আরো বিস্ময়
এক সময় সুব্রতর মনে হলো, এমনও তো হতে পারে কোন একটা গভীর উদ্দেশ্য নিয়ে এইভাবে পরপর খুন করা হচ্ছে। কিন্তু তা হলেই বা সে উদ্দেশ্যটা কী?
সুব্রত চিঠির কাগজের প্যাড়ুটা টেনে নিয়ে কিরীটীকে চিঠি লিখতে বসল।
কিরীটী।
গত কালকের সমস্ত সংবাদ দিয়ে তোকে একখানা চিঠি দিয়েছি।
ভেবেছিলাম আজ আর বুঝি তোকে চিঠি দেওয়ার মত কোন প্রয়োজনই থাকবে না; কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কতকগুলো ব্যাপারে পরামর্শ নেওয়া আমার একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আজ আবার অতর্কিতভাবে এক হতভাগ্য সাঁওতাল কুলী আমাকে খুন করতে এসে নিজে অদৃশ্য এক আততায়ীর হস্তে প্ৰাণ দিয়েছে।
এই শত্রুর দেশে কে আমার এমন বন্ধু আছেন বুঝলাম না যিনি অলক্ষ্যে থেকে এভাবে আমার প্রাণ বাঁচিয়ে গেলেন।
এ ব্যাপারটার যে explanation আমি আমার মনে মনে খাড়া করেছি, আসলে হয়ত মোটেই তা নাও হতে পারে; হয়ত এটা আগাগোড়াই সবটা আমার উর্বর মস্তিষ্কের নিছক একটা অনুমান মাত্র। কিম্বা হয়ত এমনও হতে পারে তাদেরই দলের কেউ তার উপরে হিংসা পোষণ করে বা অন্য কোন গৃঢ় কারণ বশতঃ তাকে খুন করে গেছে অলক্ষ্যে থেকে। তবে ময়না তদন্তের একটা রিপোর্ট আজ কিছুক্ষণ আগে দারোগাবাবু, দয়া করে আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন, তাতে দেখলাম, হতভাগ্য ম্যানেজারদের মৃত্যুর কারণ বিষ।…
মাইনের মধ্যকার ব্যাপারটা এখনও জানা যায় নি। তবে রিপোর্ট দেখে মনে হয় দশজনই খুন হয়েছে।
বুঝতে পারি না এরকম নৃশংসভাবে একটার পর একটা খুন করে কী লাভ থাকতে পারে খুনীর। আর ম্যানেজারগুলো তো তৃতীয় পক্ষ। তাদের নিজস্ব কী এমন interest খনি সম্পর্কে থাকতে পারে যাতে করে তাদের এভাবে খুন হওয়ার ব্যাপারটাকে explain করা যেতে পারে।
তবে কী আসল ব্যাপারটা আগাগোড়াই একটা হুমকি বা চাল?
যা হোক এখন পর্যন্ত তোর বন্ধুটি নির্বিঘ্নে সুস্থে ও বহাল তবিয়তে খোস মেজাজেই আছেন। খবর কী? রাজুর খবর কী? মা কেমন আছেন?
তোদের সুব্রত।
পরদিন সকালে সুব্রতর যখন ঘুম ভাঙ্গল, চারিদিকে একটা ঘন কুয়াশার যবনিকা দুলছে।
শংকর খানিক আগেই শয্যা থেকে উঠে মাইনের দিকে চলে গেছে; কেননা আজ থেকে আবার মাইনের কাজ শুরু হবার কথা।
ঝুমন চায়ের জল চাপিয়ে দু। দুবার সুব্রতর ঘরের কাছে এসে ফিরে গেছে, সুব্রত নিদ্রিত দেখ
শয়ন ঘর থেকে বের হয়ে সুব্রত ডাকল, ঝুমন।
সাব, ঝুমন সামনে এসে দাঁড়াল।
কী রে, তোর চা ready তো?
ঝুমন হাসতে হাসতে জবাব দিল, জি সাব?
ম্যানেজারবাবু কোথায়?
খাদে গেছেন হুজুর।
চা খেয়ে গেছে? আজ্ঞে না। বলে গেছেন। আপনি ঘুমিয়ে উঠলে তিনি এর মধ্যে ফিরে আসবেন, তারপর এক সঙ্গে দুজনে চা খাবেন।
বেশ। তবে তুই চায়ের সব জোগাড় করা। আমি ততক্ষণ চটুপটু হাত পা ধুয়ে নিই, কি বলিস?
জি সাব—
ঝুমন নিজের কাজে রান্না ঘরের দিকে চলে গেল।
সুব্রত বাথরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে গরম ওভার কোটটা গায়ে চাপিয়ে চায়ের টেবিলের কাছে এসে দেখে শংকর এর মধ্যে কখন মাইন থেকে ফিরে চায়ের টেবিলের সামনে এসে বসে আছে।
তাহলে শংকরবাবু? মইনের কাজ শুরু করে দিয়ে এলেন?
অ্যাঁ। কে? ও সুব্রতবাবু? কী বলছিলেন?
মাইনের কাজ শুরু হবার আজ সকাল থেকে Order ছিল না? কাজ শুরু হলো?
হ্যাঁ হয়েছে। কিন্তু একটা বিচিত্র আশ্চর্যের ব্যাপার ঘটেছে। মনে হচ্ছে এটা কী যেন ভেল্কী বাজীর খনি।
ব্যাপার কী? সুব্রতর দৃষ্টিটা প্রখর হয়ে উঠলো।
ঝুমন গরম চা, রুটি, মাখন, ডিমসিদ্ধ ও কেক সাজিয়ে দিয়ে গেল সামনের টেবিলের ওপরে।
একটা সিদ্ধ ডিমের অর্ধেকটা কঁটা দিয়ে ভেঙে নিয়ে সেটা গালে পুরে চিবোতে চিবোতে শংকর বলল, তা ছাড়া কি বলব বলুন? ১৩নং কাঁথিতে মরলো দশজন। কয়লার চাংড়া সরিয়ে মৃতদেহ পাওয়া গেল মোটে একটা।
তার মানে? সুব্রত বিস্মিত দৃষ্টিতে শংকরের মুখের দিকে তাকল।
হ্যাঁ মশাই, এত বিস্মিত হচ্ছেন কেন? ১৩ নং কাঁথিতে মৃতদেহ মাত্র একটিই পাওয়া গেছে।
তবে যে শুনছিলাম দশজন মারা গেছে? সুব্রত রুদ্ধনিশ্বাসে বললে।
তাই তো শোনা গিয়েছিল এবং লিস্টমত দশ জনকে পাওয়াও যায়নি।– কিন্তু কয়লা সরিয়ে মৃতদেহ উদ্ধার করার পর দেখা যাচ্ছে মাত্র একটিই।
বলেন কি! —ভাল করে খুঁজে দেখা হয়েছিল তো? সুব্রত প্রশ্ন করলে।
আমি নিজে পর্যন্ত দেখে এসেছি। মানুষ তো দূরের কথা একগাছি চুলও দেখতে পেলাম না।
আশ্চর্য। …
তারপর, আবার সুব্রত জিজ্ঞাসা করলঃ ১৩নং কাঁথিতে কাজ চলছে নাকি? না।
১৩নং কাঁথিতে কাজ একদম বন্ধ করে রেখে এসেছি।
বেশ করেছেন। চলুন, চা খেয়ে আমি একবার সেই ১৩নং কাঁথিটা ঘুরে দেখে আসব।
বেশ তো চলুন। উদাসভাবে শঙ্কর জবাব দিল।
চা পান শেষ করে বেরুবার জন্য প্রস্তুত হয়ে দুজনে বাইরের রাস্তায় এসে দাঁড়াল। … এমন সময় দেখা গেল বিমলবাবুর সঙ্গে অদূরে দারোগা -বাবু আসছেন।
দারোগাবাবুই আগে হাত তুলে নমস্কার জানালেন, নমস্কার সুব্রত-বাবু। নমস্কার মিঃ সেন।
ওরা দুজনেই প্রতি-নমস্কার জানোল।
দারোগাবাবুই প্রশ্ন করলেন, কোথায় মশাই আপনাদের শালবনে খুন হয়েছে?…
কিন্তু এত তাড়াতাড়ি খবরটা পেলেন কি করে? সুব্রত শুধায়।
এ দিকে আসছিলাম-পথেই চিঠিটা পেলাম। কিন্তু
কি?
এতক্ষণ প্ৰায় আধঘণ্টা ধরে আমি বিমলবাবুকে সঙ্গে নিয়ে তন্ন তন্ন করে। শালবন নদীর ধার পর্যন্ত খুঁজে এলাম। কিন্তু কোথাও তো মশাই লাসের টিকিটরও দর্শন পেলাম না…অন্ধকারে ভুল দেখেননি তো?
সুব্রত চমকে উঠল, আপনি বলছেন কী স্যার? —আমার চোখের সামনে ব্যাটা ছটফট করে মরল, আর আমি ভুল দেখলাম।
তবে বোধ হয় ব্যাটা মরে ভূত হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে সুব্রতবাবু। হাসতে হাসতে দারোগাবাবু বললেন।
দেখুন দারোগাবাবু। নেশা ভাঙের অভ্যাস আমার জীবনে নেই। তাছাড়া চোখের দৃষ্টি এখনও আমার খুবই প্রখর ও সজাগ।
কিন্তু লাসটা তাহলে কোথায়ই বা যাবে বলুন? কথাটা বললেন বিমলবাবু।
কোথায় যাবে তা কী করে বলব? পাওয়া যখন যাচ্ছে না। তখন নিশ্চয়ই কেউ রাতারাতি লাস সরিয়ে নিয়ে গেছে।
কিন্তু ওই শালবনে অত রাত্রে যে একটা লোক খুন হয়েছে সে-কথা লোকে জানলই বা কেমন করে যে সরিয়ে নেবে রাতারাতি? দারোগাবাবু বললেন।
এবার সুব্রত আর না হেসে থাকতে পারলে না। হাসতে হাসতে বললে, তা যা বলেছেন, তবে, যে খুনী সে তো জানতই লোকটা মারা গেছে, বিশেষ করে বন্দুকের গুলি খেয়ে যে বঁচা চলে না, এবং সে গুলি যখন পাঁজরা ভেদ করে গেছে।–
তবে কি আপনি বলতে চান সুব্রতবাবু, খুনীই লাস সরিয়েছে?—
বলতে আমি কিছুই চাই না। —লাস কেউ সরিয়েছে বা সরায় নি এ সম্পর্কে কোন তর্ক বিতর্ক করাই আমার ইচ্ছা নেই। আপনারা যে সিদ্ধান্তে ইচ্ছা উপস্থিত হতে পারেন এবং যেমন খুশী further proceed করতে পারেন। তবে এটা ঠিকই জানবেন কাল একজন কুলী শালবনে বন্দুকের গুলিতে খুন হয়েছিল।
আপনার কথাই যদি ধরে নেওয়া যায়, অর্থাৎ খুনীই লাস সরিয়ে থাকে, তবে কোথায় সরালে? দারোগাবাবু সুব্রতর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন।
কেমন করে বলব বলুন? আমার সঙ্গে পরামর্শ করে তো আর লাস সরায় নি।–
তাও তো ঠিক। তাও তো ঠিক। দারোগাবাবু মাথা দোলাতে লাগলেন পরম বিজ্ঞের মত।