বসন্ত বিলাপ

বসন্ত বিলাপ

অতি তুচ্ছ ঘটনা থেকে অনেক বৃহৎ কাণ্ড ঘটে যায়। শ্যামের বেলায়ও ব্যাপারটা সেই রকম ঘটেছিল। রেল স্টেশনের বাইরে সিঁড়ির কাছে শ্যাম দাঁড়িয়ে ছিল। মুখে প্রায় ফুরিয়ে-আসা সিগারেট। ভিড়টিড় বলতে আশপাশে তখন বিশেষ কিছু ছিল না, শাট্ল্ ট্রেনের যাত্রীরা সকলেই চলে গেছে একরকম। শ্যাম সামনের দিকে তাকিয়ে একটা সাইকেল রিকশা খুঁজছিল। কিন্তু সে বেশ অন্যমনস্ক ছিল। অন্যমনস্কতার মধ্যেই শ্যাম দূরের একটা রিকশাকে ডান হাত তুলে ইশারায় কাছে ডাকল, এবং অন্যমনস্কভাবেই বাঁ হাতের আঙুলের টোকায় সিগারেটের অতিক্ষুদ্র অংশটা বাঁ দিকে ছুড়ে দিল। শ্যাম সামনের রিকশা দেখছিল—আপপাশ দেখেনি। রিকশার জন্যে শ্যাম এগুতে যাচ্ছে, আচমকা তার জামা ধরে কেউ বেজায় জোরে টান মারল। মুখ ফিরিয়ে শ্যাম দেখল ‘বসন্ত বিলাপ’-এর সেই সিংহবাহিনী, পাশে তার অন্য এক সঙ্গিনী।

একেবারে প্রথমটায় শ্যাম কিছু না বুঝে চমকে ওঠার মতন হলেও পরের কয়েকটি মুহূর্তের মধ্যে সব বুঝে নিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল। তার সিগারেটের টুকরোটা মেয়েটির—অর্থাৎ সেই সিংহবাহিনীর শাড়ির সামনের কুঁচির মধ্যে ছুঁছো বাজির মতন ঢুকে গিয়েছিল। স্টেশনের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে, দিবালোকে শাড়ির পায়ের কাছটা দুলিয়ে, নাচিয়ে, কিছুটা বা সামনে বাড়িয়ে মেয়েটি অগ্নিমূর্তি হয়ে শ্যামকে সগর্জনে ধমকাতে ও গালিগালাজ করতে শুরু করল। মেয়েদের আরক্ত মুখ, রাঙা চোখ, সকুঞ্চিত ভ্রূ স্ফুরিত নাসা, দস্তপঙ্‌ক্তি—কোনোটাই শ্যামের অপ্রিয় বস্তু নয়, কেননা শ্যামের মাত্র চৌত্রিশ বছর চলছে, সে একটু-আধটু শৌখিন কাব্যচর্চাও করে থাকে এবং এখনও অবিবাহিত। কিন্তু এই মুহূর্তে শ্যাম চোখে অন্ধকার দেখছিল, তার সম্মুখস্থ মেয়েটির তর্জন-গর্জনে তার হুঁশ প্রায় ছিল না, আর গালিগালাজ যেটুকু মরমে প্রবেশ করছিল তাতে অপমানে শ্যাম একেবারে ঘোর কৃষ্ণবর্ণ হয়ে যাচ্ছিল।

ইডিয়েট, অসভ্য, জন্তু অভদ্র—ইত্যাদি শব্দগুলি ছুরির মতন শ্যামের আত্মসম্ম নে যত্রতত্র বিদ্ধ হলেও সে শুধু তোতলাবার চেষ্টা করছিল, কথা বলতে পারছিল না। অবশেষে মেয়েটি যখন শ্যামকে বাঁদর বলল এবং শ্যামের কান ধরে ছিঁড়ে দেবার অভিপ্রায় জানিয়ে কান ধরার একটা ভঙ্গিও করল, তখন শ্যাম আর সহ্য করতে পারল না। বলল, “এটা ইন্‌টেনশনাল নয়।”

সঙ্গে সঙ্গে আরও গর্জন করে মেয়েটি বলল, “নিশ্চয় ইন্‌টেনশনাল। চিনি না আপনাদের। যত ফেউয়ের দল।”

অগত্যা শ্যাম চুপ। কিছু লোকজন, মুটেমজুর জমে গেছে আশপাশে।

অবশেষে সঙ্গিনীকে টেনে নিয়ে গিয়ে সিংহ বাহিনী সামনের রিকশায় উঠল। শ্যামেরই ডাকা সেই রিকশাটা। যাবার সময় মেয়েটি গলা বাজিয়ে বলে গেল “এ-রকম নচ্ছারদের ধরে নিয়ে গিয়ে পুলিশে দিতে হয়। যত সব বাঁদর।”

শ্যাম অসহায়ের মতন দাঁড়িয়ে থাকল, তার অবস্থাটা বজ্রাহতের মতন।

কী দুর্দৈব। শ্যাম ভদ্রলোক। সে অশিক্ষিত, বেকার, বকাটে নয়। তার চেহারা বা চালচলনে বাঁদরামি করার কোনো লক্ষণ নেই। পুলিশে দেবার মতন লোক শ্যাম নয়। সেই শ্যামকে আজ এই হাটের মধ্যে মেয়েটা অপমানের একশেষ করে গেল! ছি ছি! শ্যাম শুধু আহত হল না, বেচারির চোখে প্রায় জল এসে গেল।

সন্ধেবেলায় শ্যাম বিরক্ত, বিমর্ষ ও উত্তেজিত হয়ে তাদের আড্ডায় এসে বলল, “সিধু, আমি সুসাইড করব।”

সিধু চওড়া চৌকির ওপর পাতা মোটা সতরঞ্চির ওপর কাত হয়ে শুয়ে ফুটবলের লীগ টেবল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। দত্তগুপ্ত একটা তাকিয়া মাথায় দিয়ে শুয়ে শুয়ে কড়ি কাঠ দেখতে দেখতে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সুর ভাঁজছিল নিচু গলায়। আর ললিত—এই বাড়ির হাফ-মালিক—তাস, কাগজ-কলম বের করে নিচ্ছিল।

শ্যামের প্রবেশ এবং ক্ষোভ প্রকাশ বন্ধুদের তেমন উৎসাহ সঞ্চার করল না। সিধু লীগ টেবল থেকে মনে মনে একটা অঙ্ক কষতে লাগল, দত্তগুপ্ত নির্বিকারচিত্তে সুর সাধনা করে যেতে থাকল।

ললিত শুধু বলল, “কি করবি?”

“সুসাইড।”

“বাঃ! ভাল জিনিস! জাপানিরা হরদম করে।”

বন্ধুদের এরকম পরিহাস, ঠাণ্ডা মনোভাব শ্যাম বরদাস্ত করতে পারল না। চৌকিতে না বসেই শ্যাম বার দুই পায়চারি করল, দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর তিক্ত গলায় বলল, “আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে! লাইফে এরকম বেইজ্জতি আর হইনি।…বসন্ত-বিলাপের সেই মেয়েটা—সিংহবাহিনীটা পাবলিক প্লেসে দাঁড়িয়ে আমার ইনসালট করেছে। আমার কান ধরে ছিঁড়ে দেবে বলেছে। …” শ্যাম আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, দম নেবার জন্যে, থেমে গেল!

বসন্ত বিলাপের নামেই হোক বা সিংহবাহিনীর টানেই হোক সিধু এবার মুখ ওঠাল। ললিত ভাল করে নজর করতে লাগল শ্যামকে। সুরচর্চা থামিয়ে দত্তগুপ্ত উঠে বসতে বসতে বলল, “কস্ কি রে শ্যাম? মাইয়া মাইনষে তরে ইনসালট্ করল?”

ললিত বলল, “ব্যাপারটা কি?”

সিধু পকেট থেকে পানের মোড়কটা বের করে পাশে রাখল। বলল, “তোকে বেইজ্জত করল কেন? চোখফোক টিপে ছিলি নাকি?”

শ্যাম আগুন হয়ে উঠল। “হোয়ট ডু ইউ মিন্? আমি কি শালা লোফার না লোচ্চা?”

হেসে উঠে সিধু বলল, “তুই চটছিস কেন? আমি কি গাল টেপার কথা বলেছি! চোখ টেপা কোনো ক্রাইম নয়। আয়, বোস, কি হয়েছে বল সব…”

বন্ধুরা এবার আর ঠাণ্ডা থাকতে পারল না, রীতিমত চঞ্চল হয়ে উত্তেজিত হয়ে উঠল।

দত্তগুপ্ত স্কুলে পড়ার সময় কোথায় যেন বক্সিং শিখেছিল, ঘুঁষি পাকিয়ে বলল, “একটা গুসি দিলি না ক্যান?’

এমন সময় ললিতের বউদি মণিমালা ভেতরের দরজা দিয়ে আবির্ভূত হল। মণিমালার বয়স বেশি নয়, ললিতের সমবয়সীই হবে হয়ত, এবং এই আড্ডার চার আনা সদস্য। অর্থাৎ সে এখানকার গল্পগুজবে কখনো-সখনো থাকে, এবং মাঝে মাঝে তাস খেলায়। পরিবর্তে তাকে এই চার দেবরকে চার এবং মাঝেমধ্যে খাবার-টাবার খাওয়াতে হয়।

মণিমালা বরাবরই হাসিখুশি মানুষ। তামাশা রসিকতায় কিছু কম যায় না। দেখতে সুশ্রী, সামান্য গোলগাল ধরনের চেহারা।

মণিমালা এসে বলল, “কি, এখনও তাস পাড়োনি?”

শ্যামরা কেউ কোনো জবাব দিল না।

মণিমালা চার জনের ভাবসাব দেখতে লাগল।

সামান্যা পরে ললিত বলল, “আজ আমরা তাস খেলছি না। …একটা ব্যাপার ভাবছি। তুমি বরং স্ট্রং করে চা পাঠিয়ে দাও।”

মিণমালা যেন কোনও কিছুর গন্ধ শুঁকতে পেল। সন্দিগ্ধ গলায় বলল, “তা ব্যাপারটা কি শুনতে পারি না?”

বন্ধুদের মধ্যে চোখাচোখি হবার আগেই দত্তগুপ্ত বলল, “শ্যামচাঁদের কান…।” কথাটা দস্তগুপ্ত শেষ করতে পারল না, তার আগেই শ্যাম জোরে একটা কনুইয়ের গুঁতো দিল গর্দভটাকে। উঃ শব্দ করে দত্তগুপ্ত থেমে গেল।

ললিত বলল, “ব্যাপারটা এখন তোমায় বলতে পারছি না। …না কি রে? কি বলিস ?” ললিত বন্ধুদের দিকে চোখ ছোট করে তাকাল। “পরে বলব। একটু চা-ফা খাওয়াও আগে।”

মনিমালা শ্যামের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। হেসে চলে গেল।

মিণমালা চলে যেতেই শ্যাম দত্তগুপ্তকে খেঁকিয়ে উঠল, “রাস্কেল কোথাকার! এখুনি ডুবিয়ে ছেড়েছিল! বউদির কাছে তুই আমার বেইজ্জতির কথা বলছিলি! কেলেঙ্কারী হয়ে যেত।”

দত্তগুপ্ত বলল, “বউদিরে কইতে দোষ কি?” সে বলল বটে, কিন্তু তার বোকামিটা বুঝতে পেরেছিল।

সিধু বলল, “দোষ কিছু নয়, প্রেস্টিজ আরও পাঞ্চার হত।”

ললিত বলল, “বাজে কথা থাক। এখন কি হবে? লেট আস ডিসাইড। ব্যাপারটা এভাবে ছেড়ে দেওয়া যায় না। স্পেশ্যালি বসন্ত বিলাপের সঙ্গে আমাদের এটা থার্ড রাউন্ড। আগের দু’বার মেয়েছেলে বলে ছেড়ে দিয়েছিলাম। বাট নট দিস টাইম।”

আগের দু’বার—অর্থাৎ একবার বসন্ত বিলাপের বাড়ি থেকে একরাজ্যি ময়লা সিধুর মাথার ওপর ফেলে দেওয়া হয়েছিল। অন্যবার—অবশ্য সেটা প্রত্যক্ষ নয় পরোক্ষভাবেই বসন্ত বিলাপ ললিতদের বেইজ্জত করেছিল, সরস্বতী পুজোর নিমন্ত্রণপত্র বলে ডাক মারফত ঠিকানা লেখা খাম পাঠিয়ে দিয়েছিল, ভেতরে কার্ড বা ছপা চিঠি কিছু ছিল না।

দত্তগুপ্তর কাছ থেকে একটা সিগারেট চেয়ে নিয়ে সিধু ততক্ষণে ধরিয়ে ফেলেছে। লম্বা ধোঁয়া ছেড়ে বলল, “না, আর টলারেট করা যায় না। আমাদের স্ট্রেট ফাইট দিতে হবে।”

-দত্তগুপ্ত রসিকতা করে হেসে বলল, “ফাইটে কাম্‌ নাই রে, টাইটেই চলব।”

শ্যাম ধমক দিয়ে বলল, “ডোন্ট লাফ্, এটা হাসির ব্যাপার নয়।”

দত্তগুপ্ত একান্ত অনুগতের মতন মুখভাব গম্ভীর করে নিল।

অতঃপর চার বন্ধু গভীর মনোযোগ সহকারে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে বসল।

বসন্ত বিলাস সম্পর্কে এবার কিছু বলতে হয়। সংক্ষেপে বললে এই দাঁড়ায় যে, ললিতদের পাড়ায়, এমন কি এই রাস্তার ওপরই বসন্ত বিলাপের অবস্থান। বেশি নয়, এই বাড়ি থেকে মাত্র মিনিট দুই হাঁটলেই বাড়িটা দেখা যায়। লালচে রঙের ছোটাখাটো দোতলা বাড়ি একটা, নিচে উপেন স্যাকরার দোকান। উপেনের পাশে অবশ্য হোমিও ডাক্তার গিরিজাবাবুর ডিসপেনসারি। আজ প্রায় বছর খানেক হতে চলল, কয়েকটি মেয়ে এসে ওই বাড়িটা ভাড়া নিয়ে একটা মেয়ে-মেস বা মেয়ে-হোস্টেল তৈরি করে দিব্যি আছে। হই-হল্লা, চেঁচামেচি করে, নেচে গেয়ে বেশ আছে সব। মনেই হয় না মেয়েদের বয়েস হয়েছে। সবাই চাকরি-বাকরি করে। কেউ বা রেলে; কেউ মেয়ে কলেজে, কেউ বা হাসপাতালে। স্কুলে চাকরি করা মেয়েও আছে জনা দুই-তিন। সবচেয়ে আশ্চর্য এই মেয়েদের মধ্যে বিবাহিত বলতে মাত্র একজন, প্রতিমা, হাসপাতালের মেট্রন ; বয়স একটু বেশিই হবে। অন্য কোনো মেয়ের মাথাতেই এখন পর্যন্ত সিঁদুরের দাগ ধরেনি।

বাড়িটার একটা নম্বর আছে কিন্তু নাম নেই। নামটা শ্যামদের দেওয়া, শ্যামেরই। জনা, আট-দশ ,মেয়ে যে বাড়িতে থাকে, এবং যেখানে সকলেই প্রায় কুমারী, সেই বাড়ির নাম বসন্ত বিলাপ হলে খুব বেমানান নিশ্চয় হয় না। শ্যামের যুক্তিতে, এতগুলি যুবতীর কৌমার্য অবলম্বন—বসন্তের বিলাপ ছাড়া আর কিই বা! শ্যাম এবং শ্যামের বন্ধুদের কাছে আজ বছর খানেকই বসন্ত বিলাপ প্রবল কৌতূহল ও রহস্যের বিষয়। এই এক বছরে বসন্ত বিলাপের পরিবর্তন অল্পস্বল্প হয়েছে, নতুন কেউ এসেছে পুরনো কেউ চলে গেছে, ওদের ঝি বদলেছে—তবু মোটামুটি চেহারাটা সেই রকমই আছে। আর শ্যামরা বসন্ত বিলাপের অধিবাসীদের নাম ধাম, কর্মক্ষেত্র সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকাকিবহাল। মেয়ের রূপগুণ, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিচার করে তারা আবার নিজেদের মধ্যে এক-একজনের এক-একটা নামও দিয়ে নিয়েছে। যেমন সিংহবাহিনী। সিংহবাহিনীর আসল নাম অনুরাধা সিংহ, বয়স বছর ত্রিশের সামান্য বেশি বলেই মনে হয়, মাথায় সামান্য খাটো, বেশ পুষ্ট চেহারা, মেজাজ খুব কড়া ধরনের, রাস্তা দিয়ে হাঁটার, সময় মিলিটারী মেজাজে হাঁটে, গলার স্বর থেকে মনে হয় ভগবান যেন তার আলজিভের কাছে একটি বিশেষ ধরনের টিনি-মাইক লাগিয়ে দিয়েছে ! চালচলনে ব্যবহারে যার এত দাপটের ভাব তাকে দত্তগুপ্ত ‘মহিষমর্দিনী’ বলতে চেয়েছিল, কিন্তু শ্যাম বা ললিত এতটা নির্দয় হতে রাজি হয়নি; বরং অনুরাধা সিংহকে সিংহবাহিনী বলাই সঙ্গত, তা ছাড়া এটা তো ঠিকই মেয়েটিকে তার চারিত্রিক সিংহই তো বহন করছে।

মণিমালা চা নিয়ে এসে ললিতদের কাছে একটা বেতের মোড়া টেনে নিয়ে বসল।

ললিত প্রথমে হালকাভাবে বলল, “দাদা কোথায়?”

“কোথায় আর—যেখানে যার দৌড়—কোলিয়ারির এক মক্কেল এসে নিয়ে গেছে।”

সিধু চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, “আজ পল্টনকে একবারও তো দেখলাম না বউদি? কোথায় গেছে?”

মণিমালা হেসে বলল, “আজ বাপের সঙ্গে গেছে। যা বায়না!”

শ্যাম, ললিত, দত্তগুপ্তের মধ্যে গোপনে চোখ চাওয়া-চাওয়ি হয়ে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত ললিত গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল, “বউদি, আমরা একটা সিরিয়াস ম্যাটার নিয়ে আলোচনা করছিলাম। ব্যাপারটা খুব সিক্‌রেট।…এখন ব্যাপার হচ্ছে কি, মানে—তুমি এমন এক পার্টি—না ঠিক পার্টি নয়—ধরো সম্প্রদায়ের লোক যার কাছে আমরা—পুরুষরা কিছু বলতে পারি না। ব্যাপারটা মেয়েদের নিয়ে। তবু তোমায় আমরা বলব। তোমাকে কনফিডেন্সে নেওয়া গেল।”

মণিমালা ঘাড় হেলিয়ে বলল, “বড় ভনিতা করছ। ব্যাপারটা বললা শুনি।”

শ্যাম বলল, “আপনি আমাদের দলে, এটা কিন্তু প্রমিস করতে হবে।”

মণিমালা সঙ্গে সঙ্গে মাথা দুলিয়ে তিন সত্যি করল।

ললিত বলল, “ব্যাপারটা বসন্ত বিলাপ নিয়ে। আজ সেই সিংহীটা শ্যামকে দশজনের সামনে যাচ্ছেতাই করে অপমান করেছে। আমরা এর শোধ নেব।”

দত্তগুপ্ত ইংরিজি করে বলল, “রিভেনজ। বুজলেন না বউদিদি, সিংহীরে টাইট রমু।” দত্তগুপ্তর বাড়ি কোনো কালেই পূর্ববঙ্গে ছিল না, অথচ সে এইভাবে কথা বলে, এটা নিছক রঙ্গ করেই। বাড়িতে তার নিজের বউদিদিও পূর্ববঙ্গীয়, দাদা খাস শান্তিপুরি বাঙলায় কথা বলে। নিতান্ত যেন বউদিদিকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে দত্তগুপ্ত ল্যাংগুয়েজ ক্লাসের মতন পূর্ববঙ্গীয় ভাষাটা রপ্ত করছে।

স্টেশনের ঘটনাটা সিধু সংক্ষেপে বলল। শুনতে শুনতে মণিমালা হেসে অস্থির।

শ্যাম ক্ষুব্ধ হয়ে বলল, “বউদি আপনি হাসছেন, ব্যাপারটা কিন্তু হাসির নয়। আমি সত্যিই বড় অপদস্থ হয়েছি।”

মণিমালা আঁচলের আগায় মুখের বেশি হাসিটা মুছে খানিকটা শান্ত হয়ে বলল, “সত্যিই ভাই, ব্যাপারটা খারাপ। কিন্তু আপনিই বা অত কথা শুনলেন কেন, দু’-চারটে বলে দিলে পারতেন।”

“পাগল! তা হলে সিংহবাহিনী শ্যামের কান কেটে ছেড়ে দিত।” সিধু বলল, ‘রিট্রট ইন ডেনজারই বেস্ট পলিসি।”

ললিত সকলকে থামিয়ে দিয়ে মণিমালাকে বলল, “আমরা একটা প্ল্যান করে ফেলেছি। এটায় আনসাকসেসফুল হলে অন্য পথ বেছে নেব। আমাদের প্ল্যানটা তুমি শুনবে?”

“বলো, শুনি।”

ললিত তাদের মতলবটা বলল।

শুনে মণিমালা শান্ত মিষ্টি হাসি হেসে বলল, “ও-সব ছাই কোনো আসবে না। বাড়িটার গায়ে শুধু দাদের মতন দাগ হবে। তা ছাড়া পাড়ার পাঁচ জনের চোখে পড়বে, তোমরাও ধরা পড়বে।”

সিধু বলল, “কিন্তু বউদিদি, পোস্টারিংটা খুব এফেকটিভ হবে। আমরা শুধু ছড়া লিখব। কিংবা সিনেমার কিছু হাল কায়দার বিজ্ঞাপনের মতন প্রথম দিন শুধু এক লাইন যেমন ‘একটি দুরন্ত আকর্ষণ; পরের দিন আরও এক লাইন “নয়ন সার্থক”।

মণিমালা মাথা নাড়ল, “না না, এসব কি?”

“তাহলে ছড়া?…শ্যাম লিখবে। আমরা ফুলস্কেপ কাগজে রঙিন কালি দিয়ে বেশ ডিজাইন করে চন্দরকে দিয়ে লিখিয়ে নেব।”

“দেওয়ালে আঁটবে কে?”

“পয়সা দিলে কাগজ আঁটার লোক পাওয়া যায়।”

“তা যাক্। এটা কিন্তু খারাপ…। এভাবে কারও পেছন লাগা ভাল নয়।”

“এই তো তুমি তোমার কমিউনিটির ইন্টারেস্ট দেখতে লাগলে—” ললিত বলল, “শ্যামের বা আমাদের পেছনে লাগতে বসন্ত বিলাপের মেয়েদের তো খারাপ লাগেনি। গোলমালটা ওরা পাকিয়েছে, আমরা নয়।”

মণিমালা ওদের মাথা ঠাণ্ডা করার জন্যে নরম গলায় বলল, “কে কার পেছনে লেগেছে সেটা অন্য কথা। তা হলে তোমরা মেয়েদের পেছনে এভাবে লাগবে কেন? অন্যভাবে লাগ?”

“অন্যভাবে লাগা মানে তো ঢিল ছোঁড়া?” শ্যাম অপ্রসন্ন গলায় বলল।

“দু চারটে বোমাও মারা যায়—কিন্তু সেটা কি উচিত হবে। আমরা ভদ্দরলোকের মতন অহিংস সংগ্রাম করতে চাই। ওদের ঝাড়সুদ্ধু এ পাড়া থেকে ওঠাতে চাই। বেজায় পাজি হয়ে গেছে—সব ক’টা। জটলা করে দাঁড়ায়, দোতলার বারান্দা থেকে মুখ বাড়িয়ে টিটকিরি মারে। আমাদের বাঁদর-টাঁদরই ভাবে।” ললিত বলল।

মণিমালা যথেষ্ট চালাক। আবহাওয়া বুঝে নিয়ে বলল, “তোমরা লাগতে চাও লাগো। তবে, আমি বলছিলাম কি, খুব চুপচাপ—কাউকে কিছু জানতে না দিয়ে পেছনে লাগো।”

চার বন্ধুই একসঙ্গে বলল, “কি রকম?”

মণিমালা জবাব দিল না।

ললিত বলল, “তোমার আইডিয়াটা কি রকম?”

“দাঁড়াও ভাবি একটু।”

মণিমালা ভাবতে লাগল। চার বন্ধুই মণিমালার মুখের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল নীরবে।

শেষ পর্যন্ত মণিমালা বলল, “আমি একটা উপায় ভেবেছি।”

“কি?”

মণিমালা তার উপায়টি ব্যক্ত করল। সঙ্গে সঙ্গে নানা জটিল প্রশ্ন। মণিমালা সব প্রশ্নেরই জবাব দিল যতটা সাধ্য।

দেখা গেল মণিমালার সিদ্ধান্ত ওরা মেনে নিয়েছে।

সপ্তাহ দুই পরে সিধুই একদিন নাচতে নাচতে এসে বলল, “লেগেছে রে, লেগেছে।”

ললিত যদিও আঁচ করতে পারল, তবুও শুধলো, “কি লেগেছে?”

“হুলুস্থুল। বসন্ত বিলাপে ফায়ার লেগে গেছে।”

শ্যাম হাতের কাগজটা ফেলে দিয়ে সহর্ষে চিৎকার করে উঠল, “লেগে যাক—লেগে যাক ; লাগিয়ে দে মা জগদম্বা…”

দত্তগুপ্ত বলল, “ফায়ার স্প্রেড করলে আমারে কল দিস রে সিধু।”

বাইরে আজ বিকেল থেকে খানিকটা ঝোড়ো ভাব হয়েছে। আকাশে মেঘ জুটেছে দুপুর থেকে, বৃষ্টি নেই, মাঝে মাঝে মেঘ ডেকে উঠেছে। হয়ত মাঝ রাত থেকে বৃষ্টি নামবে।

ললিত সিধুকে জিজ্ঞেস করল, “লেগেছে তুই বুঝলি কি করে?”

“সিকরেট মিশন ভাই; বলেছিলাম না—আমি ওটা ক্যাচ করে ফেলব।…এইবার জমবে।”

“বউদিকে ডাক—” শ্যাম অধৈর্য হয়ে বলল, “ডাক বউদিকে, ললিত। শীঘ্রি।”

ললিতকে উঠতে হল না, দত্তগুপ্তই উঠে ভেতর দরজায় গিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মণিমালাকে ডাকল।

সিধু বলল, “আমি ভাবছি আর-একবার ওষুধটা রিপিট করে দেওয়া যাক। প্রথমটাতেই বেশ ধরেছে যখন তখন রিপিট করলে আরও ফার্স্ট ক্লাস হবে। কি বল?”

শ্যাম বলল, “গুড আইডিয়া। এবার ডোজ আরও একটু কড়া করে দেওয়া যেতে পারে।”

ললিত বলল, “তাহলে এবার শ্যামই খরচটা দিক।”

“আমি একলা কেন?” শ্যাম আপত্তির গলায় বলল।

“তোর জন্যেই এই লড়াই। তোকে নিয়েই আমাদের লড়তে হচ্ছে। তুই শালা চ্যাম্পিয়ন হবি।”

শ্যাম কি যেন ভেবে বলল, “আমার একলার সঙ্গে লড়াই হচ্ছে না, হচ্ছে আমাদের সঙ্গে; তা হলেও তোরা বলছিস যখন আমি দেব, টাকা দেব।…যা অপমান সয়েছি সেদিন।”

সামান্য পরেই মণিমালা এল।

মণিমালা আসতেই সিধুরা সহর্ষে হুররে দিয়ে উঠল।

মণিমালা হেসে বলল, “হল কি তোমাদের? এত ফুর্তি?”

সিধু বলল, “বউদি, ওষুধ ধরেছে। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ।”

ললিত বলল, “তোমার চাল টেরিফিক লেগে গেছে বউদি, এতটা আমরা ভাবিনি। তোমায় একটা মিনিস্ট্রি দেওয়া উচিত।”

মণিমালা উৎসাহিত হয়ে বসে পড়ে বলল, “শুনি শুনি, ব্যাপারটা বলো।”

সিধু বলল, “আর কোনো ব্যাপার নেই বউদি, আমি আসল গোয়েন্দা লাগিয়ে ছিলাম, বসন্ত বিলাপে রোজ দশ-পনেরোখানা করে আসছে।”

দত্তগুপ্ত বলল, “আরও আসবো গো বউদিদি; শ্যামচাঁদের পয়সায় রিপিট ডোজ্‌ আড়নের কথা ফাইন্যাল হইছে না।”

ললিত বলল, “হ্যাঁ ; আমরা ভাবছি—আর একবার—রোববারেই আর-একটা ঝেড়ে দিন ব্যাপারটা বেশ পোক্ত হবে। তুমি কি বল?”

শ্যাম বলল, “আপনার কনসেন্ট পেলেই আমরা দিয়ে দি।”

মাথা হেলিয়ে হেসে মণিমালা বলল, “বেশ ভাল কথাই তো। দিয়ে দিন।”

চার বন্ধুই আবার সহর্ষে চৌকি চাপড়াল।

শ্যাম বলল, “বউদি, আপনি সত্যিই গ্রেট।”

সিধু বলল, “আপনার কী মাথা! আমাদের ঘোল খাইয়ে দিতে পারেন।”

দত্তগুপ্ত বলল, “আপনারে অবশ্য আমাগো রসোগোল্লা খাওয়ান দরকার। …খাইবেন নাকি !”

হাসির চোটে ফেটে পড়তে পড়তে মণিমালা বলল, “মাঝপথে নয়, একেবারে শেষে। আগে আপনারা সত্যি সত্যিই জিতুন, তারপর।”

ললিত রঙ্গ করে বলল, “ফাইন্যাল ভিক্টরির পর তোমায় আমরা একমাস সিনেমা দেখাব, যে বই আসবে ; চপ কাটলেট মিঠে পান খাওয়াব, যত খেতে পার। যদি বলো তো আমাদের আড্ডার নামটাও তোমার নামে রেজিস্ট্রি করে দিতে পারি। …কিন্তু বউদি, মেয়ে বলেই তোমার এরকম প্যাঁচালো বুদ্ধি, ভীষণ অরিজিন্যাল কিন্তু সূক্ষ্ম। আমার ফিউচার যে কী, ভগবানই জানেন।”

মণিমালা হাসতে হাসতেই জবাব দিল। “তোমার বেলায় আরও সূক্ষ্ম হব।”

চার বন্ধুই হাসতে লাগল।

মণিমালা চলে গেলে ললিত তাস নিয়ে বসল।

শ্যাম নিজের হাতের তাস তুলে নিতে নিতে হঠাৎ বলল, “আচ্ছা ললিত, যদি বসন্ত বিলাপ হেরে গিয়ে আমাদের সঙ্গে ফায়সালা করতে চায়। ধর, কো-এক্সিটেন্স চায়। তা হলে?”

ললিত নিজের তাস গুছোতে গুছোতে জবাব দিল, “সেটা পরের ব্যাপার।”

“না, যদি চায় ; ধর না, ওরা চাইল। তা হলে?”

“তা হলে আমি ভাই আমার ফেভারিট—সেই ফ্লুরোসেন্ট মেয়েটাকে চাই—আলো চ্যাটার্জি।”

দত্তগুপ্ত বলল, “তোর চাওয়নে আলো জ্বলব কি সিধু?”

“আলবাত জ্বলবে। নয়ত কি তুই জ্বালাবি শালা?”

“আমার—” দত্তগুপ্ত বাঁ দিকের একটা তাস ডান দিকে টেনে নিল ; বলল, “আমার আলোয় কাম নাই, আমি ভূগোলরে বড়ই ভালবাসি রে সিধু, ভূগোলের ম্যাপখান দেখছস নাকি? আহা রে, চক্ষু সার্থক করে।” দত্তগুপ্ত যাকে ভূগোল বলল, তার নাম পার্বতী সেন, স্কুলের ভূগোল-দিদি।

ললিত অবশ্য তার অভিমত স্পষ্ট করে ব্যক্ত করল না, তবু বোঝা গেল তার পছন্দ কলেজের টীচার নবনীতাকে—যাকে ললিতরা বলে, কুলপি দিদি। এমনি নার্ভ? ঠাণ্ডা আঁটা সাঁটা দিদি।

শ্যাম তার অভিমত ব্যক্ত করল না।

দেখতে দেখতে আরও কিছুদিন কেটে গেল, দিন পনেরো, শ্রাবনের শেষাশেষি প্রবল বর্ষণ নামল। আকাশ যখন সঞ্চিত সব জল ঢেলে দিয়ে একটু ফাঁকা, ঈষৎ কৃপণ, মেঘলা ভাবটা আছে অথচ সারাক্ষণ বৃষ্টি নেই, ঝিপঝিপ করে জল আসছে, পালাচ্ছে, মাঝে মাঝে ইলশেগুঁড়ি ঝরছে তখন আবার এই ঘটনাটি ঘটল।

শ্যাম নিত্যকার মতন সন্ধেবেলায় ললিতের বাড়ি আড্ডা দিতে যাচ্ছিল। এখন আড্ডাটা আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে, কেননা সিধু রোজই প্রায় বসন্ত বিলাপের খবর আনছে। আগে যা ছিল বসন্ত বিলাপের অবস্থা এখন তার চেয়েও খারাপ। বসন্তের কুসুমগুলি এখন—এই সুন্দর বর্ষাতেও রীতিমত নির্জীব হয়ে পড়েছে। ক’দিন ধরে আর টু শব্দ শোনা যাচ্ছে না ওখানে, শ্যামদের আসাযাওয়ার পথে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে চার পাঁচজনে জটলা বাঁধিয়ে আর প্রচ্ছন্ন টিটকিরিও দিচ্ছে না। রাস্তাঘাটে চোখাচোখি হলে চোখ সরিয়ে নিচ্ছে। শ্যামরা সবাই খুশি। কতকগুলো মেয়ে পাড়ায় এসে জুড়ে বসে তাদের নাকাল করবে—এ হয় না। শত হলেও তোমরা মেয়ে। আস্কারা না দিলে তোমরা বাবা গাছে উঠতে পার? পার না।

বোনের ছাতা মাথায় তুলে শ্যাম আস্তে আস্তে হাঁটছিল। বিকেলের পর থেকে আবার ঝিপঝিপ বৃষ্টি চলছে। নেমেছিল জোরে, তবে প্রথম পশলাটা জোরে হবার পর ঝিপঝিপ করে চলছে। শ্যামের আজ মনটাও বেশ ভাল। তার হয়ত একটা প্রমোশন হতে পারে, অফিসে শুনছিল। ছোট প্রমোশন, তবু প্রমোশন তো।

ললিতদের বাড়ির রাস্তাটা আজ তিন-চার দিন ধরে অন্ধকারই পড়ে আছে। মিউনিসিপ্যালিটির আলো, জল ঝড় বৃষ্টিতে কোথায় কি গণ্ডগোল হওয়ায় তা আর এখনও সারানো হয়ে উঠল না। না উঠুক, চোখ বেঁধে দিলেও শ্যামরা এ-গলি দিয়ে চলে যেতে পারবে।

বেশ খানিকটা অন্ধকারের মধ্যে দিয়েই শ্যাম টিপটিপে বৃষ্টির মধ্যে হাঁটছিল। বসন্ত বিলাপের কাছে আসতেই শ্যাম তার সামান্য তফাতে কাকে যেন রাস্তায় উবু হয়ে পড়ে যেতে এবং ককিয়ে উঠতে শুনল।

উপেন স্যাকরার দোকান বন্ধ। হোমিও গিরিজার ডিসপেনসারিতে আলো জ্বলছে অবশ্য, কিন্তু সে আলো এতটা পৌঁছচ্ছে না। হোমিও গিরিজার আলোও হোমিও—একরত্তি, জ্বলে কি জ্বলে না বোঝা যায় না।

শ্যাম তাকাল। মাথায় কাপড় তোলা এক মহিলা। একেবারে রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। পড়ে হাত পা চেপে যেন ককিয়ে ককিয়ে যন্ত্রণা প্রকাশ করছে।

বৃষ্টিটাও এ-সময় একটু বড় বড় ফোঁটায় পড়ছিল। মেয়েটি ছটফট করছে যন্ত্রণায়। নিশ্চয় অন্ধকারে আচমকা হোঁচট খেয়ে পড়েছে, কিংবা কোনো গর্তে পা দিয়ে ফেলেছে।

শ্যাম অবিবেচক হতে পারে না। পাড়ারই জানাশোনা কোনো বাড়ির বউ হবে।

এগিয়ে গিয়ে শ্যাম বলল, “কি হল, পড়ে গেলেন?”

যন্ত্রণা বোধহয় অতি তীব্র, অসহ্য ; মাথা নাড়িয়ে ছটফট করতে করতে আকারে প্রকারে এবং যন্ত্রণা-কাতর গলায় মেয়েটি যেন কি বলল ; শ্যামের মনে হল, ওকে তুলে ধরতে বলছে। পায়ে বোধ হয় জোর চোট পেয়েছে মেয়েটি।

শ্যাম উদ্বেগের গলায় বলল, “আপনাকে ধরব নাকি? উঠে দাঁড়াতে পারছেন না?”

মেয়েটি হাত বাড়িয়ে দিল সামান্য, শ্যামকে হাত ধরে উঠিয়ে দিতে বলছে।

শ্যামের এক হাতে ছাতা, অন্য হাত দিয়ে সে মেয়েটিকে সাহায্য করল উঠতে। বেচারি মেয়েটির গা হাত ভিজে, মাথার খোঁপা থেকে কাপড়টাও কাঁধে খসে পড়েছে। মুখ তুলতে পারছিল না যন্ত্রণায়, কান্নার গলায় বলল, “আমি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছি না, ওপাশটায় একটু পৌছে দিন।”

শ্যাম হাত ধরে থাকল, সাহায্য করল আর মেয়েটি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে রাস্তার পাশে বাড়িটার চৌকাঠের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

শ্যাম গোলমালে একেবারেই লক্ষ করেনি, মেয়েটি বসন্ত বিলাপের চৌকাঠে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। বরং শ্যাম জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, “গোড়ালি মচকে ফেলেছেন নাকি? কোথায় লেগেছে? একটা রিকশা ধরে দেব?” শ্যাম বুঝি মাত্র দু তিনটি শব্দ উচ্চারণ করেছে—হঠাৎ বুকের ওপর পিস্তল ধরে শাসাবার মতন করে সেই মেয়েটি শ্যামের পাঞ্জাবির বুকের কাছটায় ভীষণ জোরে মুঠো করে চেপে ধরে গর্জন করে বলল,“শিঘ্রি ভেতরে ঢুকুন, নয়ত চেঁচাব। ঢুকুন শিঘ্রি…।”

শ্যাম কিছু বোঝার আগেই মেয়েটি ঠেলে সদরের ওপারে ঢুকিয়ে দিল। আর শ্যাম দেখল দরজার পাশ থেকে সদরের গলি থেকে জনা চার পাঁচ মেয়ে বেরিয়ে এসে তাকে ঘিরে ফেলেছে।

একেবারেই বিমূঢ় বিহ্বল শ্যাম। তার পালাবার পথ নেই। ওই মেয়েটা যেটা রাস্তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে ককাচ্ছিল সে এখন দিব্যি সোজা পায়ে দাঁড়িয়ে দু চারবার যেন লাফও মারল, গলার স্বরে পিঁপড়ে কামড়াবারও কষ্ট নেই।

ভ্যাবাচাকা খেয়ে শ্যাম বলল, “মানে? আমায় এ-ভাবে—”

“মানে—?” সেই রাস্তার মেয়েটি বলল, “মানে বোঝাচ্ছি। এই লিলি, তোর হাতে কি আছে?”

“জিওমেট্রি বাক্সের কাঁটা।”

“ঠিক আছে। ও বেশি টেণ্ডাই মাণ্ডাই করলে প্যাঁক করে ফুটিয়ে দিবি।”

“মানে ব্যাপারটা কি, আপনারা……” শ্যাম কি স্বপ্ন দেখছে নাকি?

“শাট্ আপ্। কথা বললে ছুঁচ দিয়ে মুখ সেলাই করে দেব। এই অনিমা তোর হাতে কি আছে?”

“স্কেল।”

“শুভ্রা তোর কাছে কি আছে?”

‘কাঁচি।”

“আর কিছু বললেই ওর মাথার চুল কেটে দিবি ক্যাঁচ করে।”

শ্যাম আত্মরক্ষার জন্যে মাথার ছাতাটা গুটিয়ে ফেলল। একটা মাত্র দৌড়। পাঁচ পা দূরে চৌকাঠ, এদের ঝটকা মেরে ঠেলে ঠুলে পাঁচ পা এগুতে পারলেই শ্যাম বেঁচে যাবে। দেবে নাকি ধাক্কা? দু চারটে ঘুঁষি চালাবে? ছাতা পেটা করে পালাবে?

কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। কম্পাসের কাঁটা, স্কেল, রুল, কাঁচি—এবং না জানি আরও কি অস্ত্রশস্ত্র হাতে এই নারী বাহিনী তাকে ব্যুহ রচনা করে রয়েছে। শ্যাম পালাবার চেষ্টা করলেই এরা আক্রমণ করবে। সেই আক্রমণে শ্যামের ধুতি জামা, গায়ের চামড়া, মাথার চুল, পিতৃদত্ত নাক কান— থাকবে কি থাকবে না শ্যাম বুঝতে পারল না।

সেই মেয়েটা—যার পাকা অভিনয়ে ভুলে শ্যাম একেবারে বুন্ধুর মতন বসন্ত বিলাপে পা দিয়ে ফেলেছে, সে সঙ্গিনীদের বলল, “ওকে দোতলায় নিয়ে চল।” বলে শ্যামকে উদ্দেশ্য করে টিটকিরি মেরে হুকুম করল, “শুনুন শ্যামচন্দরবাবু, আপনাকে দোতলায় যেতে হবে। লক্ষ্মী ছেলের মতন চলুন। লিলি দরজাটা বন্ধ করে দে।”

শব্দ করে সদর বন্ধ হল। শব্দটা শ্যামের বুকের ওপর এমনই জোরে লাগল যে শ্যামের বুক ধকধক করতে লাগল। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে শ্যামের, পা কাঁপছিল। শ্যাম ঠোঁট ভেজাচ্ছিল বার বার। ছি ছি, শ্যাম একটা মেয়ের চালাকির কাছে হেরে গেল। রাস্তার মধ্যে একবারও শ্যাম কেন মেয়েটার মুখ ভাল করে দেখল না, কেন বুঝল না—ওই মাথার কাপড় তুলে রাখার ব্যাপারটা পুরোপুরি ফল্স্, শ্যামকে ভাঁওতা মারা, এবং বৃষ্টির জল বাঁচানো। এখন শ্যাম মেয়েটাকে চিনতে পারছে, বিজয়া চৌধুরী, সোশ্যাল ওয়েলফেয়ারে চাকরি করে।

শ্যামকে ওরা ঠেলছিল। শ্যাম বলল, “ব্যাপারটা কি হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি না। কি করছেন আপনারা? দোতলায় আমি কেন যাব?”

শ্যামের কথায় সমস্বর একটা হাসি উঠল। বিজয়া বলল, “কেন যাবেন গিয়েই বুঝতে পারবেন।…কথা বাড়িয়ে লাভ নেই, চলুন। আপনার জন্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আর বৃষ্টিতে ভিজতে পারছি না।”

শ্যাম শেষবার প্রতিবাদ করে বলল, “যদি না যাই কি করবেন?”

“পুলিশ ডেকে আনব। বৃষ্টির মধ্যে সন্ধেবেলায় মেয়েদের হোস্টেলে ঢোকার জন্যে পুলিশে ধরিয়ে দেব।”

পুলিশের নামে শ্যামের সমস্ত পেটটা আমাশার ব্যথার মতন মোচড় দিতে লাগল। সর্বনাশ ! এরা সব ছকে রেখেছে যে!

অগত্যা শ্যাম এগুতে বাধ্য হল। বিজয়া শ্যামের আগে ; বাকি মেয়েরা শ্যামের পেছনে। সদ্য বন্দী শত্রুর মতন মেয়েরা শ্যামকে আগলে নিয়ে দোতলায় উঠে এল।

লিলি বলল, “প্রতিমাদির ডিউটি, আজ ফিরবে না। রাধাদি বলেছে—প্রতিমাদিদের ঘরেই নিয়ে যেতে।”

বিজয়া বলল, “রাধাদিকে ডাক। আর সবাইকে।”

শ্যামকে ঠেলে নিয়েই ওরা একেবারে শেষ প্রান্তের ঘরে ঢোকাল। ঘরে বাতি জ্বলছিল।

শ্যাম ঘরটা একবার দেখল : গোটা তিনেক তক্তপোশ, বিছানা পাতা ; কাঠের আলনা, দড়ির আলনা, শাড়ি সায়া জামা ঝুলছে; কাঠের সস্তা র‍্যাক আর টেবিল—বইপত্র, কাগজ মাথার তেল, ক্রীম পাউডার, চুলের ফিতে, ওষুধের শিশি আরও কত কি।

শ্যামকে কেউ বসতে বলল না। বেচারি দাঁড়িয়ে থাকল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই আলোতে সে তার শত্রুপক্ষকে দেখতে লাগল। সব কটার মুখে চাপা হাসি, বিজয় গর্বের হাসি তো বটেই, তার সঙ্গে বাঁকা হাসিও মেশানো। প্রচ্ছন্ন একটা কৌশলের আভাসও যেন ওদের চোখে মুখে ফুটে আছে।

লিলি খোঁচা মেরে বলল, “তোয়ালে এনে দেবে নাকি? গা-মাথা মুছবেন?”

শ্যাম মাথা নাড়ল, না।

অনিমা বলল, “একটা ময়লা গামছা এনে দে বরং, ওই মাথা আর তোয়ালে দিয়ে মোছে না।”

আবার এক দফা হাসি উঠল। শ্যাম দেখল, নিচে থেকে তাকে যারা ধরে এনেছিল দোতলায় এসে তাদের দল আরও ভারি হয়ে উঠেছে। আলো চ্যাটার্জী, পার্বতী সেন, মীনা গুপ্ত—সবাই আছে। শ্যামের কান্না পাচ্ছিল।

এমন সময় পায়ে শব্দ তুলে এবং গলায় আওয়াজ দিয়ে সিংহবাহিনী—অর্থাৎ সেই অনুরাধা সিংহ এল। মেয়েরা সবাই গা সরিয়ে তাদের রাধাদি—অর্থাৎ, বাহিনীর সবাধিনায়িকার জায়গা করে দিল। রাধার হাতে একটা ফাইল, আর চোখে চশমা।

নাক কোঁচকালো, ঠোঁট ওলটালো তারপর অনুরাধা ঘরে ঢুকে শ্যামকে একবার আপাদমস্তক তির্যক চোখে, সঘৃণায় লক্ষ করল, এগিয়ে গিয়ে জানলার দিকে দাঁড়াল। শ্যামের পা তখন রীতিমত থরথর করে কাঁপছে, গলার কাছে সোডার গুলির মতন ভয়ের একটা শক্ত বল আটকে আছে। শ্যামের মনে হল সে একেবারে অনুরাধার পায়ের ওপর পড়ে পা জড়িয়ে ধরে।

একটা চেয়ার টেনে অনুরাধা—বা রাধা বসল। বসেই হুকুম করল, “ওকে একটা টুল দে বসার।”

কে যেন একটা টুল এনে দিল।

রাধা গম্ভীর গলায় বলল, “দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলির পাঁঠার মতন কাঁপতে হবে না। ওই টুলে বসা হোক।”

দাঁড়িয়ে থাকার অবস্থা শ্যামের ছিল না। সে সত্যিই বলির পাঁঠা। শ্যাম নিজেকেও নিজে পাঁঠা বলল। এবং অসহায়ের মতন বসল।

শ্যামকে আবার ভাল করে দেখে রাধা বলল, “মাথাটাথা মোছা হবে নাকি?”

মাথা নাড়ল শ্যাম। না।

“ভাল। ……তা মশায়ের নাম কি শ্যামচন্দ্র?”

“না, শুধু শ্যাম।”

“শ্যামের পর কিছু নেই?”

“না” শ্যাম বলল, বলেই সে এত বিপদের মধ্যে একটা বিদ্বেষপূর্ণ রসিকতা করে বলল, “শ্যামের পাশে মানাবার মতন কিছু এখনও খুঁজে পাইনি।”

রাধা ইঙ্গিতটা বুঝল। মেয়েরাও ঠোঁটের ফাঁকে হেসে ফেলেছে। খানিকটা যেন ব্যঙ্গ করেই রাধা বলল, “টিকটিকির আবার পাখা গজাবার সাধ !…তা কেষ্ট ঠাকুরের বাবার নাম কি অনাদিচরণ বাবু?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ।”

“পলাশ পাড়ার দিকে থাকা হয়?

“হ্যাঁ।”

“বয়স কত?”

“চৌত্রিশ।”

“চাকরি বাকরি তো মোটামুটি ভালই করা হয়।”

“চাকরি একটা করা হয়।”

রাধা এবার মুহূর্ত কয় চুপ করে থেকে সঙ্গিনীদের দিকে তাকিয়ে চোখে চোখে যেন কি কথা বলে নিল। পরে বলল, শ্যামকেই, “সেদিন স্টেশনে আমার কাপড় পুড়িয়ে ছিল কে?”

শ্যাম এভাবে চোরা মার খাওয়া বরদাস্ত করতে পারছিল না। বলল, “আমি সেদিন ইচ্ছে করে আপনার শাড়ি পোড়াইনি। অ্যাকসিডেন্টলি হয়ে গেছে। আমার অবশ্য কেয়ারফুল হওয়া উচিত ছিল। আমি তার জন্যে ক্ষমা চেয়েছি।…যদি তাতেও না হয়ে থাকে, শাড়ির দাম দিতে রাজি।”

আলো টিটকিরি দিয়ে বলল, “ইস্…খুব যে টাকার তেজ।”

পার্বতী বলল, “তেজস্ক্রিয় না কি বলে যেন, একেবারে তাই, না রে আলো!”

খিল খিল হাসি উঠল মেয়েদের মধ্যে।

শ্যামের আর সহ্য হচ্ছিল না। কান, নাক, চোখ জ্বালা করছিল। শ্যাম রাধার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমায় এখানে এভাবে কেন ধরে আনা হয়েছে আমি জানতে চাই।”

লিলি একটা মন্তব্য করল : আহা রে, কচি খোকা…।

রাধা বলল, “কেন ধরে আনা হয়েছে আপনি জানেন না?”

“না। এটা অন্যায়।”

রাধা যেন সাঁড়াশির মতন চোখ করে শ্যামের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনাকে কি জামাই আদর করার জন্যে ধরে আনা হয়েছে ভাবছেন?”

“না, তা তো নয়ই। দেখতেই পাচ্ছি।” বলে শ্যাম কাঁটা, কম্পাস, স্কেল, কাঁচি সজ্জিত মেয়েদের দিকে তাকাল।

রাধা বলল, “এ বাঁদরামি কে করেছে?”

“কি ?”

“জানেন না। …এই লিলি দে তো তোর হাতের কাঁটা দুটো। দেখছি জানে কি না।” বলে রাধা হাতের ফাইলটা নাড়ল। “বলি, কাগজে—বাংলা কাগজে—কে আমাদের ঠিকানা দিয়ে বিয়ের বিজ্ঞাপন ছেপেছে?”

শ্যাম একেবারেই চুপসোনো ফানুসের মতন হয়ে গেল। তার অবশ্য মনে মনে এরকম একটা সন্দেহ হচ্ছিল, কিন্তু ব্যাপারটা এত গোপনে করা হয়েছে যে বসন্ত বিলাপের মেয়েদের জানার কথা নয়। কোথায় কলকাতায় কাগজে টাকা পাঠিয়ে বিজ্ঞাপন ছাপার ব্যবস্থা আর কোথায় এরা? কি করে জানবে?

রাধা ততক্ষণে আবার জোরে ধমকে উঠেছে। “কে দিয়েছে বিজ্ঞাপন?”

শ্যাম আত্মরক্ষার জন্যে দিশেহারা হয়ে গেল। সর্বনাশ, তাদের কীর্তি যে ফাঁস হয়ে যাচ্ছে! ব্যাপারটা শাড়ি পোড়ানোর চেয়ে মারাত্মক, শ্যাম যদি স্বীকার করে নেয় তবে এই বসন্ত বিলাপের দল তার ছালচামড়া ছিঁড়ে নিয়ে ডুগডুগি বাজাতে বসবে।

চুপসোনো মুখে, গোঁ গোঁ শব্দ করতে করতে শ্যাম খানিকটা থুধুই গিলে ফেলল। অসহায়ভাবে মাথা নেড়ে বলল, “আজ্ঞে আমি কিছু জানি না। কিসের বিজ্ঞাপন?”

রাধা চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠল। “জানেন না?…মিথ্যেবাদী, লায়ার চোর…।”

শ্যাম প্রায় হাতজোড় করে বলল, “সত্যি বলছি, বিশ্বাস করুন।”

“এই আলো—” রাধা রক্তচক্ষু হয়ে হাত বাড়ালো, “ওই পাখাটা দে তো, আজ আমি ওর মাথায় পাখার বাঁট ভাঙব।”

আলো একটা বিছানার পাশ থেকে একটা পাখা তুলে নিল।

শ্যাম বলল, “আপনারা সবাই মিলে আমার ওপর অত্যাচার করছেন।” বলার সময় দেখল পাখাটা সিংহবাহিনীর হাতের কাছে নিয়ে আলো দাঁড়িয়ে আছে।

“কাগজে বিয়ের বিজ্ঞাপন আপনারা দেননি?” রাধা ধমকে ধমকেই বলল, “আমাদের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে পাত্র চাই বলে কে তাহলে বিজ্ঞাপন দিয়েছে?”

শ্যাম গোবেচারি ও ন্যাকা-বোকার মতন করে বলল, “আমি কি করে জানব। কিসের বিজ্ঞাপন ?”

রাধা হাতের ছোট ফাইল খুলে কিছু কাগজপত্র সরিয়ে, দুটো কাগজ বের করল। শ্যামের কাছে এগিয়ে এসে ভাঁজ করা কাগজের একটা জায়গা দেখাল, লাল পেনসিলের ঘেরা দেওয়া। শ্যাম দেখার ভান করল।

“এই বিজ্ঞাপন কে দিয়েছে?” রাধা জেরা শুরু করল।

“আমি জানি না।”

“মিথ্যুক, বেয়াদব। …..এই বিজ্ঞাপনে কি লেখা হয়েছে জানেন না আপনি?”

“কি করে জানব?”

“লেখা হয়েছে যে এই ঠিকানায় বামুন, কায়স্থ, বদ্যি উজ্জ্বল শ্যাম, শ্যাম, গৌরাঙ্গী, বয়স্ক, কম বয়স্কা চাকরি করা বহু পাত্ৰী আছে। বিবাহযোগ্যা এই মেয়েদের জন্যে পাত্র চাই।”

শ্যাম পর পর দুবার ঢোঁক গিলল।

“বিজ্ঞাপনটা ক’বার বেরিয়েছে জানেন?”

“আজ্ঞে না।”

“দু বার। দ্বিতীয়বার আরও নতুন নতুন কথা আছে।”

‘ও !”

“কত চিঠি এসেছে জানেন—এই ঠিকানায়?…কত চিঠি এসেছে অনিমা?”

“অনেক—প্রায় দুশো তো হবেই। এখনও আসছে।”

“তাহলে?” রাধা শ্যামের দিকে ছুরির মতন ধারালো চোখে তাকাল। “কি বলার আছে আপনার?”

বলার বাস্তবিকই কিছু নেই। ভেজা মাথায় বসে থাকতে থাকতে শ্যাম হাঁচল।

বিজয়া লিলির হাত থেকে জ্যামিতি বাক্সর দুমুখো ছুঁচলো কাঁটা কেড়ে নিয়ে এসে শ্যামের একেবারে হাতের কাছে দাঁড়াল, দাঁড়িয়ে কাঁটাটা শ্যামের মুখের কাছে তুলে বলল, “ক্যাবলার মতন করে তাকাবেন না, চোখে ফুটিয়ে দেব প্যাঁক করে।”

শ্যাম ভয়ে চোখের পাতা বুজে ফেলল।

আলো বলল, “অত দরকার কি, পুলিশে দিয়ে দে না! পুলিশের জিম্মায় দিয়ে দে। আর সঙ্গে সঙ্গে সম্ভ্রমহানির একটা মামলা সবাই মিলে ঠুকে দি। দেখি ধর্মের ষাঁড় কোথায় পালায়?”

শ্যাম ভয়ে আঁতকে উঠে বলল, “মামলা?”

“বাঃ, মামলা করব না—” আলো বলল, “আমাদের মান সম্মান সম্ভ্রম, আমাদের পারিবারিক সুনাম নষ্ট করে যারা আমাদের সম্মানহানি করছে তাদের নামে মামলা করব না!…এতগুলো মেয়ের একসঙ্গে মামলা দেখি, কোর্ট কি করে ছাড়ে আপনাদের।”

শ্যাম আর কোথাও কোনো পথ দেখতে পেল না। শালা শেষপর্যন্ত। মেয়েছেলেদের ব্যাপার নিয়ে মামলা? ক্রিমিন্যাল কেস হবে নাকি? হতে পারে। বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে, সারা শহরে রই রই পড়ে যাবে, জেলে গিয়ে ঘানি ঘোরাতে হবে। শ্যাম যেন ঘামতে লাগল। “আপনারা আমায় একলা পেয়ে যা খুশি বলছেন।”

ভিড়ের মধ্যে থেকে কলেজের টীচার নবনীতা এগিয়ে এসে বলল, “রাধা, উনি যদি এ-সময় কাউকে ডাকতে চান ডাকতে পারেন। ওঁদের তরফে যদি কিছু বলার থাকে শুনে নেওয়া যাক।”

রাধা বলল, “বেশ। একজনকে ডাকতে পারেন। যে কোনো একজনকে।”

“কি করে ডাকব! আমি এখানে?”

“দু’লাইন লিখে দিন, আমরা আনিয়ে নিচ্ছি। …ওবাড়িতে আড্ডায় নিশ্চয় পাব।”

লিলি সঙ্গে সঙ্গে কাগজ কলম এনে দিল। রাধা বলল, “কোনো আজে বাজে কথা লেখা চলবে না। কোথায় আছেন তাও নয়। শুধু লিখবেন—বিশেষ জরুরী, একবার আসতে। লেখাটা আমরা দেখে নেব।”

শ্যাম সামান্য ভাবল। কাকে এ-সময় আসতে লেখা যায়? সিধুকেই লেখা যাক। সিধু নিশ্চয় এসে বসে আছে আড্ডায়। সিধুটা একটু গুণ্ডা গোছের। দত্তগুপ্ত কিছু করতে পারবে না। ললিতটা আরও নার্ভাস। শ্যাম লিখল: “সিধু, পত্রপাঠ চলে আসবি। ভীষণ বিপদ।”

লেখাটা রাধা পড়ে দেখল, তারপর বিজয়াকে দিয়ে বলল, “যা, আর-একটাকে ধরে আন। ওবাড়িতে কেউ যাবি না তোরা, নিচে থাকবি। ঝিয়ের ছেলেটাকে পাঠিয়ে দে। বলে দিস কিছু না বলে যেন।”

বিজয়ারা একদল দৌড়ে ঘর ছেড়ে চলে গেল।

ঘরে শ্যাম টুলে বসে। আর ওদিকে রাধা, চেয়ারে ফিরে এসে বসেছে। নবনীতা বিছানায় বসে আস্তে আস্তে পায়ের পাতা কাঁপাচ্ছিল: আলো দরজার দিকে একটা টেবিলের কোণায় আধ-বসা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

প্রায় চুপচাপ। শ্যাম আটক-করা চোরের মতন হতাশ হতোদ্দম হয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল। ঘরের জানলায় মোটা শিক, রাস্তার বারান্দার দিকের দরজাটা বন্ধ, ঝিপঝিপে বৃষ্টি পড়েই চলেছে। শ্যাম যে বারান্দা থেকে নিচে রাস্তায় লাফ মারবে তার সাহস নেই, উপায়ও নেই। দৌড় মেরে নিচে পালানোও অনর্থক, নিচে পুরো ফৌজ দাঁড়িয়ে আছে সিধুকে ধরে আনার জন্যে। অগত্যা শ্যাম ঘরের জিনিসপত্র, বিছানা, শাড়ি জামা, এটা-সেটা লক্ষ করতে লাগল। করতে করতে সে দেখল, কোণার দিকে দড়ির আলনায় বেশ বাহারী একটা ব্রেসিয়ার ঝুলছে। এই ঘরে কে কে থাকে শ্যাম জানে না; প্রতিমাদি থাকে শুনেছে; আর কে? শ্যাম আড়চোখে ব্রেসিয়ার দেখতে লাগল এবং নানা রকম অনুমান করছিল।

সিধু শালা আসবে তো? নাকি ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে এ-পথ আর মাড়াবে না? বন্ধুর বিপদে সিধু যদি না আসে তবে শ্যাম তার সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক রাখবে না। সিধু, ললিত, দত্তগুপ্ত—সকলেরই এখানে এসে দেখে যাওয়া উচিত শ্যাম কেমন করে কাদায় ডুবে গেছে। একা শ্যাম কেন—ওই তিনটেরও একই হাল হওয়া দরকার, শ্যাম একা জেলে যেতে পারবে না। মণিমালা বউদির কথায় খুব নেচে ছিল সবাই। এবার ঠেলা সামলাও। বউদির ওপর শ্যামের রাগ হচ্ছিল, স্ত্রীবুদ্ধি প্রলয়ঙ্করী।

শ্যাম আবার হাঁচল, একসঙ্গে বার পাঁচেক।

রাধা ভুরু কুঁচকে ধমকে উঠে বলল, “হাঁচির হাট বসিয়ে দিচ্ছেন যে! হাঁচিতে রোগ ছড়ায় সে জ্ঞান নেই। হাঁদা কোথাকার!”

শ্যাম তাড়াতাড়ি নাকে মুখে রুমাল চাপা দিল।

নবনীতা রসিকতা করে বলল, “শ্যামবাবুর জন্যে একটু আদা-চা এনে দে, আলো।”

আলো গা দুলিয়ে ঘাড় হেলিয়ে বলল, “চা খাবেন নাকি শ্যামবাবু?”

মাথা নাড়ল শ্যাম; না খাবে না। আলো—সিধুর ফ্লুরোসেন্ট ল্যাম্প—সত্যিই বেশ জ্বলজ্বলে। বড় বড় চোখ, ডাসা নাক, বেশ স্লিপ্মারা চেহারা।

নবনীতা আর রাধা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে যদিও তবু শ্যাম বুঝতে পারছে—কথাটা শ্যামদের নিয়ে, পুলিশ ডাকা মামলা করা এইসব সংক্রান্ত। শ্যামের মাথা ধরে উঠছিল।

এমন সময় নিচের দিকে হইহই। সিঁড়িতে দুপদাপ। তারপর সিধুর গলা।

সিধুকে চারপাশ থেকে ঘিরে মেয়েরা ঘরে ঢুকল। সিধুর অবস্থা ভাল নয়, একেবারে ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছে, মাথার চুল এলোমেলো, জামার একটা পকেট ছিঁড়ে গেছে, সিধু জড়সড়, কাঠ।

সিধু ঢুকতেই শ্যাম প্রায় ছেলেমানুষের মতন ডুকরে উঠল, “সিধু!”

সিধু সিংহবাহিনীর মুখোমুখি হয়ে একেবারে ভূত দেখার মতন আঁতকে উঠল। তার গলায় আর শব্দ বেরোচ্ছে না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিধু কিম্ভূত ধরনের একটা শব্দ করল।

রাধা মেয়েদের বলল, “আর একটা টুল-ফুল এনে দে ওকে। ভিরমি খেয়ে না পড়ে যায়!”

শ্যাম আবার ডাকল, “সিধু।”

ধাতস্থ হতে সিধুর একটু সময় লাগল। কিন্তু ধাতস্থ হবার পর সিধু বেশ তাড়াতাড়ি সাহস সংগ্রহ করতে লাগল। একটা ভাঙা মোড়া এনে দেওয়া হয়েছিল সিধুকে বসতে। সিধু শ্যামের পাশে বসল।

রাধা বলল, “নামটা কি সিদ্ধেশ্বর গাঙ্গুলী?”

সিধু মাথা হেলিয়ে সায় দিল। বলল, “আমাকে এখানে আনার মানেটা কি?” বলে শ্যামের দিকে তাকাল। “কি হয়েছে রে?”

শ্যাম অসহায়ের মতন বলল, “আমাকে এঁরা রাস্তা থেকে ধরে এনেছেন।”

“ধরে এনেছে!…কচি খোকা!” আলো টিটকিরি মেরে মন্তব্য করল।

সিধু আলোর দিকে তাকাল। “শ্যাম নিজে এখানে আসতেই পারে না।”

লিলি বলল, “আসবে কি করে? এলে যে পা খোঁড়া করে দেব।”

রাধা বলল, “চুপ! তোরা চুপ করে থাক।”

মেয়েরা চুপ করে গেল।

রাধা সিধুকে বলল, বেশ গম্ভীর পরিষ্কার গলায়, “আপনার বন্ধুকে আমরা রাস্তা থেকে ধরে এনেছি। হ্যাঁ—এনেছি।”

“এটা কিডন্যাপিং…”

নবনীতা হাসল। বলল, “কেন এনেছি জানেন?”

“না।”

রাধা বলল, “আপনারা ইতর, অসভ্য, জন্তু…।”

সিধু চোখ বড় বড় করে চেয়ে থাকল।

রাধা বলল, “ধরে আনার কারণ আপনার পেয়ারের বন্ধু শ্যামচন্দরকে বলা হয়েছে শুনে নিন।”

সিধু শ্যামের দিকে তাকাল। অবশ্য সিধু এতোক্ষণে সবটাই বুঝতে পেরেছে।

শ্যাম বলল, “খবরের কাগজে—রবিবারের কাগজে—একটা বিয়ের বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে ভাই। এখানকার, এ বাড়ির ঠিকনা দিয়ে। তাতে নাকি লেখা আছে—এখানে নানারকম—ভেরিয়াস টাইপের মেয়ে পাত্রী আছে, বিয়ের যুগ্যি। …সেই বিজ্ঞাপন বেরুবার পর চিঠি এসেছে অনেক…”

বাধা দিয়ে একজন কে বলল, “ঘটকও এসেছে।”

শ্যাম নিজের কথা শেষ করল। “এঁরা বলছেন বিজ্ঞাপনটা আমরা দিয়ে দিয়েছি। দেখ তো ভাই, কী রকম খারাপ অ্যালিগেশান।”

সিধু হঠাৎ বলল, “মাইরি আর কি!”

সঙ্গে সঙ্গে আলো জিভ ভেঙিয়ে বলল, “আহা, ইললি রে…”

রাধা চেয়ারে বসে সিধুকে ধমকে উঠল জোরে, “ছোটলোকের আড্ডা নাকি এটা? মাইরি-ফাইরি চলবে না। ভদ্র ভাষায় কথা বলুন।”

সিধু বলল, “ইললি বললে দোষ নেই?”

“বাজে কথা থাক। কাজের কথার জবাব দিন।”

“বলুন।’

“বিজ্ঞাপনটা আপনারা দিয়েছেন।”

“আপনারাও দিতে পারেন।”

আলো ছুটে এল, যেন সিধুর মাথার চুলের ঝুঁটি ধরেই নেড়ে দেবে। বলল, “আমরা বিজ্ঞাপন দিয়েছি। মিথ্যেবাদী, পাজি…”

সিধু বলল, “আমরাই বা দেব কেন? বিজ্ঞাপন দিতে পয়সা লাগে। আপনাদের জন্যে আমরা চ্যারিটি করব কেন?”

একটু চুপ। নবনীতা মৃদু হেসে বলল। “তা ঠিক। তবে এখানে সেটা করা হয়েছে। বিজ্ঞাপনের টাকা আপনারা দিয়েছেন।”

সিধু এবার সন্দিগ্ধ হল। “বাজে কথা, মিথ্যে কথা। আমাদের এতে স্বার্থ কি?”

আলো বলল, “ষোলো আনা স্বার্থ।”

সিধু বলল, “এক আনাও নয়।”

রাধা বলল, “বেশ। কিন্তু সিধুবাবু, গোঁসাই-মশাই, যদি আমরা দেখাই যে এই বিজ্ঞাপন আপনারা দিয়েছেন, তা হলে?”

সিধু ভেতরে ভেতরে ভয় পেলেও মুখে প্রকাশ করল না। বলল, “প্রমাণ থাকলে অন্য কথা।”

“থাকলে কি হবে আগে বলুন?”

“কি আর—” সিধু ঘাবড়ে গেল, “আমাদের যা খুশি করবেন আপনারা।”

“আমরা প্রথমে পুলিশে যাব। শ্যামচন্দরকে আজই হাজতে ঢোকাব। আর আপনাদের নামে মামলা করব। আমাদের এতগুলো মেয়ের সামাজিক ও পারিবারিক মান সম্মান সম্ভ্রম নষ্ট করার জন্যে। বুঝলেন?”

সিধু সবই বুঝতে পেরে গেছে এতোক্ষণে, শ্যামের দিকে ঘাবড়ানো-চোখে চাইল। নিচু গলায় বলল, ‘আলোর সুই কোথায় রে?’…শ্যাম ফিসফিস করে বলল, “কোন্ আলো?”

রাধা চিৎকার করে বলল, “কানে কানে কথা বলার কিছু নেই। আমরা যা বললাম তাই করব।”

সিধু কাষ্ঠ-হাসি হেসে বলল, “আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনারা যা ভাল বোঝেন করবেন। কিন্তু প্রমাণটা… ?”

রাধা তার হাতের ছোট ফাইল ওলটালো। বলল, “আমরা কলকাতার কাগজের অফিস থেকে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, এখান থেকে মানি অর্ডারে টাকা পাঠানো হয়েছে শ্যামচন্দরের নামে। কলকাতায় আমাদের লোক আছে। কবে কত টাকা পাঠানো হয়েছে তাও বলতে পারি। এগারোই জুন আর পয়লা জুলাই। কাগজের অফিসে আমরা চিঠি লিখেছিলাম, তার জবাবও এখানে আছে—দেখতে চান?”

শ্যাম টুল সমেত মাটিতে হাঁটু গেড়ে পড়ল। সিধু একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তড়াক করে দাঁড়িয়ে উঠে হাত জোড় করে কি বলতে গেল। কেউ কোনো কথা শুনল না। আলো সিধুকে চিমটি কাটল বেজায় জোরে, লিলি সিধুর ছেঁড়া পকেট ধরে টান মেরে বাকিটাও ছিঁড়ে দিল। অনিমা শ্যামের পিঠে গুম্ মেরে এক কিল বসিয়ে দিল, আর পার্বতী কুঁজোর জল শামের মাথায় ঢেলে দিল। ওরই মধ্যে কে যেন সিধু এবং শ্যামকে সেফটিপিন দিয়ে ফোটাল, জ্যামিতি বাক্সের দু-মুখো কাঁটা দিয়ে খুঁচিয়ে দিল, দু-চারবার স্কেলের বাড়ি পড়ল।

শ্যাম এবং সিধু পাশাপাশি মাটিতে বসে জোড় হাতে ক্ষমা ভিক্ষা করতে করতে বলল, “আর না, প্লিজ, মরে যাব।”

রাধা হুকুম করল কড়া গলায়। “এই ওদের ছেড়ে দে।”

মেয়েরা সরে দাঁড়াল।

রাধা বলল, দোষ স্বীকার করছেন?”

শ্যাম বলল, “আজ্ঞে হ্যাঁ, করছি। …আপনার পায়ে পড়ছি…”

সিধু বলল, “আমাদের মাপ করুন।”

রাধা বলল, “কিন্তু এই যে আমাদের ইজ্জত নষ্ট করা হয়েছে, এর কি হবে?”

শ্যাম বলল, “যা বলবেন তাতেই রাজি। আমাকে প্লিজ পুলিশে দেবেন না। পুলিশের নাম শুনলেই আমার ডিসেন্ট্রি হয়। মামলা যদি করেন—সে স্ক্যাণ্ডেলাস হবে। শহরে টিকতে পারব না। বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে। চাকরি যাবে।”

নবনীতা বলল, “এ জ্ঞান আগে হয়নি?”

সিধু বলল, “আজ্ঞে না, হলে কি এ-পথ মাড়াই।”

রাধা বলল, “অত সস্তায় চিঁড়ে ভেজে না। এই অপমান, দুর্নাম, সম্ভ্রমহানির ক্ষতিপূরণ কে দেবে?”

শ্যাম এবং সিধু মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।

শ্যাম বলল, “আজ্ঞে, আমাদের কি আছে বলুন—?”

সিধু বলল, “যৎসামান্য মানুষ আমরা, ক্ষতিপূরণ কি করেই বা দিতে পারি?”

রাধা বলল, “তা হয় না। শুধু হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না।”

“মুচলেকা দিচ্ছি।” সিধু বলল।

এমন সময় ঘরের মধ্যে হাসির অট্টরোল পড়ে গেল। মেয়েদের ভিড় সরিয়ে মণিমালা কোথা থেকে এসে হাজির। পেছনে হন্তদন্ত ললিত আর দত্তগুপ্ত।

রাধা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে একেবারে অন্য মূর্তি হয়ে গেল। হেসে, গড়িয়ে আহ্লাদে আটখানা হয়ে বলল, “একেবারে কাঁটায় কাঁটায় এসে পড়েছে, মণিদি, ব্যাঙ কুয়োয় পড়েছে।”

মণিমালা হাসি চাপতে পারছিল না। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে বলল, “এ কি করেছিস রে ওদের? ওমা ছি ছি! আপনারা ভাই উঠে বসুন।”

শ্যাম সিধুর দিকে তাকাল, সিধু শ্যামের দিকে, তারপর দুজনেই ললিত ও দত্তগুপ্তর দিকে তাকাল। ললিতরাও কিছু কম হতবাক নয়। সিধু মণিমালার দিকে তাকিয়ে শেষে বলল, “বউদি, এটা খুব আনফেয়ার কাজ হল। আপনি ট্রেচারি করলেন আমাদের সঙ্গে।”

শ্যাম বলল, “কনস্‌পিরেসি।”

ললিত ক্ষুব্ধ গলায় বলল, “তুমি আমাদের গাছে চড়িয়ে মই কেড়ে নিলে বউদি, এখন বুঝতে পারছি তোমার চালটা কাদের তরফের ছিল।”

দত্তগুপ্ত বলল, “আমাগো খুব খেলাইলেন, বউদিদি। আপ্‌নারে দণ্ডবৎ।”

মেয়ের দল অট্টহাসি হেসে উঠল। নানা গলার, নানা সুরের হাসি। হাসির চোটে ঘরটা ফেটে যাবার জোগাড়।

মণিমালার নাকে-চোখে জল এসে গেছে হাসতে হাসতে। নাক-চোখ মুছে হাসি সামলে বলল, “কেন ভাই, দোষটা কি করলাম। আপনাদের কত হা-হুতাশ ছিল। আমি বরং বসন্ত বিলাপের ঘরে এনে বসিয়ে দিলাম এরপর যার যেমন, কপাল…”

আলো বলল, “কপাল কেন বলছেন মণিদি, বলুন কেরামতি। কার কত কেরামতি।”

সিধু আলোর দিকে তাকাল। তারা উঠে দাঁড়িয়েছে। সিধু দেখল, আলোর সুইচটা হাতের কাছেই। কেরামতি করতে অবশ্য সাহস করল না।

ললিত একপলক নবনীতার দিকে তাকাল। তাকিয়ে কী রকম লজ্জা পেল।

দত্তগুপ্ত ঝট্ করে ভূগোলদিদি পার্বতীকে চোখ টিপে দিয়েই গম্ভীর হয়ে গেল।

মণিমালা বলল, “রাধা এদের তাহলে…”।

রাধা বলল, “এখনকার মতন থাক। তবে ক্ষতিপূরণ তো দিতেই হবে। পরে দেবে। আমরাও ভেবে দেখি।”

সিধু বলল, “তেমন তেমন হলে দিতে পারি। মুচলেকাও।”

শ্যাম বলল, “ওয়ার্ড অফ অনার বউদি। …আমরা এবার যাই?”

“যান।” রাধা সম্মতি দিল।

যাবার সময় মেয়েরা রসিকতা করে একটু উলু দিয়ে নিল।

মাস খানেক হয়নি, ইলশে গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে সন্ধেবেলায় শ্যাম আর রাধা একই সঙ্গে একটা রিকশা করে স্টেশন থেকে ফিরছিল।

রেল অফিসের সামনে জোড়া কদম গাছের তলায় এসে শ্যাম বলল, “তোমার পদবিটা বড় ফেরোশাস রাধা, সিংহী। ওটা বদলে নিলে কেমন হয়?”

রাধা শ্যামের কাঁধের কাছে আলগা ঠেলা দিয়ে বলল, “বদলে নিলেও কি তোমার লাভ হবে কিছু, আমি সিংহীর মতনই থাকব।”

“তা থাকো। তাতে আমার আপত্তি নেই।”

“নেই?”

“না, আপত্তি কিসের! আমি তো তোমার খাঁচায় ঢুকে পড়েছি।…তবে পদবিটা পালটে নাও!…আ, ফার্স্ট ক্লাস কদমফুলের গন্ধ দিয়েছে।”

রাধা বলল, “শুধুই কি গন্ধ! কদমতলায় একেবারে শ্যাম রয়েছেন যে!”

“রাধাও।” শ্যাম হেসে বলল। দু’-জনেই ঘন হয়ে হাসতে লাগল হঠাৎ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

 
বসন্ত বিলাপ

বসন্ত বিলাপ

তখন চিটগং কলেজিয়েট স্কুলে ক্লাস সেভেনে পড়ি। ক্লাসটিচার বড়ুয়া স্যার আমাদের বাংলা পড়ান। স্যার একদিন ক্লাসে এসে বললেন, ‘রচনা লেখো “আমার প্রিয় ঋতু”।’ এই বলেই চেয়ারে পা তুলে তিনি ঘুমের প্রস্তুতি নিলেন। আমাদের সময়ে ক্লাসওয়ার্ক দিয়ে শিক্ষকদের ঘুমানো এবং ঝিমানো স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। এটাকে কেউ দোষের ধরত না। ছাত্ররা তো ক্লাসওয়ার্ক করছেই।
খাতা খুলে বসে আছি, আমার প্রিয় ঋতু কী বুঝতে পারছি না। শীত হওয়ার সম্ভাবনা কি আছে? শীতের সময় আমরা নানাবাড়ি মোহনগঞ্জে যাই। তখন লেপ নামানো হয়। লেপের ভেতর হুটোপুটি। রাতের উঠানে আগুন জ্বেলে চারদিকে গোল হয়ে বসে ভূতের গল্পের আসর। দিনের বেলা ডোবা সেঁচে মাছ ধরা।
প্রিয় ঋতু ‘শীত’ নিয়ে রচনা লেখা শেষ হলো। ক্লাস শেষ হয়ে গেছে, এক্ষনি ঘণ্টা পড়বে। এ অবস্থায় কারোর রচনাই স্যারের পড়ার সময় নেই। আমরা আনন্দিত। হঠাৎ স্যার আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘দেখি কী লিখেছিস?’
আমি ভয়ে ভয়ে খাতা দিলাম। স্যার হুংকার দিয়ে বললেন, ‘প্রিয় ঋতু হবে ঋতুরাজ বসন্ত। তুই লিখেছিস শীত। গাধা, কানে ধর।’
আমি কানে ধরতেই ক্লাস শেষের ঘণ্টা পড়ল। ক্লাস এইটের বৃত্তি পরীক্ষায় রচনা ছিল ‘তোমার প্রিয় ঋতু’। এইবার আর ভুল হলো না, লিখলাম ঋতুরাজ বসন্ত। রচনার ফাঁকে ফাঁকে কোটেশন ঢুকিয়ে দেওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। কোটেশন দেওয়া মানেই ছাঁকা নম্বর।
ঋতুরাজ বসন্ত নিয়ে লেখা কারও কোনো কবিতা মনে না পড়ায় নিজেই রবীন্দ্রনাথ হয়ে গেলাম। লিখলাম—ঋতুরাজ বসন্তের রূপে মুগ্ধ হইয়া বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘কত অপূর্ব পুষ্পরাজি ঋতুরাজ বসন্তে ফুটিয়াছে।’
বালক বয়সে কৃত পাপের প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বসন্তবিষয়ক একটি উদ্ধৃতি (আমার অতি প্রিয়) এখন দিচ্ছি—
‘আহা আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে
এত বাঁশি বাজে
এত পাখি গায়।’
তিনটি মাত্র লাইনে বসন্ত উপস্থিত। বাঁশি বাজার শব্দও কানে আসা শুরু হয়েছে। আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রিয় ঋতু কি বসন্ত? তাঁর বসন্তবিলাস দেখে আমি অবাকই হই। এই ব্যাকুলতার কারণ কী? বঙ্গদেশে শীত প্রায় নেই বলেই বসন্তও নেই। আমাদের অল্প কিছু পাতাঝরা বৃক্ষ, পত্রহীন গাছে বসন্তকালে নতুন পাতা আসার ব্যাপারটা সে জন্যই অনুপস্থিত বলতে হবে। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন শালবনের ভেতর। শালবনে বসন্তকালে নতুন পাতা আসে—এই দৃশ্য অবশ্যই সুন্দর। তখন কিন্তু পুরোনো পাতা ঝরতে থাকে। এই দৃশ্য অতি বিরক্তিকর।
এমন কি হতে পারে যে, রবীন্দ্রনাথের বসন্তবিলাসের পরোক্ষ কারণ পশ্চিমের দেশ? যৌবনে রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমের দেশে কাটিয়েছেন। তিনি দেখেছেন ভয়ংকর শীতের পর আনন্দময়ী বসন্তের আগমনের সর্বজনীন উচ্ছ্বাস। এই থিওরি বাতিল। রবীন্দ্রসাহিত্য পশ্চিমের প্রভাবমুক্ত। অবশ্যি সমালোচকেরা বলেন, ছোটগল্প লেখার প্রেরণা তিনি পেয়েছেন পশ্চিমা ছোটগল্প পড়ে। তাঁর প্রিয় ছোটগল্পকার এডগার এলেন পো।
সমালোচকেরা কোনো এক দুর্বোধ্য কারণে কোনো লেখকের ওপর অন্যের প্রভাব প্রমাণ করতে পারলে বিমলানন্দ উপভোগ করেন। আমি সমালোচক নই বলেই কারও লেখার ওপরই অন্যের প্রভাব পাই না। আর রবীন্দ্রনাথ তো সবার ঊর্ধ্বে। তাঁর কত কবিতায় বৃষ্টির বন্দনা আছে। তিনি অসংখ্যবার পশ্চিম দেশের অপূর্ব তুষারপাত দেখেও এই নিয়ে কাব্য রচনা করেননি।
অন্যদিকে আমাদের জীবনানন্দ দাশের পশ্চিমা সাহিত্যের মুগ্ধতা চলে এসেছে তাঁর কাব্যে। তিনি হয়ে গেছেন হেমন্তের কবি। তাঁর হেমন্ত বঙ্গদেশের হেমন্তও না, পশ্চিমা হেমন্ত। ফুল ও পাখির বসন্ত জীবনানন্দকে ছুঁয়ে যেতে পারেনি।
বসন্ত এসেছে—এই খবর আমি পাই নুহাশপল্লীতে। খবরটা আমাকে দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং। নুহাশপল্লীতে তাঁর অতিপ্রিয় ফুল নীলমণিলতা ফোটে বসন্তকালে। নীলমণিলতা নাম রবীন্দ্রনাথের দেওয়া। বোটানিক্যাল নাম Patraea volobilis. নুহাশপল্লীতে বাগানবিলাস বসন্তেই হেসে ওঠে। বাগানবিলাস রবীন্দ্রনাথের দেওয়া নাম। অন্য নাম Bougain Villea. রবীন্দ্রনাথ তাঁর কন্যা মাধুরীর নামে একটি লতানো গাছের নাম রেখেছেন মাধুরীলতা। এই গাছে ফুল বর্ষাকালে আসে কিন্তু কোনো এক বিচিত্র কারণে নুহাশপল্লীতে বসন্তকালে মাধুরীলতা ফুলে ফুলে ভরে যেতে দেখেছি। মাধুরীলতার ইংরেজি নাম Quisquallis Indica.
বসন্ত মানেই পাখির গান (‘এত পাখি গায়’), মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার মতো করে ডাকে বউ কথা কও পাখি। এক্ষুনি বউ কথা না বললে সে মারা যাবে অবস্থা। এ কারণেই ‘বউ কথা কও’ পাখির আরেক নাম ব্রেইন ফিভার বার্ড। নজরুলের গানে এই পাখি বারবার এসেছে। বউ কথা কও নামে না, পাপিয়া নামে। বসন্তকালেই শিস দিতে শুরু করে কুটুম পাখি। বনফুল বলেন, ‘খোকা হোক পাখি।’ শ্যামা পাখির গান গাওয়ার সময়ও বসন্তকাল। কোকিল ও দোয়েলের কথা তো বলাই হলো না। এরাও বসন্তের পাখি। (যেসব পাঠক বসন্তের পাখি সম্পর্কে আরও অনেক কিছু জানতে চান, তাঁরা পক্ষীবিশারদ সাদত সেলিমের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। প্রেসিডেন্ট, ঢাকা ক্লাব। বসন্তকালে তিনি পাখির গান শোনার জন্য ক্যাসেট রেকর্ডার নিয়ে বনে-জঙ্গলে ঘোরেন।)
নুহাশপল্লীতে বসন্তের দিন হলো পাখিদের জলসার দিন। কাঠঠোকরা পাখি যে ঠকঠক শব্দের বাইরে গানও করতে পারে, তা আমি নুহাশপল্লীতে এক বসন্তে প্রথম শুনি। এই পাখি দেখতে যেমন সুন্দর, তার গানের গলাও অদ্ভুত। কাক বসন্তকালে চুপ করে যায়। কা কা কম করে। মনে হয় অন্য পাখিদের বিশেষ করে তার চিরশত্রু কোকিলের হইচইয়ে বিরক্ত হয়ে চুপ করে যায়। বসন্তে কাকের নীরবতার তথ্যটা মজার না?
রবীন্দ্রনাথকে যদি তাঁর প্রিয় ঋতু নিয়ে রচনা লিখতে বলা হতো, তিনি কি বসন্ত নিয়ে লিখতেন? বসন্ত নিয়ে তাঁর উচ্ছ্বাস দেখে এ রকম মনে হওয়া স্বাভাবিক। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, বঙ্গদেশের প্রতিটি ঋতুর প্রতিই ছিল তাঁর সীমাহীন উচ্ছ্বাস। যিনি লেখেন, ‘বাদলা দিনে মনে পড়ে ছেলেবেলার গান, বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান’, তাঁর প্রিয় ঋতু তো বর্ষা। বর্ষার বর্ণনায় তিনি সেই সব পাখির নাম নিয়েছেন, যারা জলচর এবং শুধু বর্ষাতেই গান করে (ডাহুক, মাছরাঙা, সারস, বকপক্ষী)। তাঁর তীক্ষ পর্যবেক্ষণের বাইরে যাওয়ার উপায় এ দেশের প্রকৃতির ছিল না, আর ছিল না বলেই তিনি লিখতে পেরেছেন, “ও আমার দেশের মাটি তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা।”

পাদটীকা
এক চৈত্র মাসে আমি গ্রামের বাড়িতে গিয়েছি। রোদের তাপে প্রকৃতি ঝলসে যাচ্ছে। মাটি ফেটে চৌচির, আকাশ পিঙ্গল। হঠাৎ দেখি একটা শিমুলগাছ। গাঢ় লাল রঙের ফুল এমনভাবে ফুটেছে যে মনে হয় রোদের তাপে গাছে আগুন লেগে গেছে। আমি মুগ্ধ হয়ে গাছের নিচে দাঁড়ালাম। অবাক হয়ে শুনি, পটকা ফোটার মতো শব্দ হচ্ছে। শিমুল ফুলগুলোর মতো শব্দ করে ফাটে এবং বীজ থেকে বের হয়ে ছোট্ট মেঘের মতো তুলা বাতাসে উড়তে থাকে। এই দৃশ্য প্রথম দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হলাম। বসন্ত! তোমাকে অভিবাদন।

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ০৮, ২০১১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *