জানোয়ার

জানোয়ার

এস বি সোম। লোকে বলে শুয়ারের বাচ্চা সোম। পুরো নামটা কিন্তু সুধীবন্ধু সোম। সোম নিজে এবং তার স্ত্রী অতসী ছাড়া এই নামটা আর কেউ জানে বলে মনে হয় না।

অথচ জানা উচিত ছিল। সোনাপুর অ্যালুমিনিয়াম কর্পোরেশনে চারটে বছর সোমের কেটে গেল। তার আগে ছিল পুলিশে। এফিশিয়েন্সি যেভাবে দেখাচ্ছিল তাতে উন্নতি হচ্ছিল, ভবিষ্যতে আরও উন্নতি অবধারিত ছিল। কিন্তু সোমের ওই আস্তে আস্তে সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে উঁচুতে ওঠার ধৈর্য ছিল না। তা ছাড়া অল্প দিনেই যে রকম সুনাম করেছিল সোম তা সোনাপুর অ্যালুমিনিয়াম কপোরেশনের খোদ তাদের পর্যন্ত কানে গিয়েছিল। ভেতরে ভেতরে একটা ব্যবস্থা হল। সোম এল সোনাপুরে। প্রথম বছরটা অ্যাসিসটেন্ট; তার পরেই একেবারে সুপারিন্টেন্ডেন্ট ডবলু অ্যান্ড ডবলু—। ওয়াচ অ্যান্ড ওয়ার্ডের হর্তাকর্তা বিধাতা। বারোশোর গ্রেড। অফিসার্স বাংলো, ইলেকট্রিসিটি, মালি আর জমাদার ফ্রি। কোম্পানির গাড়ি আর পেট্রল। চল্লিশেই সোম এতোটা এগিয়ে এল। ভবিষ্যৎ তো পড়ে আছে সামনে। সোমের স্বপ্ন বারশোকে সে হাজার দুইয়ে অন্তত তুলবে। সোনাপুর অ্যালুমিনিয়াম কর্পোরেশনের ওয়াচ অ্যান্ড ওয়ার্ডের সোয়াশো ওয়াচম্যান, তিরিশজন আর্মড্‌ গুর্খা আর জনাচারেক জুনিয়ার যে কোম্পানি ফালতু পুষছে না—এই কাজের কথাটা ডিরেক্টরস বোর্ডকে আরও একটু ভাল করে বুঝিয়ে দিতে হবে।

সোনাপুরে আসার পর থেকেই সোম অবশ্য সব সময় এটা বোঝাবার চেষ্টা করেছে। কথায় নয় কাজে। আর তার ফলেই সুধীবন্ধু সোম—এস বি সোম সোনাপুরের লোকের কাছে শুয়ারের বাচ্চা সোমে দাঁড়িয়েছে।

সোনাপুরের যারা লেবারারস্—মজুর, মিস্ত্রি, ফিটার, ফোরম্যান-টোরম্যান মায় কেরানী বাবুটাবু, তাদের চোখ নেই। থাকলে সোমকে অন্য নামেও ডাকতে পারত। সোমকে দেখতে সত্যিই আর শুয়ারের বাচ্চার মতন নয়। বরং উল্টো। বেশ সুপুরুষ চেহারা। তা ছ’ ফুটের কাছাকাছি লম্বা, পেটানো শরীর, গায়ের হাড়গুলো যেমন চওড়া তেমনি কঠিন, রঙ আধ-ফরসা, চুল সামান্যই কিন্তু লালচে রঙ-ধরা। ঘাড়ের বাঁক দুটো বেশ চেটালো, গলা ছোট অথচ পুরু। আর মুখ—মুখটাই বা মন্দ কি দেখতে, নাক লম্বা হলেও আগায় একটু চাপা, দেখলে মনে হয় ভেতরের হাড় ভাঙা। গালে খুব একটা মাংস নেই, ভারি চোয়াল; সুন্দর করে কামানো একটু গোঁফ। ছোট কপাল, মাঝে একটা শিরা ফুলে থাকে রক্তের চাপে নীলচে হয়ে। চোখ দুটো টানাটানা হলেও কালো ভুরুর নীচে একটু ধূসর রঙের তীক্ষ্ণ মণি দুটো সোমের ভীষণ ব্যক্তিত্বটা আরও ভীষণতর করে প্রকাশ করে। তা করুক। তা বলে এই চেহারা যার, তাকে শুয়ারের বাচ্চা বলা কেন?

সোনাপুর অ্যালুমিনিয়াম কর্পোরেশনের বাবুটাবুদের জিজ্ঞেস করলে বলবে, চেহারার জন্যে কি বলি মশাই, বলি গুণের জন্যে। এমন খচ্চর লোক আমাদের এখানে আর দুটি পাবেন না। বেশ ছিল পুলিশে—হারামজাদা কেন যে মরতে এখানে এল—! জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারছে সকলকে। তবে এখানে বেশিদিন করে খেতে হবে না। একদিন শালা ঠিক গায়েব হয়ে যাবে—নুনিয়ার জলে পুঁতে দিয়ে আসব।

আর মজুর-মিস্ত্রিদের জিজ্ঞেস করলে তারা বলবে, উ শালা হারামি হ্যায়, পয়লা নম্বরকা হারামি। ডাঁট উতার যায়গা একরোজ। শালেকো ব্যাস—উঠা লেগা আউর বয়লারকো আন্দার ঘুসা দে গা।

সোমের এই দুর্নাম দিনে দিনে ছড়িয়ে পড়ছিল। আগে যাও-বা সোমকে উল্লেখ করতে হলে কেউ কেউ বলত সোমসাহেব, ইদানীং তাও আর কেউ বলত না। শুয়ারের বাচ্চা নামটাই চালু হয়ে গিয়েছিল।

অফিসার্সদের মধ্যেও সোমের সুখ্যাতি ছিল না। মুখার্জি, রায়, সেন, কিংহাম, গ্রীসলে—সবাইকেই কোনো না কোনো ছোটখাটো ব্যাপারে একবার অন্তত বিব্রত এবং বিরক্ত না করেছে এমন নয়। একবার কারখানায় মুখার্জি সাহেবের জন্যে একটা চাটু তৈরি হয়ে বাংলোয় যাচ্ছিল—চাপরাসী নিয়ে যাচ্ছিল, ওয়াচ অ্যান্ড ওয়ার্ডের লোক তাকে ধরে সোজা সোমের কাছে এনে হাজির করলে। সোম তলব করলে মুখার্জি সাহেবকে। মুখার্জি সাহেব ইঞ্জিনিয়ার মানুষ—ওয়াচ অ্যান্ড ওয়ার্ডের সোমের অফিসে তিনি যাবেন না। সোমও ছাড়বে না। শেষ পর্যন্ত চিঠি। সোম ইংরিজিতে দু-লাইন খসখস করে লিখে পাঠিয়ে দিল—যার বাংলা অর্থ—কারখানা মিঃ মুখার্জির চাটু তৈরি করার জন্যে নয়।

মুখার্জি সাহেব সেই দিন থেকেই সোমের ওপর হাড়ে হাড়ে চটা।

গ্রীসলের সঙ্গে একদিন তো খুনোখুনি হবার যোগাড় হয়েছিল। গ্রীসলের শালা এসেছিল ফ্যাক্টরির মধ্যে দেখা করতে। মোটরবাইক চেপে। গেটে ওয়াচ অ্যান্ড ওয়ার্ডের শাস্ত্রীরা আটকে দিল তাকে। পাস আছে? নেই? ভেতরে ঢোকা চলবে না। গ্রীসলের শালা চটেমটে ফিরে গেল। কথাটা সন্ধেবেলায় জানতে পারল গ্রীসলে। পরের দিন সকালেই সোমের অফিসে গ্রীসলের পদার্পণ। গ্রীসলের তিনপুরুষ আগেকার স্কচ্‌ রক্ত ফুটছিল। সোমের দাঁতগুলো খসিয়ে দেয় আর কি! “আমার লোককে গেটে আটকে দেওয়ার মানে আমাকে অপমান করা। তোমার এ-অধিকার নেই।”

“তোমার শালার জন্যে কি ফ্যাক্টরির আলাদা নিয়ম?” সোম নিজের চেয়ারে বসে বসে অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললে।

“এ-সব বাজে নিয়মকানুনের কড়াকড়ি তো তুমি করেছে—আগে ছিল না।” গ্রীসলে ঝাঁঝালো স্বরে জবাব।

“ইয়েস আমি করেছি। বছরে বিশ পঁচিশ হাজার টাকার কোম্পানির মাল তোমরা চুরি করছিলে। বাইরের লোক ঢুকে দুবার স্ট্রাইক করিয়েছে কারখানায়।”

গ্রীসলে লাফিয়ে পড়ে সোমের কলার চেপে ধরল, “আমি চোর, আমরা থিভ্‌স্? য়ু রাস্কেল—! আমার লোক আন্‌ডিজায়েরবল্‌ এলিমেন্ট!”

সোম গ্রীসলের হাত পলকে সরিয়ে দিল। চোখ দুটো তার আগুনের স্ফুলিঙ্গের মতন জ্বলছে। “আর একটা কথা বলেছো কি তোমার প্যান্ট শার্ট খুলে নিয়ে চাবকাবো। বাগার কোথাকার!”

ওয়াচ অ্যান্ড ওয়ার্ডের সেপাই শান্ত্রী না থাকলে সেদিন সোম-গ্রীসলের দ্বন্দ্বটা কোথায় যে গড়াত কে জানে।

গ্রীসলে সেইদিন থেকে সোমের ওপর খড়্গহস্ত হয়ে রয়েছে। সোমকে পথে দেখলে মনে-মনে সপ্তপুরুষ উদ্ধার করে—নাম শুনলে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয়। রায়, সেন, ভাদুড়ী—সকলেই তাই। এঁরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করেন, সোম একটা স্কাউণ্ড্রেল। টু মাচ্ আনপপুলার। এমন আর কেউ নয়। ও লাইফ রিস্ক্‌ নিচ্ছে। কেলেঙ্কারি একদিন একটা হবেই। এই তো সেদিন স্টোর শেডের কুলিরা ঘিরে ধরেছিল। ওদের হাতেই মরবে একদিন।

এ কথাটা মিথ্যে নয়। সোম নিজেও বুঝতে পেরেছিল, তার নাম সুধীবন্ধু হলেও আসলে সে সুধীজনের বন্ধু মোটেই নয়। বরং ঠিক উল্টো, সোনাপুর অ্যালুমিনিয়াম কর্পোরেশনের সবাইয়ের সে শত্রু। সবাই তার শত্রু। ডিরেক্টারস বোর্ডের দু একজন যা একটু সুনজরে দেখে তাকে। সোম বোকা নয়, মূর্খ নয়; জীবনের ওপর মমতা যে নেই তাও নয়—আবার সহজে ভয় পাবার ছেলেও সে নয়। ভয় করলেই পিছিয়ে পড়তে হবে। বারোশো দেড় হাজারের গ্রেড কোনো দিন দু হাজারে ঠেলে তোলা যাবে না। কাজেই নির্ভয় তাকে থাকতেই হবে—তবে প্রাণটাও বাঁচাতে হবে। আর সাবধানে সতর্ক হয়ে থাকলে প্রাণ সহজে যাবে না।

ভেবে-চিন্তে এবং খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে সোম ওয়াচ অ্যান্ড ওয়ার্ড থেকে বাহাদুরকে নিজের জন্যে নিয়ে নিল। কারখানার মধ্যে কিংবা খাস অফিসে পার্সোনাল গার্ডের দরকার ছিল না সোমের। নিরাপত্তার অভাব ঘটবে না সেখানে। তা ছাড়া কারখানার মধ্যে অতোটা সাহস কারুর হবে না, দুশ্চিন্তা বাংলো নিয়ে। বাংলোটা অফিসার্স বাংলোর একেবারে শেষে—নুনিয়া নদীর কাছে। চারপাশ ফাঁকা। ঝোপঝাড় গাছপালায় ভর্তি। কাছাকাছি মানুষ বলতে ওখানে ভাদুড়ী সাহেবের বাংলো—তাও অন্তত পঞ্চাশ গজের বাইরে। আপদবিপদে ডাকলে সাড়া পাওয়া যাবে না। অবশ্য সোমের দৃঢ় ধারণা, ডাক শুনতে পেলেও ভাদুড়ী সাড়া দেবে না। ইচ্ছে করেই।

তা বলে সোম কি এই ভয়ের কৈফিয়ৎ দিয়ে বাংলো বদলাতে চাইবে? কখনই না। সোম সাহেব ভয় পেয়েছে—একথা ঘুণাক্ষরেও কেউ সন্দেহ করলে সোমের সিংহাসনে ফাটল ধরে যাবে।

সোম বাংলো বদলাতে চাইল না। শুধু একবার দেখা করলে জি এম-এর সঙ্গে। “আমার বাংলোয় একটা গার্ড রাখতে চাই। ফর সেফটি।”

সঙ্গে সঙ্গে মঞ্জুর। “সিওর, অনেক আগেই গার্ড রাখা তোমার উচিত ছিল সোম। কেন রাখোনি? ইয়োরস ইজ্‌ এ রিস্কি জব।”

বাহাদুরকে পরের দিন থেকেই নিজের বাংলোয় রেখে দিল সোম। পার্সোনাল গার্ড।

সোমের তীক্ষ্ণ চোখ দিয়ে বাছাই হয়েছে বাহাদুর। বোঝাই যায় মানুষটা ভয়ংকর হবে। এমন মানুষ যার ওপর সোম অনায়াসে আস্থা রাখতে পারে; হ্যাঁ—সেই নির্জন নুনিয়া নদীর বাংলোয় শীত কি বর্ষা কিংবা গ্রীষ্ম অথবা হেমন্তের ছমছমে রাত্রিতেও যার ওপর আস্থা রেখে, ভরসা করে সোম ঘুমুতে পারে।

সোমের নির্বাচন নিখুঁত। বাহাদুর তেমনি মানুষ যাকে দেখলে ভয়ংকরই মনে হয়। তার শরীরের মধ্যে একটা ভয় যেন জমে রয়েছে। মানুষটাকে চোখ দিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে না। কাছে গিয়ে দাঁড়াতে রুচি হয় না। কুচকুচে কালো রং। মাথার চুল ছোট ছোট, কোঁকড়ানো। মুখটা গোল। নাক ছোট আর বসা। চোয়ালের হাড় উঁচু উঁচু। চোখ দুটো ছোট ছোট। ভুরু যেন নেই। দৃষ্টিটা ওপর ওপর বোকাটে—কিন্তু একটু নজর করলেই মনে হয় বোকামির নীচে ভীষণ হিংস্র আর বেপরোয়া একটা পশুর চোখ লুকিয়ে আছে। বেঁটে কোঁদানো চেহারা। ঘাড়ে পিঠে স্ফীতকায় মাংসপেশী। পায়ে হাতের গুলিতে লোকটার শক্তি যেন চমকে উঠছে।

নাম বাহাদুর হলেও লোকটা নেপালী নয়। সোমের ধারণা, মা-বাপের কেউ একজন নেপালী ছিল; অন্যজন এ-পাশের কোনো ডোম, মেথর কি সাঁওতাল-টাঁওতাল হবে। গলায় তাই বুঝি একটা তাবিজ ঝোলে কালো সুতোয় বাঁধা। সে যাক—ব্রিডিংটা জুতসই হয়েছে। শক্তির বাধ্যতা, ভয়ের সঙ্গে ভয়ংকরতা মিশ খেয়েছে।

সোমের বাংলোয় বাহাদুর অদ্ভুত মিশ খেয়ে গেল। মেহেদী আর কাঁটাতারের ফেন্সিংয়ের আড়ালে হাফ প্যান্ট আর হাতকাটা গেঞ্জি গায় একটা ভয়ংকর পশু যেন সকাল থেকে রাত—সারারাত সোমের বাড়ি আগলে রাখছে। না ভুল হল—পশু নয়—পশুপালক—কেন না সোম শুধু বাহাদুরকে রেখেই পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারেনি—দুটো সাঙ্ঘাতিক কুকুর পর্যন্ত আমদানি করে ফেলল। একটু বাড়ন্ত ছানাই এনেছিল—বিশুদ্ধ বিলিতি রক্তের—ছ’ মাসেই তারা গায়ে গতরে ভীতিপ্রদ হয়ে উঠল। আর বাহাদুর সেই দুটো অ্যালসেশিয়ানের গলায় বাঁধা শক্ত চামড়ার বক্‌লস দু হাতে ধরে সোমের বাংলোর কম্পাউন্ড আর গেট আটকে দাঁড়িয়ে গেল। দৃশ্যটা ভয়ংকর, ভীতিকর। চোখে পড়লে বুকের মধ্যে ধক্ করে ওঠে। মনে হয় একটা শয়তান তার অনুগত দুই দুর্ধর্ষ অনুচরের ঝুঁটি ধরে এই বাংলোটার একাকীত্ব রক্ষা করছে: কারও সাধ্য নেই গেট খুলে একটা পা বাড়াবে। একটা ডাক পর্যন্ত দিতে ভয় হয়, শিসের একটু শব্দ পর্যন্ত কানে গিয়েছে কি বাংলোর ভেতর থেকে মূর্তিমান দুই যমদূতের গর্জন ভেসে উঠবে।

সোম হুকুম করে দিয়েছিল, “বাহাদুর, ওহি দোনোকো রোজ গোস খিলানা। হলদি আর থোড়া চাউল ডাল্‌না গোসমে।”

“জী, হুজুর!”

“ডগ্‌ সোপ্‌-সে দু দিন বাদ নাহা দেনা।”

“জী, হুজুর।”

“দেখো, ওহি দোনোকো শিকারী বানাও। বল্ খেলাও, আউর চিড়িয়া মারকে তফাৎমে ফেঁকো। সামঝা?”

“জী, হুজুর।”

সোম যা যা বলেছিল বাহাদুর নিখুঁতভাবে সব করেছে—করছে এখনও। নিজের হাতে সামান্য হলুদ আর নুন দিয়ে অল্প চালের সঙ্গে মাংসর হাড় সেদ্ধ করে কুকুরদের খাওয়ায় রোজ। দু দিন অন্তর ডগ সোপ দিয়ে চান করিয়ে দেয়। শিকারী করে তোলার জন্যে বল্‌ ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিত দূরে, শিকার ধরা শেখাত। আজকাল প্রায়ই শিশু কী নিমগাছে সকাল-বিকেল চড়ুই শালিক কাক এসে বসলে ছররা দিয়ে বন্দুক ছোঁডে বাহাদুর,—পাখিগুলো টুপটাপ মাটিতে পড়লে কুকুর দুটো হাওয়ার বেগে ছুটে গিয়ে দাঁতে বিঁধে নিয়ে আসে। না, বাহাদুর এই শিকার কুকুরদের খেতে দেয় না। সাহেবের নিষেধ, তাতে কুকুরের রক্ত খারাপ হয়ে যাবে।

কুকুর দুটোকে পাকা শিকারী তৈরি করতে করতে বাহাদুর একদিন থামল। গাছতলা থেকে মরা পাখি কুড়িয়ে আনার খেলা বাহাদুরের আর পছন্দ হচ্ছিল না, কুকুর দুটোরও বোধ হয় ভাল লাগছিল না।

সেদিন সোম যখন পিছন দিকের বারান্দায় বসে চা খাচ্ছে, বেতের টেবিলটার একদিকে সোম—আর একদিকে অতসী, চায়ের ট্রের ওপর পরিপাটি করে বিছানো নক্‌সা তোলা কাপড়টার ওপর একটা টকটকে লাল সুতোর প্রজাপতি নিশ্চল হয়ে আছে, বাহাদুর সামনের বাগান থেকে আস্তে আস্তে হেঁটে এল। বারান্দার নীচে প্রথম সিঁড়িতে এসে দাঁড়াল।

“কিয়া বাত বাহাদুর?” সোম বেতের টেবিলে খবরের কাগজটা রেখে দিয়ে সিগারেটের ছাই ঝাড়ল।

“হুজুর!” একটু থামল বাহাদুর, মুখ তুলল, অতসীকে দেখল এক পলক, চোখ ফিরিয়ে সোমের দিকে চাইল, ‘দুসরা কোই গেম্ শিখলানে হোগা।’ বুড়ো আঙুলের তলা দিয়ে গলায় ঝোলানো তাবিজের সুতোটা ঘষে নিল বাহাদুর।

সোম বাহাদুরের মুখের দিকে অল্প একটু চেয়ে থাকল। যেন বাহাদুরের কথাটা ঠিক বুঝতে পারছিল না। পরক্ষণেই বুঝে ফেলল। কুকুর দুটোকে অন্য কোনো শিকারের খেলা শেখাতে চায় বাহাদুর। মনে মনে খুশি হল সোম। বললে, “ঠিক হায়, শিখলাও।”

“জী হুজুর।” বাহাদুর মাথা নীচু করে চলে যাচ্ছিল।

সোম ডাকল। বললে, “মাগর দেখো বাহাদুর—বাহার মাত ছোড় দো। আউর হারবাখাত আপনা হাত-মে রাখনা,—কন্‌ট্রোল মে। সামঝা?”

“জী, হুজুর।” বাহাদুর সম্মতি জানাতে গিয়ে আর একবার চোখ তুলল। মেমসাহেব তার দিকে চেয়ে রয়েছে। একটুক্ষণ, তারপরেই বাহাদুর বাগানের ঘাস মাড়িয়ে তার কোয়ার্টারে চলে গেল। সারভেন্টস কোয়ার্টার। সামনেই।

অতসী বাহাদুরের দিকে খানিক চেয়ে থেকে হঠাৎ চোখ ফিরিয়ে সোমের দিকে চাইল। ভীষণ একটা বিরক্তি আর বিস্বাদ তার মুখে কালো হয়ে নেমেছে।

“তোমরা শুরু করলে কি?” অতসীর গলায় খুব ঝাঁঝ।

সোম সিগারেটটা ফেলে দিয়ে স্ত্রীর দিকে চাইল। কোনো কথা বললে না।

অতসী অসহিষ্ণু হয়ে বললে, “ক্রমেই তোমরা এমন বাড়াবাড়ি শুরু করেছ আমায় আর থাকতে দেবে না।”

“কেন, কি হল?” সোম খুব হাল্কা গলায় যেন স্ত্রীর সঙ্গে পরিহাস করলে।

চেয়ার ঠেলে অতসী একটু পিছিয়ে গেল। হয়ত রাগে, বিতৃষ্ণায়। বললে, ‘এ-বাড়িটায় মানুষ থাকে না পশু থাকে সেটা আমি বুঝতে পারি না। কি শুরু করেছো তোমরা?’

সোম একটু হাসল, “মানুষের চেয়ে পশুরা ভাল সার্ভিস দেয়। কিন্তু বাড়াবাড়িটা তুমি দেখলে কোথায়—কুকুর দুটো সারাদিন বসে বসে খেলে আর ঘুমুলে ওয়ার্থলেস হয়ে যাবে। বাহাদুর ওদের তাজা রাখতে চায়।”

অতসী কোনো কথা বললে না। অসহ্য রাগ আর ঘৃণায় তার সারাটা মুখ বিশ্রী হয়ে গেছে।

সোম কি ভেবে, খুব খুশি খুশি মুখে, তারিফ করা গলায় বললে, “যাই বলো তুমি, বাহাদুর যখন দু হাতে দুটো কুকুরের বাক্‌লস টেনে দাঁড়িয়ে থাকে বেশ দেখায়। ফেরোসাস। কাছে এগুবার সাহস হয় না।”

অতসী চেয়ার ছেড়ে আচমকা উঠে পড়ল। হঠাৎ বললে, “তা এবার তোমাদের কোন্ খেলা শুরু হবে।”

“আমি জানি না। বাহাদুর নিশ্চয় কিছু একটা মতলব ঠাওরেছে।” সোম কথা বলতে বলতে এবার কি ভেবে যেন বেশ জোরেই হেসে উঠল, “জানোয়ারটার কথা শুনলে—মগজ পরিষ্কার হচ্ছে বোধ হয়,—বলে গেম্‌—!”

অতসী স্বামীর মুখের হাসি নিবিষ্ট চোখে দেখতে দেখতে নিজেও একটু হাসল ঠোঁটের গোড়ায়, “জানোয়ারের মতলব মতন খেলা—সাঙ্ঘাতিক একটা কিছু হবে বোধ হয়।”

“না, না—সাঙ্ঘাতিক আর কি হবে! দেখলে না, আমি তো বারণই করে দিলাম—সবসময় নিজের কন্‌ট্রোলে—হাতের মুঠোয় কুকুর দুটোকে রাখতে বলে দিলাম। আফটার অল পশু তো! কখন কি করে বসবে—”

“বসতে পারে—বলা যায় না।” অতসী যেন সোমের বাকি কথাটা শেষ করে ছেদ টেনে দিল। আর দাঁড়াল না। বারান্দা থেকে সোজা ঘরে চলে গেল।

সোম আর একটা সিগারেট ধরাল।

অতসীর কাছে সত্যিই এ-বাড়ি অসহ্য—অসহ্য। আর ভাল লাগে না। ভাল লাগার মতন কিছু নেই। অতসী ভেবে পায় না, এতো মানুষ থাকতে সোমের সঙ্গে তার বিয়ে হল কেন! তার বাবা এমন কিছু গরীব ছিলেন না, নিজেও সে দেখতে তেমন কিছু খারাপ নয়—তবু সোমের সঙ্গে বিয়ে হবার কি দরকার ছিল?

সোম যখন সোনাপুরে সবে এসেছে—তখনই তার বিয়ে হল। বাবা বুদ্ধিমান মানুষ। সোমের ভবিষ্যৎ যেন তাঁর দেখা ছিল। দেড় দু হাজারি জামাই যে মেয়ের কপালে সুখ-সৌভাগ্যের ছাতা ধরে থাকবে এ বিষয়ে তিনি নিঃসন্দেহ ছিলেন। অতসীরও সন্দেহ করার কারণ থাকেনি।

বিয়ের পর অতসী বুঝতে পারল একটা ভুল কোথাও হয়ে গেছে। সোম তেমন মানুষ যার কাছে দাম্পত্য জীবন কি স্ত্রী কিংবা সংসার বিশেষ একটা আকর্ষণ নয়। সকালের চা, দুপুরের ভাত, রাত্রের ঘুমের মতন স্ত্রী, সংসার সবই একটা স্বাভাবিক অভ্যাস। তার বেশি কিছু নয়।

আস্তে আস্তে অতসী সেটা সইয়ে নেবার চেষ্টা করল। পারল না। বাড়িতে মন বসত না বলে প্রথম প্রথম অতসী চেষ্টা করলে বাইরের পাঁচজনের সঙ্গে মেশবার। মুখার্জি, রায়, সেন সাহেবদের স্ত্রী, কন্যা, ভাইঝিদের সঙ্গে আলাপ পরিচয়, যাতায়াত, বন্ধুত্ব পাতাবার চেষ্টা করলে—। কিন্তু কি আশ্চর্য, বাইরের পাঁচটি মেয়েও তার কাছে ধরা দিল না। প্রথম প্রথম মুখার্জি সাহেবের স্ত্রী কিংবা রায় সাহেবের বোনের সঙ্গে গল্প-গুজব করতে গেলে তাঁরা ড্রয়িং রুমে এনে বসাতেন, নিজেরাও বসতেন। অল্পস্বল্প কথা বলতেন। চা দিতেন খেতে। ধীরে ধীরে সে-সব বন্ধ হয়ে গেল। বাংলোয় গেলে কেউ বলত, ও আপনি! আসুন, বসুন। আমার শরীরটা বড় খারাপ। ডাক্তারকে খবর পাঠিয়েছি। এখুনি এসে পড়বেন। কেউ বলত, এমন অসময়ে এলেন মিসেস সোম, আমাদের এখুনি গাড়ি নিয়ে বেরুতে হবে স্টেশনে—কলকাতা থেকে বড়দি আসছেন। একদিন মিসেস ভাদুড়ী তো অতসীকে বারান্দায় বসিয়ে রেখে বাথরুমে ঢুকে গেলেন মাথা ঘোরা আর গা গুলোনোর ছুতো দেখিয়ে তারপর ঠায় একটি ঘণ্টা কেউ আর সে-পথ মাড়াল না।

প্রথম প্রথম যাও বা একটু চক্ষুলজ্জা, সামাজিকতার বোধ ছিল আস্তে আস্তে তাও ঘুচল। অতসীকে কেউ আর বসতে, চা খেতেও বলে না। বরং তাকে দেখলেই ওরা অস্বস্তি বোধ করে, আতঙ্ক পায় যেন। হ্যাঁ—অতসী বুঝতে পারল, তাকে সবাই এড়িয়ে যেতে চায়, দূরে সরিয়ে রাখতে চায়। তাকে অপছন্দ করে ঘৃণা করে।

সোমকে বললে অতসী; এতটুকু দ্বিধা না করে, “তোমার এমন সুনাম এখানে যে আমাকেও মিসেস মুখার্জিরা হয়ত তোমার স্পাই কিংবা ইনফরমার ভাবেন।”

সোম শিস দিয়ে দিয়ে গালে সাবান ঘষছিল। বললে, “ওই হামবাগটাকে একদিন শায়েস্তা করব। পাকা চোর একটা।”

অতসীর সারা গা ঘেন্নায় রি রি করে উঠল, “তোমার কি লজ্জা ভদ্রতা কিছু নেই? মিঃ মুখার্জি বয়স্ক লোক, মানী মানুষ।”

“রাস্কেল!” সোম শিসের সুর থামিয়ে তার মত ব্যক্ত করলে।

অতসী স্তম্ভিত। একটু চুপ করে থেকে তেঁতো রুক্ষ গলায় বললে, “তোমার জন্যে আমি কারুর সঙ্গে দুটো কথা বলতে পারি না, মিশতে পর্যন্ত না। সকলে আমায় দূর দূর করে।”

“করে নাকি?” সোম রেজার তুলে গালের কাছে ধরল। “কেন যাও ওদের সঙ্গে কথা বলতে?”

“যাব না তো করব কি! আমি মানুষ না পশু! লোকজনের সঙ্গে মিশব না, কথা বলব না—শুধু তোমার এই ভূতের মতন বাড়িতে সারা দিন-রাত একলা মুখ বুজে থাকব!”

সোম হো হো করে হেসে উঠল। হাসি থামতে বলল, “তুমি যে ক্ষেপে গেছ দেখছি। কতকগুলো মেয়েলি গল্প না করলে তোমার কি খিদে হচ্ছে না নাকি? কে বলেছে তোমায় চুপচাপ মুখ বুজে বসে থাকতে। রেডিও বাজাও, রেকর্ড শোনো, ছুঁচের কাজটাজ করো, নাচো গান গাও, নভেল পড়ো। ডু অ্যাজ ইউ লাইক। সময় কাটানোর অভাব কি? বাগান রয়েছে, বাহাদুর রয়েছে।”

“বাহাদুর!” অতসীর গলার কাছে সাঙ্ঘাতিক একটা চমক এসে বিঁধে গেল।

“হ্যাঁ, বাহাদুরের কাছে বন্দুক ছোঁড়া শেখ না কেন? ও তোমায় শুটিং শেখাতে পারে!”

অতসী চুপ। মুখটায় যেন অনেকখানি রক্ত এসে জমে নীল হয়ে গেছে। চোখের মণি দুটো পাথর। গলার বাতাস-নলীর কাছে একটা বাতাসের কাঁকর যেন থর থর করে কাঁপছে।

সত্যিই সোমকে ঘৃণা করতে লাগল অতসী। বিতৃষ্ণা আর বিদ্বেষ বাড়তে বাড়তে চরমে উঠল। সোমকে আর সহ্য হয় না। তার কাছে পর্যন্ত যেতে অতসীর আজকাল অদ্ভুত একটা ঘৃণা হয়। সোম মানুষ নয়—স্বামী তো কিছুতেই নয়—পশু, পশুর চেয়েও অধম একটা জীব। যদি অতসীর সাধ্য থাকত এই লোকটাকে সে বুঝিয়ে দিত সারা সোনাপুর শুধু নয়—তার ঘরের স্ত্রী পর্যন্ত তাকে অত্যন্ত জঘন্য একটা মানুষ বলে ভাবে—ঘৃণা করে—ভীষণ ঘৃণা। কিন্তু মজা এই, সোম এমন মানুষ যে ঘৃণা বোঝে না। বোঝে না তার স্ত্রী তাকে কতোটা ইতর, কুৎসিত ভাবে, কী পরিমাণ ঘৃণা করে। কিংবা বুঝলেও সেটা সে গ্রাহ্যই করে না। যেন স্ত্রীর ভালবাসা আর ঘৃণা দুই-ই সমান—কিছুতেই কিছু আসে যায় না সোমের।

আশ্চর্য, অতসীর দিন দিন এই ইচ্ছেটাই তীব্র হতে লাগল যে, সোমকে—তার স্বামীকে, সে সত্যিই যে সাঙ্ঘাতিক ঘৃণা করে এটা বুঝিয়ে দিতে হবে, যেমন করেই হোক। যেন সেটা বোঝানোর ওপর অতসীর অস্তিত্ব, অতসীর স্বাতন্ত্র্য, তার নারীত্ব নির্ভর করছে। কিন্তু কি করে এই অমানুষিক ঘৃণাটা বোঝায় অতসী—!

বাহাদুর নতুন খেলা শেখাতে শুরু করেছে অ্যালসেশিয়ান দুটোকে। শিকার ধরার খেলা। সোমের নুনিয়া নদীর বাংলোয় দুটো পশুর পাশবিকতা ভীষণ হয়ে উঠেছে। বাহাদুর তার কোয়ার্টারের একটা ঘরে খরগোশ পুষছে। ধবধবে রঙ, লোমশ, চঞ্চল ক’টা জীব। সামনের মাঠে কাঠ-তক্তা জালি নেটের বেড়া দিয়ে দিয়ে একটা প্রকাণ্ড ধাঁধা করেছে। তার মধ্যে খরগোশ ছেড়ে দেয়। আর অ্যালসেশিয়ান দুটোকে। খরগোশ ছোটে—অ্যালসেশিয়ান দুটো ধাওয়া করে। সারা বাংলোটা কুকুরের ভয়ানক, ক্রুদ্ধ ডাকে চমকে চমকে ওঠে।

অতসী একদিন এই নতুন খেলা পা বাড়িয়ে দেখতে এল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল। পরে সোমকে বললে, “তোমার বাহাদুরের নতুন খেলাটা দেখেছো?”

“হ্যাঁ, খুব বুদ্ধি খেলিয়েছে জানোয়ারটা। এত বুদ্ধি ওর মগজে এল কি করে?”

“আমি সামান্য যুগিয়েছি।”

“তাই তো বলি। এ কিন্তু দিব্যি হয়েছে। একটা খরগোশ নাকি কাল মরেছে।”

“নাকি! তা মরতে পারে, আশ্চর্য কি! মুখের খাবার রোজ রোজ ফস্কে যেতে কেউ দেয় না।” অতসী পাশ থেকে, চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল।

হ্যাঁ, বাহাদুরের নতুন খেলায় নরম খরগোশ মরেছে। প্রথমে একটা। তারপর দুটো। শেষে তিনটে খরগোশও গেল।

এই খেলা শুরু হয়েছিল এক শীতের সকালে। মিঠে রোদে। হিমভেজা ঘাসে। দেখতে দেখতে শীত পেরিয়ে বসন্ত এল। নুনিয়া নদীর বাংলোর আশেপাশের পলাশ-ঝোপ লাল হয়ে গেল—আগুন ধরল। টকটকে আগুন। অতসী যেন তার আঁচ গায়ে মেখে নিল।

“বাহাদুর!”

“জী, মেমসাব!”

“বাহার চলো।”

“নুনিয়া মেমসাব?”

“হ্যাঁ।”

“কুত্তা?”

“লে লেও!”

“গান্‌—?”

“জরুর।”

নুনিয়ার উঁচু-নীচু চরে—আগুন ধরা পলাশ বনে একটা পারপেলরেড সিফনের শাড়ি ছুটে বেড়ায় পাগল হয়ে। যেন অদ্ভুত এক আগুনের শিখা ছুটে বেড়াচ্ছে। পাথর থেকে পাথরে, বালিতে, জলে—পলাশ আর কাঁটা ঝোপে ঝোপে। ছুটতে ছুটতে থমকে দাঁড়ায়। দূরে কটা হাঁস নেমেছে, ঝোপের মাথায় বুঝি এক ঝাঁক পাখি বসেছে—অতসী থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে।

“বাহাদুর!”

“জী মেমসাব।”

“গান্ দেও।”

বাহাদুর সঙ্গে সঙ্গে ছর্‌রা ভর্তি বন্দুকটা এগিয়ে দেয়। অতসীর হাত আর চোখ এতোদিনে ঠিক হয়ে গেছে। নিস্তব্ধ নুনিয়ার বুকে একটা শব্দ অট্টহাসি হেসে ওঠে। বাহাদুর কুকুর দুটো ছেড়ে দেয়। বিশ্রী একটা ডাক বাতাসে ছুঁড়ে কুকুর দুটো মরা পাখি কুড়িয়ে আনতে ছুটে যায়।

পলাশের আগুন লাগা বনে পারপেলরেড সিফনের শাড়ি দুলে দুলে হাসতে থাকে। সে তৈরি হয়ে উঠেছে। ওয়ান্ডারফুল। সোম শুনলে নিশ্চয় বলবে, ওয়ান্ডারফুল।

বসন্ত বুঝি আরও উগ্র, আরও তীব্র হল। ক’দিন থেকেই হাওয়া বইছে কেমন এক হাওয়া যেন। অতসীর ভেতর একটা চাপা আগুন এবার সব কিছু চৌচির করে তার মধ্য থেকে জ্বলে উঠেছে। নুনিয়ার চরে হঠাৎ একদিন বালির মধ্যে শুয়ে পড়ল অতসী। একটা অন্ধকার পা পা করে এগিয়ে আসছে। বালির মধ্যে লুটোপুটি খেতে গিয়েও হঠাৎ শান্ত, স্থির হয়ে গেল অতসী।

“বাহাদুর!”

“জী মেমসাব।”

“কুত্তা হাটাও।”

“জী।”

“ছোড় দেও দোনোকো।”

হ্যাঁ, বাহাদুর কুকুর দুটোকে ছেড়ে দিল। দুই পশুকে।

বসন্তও শেষ হল। গ্রীষ্ম এবং বর্ষা।

বৃষ্টি নেমেছে সোমের বাংলোয়। অ্যালসেশিয়ান দুটোর খেলা থেমেছে। বাহাদুরের কোয়ার্টারের সামনে বাঁধা থাকে। মাঝে মাঝে হুঙ্কার দিয়ে ওঠে।

অতসী বিছানায়। শরীরটা ভাল যাচ্ছে না।

“বাহাদুর।”

“জী মেমসাব।”

“গরম পানি বানাও।”

“জী।”

অতসী ফুটবাথ নেয়। বাহাদুর দুটি সুন্দর সুডৌল পায়ের কাছে বোবা পশুর মতন বসে থাকে। নধর হাঁটুর আবছা হাড় থেকে পায়ের গোড়ালি আর আঙুল পর্যন্ত মুগ্ধ হয়ে যেন দেখে। আর থেকে থেকে গলায় ঝুলনো তাবিজের সুতোয় বুড়ো আঙুল ঘষে জোরে জোরে।

“বাহাদুর।”

“মেমসাব।”

“তোমারা দেশ কাঁহা?”

“মালুম নেহি।”

অতসী আচমকা খিল খিল করে হেসে ওঠে। বাহাদুর সেই হাসির ফোয়ারার দিকে অপলকে চেয়ে থাকে। অতসী বলে, “তোমারা দেশ জঙ্গলমে। তোমারা আর তোমারা সাহাবকা। মালুম—”

“জী, মেমসাব।” বাহাদুর হাসে না। যেন কথাটা সত্যি। তার অস্বীকার করার কিছু নেই।

বর্ষাও ফুরিয়ে গেল। তারপর শরতের এক দুপর কাটতে না কাটতে হঠাৎ ভীষণ বর্ষা নামল। সোমের বাংলোর গাছপালায় ঝড় তুলে, পাতা উড়িয়ে, ডাল ভেঙে ঝড় আর বৃষ্টি। দুরন্ত সে জলধারা। আকাশ কালো—নিকষ কালো। বাতাসে সে কালো যেন মিশে মিশে গেছে। বিকেলের মাঝামাঝি যেন রাত নেমে এল। বৃষ্টিও ঝরে চলেছে। অবিশ্রান্ত।

সোমের বাংলোয় বাতি জ্বলে উঠল। সব বাতি নয়। একটি দুটি। অন্ধকারে আর জলের মধ্যে গাছপালা ঘেরা বাংলোটা যেন সেই অল্প ক’টি মৃদু আলো নিয়ে নির্জন দ্বীপের মত পড়ে থাকল।

সন্ধের একটু পরেই সোম ফিরল। গেটের কাছে আসতেই দাঁড়াল। গেট বন্ধ। গেটের বাতিটাও জ্বলছে না। হর্ন দিল সোম। সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির মধ্যে দুটো বিকট হুঙ্কার অন্ধকার থেকে তীরের মত তার সামনে লাফিয়ে পড়ল। কুকুর দুটো গেট টপকে এল বলে। তাড়াতাড়ি সোম গাড়ির কাচ দুটো তুলে দিল। ডিমার নিভিয়ে হেডলাইট জ্বেলে দিল গাড়ির। গেটের মাথার ওপর গলা তুলে ভয়ংকর দুই পশু পথ আগলে দাঁড়িয়েছে। রোখা মূর্তি। চোখ জ্বলছে। ভীতিকর গর্জনটার রেশ মিলিয়ে যেতে না যেতে আর একটা গর্জন লাফিয়ে উঠছে। সোম এই যেন প্রথম দেখল, কুকুর দুটো অত্যন্ত বীভৎস। যে কোনো মুহূর্তে লাফিয়ে গলার টুঁটি ছিঁড়ে খেতে পারে। হাউ ফেরোসাস!

অধৈর্য হয়ে সোম আর একবার হর্ন দিল। না, বাহাদুর আসছে না। বৃষ্টির শব্দে কি জানোয়ারটার কানে তালা ধরে গেল, না ঘুম দিচ্ছে! রাস্কেল, ইডিয়েট কোথাকার। এই লোকটা তার গার্ড! এর হাতে সোম তার সেফটি তুলে দিয়েছে।

ক্ষেপে গিয়ে সোম ইলেকট্রিক হর্নটা আর থামাল না। বরং হাতের সবটুকু জোর দিয়ে টিপে থাকল। বিশ্রী কর্কশ একটা একঘেয়ে শব্দ উপচে বাজতে লাগল।

হঠাৎ একটা শব্দ। জলের মধ্যে দিয়ে কেউ যেন ছুটে আসছে। বাহাদুর। দৌড়তে দৌড়তে এসে বাহাদুর কুকুর দুটোকে বাগিয়ে ধরে নিল। হেডলাইটের আলোয় সেই তিন জানোয়ারের মূর্তি গেটের কাছে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।

গেটটা খুলে দিল বাহাদুর। গাড়ির মুখ গেটের মধ্যে বাড়িয়ে একবার ব্রেক কষল সোম। জানলা দিয়ে গলা বাড়িয়ে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে চেয়ে দেখল শয়তানটাকে। ধমকে উঠল, “কিয়া করতা থা তুম। উল্লু কাঁহাকা। কুত্তা ছোড় দিয়া কাহে?”

“ছুট্‌ গিয়া হুজুর।”

“ছুট গিয়া—! সোয়াইন!”

বাহাদুর চুপ। কুকুর দুটোকে টেনে একপাশে দাঁড়িয়ে থাকল। সোম চলে গেল গ্যারেজে।

বারান্দা পেরিয়ে বিরক্ত, অপ্রসন্ন মনে সোম ঘরে ঢুকল। ড্রয়িংরুমে। অতসী নেই। শোবার ঘরে এল সোম। বিছানায় শুয়ে রয়েছে অতসী। কোমরের ওপর পর্যন্ত সুতীর চাদর টেনে। চুল এলোমেলো। মুখের মধ্যে লালচে ভাব একটা। সামান্য যেন ঘাম কপালে। বালিশের পাশে এমব্রয়ডারি ফ্রেমে কী যেন একটা পরানো। সামান্য পিঠ উঁচিয়ে সেটা টেনে নিলে অতসী। লাল রঙের সুতো পরানো ছুঁচটা আঙুলে তুলে নিল।

“বাড়িসুদ্ধ সবাই কী তোমরা মরে গিয়েছিলে?” সোম খেঁকিয়ে উঠল।

“কই, দিব্যি তো বেঁচে আছি।” অতসী আরও একটু পিঠ সোজা করে নিল।

“লক্ষণ তো দেখছি না। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আধ ঘণ্টা ধরে হর্ন দিচ্ছি—কারও কানে ঢুকছে না?”

“যা বৃষ্টি।”

“বৃষ্টি! মালী কোথায়?”

“তাকে বাজারে পাঠিয়েছি বিকেলে। এই বৃষ্টিতেই। মুরগী যোগাড় করে আনতে। এই ওয়েদারে তোমার হয়ত মুরগী ভাল লাগবে ভেবে।” অতসী বলল, পরিহাস করছে না যেন এমন সুর টেনে।

“আর বনমালী? সে কোথায়?”

“তাকে পাঠিয়েছি ডাক্তারের কাছে ওষুধ আনতে। শরীরটা দুপুর থেকে খুব খারাপ হয়েছিল। মাথা ধরা আর বমি-বমি!”

সোম স্ত্রীর দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থাকল।

“ওটা কি?” সোম অতসীর হাতের দিকে তাকিয়ে বলল।

“বাহাদুরের গেঞ্জি। একটা ফুল তুলে দিচ্ছি বুকে। ক’দিন ধরে পাগল করে মারছে আমাকে।” অতসী হাতের ছুঁচ কাপড়ের মধ্যে ফুটিয়ে দিল।

সোম দু-পা এগিয়ে এল। অতসীর প্রায় গায়ের ওপরই। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল স্ত্রীকে। চুলগুলো উস্কোখুস্কো। মুখটা লালচে। কপালে ঘাম। বুকের কাছটা খোলা। হৃদ্‌পিণ্ড যেন ভীষণ শ্রান্ত হয়ে খুব আস্তে আস্তে ধুকধুক করছে।

সোম ছোঁ মেরে অতসীর গা থেকে চাদরটা তুলে ছুঁড়ে দিল বিছানার একপাশে। অতসী চমকে উঠে চুপ করে গেল। তারপরই ভীষণ—ভীষণ একটু রূঢ়তা ও দৃঢ়তায় শান্ত স্থির হয়ে শুয়ে থাকল।

অতসীর শাড়ি বড় এলোমেলো হয়েছিল। সোম পট পট করে তার ব্লাউজের দুটো বোতাম খুলে ফেলল। তারপর হঠাৎ কি দেখে ভীষণভাবে চমকে উঠল।

“বাহাদুরের গলার তাবিজটা তোমার বিছানায় কি করে এল?” সোম বিশ্রীভাবে ইতরের মতন চেঁচিয়ে উঠল। পশুর মতন।

অতসী একটুও চমকাল না। কাঁপল না। সোমের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল।

সোম ছটফট করে বিছানার সামনে একটু পায়চারি করল। তারপর হঠাৎ অতসীর গায়ের ওপর ঝুঁকে পড়ে সাপের মতন দুই হিংস্র চোখ রেখে বললে, “আমাকে বাজে কথা বলো না। এ হতে পারে না। নেভার। তুমি নিশ্চয় ওই জানোয়ারটাকে—”

অতসী গায়ের কাপড়টা গুছিয়ে নিতে নিতে সামান্য উঠে বসল। সোমের দিকে চাইল, “এই সংসারটাই তো জানোয়ারের!” ঘৃণায় অতসীর চোখ, মুখ কুঁচকে উঠল।

সোম হাত বাড়িয়ে অতসীকে, অতসীর গলাটা খপ্‌ করে ধরতে যাচ্ছিল। হঠাৎ শব্দ শুনে ফিরে তাকাল। বেডরুমের কাচ-আঁটা দরজার বাইরে বাহাদুর দুটো ভয়ংকর জানোয়ারের গলার বক্‌লস ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

সোম পাগলের মতন ছুটে এসে দরজাটায় প্রচণ্ড একটা লাথি মারল। ঝনঝন করে একটা কাচ বোধ হয় ভেঙে পড়ল মেঝেতে। দরজাটা খুলে গেল। হাট হয়ে।

কুকুর দুটোকে সোমের আর নিজের মধ্যে রেখে বাহাদুর চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল।

সোম বাহাদুরের ভয়ংকর দুই চোখের দিকে তাকাল একবার। আর একবার কুকুর দুটোর ভীতিকর ভঙ্গির দিকে, চোখের দিকে। তিনটে জানোয়ারকে একসঙ্গে দেখে নিয়ে সোম আর একবার ঘাড় ঘুরিয়ে অতসীর দিকে চাইল।

বাহাদুর অন্ধকারে সরে যাচ্ছে না তবু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *