রাত নিঝুম - ১
রাত নিঝুম - ২

১৬. পলায়ন

পলায়ন

সেদিন রাত্রে দুপুরের কথামত আশ্রমের খাওয়া দাওয়া চুকে গেলে সকলে পিছু পিছু এসে সুধীরের ঘরে প্রবেশ করল।

সুধীর সকলকে ঘরে ঢুকিয়ে ভিতর থেকে দরজাটা এঁটে দিল। গঙ্গার দিককার জানালাটায় পরপর পাঁচটা লোহার শিক খাড়া করে বসান, তারই একটা শিক ঈষৎ উপর দিকে একটু ঠেলে নীচের দিকে টানতেইজানালার কাঠের ফ্রেম থেকে খুলে এল। সকলে বিস্ময়ে এতক্ষণ একদৃষ্টি তাকিয়ে সুধীরের কাণ্ড-কারখানা দেখছিল।

সুধীর ওদের দিকে ফিরে হাসতে হাসতে বললে, দেখলি কেমন চিচিং ফাঁক।

ছুরি দিয়ে কাঠ কুরে কুরে ফ্রেমের গর্ত বাড়িয়ে সুধীর শিক খোলবার উপায় করেছিল।

এইবার এই জানলা পথে সবাই আমরা বাইরে যাবো, সুধীর বলে।

প্রকাশ করে তার মতলব!

সকলে তখন সেই শিকের ফাঁক দিয়ে একে একে বাইরে গেল। নিঃশব্দে নীচে হয়ে প্রাচীরের গা ঘেসে সকলে আশ্রমের সীমানা পার হয়ে গঙ্গার ধারে গিয়ে দাঁড়াল।

আকাশে চাঁদ দেখা দিয়েছে। তার আলোয় চারিদিক যেন স্বপ্নময়।

গঙ্গায় তখন জোয়ার দেখা দিয়েছে।

জোয়ারের টানে গঙ্গার ঘোলাটে জল সাদা সাদা ফেনা ছড়িয়ে কলকল ছলছল করে দুপাড় ভাসিয়ে ছুটছে। খানিকটা দূর এগিয়ে যেতেই দেখা গেল কয়েকটা জেলে ডিঙ্গি পাড়ের সঙ্গে দড়ি দিয়ে খোঁটার গায়ে বাঁধা।

জোয়ারের জলে ছোট ছোট ডিঙ্গিগুলো হেলছে আর দুলছে। সামনেই অল্প দূরে জেলেদের বাড়ি।

বঁশের মাচানের গায়ে জাল শুকাচ্ছে।

সুধীর আস্তে আস্তে নীচু গলায় বললে, চুপ, সব গোলমাল করিসনে। জেলেরা টের পেলে কিন্তু আর রক্ষা রাখবে না। তোরা সব আস্তে আস্তে গঙ্গার পাড় দিয়ে খানিকটা এগিয়ে যা, আমি নৌকা খুলে দিয়ে এগিয়ে গিয়ে তোদের তুলে নেব’খন।

পরিপূর্ণ চাঁদের রূপালী আলো গঙ্গার জলের বুকে অসংখ্য ঢেউয়ের গায়ে গায়ে যেন অপূর্ব স্বপ্ন মাধুরী রচনা করে।

সুধীর নিঃশব্দে একটা ডিঙ্গি খুলে নিয়ে এগিয়ে গেল একটু দূরে।

সবাই এসে জমায়েত হয়েছিল একটু দূরে।

সুধীর একে একে সকলকে ডিঙ্গিতে তুলে নিল। সুধীর হালে বসল। আর দুজন দাঁড় টানতে লাগল। জোয়ারের টানে নৌক সামনের দিকে এগিয়ে চলে। মাঝে মাঝে গঙ্গাবক্ষের শীতল হাওয়া এসে চোখে মুখে ঝাপটা দিয়ে যায়।

হঠাৎ সুধীর সকলের দিকে তাকিয়ে বলে, আচ্ছা এমনি করে নৌকা বেয়ে আমরা যদি দুরে—অনেক দূরে পালিয়ে যাই। আর আশ্রমে কোন দিনও না ফিরি কেমন হয় বল তো–

সুধীরের কথায় সকলের মুখ যেন ভয়ে চুপসে এতটুকু হয়ে যায়।

গোবৰ্দ্ধন ভয়ে ভয়ে বলে, ওসব কী কথা সুধীর? সিংহী সাহেব তাহলে আর কাউকে জ্যান্ত রাখবে না।

সুধীর হাসতে হাসতে জবাব দেয়, কোথায় থাকবে তখন সিংহী, আমাদের নাগাল পেলে তো?

পরেশ একটু পেটুক, ঢোক গিলে প্রশ্ন করলে, পালিয়ে যে যাবে কারও কাছে তো পয়সা নেই, খাবে কি ক্ষিধে পেলে?

কেন? নদীর জল আর হাওয়া। অন্নান বদনে সুধীর জবাব দিল। তারপর হাসতে হাসতে বললে, ভয় নেইরে। পালাব না।

সত্যি বলছিস? পরেশ শুধায়।

হ্যাঁ, আর সত্যিই পালাতে যদি কোনদিন হয়ই, তবে একই পালাব সেদিন, তোদের ল্যাজে বেঁধে পালাবো না।

আশ্রম থেকে পালাবার কথা যে এমনি কথায় কথায় বলছিল সুধীর তা নয়।

সত্যিই আশ্রমে ঐ সিংহীর অত্যাচারে ও যেন হাঁপিয়ে উঠেছিল।

কেবলই মনে হতো। ওর আশ্রম থেকে পালিয়ে যায়। যে দিকে দুচোখ চলে যায়।

 

কথাটা কিন্তু চাপা রইল না। রাত্রে আশ্রম থেকে পালিয়ে গিয়ে নৌকায় বেড়ানোর কথা কেমন করে না জানি সিংহীর কানে গিয়ে উঠল।

পরের দিন সিংহীর ঘরে যখন সকলের ডাক পড়ল, সকলের বুকই ভয়ে দুর দূর করে কেঁপে উঠল।

ভয়ে সকলের মুখ চুপসে আমসির মত হয়ে গেল।

শুধু নির্বিকার সুধীর। তার যেন কিছুই নেই।

গোবৰ্দ্ধন এসে শুকনো গলায় বললে, কি হবে সুধীর? বে

শী আর কি হবে? কয়েকটা দিন অন্ধকার ঘরে বাস ও পিঠের উপর কয়েকটি করে বেত্ৰাঘাত!

সকলে যথা সময়ে বলির পাঠার মত কাঁপিতে কাঁপিতে সিংহীর ঘরের দিকে রওনা হলো।

সিংহী নিজের ঘরে ক্রুদ্ধ সিংহের মতই হাতদুটো পিছন করে পায়চারি করছিল। সকলে ঘরে ঢুকতে সিংহী ওদের দিকে তাকিয়ে কঠোর কণ্ঠে বললে, সব সার বেঁধে দাঁড়াও।

প্ৰথমে বিকাশের পালা। তার পিঠের উপর জোরে জোরে কয়েক ঘা বেত পড়তেই সে যন্ত্রণায় কেঁদে উঠলো।

সহসা এমন সময় সুধীর সিংহীর সামনে এসে গভীর স্বরে বললে, ওদের কোন দোষ নেই। স্যার। সব দোষ আমার। আমিই ওদের পরামর্শ দিয়ে। আশ্রমের বাইরে নিয়ে গিয়েছিলাম, মারতে হয় আমায় মারুন।

সিংহী ত্রুকুটি করে সুধীরের দিকে তাকাল, তারপর ব্যঙ্গ মিশ্রিত কণ্ঠে বললে, ও, তুই পালের গোদা all right —জানতাম, আমি জানতাম।

সিংহী নির্মম ভাবে সুধীরের সর্বাঙ্গে সজোরে বেত চালাতে লাগল।

সুধীর একটি শব্দ পর্যন্ত করলে না।

প্ৰায় পনের মিনিট ধরে বেত মারবার পর, সিংহী বললে, আজ যা কাল তোর বিচার হবে।

সকলে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

 

রাত্রি গভীর। আশ্রমের সকলেই যে যার বিছানায় অঘোরে ঘুমুচ্ছে।

সুধীর আস্তে আস্তে শয্যার উপর উঠে বসল।

নির্মম বেতের আঘাতে তার সর্বাঙ্গ তখনও বিষের জ্বালার মতই জ্বলছিল।

পাশেই অন্য শয্যায় শুয়ে ভিখু, বোধহয় অঘোরে ঘুমাচ্ছে।

দুপুরেই কারিগর এসে জানালার শিক ফ্রেম বদলে নূতন করে বসিয়ে দিয়ে গেছে। সুধীর একটা পুঁটলিতে কয়েকটা জামা কাপড় বেঁধে আস্তে আস্তে দরজাটা খুলে ঘরের বাইরে বারান্দায় এসে দাঁড়াল।

রাত্রির আঁধার চারিদিকে যেন গভীর মৌনতায় খাঁ খাঁ করছে।

বারান্দা থেকে সুধীর আশ্রমের আঙ্গিনায় এসে দাঁড়াল।

মাথার উপর রাতের আকাশ, শিয়রে তারার প্রদীপ জ্বলিয়ে শুধু একাকী জাগে। সমস্ত আশ্রমটা জুড়ে যেন গভীর ঘুমের চুলুনি নেমেছে। সুধীর একবার দাঁড়াল।

কত স্মৃতি বিজড়িত এতকালের আশ্রমটা যেন এক অদৃশ্য মায়ার বাঁধনে তাকে পিছন থেকে টানে।

এখানকার ঘর দুয়ার সঙ্গী সাখী মনে মনে সকলের কাছ থেকে সে বিদায় নেয়।

চোখের কোল দুটো জলে ভরে ওঠে। হাত দিয়ে সুধীর চোখ দুটো মুছে নিল।

তারপর ধীরে ধীরে সে আঙ্গিনাটা পার হয়ে গেটের দিকে এগিয়ে চলে।

গেটের কাছে এসে পুঁটলিটা মাটিতে নামিয়ে রেখে সে মালকোঁচা আঁটতে যাবে, এমন সময় তার কাঁধের উপর কার যেন হাতের স্পর্শ পেয়ে ও চমকে ফিরে তাকাল, পিছনে দাঁড়িয়ে ভিখু।

সুধীরের বিস্মিত কণ্ঠ চিরে একটা প্রশ্ন বেরিয়ে আসে, একি ভিখু?

হ্যাঁ আমি। কিন্তু তুমি এত রাত্রে কোথায় যাচ্ছ সুধীর?

চলে যাচ্ছি। ভাই এখান থেকে। যাক ভালই হলো? ইচ্ছা ছিল যাবার আগে তোকে বলে যাবো। কিন্তু সাহস হয়নি। পাছে তুই আমায় যেতে কোন রকম বাধা দিস।

তুমি যাচ্ছ? কিন্তু কেন চলে যাবে?

সুধীরের ওষ্ঠ্যপ্ৰান্তে করুণ একটু হাসি জেগে উঠল। বললে, এখানে আর আমি থাকতে পারলাম না ভিখু। দেখি এতবড় পৃথিবীতে এই আশ্রম ছাড়া আমার আর কোথাও স্থান মেলে। কিনা। এই আশ্রমের নিয়ম কানুন, এর অত্যাচারে আমার দম আটকে আসে। এ বন্দী জীবনে আমি অত্যন্ত হাঁপিয়ে উঠেছি। তাই চলে যাচ্ছি।

তারপর হঠাৎ ফিক করে একটুখানি হেসে বললে, সিংহীটা খুব জব্দ হবে, কাল যখন সকলে উঠে দেখবে যে খাঁচার পাখী পালিয়েছে, কি বলিস? আমার ভারী ইচ্ছা করছে তখন ওর মুখের চেহারাটা কেমন হয় একবার দেখবার জন্য। যাক আমার বদলে তোরাই দেখিস।

কোথায় যাবে? ভিখু জিজ্ঞাসা করে।

কোথায় যাবো? তা তো জানিনা। আর ভাবনাই বা কিসের? এতবড় দুনিয়ায় জায়গার অভাব হবে কি?

ভিখু চুপ করে থাকে। কোন জবাব দেয় না।

লোহার গেটের মাথায় সব ঘন সন্নিবেশিত ধারালো লোহার শিক বসান। সেই দিকে তাকিয়ে ভিখু প্রশ্ন করে, কিন্তু গেট পেরুবে কেমন করে?

সুধীর একটু হাসল। তারপর একটু এগিয়ে গিয়ে দারোয়ানের ঘরের পিছনের কামিনী গাছটার তলা থেকে পোল জাম্পের বড় বাঁশের ডাণ্ডাটা নিয়ে এল।

বাঁশটা দেখিয়ে বলে, এই দেখ, সন্ধ্যা বেলা লুকিয়ে এটা এখানে রেখে গিয়েছিলাম।

তারপর পুঁটলিটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে অক্লেশে সুধীর বাঁশের ডাণ্ডাটার উপর ভর দিয়ে গেটের ওপাশে গিয়ে ভল্ট দিয়ে লাফ দিয়ে পড়ল।

গেটের লোহার শিকের ফাঁক দিয়ে একটা হাত গলিয়ে ভিখুর একখানি হাত সস্নেহে চেপে ধরে ও বললে, এখানে দাঁড়িয়ে থাকিসনে, কেউ হঠাৎ দেখে ফেললে বিপদে পড়বি, যা ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়গে যা।

তুই দাঁড়া সুধীর আমিও তোর সঙ্গে যাবো। ভিখু বলে।

পাগলামি করিসনে ভিখু। —কোথায় যাবি আমার সঙ্গে?

তুই যেখানে যাবি।—

না ভাই তুই যা। আচ্ছা আসি-কেমন?

ভিখুর চোখের কোলে দু’ফোটা জল চিকচিক্‌ করে ওঠে।

ছি। ভিখু, তুই কঁদেছিস? কঁদেছিস কিরে বোকা ছেলে দুর—

ভিখু মুখ ফিরিয়ে নেয়।

সুধীর ধীরে ধীরে হাঁটতে আরম্ভ করে।

সহসা তারও চোখের কোল দুটো বুঝি জলে ঝাপসা হয়ে ওঠে।

সামনেই পায়ে চলার পথ রাতের আঁধারে থাম থম করছে।

হাত দিয়ে চোখ দুটো মুছে নিয়ে সুধীর দ্রুত চলতে থাকে। আস্তে আস্তে একসময় রাতের অস্পষ্ট আঁধারে সুধীরের ক্রম চলমান দেহখানি একটু একটু করে একেবারে অদৃশ্য হয়ে যায়।

ভিখু তখনো দাঁড়িয়ে গেটের অপর দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *