কী দেখছেন?
ভূত। চন্দনবাবুর ভূত! সুব্রত একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললে। তারপর চন্দন সিংয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনি বুঝি আমাদের শংকরবাবুর অ্যাসিস্ট্যান্ট?
চন্দন সিং সম্মতিসূচক ভাবে ঘাড় হেলাল।
এখানকার ঠিকাদার কে চন্দনবাবু?
ছট্টুলাল।
তার সঙ্গে একটিবার আলাপ করতে চাই! কাল একটিবার দয়া করে যদি পাঠিয়ে দেন তাকে সন্ধ্যার দিকে।
দেবো, নিশ্চয়ই দেবো।
আচ্ছা চন্দনবাবু! আপনাকে কয়টা কথা যদি জিজ্ঞাসা করি আপনি নিশ্চয়ই অসন্তুষ্ট হবেন না?
সে কি কথা। নিশ্চয়ই না। বলুন কি কথা?
আমি শংকরবাবুর বন্ধু। এখানে বেড়াতে এসেছি জানো তো।
জানি–।
কিন্তু এখানে পৌঁছে ওঁর আগেকার ম্যানেজারের সম্পর্কে যে কথা শুনলাম তাতে বেশ ভয়ই হয়েছে আমার।
নিশ্চয়ই, এ তো স্বাভাবিক। আমিও ওঁকে বলেছিলাম। এখানকার কাজে ইস্তফা দিতে।
আমার মনে হয় ওঁর পক্ষে ও জায়গাটা তেমন নিরাপদ নয়।
আমারও তাই মত। সুব্রত চিন্তিতভাবে বললে।
কি বলছেন সুব্রতবাবু।
হাঁ—ঠিকই বলছি—
কিন্তু স্রেফ একটা গাঁজাখুরী কথার ওপরে ভিত্তি করে এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার মধ্যে আমার মন কিন্তু মোটেই সায় দেয় না। বরং শেষ পর্যন্ত দেখে তবে এ জায়গা থেকে নড়ব-তাই আমার ইচ্ছা সুব্রতবাবু; শংকর বললে।
বড় রকমের একটা বিপদ আপদ যদি ঘটে এর মধ্যে শংকরবাবু?…অ্যাকসিডেন্টের ব্যাপার, কখন কি হয় বলা তো যায় না।
যে বিপদ এখনও আসেনি, ভবিষ্যতে আসতে পারে তার ভয়ে লেজ গুটিয়ে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে থাকব এই বা কোন দেশী যুক্তি আপনাদের? শংকর বললে।
যুক্তি হয়ত নেই। শংকরবাবু, কিন্তু অ-যুক্তিটাই বা কোথায় পাচ্ছেন এর মধ্যে?–সুব্রত বললে।
কিন্তু-চন্দন সিং বলে :
শুনুন, শুধু যে ঐ ভীষণ মুর্তি দেখেছি তাই নয়। স্যার। মাঝে মাঝে গভীর রাতে কী অদ্ভুত শব্দ, কান্নার আওয়াজ মাঠের দিক থেকে শোনা যায়। এ ফিল্ডটা অভিশাপে ভরা।…কেউ বাঁচতে পারে না। বঁচা অসম্ভব। গত তিনবার ম্যানেজার বাবুদের উপর দিয়ে গেছে.কে বলতে পারে এর পরের বার অন্য সকলের উপর দিয়ে যাবে না।
সে রাত্রে বহুক্ষণ তিনজনে নানা কথাবার্তা হলো।
চন্দন সিং যখন বিদায় নিয়ে চলে গেল রাত্রি তখন সাড়ে দশটা হবে।
শংকর একই ঘরে দুপাশে দুটো খাট পেতে নিজের ও সুব্রতর শোবার বন্দোবস্ত করে দিয়েছে।
শংকরের ঘুমটা চিরদিনই একটু বেশী। শয্যায় শোবার সঙ্গে সঙ্গেই সে নাক ডাকতে শুরু করে দেয়।
আজও সে শয্যায় শোবার সঙ্গে সঙ্গেই নাক ডাকতে শুরু করে দিল।
সুব্রত বেশ করে কম্বলটা মুড়ি দিয়ে মাথার কাছে একটা টুলের ওপরে বসে টেবিল ল্যাম্পটা বসিয়ে তার আলোয় কিরীটীকে চিঠি লিখতে বসল।
কিরীটী,
কাল তোকে এসে পৌছানর সংবাদ দিয়েছি; আজ এখানকার আশপাশ৷ অনেকটা ঘুরে এলাম। ধু-ধু মাঠ, যেদিকে তাকাও জনহীন নিস্তব্ধতা যেন চারিদিকে প্রকৃতির কণ্ঠনালী চেপে ধরেছে।
বহুদূরে কালো কালো পাহাড়ের ইসারা; প্রকৃতির বুক ষ্টুয়ে যেন মাটির ঠাণ্ডা পরশ নিচ্ছে। বর্তমানে যেখানে এদের কোলফিল্ড বসেছে তারই মাইল খানেক দূরে বহু কাল আগে এক সময় একটা কোলফিল্ড ছিল। আকস্মিক ভাবে একরাত্রে সে খনিটা নাকি ধ্বসে মাটির বুকে বসে যায়। এখনো মাঝে মাঝে বড় বড় গর্ত মত আছে। রাতের অন্ধকারে সেই গর্তর মুখ দিয়ে আগুনের হল্কা বের হয়।
অভিশপ্ত খনির বুকে দুৰ্জয় আক্রোশ এখনও যেন লেলিহান অগ্নিশিখায় আত্মপ্ৰকাশ করে। আজ সন্ধ্যার দিকে বেড়িয়ে ফিরছি; অন্ধকাব চারিদিকে বেশ ঘনিয়ে এসেছে, সহসা পিছনে দ্রুত পায়ের শব্দ শুনে চমকে পিছন পানে ফিরে তোকালাম। আশ্চর্য! কেউ যে এত লম্বা হতে পারে ইতিপূর্বে আমার ধারণা ছিল না।
লম্বায় প্রায় ছয় হাত হবে। যেমন উঁচু লম্বা তেমনি মনে হয় যেন বলিষ্ঠ গঠন। আগাগোড়া একটা ধূসর কাপড় মুড়ি দিয়ে হন হন করে যেন একটা ঝোড়ো হাওয়ার মত আমার পাশ দিয়ে হেঁটে সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে মাঠের অপর প্রান্তে মিলিয়ে গেল।
আমি নির্বাক হয়ে সেই অপসৃয়মান মূর্তির দিকে তাকিয়ে আছি, এমন সময় একটা অদ্ভুত বাঘের ডাক কানে এসে বাজল।
এত কাছাকাছি, মনে হলো যেন আশপাশে কোথায় বাঘাট ওৎ পেতে শিকারের আশায় বসে আছে।
তুই হয়ত বলবি আমার শুনবার ভুল, কিন্তু পর পর তিনবার স্পষ্ট বাঘের ডাক আমি শুনেছি।
তাছাড়া তুই তো জনিস সাহস আমার নেহাৎ কম নয়, কিন্তু সেই সন্ধ্যার প্রায়ান্ধকার নিঝুম নিস্তব্ধ প্রান্তরের মাঝে গুরুগম্ভীর সেই শার্দুলের ডাকে আমার শরীরের মধ্যে কেমন যেন অকস্মাৎ শির শির করে উঠল। দ্রুত পা চালিয়ে দিলাম, বাসায় ফিরবার জন্য।
চিঠিটা এই পর্যন্ত লেখা হয়েছে, এমন সময় রাতের নিস্তব্ধ আঁধারের বুকখানা ছিন্ন ভিন্ন করে এক ক্ষুধিত শার্দুলের ডাক জেগে উঠল।
একবার, দুবার, তিনবার। সুব্রত চমকে শয্যা থেকে লাফিয়ে নীচে নামল। তাড়াতাড়িতে নামতে গিয়ে ধাক্কা লেগে টেবিল ল্যাম্পটা মাটিতে ছিটকে পড়ে চুরমার হয়ে ঘর অন্ধকার হয়ে গেল।
আলোর চিমনিটা ভাঙার ঝন ঝন শব্দে ততক্ষণে শংকরের ঘুমটাও ভেঙে গেছে।
ত্রস্তে শয্যার ওপরে বসে চকিত স্বরে প্রশ্ন করলে, কে?
শংকরবাবু! আমি সুব্রত।
সুব্রতবাবু! হ্যাঁ, ধাক্কা লেগে আলোটা ছিটকে পড়ে ভেঙে নিভে গেল।
বাইরে একটা চাপা অস্পষ্ট গোলমালের শব্দ কানে এসে বাজে।
অনেকগুলো লোকের মিলিত এলোমেলো কণ্ঠস্বর রাতের নিস্তব্ধতায় যেন একটা শব্দের ঘূর্ণাবর্ত তুলেছে।
বাইরে কিসের একটা গোলমাল শোনা যাচ্ছে না, সুব্রতবাবু?
হ্যাঁ।
কিসের গোলমাল?
বুঝতে পারছি না, তবে যতদূর মনে হয়, গোলমালটা কুলি বস্তির দিক থেকে আসছে, সুব্রত বললে। চলুন। একবার; খবর নেওয়া যাক।
বেশ চলুন।
দুজনে দুটো লং কোট গায়ে চাপিয়ে মাথায় উলের নাইট ক্যাপ পরে দুটো টর্চ হাতে বেরুবার জন্য প্রস্তুত হলো।
গোলমালটা ক্ৰমে যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ঘরের দরজা খুলে সুব্রত বেরুতে যাবে, এমন সময় আকাশ পাতাল
জেগে উঠল। আবার অকস্মাৎ।
এবং এবারেও একবার, দুবার, তিনবার।
সুব্রতর সমস্ত শরীর লোহার মত শক্ত ও কঠিন, মনের সমগ্র স্নায়ুতন্ত্রীগুলি সজাগ হয়ে উঠেছে।
শংকর ঘরের মাঝখানে স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে গেছে; যেন সহসা একটা তীব্র বৈদ্যুতিক তরঙ্গাঘাতে ও একেবারে অসার পঙ্গু হয়ে গিয়েছে। প্রথমটা কারো মুখে কোন কথাই নেই। কিন্তু সহসা সুব্রত যেন ভিতর থেকে প্রবল একটা ধাক্কা খেয়ে সজাগ হয়ে উঠে ভিতর থেকে এক ঝটিকায় ঘরের খিল খুলে বাইরের অন্ধকার বারান্দায় টর্চটা ফেলে লাফিয়ে পড়ল।
আগাগোড়া সমগ্র ব্যাপারটা ঘটতে বোধ হয়। কুড়ি সেকেণ্ডও লাগেনি।
সুব্রতকে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখে প্রথমটা শংকর বেশ একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সে মুহূর্তের জন্য। পরক্ষণেই সেও সুব্রতকে অনুসরণ করলে।
বাইরের অন্ধকার বেশ ঘন ও জমাট। সুব্রতর হাতের টর্চের তীব্ৰ বৈদ্যুতিক আলোর রশ্মি অনুসন্ধানী দৃষ্টি ফেলে চারিদিকে ঘুরে এল; কিন্তু কোথাও কিছু নেই।
বাঘ তো দূরের কথা, একটা পাখি পর্যন্ত নেই।
ততক্ষণে শংকরও সুব্রতর পশ্চাতে এসে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু বাঘের ডাক তো স্পষ্ট শোনা গেছে।
তবে?
বুঝতে পারছি না। সত্যি সত্যিই একি তবে ভৌতিক ব্যাপার?
বলতে বলতে শংকর আবার হাতের টর্চের বোতামটা টেপে। মাঠের মাঝখানে কুলিবস্তি ও কোলিয়ারীতে যাবার পথে কতকগুলি কাট্ যুঁই ও বাবলা গাছ চোখে পড়ে। সেইদিকে শংকরের হাতের অনুসন্ধানী বৈদ্যুতিক বাতির রশ্মি পড়তেই দুজনে চমকে উঠল…কে? কে ওখানে, একটা কালো মূর্তি…তার গায়ে সাদা সাদা ডোরা কাটা।
চকিতে সুব্রত কোমরবন্ধ থেকে আগ্নেয়-অস্ত্রটা টেনে বের করলে এবং চাপা গলায় বললে : ওই দেখুন বাঘ। সরে যান। গুলি করি।
শেষের কথাগুলো উত্তেজনায় যেন বেশ তীক্ষ্ণ ও সজোরে সুব্রতর কণ্ঠ ফুটে বের হয়ে এল।
স্যার আমি।…গুলি করবেন না। স্যার।…ইয়োর মোস্ট ফেইথফুল এণ্ড ওবিডিয়েণ্ট সারভেন্ট।
একটা চাপা ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর কানে এসে বাজল।
কে?
আমি বিমল দে।…কোলিয়ারীর সরকার।
বিমলবাবু! শংকরের বিস্মিত কণ্ঠ চিরে বের হয়ে এল।
দুজনে এগিয়ে গেল। শংকর বিমলবাবুর গায়ের ওপরে টর্চের আলো ফেলে প্ৰশ্নসূচক দৃষ্টিতে বিমলবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, এত রাত্রে এখানে এই শীতে মাঠের মধ্যে কী করছিলেন?
আগাগোড়া একটা সাদা ডোরা কাটা ভারী কালো কম্বলে মুড়ি দিয়ে বিমলবাবু সামনে দাঁড়িয়ে…
আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম স্যার।
আমার কাছে যাচ্ছিলেন? শংকর প্রশ্ন করলে।
হ্যাঁ। কুলি ধাওড়ায় একটা লোক খুন হয়েছে।
খুন হয়েছে!..সুব্রত চমকে উঠল।
হ্যাঁ বাবু, খুন হয়েছে।
গোলমালটা এখন বেশ সুস্পষ্টভাবে কানে এসে বাজছে।
চলুন, দেখে আসা যাক।
সুব্রতর দিকে তাকিয়ে শংকর বললে।
আগে শংকর, মাঝখানে বিমলবাবু ও সর্বশেষে সুব্রত টর্চের আলো ফেলে কুলিবস্তির দিকে এগিয়ে চলল।
মাথার উপরে তারায় ভরা রহস্যময়ী অন্ধকার রাতের আকাশ কী যেন একটা ভৌতিক বিভীষিকার প্রতীক্ষ্ণয় উদ্গ্ৰীব।
আজ রাতে-কুয়াশার লেশমাত্র নেই।