মায়ের প্রাণ
রমা যখন সুনীলের গৃহত্যাগের সংবাদ পেল। তখন একটি শব্দও তার গলা দিয়ে বের হল না। শুধু ফোঁটায় ফোটায় অশ্রু তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগিল গভীর বেদনায়।
পানু এসে মার কাছে দাঁড়াল, দুঃখ করো না মা–দাদা আবার ফিরে আসবে।–
গভীর স্নেহে রমা পানুকে বুকের কাছটিতে টেনে নিল, আমি জানতাম এমনি করে একদিন আমায় সে কী দিয়ে যাবেই। তাকে ঘরে বেঁধে আমি রাখতে পারব না।
আবার দুফোঁটা জল গাল বেয়ে নেমে আসে।
হঠাৎ যেন একটা দমকা হাওয়ার ঝাপটায় এবাড়ির হাসির প্রদীপটা নিভে সব কিছু আঁধারে ভরে গেছে।
সুনীল নেই।
জীবনের সেই সদা চঞ্চল সহজ উচ্ছলতার ঝর্ণাধারাও যেন শুকিয়ে গেছে।
পানু আরো গম্ভীর হয়ে উঠেছে।
এমন সময় আচম্বিতে পানুর জীবনে একটা ঝড় বয়ে গেল।
সেদিন রমা দুপুরে অলস নির্জনতায় মেঝের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে তার পলাতক পুত্রের জন্য চোখের জলে বুক ভাসাচ্ছে। পরমেশবাবু এসে ঘরে প্ৰবেশ করলেন। হাতে তার অনেকদিনকার একখানি পুরাতন সংবাদপত্র।
রমা, পরমেশবাবু ডাকলেন।
কে, বাবা? রমা ধড়ফড় করে উঠে বসল।
আবার তুই কঁদেছিলি মা। … এতে যে তোর ছেলেরই অমঙ্গল হয় মা। কেন দুঃখ করিস? কারও ছেলে কি বিদেশে যায় না? ওদের দেশের ছেলেরা যে মায়ের আঁচল ছেড়ে ওর চাইতেও অল্প বয়সে দেশ দেশান্তরে ঘুরে বেড়ায়। আকাশের বুকে পাড়ি জমায়। নতুন দেশের সন্ধানে বের হয়। কই, তাদের মায়েরা তো এমনি করে চোখের জল ফেলে না। বরং হাসি মুখে ছেলেকে বিদায় দেয়, বিপদের মাঝে ছুটে যেতে। আজ তোরাই তো মায়ের দল স্নেহের গণ্ডী দিয়ে বাংলা দেশের ছেলে মেয়েগুলোকে পঙ্গু করে তুলেছিস। অথচ একদিন তোদেরই দেশের মা জনা প্রবীরকে অৰ্জ্জুনের বিরুদ্ধে নিজহাতে রণসাজে সাজিয়ে যুদ্ধে পাঠিয়ে ছিলেন। তাঁরাও তো মা ছিলেন।
বাবা—
তাঁদের বুকেও তোদের মতই মাতৃ-স্নেহের নিরন্তর ফন্তুধারা বয়ে যেত।
সবই তো বুঝি বাবা, কিন্তু মন যে মানে না। রমা জবাব দেয়।
সে তো আবার তোরই বুকে ফিরে আসবে মা। আমি বলছি সে আবার আসবে। আমাদের ভুলে কি সে থাকতে পারে? তোর বৃকভরা মেহের আকর্ষণই একদিন আবার তাকে শত আপদ বিপদের বেড়াজাল ডিঙিয়ে তোর কাছে এনে পৌঁছে দেবে। শেষের দিকে বৃদ্ধের কণ্ঠস্বরও যেন অশ্রু সজল হয়ে ওঠে।
জানি না। বাবা সে আর আসবে কিনা, তবে আমি তার জন্যে অপেক্ষা করব, রমা। শুধু স্নান স্বরে বলে।
শোন, তোকে একটা জিনিষ দেখাতে এসেছিলাম মা, বলতে বলতে পুরাতন সংবাদ পত্ৰখানি পরমেশ বাবু মেয়ের সামনে ধরলেন।
এটায় কি আছে বাবা? রমা জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে পরমেশবাবুর মুখের দিকে তাকায়।
লাল পেনসিল দিয়ে দাগ দেওয়া একখানি ছেলে হারিয়ে যাওয়ার বিজ্ঞাপনের দিকে পরমেশবাবু রামার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন।
রামা আগ্রহে বিজ্ঞাপনটা আগাগোড়া পড়ল।
তুমি কি বলতে চাও বাবা? রমা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে পিতার মুখের দিকে তাকাল। বছর পাঁচেক আগে পানুকে আমরা কি ভাবে পেয়েছিলাম গঙ্গার ঘাটে, মনে আছে নিশ্চয়ই মা তোমার? পরমেশবাবু বললেন।
রামা স্তব্ধ হয়ে গেল।
পরমেশবাবু মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন, তুমি বোধ হয়। লক্ষ্য করেছে, পানুর ডান ভ্রূর নীচে একটা লাল জরুল আছে। এবং তার গলায় যে কবচটা তোমার কাছে আছে হয়ত তাতেই তার পরিচয় পত্রটাও পাওয়া যাবে। সত্যি যদি পানু জমিদার শশাঙ্কমোহন চৌধুরীর হারিয়ে যাওয়া ছেলেই হয়, তবে তো আমাদের উচিত তাকে তার মা বাবার হাতে তুলে দেওয়া। তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ থেকে তাকে তো আমরা বঞ্চিত করতে পারি না মা।
বাবা। আর্তস্বরে রমা চিৎকার’করে উঠল।
জানি মা সব জানি। বুঝি সব। পরমেশবাবু বলতে লাগলেন, পুত্রের মতই এ-কয় বছর তাকে তুমি বুকে করে আগলে এসেছে। আজ তাকে বিদায় দিতে বুক তোমার ভেঙে যাবে, কিন্তু আজ যদি তুমি সেই লালন-পালনের মেহের দাবীতে তাকে তোমার কাছে আটকে রাখতে চাও সে কি অন্যায় হবে না? ভেবে দেখ, তোমার মঙ্গল স্নেহ দাবী তাকে তার জীবনের সব চাইতে বড় পাওয়া থেকে বঞ্চিত করছে।
কিন্তু যে মা তাকে তার জন্ম মুহুর্তে-রমা বলতে লাগল, —তার স্নেহ থেকে বঞ্চিত করে একদা এক অচেনা অনাথ আশ্রমে পাঠিয়ে দিতে পেরেছিল-আজ এই দীর্ঘ ষোল বছর পরে তার স্নেহ যদি তার সেই হারান ছেলের উপরে জেগেই থাকে। তবে তার কতটুকু মূল্য আছে? না, আমি পানুকে ছাড়তে পারব না। বাবা। সুনুকে হারিয়ে ওর মুখ চেয়েই যে আমি বাঁচবার চেষ্টা করছি বাবা।
ভেবে দেখ রমা, বড় হয়ে ও যদি কোনোদিন একথা জানতে পারে। য়ে ও এক মাস্তবড় জমিদারের ছেলে হয়েও জন্ম গরিবই রয়ে গেল এবং সেদিন যদি ওর মনে হয় এর জন্য তুমি আর আমিই দায়ী?
না বাবা-না-ও কখন তা ভাববে না—
শোন মা। তোমার কথা ভেবেই এতদিন মুখ বুজে ছিলাম। গত সপ্তাহে ওই বিজ্ঞাপন যখন চোখে পড়ে সেই দিনই দুপুরে একান্ত কৌতুহল বশেই আমার বাক্স থেকে পানুর গলার সেই কবচটা খুলে নিয়ে ওই বিজ্ঞাপন দাতার সঙ্গে দেখা করি। এবং তঁর কাছেই পানুর পূর্বজীবন সম্পর্কে সব শুনে এসেছি।
বাবা—
হ্যাঁ মা, পানুর বাবা শ্ৰীপুরের মস্ত।বড় জমিদার। কিন্তু এসব জানার পর আর তো ওকে আমাদের কাছে ধরে রাখা যায় না। এবারে ওকে ওর মা বাবার কাছে পৌঁছে দেওয়াই কর্তব্য আর তুমি ওর মা সম্পর্কে যে দোষারোপ করছে, আসলে তিনি নির্দোষ। ওর জন্ম মুহুর্তে একটা প্ৰকাণ্ড ষড়যন্ত্রই ওর এই ভাগ্য বিপর্যয়ের কারণ।
জন্মবৃত্তান্ত সম্পর্কে যা যা শুনেছিলেন সব রমার কাছে খুলে বললেন।
এবারে কিন্তু রমা চুপ করেই রইল। বরং পানুর প্রতি পূৰ্বস্নেহ তার আরো গভীর হলো। আহা বেচারী, শিশুকালে মা থাকতেও মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
কিন্তু একটা কথা। পরমেশবাবু বলতে লাগলেন, পানুকে তার পূর্ব জীবনের সব কথা তোমাকেই খুলে বলতে হবে এবং একথাও বলতে হবে যে শীঘ্র তাকে সেখানে ফিরে যেতে হবে।
আমি! শরাহত পাখীর মতই রমা চীৎকার করে উঠলো, ক্ষমা করো বাবা, আমায় ক্ষমা করো, আমায় এ অনুরোধ করো না, বরং তুমিই বলে।
অগত্যা পরমেশবাবুই পানুকে সকল কথা খুলে বলতে রাজী হলেন।