পিঙ্গলার প্রেম

পিঙ্গলার প্রেম

ভোরের ট্রেনে এসে পৌঁছল ওরা। তখনও ভাল করে ফরসা হয়নি আকাশ, স্টেশনের বাতিগুলো পর্যন্ত কুয়াশায় ভিজে ভিজে। ইঞ্জিন হল্টের ছাইগাদায় ক’টি কাক সবে উড়ে এসেছে।

মাথায় গলায় মাফলার জড়িয়ে, র‍্যাপারে গা হাত মুড়ে এরা সারা রাত ঠায় বসে ছিল, এরা চারজন—ফ্রেন্ডস ড্রামাটিকের চার ছোকরা। ঠাণ্ডায় বসে বসে ঝিম মেরে গিয়েছিল সকলেই। ভোরের ট্রেন প্লাটফর্মে ঢুকতেই জানলা দিয়ে ওদের মুখ চোখে পড়ল, কিরণশশীদের মুখ। সঙ্গে সঙ্গেই লাফ দিয়ে উঠল এরা। এসে গেছে, এসে গেছে। মাংকি ক্যাপ, মাথায় ঢাকা মাফলার কি র‍্যাপার ঝপাঝপ মুখ থেকে সরিয়ে ফেলে দৌড়োদৌড়ি শুরু করে দিল চারজন।

ভুবন চৌধুরী ততক্ষণে প্লাটফর্মে নেমে পড়েছে। তার মুখে চুরুট, গায়ে অলেস্টার। কিরণশশী জানলা দিয়ে গলা বাড়িয়ে স্টেশন দেখছে। চোখে ঘুমের রেশ লেগে আছে তার, মাথার চুল একটু উস্কোখুস্কো, ঠোঁট দুটি এখনও ফিকে লাল।

ফ্রেন্ডস ড্রামাটিকের মানিক ভুবন চৌধুরীকে নমস্কার করে বলল, “যাক, এসে গেছেন। আমরা সারা রাত—!”

প্রতি-নমস্কার জানিয়ে ভুবন বললে, “হ্যাঁ—দলবল নিয়ে আসা, সন্ধের ট্রেন ধরতে পারলাম না।”

লবঙ্গ ততক্ষণে নেমে এসেছে। জর্জেট শাড়ির ওপর শাল চাপিয়ে কাঁপছে আর হাসছে।

“ও ভুবনদা, এই নাকি মনোহরণপুর।”

“তুমি আবার হরণ পেলে কোথায়—জায়গাটার নাম মনোহরপুর।” ভুবন চৌধুরী বলল।

“তাই নাকি।” লবঙ্গ ফ্রেন্ডস ড্রামাটিকের ফটিকের দিকে তাকিয়ে মাথা দুলিয়ে চোখ বড় করল।

ফটিক মাথা নেড়ে আপ্যায়িত করার হাসি হাসল।

ট্রেন ছেড়ে দেবে। তাড়াতাড়ি হুড়োহুড়ি করে মালপত্র নামাচ্ছিল আর দু’জন।

মানিক ফটিক ছুটে গেল।

কিরণশশী নামল। সতীশ দত্ত আগেই নেমেছে। হেনা, রানী, চাঁপা, পরীরাও নিচে নেমে শীতে কাঁপছে হিহি করে।

জরির চুমকি তোলা চটি-সমেত পা-টা একটু এগিয়ে ভুবনের নজর টানল কিরণশশী। বললে, “পায়ে যে সাড় পাই না!”

“বলেছিলুম তো মোজা পরে নাও।”

“নিলেই হত,” কিরণশশী বাঁ হাত দিয়ে খোঁপার হেয়ারপিনটা ঠিক করে নিতে নিতে স্টেশনের চারপাশে তাকাল। পরমুহূর্তেই ডান চোখের পাতা ক’বার কাঁপিয়ে বুজে ফেলল। বলল, “ও লবঙ্গ, দেখ তো—কয়লার গুঁড়ো পড়ল বুঝি চোখে।”

আঁচলের একটি কোণ সরু করে পাকিয়ে কিরণশশীর চোখ থেকে কয়লার গুঁড়ো তুলতে তুলতে খিলখিল করে হাসল লবঙ্গ, “পা দিতে না দিতেই মনোহরণপুর তোমার চোখ হরণ করল, কিরণদি।”

“মন তো আর হরণ করেনি!” কিরণশশীও ঠোঁট উল্টিয়ে হাসি ছড়িয়ে দিল।

“ও লবঙ্গ, নবরঙ্গ, চা খাবে নাকি? ওই যে টি-স্টল।” সতীশ দত্ত ডাকছে।

ফ্রেন্ডস ড্রামাটিকের মানিক বললে, “আপনাদের চা-টায়ের ব্যবস্থা করা আছে। আস্তানায় গেলেই দেখবেন সব রেডি। যদি বলেন, এখানেও এক দফা হয়ে যেতে পারে।”

“পারে যদি তবে কথায় কেন কাজে হোক, মশাই ; শীতে আমি জমে গেলুম।”

সতীশ দত্ত সিগারেটে টান দিতে লাগল ঘন ঘন।

ফটিক ছুটল টি-স্টলে।

“আমাদের থাকবার জায়গাটা কতদূর?” প্রশ্ন করলে কিরণশশী।

“কাছেই।”

“হেঁটে যেতে হবে তো?”

“না, না—ঘোড়ার গাড়ি রয়েছে স্টেশনের বাইরেই। কোনো কষ্ট হবে না আপনাদের।”

“ঘোড়ার গাড়িতে বাজনা নেই তো?” লবঙ্গ আচমকা বলল। আর বলেই হেসে কুটি-কুটি।

মানিক অবাক ; একটু যেন কেমন অপ্রতিভ। বোকার মতন চেয়ে লবঙ্গর হাসি দেখতে লাগল।

“হাসির তুই কী পেলি?” কিরণশশীও ধমক দিল।

“তুমি জানো না কিরণদি, সে য়া হয়েছিল একবার! লালগোলা না কিষণগোলা কোথায় যেন একবার গিয়েছিলুম, বাপু। তাদেরও ঘোড়ার গাড়ি। আমাকে আর পুতুলকে ঘোড়ার গাড়িতে চাপিয়ে দিয়েছে। যাচ্ছি। ওমা, দেখি ভ্যাঁপোর-পো করে বাজনা বাজছে। কোথায়? না, মাথার ওপর ঘোড়ার গাড়ির ছাদে। আর রাস্তার যত্ত লোক ভিড় করে আসছে। ছুটছে আমাদের পিছু পিছু। কী ব্যাপার, না—কলকাতার থিয়েটারের মেয়েদের দেখছে ওরা।” লবঙ্গ কথা শেষ করে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসির দমক আটকাতে লাগল।

কিরণশশী হেসে মানিককে বললে, “আপনারাও আমাদের বাজনা বাজিয়ে নিয়ে যাবেন নাকি?”

“না, না—!” মানিক মাথা নাড়ল।

বাজনা বাজিয়ে না নিয়ে গেলেও ভুবন চৌধুরীদের আদর-আপ্যায়নে, থাকা-খাওয়ায় কোনো ত্রুটি রাখেনি মনোহরপুর ফ্রেন্ডস ড্রামাটিক ক্লাব। থাকবার জন্যে বাগান-ঘেরা বাড়ি দিয়েছে। কুয়া থেকে জল তুলে দিতে ফাই ফরমাস খাটতে চাকর রেখে দিয়েছে। মুখ ফুটে না চাইতেই চা, খাবার, পান, সিগারেট। স্নানের জন্যে গরম জল চেয়েছিল লবঙ্গ। চোখের পলকে তিন বালতি গরম জল তৈরি হয়ে গেল। খেতে বসে সরু চালের সাদা ধবধবে ভাত, টাটকা শাক-সবজি, পুকুরের মাছ।

ফ্রেন্ডস ড্রামাটিকের সেক্রেটারি কুন্দভূষণ ভূবন চৌধুরীর একটু-আধটু পরিচিত। কলকাতা থেকে ওদের আনা-টানার ব্যবস্থা কুন্দই করেছে। কুন্দকে বললে ভুবন চৌধুরী পরিহাস করেই, “এত তোয়াজ দেখে ভয় হচ্ছে, মশাই। শেষ পর্যন্ত মারধোর দেবেন না তো?”

“আজ্ঞে না, তেমন কোন উদ্দেশ্য নেই। তবে দাদা, প্লে খারাপ হলে দু-চারটে ইট কিন্তু স্টেজে পড়তে পারে!” সহজভাবেই হেসে জবাব দিল কুন্দ।

কথাটা সহজ হলেও স্পষ্ট। যার অর্থ হচ্ছে, কলকাতা থেকে তোমাদের টাকা দিয়ে এনেছি। তোয়াজ করছি যথাসাধ্য। হেলা-ফেলা করে পার্ট করলে চলবে না।

বলতে কি, ফ্রেন্ডস ড্রামাটিক রেল ইনস্টিটিউটের দলকে টেক্কা দেবার জন্যই এত করছে। ইনস্টিটিউট প্রথমে কলকাতা থেকে ক’জন অভিনেতা অভিনেত্রী ভাড়া করে এনে মিলেমিশে দু রাত চুটিয়ে প্লে করছে পুজোর সময়। অভিনয় যেমনই হোক, ভিড় হয়েছিল খুব। সেই থেকে ফ্রেন্ডস ড্রামাটিকের রোখ চেপে আছে। ফ্রেন্ডস ড্রামাটিকের দলের সুনাম ছিল এদিক পানে। ইনস্টিটিউট কম্বাইন্ড-পারফরমেন্স করে সে সুনামের মুখে যেন দুয়ো দিয়ে দিল। তখন থেকেই ফ্রেন্ডস ড্রামাটিকের তর্জন-গর্জন। আচ্ছা, দেখে নেব, আমরাই বা কম কিসে!

কুন্দর কলকাতায় যাওয়া-আসা আছে। তার ওপর সে হচ্ছে সেক্রেটারি। শপথ করেছিল কুন্দ, আচ্ছা আমিও দেখে নেব। গোঁফ কামিয়ে হারাধনকে আর হেলেনের পার্টে নামাচ্ছি না। কলকাতার কিরণশশীকে আনব। যেমন দেখতে আগুন, তেমনি প্লে।

কিরণশশী তিন দফায় দাম নেয়। এক দফা তার রূপের জন্যে, দ্বিতীয় দফা তার অভিনয়ের জন্যে। আর তিন দফার কথাটা জানত থিয়েটার মহলের লোকেরা। কিরণ ভুবনময়। ভুবনকে বাদ দিয়ে কিরণ পাওয়া যায় না। তা ছাড়া ভুবন চৌধুরী নামকরা অ্যাক্টর। কিরণ-ভুবনকে যদি আনতেই হয় মোটা টাকা খরচ করে তবে নাচ-গানের জন্যে লবঙ্গই বা বাদ যায় কেন। সখীর দলও থাক। লবঙ্গ আর সখীর দলের হেনা, চাঁপাকে দিয়ে স্ত্রী-ভূমিকায় অন্যান্য পার্টগুলোও করিয়ে নেওয়া যাবে। এদের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত যোগ হল কমিক অ্যাক্টর সতীশ দত্ত।

বিস্তর পয়সা খরচ করেছে ফ্রেন্ডস ড্রামাটিক কিরণশশীদের জন্যে, তোয়াজে ভিজিয়ে রেখেছে, রাখছে, রাখবেও তিনদিন—কিন্তু বাপু স্টেজে নেমে হেলাফেলা করলে চলবে না। টাকা দিয়েছি—কাজ দেখাতে হবে। কুন্দভূষণের এই কথা।

“আমাদের ব্যাপারটা কি জানেন,” ভুবন চৌধুরী পান চিবোতে চিবোতে বললে, “লোকে নিয়ে যায় ; যাই। নিজেদের টিম হলে কথা ছিল না। মফস্বলের সব অ্যাক্টর, সত্যি বলব কি মশাই পার্ট-ফার্ট করতে জানে না। তাদের সঙ্গে কো-অ্যাক্‌টিং! ও হয় না। কাজেই কোনোরকমে কাজ চালিয়ে দি।”

“আমাদের ক্লাবের অ্যাক্টররা কিন্তু অত কাঁচা নয়, দাদা!” কুন্দ চোখ পিটপিট করে বললে, “অন্তত একজন আছে যে ভাল রকমই পাল্লা দেবে।”

“তাই নাকি? ভুবন অবজ্ঞার হাসি মিশিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করলে, “কোথায় সেই নটরাজ—দেখলাম না তো!”

“এখানে আসেনি এখনো। যথাসময়ে হাজির হবে আর কি!”

সন্ধের গোড়ায় মৃণাল গ্রিনরুমে হাজির। রেল ইনস্টিটিউটের স্টেজ ভাড়া নিয়ে থিয়েটার হচ্ছে। সবই চেনা জানা মৃগাঙ্কর। সটান যথাস্থানে এসে ভাঙা চেয়ারে বসে পড়ল। তখন—সে-ঘরে পুরুষরা মেকআপ নিচ্ছে। চা, সিগারেট হাসি তামাশা।

“এসেছিস?” মৃগাঙ্ককে দেখে কুন্দভূষণ তার পিছু পিছু ছুটে এসেছে, “কোথায় ছিলি সারাদিন?”

“হীরাপুরের বাঁধে মাছ ধরছিলাম।”

“মাছ ধরছিলি, না, বাড়িতে খিল বন্ধ করে বসে পার্ট মুখস্থ করছিলি?”

“না, মাইরি না, কুন্দদা। বিশ্বাস করো, মাছ ধরছিলাম। অবশ্য মাছ ধরতে বসে পার্টের কথাই ভেবেছি সারাক্ষণ।” মৃগাঙ্ক চারদিকে তাকিয়ে গলার স্বর খাটো করে বলল, “কলকাতা থেকে ওঁরা সবাই এসে গেছেন তো!”

“হ্যাঁ।” কুন্দ তার গলার স্বর আরো খাটো করে মৃগাঙ্কর কানে মুখ নিয়ে বলল, “ওই ভদ্রলোক ভুবন চৌধুরী। ওঁর কাছে তোর খুব সুনাম করেছি, মৃগে। আমার প্রেস্টিজ তোর হাতে। প্রাণ দিয়ে অ্যাক্‌টিং করবি, ভাই। আয়—ওঁর সঙ্গে তোর আলাপ করিয়ে দি।”

“বেশ তো, চলো। আমায় কিন্তু এক কাপ চা দিতে বলো, কুন্দদা—!”

ভুবন চৌধুরীর কাছে এনে মৃগাঙ্কর সাথে আলাপ করিয়ে দিলে কুন্দ। বলল হেসে, “আমাদের হিরো।”

ভুবন চৌধুরী স্থির দৃষ্টিতে দেখছিল মৃগাঙ্ককে। চেহারাখানা নায়কের মতনই। সুঠাম অঙ্গ। রং ফর্সা। মুখখানি সুন্দর। ঈষৎ দীর্ঘ মুখের গড়ন, লম্বা নাক, চওড়া কপাল। উজ্জ্বল চোখ।

“বা, খাসা চেহারা!” সপ্রশংস কণ্ঠে বলল ভুবন চৌধুরী।

মৃগাঙ্ক যেন লজ্জা পেল। একটু ইতস্তত করে বলল, “চেহারায় কী হয়, গুণই বড়। আপনারা গুণী লোক।’

কথাটা কানে ভাল লাগল ভুবন চৌধুরীর। এমন বিনীত প্রশংসা, ঠিক এমন সুরেই আর কোথায় যেন শুনেছিল ভুবন চৌধুরী। কোথায় যেন, মনে করবার চেষ্টা করেই পরমুহূর্তে আবার অন্য কথায় মশগুল হয়ে গেল ও।

নাটকটা নিছক প্রেমের। বিরহ, ষড়যন্ত্র, মর্মান্তিক মৃত্যুর শোকে সিক্ত। জমাট কাহিনী। বরেন্দ্র বিজয়ে এসেছে লক্ষ্মণ সেন। পাল রাজার সভায় রাজনটী অহনা নামে গোপনে সেন-রাজাদের গুপ্তচর বৃত্তি করছে সোমপ্রভা। এক শিল্পী অহনার রূপে মুগ্ধ। নাম তার ভাস্কর উপল। উপলের বন্ধু মেঘবর্ণ। মেঘবর্ণ পাল রাজকুলের এক মন্ত্রীপুত্র। মেঘবর্ণও ভালবাসে নটী অহনাকে। তাকে লাভ করতে চায়। কিন্তু অন্তরায় উপল। মেঘবর্ণ ষড়যন্ত্র করতে থাকে তলে তলে। হঠাৎ রাজাদেশ এল, ভাস্কর উপলকে পাল-রাজ্য থেকে নির্বাসনের দণ্ড দিয়েছেন মহারাজ। অপরাধ, ভাস্কর নবনির্মিত মন্দিরগাত্রে রাজনটী অহনার প্রতিমূর্তি উৎকীর্ণ করেছে। দেবদেবীর পরিবর্তে মানুষী মূর্তি, তাও নটীর! এ পাপ। কলুষিত হয়েছে মন্দির। নির্বাসিত করো শিল্পীকে।

রাজদণ্ড শিরোধার্য করে রাজ্য ত্যাগ করতে প্রস্তুত হল ভাস্কর।

নটী অহনাও প্রিয়র হাত ধরে পলাতক হতে চায়। পাল রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে চলে যাবার উদ্দেশ্যে কৃষ্ণপক্ষ রাত্রে পলাতক হল উভয়েই। মেঘবর্ণ তাদের পশ্চাদ্ধাবন করলে। শেষ পর্যন্ত সেই মন্দিরের কাছে এসে ধরা পড়ল ওরা। অসি যুদ্ধে আহত হল মেঘবর্ণ। কিন্তু মন্দির প্রবেশের মুখে মেঘবর্ণ আহত করলে উপলকে। অন্ধকার মন্দির অভ্যন্তর। গোপন সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে পালিয়ে যাবার শেষ চেষ্টা করে অহনা আর উপল। পারে না। প্রিয়ার বিষলিপ্ত অঙ্গ চুম্বন করে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে উপল। অহনাও প্রিয়তমের পথ অনুসরণ করে।

কিরণশশী পার্ট করছিল রাজনটী অহনার। মৃগাঙ্ক ভাস্কর উপলের, আর ভুবন চৌধুরী মেঘবর্ণের। লবঙ্গ অহনার সখী দেবস্মিতার।

জমাট বই। অভিনয়ের সুযোগ যথেষ্ট। কিরণশশীর নাম আছে পার্টটায়। তবু গোড়ায় গা দেয়নি কিরণশশী। ভুবন চৌধুরীও।

দ্বিতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্য থেকেই কেমন যেন গোল বাধল। রাজনটী অহনার সঙ্গে ভাস্কর উপলের এই প্রথম প্রকাশ্য সাক্ষাৎ। নির্জন কানন। চরণে নূপুরের রিনিঝিনি বাজিয়ে চটুলা নটী পথ চলেছে। হঠাৎ গতি তার রুদ্ধ হল। সামনে অপরূপ এক তরুণ। গায়ে স্খলিত উত্তরীয়। পাষাণের মতো প্রাণহীন, কিন্তু বিমুগ্ধ দুটি চোখ। সেই দুটি চোখ অপলক নয়নে দেখছে একটি পার্থিব সৌন্দর্যকে। সে সৌন্দর্য এক নারীর ক্ষৌম বাস, অঙ্গের লাবণ্য থেকে ঝরে পড়ছে। স্থির হয়ে আছে তার নয়ন রাজনটীর উদ্ধত কুচযুগ, কৃশ কটি, সঘন জঘনে।

কিরণশশী অবাক। ছেলেটা কি পার্ট ভুলে গেছে! নয়ত এতক্ষণ পাথরের মতো নিস্পন্দ হয়ে কী দেখছে তাকে! ভাবল মনে মনে কিরণশশী, রূপ দেখে না মূর্ছা যায়!

ভাস্কর দেখছিল, সদ্য প্রস্ফুটিত পদ্মর মতন একটি আনন। চোখে যার ঘন অঞ্জন, সুডৌল গণ্ডে চন্দন রাগ। ক’টি চূর্ণ কুন্তল ললাটে।

অস্বস্তি বোধ করছিল কিরণশশী। গলায় মালাটা বুকের কাছে বাঁ হাতের মুঠোয় দুমড়ে নিয়ে একটু বুঝি ভ্রূভঙ্গি করল।

“দেবী অহনা—!” অস্ফুট, সলজ্জ একটি বিস্ময় ধ্বনি শোনা গেল। এতক্ষণ পরে।

বইয়েতে আছে ‘নটী’। মৃগাঙ্ক বললে ‘দেবী’। আর শুধু বলা নয়, এমন সুরে বললে যেন মনে হল রূপভিক্ষু এক শিল্পী ওই একটি কথায় রূপ থেকে প্রাণে নেমে এল। প্রেমভিক্ষু হল এক নারীর। সেই আহ্বানে চমকে উঠল কিরণশশী। বুঝল—মূর্ছা নয়, মৃগাঙ্ক একটা ঘোর কাটিয়ে যেন স্তুতির অর্ঘ দিল কিরণশশীকে। না, কিরণশশীকে নয়, অহনাকে। আর ও মৃগাঙ্ক নয়, অতীত ইতিহাসের এক প্রেমিক ভাস্কর।

উইংসের পাশে দাঁড়িয়েছিল ভুবন চৌধুরী। কিরণশশী স্টেজ থেকে বেরিয়ে আসতেই ভুবন ওর কাঁধে হাত দিল। নিচু গলায় বললে, “তুমি হারলে, কিরণ!”

কিরণশশীও বুঝতে পেরেছিল। মফস্বলের এক শৌখিন ছোকরা অভিনেতার কাছে প্রথম মুখেই তার হার হয়েছে।

“প্লে তো আর শেষ হয়নি!” কেমন যেন তিক্ত সুর কিরণশশীর।

“আচ্ছা দেখি!” ভুবন চৌধুরী হাসল। মুখে তার মদের গন্ধ ধরা দিয়েছে এতক্ষণে।

দ্বিতীয় অঙ্কের শেষ থেকে নাটক জমে গেল। হঠাৎ যেন তিন নটনটী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে পড়ল। কে ভাল, কে কার চেয়ে ভাল অভিনয় করতে পারে, দেখাতে পারে। দর্শককুল হৰ্ষরোমাঞ্চিত, ফ্রেন্ডস ড্রামাটিকের উত্তেজনা ফেটে পড়ার মতন।

ভাস্কর উপলবেশী মৃগাঙ্ক কোথাও এতটুকু শিথিল অভিনয়ের সুযোগ দিচ্ছে না। ফলে কিরণশশীকে আর ভুবন চৌধুরীকে সদা সতর্ক থাকতে হচ্ছে। কলকাতার নামকরা নটনটী তারা। বৃত্তিতে পরাজয় স্বীকার করে নিতে বাধে।

যতক্ষণ প্রেম ছিল, ততক্ষণ মৃগাঙ্ক মাতিয়ে রাখল। আবেগে তার সুন্দর কণ্ঠস্বর কেঁপে কেঁপে গেছে। ফুটলাইটের ঈষৎ নীলাভ আলোয় আশ্চর্য এক স্বপ্নময় জগতের ভাস্কর বলেই মনে হচ্ছিল তাকে, এক বিরহকাতর প্রাণ। কিরণশশীও কম যাচ্ছিল না। তার রূপ যেন একটু একটু করে প্রাণে এসে দানা বাঁধছিল—আর খুলে যাচ্ছিল প্রাণের রূপ। নটী নারীতে প্রকাশ পাচ্ছিল।

মন্দিরের দৃশ্যে অসি-যুদ্ধের সময় একটা কেমন ক্লান্তি নেমেছিল মৃগাঙ্কর। ভুবন চৌধুরী এখানে টেক্কা দিল মৃগাঙ্ককে।

কিন্তু শেষ দৃশ্যে সবাই সুন্দর। মৃত্যু সামনে, প্রিয়াও হাতের নাগালে। আর কোনো পথ নেই। জীবনের উপরই যবনিকা নেমে আসছে। তবে শেষ মুহূর্তে সেই সুখ নিয়ে যেতে দাও, তোমার স্পর্শের সুখ, তোমার অঙ্গের মধু, তোমার প্রাণের।

অহনার দুটি হাত টেনে নিল উপল। চুম্বনের জন্যে ওষ্ঠের কাছে তুলে ধরল। চমকে উঠে হাত সরিয়ে নিতে যায় অহনা। সর্বাঙ্গে বিষলিপ্ত তার, গুপ্তচরীর বর্ম, নিষ্ঠুর হিংসা।

“সখি, যে অঙ্গের লাবণ্যে আমি সৃষ্টি প্রত্যক্ষ করেছি, ষড় ঋতুর মনোহর ভুবন—সে অঙ্গ বিষ নয়, অমৃত।” ভাস্কর প্রিয়ার হাত দুটি টেনে নিয়ে ওষ্ঠে স্পর্শ করছে।

একটি ক্ষুধাতুর ওষ্ঠের চুম্বন। শব্দটুকুও যেন অনন্ত ক্ষুধা আর বেদনা নিয়ে রঙ্গমঞ্চে কেঁপে কেঁপে উঠে মিলিয়ে গেল। এক মুহূর্তে বুঝি বিহ্বল, পরমুহূর্তে কিরণশশী মৃগাঙ্কর মুখ দু হাতে নিয়ে যেন গন্ধ নিল মৃত্যুর, মৃত্যুর শীতলতার। কিরণশশী নয়, কিরণশশী যেন এই মঞ্চের মায়ালোকে মরে গেছে। রাজনটী অহনা নিঃস্বতার বেদনায় স্তব্ধ, অচেতন। তারপর দু ফোঁটা চোখের জল। চাপা একটা কান্না গুমরে গুমরে উঠে শেষ ধাপে এসে হঠাৎ যেন ছড়িয়ে পড়ল। “প্রিয়তম, জীবন অমৃত দিতে পারলাম না, বিষ দিলাম তোমায়। এ আমার নিয়তি।” কী করুণ, কী দুঃসহ।

ভুবন চৌধুরীও তার শেষ মুহূর্তের পৈশাচিক উল্লাস আর অন্তিম বেদনাটুকু সুন্দর করে ফুটিয়েছিল। তা সত্ত্বেও কিরণশশীই যেন শেষ পর্যন্ত সকলকে ছাড়িয়ে গেল।

দর্শককুল চমৎকৃত। ফ্রেন্ডস ড্রামাটিক ধন্য মনে করল নিজেদের। কিরণশশী আর ভুবন চৌধুরীর ঘোড়ার গাড়িতে ফুলের সঙ্গে দামি মদের বোতল উঠিয়ে দিল।

যাবার সময় কুন্দভূষণ বললে ভুবন চৌধুরীকে, “গ্র্যান্ড হয়েছে দাদা। ওয়ান্ডারফুল। এমন দেখিনি।”

কুন্দর পিঠ থাবড়ে ভুবন চৌধুরী হাসল, “আপনাদের হিরো সত্যিই গুণী ছেলে ওর হবে।”

মৃগাঙ্ক তখন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে অলস চোখে দেখছিল ঘোড়ার গাড়ির গদিতে যে বসে রয়েছে তাকে। ও আর অহনা নয়, এখন কিরণশশীই। কিরণশশীর গলায় সেই মালাটি তখনও দুলছে।

পরের দিন সকালে দেখা। কিরণশশীদের বাড়িতে আসছিল মৃগাঙ্ক। বাগানের পথ দিয়ে আসতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। পেয়ারা গাছের তলায় কিরণশশী আর লবঙ্গ দাঁড়িয়ে।

ওর দিকেই তাকিয়ে রয়েছে, হাসি হাসি মুখ। এমন চোখে তাকিয়ে রয়েছে ওরা, যেন কথা বলার জন্যে ডাকছে মৃগাঙ্ককে।

একটু ইতস্তত করে কাছে গিয়ে দাঁড়াল মৃগাঙ্ক। বঙ্কিম চোখে কিরণশশী তাকে দেখল। আর তারপরই একটু গা এলিয়ে দিয়ে হাই তুলল।

“ধন্যি লোক মশাই আপনি,” কথা বলল লবঙ্গ, “পার্ট করতে নেমে অন্য মানুষের গা হাতের দিকে তাকালে জ্ঞান থাকে না! ইস্‌, কিরণদির হাতটা কী ভাবে কামড়ে দিয়েছেন—এখনো লাল টকটক করছে।”

মৃগাঙ্ক হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। অপ্রস্তুত।

“আ, লবঙ্গ—কী বলিস।” কিরণশশী কৃত্রিম ধমক দেয়।

“আমি হাত কামড়েছি?” মৃগাঙ্ক আমতা আমতা করে।

“না, না। ওই একটু—!”

“একটু কী, দাও তো তোমার হাত!” লবঙ্গ খপ্‌ করে কিরণশশীর হাত ধরে মৃগাঙ্কর চোখের ওপর বাড়িয়ে দিল, “দেখুন তো, মশাই—!”

সত্যিই কিরণশশীর ডান হাতের উল্টো পিঠে এক জায়গায় লালচে হয়ে আছে। একটুক্ষণ তাকিয়েই মৃগাঙ্ক বুঝতে পারল। কালকের সেই শেষ দৃশ্যের চুম্বনের চিহ্ন। কিন্তু মৃগাঙ্ক তো দাঁত বসায়নি, ঠোঁট বসিয়েছিল। এখন বুঝতে পারা যাচ্ছে কী গভীর এবং তীব্র ভাবে মৃগাঙ্কর ওষ্ঠ শোষণ করেছিল কিরণশশীর হাত।

লজ্জায় মৃগাঙ্ক আরক্ত। মুখ নীচু করে থাকল ও।

“তুই বড় জ্বালাস, লবঙ্গ।” কিরণশশী হাত সরিয়ে নিয়ে অবস্থাটা সহজ করবার চেষ্টা করল।

“বেশ তো, জ্বালাই যখন, তখন তো তুমি জ্বলছই। আমি এবার যাই!” ঠোঁট টিপে হাসে লবঙ্গ।

লবঙ্গ সত্যি সত্যিই চলে গেল।

একটু অপেক্ষা করে কিরণশশী দু পা এগিয়ে পেয়ারা গাছের ডালে গা হেলিয়ে দাঁড়াল।

“আপনার নাম তো মৃগাঙ্ক?” কিরণশশী আলাপ শুরু করল।

মাথা নাড়ল মৃগাঙ্ক।

“এখানেই থাকেন?”

“হ্যাঁ।”

“কী করেন?”

“কিচ্ছু না।” এবার মৃগাঙ্ক হাসল।

“শুধুই থিয়েটার করে বেড়ান!” কিরণশশী একটু থেমে হেসে হেসে বলল।

“কোথায় আর, ওই মাঝে-সাঝে কখনো!”

পেয়ারা গাছের ক’ হাত দূরে এক রাশ মরসুমি ফুল হাওয়ায় দুলছে। চকচক করছে শীতের রোদে। প্রজাপতি উড়ছে ফুলে ফুলে সেই দিকে তাকিয়ে কিরণশশী যেন কী দেখল, খুঁজল, ভাববার চেষ্টা করল।

কিরণশশী হাঁটতে শুরু করল। কালকের রাতে জরির ফিতে দিয়ে বাঁধা বিনুনিটা পিঠের ওপর ঝুলে রয়েছে। হাঁটার তালে তালে নড়ছে। সোনালী ডোরা-কাটা সাপ যেন।

কুয়াতলার পাশেই পায়চারি করছে ভুবন চৌধুরী। কিরণশশী চোখ তুলে তাকাল। চোখাচোখি হল।

“আরে মৃগাঙ্ক যে, এসো ভাই। কন্‌গ্রাচুলেশান জানাতে পারিনি কাল রাত্তিরে। কোথায় উধাও হয়ে গেল হঠাৎ। অ্যাঁ—!” ভুবন চৌধুরী হাত বাড়িয়ে মৃগাঙ্ককে কাছে টেনে নিল।

কিরণশশী দাঁড়াল না। মন্থর পায়ে এগিয়ে চলল। এমনি করেই কালকেও যেন মৃগাঙ্কর চোখের সামনে দিয়ে হেঁটে গেছে কিরণ।

সেদিন রাত্রে প্লে যেন আরও জমে উঠল। আজ কিরণশশী সেজেছে কপালকুণ্ডলা। পিঠময় এলো চুল ছড়ানো, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, হাতে ফুলের বালা, পরনে ফিকে হলদে রঙের শাড়ি। কিরণশশীকে আশ্চর্য মানিয়েছে। চোখে তার টলমল করছে অরণ্যচারী হরিণীর রহস্য, বিস্ময়।

পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ? মৃগাঙ্ক সত্যিই যেন পথ হারিয়ে ছিল। ডাক শুনে চমকে ওঠে। কে? কিরণশশী। না, কিরণশশী নয়, অন্য কেউ। অজানা, অচেনা। মৃগাঙ্ক নয়, নবকুমার বিস্মিত বিমুগ্ধ দৃষ্টি মেলে তাকায়। ওর কাছে কি আশ্রয় আছে?

ভুবন চৌধুরী সেজেছে কাপালিক। ভয়ংকর, নিষ্ঠুর, বীভৎস। ধকধক করে জ্বলছে তার চোখ। লোকটা আজ আকণ্ঠ মদ খেয়েছে।

গ্রিনরুমের কাছে দু’জনে দেখা। মৃগাঙ্ক আর কিরণশশীতে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কিরণশশী মুচকি হাসল।

“হাসছেন যে!”

“এমনি। কপালকুণ্ডলার পোড়া কপালের কথা ভাবছি—!” কিরণশশী এক দৃষ্টিতে মৃগাঙ্কর দিকে তাকিয়ে মুহূর্তের জন্যে গম্ভীর হল। পরমুহূর্তেই হেসে উঠে বলল, “এমন নবকুমার জুটলে—” কথাটা শেষ না করেই কিরণশশী হঠাৎ থেমে গেল।

মৃগঙ্ক কেমন একটু উষ্ণতা বোধ করল। মুখ নামিয়ে নিল। একটু পরে মুখ তুলে কী একটা কথা যখন বলি বলি করছে—কিরণশশী তখন সরে গেছে।

শেষ দৃশ্যটায় মৃগাঙ্ক সকলকে মোহিত করে দিল। শ্মশানে তারা দু’জন। অনন্ত বিচ্ছেদ ঘনিয়ে এসেছে। সব যেন বিষাদে ভারাক্রান্ত।

হাত ধরে ফেলেছে নবকুমার কপালককুণ্ডলার। কপালকুণ্ডলা, একবার বলো তুমি অবিশ্বাসিনী নও। সন্দিগ্ধ স্বামীর প্রশ্নই শুধু নয়, একটি গভীর ভালবাসা যেন শ্মশানভূমির নিস্তব্ধতায় কেঁদে উঠল।

কিরণশশী বহুবার এই কথাটি কানের কাছে শুনেছে—বহু মুখে, একবার বল তুমি অবিশ্বাসিনী নও। কোনোবারই এমনভাবে তার বুক কেঁপে ওঠেনি। আশ্চর্য, আজ কেন বুক কেঁপে যায়। কেন?

প্লে ভাঙছে। ঘোড়ার গাড়িতে এসে উঠে বসল কিরণশশী। ভুবন চৌধুরীকে আজ অনেক আগেই পৌঁছে দিয়ে আসতে হয়েছে। আকণ্ঠ মদ খেয়ে লোকটা গড়াগড়ি যাচ্ছিল গ্রিনরুমের মেঝেতে।

কিরণশশীই মৃগাঙ্ককে তার গাড়িতে ডেকে নিয়েছে পৌঁছে দিয়ে আসতে। লবঙ্গরা অন্য গাড়িতে।

শেষ রাতের ঠাণ্ডায় শীত ধরেছিল মৃগাঙ্কর। ঘোড়ার গাড়ির দরজা খানিকটা ফাঁক করা ছিল। কিরণশশী নিজের হাতে টেনে বন্ধ করে দিল।

তারপর একটানা ঘোড়ার খুরের খট খট। গাড়ির ভেতরটা অন্ধকার ওরাও চুপ।

“চলুন আমাদের সঙ্গে কলকাতা!” কিরণশশী বলল এক সময়।

“কলকাতা?” মৃগাঙ্ক শব্দটা কেমনভাবে যেন পুনরাবৃত্তি করে।

“কলকাতাই আপনার জায়গা।”

“সেখানে গিয়ে কী করবো?”

“যা করতে জানেন, তাই করবেন।” কিরণশশী সামনের দিকে একটু ঝুঁকে পড়ল। অন্ধকারে মৃগাঙ্কর মুখ দেখা গেল না। দেখা গেলে বোঝা যেত ওর মুখে বহুদিনের একটি লালিত স্বপ্ন যেন এই মুহূর্তে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে।

পরের দিন সারা সকাল, দুপুর মৃগাঙ্কর কেটে গেল কিরণশশীদের কাছে। ভুবন চৌধুরী বেলায় উঠে স্নানটান সেরে কুন্দভূষণের সঙ্গে মাছ ধরতে বেরিয়ে গেছে। ভুবন চৌধুরীর মাছ ধরার শখ যে হঠাৎ কেন হল—কিরণশশী ভেবে পেল না। সতীশ দত্তকে নিয়ে গেছে পাড়ার ছেলেরা। লবঙ্গ আজ হেনা, চাঁপাদের নাচ প্র্যাক্‌টিস করাচ্ছে। ও ঘরে নূপুরের ঝুম ঝুম আর মুখের বোল। মাঝে মাঝে লবঙ্গদের খিল খিল হাসি।

বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছিল ওরা দুটিতে। কিরণশশী আর মৃগাঙ্ক। গোলাপের কাঁটা কিরণশশীর আঙ্গুলে ফুটেছিল। এক ফোঁটা রক্ত ঝরেছে। ক’টি রক্ত গোলাপ তুলে ওর হাতে দিল মৃগাঙ্ক।

ঝিকমিক করছে রোদ গাছের পাতায়। প্রজাপতি উড়ছিল। বসছিল ফুলে ফুলে। কিরণশশী সেদিকে চেয়ে চেয়ে বলল এক সময়, “কী সুন্দর প্রজাপতি!”

মৃগাঙ্ক প্রজাপতি ধরতে গেল। পারল না।

“ভীষণ চালাক ওরা।” মুচকি হাসে কিরণশশী।

“হ্যাঁ, ধরা যায় না, উড়ে পালায়।”

“কখনো কখনো ধরা পড়েও যায়,” কিরণশশী ফুল-ধরা, হাতটার উল্টো পিঠের একটু লাল আভা খুঁজতে খুঁজতে বলে, “অবশ্য তেমন করে কেউ যদি ধরতে পারে!”

মৃগাঙ্কর ইচ্ছে হল, আর একবার চেষ্টা করে প্রজাপতি ধরতে। পাছে বিফল মনোরথ হয়ে লজ্জায় পড়ে, তাই আর সাহস করল না।

খনিক পরে কিরণশশীই আবার কথা বলল, “কাল আমরা এতক্ষণে ফিরে যাচ্ছি।”

“ট্রেন তো দুপুরে!”

“ওই একই। সকালও যা, দুপুরও তাই।”

কিরণশশী বাগানের পথ ছেড়ে বাড়ির দিকে চলেছে।

“কেমন লাগল আমাদের মনোহরপুর?” মৃগাঙ্ক হেসে প্রশ্ন করল।

“বেশ!” কিরণশশী গোলাপের গন্ধ নিতে নিতে বলল, “লবঙ্গ হলে বলত মনোহরণপুর।” বলে ঘাড় ফিরিয়ে হাসল। মনে পড়ল পরশু সকালে স্টেশনের কথা। লবঙ্গকে যা বলেছিল ও।

সেদিন রাতে কিরণশশী করছিল মায়ের পার্ট আর মৃগাঙ্ক হারানো ছেলের।

এই পার্টটি কিরণশশী খুব কম করেছে। ওর নিজেরই ভয় ছিল ভাল বুঝি হবে। মৃগাঙ্কর সঙ্গে দাঁড়িয়ে পার্ট করতে সত্যিই এখন ভয় পায় কিরণশশী।

স্টেজে দেখা গেল, কেউ কম যায় না। মৃগাঙ্কও যত ভাল, কিরণশশীও ততটা।

শেষ দৃশ্যটা চমৎকার হয়েছিল। মৃগাঙ্কর সেই বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে দিয়ে দুহাতে জড়িয়ে ‘মা’ ডাক শুনে কিরণশশী যেন সত্যিই হারানো ছেলের মা হয়ে গেল। ব্যাকুল বাহুতে জড়িয়ে ধরেছে মৃগাঙ্ককে তখন। আর আনন্দে বেদনায় বিহ্বল হয়ে যেমন করে হাসি-কান্নায় মাখামাখি হয়ে গিয়েছিল সেই স্টেজে, তার বুঝি তুলনা নেই।

সেদিন রাত্রে ঘোড়ার গাড়িতে করে ফিরছিল ওরা দুজন। মুখোমুখি বসে। গাড়ির মধ্যে অন্ধকার। বাইরে ঘোড়ার খুরের খট খট।

“তুমি-ই বলছি তোমাকে।” কিরণশশী খুক্‌ করে একবার কেশে উঠল, “শুনলাম তোমার বয়েস নাকি মাত্র বাইশ তেইশ।”

“কে বলল?”

“কুন্দবাবু।” কিরণশশী আর একবার কাশল, “দেখলে কিন্তু তিরিশ-টিরিশ মনে হয়। চমৎকার বাড়ন্ত তোমার শরীর স্বাস্থ্য।”

একটু চুপ।

“আমার বয়স কত বলতে পারো?”

“না!”

“তা তোমার প্রায় ডবলই হবে। সাঁইত্রিশ-আটত্রিশ।”

মৃগাঙ্ক অন্ধকারেই চোখ তুলে তাকাল।

“মনে হয় না এত, না?” কিরণশশী মৃগাঙ্ককে চুপ দেখে বলল।

“হ্যাঁ সত্যিই মনে হয় না।” নীচু গলায় জবাব দেয় মৃগাঙ্ক।

“মনে হবে কী করে! বয়েস আমাদের রাখতে হয়। বয়েস, গলা, রূপ—। যতদিন রাখা যায়, ততদিন।”

“বয়সে কী যায় আসে!” বলল মৃগাঙ্ক।

আবার একটু চুপ। ধীরে ধীরে কিরণশশী মৃগাঙ্কর হাত নিজের হাতের মুঠোয় টেনে নেয়।

“ঠিক বলেছ বয়েসে কী যায় আসে।”

ঘোড়ার গাড়ির চাকায় শব্দ উঠছে। দূরে কোথায় যেন কুকুর কাঁদছে একটা। লবঙ্গদের গাড়িতে খিল খিল হাসি উঠেছে।

সব থেমে গেলে কিরণশশী সেই চুপের মধ্যে বললে, “ওকে আমি বলেছি। রাজি হয়েছে ও। তোমায় কলকাতায় নিয়ে যাব। যাবে তো?”

“না যাবার কি আছে?”

“সেকি, কিছু নেই? মা, বাবা, বউ, ভাই বোন—!”

“না; কেউ নেই আমার।” মৃগাঙ্কর গলার স্বর একটু ভারি শোনায়।

“তবে তো ভালই।” কিরণশশী বলে, “আমরা ফিরে গিয়ে তোমার একটা ব্যবস্থা করে চিঠি লিখব।”

আবার চুপ। ঘোড়ার খুরের সেই খট খট। অন্ধকার আর শীত। দুটি হাতই শুধু উষ্ণ। আর উষ্ণমধুর কেমন এক গন্ধ। কিরণশশী মনে মনে ঘোড়ার খুরের খট-খটের সঙ্গে জোড় বিজোড় মেলাচ্ছিল “বয়সে কী যায় আসে।” যায়, না আসে। আসে, না যায়!

গাড়ি থামল। নামল ওরা। লবঙ্গরা বাগান দিয়ে দৌড়তে দৌড়তে ঘরে গিয়ে ঢুকল। বাগান দিয়ে একটু বুঝি জড়োসড়ো হয়েই হাঁটছিল মৃগাঙ্ক।

“ওকি, এসো না!” কিরণশশী ওর পাশ ঘেঁষে গিয়ে নিজের শালের অর্ধেকটা দিল।

ক্ষীণ আপত্তি করেও মৃগাঙ্ক সেই শাল গায়ে রাখল। শেষ রাতের কৃশ চাঁদ আকাশে। ঘন কুয়াশায় চোখের গণ্ডিও সঙ্কীর্ণ হয়ে এসেছে। কেমন একটা শ্বেতঅন্ধকারের রঙ্গমঞ্চে ওরা হেঁটে চলেছে—ওরা দুজন।

কেউ ভাবেনি—আর একজনও থাকতে পারে এই মুহূর্তে। কিন্তু আর একজন ছিল। ভুবন চৌধুরী। বাড়ির বারান্দায় অলেস্টার চাপিয়ে চুপ করে বসে ছিল।

পায়ের শব্দ পেয়ে জড়িত কণ্ঠে ভুবন চৌধুরী কী-যেন বিড় বিড় করে বলে ওঠে। চকিতে কিরণশশীর শালের অংশটুকু গা থেকে ফেলে দেয়। সরে দাঁড়ায় মৃগাঙ্ক।

“তুমি এখনো বাইরে বসে?” কিরণশশী থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে।

ভুবন চৌধুরী টলমল পায়ে উঠে দাঁড়ায়। নেশাটা এখন ওর মনে থিতিয়ে রয়েছে।

দু’ চার পা এগিয়ে কিরণশশীদের মুখোমুখি দাঁড়াল ও। জড়িত কণ্ঠে পরিহাস করে বলল, “কিরণ, আমার বাহির দুয়ারে কপাট লেগেছে, ভিতর দুয়ার খোলা।”

টলে পড়তে গিয়ে টাল সামলে নিল। মৃগাঙ্ক ওকে ধরল।

এবার হোহো করে হাসল ভুবন চৌধুরী, “ব্রাদার, অদ্যই শেষ রজনী।…চমৎকার অভিনয় হয়েছে তোমাদের—গ্র্যান্ড! প্রিয়া, জায়া, জননী—তিন রূপ—কিরণ তমি অপূর্ব—ওয়ান্ডারফুল! চার্মিং!”

“কী হচ্ছে? এসো তো—!” কিরণশশী ধমক দিল মাতাল ভুবন চৌধুরীকে। ডান হাত বাড়িয়ে ওর বুক জড়িয়ে ধরল। তার দেহের ভারটা টেনে নিল নিজের দেহে। এগিয়ে চলল ঘরের দিকে।

মৃগাঙ্ক বললে, “আমি যাই।”

“কাল একবার এসো।” কিরণশশীর মুখ দেখা গেল না।

মৃগাঙ্ক নিশ্চিত হতে পারেনি; ওর মনে সন্দেহ ছিল, সংশয়াকুল হয়ে ছিল যত দিন গেছে, দিন যাচ্ছিল—কিন্তু মাস চারেক পরে সত্যি সত্যিই আবার কিরণশশীর মুখ দেখতে পেল ও।

কৈফিয়ত দেবার প্রয়োজন ছিল হয়ত। কিরণশশী বললে মিষ্টি হেসে, “নতুন বই নামাচ্ছি আমরা। তোমায় দিয়েছি রাজপুত্রের পার্ট—। প্রথম দিনেই বিখ্যাত হয়ে যাবে।”

পাশেই ছিল ভুবন চৌধুরী। চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে সরিয়ে রাখল কাপ। আশ্চর্য উজ্জ্বল হাসি তার মুখে। ভুবন বললে, “এমন চান্স কেউ পায় না, ব্রাদার। অন্য থিয়েটারে ঢুকিয়ে দিলে তোমায় পাক্কা তিনটি বচ্ছর কোটালপুত্র সাজিয়ে রাখত।”

ওর কথায় এরা হাসল। হাসি থামলে কিরণশশী বলল, “কাল থেকে রিহার্সাল শুরু। দশ দিনের মধ্যে তৈরি করে নিতে হবে সব। বুঝলে তো?”

ঘাড় নাড়ল মৃগাঙ্ক।

ভুবন চৌধুরী ইজি-চেয়ারে গা এলিয়ে বসেছিল এতক্ষণ। এবার সোজা হয়ে বসে সিগারেট ধরাল।

“বইয়ের নাম, ‘পিঙ্গলার প্রেম’। আমিই নাট্যকার।” একটি মুহূর্ত থামল ভুবন চৌধুরী, দেখল ওদের দুজনকে আপন মনেই ঠোঁট বুজিয়ে হাসল একটু। বললে, “অবাক হচ্ছো নাকি, ব্রাদার! তা তোমার আর দোষ কী, পাবলিকই ভুলে গেছে হয়ত। বছর কুড়ি আগে আমি যখন এদিকে আসি, নাট্যকার হয়েই এসেছিলাম, না-কি কিরণ? কিরণ সব জানে। খান দুয়েক বই লিখেছিলাম, ভাল চলল না; জমল না।। নাট্যকার ভুবন চৌধুরী অ্যাক্টর ভুবন চৌধুরী হয়ে গেল। তাতেই যা নাম-যশ।” ভুবন চৌধুরী আবার থেমে, একটু চুপ করে হাসল, “কী কাণ্ড! চেয়েছি নাট্যকার হতে, হলাম অ্যাক্টর!”

“এখন আবার নাট্যকার হবার শখ হয়েছে!” বললে কিরণশশী ভঙ্গি করে, পানের কৌটা থেকে আতর দেওয়া পান নিতে নিতে। কৌটোটা হাত বাড়িয়ে এগিয়ে দিল ভুবনের দিকে।

একসঙ্গে দু-তিন খিলি পান মুখে ফেলে ভুবন চৌধুরী ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দিল আবার।

“নাটকের একেবারে শেষটুকু এখনো আমার লেখা হয়নি—”

“অথচ চার মাস ধরে নাট্যকার-মশাই নাটক লিখছেন, সেই তোমাদের মনোহরপুর থেকে ফিরে আসার পর,” কিরণশশী ঠাট্টা করল “আরও ক’ মাস লাগত কে জানে! আমিই জোর করে রিহার্সালে নামিয়ে দিলাম। তাও যদি শেষ হয়!”

“শেষের একটাই তো দৃশ্য! আমার মনে ছকা আছে। আর একটু ভেবে লিখে ফেলব।” ভুবন চৌধুরী আবার সিগারেট ধরায়।

মৃগাঙ্ক ভুবন চৌধুরীর মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

“গল্পটা—” ভুবন চৌধুরী বলতে শুরু করে, “গল্পটা শোনো। কিরণ, তুমিও।”

কিরণশশী কখনো-সখনো এই নাটকের দু-চারটে পাতা দেখেছে পাণ্ডুলিপির, কিন্তু গল্পটা পুরো শোনেনি। ভুবন চৌধুরী-ই বলেনি। তন্ময় হয়ে ছিল ও নিজের নাটকে। সিন্ধুর অতল তলে ডুবুরীর মতন।

“কৌপলী নামে এক রাজ্য ছিল আদ্যিকালে। সে রাজ্যের যিনি রাজা, বুড়ো বয়সে অপুত্রক অবস্থায় ভীষণ দুঃখকষ্ট মনে নিয়ে মারা যান—,” ভুবন চৌধুরী গল্প শুরু করল, “রাজার ছেলে ছিল না, কিন্তু একটি মেয়ে ছিল। নাম তার পিঙ্গলা। অপূর্ব সুন্দরী সে। বিলাস ব্যসনে, ছলাকলায় তার মতন পটু আর কেউ ছিল না। ওদিকে আবার পুরুষের মতন মৃগয়ায় যেত পিঙ্গলা। তার কোমল দেহ বৰ্ম-আবৃত করে অশ্বারোহণে ঘন অরণ্যে ঘুরে বেড়াত। পিঙ্গলা বিবাহ করেনি। রাজা অনেক চেষ্টা করেছেন, অনুনয় করেছেন, রাজপুরুষরা পরামর্শ দিয়েছে, তবু পিঙ্গলা বিবাহে সম্মত হয়নি। ধীরে ধীরে একটা কথা ছড়িয়ে গিয়েছিল গোপনে গোপনে—পিঙ্গলা শুধু পশু মৃগয়াই করে না—তার অব্যর্থ শরে বহু সুপুষেরও অন্তর বিদ্ধ হয়েছে। তারা যে কারা, কেউ জানত না। অপুত্রক রাজা কন্যার এই অধর্ম ও স্বেচ্ছাচারিতা নীরবে সহ্য করতে করতে শেষে একদিন মারা গেলেন।”

ভুবন চৌধুরী থামল।

কিরণশশী আর মৃগাঙ্ক কৌতূহলের চোখে তাকিয়ে ভুবন চৌধুরীর মুখের দিকে।

আবার একটা সিগারেট ধরাল ভুবন চৌধুরী। চোখ বুজে একটুক্ষণ ভেবে নিল কী যেন। তারপর আরম্ভ করল, “এই গেল ফাস্ট অ্যাক্ট। সেকেন্ড অ্যাক্টের শুরু—কৌপলী রাজ্যের অধিশ্বরী এখন পিঙ্গলাই। একদিন মৃগয়ায় গিয়ে, অরণ্যের এক নদীতীর থেকে অচেতন, মৃতপ্রায় এক যুবককে প্রাসাদে নিয়ে এল পিঙ্গলা। অমন রূপবান পুরুষ খুব কমই চোখে পড়ে। রাজবৈদ্য এলেন। সযত্নে পরীক্ষা করলেন যুবককে। ঔষধাদি দিলেন। বললেন, এই তরুণ কোনো বিষাক্ত সাপের দংশনে বিষক্রিয়ায় মৃতপ্রায় হয়েছিল। ওর আত্মীয়স্বজন সম্ভবত তাকে মৃতজ্ঞানে নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল। করুণাময় ঈশ্বরের কৃপায় যুবক আশ্চর্যভাবে পুনরায় প্রাণ ফিরে পেয়েছে। অতি সুলক্ষণ পুরুষ। যুবকটি প্রাণ ফিরে পেল, কিন্তু অতীত কথা তার কিছুই মনে পড়ল না। কুল, শীল, বংশ, নাম, দেশ—কোন কিছুই তার স্মৃতিপথে ধরা দিল না। রাজ জ্যোতিষী এলেন। গণনা করলেন প্রচুর। অবশেষে বললেন, ইনি অবশ্যই অতি সুলক্ষণ পুরুষ, সদ্‌বংশজাত, সম্ভবত কোনো রাজপুত্র। …রাজ-জ্যোতিষী তার বেশি কিছু বলতে পারলেন না। …পিঙ্গলা তার নতুন করে নামকরণ করল, মৃত্যুঞ্জয়। আর নামকরণ করেই ও ক্ষান্ত হল না। ক্রমশই মৃত্যুঞ্জয়কে আকৃষ্ট করতে লাগল নিজের প্রতি। নিজেও আকৃষ্ট হল তার প্রতি।” ভুবন চৌধুরী আবার চুপ করলে।

“দ্বিতীয় অঙ্ক বুঝি এখানেই শেষ?” মৃগাঙ্ক প্রশ্ন করল।

“হ্যাঁ, এখানেই। এরপর আর একটা অঙ্ক মাত্র আছে। তাতে তিনটি দৃশ্য। তার মধ্যে দুটি দৃশ্য লেখা হয়ে গেছে আমার।” ভুবন চৌধুরী উঠে পড়ল। বলল, “একটু বসো, আমি আসছি।”

ভুবন চৌধুরী চলে যেতে ওরা দুজন পরস্পরের দিকে তাকাল। মৃগাঙ্ক একটু অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিল।

“তুমি হয়তো ভাবছিলে, তোমার কথা আমি ভুলেই গেছি, না?” কিরণশশী নিচু গলায় প্রথমে বলল।

“তাই মনে হচ্ছিল।” মৃগাঙ্ক কিরণশশীর হাতের দিকে চাইল। সেই লাল দাগটা কি বেশি দিন থাকা সম্ভব ও ভাবল।

“তা বইকি! ভুলে যাওয়া অত সহজ!” কিরণশশীর গলায় অভিমান।

মৃগাঙ্ক অভিমানটুকু বুঝতে পারল। হাসল মধুর করে। বলল, “আমি যা-ই ভাবি, আপনি তো আর সত্যি ভুলে যাননি।”

কিরণশশী উঠল। স্টেজে এইটেই তার সাজগোজ করবার, কাপড় ছাড়বার নিজস্ব ঘর। ওদিকের আয়নায় গিয়ে দাঁড়াল একটু। নিজের মুখ নিজেই দেখল। হাত দিয়ে কপালের চুলগুলো সরাল। গলার হারটা আঙুল দিয়ে নাড়াচাড়া করল। তারপর ঘরের দরজা পর্যন্ত গিয়ে গলা বাড়াল।

ফিরে এসে মৃগাঙ্কর মাথার কাছে বুক ছুঁইয়ে দাঁড়াল। কী-একটা খড়কুটো বুঝি পড়েছিল মৃগাঙ্কর চুলে—সেটা ফেলে দিল।

“কোথায় এসে উঠেছ?”

“কুন্দদার এক বন্ধুর মেসে।”

“মেস—! অনেক লোক তো? ডাল-চচ্চড়ি খাওয়াচ্ছে?”

“হ্যাঁ।” মৃগাঙ্ক হাসল।

“ও মেস তুমি কালই ছেড়ে দিয়ে টাউন হোটেলে উঠবে! বুঝলে? একটা ঘর নেবে নিজের। আচ্ছা, আমি-ই বলে দেবো মাধববাবুকে। টাউন হোটেলের ম্যানেজার উনি।”

কিরণশশী আলগা হাতে মৃগাঙ্কর মাথার চুলে ইলিবিলি কেটে দিল।

“ভালভাবে না থাকলে শরীর রাখা যায় না। মেসের ছাই-ভস্ম খেলে ও রূপ কি থাকবে নাকি তোমার? তখন—?”

“আমার টাকা কই অত?”

“টা-কা!” কিরণশশী আশ্চর্য চোখে তাকাল মৃগাঙ্কর দিকে। সেই চোখ ক্রমেই নরম, কোমল, কেমন যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন, বিষণ্ণ হয়ে এল। অস্পষ্ট—মৃদু অতি মৃদু সুরে বললে, “তোমার টা-কা—!”

কিরণশশী আর কিছু বললে না মুখে। কিন্তু তার না-বলা মুখই যেন বাকি কথাটুকু বুঝিয়ে দিল: আমি কেন আছি তবে!

ভুবন চৌধুরী কোথায় যেন ছিল—এই সময় ঘরে ঢুকল। সঙ্গে সঙ্গে একটা গন্ধ উঠল বাতাসে। কিরণশশী একটু সরে গেল।

কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ না করেই ভুবন চৌধুরী ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দিল। এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললে, “থার্ড অ্যাক্টের শুরুতেই আমি দেখাচ্ছি এক ভিলেনকে। এই ভিলেন হচ্ছে পিঙ্গলার রাজ-পরিষদের মন্ত্রী। লোকটা বিচক্ষণ, চতুর, কঠিন-হৃদয়, নিষ্ঠুর। তার দুর্বলতা শুধু এক জায়গায়। আর তা হচ্ছে, পিঙ্গলার ওপর। পিঙ্গলার নিষ্কণ্টক জীবনের অনেকখানি কৃতিত্ব তার প্রাপ্য। এক সময়ে পিঙ্গলাও বুঝি তাকে ভালবাসত। কিন্তু…। কিন্তুটা বুঝতেই পারছ। মৃত্যুঞ্জয় আসার পর সে কিন্তু আরও দূরে সরে গেল। এদিকে পিঙ্গলা দিনে দিনে হৃদয় জয় করে নিল মৃত্যুঞ্জয়ের। শেষ পর্যন্ত পিঙ্গলা তার মনোভাব প্রকাশ করল প্রকাশ্যেই—মৃতুঞ্জয়কে সে বিবাহ করবে। প্রথমেই বাধা দিল সেই মন্ত্রী। বলল, অজ্ঞাত কুলশীল পরিচয়হীন এক তরুণ, বয়সের পার্থক্য প্রচুর—এ বিবাহ হয় না। প্রজারা অসন্তুষ্ট হবে, বিদ্রোহ করবে। পিঙ্গলা হাসে। কোনো বিপদের আশঙ্কাই তাকে সঙ্কল্প থেকে বিচ্যুত করতে পারবে না। মৃত্যুঞ্জয় অপ্রাজ্ঞ—নিরীহ তরুণ। সে ভাবল, অন্তর্বিপ্লবে প্রয়োজন কী—ও পালিয়ে যাবে। পিঙ্গলা বুঝতে পারল। ওর চাতুরি বাড়ল আরও, আরও ছলা-কলা। সুরা, সঙ্গীত, বিলাস ব্যসন, মৃত্যুঞ্জয়কে লোভের নাগপাশ দিয়ে বেঁধে রাখল পিঙ্গলা। মৃত্যুঞ্জয় ভেসে যাচ্ছিল তার স্রোতে। মাঝে মাঝে তার ভয় হয়, কী-যেন একটা আশঙ্কা জাগে, কিন্তু পরক্ষণেই পিঙ্গলার বরতনুর আশ্রয়ে সব ভুলে যায় ও। শেষ পর্যন্ত স্থির হয়ে গেল বিবাহের দিন।” ভুবন চৌধুরী থামল একটু। তারপর হেসে বলল, “বিবাহের দিনটাই নাটকের শেষ দৃশ্য। ওটাই লেখা হয়নি—মনে মনে ছকা আছে। লিখে ফেলবো শিগগির।”

“বিয়ে কি হবে না?” কিরণশশী থমথমে গলায় শুধলো।

“কেন, বিয়ে না হলে কি তুমি পিঙ্গলার পার্ট করতে রাজি নও?” ভুবন চৌধুরী অদ্ভুত একটা অট্টহাসি হাসল। যার শব্দ সেই ঘরে অনেকক্ষণ পর্যন্ত বাতাসে বাতাসে কাঁপতে থাকল।

দশ দিনের রিহার্সাল—কিন্তু বাহাদুর বলতে হবে ভুবন চৌধুরীকে। আশ্চর্য কৃতিত্বে দশদিনেই শিখিয়ে পড়িয়ে নাটকটা ঝলমলিয়ে তুলল ও। কিরণশশী পিঙ্গলা। পিঙ্গলাই বটে। রূপে, রহস্যে, ছলনায়, নিষ্ঠুরতায়, প্রেমে কিরণশশী যেন পিঙ্গলাকে অতীতের কোন অন্ধকার থেকে তুলে এনে মঞ্চের পাদপ্রদীপে জীবন্ত করে তুলল। তেমনি মৃগাঙ্ক। অজ্ঞাত কুলশীল এক তরুণ, জীবনদাত্রীর প্রতি তার কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই, পিঙ্গলার প্রেম তাকে বসন্তের আশ্চর্য শিহরণ দিয়ে গেছে, উন্মনা সে। অথচ নিষ্ঠুর অতীতের সামান্য কটি অভিজ্ঞানের অভাবে এ সুখ তার করতলগত হয়েও হয় না। অন্তর্বিপ্লবকে ভয় পায় মৃত্যুঞ্জয়। সে বিপ্লব যদি জাগে, তবে? মৃত্যুঞ্জয় চায় না—তবু পিঙ্গলার উষ্ণ প্রলোভনের মায়ায়, সুরায়, নারীতে, আত্মবিস্মৃত হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে মনে হয় সে বন্দী, পরমুহূর্তে পিঙ্গলার বাহুলতায় সত্যই সে স্বেচ্ছায় বন্দী হয়ে থাকে।

আজই প্রথম রজনীর অভিনয়। গ্রিনরুমের চঞ্চলতায় কলরবে, আলোয় মৃগাঙ্কর কেমন যেন ভয় ভয় করছিল। ও কি পারবে আজ? কলকাতার স্টেজ। অসংখ্য দর্শক। এখানে মঞ্চ ঘুরে যাবে, কত রঙের আলো রামধনুর মতন নেমে আসবে—একটা ঐক্যতান গুঞ্জন করে উঠবে। ও কি পারবে? গলা দিয়ে স্বর বেরুবে কি কিরণশশীর সেই পিঙ্গলার রূপমূর্তির দিকে তাকিয়ে।

কিরণশশীও সেজেছে আজ। প্রতি নতুন দৃশ্যে তার নব নব বেশ। কখনো স্তোকনম্রা, কখনো মৃগয়া বিহারিণী, কখনো লাস্যময়ী, ছলনাময়ী নারী; আবার কখনো মমতাময়ী নারী, প্রেমিকা সুচাতুরা রাজকন্যা।

যবনিকা উঠল। আবার নামল। …একটি অঙ্ক শেষ হল।

ভালই হয়েছে। কথাটা অভিনয় করতে করতেই বোঝা গিয়েছিল দর্শকদের উচ্ছ্বাসের করতালি থেকে।

দ্বিতীয় অঙ্কের যবনিকা উঠল। ভয় করছিল মৃগাঙ্কর। মনে হল, ওর হৃৎপিণ্ড বুঝি বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু না, হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ হল না। বরং কিসের একটি যাদুম্পর্শে যেন সত্যিই মৃত্যুঞ্জয় জেগে উঠল। চোখ মেলে দেখল, পিঙ্গলা। পিঙ্গলা, পিঙ্গলা, পিঙ্গলা।।

দ্বিতীয় অঙ্কের যবনিকা নেমে এল।

“মার্ভেলাস!” ভুবন চৌধুরী ওর গলা জড়িয়ে ধরল। মুখে তার মদের গন্ধ, ‘ফার্স্ট নাইটেই তুমি ফেমাস হয়ে গেলে, ব্রাদার। কিন্তু, শোনো, ওই শেষ দৃশ্যটা আমি বদলেছি। তোমার কথাবার্তা একেবারে শেষে তো কিছু ছিল না—কাজেই কিছু যাবে আসবে না। শুধু পোজটা বদলে যাবে তোমার। এই নাও—এই ক’টা কাগজ—শেষটুকু নতুন করে লিখেছি—দেখে নাও একলা দাঁড়িয়ে। যাই, কিরণকে আবার দেখিয়ে দি। ওর পার্টটাই বদলেছে—নিউ ডায়লগ।”

ভুবন চৌধুরী ছুটল কিরণশশীর সাজঘরে।

মৃগাঙ্ক অবাক। লোকটা মাতাল ছিল—এবার পাগলা হয়ে গেল নাকি! শেষ মুহূর্তে শেষ দৃশ্য বদলাচ্ছে!

চমকে উঠেছে কিরণশশী ভুবন চৌধুরীর দৃশ্য-পাল্টানো কাগজের টুকরো ক’টা হাতে নিয়ে। প্রথমটায় ও কথাই বলতে পারল না। তারপর বললে, “তুমি কি পাগল হলে নাকি?”

“পাগল হবো কেন! এই ঠিক। এই ঠিক নাটক। এমন ট্র্যাজেডি আর হয় না কিরণ। দিস্ ইজ নেমিসিস—নিষ্ঠুর নিয়তি!”

“না, না, এ আমি পারবো না।” কিরণ কাগজ ক’টা ছুঁড়ে ফেলে দেয়।

ভুবন চৌধুরী হাসিমুখেই কাগজ ক’টা কুড়িয়ে নিয়ে কিরণের হাত ধরে।

“আমি নাট্যকার, কিরণ। এই বই আমার জীবনের একটি কীর্তি। ভাল মন্দর আমি কি কিছু বুঝিনে?”

“তা বলে এমন নিষ্ঠুর হবে তোমার নাটক, এমন অসম্ভব?”

“কোন্‌টা অসম্ভব, কিরণ? কী অসম্ভব? তুমি যদি ইংরেজি জানতে, শেক্সপিয়ারের একটা কথা শুনিয়ে দিতাম। সে কথা যাক। আমার পিঙ্গলার দুঃখটা তুমি বুঝছো না কেন​?”

“কিসের দুঃখ—!” বিরক্ত হল কিরণশশী।

“দুঃখ নয়, বোকা!—তুমি অসম্ভব বোকা, কিরণ! ভেবে দেখো—পিঙ্গলা জীবনে বহু বঞ্চনার মৃগয়া করে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুঞ্জয়কে ভালবাসল। শত বাধা সত্ত্বেও সে ওর গলায় মালা দুলিয়ে বরণ করতে যাচ্ছে। ঠিক যে-মুহূর্তে ধর্ম সাক্ষী করে গলায় বরমাল্য দিতে যাবে মৃত্যুঞ্জয়ের—ঠিক সেই মুহূর্তে একটি বজ্র কঠিন আদেশ শুনে মুখ ফিরিয়ে তাকাল। সেই মন্ত্রী—এককালে যে তার সহচর ছিল অনেক পরিশ্রমে গোপন অনুসন্ধানের পর সেই মন্ত্রী মৃত্যুঞ্জয়ের পরিচয় সূত্র জেনে এসেছে। সামনের ওই বরবেশী সূর্যকান্তি তরুণ—পিঙ্গলার সন্তান। বহুকাল আগে বিলাসিনী পিঙ্গলা হৃদয়-মৃগয়ায় গিয়ে ওকে লাভ করেছিল—কিন্তু গ্রহণ করেনি—ফেলে দিয়ে এসেছিল।” ভুবন চৌধুরী পকেট থেকে একটা চ্যাপ্টা বোতল বার করে খানিকটা মদ গলায় ঢেলে দিল।

কিরণশশী যেন পাথর। ভুবন চৌধুরী ওর চুল, চোখ, গালে নিবিড় সোহগে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

“তুমি পিশাচ!” কিরণশশী দাঁতে দাঁত চেপে বলল।

“আমি নাট্যকার।” ভূবন করুণ মুখে হাসল, “কিন্তু তাতে কী—এই বইয়ে তুমি অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এমন সুযোগ আর পাবে না কখনো!”

“সুযোগ?”

“সুযোগ নয়। তোমার শেষ অভিনয়—সত্যকার অভিনয়।”

“অভিনয়?” কিরণশশী পুনরাবৃত্তি করে কথাটায়।

“হ্যাঁ, অভিনয়। পারবে না ফুটোতে একটি নারীর সেই তিনটি রূপ—তার ভালবাসার সেই আশ্চর্য রহস্য। হলেই বা মৃত্যুঞ্জয় পিঙ্গলার পুত্র। কিন্তু নারী-প্রেমের তিনটি-ই যে একরূপ—শুধু সাজ বদলে যায়—প্রিয়া হয় জায়া, জায়া হয় জননী। শেষ দৃশ্যে তোমার নির্বাক অভিনয়—শুধু এই তিন প্রেমের বেদনাকে একটি বেদনায়—”

ম্যানেজার ঘরে মুখ বাড়াল এই সময়। তৃতীয় অঙ্ক শুরু হয়ে গেছে। ও চলে যেতে ভুবন পকেট থেকে বোতলটা বের করে কিরণশশীর হাতে দিল।

“অভিনয়, অভিনয়; তার জন্যে এতো। ওঠো। যদি শেষ দৃশ্য খারাপ হয় আমি কথা দিচ্ছি তোমায়, কাল বদলে দেব। যা ছিল আগে—তাই থাকবে।”

কিরণশশীর স্নায়ু শিথিল হয়ে এসেছিল—একটু উত্তেজিত করে নিল।

সময়টা এসে গেছে। উইংসের পাশে কিরণশশী পিঙ্গলার বেশে অপেক্ষা করছে বরমাল্য হাতে—তার পাশে মন্ত্রীর বেশে ভুবন চৌধুরী।

কিরণশশী যেন কাঁপছিল। নিশ্বাস ভারি হয়ে এসেছে। বুকটা ধক ধক করছে।

“অত ভয় কেন তোমার—এত বছর ধরে অভিনয় করছো!” ভুবন বলল চাপা গলায়।

“আমি পারব না। সত্যিই পারব না।”

“পারবে, পারবে। না পারার কী আছে?”

“কেমন করে তাকাব আমি অমন কথা শোনার পর।”

“যেমন করে তাকাতে হয় তুমিই জানো।”

আর দু-মিনিট। স্টেজের মধ্যে মৃত্যুঞ্জয়—বরবেশে এসে দাঁড়িয়েছে। রাজপুরোহিত স্বস্তিবচন করছেন।

“আমি পারব না গো আমার বুক কাঁপছে।”

“কাঁপুক; ভয়ে নয়—আনন্দে কাঁপছে তোমার বুক।” ভুবন চৌধুরীর গলার সুরটা কেমন যেন বদলে যায়, হয়ত একটা হিংস্রতা আছে কিন্তু নরম সুরে ঢাকা—শাণিত ভঙ্গি আছে কিন্তু শোভনতা দিয়ে মোড়া। স্পষ্ট, মৃদু সুরে কিরণশশীর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ও বলল, “আমি জানি—আজ তোমার অভিনয় জীবনের সমস্ত অভিনয়কে ছাপিয়ে যাবে নয়নতারা। হ্যাঁ—ভাবো না সেই কথা, মনে কর না ঠিক এই সময়েই—সে দিনের কথা—যখন তোমার নাম ছিল নয়নতারা। ভদ্র কিন্তু দরিদ্র স্বামী ফেলে—কোলের এক বছরের ছেলেটিকে কোল থেকে সরিয়ে ভুবন চৌধুরীর সঙ্গে পালিয়ে এলে। এতকাল পরে সেই ছেলেকেই না হয় ফিরে পেয়েছ…। ফিরে পেলে। তোমারই ছেলে ও। ওই মৃগাঙ্ক, কিন্তু তুমি জানো, তোমার মন, তোমার চোখ—মৃগাঙ্ককে—’ কথাটা আর শেষ করল না ভুবন চৌধুরী। পিঙ্গলার মঞ্চপ্রবেশ-মুহূর্ত অপেক্ষা করছে।

“যাও—” ভুবন আস্তে ওকে ঠেলে দিল।

কিছু বোঝবার, ভাববার, জানবার আগেই কিরণশশী দেখে ও শতচক্ষুর সামনে দাঁড়িয়ে, উজ্জ্বল আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারিদিক। সামনে মৃগাঙ্ক। মৃগাঙ্ক না মৃত্যুঞ্জয়।

ভুবন চৌধুরীর উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্টেজের দিকে। কথা বলছে নয়নতারা। না, কিরণশশী। না, না, কিরণশশীও নয়, পিঙ্গলা।

দু চোখ ভরে জল আসছিল ভুবন চৌধুরীর। সুন্দর নাটক লেখায় এত বেদনা আছে আজ জানল ও।

তখন বুঝি মাঝ রাত। মৃগাঙ্ক থাকতে পারেনি। চলে এসেছে কিরণশশীর বাড়ি। ছটফট করছিল ওর মন। অতুলনীয় অভিনয় করেছিল কিরণশশী। কিন্তু তারপর, আশ্চর্য, কী যে হল তার, স্টেজের বাইরে এসে কারুর সঙ্গে কথা বললে না, কোথাও দাঁড়াল না, মৃগাঙ্ক সামনে গিয়েছিল তার দিকে ফিরেও তাকাল না—চলে গেল। ওরা বলছিল—ও অসুস্থ হয়ে পড়েছে হঠাৎ।

ভুবন চৌধুরীকেও আর খুঁজে পায়নি মৃগাঙ্ক। অনেক—অনেকক্ষণ চুপ করে ছিল মৃগাঙ্ক। একাই বসেছিল গ্রিনরুমে। অসুস্থ—হঠাৎ কী এমন অসুস্থ হল কিরণশশী।

ছটফট করেছে মৃগাঙ্ক পুরো দু’ ঘণ্টা। তারপর সটান কিরণশশীর বাড়ি।

কিরণশশীর বাড়িতে আসতে ভুবন চৌধুরীর সঙ্গে দেখা। অন্ধকার বারান্দায়—বেতের চেয়ারে বসেছিল ভুবন।

“মৃগাঙ্ক!” ভুবন চৌধুরী চমকে উঠল।

“উনি কোথায়, কী হয়েছে?”

ভুবন চৌধুরী ভাবল একটুক্ষণ। তারপর বলল, “এসো।”

ভেজানো দরজা খুলে সুইচ টিপতেই আলোয় ভরে গেল ঘর। মৃগাঙ্ক ঘরের মধ্যে পা দিয়ে থমকে দাঁড়াল। বিছানায় পড়ে আছে কিরণশশী—বেঁকিয়ে, এলিয়ে, অবশ অঙ্গ ছড়িয়ে-ছাড়িয়ে। গায়ের ব্লাউজ খোলা, শাড়িটা সবই প্রায় তালগোল পাকিয়ে পায়ের কাছে পড়ে আছে—পাশ বালিশ আর মাথার বালিশ এদিক ওদিক ছড়ানো—মদের বোতল আর কাচের পাত্র, ভাঙা প্লেট মেঝেয়। পিঙ্গলার সেই মালাখানি কার্পেটের ওপর পড়ে। মদের গন্ধ ভর ভর করছিল ঘরে।

ভুবন শাড়িটা দিয়ে কিরণশশীর গা ঢেকে দিল। ডাকল, “কিরণ, দেখো কে এসেছে!”

কথাটা যেন কানেই, যায়নি কিরণশশীর। সবার ডাকার পর কোনোরকমে মাথাটা উঁচু করে ও চাইল। চোখের পাতা আধবোজা। কী দেখল সে কে জানে। যেন মনোহরপরের প্রথম রাত্রির অভিনয়ে রাজনটীর পার্ট করছে। মৃত্যুর সেই দৃশ্য। বিড় বিড় করে জড়ানো গলায় বলল, “জীবনে অমৃত দিতে পারলাম না, বিষ দিলাম তোমায়। প্রিয়তম—এ আমার নিয়তি। “ একটা হিক্কা উঠল। চোখ মুখ কুঞ্চিত করল কিরণশশী। তারপরই খিল খিল করে হেসে বালিশে লুটিয়ে পড়ল।

ভুবন কেমন অস্বস্তি বোধ করছে। মৃগাঙ্ক পাথর। একটু অপেক্ষা করে কিরণের গায়ে ঠেলা দিল ভুবন। ডাকল, “কিরণ—মৃগাঙ্ক এসেছে, মৃগাঙ্ক!”

বালিশে লুটোপুটি খেয়ে মাথাটা এবার আর একটু উঁচু করল কিরণশশী। চোখ চেয়ে দেখবার চেষ্টা করল। হঠাৎ কেঁদে উঠল ফুঁপিয়ে। জড়িয়ে জড়িয়ে বললে, “আমি অবিশ্বাসিনী নই—নবকুমার! আমি!” কান্নাটা হাসিতে জড়িয়ে গেল। মুখের মধ্যে হাত চাপা দিয়ে হাসতে হাসতে আবার লুটিয়ে পড়ল কিরণশশী বিছানায়।

ভুবন ওর কপালে একটু জল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিল। মাথাটা কোলে তুলে বলল, “কিরণ, কী হচ্ছে তোমার—মৃগাঙ্ক তোমায় দেখতে এসেছে!”

এবার কিরণশশী দু হাতে ভর দিয়ে সোজা হয়ে বসল। চোখ তুলে তাকাল। মৃগাঙ্ককে দেখতে পেল কি না—কে জানে। ভাঙা গলায় বলছে, “তুই ফিরে এসেছিস। খোকা—!”

কথা শেষ হবার আগেই সর্বাঙ্গ পাকিয়ে বমির ওয়াক তুলল কিরণশশী। খানিকটা বমি ছিটকে এসে পড়ল মৃগাঙ্কর পায়ে।

গা ঘিনঘিন করছিল মৃগাঙ্কর। পকেট থেকে রুমাল বের করে নাক চাপা দিল।

এই কুৎসিত পরিবেশ, ঘৃণ্য, নগ্ন আবহাওয়ায়—মৃগাঙ্করও বমি-বমি লাগছিল। বীভৎস মনে হচ্ছিল কিরণশশীকে।

বাইরে বেরিয়ে এল মৃগাঙ্ক। রি-রি করছে সারা গা, ঘিন-ঘিন করছে। বমি আসছে তার নিজেরই।

নাক মুখ ঘৃণায় সিঁটকে থু করে খানিকটা থুতু ফেলল মৃগাঙ্ক। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে অস্ফুট কণ্ঠে বললে, ‘বেশ্যা!’

অন্ধকার বারান্দা দিয়ে নীচে নামতে লাগল মৃগাঙ্ক দ্রুত পায়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *