিস ফিস করে চাপা কণ্ঠে দুজনার মধ্যে কি কয়েকটা কথা হলো।
আগস্তুক যেমন এসেছিল। তেমনি অন্ধকারে মিলিয়ে গেল নবজাত শিশুটিকে বুকের মধ্যে নিয়ে।
মঙ্গলা আঁতুড় ঘরে ঢুকে আবার দরজায় খিল তুলে দিল। এবার সে যেন নিশ্চিন্ত।
বিভাবতীর একটি কন্যা হয়েছে সকলে জানল।
নবজাত শিশুর কল্যাণে দান ধ্যান-যাগ যজ্ঞ কত কি হলো। কত মিষ্টান্ন জনে জনে বিতরণ করা হলো।
সব ব্যাপারে বেশী উৎসাহী যেন মৃগাঙ্কমোহনই।
দিন যায়-মাস যায়-বছর ঘুরে আসে।
মৃগাঙ্কমোহনই শিশুর নামকরণ করল-শ্ৰীলেখা। ক্ৰ
মে মেয়ে আরো বড় হয়—লেখা পড়া শুরু করে—
মৃগাঙ্কমোহনের বড় আদরের ভ্রাতুষ্পুত্রী।
চৌধুরী বংশের দুলালী–আদরিণী—শ্ৰীলেখা।