বন্ধুর জন্য ভূমিকা

বন্ধুর জন্য ভূমিকা

আমার বন্ধু স্বৰ্গত বসুধা মুখোপাধ্যায় অখ্যাত ও অজ্ঞাত লেখক। প্রায় বিশ বাইশ বছর আগে তার একটি বই আমরা তিনবন্ধু মিলে বের করেছিলাম। বসুধা তখন আমাদের মধ্যে ছিল। সেই বই যথারীতি গোয়াবাগানের এক ছাপাখানায় দীর্ঘদিন পড়ে থেকে নষ্ট হয়েছে। ফুটপাথে দু-পাঁচখানা বই আমরা দু-চার আনায় বেচতে পেরেছিলাম, সে বই কেউ কিনেছেন বা পড়েছেন এমন আশা আমি করি না।

বসুধার সেই বই এতকাল পরে আবার নতুন ছাপা হচ্ছে। ছাপছে আমার এবং বসুধার বন্ধু। প্রথমবারের ছাপার সময়েও সে ছিল।

‘নরক হইতে যাত্রা’—এই নামেই প্রথমবার বইটি বেরিয়েছিল, এবারেও সেই নামটি রাখা হল; পুরনো বইটিতে ছিল তিনটি গল্প, এবারে আরও দুটি যোগ হয়েছে। বসুধা মারা গিয়েছিল এমন এক হাসপাতালে, যেখানে যাওয়া বা তার শেষ কোনো লেখা (যদি সে লিখে থাকে) সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল না। আমরা আমাদের জানা লেখা থেকেই তার বইটি প্রকাশ করছি।

পাঠকদের কাছে আমার পক্ষ থেকে পূর্বেই মার্জনা ভিক্ষা করা উচিত। আমি লেখক নই, ভূমিকা কেমন করে লিখতে হয় জানি না। আমার ভাষাও ভূমিকার উপযোগী নয়। ভূবনই্‌ আমায় এই দায়িত্ব দিয়েছে। সে মনে করে, যৌবনে যখন বসুধার সঙ্গে আমিও লেখাটেখার চেষ্টা করেছি তখন কাজটা আমারই করা উচিত। ভুবন আরও মনে করে, বসুধার কথা আমি তার চেয়েও বেশি জানি। কথাটা হয়ত ঠিক না। কলম না ধরলেও ভুবন আমার চেয়ে বসুধার কম অনুরাগী, গুণমুগ্ধ ও ঘনষ্টি ছিল না; তবু বসুধার বইয়ের ভূমিকা আমাকেই লিখতে হচ্ছে।

দীর্ঘ বিশ-বাইশ বছর পরে বসুধার মতন অখ্যাত অজ্ঞাত লেখকের অপঠিত বিস্মৃত একটি বই আবার কেন ছাপছি তার একটা কৈফিয়ত থাকা দরকার। বন্ধুত্ব ভিন্ন এর কোনো কৈফিয়ত থাকতে পারে না। অবশ্য মৃত বন্ধুর প্রতি অনুরাগ প্রদর্শন করে ব্যক্তিগতভাবে আমরা কিছু সান্ত্বনা পাচ্ছি। …দ্বিতীয় কারণ কিছুটা অন্য রকম। মাস চার-পাঁচ আগে ভুবন একবার কাশী গিয়েছিল। কাশীতে রামপুরায় এক ভদ্রলোকের সঙ্গে তার আলাপ হয়। ভদ্রলোক বৃদ্ধ। একদিন তাঁর বসার ঘরে বসে গল্প করছে ভুবন, এমন সময় একটি ছেলে এসে একটা বাঁধানো ছবি দিয়ে গেল । কয়েক দিন আগে ঘরের ঝুল ঝাড়বার সময় দেওয়াল থেকে পড়ে গিয়ে ছবিটির কাচ ভাঙে, আবার সেটি বাঁধিয়ে বাড়িতে এল। স্বভাবতই ছবিটি ভুবনের চোখে পড়েছিল। ধূসর বিবর্ণ ছবির মধ্যে ভুবন বসুধাকে দেখতে পেল। তিনটি মুখের একটি বসুধা, অন্য দুটির একজন বৃদ্ধ নিজে, অন্যজন তাঁর মেয়ে। ভুবন বলল, ‘একে আমি চিনি; আমার বন্ধু বসুধা।’ বলে সে বসুধার অন্য পরিচয় দিল, ‘ও লেখক ছিল।’ বৃদ্ধ বললেন, ‘আমার মেয়েও বলত, ও নাকি লেখে। আমি কখনো দেখিনি লিখতে। তবে হরিদ্বারে গিয়ে সেবার ওকে এক ক্ষয়-রুগীর সেবা করতে দেখেছি। এই ছবিটা হরিদ্বারের। ছেলেটা যেন সন্ন্যাসীর মতন ছিল। …তুমি ওর খবর জান?’… ভুবন কি ভেবে যেন বসুধার মৃত্যু-সংবাদ দেয়নি, ‘না, আমি জানি না।’

কাশী থেকে ফিরে এসে ভুবনের কেন যেন খেয়াল চাপল, বসুধার সেই বই ও ছাপবে। আমি অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি—কেন ছাপবে। কী হবে ছেপে? সে শুধু মাথা নেড়ে নেড়ে বলেছে, “না, ছাপব। ছাপা আমাদের উচিত। বসুধাকে আমি আগে কতবার বলতাম, আমার যদি পয়সা থাকত, তার বই আমি ছাপতাম। আমার অবস্থা এখন ভাল, আমি তার বইয়ের জন্যে টাকা খরচা করতে রাজি।’

আমার মনে হয়, ভুবন আজ প্রায় ছেচল্লিশ-সাতচল্লিশ বছর বয়সেও তেমনি আবেগপ্রবণ উৎসাহী রয়েছে, আমি যা থাকতে পারিনি। আমার একমাত্র সান্ত্বনা, বসুধার জন্যে আমি এই ভূমিকাটুকু লিখতে পারছি। পাঠক নিজগুণে আমার অক্ষমতা মার্জনা করবেন।

বসুধার জন্ম বাংলাদেশে, পশ্চিমবঙ্গে। প্রথম যুদ্ধ থামার বছরে, উনিশ শো আঠারোতে তার জন্ম; বোধহয় অগ্রহায়ণ মাসে। তার বাবা ছিলেন পোস্টমাস্টার। বদলির চাকরি বলে বসুধারা হাজার ঘাটের জল খেয়েছে। বাংলা আর বিহারের মধ্যেই অবশ্য। বসুধার মা ছিলেন নম্রস্বভাব, শান্ত, ধর্মভীরু। ওর এক দিদি ছিল, বসধা যখন কলেজে পড়ছে তখন তার দিদি স্বামীগৃহে মারা যান। বসুধার অন্যান্য কোনো আত্মীয়স্বজনের কথা আমরা জানি না।

কলকাতায় কলেজে পড়তে এল যখন বসুধা, তখন আমাদের সঙ্গে আলাপ। সে ভাল ছাত্র ছিল না, তার চেহারা সুন্দর ছিল না, এমন কি তার গলার স্বরও ভাঙা ছিল। বন্ধু হিসেবে বসুধা ছিল দুর্লভ। সে যত না পড়ত তার দশগুণ আপনমনে নানা কথা ভাবত, যখন আমাদের কিছু বলত বা বোঝাত, তার ভাঙা ভাঙা গলার স্বর আবেগে কেমন যেন অদ্ভুত সুন্দর হয়ে উঠত। বসুধার চোখ বলত, সে একটু বেশি রকম আবেগপ্রবণ। তার মুখের গড়ন ছিল লম্বা, থুতনি সরু, নাক বেশ পাতলা আর উঁচু; কিন্তু চোখ দুটি ছিল সামান্য যেন ছোট, খুব ঝকঝকে, মোটা মোটা ভুরু। ওর রঙ ছিল আধ-ফরসা, মাথার চুল কোঁকড়ানো। চেহারার মধ্যে তার এমন কিছু ছিল না যা অন্যকে আকর্ষণ করবে, সাধারণ বাঙালীর ছেলের থেকে ওকে আলাদা করার কথাও নয়। কিন্তু আমরা, যারা বসুধার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম, তারাই শুধু জানতাম ওর স্বভাবের ছাঁচটা আমাদের মতন নয়, কোথায় যেন একটা আকর্ষণ রয়েছে।

বি. এ. ক্লাসে পড়ার সময় বসুধা লেখার চর্চা শুরু করে। তার আগেও হয়ত লিখত, কিন্তু আমরা তার খবর জানতাম না। বসুধার প্রথম লেখা গল্প আমাদের বন্ধুদের এক কাগজে বেরিয়েছিল। সেই কাগজ বা সেই গল্প হারিয়ে গেছে। তখন কলকাতায় বোমা পড়ার সময়, নানা দিকে ডামাডোল, মানুষ ভয়ে আতঙ্কে ছুটছে পালাচ্ছে। ওই রকম অস্থিরতার সময় সবাই যা লিখছিল বসুধাও সেই রকম এক গল্প লিখেছিল। একেবারে মামুলি লেখা। তখন অবশ্য আমরা তার খুব প্রশংসা করেছি, কিন্তু বলতে কি, সেই গল্প এত মামুলি যে, আজ আমার কিছু মনে নেই গল্পটা সম্বন্ধে।

আমার বিশ্বাস, বসুধাও মনে করত, তার ঠিক-ঠিক নিজের লেখা শুরু হয়েছিল তেতাল্লিশ সাল থেকে। তখন আমরা সবাই চাকুরে, বসুধা চাকরি করত সিভিল সাপ্লাইয়ে; আমি আর ভুবন অন্যত্র। বউবাজারের এক মেসে থাকত বসুধা, বন্ধুবান্ধব বলতে আমরা দু’জন, মেসের ঘরে বিকেলের পর সন্ধে থেকে আমাদের আড্ডা জমত, বসুধা তার লেখার কথা বলত, কিছু যদি লিখে রাখত আমাদের পড়ে শোনাত। তার মন বড় অস্থির ছিল, কখনো পুরো করে কিছু লিখত না, একটা কিছু আজ লিখব বলল, কাল আর লিখল না; অনেক লেখা শুরু করেছে, সামান্য লিখে ছেড়ে দিয়েছে। মাসের পর মাস সে শুধু লেখার কথা বলেছে, কিন্তু এক বর্ণও লেখেনি।

এই বইয়ের যেটি প্রথম গল্প, ‘বিনোদিনীর দুঃখ’—তখনকার দিনের একটি মাসিক পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। গল্পটিতে বসুধার প্রথম যেন নিজের কোনো বলার কথা ধরা দিয়েছে। তেরো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল বিননাদিনীর, স্বামীর বয়স তখন আঠারো। লালপেড়ে মোটা শাড়ি গায়ে থাকত না বলে বিনোদিনী পুঁটলির মতন করে অর্ধেকটা শাড়ি পিঠে করে বয়ে বেড়াত। তার স্বামী গঙ্গাপদ বউয়ের জন্যে স্টিমারঘাটের হাট থেকে মাটির পুতুল, কাচের চুড়ি, কাচপোকার টিপ, চিনে সিঁদুর, কাঁচা পেয়ারা, জাম কিনে আনত লুকিয়ে লুকিয়ে, এনে বউকে দিত, রাত্রে তক্তপোশের তলা থেকে লুকোনো জিনিস বের করে বিনোদিনী খেলতে বসত, কিংবা রাত্রেই কাঁচা পেয়ারাটা চিবিয়ে চিবিয়ে খেত। গঙ্গাপদ স্টিমারঘাটায় চাকরি পেলে বিনোদিনীর জন্যে কিনে এনেছিল এক কাচের গৌরাঙ্গঠাকুর। বিনোদিনী তখন থেকে ঠাকুরভক্ত। এমনি করে বিনোদিনী যুবতী হল, ছেলেমেয়ের মা হল, গিন্নী বউ হল, যৌবন ফুরোলো, বুড়ো হয়-হয়, তারপর তার স্বামী গঙ্গাপদ মারা যাবার পর বিনোদিনী এই সংসারে কোথাও আর নিজেকে মানাতে পারল না। পঁয়তাল্লিশ বছরেরও বেশি স্বামীর সঙ্গে তার নিজের জীবন এমন করে জড়ানো যেন সে এবং তার স্বামী তাদের সংসার, তাদের সম্পর্ক এক ধরনের জীবন-নকশা তৈরি করেছিল (ইংরেজীতে যাকে আমরা বলি প্যাটার্ন, তাই), স্বামীর মৃত্যুতে সে-নকশা হঠাৎ নষ্ট হয়ে গেল। বিনোদিনীর জীবন এখন শূন্য, অর্থহীন, অকারণ। যেন যেতে যেতে একটি নদী হঠাৎ কোথায় হারিয়ে গেছে, তার আর প্রবাহ থাকল না। বিনোদিনীর মনের অবস্থার একটি বর্ণনা এই রকম: ‘যে রেখা এবং রঙ দিয়া বিধাতা তাহার জন্য এই সংসারের একটি অতি ক্ষুদ্র চিত্র আঁকিয়াছিলেন, সেই রেখাগুলির অর্ধেক মুছিয়া গিয়াছে, অনেক রঙ ধুইয়া গিয়াছে। এখন আর বিনোদিনী চিত্র নয়, আর কখনও তাহার চিত্র হইবার সম্ভাবনা নাই।’

বিনোদিনী তার এই শূন্যতা পূর্ণ করার জন্যে ছেলের কথা ভেবেছে, মন তেমন করে সাড়া দেয়নি; ঠাকুর-দেবতা নিয়ে ভুলতে চেয়েছে, ভুলতে পারেনি। বিনোদিনীর বড় আদরের ছিল তার সেই কাচের শ্রীগৌরাঙ্গ, পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে গৌরাঙ্গকে সে নিত্য সেবা করেছে, গঙ্গাপদর অবর্তমানে গৌরাঙ্গও শুধুমাত্র কাচ হয়ে থাকল। শেষে বিনোদিনী একদিন হঠাৎ অনুভব করল: ‘প্রতিমার বিসর্জন হয়, তাহার সাজ-শোভা, মাটি সবই গলিয়া যায়, কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না। মানুষের জীবনেও এই বিসর্জনগুলি অতি সত্য। গঙ্গাপদ ও বিনোদিনীকে কাহারা যেন বিসর্জনের বাজনা বাজাইয়া নদীর ঘাটে আনিয়া রাখিয়াছে, স্বামী গিয়াছেন, বিনোদিনীর জন্য নদীর জল অপেক্ষা করিতেছে। একই নদীর জলে উভয় মূর্তি ডুবিয়া গলিয়া একাকার হইয়া থাকিবে, বিননাদিনী ইহা ভাবিয়া ঈশ্বরকে আজ প্রণাম করিল।

‘বিনোদিনীর দুঃখ’ গল্পে বসুধা তার মা’র কথা লিখেছিল। তার মা আর বিনোদিনীতে তফাত নেই, ধর্মভীরু হওয়া সত্ত্বেও তার মা স্বামীর মৃত্যুর পর না বসুধা না বা ধর্মকে আশ্রয় করে সত্যকার সান্ত্বনা পেয়েছিলেন। বসুধা বলত: মা পরকালও বিশ্বাস করে না। একমাত্র মৃত্যুকেই বিশ্বাস করে। আমি কিছু বুঝতে পারি না।

বসুধার মা মারা যাবার পর, বেশ কিছুদিন পর, সে আরও একটা গল্প লেখে। গল্পটির নাম ‘দুঃখ মোচন’। এই বইয়ের সেটি দ্বিতীয় গল্প। একটি অপ্রচলিত পত্রিকায় গল্পটি ছাপা হয়েছিল। ‘বিনোদিনীর দুঃখ’ লেখা হয়েছিল সাধু ভাষার ঢঙে। বসুধা প্রথম দিকে তাই লিখত। ‘দুঃখ মোচন’ সে চলতি ভাষায় লিখেছে।

‘বিননাদিনীর দুঃখ’ গল্পে বিনোদিনীর শেষ সান্ত্বনা ছিল মৃত্যু। মৃত্যুকে বিনোদিনী দুঃখ মোচনের পরিণতি হিসেবে দেখেছিল। কথাটা বোধ হয় ঠিক মতন বলা হল না, বলা উচিত ছিল, বিনোদিনী মৃত্যুর মধ্যে এক ধরনের আত্মিক পুনর্মিলন আশা করেছিল। ‘দুঃখ-মোচন’-এ এই মৃত্যুকে যেন আরও বেশি করে যাচাই করবার চেষ্টা করেছে বসুধা।

আগে বলেছি, গল্পটা বসধা তার মা মারা যাবার বেশ কিছু পরে লিখেছে। ওর মা যখন মারা যায় তখন বসুধার সঙ্গে একটি মেয়ের পরিচয় গড়ে উঠছিল। তার নাম এখানে গোপনে রাখলাম, সুবিধের জন্যে আমরা তাকে নিরু বা নিরুপমা বলে উল্লেখ করব। বসধা তার মা’র অসুস্থতার খবর পেয়ে দেশে চলে গিয়েছিল, এবং মা’র মৃত্যুর পর শ্রাদ্ধকৰ্ম পর্যন্ত দেশেই ছিল। আমরা—আমি আর ভুবন—বসুধার মা’র শ্রাদ্ধের দিন তার দেশের বাড়িতে গিয়েছিলাম। বসুধা তখন আমাদের এক অদ্ভুত কথা বলল; বলল যে, শ্মশানে যখন নদীর পাড়ে মা’র চিতা দাউ দাউ ক্‌রে জ্বলছিল তখন এক জামগাছের তলায় বসে সে প্রায় সারাক্ষণ নিরুর কথা ভেবেছে। তারপর এই যে ক’দিন—শোক আর অশৌচের পর্ব—এই ক’দিনও সে মা’র কথা অল্পই ভেবেছে, নিরুর কথাই ভেবেছে বেশি। কেন?

বসুধার সব ব্যাপারেই ‘কেন’-র বাতিক ছিল। মা’র জন্যে তার যেমন শোক পাওয়া উচিত ছিল, বেদনা বোধ করা কর্তব্য ছিল—তেমন শোক বা বেদনা সে পেল না, নিরুপমার কথা ভাবল শুধু—এই গ্লানিতে তার মন অনেক দিন বিমর্ষ থাকল। যেন সে কত বড় অপরাধী, কী গুরুতর অন্যায় না করেছে! আমরা তাকে বোঝাতে পারিনি, অকারণে সে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছে।

কিছুদিন ওইভাবে, বিমর্ষতা ও গ্লানির মধ্যে কাটল বসুধার। নিরুকেও সে অসুখী অপ্রসন্ন করে রাখল; তারপর নিজের মনের মতন এক উত্তর খুঁজে পেয়ে বসুধা ‘দুঃখ মোচন’ গল্পটি লিখল।

‘বিনোদিনীর দুঃখ’ গল্পে বিনোদিনী মৃত্যুর মধ্যে তার দুঃখের নিবৃত্তি অনুভব করেছে, ‘দুঃখ মোচন’-এ সুখেন্দু অনুভব করেছে মৃত্যু নিষ্ক্রিয়, জড়তুল্য; জীবন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না। সরল করে বললে কথাটা এই দাঁড়ায়, বিনোদিনী মৃত্যুকে গ্রহণ করে শান্তি পেতে চেয়েছিল, সুখেন্দু জীবিত থাকতে এবং সজীবতা থেকে শান্তি পেতে চাইল।

সুখেন্দু ‘দুঃখ মোচন’ গল্পের নায়ক। তার বয়স কিছুটা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গল্পের মুখ্য বিষয় আপাতত মনে হবে প্রেম; কিন্তু আমি মনে করি, মৃত ও জীবিতরা মৃত্যু ও জীবনের দ্বন্দ্ব। গল্পটির শুরু থেকেই আমরা দেখি, সুখেন্দু একটি অদ্ভুত দ্বিধার মধ্যে অত্যন্ত দুঃখীর মতন বেঁচে আছে। সে রেণু বলে একটি মেয়েকে ভালবাসে, অথচ তার মা’র সর্বগ্রাসী এক স্মৃতি তাকে রেণুর সঙ্গে সহজ সম্পর্ক স্থাপন করতে দিচ্ছে না। তার মনে সর্বদাই একটি অন্যায়ের ভয়, বিবেকের গ্লানি। সুখেন্দুর মনে হয়, সে যেন তার মা’র নিত্য অভিশাপ কুড়িয়ে বেঁচে আছে। এ-রকম কেন হয় সে বোঝে না, এইমাত্র বুঝতে পারে, মা’র প্রতি যথোচিত কর্তব্যগুলি সে পালন করেনি।

মনের এই দ্বন্দ্ব থেকে সুখেন্দুকে আমরা উদ্ধার পেতে দেখব বলে যখন আর আশা করি না—তখন একটি ঘটনা থেকে সমস্ত দ্বন্দ্বের অবসান ঘটছে। গল্পের শেষের দিকের অলৌকিক ঘটনাটির কথাই আমি বলছি। শীতের শুরু তখন, রেণুদের বাড়ির ছাদে সেদিন সন্ধেবেলায় রেণু আর সুখেন্দু বসে গল্প করছিল। কলকাতার গলি ধোঁয়া-কুয়াশা আর গ্যাসের আলো ও ঈষৎ জ্যোৎস্নায় কেমন ঝাপসা হয়ে আছে। গল্প করতে করতে রেণু হঠাৎ উঠে গিয়েছিল, সুখেন্দু বসে ছিল। সহসা তার মনে হল কে যেন তার পাশে এসে বসে আছে। ঝাপসা জ্যোৎস্না ও ধোঁয়া-কুয়াশার মধ্যে নির্বাক সেই মূর্তিকে সে প্রথমে চিনতে পারল না, সাদা ছায়ার মতন লাগছিল যেন মূর্তিটিকে। সামান্য লক্ষ করার পর সুখেন্দু চিনতে পারল, তার মা। প্রথমে অবাক হলেও পরে সুখেন্দু যেন বুঝতে পারল, মা কেন এসেছে। মৃত মা’র প্রতি তার করুণা ও মমতা হচ্ছিল, মা’র জন্যে দুঃখ হচ্ছিল। অদ্ভুত একটি উদাসীনতা ও চিন্তানুভূতি এসে তাকে গ্রাস করছিল যেন। মাকে কিছু বলতে যাচ্ছিল সুখেন্দু—সহসা সে কেমন এক গন্ধ অনুভব করল। কিসের গন্ধ? কার গন্ধ? অন্যমনস্কভাবে মুখ নিচু করতে বুকপকেটের মধ্যে থেকে ফুলের গল্প এল। মনে পড়ল, রেণু সামান্য আগে তার মাথার খোঁপা থেকে একটিমাত্র গোলাপ খুলে সুখেন্দুর পকেটে দিয়ে গিয়েছিল? গন্ধটি আশ্চর্য লাগল সুখেন্দুর, কত জীবন্ত, মনোরম, স্পর্শযোগ্য। রেণুর শরীর মন ভালবাসা, সব যেন সেই মুহূর্তে বিশাল এক ঢেউয়ের মতন এসে তাকে ভাসিয়ে দিল। সুখেন্দু সেই অবস্থায় কোনো রকমে তার মাকে বলল: তুমি আর এসো না।

বসুধা নিজের বেলায় যে গ্লানি অনুভব করেছে, সুখেন্দুর মধ্যে দিয়ে সেই গ্লানি কাটিয়ে উঠেছে। মৃত মা’র জন্যে তার ভীষণ কোনো শোক অথবা বেদনা হয়নি, অথচ নিরুর চিন্তাতে তন্ময় হয়েছিল—এই গ্লানিবোধের জন্যে তার যে দুঃখ জন্মেছিল সেই দঃখ তার মোন হল এতদিনে। নিরু জীবিত বলেই তার আকর্ষণ বেশি, নিরু জীবিত বলেই সে প্রয়োজনীয়। জীবনই প্রেম।

‘দুঃখ মোচন’ ঠিক প্রেমের গল্প নয়, প্রেম এই গল্পে উপজীব্য বিষয় নয়। মানুষ মাত্রেই জীবনের প্রতি আসক্ত, এবং এই আসক্তি ভিন্ন কোনো জীব জীবিত হতে পারে না, বসুধা যেন সেই কথাই বলতে চেয়েছে।

ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়, বসুধার এই গল্পটি তার নিজের পক্ষে কল্যাণকর হয়েছিল। সুখেন্দু নিমিত্তমাত্র।

এই বইয়ের তৃতীয় গল্প ‘নরক হইতে যাত্রা’। আমি আগে বলেছি, আরও একবার স্মরণ করিয়ে দি, এই গল্পটির নামেই প্রথমবার তার বই আমরা ছেপেছিলাম। এবারেও ওই নাম রাখা হয়েছে।

‘দুঃখ মোচন’ গল্পটি লেখার প্রায় বছর খানেক পরে বসুধা এই গল্পটি লিখেছিল। গল্পটিকে প্রেমের গল্প বলা যায়। অবশ্য প্রেমের গল্পের নাম ‘নরক হইতে যাত্রা’—এ যেন খুবই অদ্ভুত শোনায়।

‘নরক হইতে যাত্রা’য় একটি যুবকের প্রেম-পিপাসা, প্রেম এবং পরে তার ব্যর্থতার কথা বলা হয়েছে। গল্পের নায়ক বসুধা নিজে, যদিও লেখায় নায়কের নাম পরিমল। এখানে নায়িকার নাম কিন্তু সত্যিই নিরুপমা। কলকাতার সদানন্দ চৌধুরী লেনের যে বাড়িতে নিরুপমা থাকত, তার নিচের তলায় পরিমলের এক বন্ধু থাকত। মাঝে মাঝে পরিমল বন্ধুর কাছে যেত। সেই সূত্রে নিরুপমার সঙ্গে পরিচয়। …পরিচয় ঘনিষ্ঠ হতে কিছুটা সময় নিশ্চয় লেগেছিল, কিন্তু এ-কথা বেশ বোঝা যায়, প্রথম থেকেই পরিমল নিরুপমার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। পরিমল ছিল সেই ধরনের ছেলে—ভালবাসাকে যারা অনেকটা দৈবশক্তির মতন মনে করে, এখনো বিশ্বাস করে ভালবাসায় মানুষের হৃদয় উজ্জীবিত হয়। মুখচোরা লাজুক এবং ভাবুক গোছের এই ছেলেটিকে খুব সাধারণ মেয়ে নিরুপমার ভাল না লাগার যথেষ্ট কারণ ছিল। নিরুপমা ছিল স্বভাবে খুবই সাধারণ।

গল্পের প্রথমাংশে পরিমল এবং নিরুপমার ক্রম-ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠার কাহিনী আছে। দ্বিতীয়াংশে তাদের ভালবাসার সম্পর্ক। এই ভালবাসাকে পরিমলের তরফ থেকে গভীর ও আন্তরিক বলতে কোথাও বাধা দেখি না। পরিমল ভাবত; এই প্রেম তার অস্তিত্বকে সার্থক করেছে, তার জীবনকে মূল্যবান করেছে; নিরুপমা অত ভাবত না, ভাবার কারণ দেখত না। হয়তো সে ভাবতে জানত না। তবু, যুবতী যে কোনো মেয়ের মতন তার কিছু রোমাঞ্চ ছিল এই প্রেমে।

এই ভালবাসা একদিন ভেঙে গেল। কেন ভাঙল বোঝা যায়। তবু কখনো মনে হবে নিরুপমাদের বাড়ির নিচের তলার ভাড়াটে পরিমলের বন্ধু মন্মথর ইতরতা ও চতুরতার জন্যে এই প্রেম নষ্ট হয়েছিল; কখনো মনে হবে দোষটা পরিমলেরই; আবার এক এক সময় নিরুপমাকেই দায়ী করতে ইচ্ছে হয়। মন্মথকে যদি কারণ বলে ধরি, তবে দেখব, মন্মথ পরিমলের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নিরুপমাকে লাভ করার চেষ্টা করেছিল; কিন্তু সে অতিরক্তি চতুর বলে সরাসরি কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি: গোপনে করেছিল, সাদামাটা সাংসারিক পথে, ধূর্ত ভাবে। সে নিরুপমার মাকে বশ করতে পেরেছিল, এমনকি নিরুপমাকেও। নিরুপমার মা সংসার বুঝতেন, মেয়ের সুখশান্তি বুঝতেন, ভালবাসাবাসি তেমন বুঝতেন না। পরিমলকে তিনি যোগ্য পাত্র বলে মনে করলেন না। নিরুপমাও কেমন ভুল করেছিল। মন্মথর চাতুর্য এবং শক্ত-সামর্থ দাবি তার কাছে অনেক আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল। তা ছাড়া মায়ের দিক থেকে পরিমলকে গ্রহণ করায় বাধা ছিল প্রবল। নিরুপমার ছেলেবেলা থেকেই সবরকম অসুস্থতার ওপর ভয় ছিল, ঘৃণা ছিল। পরিমলকে তার কেমন অসুস্থ বলে মনে হত। পরিমলকে সে অনেক দিন প্রেমিক হিসেবে ভাবতে চেষ্টা করেছে, কিন্তু ভেবে পায়নি, এই প্রেম যখন ব্যবহার্য বিষয় হয়ে উঠবে, সংসারে, তখন—তখন কি হবে? শান্তি বা সুখ কী পাবে নিরুপমা? তার মনে হয়নি পরিমল তাকে গার্হস্থ্য সুখশান্তি দিতে পারবে।

পরিমলের দোষের কথা যদি ভাবি, তবে দেখব, পরিমল অনেকখানি পথ যেন অক্লেশে পেরিয়ে এসে হঠাৎ কেমন থমকে দাঁড়াল। কেন দাঁড়াল তা বলা উচিত। খুব সম্ভব, পরিমল ভালবাসার মধ্যে যেটুকু পাবার পেয়ে গিয়েছিল এবং ভালবাসার বিষাদ ও অসম্পূর্ণতার দিকে আকৃষ্ট হচ্ছিল। এক জায়গায় পরিমল ভালবাসার তাৎক্ষণিক প্রাপ্তির কথা ভাবতে বসে দেখেছে, প্রেমের কোনো স্থায়িত্ব নেই, আজ যেমন আছে চিরকাল তেমন থাকবে না। ভালবাসার মধ্যে অসম্পূর্ণতার ও বিষাদ তা এই কারণে যে, অন্য সকল অজড় সৌন্দর্যের মতন তার ক্ষয় আছে, পরিবর্তন আছে। …পরিমল বোধহয় অক্ষয় প্রেম, অপরিবর্তনীয় প্রেম কামনা করছিল, যা এ-সংসারে অসম্ভব।

নিরুপমার দোষ এই, যে সাধারণ মেয়ে। নিতান্ত সাধারণ চোখে সে প্রেম এবং ঘর-সংসার সুখ দেখতে চেয়েছে। পরিমলকে গ্রহণ করতে সে দ্বিধা করেছিল। এই দ্বিধার অনেকটা মন্মথ মারফত এসেছে, বাকিটা নিরুপমার সাধারণ ইচ্ছার জন্য এসেছে।

‘নরক হইতে যাত্রা’, বসুধার নিজের গল্প। নিরুর প্রেম শেষাবধি তাকে শান্তি দেয়নি। এমনকি নিরুকে সত্যিই তার কোনো এক বন্ধু বিয়ে করে নিয়েছিল। প্রেমের এই ব্যর্থতা আমরা যেভারে গ্রহণ করতাম, বসুধা সেভাবে গ্রহণ করেনি। সে বলত, আমাদের প্রেমের ধারণা খুব ছোট, শুধু একটিমাত্র মানুষকে অবলম্বন করে; সে ছেড়ে গেলে মরে যাই, ছটফট করি, কাতর হই। কেন এমন হবে? কেন?

‘কেন’-র ভূত কোনোদিন ওর ঘাড় থেকে নামেনি। বলতে নেই, বসুধা আমাদের এই ছোটখাটো ভালবাসাকেই পছন্দ করেনি। এই ভালবাসাকে সে শেষপর্যন্ত বাতিল করেছে। সে দেখেছে আমাদের এই সংসারের শত রকম গ্লানি তুচ্ছতা ধূর্ততা, প্রাপ্তির ইচ্ছা আমাদের আত্মিক দীনতাকে ক্রমশই দীন করে তুলেছে। তার ধারণা—আমরা নিজেদের দীনতার জন্য নরকবাসী জীব হয়ে আছি। এই নরক থেকে উদ্ধার পাবার চেষ্টাই তার ‘নরক হইতে যাত্রা’। ব্যক্তিগত প্রেম ও প্রাপ্তি থেকে সম্ভবত সে কোথাও চলে যাবার চেষ্টা করেছিল।

কলকাতা ছেড়ে বসুধা যে বছর চলে গেল, সে বছর আমি বিয়ে করেছি। আমার স্ত্রী বসুধার লেখার খুব অনুরাগী ছিল কিনা জানি না তবে তাকে চিনত। বসুধাকে আমি বিয়ের সময় থাকতে বলেছিলাম, সে থাকেনি। তার মাস কয় মাত্র আগে আমরা তার বই ছেপেছিলাম।

বসুধার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ যোগাযোগ আর ঘটেনি। বছরে এক-আধবার তার চিঠি পেয়েছি। ভুবনও আমার মতন কদাচিৎ একটা-দুটো চিঠি পেত। আমরা বসুধার চিঠি থেকে বুঝতে পারতাম সে বাউণ্ডুলে হয়ে গেছে। তারপর দেখলাম সে খুব ঈশ্বরবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। আর একেবারে শেষে জানলাম, সে ঈশ্বর বিসর্জন দিয়ে সেবব্ৰতী হয়ে উঠেছে।

বসুধার শেষ দুটি লেখা সম্পর্কে আমার কিছু বক্তব্য নেই। আমি নরকবাসী জীব। নরক থেকে যাত্রা শুরু করে বসুধা যেসব পথে যাবার চেষ্টা করেছে তার খোঁজ আমি রাখি না। হয়তো তার চতুর্থ গল্প ‘ঈশ্বর’ এবং পঞ্চম গল্প ‘আশ্রয়’ তার জীবনের শেষ কয়েক বছরের ইতিবৃত্ত জানাতে পারবে। এই দুটি লেখাই ভুবন কাশী থেকে ফেরার সময় সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোকের মেয়ের কাছ থেকে সংগ্রহ করে এনেছিল। লেখা দুটির পাণ্ডুলিপি থেকে বেশ বোঝা যায়, দুটি লেখাই অসম্পূর্ণ, অসমাপ্ত; পড়ার পর পাঠকও তা অনুভব করতে পারবেন।

‘ঈশ্বর’ গল্পটি স্বাভাবিক ধাঁচে লেখা গল্প নয়। আমরা এটিকে প্রতীকী গল্প বলতে পারি। পড়তে বসলে অসাধারণ এক সারল্যের স্বাদ পাব। শেষাবধি অবশ্য কিসের যেন অভাব বোধ করি। গল্পের শুরুতেই অস্বাভাবিকতা লক্ষ করা যাবে। একটি পথযাত্রী কোনো দুর্যোগের সময় অন্ধকারে এক মন্দিরে এসে আশ্রয় নিয়েছে। সেখানে এক সন্ন্যাসীর সঙ্গে তার অন্ধকারেই সাক্ষাৎ ঘটল। কথাবার্তার মধ্যে এক সময় সন্ন্যাসী বললেন, তাঁর ঝুলিতে একটা প্রদীপ আছে, অলৌকিক প্রদীপ, তাকে যে কোনো সময় যে কোনো দুর্যোগে জ্বালিয়ে নিয়ে পথ চলা যায়। যাত্রী বলল, ‘তবে আপনি কেন সে-প্রদীপ না জ্বালিয়ে এই অন্ধকারে বসে আছেন? সন্ন্যাসী বললেন, ‘আমার কাছে তিনটি প্রদীপ, তার একটি আসল, দুটি নকল। আমি আসল, নকল ভেদাভেদ করতে পারছি না অন্ধকারে।’

শুনে যাত্রীর আকাঙক্ষা হল, আহা, যদি তার হাতে প্রদীপগুলি থাকত, বড় ভাল হত। সন্ন্যাসী যেন এই আকাঙক্ষা বুঝতে পারলেন তার। বললেন, ‘তুমি যদি পার, আসলটি খুজে নাও।’…যাত্রী প্রদীপগুলি তার হাতে দিতে বলল। সন্ন্যাসী দিলেন। অন্ধকারে যাত্রীর কাছে তিনটি প্রদীপ একই রকম মনে হল, সে ভেদাভেদ করতে পারল না…সন্ন্যাসী বললেন, ‘পারলে না?’ যাত্রী বলল, ‘না।’ সন্ন্যাসী তখন প্রদীপ তিনটি ফেরত নিয়ে বললেন, ‘এর একটি নিশ্চয় জ্বলবে। যে জ্বালাতে জানে তার হাতে জ্বলবে। সে নিজের গুণে জ্বালিয়ে রাখতে পারবে।’

গল্পটি এখানে শেষ হয়েছে। কিন্তু পাণ্ডুলিপি দেখে বোঝা যায়, বসুধা আরও কিছু লিখতে চেষ্টা করেছিল অনেকবার, পারেনি। সম্ভবত সে এই হেঁয়ালির কোনো অর্থ বোঝাবার চেষ্টা করেছিল, বিফল হয়েছে।

শেষের গল্পটির নাম ‘আশ্রয়’। কাশী শহর নিয়ে লেখা গল্প। গল্পের শুরু আছে শেষ নেই। বসুধা উত্তমপুরুষে গল্পটি লিখতে শুরু করেছিল। শীতের দিকে কাশীর গ্রামঞ্চলে মড়ক বাধে প্রতি বছর। সেবারে ভীষণ মড়ক বেধেছিল, লোকজন পালাচ্ছিল, সরকারী লোকজনও গ্রামে যাচ্ছিল না, গঙ্গার ঘাটে অবিরাম চিতা জ্বলছিল। গল্পের নায়ক একদিন অতি প্রত্যুষে গঙ্গাস্নান সেরে বাড়ি আসার পথে অনুভব করল, গ্ৰামন্তর থেকে কে যেন তাকে ডাকছে, সম্ভবত সেই গ্রাম্য বন্ধুটি, যে তাকে গ্রাম্য সুরে দোঁহা গেয়ে শোনাত।

…বসুধা যেন সেই দোঁহার সুর শুনতে পেল: আমরা বড় দুঃখী, বড় চঞ্চল, গাছের যেমন শেকড় আছে আমাদের তেমন শেকড় নেই; আমরা এক জায়গায় থাকতে পারি না।

বসুধা আর বাড়ি ফিরল না, গ্রামান্তরের দিকে—যেদিকে মড়ক—সেদিকে চলে গেল।

গল্পটি ওই পর্যন্ত লেখা; পরে আর লেখা হয়নি। ভুবন বলে, গল্পটি লেখার পরের দিন বসুধা কোথায় চলে গিয়েছিল, সেই কাশীর বৃদ্ধ বা তার মেয়ে জানে না।

ছোটনাগপুরের এক অখ্যাত জায়গায় মিশনের এক হাসপাতালে বসুধা মারা যায়। আমরা তার মৃত্যু-সংবাদ জেনেছি অনেকদিন পরে। হাসপাতালে সে কিছু লিখেছিল বলে মনে হয় না। তার লেখার প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছিল।

বসুধার সমস্ত লেখার বিচার আমি বন্ধু হিসেবে করেছি, হয়তো অন্যায় করেছি, কিন্তু আমার পক্ষে সেইটাই স্বাভাবিক। পাঠক আমায় মার্জনা করবেন।

এই বইয়ের গোড়ায় একটি উৎসর্গপত্র আছে। প্রথম বারেও ছিল। বলা বাহুল্য, সেই উৎসর্গপত্রে যে নিরুপমা রায়-এর নাম উল্লেখ আছে তিনি আমার স্ত্রী নন, ইনি বসুধার সেই নিরুপমা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *