হেমাঙ্গর ঘরবাড়ি

হেমাঙ্গর ঘরবাড়ি

রবিবার সকাল থেকেই হেমাঙ্গর দু হাত ভরে কাজ। অবসর পায় না। সকালে দু চার গাল মুড়ি আর গ্লাসটাক চা খেয়ে হেমাঙ্গ কাজে নেমে পড়ে। প্রথমে ঘরদোর পরিষ্কর করা, ঝুল ঝাড়া। বাড়িটা বাবার আমলের। একতলা। ছোট বড় মিলিয়ে গোটা চারেক ঘর। মাথায় টালির ছাদ। তলায় সিলিং। আগে চটের সিলিং ছিল। পোকা মাকড় ইঁদুরে উত্যক্ত হয়ে হেমাঙ্গ চট ফেলে প্লাইউডের সিলিং লাগিয়ে নিয়েছে।

এই বাড়ির ওপর হেমাঙ্গর বড় মায়া। কেন, কী জন্যে বোঝা যায় না। হেমাঙ্গর কেউ নেই, বাবা নয়, মা নয়; বউ বাচ্চাও নেই। তবু মায়া। প্রতি রবিবার নিজের হাতে ঘরদোর পরিষ্কার করে; প্রতি বছর বর্ষা কেটে গেলে পুজোর পর টালি মেরামত করায়, দরজা জানলার খড়খড়ির কাঠকুটো পালটায়।

রবিবার সকালে ঘর দিয়ে শুরু করে হেমাঙ্গ। অনেকটা সময় চলে যায়। তারপর বসে তার সাইকেল নিয়ে। চাকার টাল, হ্যাণ্ডেলের ঢিলেমি, ব্রেক-ট্রেক সবই নিজের হাতে শুধরে নেয় হেমাঙ্গ, পাংচার সারাই করে—তারপর হাওয়া-টাওয়া দিয়ে, ঝেড়েঝুড়ে রেখে দেয় মাঝের ঘরে।

সাইকেল সারাইয়ের পর নেমে যায় বাগানে। তেমন কিছু বাগান নয়, বাড়ির সামনে মামুলি কিছু ফুলগাছ; জবাব, করবী, বেল, দু চারটে লতাপাতা। পেছনের দিকে পেঁপে আর কলাঝোপ। একটা বাতাবি লেবুও মস্ত বড় হয়ে উঠেছে; অথচ ফল ধরে না।

বাগানের কাজ সেরে হেমাঙ্গ হাতমুখটা ধুয়ে নেয়। জলখাবার খায় ভেতর বারান্দায় বসে। মোটা মোটা রুটি গোটা দুই, ডাল কিংবা কুমড়ো ভাজা। গ্লাসটাক চা খায়। খেতে খেতে ঝিমলিকে দু চারটে উপদেশ দেয় কাজকর্মের।

ঝিমলি এ বাড়ির সব। রান্নাবান্না করে, বাসনকোসন মাজে, ঘরদোর ঝাঁট দেয়, সারাদিন ফাঁকা বাড়িটার পাহারাদারি করে। ঝিমলি তার মায়ের সঙ্গে কোলিয়ারির সাইডিংয়ে কয়লা বোঝাই করত একসময়। টব্ গাড়িতে পায়ের আঙুল উড়ে যায়। মেয়েটা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল। বাঁ পায়ে খুঁত, খোঁড়া মতন। লাঠি নিয়ে হাঁটাচলা। ঝিমলির মা মারা যাবার পর থেকেই সে এখানে। হেমাঙ্গ তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে কাজের মানুষ করে নিয়েছে। এ বাড়িতেই সে আজ পাঁচ-সাত বছর।

বরাদ্দ সিগারেটটা শেষ করে হেমাঙ্গ সোজা চলে যায় কুয়োতলায়। নেড়িকে ডগ্ সোপ মাখিয়ে রবিরারের স্নান করাবে। রবিবারের স্নানপর্ব কোনোদিনই নেড়ির পছন্দ নয়, কিন্তু হেমাঙ্গর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া তার সাধ্যে কুলোয় না।

নেড়িকে স্নান করাতে করাতে হেমাঙ্গ তার সাধের কুকুরের সঙ্গে কথা বলবে: “নেড়ু, তুই বেটা মোটা হচ্ছিস না কেন রে? খাচ্ছিস দাচ্ছিস, লাটের মতন পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিস, তবু তোর এই হাড়গিলে চেহারা! ছো ছো—লোকে বলবে কী? মাংস-টাংস খেলে পালবাবুদের ডালকুত্তার মতন হতে পারতিস। কিন্তু এটা বোস্টমের বাড়ি, বুঝিল? নো মিট, নো এগ…। মাঝে মাঝে ফিশ।…নেড়ু, আমার মাংস ডিম খাওয়া বারণ ছিল অসুখের জন্যে। না খেতে খেতে অভ্যেস চলে গেছে। এখন পিঁয়াজ রসুনের গন্ধ পর্যন্ত সহ্য করতে পারি না। …তুই নেড়ু, বিলেতে জন্মাসনি—এখানে জন্মেছিস বেটা, ডালভাত খেয়ে তাগড়া হতে পারিস না? ঝিমলি কী খায় রে হারামজাদা? ও কেমন তাগড়া হচ্ছে দেখিস না?”

নেড়ি হেমাঙ্গর সঙ্গে বাক্যালাপে যোগ দেয় না। মাঝে মাঝে আকাশের দিকে মুখ তুলে বোধ হয় সকরুণ মিনতি জানায় ছেড়ে দেবার। ছাড়া পেলেই রোদে গিয়ে গা ঝাড়ে।

এরপর হেমাঙ্গ বসে নিজের কাপড়-চোপড় নিয়ে। ঝিমলি সোডাসাবানে ফোটানো জামাকাপড়ের বালতিটা রেখে দিয়ে যায় কুয়োতলায়। হেমাঙ্গ আরও খানিকটা বার সাবান নিয়ে কাপড়, জামা, চাদর কাচতে বসে পড়ে। নিজের কাপড়-চোপড় নিজেকেই কেচে নিতে হয় হেমাঙ্গর। এখানকার কোনো ধোপী তার কাপড় নেবে না। কোনো লন্ড্রিঅলাও নয়।

আজ বছর দশ হেমাঙ্গ এক আশ্চর্য ব্যাধিতে ভুগছে। ব্যাপারটা কী জানে না। অন্যেও নয়। বাবা ছেলের বিয়ে দিয়ে সবে মারা গেছেন। মা বেঁচে। হেমাঙ্গ তার নতুন বউ নিয়ে তখন খুব রসকষে মেতে আছে। সকাল থেকেই পেছনে লেগে আছে বউয়ের। দুপুরটুকু অফিস। বিকেলে ফিরে এসে কোনোদিন ‘দেশবন্ধু সিনেমা’, কোনোদিন নতুন রেকর্ড কিনে এনে গ্রামোফোনো বাজানো, মাঝে মাঝে এস্রাজ টেনে নিয়ে বউকে শেখানোর চেষ্টা। ওরই মধ্যে লুকিয়ে চুরিয়ে বাজার থেকে এনে দিচ্ছে বউকে, বোম্বাইঅলার মিঠাই, দু একটা পলকা গয়নাও গড়িয়ে দিচ্ছে। একেবারে তরতরে ঝরঝরে জীবন।

হঠাৎ একদিন হেমাঙ্গর নজরে পড়ল তার গায়ে মুখে কেমন সাদা সাদা ফুটেছে।

“এই দেখো তো, এগুলো কী?”

হেমাঙ্গর বউ ভাল করে দেখলেও না। পান খাচ্ছিল। বরের মুখের সামনে হাঁ করে শ্বাস ছেড়ে বলল, কিচ্ছু না।

হেমাঙ্গর বুকের মধ্যে ঘ্রাণ চলে গিয়েছিল পানের আর মুখের। বউয়ের গাল টিপে টেনে নিয়ে শুয়ে পড়ল।

এইভাবে শুরু। দাগগুলো ক্রমশ ছড়াতে লাগল, বাড়তে লাগল।

হেমাঙ্গর মন খুঁতখুঁত শুরু হল। সারা দিনই নিজে দেখে, বউকে দেখায়। “কী করি বলো তো? এ যে বেড়েই যাচ্ছে। কুষ্ঠ-টুষ্ঠ হবে নাকি?”

বউ এখন আর উপেক্ষা করতে পারল না। মুখ ভারি করে বলল, “ডাক্তার দেখাও।”

মা বলল, “নিমজলে চান কর, নিমতেল মাখ, সেরে যাবে।”

নিমতেল, নিমসাবান, চন্দন, শাঁখের গুঁড়ো যখন চলছে মা মারা গেল। মা মারা যাবার পর হেমাঙ্গ নিজের দিকে তাকাতেই ভয় পেত। সর্বাঙ্গে রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, কবিরাজী কিছুই বাদ নেই—তবু গায়ের চামড়া সাদা হয়ে গেল। এ-এক অদ্ভুত সাদা রঙ, গাছের ওপরকার ছাল ছাড়িয়ে ফেললে যেমন দেখায় অনেকটা সেই রকম।

হেমাঙ্গর বউ ততদিনে সাবধান হয়ে গিয়েছে। ঘন ঘন বাপের বাড়ি যায়। ফেরার সময় একজনকে সঙ্গে নিয়ে আসে, কোন এক দাদা-টাদা।

হেমাঙ্গর বউ বলল, “তুমি একবার কলকাতায় যাও। দেখিয়ে এস।”

কলকাতায় যাবার মতনই অবস্থা তখন হেমাঙ্গর। মাথার চুল সাদা হয়ে যাচ্ছে সব। ভুরু সাদা। চোখের পালক সাদা। মুখ, হাত, পা সবই শ্বেত। ঠোঁট দুটো যেন আগুনে ঝলসে যাবার মতন রঙ ধরেছে।

হেমাঙ্গ কলকাতায় গেল।

দিন চার পাঁচ. পরে ফিরে এসে দেখল পায়রা চলে গেছে। হেমাঙ্গর বউয়ের ডাক নাম ছিল পায়রা। ভাল নাম সন্ধ্যামণি। বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার সময় পায়রা দু-লাইন চিঠি লিখে রেখে গেছে। “তোমার সঙ্গে আমি আর থাকতে পারি না। শুতে পারি না তোমার পাশে। তাকাতে পারি না। আমার গা ঘিনঘিন করে। বমি আসে।”

পায়রা চলে যাবার পর হেমাঙ্গ ঘরে বসে কেঁদেছিল খুব। বছর আড়াই তিন, তার মধ্যে হেমাঙ্গ কোথা থেকে কোথায় নেমে এল। হেমাঙ্গর চেহারায় আর কোনো স্বাভাবিকতা নেই। গায়ের লোমগুলো পর্যন্ত সাদা হয়ে গেছে। পায়রা যে চলে যাবে হেমাঙ্গ কিছুদিন ধরেই আঁচ করতে পারছিল। কার সঙ্গে যাবে তাও সে বুঝতে পেরছিল। কিন্তু খুবই আশ্চর্য, হালে, পায়রার পেটে ডিম এসেছিল। কার ডিম? কী হবে তার—? কেমন হবে সে? ভগবানের কাছে মনে মনে প্রার্থনা করল হেমাঙ্গ।

তখন থেকেই হেমাঙ্গ একা। বাড়িতে, বাড়ির বাইরেও। ঝিমলি পরে এসেছে। নেড়ি আরও অনেক পরে।

মানুষ একে একে সবই সয়ে নেয়। হেমাঙ্গও নিয়েছিল। শান্ত ভাবে। বাইরের সঙ্গে তার একটু-আধটু সম্পর্ক না রাখলেই নয় বলে রেখেছিল, নয়ত পেট চলবে না। অফিসে যেত। মাইল দেড়েক দূর। ব্যাধিটা প্রকট হবার পর তার আগের অফিস থেকে তাকে সরিয়ে নিয়েছিল, নিয়ে এমন এক জায়গায় পাঠিয়ে দিয়েছিল যেখানে তিন-চারটি মাত্র লোক। কাজ প্রায় কিছুই ছিল না। চুপচাপ বসে থাকা, মাঝে মাঝে চাপরাসি গোছের দু তিন জনকে স্টোর খুলে তেল-টেল বার করে নিতে বলা, হিসেব লেখা। ম্যালেরিয়া কনট্রোলের এই ডিপোয় বসে দিন কেটে যাচ্ছিল হেমাঙ্গর।

হেমাঙ্গ জানত অফিসে তার দিন এই ভাবেই কেটে যাবে। চেয়ারে বসে, কখনও খোলা জানলা দিয়ে বনতুলসীর জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে, কখনও ফাঁকা: আকাশ কিংবা মেঘের পাল দেখে। অফিসের চেয়ার টেবিল কাঠের সস্তা একটা আলমারি অস্পৃশ্যের মতন পড়ে থাকে, স্পর্শ করে না কেউ। সাইকেলটা রাখা থাকে বাইরে। কেউ ছোঁয় না। নিজের হাতে জল নিয়ে খায় হেমাঙ্গ, নিজের হাতে গ্লাস ধোয়। দুপুরের টিফিন খেয়ে কৌটোটা ধুয়ে রেখে দেয় টেবিলে।

এই অফিস ওই বাড়ি। অফিসে একরকম একাই। বাড়িতেও তাই। বাড়িতে অবশ্য ঝিমলি আছে, নেড়ি আছে। একা বইকি!

হেমাঙ্গ এখানকার পুরনো লোক। চেনাজানা সবাই। কাকা, দাদা, মাসিমা, পিসিমা বলার লোক অগুনতি, বন্ধুবান্ধবও কম ছিল না। এখন কেউ নেই। হেমাঙ্গ নিজেই বুঝতে পেরেছিল—তার কাছ থেকে লোকজন সমাজ সামাজিকতা সরে যেতে চাইছে, অন্তত আড়ষ্ট বোধ করছে কাছাকাছি থাকতে, বুঝেসুঝে হেমাঙ্গ নিজেই সরে এল। বাড়ির মধ্যে গুটিয়ে ফেলল নিজেকে। বাইরের সঙ্গে সম্পর্ক যেটুকু না রাখলে নয় মাত্র সেইটুকুই রাখল। বাজারে যেতে হয়, অফিস ছুটতে হয়, কেউ মারা-টারা গেলে একবার তার বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হয়—এ রকম সম্পর্ক সে রেখেছিল। বিয়ে-টিয়েতে তার নেমন্তন্ন থাকত মাঝে মাঝে। হেমাঙ্গ জানত, ওটা ভদ্রতা—আন্তরিকতা নয়। হেমাঙ্গও ভদ্রতা রক্ষা করত, পোস্ট অফিসে গিয়ে পনেরো-বিশ টাকা মনি অর্ডার করে দিত।

শুধু একজন হেমাঙ্গকে হঠাৎ হঠাৎ এসে চমকে দিয়ে যেত। বিলাস, হেমাঙ্গর বন্ধু। বয়েসের বন্ধু নয়, একটু ছোটই বয়েসে। মাইল তিরিশ দূরে ব্যারাকে কাজ করত। বিলাস মাঝে মাঝে আসত মোটর বাইকে ঝড় তুলে। এসেই চেঁচাত, “হেমদা, আমার দুটো ডবল ডিমের ওমলেট চাই, গোটা চারেক রুটি, দু কাপ চা। ভীষণ খিদে পেয়েছে।”

হেমাঙ্গ চাইত না বিলাস আসুক। চমৎকার ছেলে বিলাস, তাজা বাঘের মতন চেহারা, টগবগ করছে। বিয়ে করেনি। বছর চৌত্রিশ বয়েস হয়ে গেল। হেমাঙ্গ অস্বস্তি বোধ করত। কিন্তু কে ঠেকাবে বিলাসকে।

কাছেই মতিয়ার দোকান। ঝিমলি গিয়ে ডিম কিনে আনত, ওমলেট বানাবে।

এই বিলাসই মাঝে মাঝে বলত, “হেমদা আমায় কে একজন বলেছিল—সাপে কামড়াবার পর নাকি কারও কারও এই রকম হতে দেখা যায়। এতটা নয়। তোমায় না একবার সাপে কামড়েছিল?”

হেমাঙ্গকে একবার সাপে কামড়েছিল বিয়ের আগের বছর। ওষুধ ইনজেকশান কম হয়নি। তবে এটা সাপের কামড়ের ফল না অন্য কিছু হেমাঙ্গ জানে না। কেই বা জানে!

এই বিলাসই মাঝে মাঝে রবিবার চলে আসত। দেখত, হেমাঙ্গ তার বাড়ি, বাগান, সাইকেল, গ্রামোফোন, কুকুর আরও কত কী নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে।

বিলাস হেসে বলত, “আচ্ছা হেমদা, তোমার এই স্থাবর অস্থাবর জঙ্গম সম্পত্তি মানে পদার্থগুলো কি তুমি যাবার সময় বুকিং করে স্বর্গে নিয়ে যাবে? কিসের পরোয়া তোমার! তুমি মরে গেলে এ-শালা তো ভূতের বাড়ি হবে, পাঁচ ভূতে ঠ্যাং দুলিয়ে নাচবে! তুমি কেন এই বাড়ি-ফাড়ি নিয়ে এত মায়া করো?”

কথাটা মিথ্যে নয়, তবু হেমাঙ্গর পছন্দ হত না, ভাল লাগত না শুনতে। স্পষ্ট কোনো জবাব দিত না, বলত, “এই নিয়েই তো আছি রে! নিজের জিনিস নিজে না দেখলে চলে…।”

“নিজের জিনিস দেখার জন্যে তুমি যেন বসে থাকবে?”

হেমাঙ্গ জবাব দিত না।

হেমাঙ্গ নিজের জিনিসই দেখত: তার বাড়ি, ঘর দোর, তার বাগান, তার সাইকেল, গ্রামোফোন, তার যা কিছু এখনও তার অধিকারে আছে—সব।

এই ভাবেই চলে যাচ্ছিল হেমাঙ্গর। রবিবার বাদে অন্যান্য দিন সে তেমন করে নিজেকে বাড়ি এবং প্রতিটি খুঁটিনাটির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারত না, অবসর পেত না। রবিবার হেমাঙ্গ সকাল থেকে বসত, কাজকর্ম সেরে স্নান খাওয়া দাওয়া সারতে দুপুর। দুপুরের পর খানিকটা গড়াত বিছানায়। বিকেলে কাপড়-চোপড় তুলে নিয়ে ইস্ত্রি করতে বসত। তারপরে সন্ধের মুখে রামসোহাগের দোকানে চলে যেত শিশি হাতে দিশি মদ কিনে আনতে।

বাড়ি ফিরে এসে হেমাঙ্গ নেশা নিয়ে বসত। কোনো কোনো দিন গ্রামোফোনে তার পুরোনো রেকর্ডগুলো বাজাত, কোনো কোনোদিন এস্রাজটাকে সুরে তুলতে চাইত, পারত, পারত না। নেশা কানায় কানায় পৌঁছে গেলে হেমাঙ্গ তার সাবেকি বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ডান হাতটা যতদূর পারে ছড়িয়ে দিত, যেন কাউকে হাত বাড়িয়ে ছোঁয়ার কিংবা ধরার চেষ্টা করছে।

আরও রাত হলে ঝিমলি এসে দাঁড়াত। ডাকাত, “বাবু—এ বাবু।”

হেমাঙ্গ মাতলামি করত না। উঠত। খাওয়া সারত। তারপর বিছানায় এসে শুয়ে পড়ত।

মাঝ কিংবা শেষ রাতে ভাঙা ঘুমের মধ্যে হেমাঙ্গ কেমন স্বপ্নের ঘোরে দু হাতে বিছানা হাতড়াত, ভাবত কেউ যেন পাশে এসে রয়েছে। কেউ আসত না।

আবার ঘুমিয়ে পড়ত হেমাঙ্গ।

দুই

রবিবারে দক্ষিণ দিকের বারান্দায় বসে সাইকেল সারাচ্ছিল হেমাঙ্গ। কার্তিক মাস। শীত নামছে। রোদে বসে সাইকেল সারাতে সারাতে হেমাঙ্গ কাঠের ফটক খোলার শব্দ পেল। এখান থেকে দেখা যায় না। হেমাঙ্গ কিছু দেখতে পেল না। বিলাস নয়। বিলাস হলে মোটর বাইকের শব্দটাই আগে কানে পড়ত।

ঝিমলির কাছে এসেছে কেউ। দু চার জন দেহাতি আসে মাঝে মাঝে লাউ, কুমড়ো, বেগুন কিংবা আরও কিছু বেচতে। নদীর চুনো মাছও হতে পারে।

হেমাঙ্গ সাইকেল নিয়ে মেতে থাকতে থাকতে শুনল নেড়ি চেঁচাচ্ছে। দু চার বার চেঁচাবে, তারপর থেমে যাবে। ঝিমলি লাউ, কুমড়ো কচু, কখনও কখনও চুনো মাছ কিনবে। নেড়ি বেটা মাছের গন্ধও বুঝতে পারে।

ঝিমলির কাছে যারা আসে সোজা পেছনে রান্নাঘরের দিকে চলে আসে। কেউ এল না। এলে হেমাঙ্গ দেখতে পেত।

নেড়ি সমানে চেঁচাচ্ছে।

হেমাঙ্গ সাইকেল রেখে উঠল। বাইরের বারান্দায় এসে দেখল, ফটকের বাইরে রাস্তায় টাঙা দাঁড়িয়ে, একটি বউ আর মেয়ে ফটকের সামনে থমকে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

হেমাঙ্গ অবাক হল। বুঝতে পারল না।

বাগান দিয়ে ফটকের কাছে চলে এল হেমাঙ্গ। নেড়িকে ধমক দিল।

কাছে এসে তাকাতেই হেমাঙ্গ কেমন চমকে উঠল। পায়রা নাকি? চেনা যায় না মুখের আদলই যেন বদলে গেছে। তবু পায়রা বলেই মনে হচ্ছে।

মানুষ যেভাবে চোখের ওপর হাত আড়াল করে সুর্যের গ্রহণ দেখে অনেকটা সেইভাবে হেমাঙ্গ বউটির মুখ দেখতে লাগল। “কে?”

“আমি”, হেমাঙ্গকেও দেখছিল বউটি।

“পায়রা?”

মাথা নোয়াল পায়রা।

হেমাঙ্গর পা কাঁপছিল, হাত কাঁপছিল। বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ড ঘা মারছিল। পিঠ নুয়ে আসছিল, মেরুদণ্ডে টনটনে ব্যথা।

হেমাঙ্গ ফটক খুলতে গিয়ে দেখল, ওপরের আঙটা খোলা, পায়রা ফটক খুলে ঢুকেছিল—নেড়ির চেঁচানিতে ভয় পেয়ে, আবার পিছিয়ে গেছে।

“এসো,” হেমাঙ্গ ডাকল। ডেকে বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে থাকল।

পায়রা পা বাড়াল, মেয়েটির হাত ধরে বলল, “টাঙায় আমার বাক্স পুঁটলি রয়েছে।”

“নামিয়ে নেব। তুমি এস।….তোমার মেয়ে?”

পায়রা মেয়েটিকে বলল, “প্রণাম করো।”

মেয়েটি পায়রার হাত চেপে ধরে হেমাঙ্গকে দেখছিল, ভীষণ ভয়ে ভয়ে চোখ বড় বড়।

হেমাঙ্গ বলল, “পরে হবে। তোমরা ভেতরে এস। টাঙাঅলাকে ছেড়ে দি আগে।”

পায়রা মেয়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকল বাগানে। নেড়ি তফাতে দাঁড়িয়ে চেঁচাতে লাগল। ঝিমলিও কখন বাইরে বেরিয়ে এসেছে। লাঠি ছাড়া হাঁটতে পারে না। দেখছিল পায়রাদের।

টাঙা ছেড়ে দিল হেমাঙ্গ। বাক্স পুঁটলি ঘরে নিয়ে গিয়ে রাখল। তারপর পায়রাদের ডাকল, “ঘরে এসো।”

কথাবার্তা বিশেষ কিছু হল না। পায়রা বলতে যাচ্ছিল। হেমাঙ্গ বলল, “পরে হবে। ট্রেনে এসেছ বললে। জিরোও। কাপড়চোপড় ছাড়। কিছু খাও। পরে শুনব।”

রবিবারটা অন্যরকম হয়ে গেল হেমাঙ্গর। জল তুলে দিল কুয়ো থেকে, পায়রা আর তার মেয়ে স্নান করবে। নতুন সাবান বার করে দিল। ঝিমলিকে বলল, আবার করে রান্না চাপাতে, শাক সবজি রাঁধতে বেশি করে। মাঝের ঘরে বাবার আমলের খাট পড়ে ছিল। পুরনো শতরঞ্জি চাপা দেওয়া। সেটা পরিষ্কার করে রাখল।

নিজে স্নান করে, মেয়েকে স্নান করিয়ে পায়রা রোদে এসে দাঁড়াল। এলো ভিজে চুল পিঠের ওপর ছড়ানো। সামনের দিকের অনেক চুল পেকে গেছে পায়রার। কানের পাশেও সাদা হয়েছে। মুখ ভারি, ফোলা, গালে দাগ ধরেছে। শরীরটাও বেশ ভারি লাগছিল। হেমাঙ্গর চেয়ে বছর পাঁচেকের ছোট ছিল পায়রা। হেমাঙ্গর এখন বছর বিয়াল্লিশ বয়েস। পায়রার ছত্রিশ সাঁইত্রিশ। এই বয়েসেই পায়রার এত চুল পাকল কী করে, শরীরটাই বা এমন ভারি হয়ে উঠল কেন—হেমাঙ্গ বুঝতে পারল না। যুবতী বয়সে পায়রার চেহারা ছিল ছিপছিপে, গালটাল উঁচু ছিল, দাঁত ছিল ধবধবে। এখন একেবারে গোল। দাঁতে ছোপ ধরে ধরে কালচে দাগ হয়েছে।

হেমাঙ্গ কুয়োতলায় বসে তাড়াতাড়ি কাপড়জামা কেচে নিচ্ছিল। পায়রা এসে দাঁড়াল।

হেমাঙ্গ চাদর কাচতে কাচতে বলল, “তোমার মেয়ের নাম কী?

“পুতুল।”

“কত বয়েস হল?”

“ন’ শেষ করেছে।”

হেমাঙ্গ একবার সামনের দিকে তাকাল।

আতা গাছের ডালে শালিক বসে একটা।

“কোথায় ও?” হেমাঙ্গ জিজ্ঞেস করল।

“ওই তো—ওদিকে দাঁড়িয়ে আছে। কাশি হয়েছে ঠাণ্ডা লেগে।”

“আহা—রে! ওকে ঠাণ্ডা জলে চান করালে কেন? ঝিমলিকে বললেই গরম জল করে দিত।”

পায়রার সাদা খোলের শাড়ির ঝোলানো আঁচল মাটিতে পড়ছিল। তুলে নিতে নিতে বলল, “রোদে জলে পড়ে থেকেছে, সয়ে গেছে সব। কিছু হবে না। সেরে যাবে।”

হেমাঙ্গ পায়রার মুখের দিকে তাকাল। ঠাণ্ডা, নিস্পৃহ, উদাসীন মুখ।

দুপুরেও হেমাঙ্গ এড়িয়ে গেল পায়রাকে, যেন তার কোনো ব্যস্ততা নেই, কৌতূহল নেই পায়রার কথাবার্তা শোনার। পরে শোনা যাবে। এখন এই দুপুরে একটু ঘুমিয়ে-টুমিয়ে নিক পায়রা। সারারাত রেলে এসেছে, প্যাসেঞ্জার গাড়ি তো! সে জানে কী ভিড়।

পায়রা ঘুমোল না। মাঝের ঘরে শ্বশুরের পুরনো খাটে মেয়ে নিয়ে শুয়ে থাকল। হেমাঙ্গ তেমন কিছু বিছানাপত্র দিতে পারেনি। দিতে হলে নিজেরটা দিতে হয়। তা কি দেওয়া যায় পায়রাদের।

হেমাঙ্গও ঘুমোল না। সামান্য গড়াগড়ি করে বাইরে গিয়ে বসে থাকল।

বিকেলের গোড়ায় হেমাঙ্গর নজরে পড়ল, প্রতিবেশীদের দু একজন তার বাড়ির সামনে দিয়ে পায়চারি করে যাচ্ছে, উঁকি দিচ্ছে রাস্তা থেকে। হেমাঙ্গর বাড়িতে কেউ কোনোদিন আসেনি। কে এল টাঙায় চড়ে, মেয়ের হাত ধরে?

হেমাঙ্গর মনে হল, পায়রা ফিরে এসেছে এটা বোধ হয় এখনও কেউ জানতে পারেনি। জানা সম্ভব নয়। কে আর মনে রাখতে গেছে পায়রার মুখ।

এমনি করেই বিকেল হল, ফুরিয়ে গেল। পায়রার মেয়ে সামান্য ধাতস্থ হয়েছে, তবু কেন যেন হেমাঙ্গর দিকে ঘেঁষছে না। ভয় পাচ্ছে বোধ হয়।

চা-টা খাওয়া হলে হেমাঙ্গ বলল, “আমি একবার বাজার ঘুরে আসি?”

পায়রা বলল, “কেন?”

“দত্ত স্টোর্সে রেডিমেড তোশক বালিশ পাব। সাইকেলে বেঁধে নিয়ে আসি।”

“পুরনো নেই?”

“না।”

“খুঁজেপেতে কিছু বার করা যাবে না?”

“না।”

পায়রা কিছু বলল না আর। হেমাঙ্গকে দেখতে লাগল। ফরফর করছে সাদা চুল, সাদা মুখ, চোখের ভুরু পালক সবই সাদা, গায়ের লোমও ধবধব করছে। চোখের মণিটুকুই যা এখনও কালো। কিছু বোঝাই যায় না হেমাঙ্গকে দেখলে, কী ভাবছে সে।

হেমাঙ্গ সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেল।

কার্তিকের বিকেল ফুরলো হু হু করে। সন্ধে হল। এদিকে এখনই কুয়াশা নামতে শুরু করেছে। অন্ধকারে তারা ফুটে উঠল আকাশে।

হেমাঙ্গ ফিরল। সাইকেলের পেছনে দড়ি দিয়ে বেঁধে তোশক এনেছে, তোশক বালিশ চাদর। হ্যাণ্ডেলে ঝোলানো থলি একটা। তার মধ্যে থেকে পুতুলের কাশির ওষুধ, এক শিশি তালমিছিরি, টুকিটাকি বার করে রাখল।

নতুন বিছানাটা পায়রা নিজেই পেতে নিল। মেয়েকে এক চামচ কাশির ওষুধ খাওয়ালো।

সন্ধের পর হেমাঙ্গ কেমন ছটফট করতে লাগল। একবার করে বাইরে যায়, আবার ঘরে ঢোকে। বারবার পায়রার দিকে তাকায়। কী যেন বলতে যায়, পেরে ওঠে না।

পায়রা বলল, “কী?”

হেমাঙ্গ ইতস্তত করে বলল, “আমি একটু ইয়ে খাই—এ সময়?”

পায়রা বুঝল। বলল, “খাও না।”

“তোমার মেয়ে?”

“ওর দেখার অভ্যেস আছে।”

হেমাঙ্গ তাকাল। পায়রার কোনো সঙ্কোচ নেই। হেমাঙ্গ বলল, “আমি ওপাশের ছোট ঘরটায় যাই বরং। এদিক দিয়ে আসা-যাওয়া যাবে না।”

“যাও।”

এতদিন নিজের ঘরে বসেই খেত হেমাঙ্গ। মাঝে মাঝে গ্রামোফোনের পুরনো রেকর্ড বাজাত। এস্রাজ তুলে সুর ফোটাত। আজ নিজের ঘর ছেড়ে কোণার দিকের কুঠরিতে চলে গেল হেমাঙ্গ। বাতিও জ্বালাল না। জানলাটা খুলে দিল। পেছন-বাগানের দিকে জানলা। কুয়াশা জড়ানো ঝাপসা আলোর ভাব এল একটু জানলা দিয়ে।

হেমাঙ্গ সামান্য খাওয়ার পর পায়রা এল।

বসার কিছু নেই, পুরনো ভাঙা বাক্সর ওপর বসল পায়রা।

হেমাঙ্গ বলল, “তোমার মেয়ে কোথায়?”

“ঝিমলির কাছে রান্নাঘরে।”

“আসবে না?”

“না।”

হেমাঙ্গ আবার খানিকটা ঢেলে নিল।

পায়রা বলল, “রোজ খাও?”

“না। রবিবারে খাই। কোনো কোনোদিন…”

“আগে তো খেতে না।”

“না।”

“কত দিন খাচ্ছ?”

“তা পাঁচ সাত বছর।”

পায়রা চুপ করে থাকল। হেমাঙ্গও চুপচাপ। অন্ধকারে কেউ কারুর আকৃতি স্পষ্ট করে দেখতে পাচ্ছিল না, ভাসাভাসা আবছা চোখে পড়ছিল। অন্ধকার যেন দু জনকেই পরস্পরের কাছ থেকে আড়াল করে রেখেছে। অবস্থাটা স্বস্তিদায়ক।

অনেকক্ষণ পরে পায়রা বলল, “আমি কপাল ঠুকে চলে এলাম।”

হেমাঙ্গ গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিল। নামিয়ে রাখল। সিগারেট ধরাল। পায়রা এলো চুল কোনোরকমে জড়িয়ে খোঁপার মতন করেছে। শাড়ি পালটায়নি।

হেমাঙ্গ বলল, “তোমার শরীর তো ভাল মনে হচ্ছে না।”

“কেন?” পায়রা অন্যমনস্কভাবে বলল।

“ফোলা ফোলা লাগছে। অনেক বয়েস হয়ে গিয়েছে যেন। তোমার বয়েস তো বেশি নয়।”

পায়রা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আমি ঠিকই আছি। ন’দশ বছর পরে আমায় দেখছ, তাই। মেয়েদের আর এই বয়েসে শরীরের কী থাকে। তার ওপর আমার মতন মেয়েদের।

হেমাঙ্গ খেয়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। পায়রা তার খুব কাছাকাছি। হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। এত কাছকাছি এমন করে কোনো মানুষ তার কাছে বসেনি আজ দশ বছর। বিলাস বাদে। কিন্তু বিলাস আলাদা।

“অসুখ বিসুখ করেনি তো?” হেমাঙ্গ জিজ্ঞেস করল।

“বড় কিছু নয়। জানি না। কে আর দেখতে গেছে।”

“তোমার চুল পাকছে, দাঁত কালো হয়ে গেছে…”

পায়রা যেন কানে শুনল না। নিজের মনেই বলল, “এখান থেকে চলে যাবার পর আমার বরাতে ভাল কিছু জোটেনি। এখানে দু বছর, ওর কাছে ছ’ মাস, তার ঘরে এক বছর—এই ভাবেই কেটেছে। নন্তুদা—আমায় বছর আড়াই রেখেছিল, তারপর যা হয়…”

বাধা দিল হেমাঙ্গ, বলল, “থাক, ও কথার দরকার নেই।”

“শুনবে না?”

“কী হবে শুনে! এ-রকম তো হয়। নতুন কিছু নয়। আমি ভেবেছিলাম নন্তুর কাছেই তুমি থাকবে।”

পায়রা তাকিয়ে থাকল হেমাঙ্গর দিকে। চোখের মণিও দেখা যাচ্ছে না। সব সাদা। দিশি মদের গন্ধে ঘর ভরে উঠেছে। পায়রার নাকে লাগছিল না। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে পায়রা বলল, “তোমার কাছে ফিরে আসার মুখ আমার ছিল না, তবু এলাম। কপাল ঠুকে। আমার কোনো উপায় ছিল না। যদি তুমি বাড়িতে ঢুকতে না দিতে…।”

“আমি তোমায় চিনতে পারিনি প্রথমটায়—” হেমাঙ্গ বলল, যেন কথা এড়িয়ে গেল।

পায়রা বলল, “চেনা মুশকিল। তখন একরকম ছিলাম, এখন অন্যরকম। তুমিও অনেক বদলে গেছ।”

“কেন! আমার সবই তো সেই রকম আছে। তুমি যাবার পর…”

“না, তুমিও বুড়ো হয়ে গেছ।”

“কোথায় বুড়ো—” হেমাঙ্গ হাসল, “রোজ মাইল চারেক করে সাইকেল ঠোঙাই।”

পায়রা চুপ করে থাকল।

নেড়ি বার কয়েক ডাকল। সে বাইরের বারান্দা থেকে যেন ছুটে কোথাও গেল। রাস্তা দিয়ে গাড়ি যাচ্ছিল। শব্দটা মিলিয়ে গেল সামান্য পরে। জানলার বাইরে কুয়াশা গাঢ় হয়ে আছে। ঠাণ্ডা আসছিল হেমন্তর।

পায়রা নিশ্বাস ফেলে বলল, “আমি যে এইভাবে এলাম—আসা আমার উচিত হয়নি। কোন মুখে আসব বল?”

হেমাঙ্গ বলল, “না না, তোমার আর কী দোষ!” বলে আবার খানিকটা ঢেলে নিল গ্লাসে। বলল, “আমি অনেক ভেবেছি। ভেবে দেখেছি তুমি কিছু অন্যায় করোনি। আমায় নিয়ে কে থাকতে পারত পায়রা? কেউ নয়। দেখো না বাইরের লোক যারা—আমার মুখ ছাড়া যাদের আর কিছু চোখে পড়ে না, আমার সঙ্গে খায় না শোয় না—তারাও আমায় সহ্য করতে পারে না। আমায় পুরনো অফিস থেকে পর্যন্ত তাড়িয়ে দিয়েছে। বাজারে দোকানে-টোকানে গেলে আমায় কোনো জিনিস ছুঁতে পর্যন্ত দেয় না, আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হয়—এটা দাও ওটা দাও। বিলাস ছাড়া আমার বাড়িতে কেউ আসে না।” হেমাঙ্গ গ্লাস তুলে নিয়ে বড় করে চুমুক দিল। গলা পরিষ্কার করল। বলল, “যারা আমায় দু চার ঘণ্টা চোখেও সহ্য করতে পারে না তারা বাইরের লোক। তুমি বউ হয়ে আমায় চব্বিশ ঘণ্টা বারো মাস কেমন করে সহ্য করতে? পারতে না।”

পায়রা বলল, “তখন পারিনি।”

“কেউ পারত না।”

হেমাঙ্গ চোখ তুলে পায়রার দিকে তাকাল। কিছু বলল না।

পায়রার মেয়ের গলা পাওয়া গেল।

হেমাঙ্গ বলল, “তোমার মেয়ে। যাও, দেখো গিয়ে। নতুন জায়গা, ভয়-টয় না পায়।”

পায়রা বলল, “পাক ভয়। আমি আর কত ভয় থেকে বাঁচাব।” বলে উঠে গেল।

হেমাঙ্গ সাড়া দিল না।

পায়রা চলে গেল। সে চলে যাবার পর অন্ধকারে হেমাঙ্গ শান্ত স্বাভাবিকভাবে বসে থাকল। বসে বসে বাকিটা শেষ করতে লাগল।

নেশা গাঢ় হয়ে গিয়েছিল হেমাঙ্গর। কপালে ঘাম। চোখ সামান্য জড়িয়ে আসছিল। নিজের নিশ্বাসেই গন্ধ পাচ্ছিল দিশি মদের।

হেমাঙ্গ উঠল। ভেতর বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল এদিক ওদিক। ঝিমলি তখনও রান্নাঘরে। আলো জ্বলছে। এতটা রাত সে করে না। রান্নাবান্না শেষ করে পশ্চিমের কুঠরি ঘরে তার খাটিয়ায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। আরও রাত বাড়লে, হেমাঙ্গ যখন তার ঘরে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে, ঝিমলি কাছে গিয়ে তাকে ডাকে, বাব—এ বাবু। রান্নাঘরের ওপাশে কলাঝোপ। অন্ধকার চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আকাশের দিকে তাকাল হেমাঙ্গ, তার চোখে তারাটারা ধরা পড়ল না।

পায়রা মেয়েকে খাওয়াচ্ছে। ঘরে বসে। খাওয়াতে খাওয়াতে কথা বলছিল।

হেমাঙ্গ মেয়েটার সঙ্গে এখনও কথাবার্তা বলতে পারেনি। দু একবার কী খুকু, কী করছ, গোছের কথা বলেছে। পায়রার মেয়ে হেমাঙ্গকে দেখে ভয় পাচ্ছে, না কি পছন্দ করছে না—বুঝতে পারছিল না সে। মেয়েটাকে খুঁটিয়ে দেখছে হেমাঙ্গ। পায়রার ছাঁদ রয়েছে মুখে। নাক চোখ পায়রার মতন।

নিজের ঘরে চলে যাচ্ছিল হেমাঙ্গ।

পায়রা মেয়েকে বলছিল, “খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়বে। ঘুমিয়ে পড়বে।”

“তুমি শোবে না?”

“না। আমার রাত হবে। খাব দাব। তারপর……”

“আমার ভয় করছে।”

“কিসের ভয়! এখানে কি ভূত থাকে?”

“এটা কার বাড়ি মা?”

“তাতে তোমার দরকার কী! পাকা পাকা কথা কেবল!”

পায়রার মেয়ে চুপ করে গেল।

নিজের ঘরে এল হেমাঙ্গ। বাতি জ্বালল না। বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। উপুড় হয়ে। বালিশে মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে শুয়ে হেমাঙ্গ একবার চেষ্টা করে দেখল, তার মাথা ঠিক মতন কাজ করছে কিনা। দত্ত স্টোর্সে কত টাকা দিয়েছিল মনে করার চেষ্টা করল। পারল মাথা ঠিক আছে।

হঠাৎ অনেক পুরনো কথায় চলে গেল হেমাঙ্গ। পায়রা কোন রঙের শাড়ি পরতে ভালবাসত? টিয়া-সবুজ রঙ। তার কোন দাঁতটা বেঁকা ছিল? নিচের পাটির ডান দিকের সামনের একটা দাঁত। পায়রার কোন বুকের তলায় বড় আঁচিল ছিল? ডান? নাকি বাঁ? ডান।

হেমাঙ্গ আচমকা হেসে উঠল। পায়রার কোথায় কী ছিল হেমাঙ্গ কি সত্যিই জানত? না আজও জানতে পারছে?

সংসারের এইটেই মজার। সব জিনিসই গায়ের চামড়া নয়। দেখা যায় না, দেখা যায় না। হেমাঙ্গকেই কি দেখা যায়?

তিন

হেমাঙ্গ ঘুমিয়ে পড়েছিল। নেশার মধ্যে গভীর ঘুম। প্রথমে তার খেয়াল হল কে যেন তাকে নাড়া দিচ্ছে।

“কে?”

“আমি। অনেক রাত হয়েছে।”

“তুমি শোওনি?”

“শুয়ে ছিলাম। উঠে এলাম। নতুন বিছানার-গন্ধ বড় নাকে লাগছে।”

“গন্ধ? কিসের গন্ধ?”

“কোরা গন্ধ। তোশক বালিশ চাদর……।”

হেমাঙ্গ উঠে বসল। “খেয়েছ?”

“না। তুমি খাবে চলো।”

“ঝিমলি কোথায়?”

“শুয়ে পড়েছে।”

হেমাঙ্গ উঠে দাঁড়াল। “চলো।”

খাওয়া-দাওয়া সেরে শুতে এল হেমাঙ্গ। সিগারেটটা শেষ করে নিচ্ছিল। পায়রা ঘরে এল।

হেমাঙ্গ বলল, “আর রাত করো না, শুতে যাও।”

পায়রা দরজাটা ভেজিয়ে দিল। পিঠ দিয়ে দাঁড়াল দরজায়।

অবাক হচ্ছিল হেমাঙ্গ। “কী?”

“ওই নতুন বিছানায় আমি শুতে পারব না।”

“কেন? কী হয়েছে?”

“ভীষণ গন্ধ লাগছে।”

হেমাঙ্গ একটু চুপ করে থেকে বলল, “আর তো বিছানা নেই।”

পায়রা জবাব দিল না। না দিয়ে হেমাঙ্গর বিছানার দিকে যাচ্ছিল।

হেমাঙ্গ হাত ধরে ফেলল পায়রার। শক্ত করে। বলল, “ও বিছানায় আরও গন্ধ। তুমি ঘেন্নাটেন্না ভুলে গেছ?”

“গিয়েছি। কবেই—।”

“কেমন করে গেলে?”

“গেলাম। আমার কপালে কত বিছানা জুটেছে জান তুমি?”

হেমাঙ্গ শক্ত হাতে পায়রাকে টানল। বলল, “আমি কিছু জানতে চাই না। কী লাভ আমার জেনে! তুমি কেন গিয়েছিলে তা জানি, কেন ফিরে এসেছ তাও জানি।”

“আমিও জানি।”

“কী?”

“তুমি এতকাল কেন এই ঘরবাড়ি আগলে বসেছিলে।”

হেমাঙ্গ কয়েক পলক তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল, “তুমি ও-ঘরে যাও। কাল বিছানা পালটে দেব।”

পায়রাকে ঘর থেকে ঠেলে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল হেমাঙ্গ।

পরের দিন বেলায় পায়রা হেমাঙ্গর ঘরের ভেজানো দরজা খুলে দেখতে পেল না মানুষটাকে। ঝিমলিও দেখেনি। নেড়ি চেঁচাচ্ছিল। পায়রার মেয়ে রোদে দাঁড়িয়ে লেবুগাছের মাথায় পাখি দেখছিল।

পায়রা বার বার হেমাঙ্গর ঘরে আসছিল।

হঠাৎ চোখে পড়ল হেমাঙ্গ এক টুকরো কাগজ রেখে গেছে। একদিন সে নিজে যেমন রেখে গিয়েছিল।

কাগজটা দেখল পায়রা। তারপর ছুটে গেল কালকের সেই হোট ঘরটায়, যেখানে যসে হেমাঙ্গ সারা সন্ধে দিশি মদ খেয়েছিল।

বোতলের ভাঙা কাচে গলার নালী কেটে হেমাঙ্গ মরেছে। তার সাদা শরীরে রক্তগুলো জমাট বেঁধে কেমন যেন দেখাচ্ছিল। পায়রা দু চোখ বন্ধ করে চেঁচিয়ে উঠল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *