গোপন কথা
সংবাদটা চাপা রইলো না। ক্ৰমে একান ওকান হতে হতে শ্ৰীলেখাও একদিন শুনল যে সে শশাঙ্ক চৌধুরী ও বিভাবতীর নিজের মেয়ে নয়।
এতদিন চোরের মতই চুরি করে তাদের স্নেহ ও ভালবাসা ভোগ করে এসেছে।
এই বিশাল জমিদারী, মূল্যবান ঝকঝকে তকতকে আসবাবপত্র, কাপড় জামা, খেলনা, গয়নাগটি কিছুতেই তার অধিকার নেই, সে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। একদিন যাকে প্ৰাণ ভরে মা বলে ডেকে ডেকে আশ মেটেনি, সে মাও তার নিজের মা নয়। তার উপরে আজ তার কোন অধিকার নেই।
এ বাড়ীর সামান্য একটা ভূত্যেরও যে অধিকার এখানে আছে তার আজ সেটুকুও নেই। শ্ৰীলেখা স্তব্ধ হয়ে গেল। বোবা হয়ে গেল যেন।
একটা বিদ্যুৎ প্রবাহ যেন তার ভিতর দিয়ে ছুটে গিয়ে দেহের সমস্ত কলকব্জাগুলো মুহুর্তে বিকল করে দিয়ে গেছে।
দুপুরের পড়ন্ত রোদে বাগানের পাতাবাহারের গাছগুলো যেন ঝিমুচ্ছে। একটা পড়বার বই খুলে শ্ৰীলেখা নিজের ঘরে চুপটি করে বসে ছিল।
খোলা জানালা পথে দেখা যায় গেটের ধারের প্রকাণ্ড কৃষ্ণচুড়া গাছটায় যেন লাল আগুনের আভা ছড়িয়ে পড়েছে। মাঝে মাঝে দ্বিপ্রহরের ক্লান্ত নির্জনতায় অশান্ত ঘুঘুর একঘেয়ে সুর ভেসে আসে।
ফট্ফট্ করে জাপানী চপ্পলের সাড়া জাগিয়ে সুধীর এসে ঘরে প্রবেশ করল,
আজকের সুধীরকে যেন আর চেনাই যায় না। দামী সিস্কের বেশভূষায় ও জমিদার বাটির দুধ, ঘি-সারে পনের দিনেই তার ভোল গেছে সম্পূর্ণ বদলে। সিস্কের সার্ট গায়ে। পরিধানে সিল্কের ঢোলা পায়জামা।
কিরে শ্ৰী কি করছিস?
শ্ৰীলেখার পরিপাটি করে বিছান শয্যায় নিজের দেহভার ছড়িয়ে দিতে দিতে সুধীর প্রশ্ন করল।
মাথার কাছে টিপয়ে একটা সুদৃশ্য কারুকার্যখচিত রূপার বাটীতে চকলেট রয়েছে, তার থেকে কয়েকটা তুলে মুখে দিয়ে বলল, এসব কিনে পয়সা নষ্ট করিস কেন? এ বয়সে পয়সা নষ্ট করবার বাতিকটা বড্ড খারাপ।
শ্ৰীলেখার চোখে জল এসে পড়ে।
শ্ৰীলেখার মনে পড়ে কখনো মা বাবার কাছে কোন দিন কোন দাবী জানায় নি বলে মা বাবার কাছে কত অনুযোগ তাকে শুনতে হয়েছে, চকলেট খেতে ভালবাসে বলে মা নিজেই রোজ চকলেট এনে রেখে যান।
আজ তার কৈফিয়ৎ দিতে হচ্ছে। দিতে তো আজ তাকে হবেই কৈফিয়ৎ, কে সে এখানকার, কি তার দাবী?
সুধীর বলে চলে, এমনি করে আর পয়সা নষ্ট করা চলবে না, আর এমনি করে পয়সা নষ্ট করলে কয়দিন জমিদারী চলবে? দুদিনেই তচনচ হয়ে নষ্ট হয়ে যাবে।
শ্ৰীলেখা চুপ।
গায়ে তোর ওটা কিসের জামা রে? মুর্শিদাবাদ সিল্কের বুঝি? এত বাবুগিরী কেন? সাধারণ ছিটের জামাই তো যথেষ্ট।
গভীর রাত্রে বিছানায় শুয়ে শ্ৰীলেখা ছটফট করে। যে মাকে সে কোনদিন দেখেনি, জ্ঞান হওয়া অবধি যার কথা কোন দিনের জন্য একটিবারও শোনেনি, সেই অদেখা, অচেনা, অজানা মার জন্য চোখের কোল বেয়ে আজ তার অশ্রু ঝরে। মা, মাগো কোন অপরাধে এমনি করে আজ আমায় নিঃস্ব একাকী সংসার সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে গেলে মা।
শ্ৰীলেখা যেন চোরের মত বাড়িতে আছে। নিঃশব্দে যেন সকলের দৃষ্টি থেকে নিজেকে সর্বক্ষণ আড়াল করে রাখতে সচেষ্ট। এমন কি বিভাবতীর কাছেও যায় না। পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়।
সেদিন বিভগবতী ধরে ফেলেন শ্ৰীলেখাকে।
শ্রী–
শ্ৰীলেখা সাড়া দেয় না। মাথা নীচু করে থাকে।
বিভাবতী শ্ৰীলেখাকে আপনি বুকের উপরে টেনে গভীর মেহমাখা সুরে জিজ্ঞাসা করেন, কি হয়েছে মা তোর? দিনরাত গম্ভীর হয়ে থাকিস কেন?
কই কিছুই তো হয়নি, শ্ৰীলেখা জবাব দেয়।
তোর আগেকার সেই হাসি কোথায় গেল মা।
কেন মা? আমি তো হাসি, শ্ৰীলেখা ম্লান কণ্ঠে জবাব দেয়।
ওরে তুই আগেও যেমন আমার মেয়ে ছিলি এখনও তেমনিই আছিস…।
শ্ৰীলেখার পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে বিভাবতী বলেন।
হঠাৎ আচমকা শ্ৰীলেখা প্রশ্ন করে বসে, আমার-সত্যিকারের মা বাবার কি কোন খোঁজই জান না মা তোমরা?
না।…
শ্ৰীলেখা চুপ করে থাকে।
কিন্তু কেন, ওকথা জিজ্ঞাসা করছিস কেন? কি হবে তোর সে কথা জেনে? আমরাই তোর মা বাপ।
রাত্রি বোধ করি। অনেক হবে।
সুধীর জেগেই ছিল, কে যেন তার শয়ন ঘরের বন্ধ দরজার গায়ে মৃদু টোকা দেয়, টুক্ টুক্।…
সুধীর কান খাড়া করে শোনে, আবার শব্দ হয়… টুক… টুক।
এবারে সুধীর নিঃশব্দে উঠে দরজার খিল খুলে দেয়। আপাদমস্তক ভারী চাদরে ঢাকা এক ছায়ামূর্তি এসে ঘরে ঢোকে।
মূর্তিই ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দেয়।
কিরে, কিছু জোগাড় করেছিস?
হ্যাঁ, শ পাঁচেক টাকা মাের ক্যাসবাক্স থেকে চুরি করে রেখে দিয়েছি।
বিছানার তলা থেকে দশটাকার পঞ্চাশখানি নোট সুধীর বের করে মূর্তির হাতে নিঃশব্দে গুজে দেয়।
লোকগুলো সব কেমন? ছায়ামূর্তি প্রশ্ন করে।
ভয়ানক বোকা। সুধীর জবাব দেয়।
মেয়েটা? আবার ছায়ামূর্তি জিজ্ঞাসা করে।
গোলমাল করেনি। আর করবেও না বোধ হয়।
কিন্তু সুধীর ও সেই ছায়ামূর্তি জানতেও পারে না, তাদের সব কিছু লক্ষ্য করছে। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আর এক ছায়ামূর্তি, ওদের সব কথাই তার কানে যায়।
এক সময় প্রথম ছায়ামূর্তি ঘর থেকে বের হয়ে গেল।