রাত নিঝুম - ১
রাত নিঝুম - ২

১৭. পথহারা

পথহারা

রাতের আঁধারে পায়ে চলা পথটা যেন প্ৰকাণ্ড একটা ঘুমন্ত অজগরের মত নিঃসাড়া হয়ে পড়ে আছে।

পথের দুধারের বাড়িগুলো ঘুমের কাঠির ছোঁয়া পেয়ে যেন একেবারে নিশ্চল নিঝুম হয়ে পড়েছে।

কেউ কোথাও জেগে নেই।

একাকী শুধু যেন এ জগতে এক সুধীরই জেগে পথ হেঁটে চলেছে। আর মাথার উপরে কালো আকাশে রাতজাগা তারার দল এই গৃহহারা একাকী নিঃশব্দে চলমান বালকটির দিকে নীরবে তাকিয়ে আছে।

মাঝে মাঝে রাতের হাওয়া চুপিচুপি পথের বাঁকে বাঁকে কী কথা বলে যায়?

পথের ধারে একটা কুকুর গুটি শুটি দিয়ে বুঝি ঘুমিয়েছিল। সুধীরের পায়ের সাড়া পেয়ে একবার মুখ তুলে তাকিয়ে আবার পেটের মধ্যে মুখটা গুঁজে ঘুমিয়ে পড়ল।

সুধীর এগিয়েই চলে।

রাস্তার ধারে কয়েকটা রাত জাগা ভিখারী গুণ গুণ করে গল্প করছে।

সুধীর তাদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলল….।

রাত বাড়তে থাকে…।

হাঁটতে হাঁটতে সে রসা রোড, চৌরঙ্গী, হ্যারিসন রোড প্রভৃতি পার হয়ে একসময় হাওড়ার পুলের উপর এসে দাঁড়াল।

রাত্ৰি বুঝি শেষ হয়ে এল। আকাশের রং ফিকে হয়ে আসে।

পুলের নীচে গঙ্গার গৈরিক জলরাশি একটানা বয়ে চলে। নৌকা ও স্টীমারের দুএকটা আলো জলের বুকে থির থির করে কঁপে। মাঝে মাঝে দুএকটা জাহাজ বা স্টীমার চারিদিক প্রকম্পিত করে সিটি দিয়ে ওঠে ভোঁ ও ও! দুএকটা স্টীমলঞ্চ জলের বুকে শব্দ জাগিয়ে ছুটে যায়।

অনেকটা হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত–ক্রমে ওর চোখের পাতা দুটো যেন বুঁজে আসতে চায়।

পা দুটো আর টানতে পারে না-অবশেষে রাস্তারই ধারে একটা গাছের নীচে পুটলিটি মাথার তলায় দিয়ে সুধীর সেইখানেই শুয়ে পড়ল এবং অল্পক্ষণের মধ্যেই ঘুমে চোখ দুটো তার বুজে এলো।

পরের দিন যখন সুধীরের ঘুম ভাঙ্গল বেলা তখন অনেক হবে। রৌদ্রালোকিত শহর কর্মের সাড়ায় চঞ্চল।

লোকজন, গাড়ি, ঘোড়া, রিক্সা, বাস এক বিরাট ব্যাপার।

সমস্ত শরীরে ব্যথা। অসহ্য ক্লান্তি।

সুধীর অনেকক্ষণ ধরে বসে বসে তাকিয়ে তাকিয়ে আশে পাশে শূন্য দৃষ্টিতে দেখতে লাগল। তারপর উঠে মুখ হাত ধোয়ার জন্য গঙ্গার ঘাটের দিকে চলল।

পা যেন আর চলতে চায় না।

ক্ষিধেও পেয়েছে প্ৰচণ্ড, ক্ষিধেতে পেটের মধ্যে যেন পাক দিচ্ছে।

সঙ্গে একটি পাই পয়সাও নেই।

শূন্য পকেট একেবারে।

তবু উঠে দাঁড়াল সুধীর।

আবার হাঁটতে শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতে বেলা আটটা নাগাদ বালীতে এসে পৌঁছাল।।

পিপাসায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। গঙ্গার ঘাটের দিকে এগিয়ে চলে সুধীর।

ঘাটে স্নানার্থীদের ভিড়।

ধীরে ধীরে জলে নেমে হাত মুখ ধুয়ে আঁজলা করে এক পেট জল খেল।

শরীরটা অনেকটা জুড়াল। একটু বিশ্রাম করে গঙ্গার ঘাটে আবার হাঁটতে শুরু করে সুধীর গ্রাণ্ডট্রাঙ্ক রোড ধরে।

 

হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যার দিকে সুধীর শ্ৰীরামপুর এসে পৌঁছল। সারাটা দিন হেঁটে হেঁটে খুব খিদে পেয়েছে। অথচ সঙ্গে একটি পাই পয়সা নেই।

কী করা যায়?

একদিকে তীব্র ক্ষুধার প্রবল জ্বালা। অন্যদিকে ভবিষ্যতের অনাহারে ক্লান্তিকর দুঃস্বপ্ন। কি করবে। সে? বেচারী। এদিকে রাতও ক্ৰমে বেড়ে চলেছে।

আজকের রাতই বা কাটবে কোথায়? রাতের অন্ধকার তো নয়, কত দুঃখ ও বেদনার দুঃস্বপ্ন যেন বাদুরের মত কালো ডানা ছড়িয়ে সুধীরকে গ্রাস করবার জন্য এগিয়ে আসছে।

আশ্রমের সেই ঘর খানির মধ্যে ভিখুর শয্যার পাশে পাতা আপন শয্যাটির কথা মনে পড়ে।

আর একটু পরেই খাবার ঘণ্টা পড়বে।

ছেলেদের দল সব সার বেঁধে খেতে বসে যাবে।

কে জানত যে,..আশ্রমের বাইরের পদে পদে এত দুঃখ, এত কষ্ট। মনের কোণে কোথায় বুঝি একটা গোপন অনুশোচনা ব্যথার দোলা দিয়ে যায়।

হাঁটতে হাঁটতে গঙ্গার যাত্রী ঘাটে গিয়ে হাজির হলো। প্ৰকাণ্ড সিঁড়িগুলি ধাপের পর ধাপে বরাবর গঙ্গার বুকে নেমে গেছে।

একধারে প্রকাণ্ড একটা বটগাছ তার অজস্র শাখা প্ৰশাখা ছড়িয়ে দিয়ে সুদূর কোন অতীতের সাক্ষী দেয়।

রাতের হাওয়ায় পাতাগুলি ফর-ফর পতৃ-পত্ পত্র মর্মর তোলে। ওপারে মিলের সার বাধা আলোগুলি পিটু পিটু করে জুলে আর জ্বলে। গঙ্গায় এখন বোধহয় ভাঁটা।

জল অনেক দূর পর্যন্ত নেমে গেছে।

নরম মাটির আস্তরণ বহুদূর পর্যন্ত চকচক করে।

জলে ঢেউ জাগা ও ভাঙ্গার অস্পষ্ট শব্দ কানে আসে।

পুঁটলিটি মাথার তলে দিয়ে সুধীর শুয়ে পড়ল।

 

এই খোকা, ওঠ, … ওঠ।…

কার ডাকে সুধীরের ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। ধড়মড় করে সে উঠে বসল।

পূর্বের আকাশে এক অদ্ভুত চাপা লালচে আভা, ভাঙা মেঘের ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে।

মাঝরাতে কখন হয়ত ভাটির শেষে জোয়ার এসেছে. জল এখন একেবারে দুসিঁড়ির নীচে কলকল ছল ছলাৎ করে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।

এখানে শুয়ে কেন?

সুধীর কী জবাব দেবে, চুপ করে থাকে।

বাড়ি কোথায়?

বাড়ি নেই!

তা আসছে কোথা থেকে?

কলকাতা থেকে।

কী নাম তোমার বাবা?

সুধীর এতক্ষণে ভাল করে মুখ তুলে চাইলে, পাশেই দাঁড়িয়ে এক সৌম্যমূর্তি বৃদ্ধ।

গরদের ধুতি পরিধানেও গায়ে গরদের উড়নি।… তারই ফাঁক দিয়ে শুভ্র যজ্ঞোপবীত দেখা যায়।

এইমাত্র বোধহয় স্নান করেছেন। সমগ্ৰ মুখখানিতে গভীর স্নিগ্ধ প্রশান্তি।

তোমার নাম কি?

আমার নাম পান্নালাল চৌধুরী।… সুধীর নাম গোপন করলে।

তোমার মা বাবা, কিম্বা কোন আত্মীয় স্বজন নেই?

কেউ নেই।

এতদিন কোথায় ছিলে?

এক ভদ্রলোকের বাড়িতে। এবারেও সুধীর ইচ্ছা করেই আসল কথাটা গোপন করলে।

তা সেখান থেকে চলে এলে কেন?

তারা থাকতে দিল না।

বললে, বসে বসে খাওয়াতে পারব না।

ভদ্রলোক হাসলেন, কেন? তুমি বুঝি বসে বসে খেতে শুধু?

হ্যাঁ।

তা এখন কি করবে। ঠিক করেছ?

জানিনা।

আচ্ছা এখন আমার সঙ্গে আপাতত আমার বাড়িতে চল। যাবে?

যাবে।

তবে চল। ওঠে।

সুধীর উঠে দাঁড়াল। রাস্তার উপর ভদ্রলোকের গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল।

ভদ্রলোক গাড়িতে নিজে উঠে সুধীরকেও উঠতে বললেন।

ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিল।

যেতে যেতে সে ভাবছিল এতক্ষণ হয়ত আশ্রমের মধ্যে তার পলায়নের ব্যাপার নিয়ে একটা রীতিমত সাড়া পড়ে গেছে।

সিংহী তার কালো মুখখানাকে হাঁড়ির মত করে নিস্ফল আক্ৰোশে ঘরের মধ্যে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে।

ছেলের দল হয়ত কত রকমের কানা ঘুষো করছে।

 

পরমেশবাবুর বাড়িতে সুধীর আশ্রয় পেল। পরমেশবাবুর বিধবা মেয়ে রমা সুধীরকে বুকে টেনে নিল। এক ছেলে ছিল তার সুনীল–হলো দুই ছেলে-পানু আর সুনীল।

পরমেশবাবুর অবস্থা খুবই ভাল। শ্ৰীরামপুর শহরে দুইখানি বাড়ি ভাড়া খাটে। তাছাড়া বিরাট চাল ডালের ব্যবসা ও তেলের কল।

সংসারে ঐ বিধবা মেয়ে রমা ও একমাত্র দৌহিত্র সুনীল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *