অদৃশ্য আততায়ী
সেই আগেকার পথ ধরেই সুব্রত আবার ফিরে চলেছে। আকাশে কাস্তের মত সরু এক ফালি চাদ জেগেছে, তারই ক্ষীণ জ্যোৎস্না শীতার্ত ধরণীর ওপরে যেন স্বপ্নের মতই একটা আলোক ওড়না বিছিয়ে দিয়েছে। পলাশ ও মহুয়া বনে গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে টুকরো টুকরো চাঁদের আলোর আলপনা। বনপথে যেন আলোর আলপনা ঢাকাই বুটি বুনে দিয়েছে। মাদল ও বাঁশীর শব্দ তখনও শোনা যায়।
সুব্রত অন্যমনস্ক ভাবেই ধীরে ধীরে পথ চলছিল, সহসা সোঁ করে কানের পাশে একটা তীব্র শব্দ জেগে উঠেই মিলিয়ে গেল। পরক্ষণেই স্তব্ধ আলোছায়া ঘেরা বনতল প্ৰকম্পিত করে বন্দুকের আওয়াজ জেগে উঠলঃ গুড়ুম।…এবং সঙ্গে সঙ্গে করে যেন আর্ত চীৎকার কানে এল। সুব্রত থমকে হতচকিত হয়ে থেমে গেল।
প্রথমটায় সে এতখানি বিচলিত ও বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল যে ব্যাপারটা যেন ভাল করে কোন কিছু বুঝে উঠতেই পারে নি। পরক্ষণেই নিজেকে নিজে সামলে নিয়ে, কোমরবন্ধে লোডেড রিভলভারটা ডান হাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরে যে দিক থেকে গুলির আওয়াজ শোনা গিয়েছিল। সেই দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল। কিছু দেখা যায় না বটে। তবে শুকনো পাতার ওপরে একটা ঝটপটির শব্দ শোনা যাচ্ছে।
সুব্রত রিভলভারটা মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরে টর্চটা জ্বালল এবং টর্চের আলো ফেলে সন্তপণে এগিয়ে গেল, শব্দটা যে দিক থেকে আসছিল। সেই দিকে।
অল্প খুঁজতেই সুব্রত দেখলে একটা পলাশ গাছের তলায় কে একটা লোক রক্তাক্ত অবস্থায় ছট্ফট্ করছে।
সুব্রত লোকটার গায়ে আলো ফেললে।
লোকটা একজন সাঁওতাল যুবক।
লোকটার ডানদিকের পাঁজরে গুলি লেগেছে।
তাজা লাল টকটকে রক্তে বনতলের মাটির অনেকটা সিক্ত হয়ে উঠেছে।
লোকটার পাশেই একটা সঁওতালী ধনুক ও কতকগুলো তাঁর পড়ে আছে।
সুব্রত লোকটার সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। কিন্তু সাঁওতালটাকে চিনতে পারল না।
লোকটা ততক্ষণে নিস্তেজ হয়ে প্ৰায় শেষ হয়ে এসেছে। দুএকবার ক্ষীণ অস্ফুট স্বরে কী যেন বিড় বিড় করে বলতে বলতে হতভাগ্য শেষ নিশ্বাস নিল।
সুব্রত নেড়ে চেড়ে দেখলে, শেষ হয়ে গেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস সুব্রতর বুকখানাকে কাঁপয়ে বের হয়ে গেল। সে উঠে দাঁড়াল। টর্চের আলো ফেলে ফেলে আশে পাশের বন ও ঝোঁপ ঝাড় দেখলে, কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না।
হতভাগা সাঁওতালটা বন্দুকের গুলি খেয়ে মরেছে এবং স্বকৰ্ণে সে বন্দুকের গুলির আওয়াজও শুনতে পেয়েছে।
কিন্তু কে মারলে? কেনই বা মারলে?
নানাবিধ প্রশ্ন সুব্রতর মাথার মধ্যে জট পাকাতে লাগল। কিন্তু এটা ঠিক, যেই মেরে থাক সে সশস্ত্ৰ।
অন্ধকার বনপথে সুব্রতর কাছে লোডেড রিভলভার থাকলেও সে একা। তার উপর এখানকার পথ ঘাট তার তেমন ভাল চেনা নয়। অলক্ষ্যে বিপদ আসতে কতক্ষণ? আর বিপদ যদি আচমকা অন্ধকার আশপাশ থেকে এসেই পড়ে। তবে তাকে ঠেকানও যাবে না। অথচ এত বড় একটা দায়িত্ব মাথায় নিয়ে এমনি করে বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকাটাও সমীচীন নয়। অতএব এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সরে পড়া যায় ততই মঙ্গল।
সুব্রত সজাগ হয়ে উঠল।
টর্চের আলো জ্বলে সতর্ক দৃষ্টিতে চারিদিকে দেখতে দেখতে সে এগিয়ে চলল।
কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার!
কেবলই একজনের পর একজন খুন হচ্ছে। কারা এমনি করে নৃশংসভাবে মানুষের প্রাণ নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে।
কিসের প্রয়োজনেই বা এমনি ভয়ঙ্কর খেলা? কিন্তু পথ চলতে একটু আগে যে সে করে শব্দটাকে সে কানের পাশে শুনেছিল সেটাই বা কিসের শব্দ?
কিসের শব্দ হতে পারে?
নানা রকম ভাবতে ভাবতে সুব্রত অন্ধকার শালবনের পথ ধরে যেন বেশ একটু দ্রুত পদেই অগ্রসর হতে থাকে। রাত্ৰি কটা বেজেছে কে জানে? আসবার সময় তাড়াতাড়িতে হাত-ঘড়িটা পর্যন্ত আনতে মনে নেই। খানিকটা দ্রুত হেঁটে শালবন পেরিয়ে সুব্রত পাহাড়ী নদীটার ধারে এসে নামল।
মাথার উপরে আকাশের বুকে ক্ষীণ চাঁদের আলোয় যেন একটা সূক্ষ্ম রূপালি পর্দা থির থির করে কাঁপছে। কোথাও কুয়াশার লেশ মাত্ৰ নাই। দুরে সাঁওতাল ধাওড়া থেকে একটানা একটা কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে।
শীতের পাহাড়ী নদী, একেবারে জল নেই বললেই হয়। অনেকটা পর্যন্ত শুধু বালি আর বালি। নদীটা হেঁটেই সুব্রত পার হয়ে গেল।
সামনেই একটা প্ৰান্তর। প্রান্তর অতিক্রম করে সুব্রত চলতে লাগল। আনমনে চিন্তা করতে করতে কতটা পথ সুব্ৰত এগিয়ে এসেছে তা টের পায়নি; সহসা অদূরে আবছা চাঁদের আলোয় প্রান্তরের মাঝখানে দৃষ্টি পড়তেই সুব্রত থমকে দাঁড়িয়ে গেল।
এখানে আসবার পরের দিন সন্ধ্যার দিকে প্ৰান্তরের মাঝে বেড়াতে বেড়াতে যে ভয়ঙ্কর মুর্তিটা দেখেছিল অবিকল সেই মূর্তিটাই যেন লম্বা লম্বা পা ফেলে ফেলে জনহীন মৃদু চন্দ্রালোকে প্রান্তরের ভিতর দিয়ে হেঁটে চলেছে। সুব্রত ক্ষণেক দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবল, তারপরই কোমরের লেদার কেস থেকে অটোমেটিক রিভলভারটা বের করে অদূরের সেই চলমান মূর্তিটাকে লক্ষ্য করে রিভলভারের ট্রিগার টিপল।
নির্জন প্ৰান্তরের অন্ধকারে একঝলক আগুনের শিখা উদগিরণ করে চারিদিকে ছড়িয়ে একটা আওয়াজ ওঠে-গুড়ুম।
সঙ্গে সঙ্গে প্ৰান্তরকে ভয়চকিত করে ক্ষুধিত শার্দুলের ভয়ঙ্কর ডাক শোনা গেল। পর পর তিন বার।
চমকে উঠতেই সুব্রত চকিতের জন্য চোখের পাতা দুটো বুজিয়ে ফেলেছিল; কিন্তু পরক্ষণেই যখন চোখের পাতা খুলল, দেখল। দ্রুত হাওয়ার মতোই সেই মূর্তি ক্ৰমে দূর থেকে দূরান্তরে মিলিয়ে যাচ্ছে।
মূর্তিটিকে যে জায়গায় দেখা গিয়েছিল। সেই দিকে লক্ষ্য করে সুব্রত রিভলভারটা হাতে নিয়ে দৌড়াল।
আন্দাজমত জায়গায় এসে পৌঁছে সুব্রত টর্চটা জেলে চারিদিকের মাটি ভাল করে লক্ষ্য করে দেখতে লাগল।
সহসা ও লক্ষ্য করলে প্ৰান্তরের শুকনো মাটির ওপরে তাজা রক্তের কয়েকটা ফোঁটা ইতস্তত দেখা যাচ্ছে।
রক্ত! তাজা রক্তের ফোঁটা! তাহলে সত্যিই ভূত নয়, দৈত্য দানব বা পিশাচ নয়। সামান্য রক্ত মাংসের দেহধারী মানুষ। কিন্তু জখম হয়নি। সামান্য আঘাত লেগেছে মাত্র। কিন্তু পালাবে কোথায়?
এই যে মাটির ওপরে রক্তের ফোঁটা ফেলে গেল এইটাই তার নিশানা দেবে। যেখানে যতদূর পালাক না কেন হাওয়ায় উবে যেতে পারবে না।
একদিন না একদিন ধরা দিতেই হবে। কেননা আঘাত যত সামান্য হোক না কেন, আহত হয়েছে। এ অবধারিত; এবং সেই জন্যই বেশী দূর পালান সম্ভব হবে না।
কিন্তু শার্দুলের ডাক!
ব্যাপারটা কী?
অবিকল শার্দুলের ডাক।
সহসা সোঁ-সাৎ করে একটা তীক্ষ্ণ শব্দ সুব্রতর কানের পাশে দিয়ে যেন বিদ্যুতের মত চকিতে মিলিয়ে গেল।
সুব্রত চমকে উঠে এক লাফে সরে দাঁড়াল। এবং সরে দাঁড়াতে গিয়েই পাশে অদূরে মাটির দিকে নজর পড়ল। একটা ছোট তীরের ফলা অর্ধেক মাটির বুকে প্রোথিত হয়ে থির থির করে কাঁপছে।
সুব্রত নীচু হয়ে হাত দিয়ে তীরটা ধরে একটান দিয়ে মাটির বুক থেকে তুলে নিল।
তীরের তীক্ষ্ণ চেপটা অগ্রভাগে মাটি জড়িয়ে গেছে। এতক্ষণে সুব্রত বুঝতে পারলে একটু আগে শালবনের মধ্যে অতর্কিতে যে শব্দ শুনেছিল সেও একটা তীর ছোটারই শব্দ এবং সেই তীরটাও তাকে মারবার জন্যই নিক্ষিপ্ত হয়েছিল বুঝতে আর কষ্ট হয় না।
শত্রুপক্ষ তাহলে সুব্রতর ওপরে বিশেষ নজর রেখেছে এবং তাকে মারবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। তীরটা হাতে নিয়ে সুব্রত সটান বাংলোর দিকে পা। চালিয়ে দিল।
সুব্রত এসে বাংলোয় যখন প্রবেশ করল, শংকর তখন ঘরে টেবিলের ওপরে এক রাশি কাগজপত্র ছড়িয়ে গভীর মনোযোগের সঙ্গে কী যেন দেখছে।
শংকর বাবু! সুব্রত ঘরের মধ্যে পা দিয়ে ডাকিল।
কে?…ও, সুব্রত বাবু? এত রাত করে, কোথায় ছিলেন এতক্ষণ—
একটু বেড়াতে গিয়েছিলাম ঐ নদীর দিকটায়।
সামনেই একটা বেতের চেয়ারে বসে পড়ে, সুব্রত পা দুটো টান করতে করতে বললে।
এতক্ষণ এই অন্ধকারে সেখানেই ছিলাম?
হ্যা–
কথাটা বলে সুব্রত হাতের তীরটা টেবিল ল্যাম্পের অত্যুজ্জ্বল আলোর সামনে উঁচু করে তুলে তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে পরীক্ষা করতে লাগল।
সুব্রতর হাতে তীরটা দেখে শংকর সবিস্ময়ে বললে, ওটা আবার কী? কোথায় পেলেন?
সুব্রত তীরটা গভীর মনোযোগের সঙ্গে পরীক্ষা করতে করতেই মৃদু স্বরে জবাব দিল, মাঠের মধ্যে কুড়িয়ে পেলাম।
মাঠের মধ্যে তাঁর কুড়িয়ে পেলেন? তার মানে? শংকর বিস্মিত স্বরে প্রশ্ন করল।
মানে আবার কী? কেন মাঠের মধ্যে একটা তাঁর কুড়িয়ে পেতে নেই নাকি?
শংকর এবারে হেসে ফেলল, তা তো আমি বলছি না; আসল ব্যাপারটা কী তাই জিজ্ঞাসা করলাম।
আমার কী মনে হয় জানেন? সুব্রত বললে শংকরের মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ।
কী?
এই তীরের ফলায় নিশ্চয়ই কোন তীব্ৰ বিষ মাখান আছে এবং সে বিষ সাধারণ কোন সুস্থ মানুষের শরীরের রক্তে প্ৰবেশ করলে কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মৃত্যু অবধারিত।
কি বলছেন সুব্রতবাবু?
শংকর জিজ্ঞাসু সুব্রতর মুখের দিকে তাকাল।
মনে হওয়ার কারণ আছে শংকরবাবু। সুব্রত গভীর স্বরে বললে।
বুঝতে পারছি না। ঠিক আপনার কথা সুব্রত বাবুকোন এক হতভাগ্যের উদেশে এই বিষাক্ত তাঁর নিক্ষেপ করে তার জীবনের ওপরে attempt করা হয়েছিল।
সর্বনাশ বলেন কী?
হ্যাঁ, কিন্তু তার আগে অর্থাৎ বিস্তারিত ভাবে আপনাকে সব কিছু বলবার আগে এক কাপ চা-দীর্ঘ পথ হেঁটে গলাটা শুকিয়ে গেছে।
O! Surely! এক্ষুনি। বলতে বলতে শংকর সামনের টেবিলের ওপরে রক্ষিত কলিং বেল টিপল।
ভৃত্য এসে খোলা দরজার ওপরে দাঁড়াল। সাহেব আমাকে ডাকছেন?
এই শীগগির সুব্রতবাবুকে এক কাপ গরম চা এনে দে।
আনছি। সাহেব। ভূত্য চলে গেল। ভৃত্যকে চায়ের আদেশ দিয়ে সুব্রতর দিকে তাকিয়ে শংকর দখলে, চেয়ারের ওপরে হেলান দিয়ে চোখ বুজে সুব্রত গভীর চিন্তামগ্ন হয়ে পড়েছে।