ছায়া না কায়া
রাত্রি অনেক হয়েছে। কিন্তু এখনো শশাঙ্কমোহনের প্রাইভেট রুমে আলো জুলছে। মৃগাঙ্কমোহন হঠাৎ কাল বিকালে একটা জরুরী তার পেয়ে কোথায় যেন গেছে। আজকাল প্রায়ই ঘনঘন সে দু এক দিনের জন্য শ্ৰীপুর থেকে চলে যায়। আবার হঠাৎ একদিন ফিরে আসে।
এক জোড়া তীক্ষু চোখের দৃষ্টি নীচের বাগানে করবী গাছটোব আড়াল থেকে শশাঙ্কমোহনের দিকে চেয়ে চেয়ে কী যেন দেখছে।
হঠাৎ এমন সময় শশাঙ্কমোহনের ঘরের বাতি নিভে গেল। নিমেষে। নিশিছিদ্র আঁধারে সমস্ত ঘরটা ভরে উঠলো।
চোখ দুটো তখনো কিন্তু করবী গাছটা আড়াল থেকে একইভাবে শশাঙ্কমোহনের ঘরের দিকে তাকিয়ে। বাইরে ক্ষীণ চাদের আলো যেন শ্রাবণ আকাশের মেঘস্তর ভেদ করে ঝাপসা ক্ষীণ মনে হয়।
সমস্ত জমিদার বাড়ী একেবারে নিস্তব্ধ নিঝুম আঁধারে ছায়ার মত স্তুপীকৃত হয়ে আছে।
চোখ দুটো দেখতে পায়, শশাঙ্কমোহনের ঘরের মধ্যে একটা অস্পষ্ট সাদা ছায়া এদিক ওদিক নড়ে চড়ে বেড়াচ্ছে।
অন্ধকারে করবী গাছটার আড়াল থেকে বিড়ালের মত নিঃশব্দে। আপাদমস্তক কালীে কাপড়ে ঢাকা একটা ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এলো, তারপর সেই ছায়ামূর্তি কাছাড়ি বাড়ির দিকে এগিয়ে চলল।
জমিদারবাবুর বসবার ঘরের ঠিক পাশ দিয়ে, যেখান থেকে উপরে উঠবার সিঁড়িটা-ছায়ামূর্তি সেই দিকে এগিয়ে চলল, তারপর নিঃশব্দে দুটো করে সিঁড়ি এক এক লাফে ডিঙ্গিয়ে উপরে উঠে গেল।
টানা বারান্দাটা রাতের নিঃসঙ্গ আঁধারে খ খ করে। মাঝে মাঝে ঝোলান কানিশের ফাঁকে ফাঁকে ক্ষীণ অস্পষ্ট চাদের আলো বারান্দার উপরে এসে এখানে একটু ওখানে একটু করে ছড়িয়ে পড়েছে।
চোরের মত পা টিপে টিপে নিঃশব্দে ছায়ামূর্তি শিকারী বিড়ালের মত এগুতে লাগল রেলিং ঘেঁষে।
সহসা খুঁট করে একটা শব্দ শোনা যায়।
আগাগোড়া সাদা চাদরে ঢাকা একটা মূর্তি নিঃশব্দে শশাঙ্কমোহনের ঘর থেকে বাইরে এসে দরজাটা টেনে দিল।
মুর্তি এগিয়ে চলে।
এ বারান্দারই একটা দরজা দিয়ে অন্দর মহলে যাওয়া যায়।
মুর্তি এগিয়ে এসে সেই দরজা খুলে অন্দর মহলে প্রবেশ করল।
প্রথমেই মৃগাঙ্কমোহনের ঘর।
বাইরে থেকে সেই ঘরের দরজায় একটা তালা দেওয়া। ছায়ামূর্তির হাতে একগোছা চাবি ছিল। সে একটার পর একটা চাবি দিয়ে ঘরের তালা খুলবার চেষ্টা করতে লাগল। গোটা পাঁচ ছয় চাবি চেষ্টা করার পর খুঁট করে একটা চাবি ঘুরে যেতেই তালাটা খুলে গেল।
মূর্তি তাড়াতাড়ি ঘরের মধ্যে ঢুকেই দরজা। এঁটে দিল। চাবিটা কিন্তু তালার গায়েই আটকে রইল। মূর্তির হাতে একটা ছোট শক্তিশালী টর্চ ছিল। সেটা টিপে আলো জুলিয়ে ঘরটার চারিদিক একবার ভাল করে ঘুরিয়ে দেখে নিল।
মৃগাঙ্কর যাবতীয় জিনিষপত্র একটা দেওয়াল আলমারীতেই বন্ধ থাকত। মৃগাঙ্কর স্বভাবটা ছিল চিরদিনই ভারী অগোছোল। অথচ তার মনটা ছিল অত্যন্ত সৌখিন।
সমস্ত ঘরময় ইতস্তত সব জিনিসপত্র ছড়ান। এখানে জামা ওখানে কাপড়, সেখানে জুতো ইত্যাদি সব ইতস্তত বিক্ষিপ্ত।
একপাশে একটা চামড়ার সুটকেশ হাঁ করে খোলা।
টেবিলের উপর গোটা পাঁচ সাত ‘ক্যাপসটেন’ সিগারেটের খালি টিন। অ্যাসট্রেটা ভর্তি একগাদা সিগারেটের ছাই জমা হয়ে আছে। ঘরের মেঝেয় একপর্দা ধুলো জমে রয়েছে। এদিক ওদিক সব পোড়া দেশলাইয়ের কাঠি ছড়ান। একপাশে খাটে শয্যাটা ধুলো বালিতে ময়লা।
বিশৃঙ্খলতার যেন একখানি চূড়ান্ত প্রতিচ্ছবি।
ছায়ামূর্তি এগিয়ে গিয়ে আলমারীটার সামনে দাঁড়াল।
মূর্তির ডান হাতের মুঠোর মধ্যে একটা বাঁকানো মোটা লোহার তার। সেটা আলমারীর গা-তালার ফোকরে ঢুকিয়ে দিয়ে গোটা দুই জোরে মোচড় দিতেই আলমারীর কপাট দুটো ফাঁক হয়ে গেল।
আলমারীটা খুলে কি যেন সে খুঁজতে লাগল।
অল্পক্ষণ খুঁজতেই মূর্তি একটা কাগজের ছোট প্যাকেট দেখতে পেল একটা বিস্কুটের খালি টিনের মধ্যে।
তাড়াতাড়ি সেই প্যাকেটটা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
পিছন ফিরে চাবিটা যেমন লাগাতে যাবে সহসা কোথা থেকে ঝুপ করে এসে একটা কালো চাদরের মত মাথার উপরে পড়ল। এবং চোখের পলকে একটা ফাসের মত কী যেন গলার উপর এঁটে গেল।