পুঁটলি রহস্য
সুব্রত এসে বাংলোয় নিজের ঘরে ঢুকল।
নানা এলোমেলো চিন্তায় সেও যেন দিশেহারা হয়ে পড়েছে। ব্যাপারটা নিছক একটা অ্যাকসিডেণ্ট না অন্য কিছু। কিন্তু সবচাইতে আশ্চর্য, লোক গেল কি করে খাদের মধ্যে।
নাঃ ব্যাপারটাকে যতটা সহজ ভাবা গিয়েছিল, এখন দেখা যাচ্ছে ঠিক ততটা নয়।
চাকরকে এককাপ গরম চা দিতে বলে শংকর ইজিচেয়ারটার ওপরে গাটা ঢেলে দিয়ে চোখ বুজে চিন্তা করতে লাগল।
চিন্তা করতে করতে কখন এক সময় জাগরণ-ক্লান্ত দুচোখের পাতায় ঘুমের চুলুনি নেমেছে তা ও টেরই পায়নি। ভৃত্যের ডাকে চোখ রাগড়াতে রগড়াতে উঠে বসল।
বাবুজি, চা।
ভৃত্যের হাত থেকে ধূমায়িত চায়ের কাপটা নিয়ে সামনের একটা টিপিয়ের ওপরে সুব্রত নামিয়ে রাখল।
তৃত্য ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।
খোলা জানোলা পথে রৌদ্র কলঙ্কিত শীতের সুন্দর প্রভাত। দূরে কালো পাহাড়ের অস্পষ্ট ইশারা। ওদিকে ট্রাম লাইনে পর-পর কয়খানা খালি টবগাড়ি-কয়েকটা সাঁওতাল যুবক সেখানে দাঁড়িয়ে জটলা পাকাচ্ছে। চা পান শেষ করে সুব্রত উঠে গিয়ে ঘরের দরজাটা এঁটে জামার পকেট থেকে খনির মধ্যে কুড়িয়ে পাওয়া ন্যাকড়ার ছোট্ট পুটলিটা বের করল।
একটা আধময়লা রুমালের ছোট পুঁটলি।
কম্পিত হস্তে সুব্রত পুঁটলিটা খুলে ফেলল।
পুঁটলিটা খুলতেই তার মধ্যকার কয়েকটা জিনিস চোখে পড়ল। একটা মাঝারি গোছের ডিনামাইট, একটা পলতে, একটা টর্চ!…
আশ্চর্য, এগুলো খনির মধ্যে কেমন করে গেল।
ডিনামাইট কেন?…সুব্রত ভাবতে লাগল। ডিনামাইট সাধারণতঃ খাদের মধ্যে বড় বড় কয়লার চাংড়া ধ্বসাবার জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সঙ্গে পলতেও একটা দেখা যাচ্ছে। এই ডিনামাইটের সঙ্গে পলতের সাহায্যে আগুন ধরিয়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বড় বড় কয়লার চাংড়া ধ্বসানোর সুবিধা হয়।
টর্চ।…এটা বোধ হয়। অন্ধকারে পথ দেখাবার জন্য। তবে কি কেউ গোপনে রাত্রে এই সব সরঞ্জাম নিয়ে খাদে গিয়েছিল কয়লার চাংড়া ধ্বসাতে?..নিশ্চয়ই তাই-কিন্তু ধ্বসাতেই যদি কেউ গিয়ে থাকবে। তবে, এগুলো সেখানে ফেলে এলো কেন?–তবে কি ধ্যবসায়নি? না ধ্বসিয়ে চলে এসেছিল?-কিন্তু এমনও তো হতে পারে আরো ডিনামাইট, আরো পলতে ছিল, একটায় যদি না হাসিল হয় তবে এটার দরকার হতে পারে এই ভেবে বেশী ডিনামাইট নিয়ে যাওয়া হয়েছিল? তারপর হয়ত একটাতেই কাজ হয়ে যেত, এটার আর দরকার হয়নি, তাড়াতাড়িতে এটা ফেলেই চলে এসেছে।—কিন্তু কোন পথ দিয়ে লোকটা খনির মধ্যে ঢুকল। ঢুকবার তো মাত্র একটিই পথ। চানকের সাহায্যে! চানকের চাবী কার কাছে থাকে? আবদুল মিস্ত্রি বললে তার কাছেই থাকে। চাবীটা এমন কোন মূল্যবান চাবী নয়, বা কোন প্রাইভেট ঘরের চাবী নয়, সামান্য চানকের চাবী।-চাবীটা রাত্রে চুরি করা এমন কোন কঠিন ব্যাপার নয়। এবং কাজ শেষ হয়ে যাবার পর যথাস্থানে চাবীটা আবার রেখে আসাও দুঃসাধ্য ব্যাপার নয়…তাহলে দেখা যাচ্ছে ভূত নয়। মানুষেরই কাজ। কিন্তু এর সঙ্গে লোকগুলো মারা যাবার কী সম্পর্ক আছে? তবে কি।–সহসা চিন্তার সূত্র ধরে একটা কথা সুব্রতর মনের কোঠায় এসে উঁকি দিতেই, সুব্রতর মুখটা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। নিশ্চয়ই তাই।–কিন্তু রুমালটা? রুমালটা কার?–সুব্রত রুমালখানি সজাগ দৃষ্টির সামনে তুলে ধরে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করতে লাগল।
রুমালখানি আকারে ছোটই। হাতে সেলাই করা সাধারণ লংকুথের টুকরো দিয়ে তৈরী রুমাল। রুমালে একধারে ছোট অক্ষরে লাল সূতায় ইংরাজি অক্ষর S, C.
এক কোণে ধোপার চিহ্ন রয়েছে।…
সুব্রতর মাথার মধ্যে চিন্তাজাল জন্ট পাকাতে লাগল। কবি রুমাল! কার রুমাল! S, C নামের। initial যার তার পুরো নাম কি হতে পারে? শশাঙ্ক, শংকর, শশধর, শরদিন্দু, শরৎ, শশি, শচীন, শৈলেশ কিংবা সনৎ, সুকুমার, সমীর, সুধাময়। কে! কে! কিন্তু এমনও তো হতে পারে অন্য কারো রুমাল চুরি করে আনা হয়েছিল, তবে?
…সব যেন কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। যোগসূত্র এলোমেলো হয়ে কেমন যেন জট পাকিয়ে যায়। হ্যাঁ, ঠিক ঠিক…আসতেই হবে! সে আসবে! আসবে!
অবশ্যম্ভাবী একটা আশু ঘটনার সম্ভাবনায় সুব্রতর সর্বশরীর সহসা যেন রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে!
সুব্ৰত চেয়ার ছেড়ে ওঠে, ঘরের মধ্যে পায়চারী শুরু করে দেয় দীর্ঘ পা ফেলে ফেলে।
বাইরে গোলমাল শোনা গেল।
পুলিশের লোক এসে গেছে অদূরবর্তি কাতরাসগড় স্টেশন থেকে।
চঞ্চলপদে পুঁটলিটা আবার পূর্বের মত বেঁধে সুব্রত সেটা নিজের সুটকেসের মধ্যে ভরে রেখে দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে এল।
দারোগাবাবু সকলের জবানবন্দী নিয়ে, ধাওড়ার লাস ময়না তদন্তের জন্য চালান দিয়ে খাদের লাসগুলো উদ্ধারের একটা আশু ব্যবস্থা করবার জন্য শংকরবাবুকে আদেশ দিয়ে চলে গেলেন।
সুব্রত যাবার সময় তার পরিচয় দিয়ে দারোগাবাবুকে অনুরোধ জানাল : এখানে ইতিপূর্বে যে সব ম্যানেজারবাবু খুন হয়েছেন তঁদের ময়না তদন্তের রিপোর্টগুলো সংক্ষেপে মোটামুটি যদি জানান। তবে তার বড্ড উপকার হয়। দারোগাবাবু সুব্রতর পরিচয় পেয়ে অত্যন্ত খুশী হলেন এবং যাবার সময় বলে গেলেন, নিশ্চয়ই, একথা বলতে। আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে কত যে খুশী হলাম। কালই আপনাকে রিপোর্ট একটা মোটামুটি সংগ্রহ করে লিখে পাঠাব।
সুব্রত বললে, আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। পুলিশের লোক হয়েও যে আপনি এত উদার, সত্যই আশ্চর্যের বিষয়। কিরিটী যদি এখানে আসে। তবে নিশ্চয়ই আপনার কাছে সংবাদ পাঠাবো। এসে আলাপ করবেন। আচ্ছা! নমস্কার।