সুধাময়

সুধাময়

আমার বন্ধু সুধাময় আমায় শেষ চিঠি দিয়েছিল মাস পাঁচেক আগে। তখন ওর মন খুব অস্থির ; নিজের সঙ্গে অদ্ভুত রকমের এক বোঝাপড়া করবার চেষ্টা করছিল। আমি তা জানতাম। চিঠিতেও খাপছাড়াভাবে সে-সব কথা কিছু কিছু ছিল। কিন্তু এমন কোনো কথা ছিল না, যা থেকে মনে করা সম্ভব, মিহিরপুর টি বি স্যানেটোরিয়াম ছেড়ে সুধাময় হঠাৎ উধাও হয়ে যাবে।

ওর শেষ চিঠির জবাব দিয়ে আমি মাসখানেক পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলাম। সচরাচর দিন পনেরো অপেক্ষা করলেই ফিরতি জবাব আসত। উত্তর পাই নি। উদ্বিগ্ন হয়ে আবার চিঠি দিয়েছি, অপেক্ষা করেছি। তারপর আবার শেষে টেলিগ্রাম। ডাক্তার মুখার্জির চিঠি থেকে শেষে জানতে পারি, সুধাময় মিহিরপুর টি বি স্যানেটোরিয়াম ছেড়ে চলে গেছে। কোথায় গেছে, ফিরবে কি ফিরবে না—কেউ জানে না।

পাঁচ মাস পরে কাল সুধাময়ের দু-ছত্রের এক চিঠি পেলাম। ঠিকানা নেই কোনো। কোথায় আছে তাও লেখে নি। পোস্ট অফিসের সিলের ছাপ থেকেও স্পষ্ট কিছু বোঝবার উপায় নেই। রেলের মেল-সার্ভিসে ফেলা চিঠি। খুব সম্ভব দিন তিনেক আগে নাগপুরে এই চিঠি ফেলা হয়েছে।

সুধাময় লিখেছে : তোমার লেখা একটা গল্প হঠাৎ চোখে পড়ে গেল। ওয়েটিংরুমে বসে মাঝরাত্রে সেই লেখা পড়লাম। মালা-বদলের রূপকথা কি প্রেম ? না চোখে বান ডাকলেই প্রেম হয় ? প্রেম কি তুমি জান না বা সঠিকভাবে বোঝে না। তবু, কেন লেখ ? প্রেমের উপলব্ধি যদি কোনো দিন হয় তোমার, তবে লিখো, নচেৎ নয়। আশা করছি, তোমার সর্বাঙ্গীণ কুশল । ইতি সুধাময় ।

সুধাময়ের চিঠি অপ্রত্যাশিত। এবং বলা বাহুল্য, নাটকীয়। আমার পক্ষে ক্ষুব্ধ হওয়াই স্বাভাবিক। হয়ত আমি আহত হয়েছি। তবু, একটু যে খুশি বা নিশ্চিন্ত না হয়েছি এমন নয়। সুধাময় বেঁচে আছে—আমাকে মনে রেখেছে—এটুকু জানাও কিছু কম নয়।

কিন্তু সুধাময়কেও একটা বিষয় আমার জানানো দরকার। তার ঠিকানা জানলে কাজটা চিঠি দিয়ে সারতে পারতাম। গর-ঠিকানার সেই বন্ধুর জন্যে আমায় আর একটা গল্পই লিখতে হচ্ছে। তার চোখে পড়বে এ-আশা আমার অল্প। তবু, বলা যায় না, যে-নাটক নাগপুরের কাছাকাছি কোনো রেল স্টেশনের ওয়েটিংরুমে মাঝরাত্রে একবার ঘটেছে—হয়ত আবার কোনো এক সকালে বা দুপুরে মন্থরগতি কোনো ট্রেনের কামরায় সেই নাট্যদৃশ্যের পুনরাভিনয় হতে পারে। চোখে পড়লে, আমি জানি, সুধাময় আমার লেখা পড়বে, সমস্ত মন দিয়ে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। কিংবা এমন যদি কখনও হয়—আপনাদের কেউ যদি এ-গল্প পড়েন, অন্তত ভাসা-ভাসাভাবেও মনে থাকে এই গল্প, এবং কোনো মানুষের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়—যার নাম সুধাময়, প্রায় চল্লিশ বয়স, টকটকে ফরসা, একটু রোগা চেহারা, ভীষণ ধারালো নাক, মেয়েদের মতন টলটলে গভীর চোখ, অথচ নিবিড় দৃষ্টি, জোড়া ভুরু, চোখে পুরু কাচের চশমা, কপালের ডান পাশে একটা বড় মতন আঁচিল—অনেক চুল মাথায় আর মুখে সব সময় শান্ত হাসি লেগে আছে—না, একটু ভুল হল, এক সময় এই হাসি অবশ্য লেগে থাকত, এখন হয়ত তা নিভে গেছে— হ্যাঁ, এ-রকম কাউকে দেখতে পেলে সময়মতন একবার জিজ্ঞেস করে দেখবেন, তার নাম কি সুধাময় বিশ্বাস, মিহিরপুর টি বি স্যানেটেরিয়ামে থাকত ?

আমার বন্ধু সুধাময় তার পরিচয় গোপন রাখবে না। আমি জানি। মিথ্যে কথা সে বলে না, কপটতা অপছন্দ করে। তা ছাড়া এমন কোনো কারণ নেই, নিজের নাম কিংবা পরিচয়ের মতন তুচ্ছ একটা ব্যাপারের জন্য সে রহস্যের আশ্রয় নেবে। “আপনার কথা আমি শুনেছি।” সুধাময়কে বিস্মিত করে আপনি বলতে পারেন তখন, “আপনার বন্ধুর কাছ থেকে। তিনি একটা গল্প লিখেছিলেন আপনাকে নিয়ে। গল্পটা কিছু নয়, কিন্তু আপনি মশাই ভীষণ ইন্টারেস্টিং ক্যারেকটার। আপনি নাকি জীবনে…। দেখছেন প্রথমেই একেবারে জীবনে চলে যাচ্ছি আপনার। না, সেটা উচিত নয়। তার আগে মোটামুটি আপনার পরিচয় যা পেয়েছি তা বলা দরকার। কে জানে, আপনার লেখক বন্ধু কতটা রঙ চড়িয়েছে বা আলকাতরা মাখিয়েছে গায়ে। তেমন হলে সবটাই বাজে, মনগড়া ব্যাপার ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।”

“যতদূর মনে পড়ছে আপনি, সুধাময়বাবু, খুব সুন্দর এক দিনে জন্মেছিলেন। কোজাগরী পূর্ণিমায়। বাংলা দেশের কোজাগরী পূর্ণিমা যে কী আমার পক্ষে তা বর্ণনা দিয়ে বলা অসম্ভব। আপনাদের দেশের বাড়ির গা ছুঁয়ে নদী বয়ে গিয়েছিল। এ-পাশে তিনমহলা বাড়ি ; ও-পাশে ধু-ধু চর আর সবুজ গাছপালা। কোজাগরী পূর্ণিমার রাত্রে, সেই ফিনকি-ছোটা জ্যোৎস্নায় নদীর জল যখন রুপোর পাতের মতন ঝকঝক করছে, কলকল একটা শব্দ উঠে বাতাসে মিশ খেয়ে গেছে, ঝিঁঝিঁ ডাকছে, জোনাকি উড়ছে, কেমন এক আশ্চর্য গন্ধ, চর আর বুনো লতাপাতা ফুটফুটে আলোয় ঘুমিয়ে পড়ে স্বপ্নের ঘোরে ফিসফিস করে উঠছে-—বিশ্ব-চরাচর শান্ত, স্তব্ধ, সমাহিত—তখন দোতলার পুব-দক্ষিণের সবচেয়ে বড় ঘরটিতে কচি গলার একটা কান্না ককিয়ে উঠল। নদীর দিকের খোলা জানলা দিয়ে কোজাগরীর বাঁধ-ভাঙা আলো চামর দোলাচ্ছে ঘরে ; উত্তরের দিকে ‘জন্মসুখী’ প্রদীপ। আপনার মার গায়ে তখনও লক্ষ্মীপুজোর শাড়ি। কোরা গন্ধ উঠছে।

আপনার পিসি ছুটতে ছুটতে গিয়ে তার ভাইকে বলল, দাদা—খোকা হয়েছে ।

আপনার বাবা তখন তেতলার শোবার ঘরের সামনে নদীর-দিকে-মুখ-করা টানা বারান্দায় একা চুপচাপ বসে। সুন্দর, শান্ত, স্তব্ধ এক বিশ্বের লীলা দেখছিলেন তন্ময় হয়ে।

“তোর বৌদি ভাল আছে?”

“হ্যাঁ।”

“খোকা ?”

“বলো না ; পেট থেকে পড়তে না পড়তেই কী কান্না ! গলা চিরে ফেলল।” আপনার পিসি শুভসংবাদের ফুলঝুরিটি জ্বালিয়ে দিয়ে ধড়ফড় করে ফিরে যাচ্ছিল।

“শোন, সুবর্ণ— !” আপনার বাবা ডাকলেন পিসিকে, হাত দিয়ে জ্যোৎস্না-আকুল নদী চর বন আকাশ দেখিয়ে দিয়ে বললেন, “এরই কোথাও থেকে ও এসেছে কি না—তাই বড় লেগেছে। অত কান্না। ভাবছে বুঝি অত আনন্দ অত সুধা থেকে কেউ ওকে কেড়ে নিয়ে এসেছে। বড় হলে বুঝতে পারবে এ-সবের সঙ্গেই সে আছে। তখন আর কাঁদবে না।”

আপনার উনিশ বছরের পিসি তার দাদার এত তত্ত্বকথা বুঝল না। বোঝার গরজও ছিল না তার। চলেই যাচ্ছিল আবার, আপনার বাবা বললেন, “সুবর্ণ তোর ভাইপোর নাম থাক সুধাময়।”

“বা! বেশ নাম ; কী সুন্দর নাম হয়েছে দাদা।” পিসি যেন নামটা আঁতুড়ঘরের দরজায় পৌঁছে দিতে ছুটে চলল।

জন্ম থেকেই আপনি সুধাময়।

মা বাড়িতে আদর করে কখনো কখনো ডাকত, লক্ষ্মী, লক্ষ্মীকান্ত। নামটা আপনার পছন্দ ছিল না, বাবারও নয়, পিসির তবু বা একটু ছিল। ঠাকুরঘরে লক্ষ্মীর যে পট ছিল, তাতে লক্ষ্মীর চেহারাটা ছিল বামুন দিদিমণির মতন। তেমনি মোটাসোটা, ভারিক্কি । পানের বাটা আর ভাঁড়ারের চাবির গোছা সব সময় হাতের কাছে রেখে সে বসে থাকত। এই বামুন দিদিমণিকে আপনার ছেলেবেলা থেকেই তেমন পছন্দ হত না।পটের লক্ষ্মীর সঙ্গে দিদিমণির চেহারার মিল যদিও বা ভুলতে পারতেন, কিন্তু পায়ের তলার বিরাট প্যাঁচাটি কিছুতেই সহ্য হত না।

“প্যাঁচায় চড়ে লক্ষ্মীঠাকুর কেন ঘুরে বেড়ায়, মা ?” আপনি শুধোতেন মাকে।

মা বলত, “ওমা ও যে বাহন-রে?”

বাহন কি কে জানে! তবে এই বাহনটি যে বিশ্রী তাতে আর কথা ছিল না। অথচ কি আশ্চর্য দেখুন, এক বোনকে ভীষণ অপছন্দ হলেও অন্য বোনকে আপনার খুব ভাল লেগে গিয়েছিল। সরস্বতী। সরস্বতী ধবধবে সাদা, সুন্দর ; পায়ের তলায় কী চমৎকার হাঁস, পদ্মফুল ; হাতে বই, বীণা।

‘সরস্বতীকে বিয়ে করব’ বলে একদিন কী ভীষণ আব্দার যে জুড়েছিলেন আপনি সে-কথা আপনার মা কিংবা বাবা বোধহয় শেষ বয়সেও ভুলতে পারেন নি।

“তোমার ছেলের পয়সাকড়ির ওপর টান থাকবে না, দেখছ তো পুণ্য। আমার মতনই হবে শেষ পর্যন্ত।” আপনার বাবা বলতেন।

“তাতে আর ভালটা কি হবে ; এই সর্বস্বই তো যাবে।” মা জবাব দিতেন। “সব বিলিয়ে টিলিয়ে বৈরাগী হয়ে ঘুরে বেড়াবে।”

“তা কেন, আমি কি বৈরাগী হয়েছি ?”

“কমটাই বা কি ! নেহাত শ্বশুরঠাকুর থাকতে বিয়ে দিয়েছিলেন তাই। নয়ত বিয়েটাও কি করতে নাকি।” আপনার মা, পুণ্যময়ী বলতেন ঈষৎ যেন ক্ষুদ্ধ হয়ে। তারপর ভবিষ্যতের ভাবনা তুলে দিতেন কথার কটা টুকরো দিয়ে। “যে-বয়সে ছেলে হল সেটা এমন কোনো কচি বয়েস নয় আমাদের। খানিকটা মানুষ করে যেতে না পারলে কি যে হবে বুঝতে পারছ তো!”

“মানুষই তো করছি। দেখছ না, রোজ দু-বেলা পড়াই ওকে।”

“দেখছি। পাঁচ বছরের ছেলে—সকাল-সন্ধে ছাদে দাঁড়িয়ে বাপের সঙ্গে জোড় করে গান গেয়ে প্রার্থনা করছে, তোমার অপার আকাশের তলে বিজনে বিরলে হে, নম্র হৃদয়ে নয়নের জলে দাঁড়াবো তোমারি সম্মুখে।” পুণ্যময়ী একটু হাসেন।

“এর চেয়ে তোমার লক্ষ্মীর পাঁচালী বা সত্যনারায়ণের ছড়া শেখালে কোন ভাল শিক্ষা হত ?” আপনার বাবা শুধোন স্মিত হাসি হেসে।

“জানি না। ঠাকুর-দেবতায় অন্তত ভক্তি হত। ”

“ভক্তি শিখতে হয় না, ওটা এমনিতেই আসে, সংস্কারের সঙ্গে। এই যে আমায় তুমি অত ভক্তি করো, এ কি কেউ শিখিয়েছিল?” আপনার বাবা একটু হাসি-হাসি মুখ করে মায়ের দিকে চেয়ে থাকেন : তারপর বলেন, “ভক্তিতে দরকার নেই ; ও ভালকে ভালবাসতে শিখুক। ওটা শিখতে হয়।”

“আমাকেও শিখতে হবে নাকি?” পুণ্যময়ী হাসেন, আড়চোখে স্বামীকে লক্ষ করে।

বাবাও হেসে ফেলেন।

আপনাকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে মা বলেন, “তোর বাবা কাকে বেশি ভালবাসতে শেখাচ্ছে রে সুধা ; আমাকে, না তোর বাবা নিজেকেই ?”

“তোমাকে। পিসিকেও আমি অনেক ভালবাসি। টুনটুনিকেও।” টুনটুনি বেড়াল ছানা।

পুণ্যময়ী হাসতে গিয়েও হাসতে পারেন না। চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে।

আপনার ছেলেবেলার কথা আরও যেন কি আছে সুধাময়বাবু। হরি বাউল, মধু মাস্টার, অমৃত পণ্ডিত…সব আমার মনে পড়ছে না। মোটামুটি এই বাল্যশিক্ষাটা হয়েছে বাড়িতে। মনের বাইরের দিকটা তৈরি করেছিলেন বাবা, ভেতরটা মা। একজনের শিক্ষায় কৌতূহল এবং বিস্ময় দিন-দিন বাড়ছিল ; অন্য জনের প্রভাবে এমন একটা নরম স্বভাব গড়ে উঠছিল যা পুরুষ-চরিত্রে অল্পই দেখা যায়। বাবা আপনাকে এক ধরনের সুন্দর নিঃসঙ্গতা শিখিয়েছিলেন—মা আত্মমগ্ন মাধুর্য। এখানে বড় একটা বিরোধ ছিল না। বরং বলা যায়, আপনি যদি সেতু হন, তবে এঁরা ছিলেন দু দিকের দুই ভূমি। সব মিলিয়ে একটা সম্পূর্ণতা।

বিরোধ ঘটল অন্য জায়গায়। মা চাইতেন, ছেলে তাঁর রক্তমাংসের মানুষ হোক, সংসারের আর পাঁচজনের মতন—তবে মাথায় উঁচু। ডাক্তার হতে চায় তো তাই হোক, জজ ম্যাজিস্ট্রেট হতে চায় তো তাই হোক; বিয়ে-থা ঘর-সংসার করুক। কিন্তু এ কি সৃষ্টিছাড়া কাণ্ড করছে সুধা ? আজ কলকাতায় পড়তে গেল তো কাল ছেড়েছুড়ে চলে গেল বেনারস। বেনারসে মাস তিনেক কাটতে-না-কাটতে আবার কলকাতা।

“একটা কিছু তো তাকে করতে হবে।” মা বলেন অনুযোগের গলায় স্বামীকে।

“না করলেই বা কি! আমাদের যা আছে তাতে ওর একার জীবন বেশ কেটে যাবে।”

বাবা জবাব দেন।

“জীবন কাটাটাই কি বড় কথা ?”

“কখনই নয়। তবে জজ ব্যারিস্টার হওয়াটাও হাতে স্বর্গ পাওয়া নয়।”

“সুধা ছন্নছাড়া হয়ে থাক, এই কি তুমি চাও ?”

“সুধা সুধার মতন হোক এইটুকু শুধু আমি চাই। সে বড় হয়েছে। আমার মর্জিমতে, আমার ভালমন্দ বোঝার ওপর তাকে আমি চালাতে চাই না। সে হবে জবরদস্তি। পিতৃত্বের ছোট বেড়া থেকে তাকে মুক্তি দিয়েছি, পুণ্য। আমাদের সম্পর্ক রাজা প্রজার নয়। আমি আধিপত্য করব না, তার ফসলের ভাগ চাইব না।”

পুণ্যময়ী স্বামীর এই মুক্তিতত্ত্ব বুঝতেন না। কিছুতেই মাথায় ঢুকত না।

এই সময় ছেলেকে একটা দীর্ঘ চিঠি লিখলেন পুণ্যময়ী। তাতে অনেক কথা ; নানা উপদেশ অনুরোধ। শেষে নিজের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথাও থাকল : সুধা, তুমি আমাদের একমাত্র সন্তান। তোমার পিতৃপুরুষের ভিটেয় সন্ধেপ্রদীপ দিতে তোমার পর আরও একজনের যে থাকা দরকার। সব দিক বিবেচনা করা কি তোমার কর্তব্য নয় ? বাবা সুধা, আত্ম-সুখী হয়ো না, তাতে কষ্টই পাবে।

পুণ্যময়ীর চিঠির জবাব দিল সুধাময় তিন গুণ দীর্ঘ করে। তাতে অদ্ভুত অদ্ভুত সব কথা। স্বামীর নানারকম হেঁয়ালি যেমন পুণ্যময়ীর দুর্বোধ্য লাগত এবং সে-সব তত্ত্বকথার সঙ্গে সংসারের কোনো কিছুকে খাপ খাওয়ানো অসম্ভব ছিল, সুধাময়ের চিঠিরও প্রায় নিরানব্বইটা কথা কিছুই বুঝতে পারলেন না তিনি। সুধা এম. এ. পরীক্ষা দিচ্ছে না এই খবরটা ছাড়া বাকি যা বুঝলেন তাতে পুণ্যময়ী নিঃসন্দেহ হলেন, সুধা বিয়ে করবে না।

“আমি নিজেকে জানবার চেষ্টা করছি, মা, আমার মনে শান্তি নেই। কী ভীষণ অতৃপ্তি যে! আমার সুখ কিসে, কেমন করে তা পাব, কে জানে। বাবার কাছে শিখেছি, যা ভাল তাকে ভালবাসতে পারলে আনন্দ। আমার মনে আনন্দ কই! কত ভাল জিনিস দেখছি, ভালও লাগছে, কিন্তু কই তেমন আনন্দ তো হয় না। আমি পারছি না…ভালবাসতে পারছি না। …তুমি বুঝতে পারবে কি মা, আমি কত নিঃসঙ্গ আর একা-একা রয়েছি। আমায় এখন একাই থাকতে হবে । …”

চিঠি থেকে বোঝা গেল ছেলে পাগল হয়েছে। তার বাবার চেয়ে বেশি। উনি তবু সংসার বাদ দেন নি, ছেলে সবকিছুই বাতিল করছে।

ছেলের চিঠি স্বামীর সামনে ফেলে দিয়ে পুণ্যময়ী বললেন, “সুধাকে একবার এখানে আসতে লেখ ; অনেকদিন দেখি নি।”

সুধাময়কে বাড়ি আসতে লেখা হল। তখন প্রচণ্ড বর্ষা। নদীর জল তট ছাপিয়ে অনেকখানি উঠেছে। দেশের বাড়ির ভিত অনেক আগেই জলে ডুবেছে। তার ওপর চার দিন ধরে সমানে একটানা বৃষ্টি। জল বেড়েই চলেছে। নদীর-দিকে-মুখ-করা লম্বা টানা বারান্দার উত্তর কোণের খানিকটা কেমন করে যেন ধসে গেল। সেই সঙ্গে বাবাও। ঘোলা জলের তোড়ের সঙ্গে ভাসা দেহটা অনেকখানি চলে গিয়েছিল। গিয়ে আটকে ছিল জামরুল গাছের গায়ে।

সুধাময় বাড়ি এসে পৌঁছল যখন, বাবার দেহটা ততক্ষণে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সমস্ত বাড়িতে যেন সেই ছাই উড়ছিল। বাবার সেই বসার ঘরটা কী অদ্ভুত ফাঁকা, আলমারির বইগুলো যেন বাবার সঙ্গে শেষ কথা বলে চিরকালের মতন চুপ করে গেছে, শোবার বিছানাটি পর্যন্ত নিঃসঙ্গ করুণ !

সুধাময় অনুভব করতে পারছিল, কোন্ জিনিস তার খাওয়া গেল, কিন্তু বলতে পারছিল না। এ-সংসারে তার সবচেয়ে নিকট বন্ধু, একান্ত শ্রদ্ধার মানুষ এবং সেই মহৎ শিক্ষকটিকে সুধাময় হারিয়েছে—যাঁকে কোনোদিন হারাতে হবে এ যেন তার চিন্তায় আসে নি। নিজেকে ভীষণ অসহায়, সম্বলহীন মনে হচ্ছিল সুধাময়ের। অদ্ভুত রকম শূন্য, নিঃসঙ্গ।

“আমরা যে-জগতে বাস করি সে-জগতে অনিত্যতার একটি নিষ্ঠুর নিয়ম আছে। আমি তা উপলব্ধি করতে পেরেছি। যে-ঘরে আমরা রাত কাটাতে এসেছি, যদি সে-ঘরের দীপশিখা সব সময় বাতাসে কাঁপে, নিভু নিভু হয়—তবে আর আশ্বাস কোথায় ? যে-কোনো সময় অন্ধকার আসতে পারে। এই অনিশ্চয়তার মধ্যে যে ক’ মুহূর্ত আছি—আমরা কি মানুষের মতন বাঁচতে পারি ? না ভাই, পরিমল—তা সম্ভব নয়। আমরা হুড়োহুড়ি করে, দাপাদাপি করে সুখ অর্থ সম্মান ঘর বাড়ি আধিপত্য যা পাই যতটা পারি লুঠে নিতে চাইছি। কী শোচনীয় অবস্থা! মর্মান্তিক স্থিতি।’ সুধাময় দেশের বাড়ি থেকে কলকাতার বন্ধু পরিমলকে এক চিঠিতে লিখল।

জবাবে বন্ধু লিখেছিল : ‘ভাই সুধা, দিনে দিনে তুমি বড়ই দার্শনিক হয়ে উঠছ। আমি জানি, তোমার মনের ছাঁচই অমন। তবু একটা কথা তোমার বোঝা দরকার ছটফট করার চেয়ে শান্ত হয়ে সবদিক ভেবে দেখা ভাল। আমি যতদূর জানি, তুমি মনের শান্তি, নিরুদ্বিগ্ন স্থৈর্যের পথচারী। যারা এত বিচলিত-হৃদয় তারা কি গভীরতম কোনো সত্যে গিয়ে পৌঁছতে পারে ? অত হতাশ হয়ো না, চঞ্চল হয়ো না—নিজেরই ক্ষতি হবে।

দীর্ঘ দু বছর সুধাময় দেশের বাড়ি ছেড়ে নড়ল না। পুণ্যময়ীর অবস্থা কল্পনাও করা যায় না। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি যেন একপাশের ডানাকাটা এক অসহায় পাখির মতন পড়েছিলেন। করুণ, শোকাবহ, হৃতশক্তি। হয়ত এতোটা হত না যদি তাঁর অন্য ডানাটিও সবল থাকত। কিন্তু সুধাময় তাকেও আড়ষ্ট, অনড় করে রেখেছে। পুণ্যময়ীর বার বার মনে হত, স্বামীর মৃত্যু ঠিক স্বাভাবিক নয়। যেন নিজের এবং স্ত্রী এবং সন্তানের মধ্যে যে বিচ্ছেদ ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল, সম্ভবত সেই বিচ্ছেদের দায়ভাগ থেকে সরে দাঁড়াবার জন্যে তিনি ওই জলের মধ্যে সরে দাঁড়ালেন। স্বামী তাঁর মৃত্যুবিলাসী ছিলেন না, পুণ্যময়ী জানতেন, কিন্তু যে বিশ্বচরাচরকে তিনি ঈশ্বর বলে গ্রহণ করেছিলেন—হয়ত সেই অখণ্ড জীবনস্রোতের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দেওয়াকে তিনি মৃত্যু বলে ভাবেন নি।

পুণ্যময়ী দেখতেন, সুধার নিঃসঙ্গতা কী গভীর। ওর কাছে এই সংসার যেন ইট-কাঠ ছাড়া কিছু নয়। ও অস্থির, ও চঞ্চল ; ওর চোখে অনবরত শুধু প্রশ্ন আর ব্যাকুলতা। বই আর কাগজ কলম থেকে তার মাথা যখন ওঠে—তখন মনে হয় একটা ক্লান্ত অসুস্থ শিশু ঘুমের ঘোরে হঠাৎ উঠে বসেছে, চোখ তুলে তাকিয়ে কাকে যেন খুঁজছে।

এই সময় সুধাময়ের একটা রোগ দেখা দিল। থাকে থাকে, হঠাৎ ছুটে আসে। পুণ্যময়ীর কাছে। মুখে ভীষণ এক উদ্বেগ আর ভয়। “মা, দেখ তো আমার জ্বর এসেছে কি না। মাথায় বড় যন্ত্রণা হচ্ছে।”

পুণ্যময়ী তাড়াতাড়ি গা কপাল দেখেন ছেলের গায়ে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে। পরীক্ষকের হাত নয় তা সান্ত্বনার হাত। কী অপূর্ব কোমলতা মাখানো। “জ্বর কই গা বেশ ঠাণ্ডা ! তোর এই জ্বর জ্বর ছাড় তো ! শরীর যে ভেঙে যাচ্ছে এমনি করে।”

“উঁহু, কী একটা হয়েছে মা।” সুধাময়ের মুখে দুশ্চিন্তা, গলার স্বরে এক ধরনের হতাশা, “শরীরটা সেইজন্যেই খারাপ হয়েছে। রাত্রে ঘুমুতে পর্যন্ত পারি না ভাল করে।”

“সারাদিন ঘাড় গুঁজে বসে থাকবি, না হয় হাঁ করে আকাশের দিকে চেয়ে থাকবি—এতে কি আর ঘুম হয় ?”

পুণ্যময়ীর কথা যেন কানেই তোলে না সুধাময়। বলে, “ঘাড়ে চোখে সব সময় ব্যথা, মাথার মধ্যে যেন কিছু নেই বলে মনে হয়—ফাঁকা। আমার কি ব্রেন প্যারালিসিস হবে মা ?”

“কি বলিস তুই— ?” পুণ্যময়ী ভয় পেয়ে যান যেন।

প্রায় সাত আট মাস একটানা সুধাময় মৃত্যু ভয় ভোগ করল। চোখ আর মাথা মাথা করে যেত। প্রতিদিন বিছানায় শুতে গিয়ে ভাবত এই ঘুমই হয়ত শেষ। এমন সময় পুণ্যময়ী অসুখে পড়লেন। সুখ তাঁর কি-ই বা ছিল ! তবু, শরীরটা বিছানা নেয় নি এতদিন। আসলে, অনেক আগেই তাঁর শয্যা নেওয়া উচিত ছিল, সেই তখন থেকে, যখন সকালে আর বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করত না, উঠলে মনে হত কী এ অবসাদ, কী ক্লান্তি, গায়ে ঘাম-গন্ধ —সারা রাত যেন ঘেমেছেন, দুপুর থেকে চোখ জ্বালা মাথা টিপ্-টিপ, ঘুসঘুসে জ্বরভাব, রাত্রের দিকে আস্তে আস্তে আরও তাপ আরও ঘোর । রাত্রে ঘুমের মধ্যে ঘাম হয়ে জ্বরটা যেত। অতটা বোঝেন নি পুণ্যময়ী হয়ত, কিংবা বুঝলেও নিজের জন্যে—এই তুচ্ছ জ্বরভাব আর দুর্বলতার জন্যে কাউকে উদ্ব্যস্ত উদ্বিগ্ন করতে চান নি। এই জ্বর বাড়ল। কাশি নিত্যকার হল ; বুকে ব্যথা দেখা দিল ; এবং ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরল কাশিতে। শয্যা নিতে হল তখন।

কলকাতায় যাবার আগেই বোঝা গেল, এ যক্ষ্মাব্যাধি।

সুধাময় ভয় পেল। ভীষণ ভয়। পুণ্যময়ী যেন ভয়ংকর এক আতঙ্ক। সুধাময়ের মনে হত এ-বাড়ির প্রতিটি কক্ষে যক্ষ্মার বীজাণু হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে, সর্বত্র একটা কাশির ধাক্কা-খাওয়া-বাতাস নিঃশব্দে তাকে শাসাচ্ছে। দেওয়ালে, দরজায়, চৌকাঠে, থালায়, বাসনে, খাবারে যক্ষ্মার অদৃশ নোংরা বীজাণু ওৎ পেতে আছে সুধাময়ের জন্যে। ফুটন্ত জল ছাড়া সুধাময় জল খেত না, আগুনের মতন গরম দুধ, প্রথমে ক্লোরিন তারপর পটাশপারমাঙ্গানেটের জলে তার বাসনপত্র খাবারদাবার ঘন্টাখানেক ডোবানো থাকত। তবু মনের খুঁত খুঁত যেত না সুধাময়ের। খেতে বসে হঠাৎ থালা ছেড়ে উঠে যেত, শুতে গিয়ে আচমকা মাথার বালিশ চাদর সব টান মেরে ছুঁড়ে ফেলে দিত বাইরে। “আমারও হবে—আমি বাঁচব না।” সুধাময় ঘরের মধ্যে ক্ষোভে যন্ত্রণায় ভয়ে চিৎকার করে উঠত। যেন মৃত্যু তাকে চিঠি পাঠিয়েছে আসছি বলে। আর যার আসা অবধারিত।

পুণ্যময়ীর ঘরের মধ্যে ঢুকত না সুধাময়। তার সাহস হত না ; চৌকাঠের কাছে দাঁড়াত দিনান্তে এক-আধবার, হাতে অ্যান্টিসেপটিক লোশন মাখানো রুমাল। মার সামনে মুখ চেপে থাকতে সংকোচ হত, তবু সুযোগ পেলেই মুখ চাপত। নিশ্বাস যতক্ষণ পারে বন্ধ করে রাখত, যেন মার ঘরের হাওয়ার বীজাণু না বুকে চলে যায়।

সুধাময়ের ইচ্ছে হত এবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়।

রোগের হাত থেকে শুধু নয়, মনের হাত থেকেও সুধাময় বাঁচতে চাইছিল। এ-বাড়ি তার অসহ্য লাগত, অসহ্য লাগত নিজেকেই নিজের স্বার্থপরতাকে। সুধাময় সব সময়ই ভাবত, নিজের আয়ুর ওপর তার এই মোহ পশুর মতন। দুঃখ ভোগের ভয়ে, কিংবা মৃত্যুর আশঙ্কায় তার ব্যবহার দিন দিন হীনতর হয়ে উঠছে। ইতরের মতন ; অমানুষিক। আমার আয়ু কি আমার মার চেয়ে মূল্যবান ? সুধাময় ভাবত। আর এই চিন্তা তাকে কুরে কুরে খেত যে, সাতাশ বছর ধরে যে-মার নিরঙ্কুশ স্নেহ সে একা ভোগ করেছে—; এবং অসীম ভালবাসা, আজ সেই অসহায় মুমূর্ষ বেচারি মার কাছ থেকে ছুটে পালাতে চাইছে। যেন এই মা আর মৃত্যুর মধ্যে কোনো তফাত নেই। কী সাঙ্ঘাতিক! আমি কি মানুষ ? সুধাময় বিছানায় উঠে বসে মাঝরাতে চিৎকার করে কেঁদে উঠত। ছেলেমানুষের মতন।

“আমি আমার মাকে ভালবাসতাম। আমি তাকে ভালবাসি। মা ছাড়া আমার আর কেউ নেই, আমি ছাড়া মার আর কেউ, কেউ নেই। আমাকে আমার মার পাশে নিয়ে চল, মার মাথার কাছে, কোলের পাশে।” সুধাময় আকুল হয়ে কাকে যেন বলত। বাবাকে কি !

তারপর এক সকালে পুণ্যময়ীর ঘরে গিয়ে দাঁড়াল সুধাময়। প্রথম শীতের হিম-কুয়াশা ধোয়া রোদ এসে পড়েছে পুণ্যময়ীর পায়ের কাছে।

“মা, কালই আমরা কলকাতা যাব ! এখানে আর নয়। এ-সব ডাক্তার দিয়ে কিছু হবে না।”

পুণ্যময়ীর যে যাওয়ার ক্ষমতা আর নেই সুধাময় তা বুঝল না ।

“কা—ল ? কালই যেতে হবে ?” পুণ্যময়ী যেন অদ্ভুতভাবে হাসলেন, “দেখি ।

সুধাময় মার পাশটিতে বসল

“এখানে বসলি ! ওঠ্‌ ওঠ্‌…!” পুণ্যময়ী ব্যস্ত হয়ে বললেন।

মাথা নাড়ল সুধাময়, সে উঠবে না। ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল সাতাশ বছরের দার্শনিক ছেলে। মার হাত টেনে নিল, মার পায়ে মাথা রাখল, মার গায়ে মুখ ঘষল শিশুর মতন।

সুধাময় জিতে গেল। জেতা তার উচিত ছিল। শৈশব থেকে যে-ছেলে শিখেছে আনন্দই একমাত্র সত্য, ভালবাসাই সব—সে-ছেলে আনন্দ আর ভালবাসার রাজপথ খুঁজতে গিয়ে গলিঘুঁজির মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। আত্মসুখ আর আনন্দ যে এক নয় এ-কথা বোঝে নি, ধরতে পারে নি নিজেকে পশুর মতন রক্ষা করা ভালবাসা নয়। মৃত্যু একটা নিয়ম, আঘাত যে অভিজ্ঞতা এ-সব তার জানা ছিল না। ধীরে ধীরে সব জানা হল। সুধাময় বুঝতে পারল, নিজেকে দুর্গের মধ্যে রক্ষা করায় আনন্দ নেই, তাতে আত্মা বাঁচে না—চিতায় ওঠা থেকে রক্ষা পাওয়া যায় না। নিজেকে ভাঙতে হবে, যেমন করে ফলফুলের এক একটি বীজ নিজেকে ভাঙে, টুকরো হয়ে যায়—অথচ তাতে সে শেষ হয় না, একটি অঙ্গুর হয়ে ওঠে এবং আস্তে আস্তে সবুজ চারা, তারপর শত প্রশাখা-পল্লব-ঘন বৃক্ষ।

সুধাময় ভয়কে জয় করল। মৃত্যুকে উপেক্ষা।

সকালে গোছগাছ শেষ হয়েছিল। দুয়ারে দাঁড়িয়ে গাড়ি । বাড়ির ডাক্তার সঙ্গে যাবে কলকাতা। বামুন দিদিমণির ভাইঝি লতিকা যাবে পুণ্যময়ীর সেবাশুশ্রুষার জন্যে। সব তৈরি। নদীর চরে রোদ টকটক করছে। ঝাঁক বেঁধে পাখি উড়ছে আকাশে। নীল একটা মেঘ মাথার ওপর শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সুধাময়ও তৈরি। কিন্তু পুণ্যময়ী তৈরি হতে পারলেন না। হয়ত হতে চাইছিলেন না। রক্ত উঠল অনেকটা ; মাথা টলে পড়ল।

তারপর পাঁচটা দিন কাটল। ছ’দিনের দিন সকাল। সুধাময় মার ঘরে এসে দাঁড়াল। সমস্ত জানলা খোলা, রোদে রোদে ঘর ভেসে যাচ্ছে। বিছানার ধবধবে চাদরের ওপর মা শুয়ে। চোখের পাতা বন্ধ । বালিশের একপাশে মাথা একট হেলে রয়েছে। সাদা সিঁথির ওপর এক ফোঁটা জল।

কা—লকেই যেতে হবে ? পাঁচ দিন আগে মা বলেছিলেন—সুধাময়ের মনে পড়ল। ঠিক এই সময় বোধহয়।

সুধাময় আস্তে পায়ে মার পাশে এসে বসল। মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল অনেকক্ষণ। বুকের হাড়গুলো কুচো কুচো হয়ে ভেঙে যাচ্ছিল, পিষে পিষে যেন জল হয়ে যাচ্ছিল, আর সেই জল গলার কাছে এসে থর-থর করে কাঁপছিল। চোখ ঝাপসা ঝাপসা। সুধাময় দু হাত দিয়ে মার গলা জড়িয়ে ধরল। বুকে মাথা মুখ চেপে ধরল। চুমু খেল। গালে গাল দিয়ে কাঁদল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।

এতক্ষণ ঘর নিস্তব্ধ ছিল—এইবার কান্নার একটা দুঃসহ রোল স্তব্ধতাকে সিক্ত করে দিল।

কখনো কখনো এ-রকম কোনো বাড়ি চোখে পড়ে—ফাঁকা ধু-ধু মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, নির্জন নিস্তব্ধ, গায়ে শ্যাওলা, সুপুরি আর নারকেল গাছের ঝাঁকড়া মাথা অন্ধকারে আড়াল দিয়ে। এমন শূন্য স্তব্ধ বাড়ির নিজস্ব একটি সৌন্দর্য আছে। পুণ্যময়ীর মৃত্যুর পর সুধাময়ের অবস্থাটা ওই রকম দেখাচ্ছিল। ও একা-নিঃসঙ্গ, শান্ত অথচ যেন সমাহিত। মায়ের মৃত্যুর পর সে ভীত অধীর অস্থির হল না, আগে বাবার মৃত্যুর পর যেমন হয়েছিল। একটা গভীর অনুশোচনা এবং দুঃখ তাকে কিছুকাল খুবই উন্মনা করে রেখেছিল, আস্তে আস্তে যা কেটে গেল একসময় ।

অন্তরে সুধাময় এবার পরিশুদ্ধ হয়ে উঠেছিল। মনের তরঙ্গ ক্রমশই শান্ত থেকে আরও শান্ত হয়ে আসছিল। একটি প্রাচীন অথচ নিরিবিলি সুন্দর ঘরে চন্দনের মিষ্টিগন্ধ ধূপ জ্বেলে দিয়ে কোনো তন্ময় শিল্পী যেন নিজেকে নতুন করে আবিষ্কারের মাধুর্য উপভোগ করতে চাইছিল।

কিছু দিন এইভাবে কাটল। সুধাময় এই সময় কিছু কিছু ‘আত্মচিন্তা’ লিখতে শুরু করেছিল। এতে তার নিঃসঙ্গতার ক্লান্তি মোচন হত, মনের অনেক জটিলগ্রন্থি চিন্তা স্পষ্ট হয়ে ধরা দিত। আর কলকাতার বন্ধু পরিমলকে সেই সব চিন্তার টুকরো পাঠাত চিঠিতে।

সুধাময় যে জীবনকে ভালবাসত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে সে-ভালবাসা ওই বয়সেই, এত ব্যাকরণসম্মত হয়ে উঠেছিল যে, তার মধ্যে চঞ্চল আবেগময় একটি স্বাভাবিক ছন্দ একেবারেই বাদ পড়ে যাচ্ছিল। আনন্দের প্রকারভেদ সম্পর্কে সুধাময়ের নিজস্ব মতামত হয়ত দীন ছিল না কিন্তু তা ওর নিজস্ব উপলব্ধ অভিজ্ঞতার দ্বারা পরীক্ষিত নয় বলে, প্রায়ই কৃত্রিম মনে হত।

এমন সময় কিছু দিন চোখ নিয়ে ভীষণ ভুগতে হল সুধাময়কে। দিনের বেলাতেও তার কাছে সব ঝাপসা দেখাত। চোখে অসহ্য ব্যথা হত, মাথা ধরে থাকত। কিন্তু এমন পাগল ও, কলকাতায় এসে চোখ দেখাবার প্রয়োজন অনুভব করত না। তখন ওর মাথায় এই ভূত চেপেছে যে, নিজের মন ও ইচ্ছার কাঠিন্য এবং একাগ্রতা দিয়ে শারীরিক যন্ত্রণাকে সে অগ্রাহ্য, উপেক্ষা এবং পরাস্ত করবে।

এর ফলে লাভ হল এই চোখের গোলমালে এক ব্যাধি যখন পাকা হল, প্রায়-অন্ধ অবস্থা তখন তাকে কলকাতায় আসতে হল। সাড়ম্বর চিকিৎসা শুরু হল তারপর। কিছু দিন এর কাছে ওর কাছে ছুটোছুটি। শেষে এক বিলিতি কায়দার নার্সিংহোমে—টানা এক মাস চোখে ঠুলি এঁটে শুয়ে থাকতে হল।

চোখ সারল। চশমা নিতে হল বেশি পাওয়ারের। কিন্তু সুধাময় আর দেশের বাড়িতে ফিরে গেল না। ভবানীপুরের দিকে ছোটখাট নিরিবিলি সুন্দর এক ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকতে শুরু করল।

এক একটা সময় আসে যখন মন কি করছে কেন করছে কিছুর জন্যে তৈরি থাকে না। যা ভাল লাগে করে এবং করে আরাম পায়। সুধাময়ের বোধহয় তখন মনের তেমন একটা অবস্থা। অনেকদিন ধরে ভেতরে ভেতরে, ওর অজ্ঞাতেই এক রকমের ক্লান্তি জমে উঠেছিল। যদি বা ক্লান্তি নাও হয়, তবে গুমট তো নিশ্চয়ই। তার ওপর সম্প্রতি অসুস্থতার একটা একঘেয়েমি বিরক্তি গেছে। একটু হাঁপ ছাড়তে চাইছিল সুধাময়, হয়ত বা দীর্ঘ দিনের বাঁধা ছক থেকে বেরিয়ে এসে কিছু নতুনত্ব খুঁজেছিল, খানিক বৈচিত্র্য। আমরা যাকে বলি ‘ফুর্তি’—তেমন কোনো ফুর্তির ওপর তার ঝোঁক ছিল না। সিনেমা-থিয়েটার, মদ, হোটেল-কাফে, রেসের মাঠ—এ-সব তাকে টানে নি। অন্য রকম এক লঘুতা দিয়ে মনের গভীরে রঙে সে চুমকি বসাতে শুরু করেছিল। কলকাতায় তার পরিচিত যে ক’জন মানুষ ছিল, এতোদিন পরে খোঁজ নিয়ে নিয়ে তাদের বাড়ি যাওয়া শুরু করল। তাদের নিজের বাড়িতে গল্পগুজব করতে ডাকতে লাগল। সুন্দর চায়ের সঙ্গে রমণীয় খাদ্য পরিবেশনে আপ্যায়িত করতে লাগল সকলকে। সুধাময়ের ফ্ল্যাটে বেশ একটা আড্ডা জমে উঠল।

এই ঘরের মধ্যে কেমন করে যে একদিন উড়ে এল এক অপরূপ পাখি ! কি করে এল, কে আনল—কিংবা সুধাময় নিজেই তাকে গিয়ে কোথায় আবিষ্কার করল—পরে সে-কথা সুধাময়ের মনে থাকল না। এইটুকু শুধু সে জানত, বিভূতি মজুমদারের কোন্ সম্পর্কের বোন হয়। নাম, রাজেশ্বরী ।

রাজেশ্বরী যেন অগ্নিশিখা। রূপের এত দীপ্তি সুধাময় আগে দেখে নি। ওর মা সুন্দরী ছিলেন—অসাধারণ সুন্দরী—তাঁর রূপ ফেটে পড়ত, কিন্তু রাজেশ্বরীর রূপ নিশ্চল আছে। মনে হয় কোনো, কী যেন এক সৌন্দর্য ওর শরীরের মধ্যে জ্বলছে, ভীষণ উজ্জ্বল। স্ফুলিঙ্গের মতন দীপ্ত, দাহ্য। চোখ আচ্ছন্ন হয়ে আসে ওর দিকে তাকালে। বোধের স্নায়ুগুলো ঘোলাটে হয়ে যায়।

সুধাময় সেই রূপের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত, বিভ্রান্ত হয়েছিল। মনে মনে এই সৌন্দর্যের রহস্য আবিষ্কার করবারও বুঝি চেষ্টা করত। পারত না। ব্যর্থ হয়ে নিজেকে বলত, আকস্মিকতা ছাড়া এ সম্ভব নয়, সম্ভব হতে পারে না।

মেয়েটি ছিল দীর্ঘাঙ্গী। সাগর ঢেউয়ের মাথায় যেমন দীর্ঘ বক্র সুছন্দ একটি গতিশীল ভঙ্গিমা ফুটে ওঠে রাজেশ্বরীর দীর্ঘ অঙ্গে তেমনই এক জীবন্ত ভঙ্গিমা। নিখুঁত অবয়ব। অশ্বপল্লবের ডৌলে গড়া মুখ। সুষম কপাল। কাজলের বাঁকা টান দিয়ে ঘন ভুরু দুটি যেন কেউ এঁকে দিয়েছে। দীর্ঘপদ্ম চোখ। শ্বেতপাথরের মতন সাদা অক্ষিপট। মেঘ-কালো চোখের তারা। অস্বাভাবিক উজ্জ্বল ; যেন দুটি অন্ধকারের বিন্দু জ্বলছে। চোখের তলায় কিসের এক উষ্ণতা। অবোধ্য ভাষায় হাসছে। টিকলো নাক, স্ফুরিত ওষ্ঠ। বাঁকা রেখা কোথাও যদি এতটুকু কেঁপেছে। চিবুকটি নিটোল এবং এক ধরনের ঘন আভার রঙ লেগে আছে।

রাজেশ্বরীর অজস্র কালো ঘন নরম চুলের মধ্যে মুখের সম্পূর্ণ ছবিটি বসন্তের মোহিনী মায়ার মতন। তীব্র অথচ আত্মবিভোর। কুহকী মৃগীর মতন। রাজেশ্বরীর অঙ্গে তার যৌবন যে লীলা করছে—সুধাময় তার দুর্বল চোখ দিয়েও তো দেখতে পেয়েছিল। এবং সেই দুধমাখা জবাফুলের মতন রঙ, ননী-কোমল তনু, কৃশ কটি, অপরূপ বাহুবল্লরী ভাল লেগেছিল সুধাময়ের। মুগ্ধ হয়েছিল বেচারি যুবক দার্শনিক।

রাজেশ্বরী আসত যেন রাজহংস। গর্বিত, সতর্ক, সচেতন। পোশাকে তার ইচ্ছাকৃত পরিপাটি চোখে পড়ত। কখনো আসত সোনালী কিংবা গভীর নীল সরু পাড়ের সাদা ধবধবে শাড়িতে নিজেকে সাজিয়ে কখনো উজ্জ্বল গভীর রঙে অঙ্গকে শিখার মতন জ্বালিয়ে। গলায় দুলত সরু হার, বুকের ভাঁজে মুক্তো বসানো সুন্দর একটি লকেট হৃদপিণ্ডের ওপর যেন কাঁপত সামান্য। পঞ্চমীর চন্দ্রকলার মতন বঙ্কিম উরোজ। মকরবালা পরা দুটি হাত। একটি আঙটি অনামিকায় ; বেদানার দানার মতন রঙ তার পাথরটির।

রাজেশ্বরীর কোথাও পাথরের জড়তা ছিল না। না মুখে না মনে। অহেতুক ন্ম্রতা তাকে লজ্জাবতী লতা করে নি যেমন, তেমন ফোয়ারার জলের মতন অনর্গল বাহারি জলধারা হয়ে সে উছলে পড়ত না। সংযত, সভ্য, শালীন। কথা বলত একটু মৃদু অথচ স্পষ্ট গলায়। হাসত ততটুকু ধ্বনি তুলে যতটুকুতে মাধুর্য আছে অথচ চপলতা নেই। ওর মধ্যে এক ধরনের সহানুভূতি এবং কোমলতা ছিল যা মানুষকে তৃপ্ত করে । ভাল গাইতে পারত; বুদ্ধির ধার মুড়ে কথা বলতে জানত, আর জানত নিজেকে মনোরম করে রাখতে।

সুধাময়ের সঙ্গে রাজেশ্বরীর পরিচয়ের পর, খুব দ্রুত না হলেও একটু তাড়াতাড়ি ওদের দুজনের মধ্যে একটা অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠছিল। রাজেশ্বরী প্রায়ই আসত, সুধাময়কে নিজের হাতে চা তৈরি করে খাওয়াত, গান শোনাত, সদালাপে খুশি করত।

সুধাময়ও যে খুশি ছিল তাতে সন্দেহ নেই।

একদিন, তখন সবে বিকেল শেষ হচ্ছে, সুধাময়ের লেখক বন্ধু পরিমল সবে সুধাময়ের ফ্ল্যাটে পা দিয়েছে—দেখতে পেল ওরা দুজন সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে।

“বেরুচ্ছো ?” শেষ ধাপে নেমে এলে সুধাময়ের দিকে তাকিয়ে পরিমল বলল ।

“হ্যাঁ; তুমিও চলো।”

“আমি, কোথায়— ?”

“আমিও তা জানি না ; ও জানে—।” সুধাময় রাজেশ্বরীকে ইঙ্গিতে দেখিয়ে দিল।

“যাবেন, চলুন না” —রাজেশ্বরী বলল, “বেড়াতে যাচ্ছি একটু।”

পরিমল মাথা নাড়ল। বলল, “না ; আমি আজ বড় ক্লান্ত ; মন-মেজাজও ভাল নেই। সুধাময়, আমি বরং ওপরে গিয়ে অপেক্ষা করি গে, যদি কেউ আসে, গল্পগুজব করব।”

“মৃণাল আসতে পারে। তুমি যাও ওপরে, চা-টা খেয়ে বিশ্রাম করগে। আমাদেরও খুব দেরি হবে না।”

দেরি বাস্তবিকই হয় নি। ঘন্টা দেড়েক পরে সুধাময় একা ফিরে এল।

“ওরা কেউ আসে নি ?”

“না। একা বসে বসে তোমার কথাই ভাবছি। “

“আমার কথা —?” সুধাময় একটা সিগারেট তুলে নিল পরিমলের প্যাকেট থেকে। সোফায় বসল। অনভ্যস্ত আঙুলে সিগারেট ধরিয়ে হাস্যকর ভাবে টানতে লাগল।

“রাজেশ্বরীকে তুমি ভালবেসে ফেলছ যেন?” পরিমল বলল, বলে বন্ধুর মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল।

সুধাময় কথাটা শুনল ।পরিমল চোখে চোখে তাকিয়ে থাকল ক মুহূর্ত । সিগারেটটা নিভিয়ে ফেলল ।তারপর বলল, “জানি না ।”

পরিমল একটু কি ভাবল। সুধাময়ের ‘জানি না’ যে গোপনতা বা এড়িয়ে যাওয়া নয় এ সত্য তার জানা ছিল। বলল, “রাজেশ্বরী তোমায় মুগ্ধ করেছে।”

“তাতে কি! খুব ভাল ম্যাজিক দেখেও তো মানুষ মুগ্ধ হয়।”

পরিমল পালটা জবাব দিতে পারল না। আবার খানিক ভাবল। বলল, “ও তোমায় খুব আকর্ষণ করেছে, আমি ভেবেছিলাম।”

“ঠিকই ভেবেছ। কিন্তু সেটা রাজেশ্বরীর আকর্ষণ ক্ষমতা, আমার তাতে কোন গুণ আছে ?” সুধাময় এবার একটু হাসল।

“তুমি তর্ক জুড়লে আবার ?” পরিমল হতাশ হল।

“সঠিকভাবে কিছু জানতে হলে কোথাও রহস্য রেখে লাভ নেই পরিমল । বহু পুরুষ মানুষ আছে তারা পতিতালয়ে যায়। কেউ কেউ ধরাবাঁধা একটি মেয়ের কাছে। তারা আকর্ষণ করে ব’লেই যায়। সেটা কি ভালবাসা ?” সুধাময় সোফার ওপর আরাম করে বসল। যেন এবার তর্কটা জমবার সময় হয়েছে। পরিমল অসহায় বোধ করছিল এবং বিব্রত। ঠিক এ-ভাবে প্রেম নিয়ে তর্ক করতে সে অস্বস্তি এবং অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তবু খানিকটা ভেবে একবার শেষ চেষ্টা করল পরিমল, শুধলো, “তোমার কি কখনো মনে হয় না রাজেশ্বরীর সঙ্গে মিলন হলে তুমি খুশি হবে ।’

“হয় আজও হয়েছে। তেষ্টা পেলে আমি এক গ্লাস জল খাই। তাতে তেষ্টার অস্বস্তি মেটে, ভাল লাগে। তাতে বোঝা যায়, জল তেষ্টা মেটায়। কিন্তু জল কি, তা কি বোঝা যায় পরিমল ? মিলনের ইচ্ছাটা তেমনি। ওটা ভালবাসার লক্ষণ, কিন্তু সার কথা নয়।”

রাজেশ্বরী সুধাময়কে মুগ্ধ করেছে, আকর্ষণ করছে ; সুধাময়ের মনে মিলন কামনাও আছে—তবু যদি এই মুগ্ধতা, আকর্ষণ, মিলন-কামনা ভালবাসা না হয়—তবে ভালবাসা কি ?

সুধাময় বলেছিল, প্রেম আনন্দ। “যা আমার আনন্দ, যাতে আমি আনন্দিত, অন্তত যার আবির্ভাবে আমার আনন্দ জেগে ওঠে—আমি তাকেই ভালবাসা বলি।”

পরিমলের একটা ভুল ভাঙল। কিংবা বলা যায় পরিমলের মনে একটা খট্‌কা এবার লাগল। ও ভেবেছিল সুধাময় রাজেশ্বরীর প্রেমে পড়েছে। এই প্রথম প্রেম এসেছে সুধাময়ের জীবনে। তাকে অবহেলা করতে ও পারবে না। এবার ওই আকাশমুখী বন্ধু মাটিতে নেমে দাঁড়াবে। এতে ভাল হবে। কিন্তু সুধাময়ের সঙ্গে কথা বলার পর বুঝলো, রাজেশ্বরী সম্পর্কে সুধাময়ের অনুভূতি এখনও স্পষ্ট নয়।

আর একদিন কথা প্রসঙ্গে পরিমল বললে, “তুমি সোনা বলতে সোনার তাল বোঝো। ওটা মূল্যবান, সঞ্চয় করে রাখার মধ্যে অবশ্য হিসেবিপনা আছে, কিন্তু ব্যবহারে ওটা অচল। সোনার তাল গলিয়ে তাকে অলংকার করতে হয়। রাজেশ্বরীর মকরবালা দুটো, গলার হারটি ক’ ভরি সোনার ডেলা হয়ে বাক্সে বন্দী থাকলে তাতে কি তার গলার হাতের সৌন্দর্য বাড়ত না তোমার চোখ জুড়তো ? আনন্দ, প্রেম—এ-সব আইডিয়ার নিরেট তাল নিয়ে মানুষের চলে না। তোমাকে তা ভেঙে গলিয়ে কাজে লাগাতে হবে।”

সুধাময় খুব মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনল। তারপর হেসে বলল, “আচ্ছা পরিমল, তুমি কি নিঃসন্দেহ যে, রাজেশ্বরীকে বিয়ে করলে আমার সব অভাব মিটে যাবে ?”

“কোনো স্ত্রীই স্বামীর সব অভাব মেটাতে পারে না। শুধু স্বর্গফলের চিন্তায় তুমি কিছু পাবে না, সুধা। রাজেশ্বরী অসংখ্য মানুষ নয়, অসংখ্য গুণের সমষ্টিও নয়—একটিমাত্র মানুষ—কিন্তু তাকে ভালবাসতে পারলে, তার ভালবাসা পেলে—তুমি সাংসারিক জীবনে সুখী হবে, শান্তি পাবে। আমার তো তাই মনে হয়।”

সুধাময় কোনো জবাব দিল না ।

সুধাময়ের স্বভাব ছিল পরীক্ষকের। সে হৃদয়-তুফান বিশ্বাস করত না। রাজেশ্বরীকে ভালবেসেছে কি না—মনে মনে তা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে আরও কয়েক মাস কাটল। তারপর একদিন….

সেই একদিনে কি ঘটেছিল সেটা সুধাময়ের মুখের কথায় বলা ভাল । সুধাময় নিজেই পরিমলকে বলেছিল : ‘পরশু বিকেলে রাজেশ্বরী এসেছিল। টকটকে লাল গোলাপের মতন শাড়ি পরে, ধবধবে সাদা জামা, গলায় হাতে জরির কাজ। ওর চুল এলোমেলো, রুক্ষ, ফাঁপানো ফোলানো। যেন এইমাত্র ঘুম থেকে উঠে এসেছে।

তখন শেষ গোধূলি। ঘরের বাতি আমি জ্বাললাম না। রাজেশ্বরী জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। খানিকটা আলো, আঁচের মতন রঙ—রাজেশ্বরীর গালে এসে পড়ছিল। অল্প একটু সেই আলো থাকল, তারপর সরে গেল। অন্ধকার হয়ে আসতে লাগল। সব ঝাপ্‌সা।….আমি উঠে রাজেশ্বরীর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আর একটু অন্ধকার হল। রাজেশ্বরীর নিশ্বাসের শব্দ আমার কানে আসছিল, গালে লাগছিল। আমার হাত, আমার শরীর, আমার চোখ রাজেশ্বরীকে দেখছিল না ; দেখতে পাচ্ছিল; না একটা গোটা মানুষের বদলে আমি তার কতক টুকরো টুকরো অংশকে দেখছিলুম, যা আমায় লুব্ধ করছিল, আমাকে আর সবকিছু ভুলিয়ে দিচ্ছিল। ওর গায়ের একরকম ঘ্রাণ পাচ্ছিলাম—তীব্র—শরীরের কোথায় যে তা লুকিয়ে ছিল। আমার শরীর ওকে পীড়ন করবার জন্যে পাগল হচ্ছিল। আমি কেমন এক ধরনের বন্য-প্রবৃত্তি বোধ করছিলুম। রাজেশ্বরী…। যাক, শেষ পর্যন্ত আমি রক্ষা পেলাম। কে যেন আসছিল—তার পায়ের শব্দ শুনতে পেয়ে আমি সরে গেলাম। বাতি জ্বাললাম ঘরের। রাজেশ্বরী যেন আগুনের শিখা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে আবার সম্পূর্ণ করে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম। একটু পরে রাজেশ্বরীকে আমি বললাম, তুমি বাড়ি যাও। আমায় ক্ষমা কোরো।..রাজেশ্বরী হয়ত কিছু বলত, কিন্তু ততক্ষণে তোমার গলার সাড়া পাওয়া গেছে। এদিকের দরজা দিয়ে রাজেশ্বরী চলে গেল। ও আর আসবে না।

পরিমল, রাজেশ্বরীর রূপ, তার অমন দেহ আমি উপভোগ করতে পারতাম। বিয়ে করেই। কিন্তু, কে বলতে পারে—রাজেশ্বরীর রূপ, তার দেহই এতোদিন আমার আনন্দের উৎস ছিল না। এবং ভোগ দখলের পর একদিন আমি ক্লান্ত হব না, আমার আনন্দ উবে যাবে না! ওকে ভোগ করার জন্য যখন পাগল হয়েছিলাম—তখন রাজেশ্বরী কেন হরিয়ে গেল, তার বদলে ওর শরীরের কতকগুলো অংশই কেন আমার চোখ মন বোধ আবেগকে আচ্ছন্ন করল। যতই বলো, দেহের কোনো কোনো অংশ একটা পরিপূর্ণ মানুষ নয়। আমি কি পরিপূর্ণ মানুষকে ভালবাসতে চাইছি না পরিমল ! তবে— ?’ সুধাময়ের অন্তর হাহাকার করে উঠেছিল।

রাজেশ্বরী পর্ব শেষ হল। সুধাময়ের মনে সেই যে সন্দেহ এবং দ্বন্দ্ব দেখা দিল, সে দ্বন্দ্ব আর সহজে নিরসন হল না।

বছর দুই কাটল। সুধাময় ঘুরে বেড়াল বাইরে বাইরে। তারপর আস্তে আস্তে সব থিতিয়ে এল, মন শান্ত হল, আবার ফিরল সে কলকাতায়। তখন ওর অবস্থা বানের জল সরে যাওয়া নদীর চরের মতন। পলিমাটি পড়ে গেছে। ফসল বুনলে সোনা ফলবে হয়ত।

এই সময় সুধাময়ের প্লুরিসির মতন হল। খুব যে একটা ভুগেছিল তা নয়, তবু বেশ কিছুদিন বিছানায় পড়ে থাকতে হল। সেরে উঠে বাইরে গেল জলবায়ু বদলাতে। আর তারপর একদিন কি করে যে মিহিরপুর টি বি স্যানেটোরিয়ামের হাতছানি তাকে টেনে নিল কে জানে! না, হয়ত ভুল হল একথা বলা, মিহিরপুর টি বি স্যানেটোরিয়াম না টানলেও ওই ধরনের একটা কিছু তাকে টানতোই। কেননা সুধাময় তখন বৃহৎ সংসারে, বৃহৎ মায়ায় ভালবাসায় এবং কল্যাণের ক্ষেত্রে নিজেকে সমর্পণ করে দিতে চাইছিল।

মিহিরপুর টি বি স্যানেটোরিয়াম থেকে সুধাময় প্রথম যে চিঠিটি লিখেছিল পরিমলকে তা বড় সুন্দর। তার প্রথমেই ছিল এই কথা : ‘ভাই পরিমল, আমি এখানে আতুরজনের শারীরিক সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করছি না ; আমি ওদের হতাশ ক্লান্ত অসুস্থ মনের সেবায় নিজেকে সমর্পণ করেছি। মৃত্যুভয় ওদের মনের রক্ত শুষে নিয়েছে ; ওরা কী অসহায়, ভগবানকে ভাবে পরমগতি, ভাগ্য ছাড়া আর কোথাও আস্থা রাখে না। ওদের মন শূন্য, সেখানে কিছু সম্বল চাই, বাঁচার তীব্র বাসনা শুধু নয়, বিশ্বাস। আমি ওদের সেই বিশ্বাস যোগাব। আমি এতদিন পরে নীড় ছেড়ে আকাশে ঝাঁপ দিতে পারলাম। আমি কি আজ সুখী নয়।’

সুধাময় সুখী হয়েছিল। যে কর্তব্য ও দায়িত্ব সে স্বেচ্ছায় নিয়েছিল তার মধ্যে কোথাও খাদ রাখে নি। দেশের বাড়িঘর জমিজমা সব বিক্রি করে দিয়ে টাকাটা প্রায় সবই দিয়ে দিয়েছিল স্যানেটোরিয়ামে। পুণ্যময়ীর নামে কোনো বেড হয় নি—তবে পুণ্যময়ীর নামে তার সন্তান টাকাটা দিচ্ছে এ-ভাবে ওটা স্যানেটোরিয়ামের তহবিলে জমা পড়েছিল। বাকি সামান্য কিছু টাকা যা ছিল তাই দিয়ে স্যানেটোরিয়ামের চৌহদ্দির পাশেই দুটো ছোট ছোট মাটি আর পাথর মেশান ঘর করে নিয়েছিল সুধাময় নিজের জন্যে। মাথার ওপর কাঠের তক্তার ছাদ। স্যানেটোরিয়ামের কিছু খুচরো অফিস-কাজ করে দিত—তার বদলে ওর খাওয়ার চাল ডাল দুধ শাকসব্জিটা পেত স্যানেটোরিয়ামের ভাঁড়ার থেকে। কুকারে রান্না করে নিত সুধাময় নিজেই। এবং তৃপ্ত হয়ে খেত।

পরিমলকে বার বার ডাকছিল সুধাময়।‘ এসো একবার এখানে, দেখে যাও—কী সুন্দর জায়গায় কেমন সংসার পেতে বসেছি। কত আনন্দে আছি।’

পরিমল একবার নয় বার দুই গেছে সেখানে। সত্যি, চমৎকার জায়গা। পাহাড়ি ঢলের ওপর ছোট্ট স্যানেটোরিয়াম। ওপরের চেহারায় দারিদ্র্য আছে, ভেতরে তার ধনের অভাব নেই। দুটি মাত্র ডাক্তার—কয়েকজন নার্স, জনা বিশেক পেশেন্ট, দু একজন অন্য কর্মচারী–কিন্তু কী সদয়, সহানুভূতিশীল, যত্নময় ব্যবহার। পরিবেশটিও চমৎকার—উত্তরে শালবন, দক্ষিণে ঢালু জমি ঢেউ ভেঙে ভেঙে নেমে গেছে—সবুজ মখমলের মতো নরম যেন ; পশ্চিমে আকাশপটে হেলান দিয়ে পাহাড়চূড়া দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চল মেঘের মতন। পুবে অনেকটা দূরে ক্ষেতখামার। সূর্য উঠত সোনার জল ছড়িয়ে, আমলকি বন থেকে হিমের গন্ধ ভেসে আসত। বুনো পাখি ডাকত। শালবনের কাঠ কেটে বয়েল গাড়ি যেত দুপুর আর বিকেলে, চাকায় শব্দ উঠত করুণ, অথচ সুন্দর, বয়েলের গলায় ঘন্টা বাজত ঠুন ঠুন করে। গোধূলিতে পাহাড়ছোঁয়া আকাশে সূর্য অস্ত যেত। কী যে রঙ—যেন কোনো অনন্ত পুরুষ প্রতিদিন তার বুক থেকে এক সমুদ্র রক্ত এখানের রক্তহীন পাংশু কাতর রুগীদের বুকে ঢেলে দিয়ে যেত।

পরিমল যে কবার মিহিরপুর স্যানেটোরিয়ামে গেছে—দেখেছে, সরল শান্ত জীবন এবং আপন আদর্শ নিয়ে সুধাময় প্রতিবারেই যেন আরও শুদ্ধ, শুদ্ধ থেকে শুদ্ধতর হয়ে উঠছে আত্মায়। স্যানেটোরিয়ামের রুগীরা সকলেই তার যেন পরিজন, সকলেই সুধাময়কে ভালবাসে শ্রদ্ধা করে, সুধাময়ের ব্যক্তিত্বের আভা নিজেদের মনে মেখে নেয়। ছোট বড়, ছেলে মেয়ে—কারুর কাছেই সুধাময় অনাত্মীয় নয়।

সকালে সূর্য উঠে গেলে সুধাময় স্যানেটোরিয়ামের অফিসে যেত। কোনোদিন দু একটা কাজ থাকত কি থাকত না—দারোয়ান চিঠি নিয়ে এলে সব চিঠি বাছত, সাজাত—তারপর হাতে করে চলে যেত ওয়ার্ডে চিঠি বিলি করতে। সকালে প্রতিজনের সঙ্গে এইভাবে সাক্ষাৎ শেষ হত। ফিরে এসে অফিসে হিসেবের খাতা খুলে আঁকজোক—কিংবা চিঠিপত্র লেখা। তারপর বাড়ি। দুপুরে আবার ওয়ার্ডে ঘুরত। কারুর চিঠির জবাব লিখে দিত, কাউকে বই পড়ে শোনাত, কাউকে বা তার সরু মেঠোসুর গলায় থেমে থেমে বাউল গান শুনিয়ে দিত, নানান গল্প হাসি। একবার একটি ছেলে বছরখানেক ছিল এখানে।—মাত্র বারো বছর বয়স—সুধাময় তার সঙ্গে লুডো পর্যন্ত খেলেছে—দুপুর ভোর। কত যে বকবক গল্প করেছে। সে বাড়ি যাবার সময় তাকে একটা ক্যারাম বোর্ডও কিনে দিয়েছিল সুধাময়।।

বিকেলে মোটামুটি সুস্থ রোগীরা বেড়াত—স্যানেটোরিয়ামের সামনে কিংবা বাইরেও। তাদের কারোর সঙ্গে আজ, কারোর সঙ্গে কাল সুধাময়কে দেখা যেত। বিকেল পড়ে এলে সুধাময় নিজের ঘরে গিয়ে বসত। বসার ঘরটি ছোট। তক্তপোশ আর মাদুর পাতা, হ্যারিকেন লণ্ঠন, মাটির ফুলদানিতে বুনো ফুল, এক ধরনের গাছের শক্ত শক্ত আঠা ধুনোর মতন পুড়ত। চমৎকার গন্ধ। দুএকজন করে ধীরে ধীরে একটি ছোট দল এসে বসত তক্তপোশের ওপর। বীরেনবাবু, পশুপতি, অমল, কমলা, শোভনাদি, সুধীন…এমনি সব। সুধাময় তাদের মুখোমুখি বসে এ-কথা সে-কথার পর আস্তে আস্তে জীবনের গল্পে চলে যেত :

জীবন কোনোদিন শূন্যে গিয়ে থামে না। তবে দুঃখ ? হ্যাঁ, দুঃখ আছে। আছে বলেই আশা দিয়ে ভালবাসা দিয়ে বিশ্বাস দিয়ে তার সঙ্গে যুঝতে হবে। কর্মফল ভাগ্য ঠাকুর-দেবতা—এ-সব কোনো কাজের কথা নয়, সত্যও নয়। আমাদের জীবনটা একটা ছাঁট রঙিন কাগজ নয়, আর তাতে সরু কাঠি আঁটা নেই—যে আমরা নিছ্ক ঘুড়ি—সুতো দিয়ে বাঁধা। অন্য কারও হাতে লাটাই আছে—তার খেয়াল খুশিতে আমরা উড়ছি, নামছি, গোঁত্তা খাচ্ছি—তারপর একবার সুতো-কাটা হয়ে ভেসে যাচ্ছি । না, জীবন ঘুড়ি নয়। অথবা গালে হাত তুলে, গলায় ফাঁস লাগিয়ে, আকাশের দিকে মুখ করে ভগবান ভগবান করে কেঁদে ককিয়ে ছটফট করে শেষ করে দেবার জন্যে নয়।

তবে জীবন কি ?

আয়ুকে রক্ষা করার ইচ্ছা, আত্মাকে রক্ষা করার ইচ্ছা, মুক্তির পিপাসা, প্রেম আর আনন্দ। সৎকে রক্ষা করো, সত্তাকে রক্ষা করো—জীবন পূর্ণ হবে।

জীবনের সব অঙ্ক সব সময় মেলে না। হয়ত কখনোই মেলে না, কদাচিৎ কিংবা ব্যতিক্রম ছাড়া। সুধাময় ভেবেছিল, তার অঙ্ক মিলে গেছে, সে অনেক পথ হাতড়ে ঠিক জায়গায় পৌঁছে গেছে।

মিহিরপুর টি বি স্যানেটোরিয়ামের বছর ছয় মনের ভরা আনন্দে এবং শান্তিতে কাটাবার পর হঠাৎ সব গোলমাল হয়ে গেল—; সুধাময়ের শান্ত নিস্তরঙ্গ সুন্দর জীবনে যেন কিসের এক জোয়ার এসে লাগল। সাধ্য ছিল না তার একে প্রতিরোধ করে।

ফিমেল ওয়ার্ডের সি ব্লকে একটি রুগী এল, নাম হৈমন্তী । মাত্র বছর বিশ বয়স। রোগা, মাথায় ছোট, রঙ শ্যামল। হৈমন্তীর মুখ ছোট, গালের হাড় ফুটে উঠেছে, চোখ দুটি কেমন যেন—ক্লান্ত বিষন্ন গভীর অথচ কিসের এক ছায়ায় স্নিগ্ধ। নাকের ডগাটি একটু টোল খাওয়া, পাতলা পাতলা দুটি ঠোঁট, মুখের পাশে গোল হয়ে আশ্চর্য এক হাসি ফুটে আছে। মাথায় এলোমেলো একরাশ চুল।

সুধাময় মাঘ মাসের এক সকালে চিঠি বিলি করতে এসে এই নতুন-আসা রুগীটিকে দেখেছিল। এবং কয়েক মুহূর্ত আর চোখ ফেরাতে পারেনি। ওর মনে হয়েছিল, ও যেন এক হিমভেজা ছোট্ট পাখির দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর অনুভব করল—একটি আশ্চর্য নিস্তব্ধতা তার এবং হৈমন্তীর ব্যবধানটুকুর মধ্যে কিসের এক বুনন গাঁথছে। সুধাময়ের কেমন একটু ভয় ভয় লাগল, নিশ্বাস তার থেমে গিয়ে ছিল তা মনে হল এবং কপালে যেন সূর্যের তাপ এসে লাগছে অনুভব করল।

সুধাময় সরে গেল। কিন্তু অল্প কয়েকটি মুহূর্তের মধ্যে কি যেন হয়ে গেল। সুধাময় অজ্ঞাত এক বেদনা বোধ করতে লাগল। ওর মনে হচ্ছিল, হঠাৎ যেন কিছু সে হারিয়ে ফেলেছে—এমন কিছু যা খুঁজে না পেলে আর সে যেতে পারবে না।

বিকেলে হৈমন্তীকে আবার দেখল সুধাময়। তখন বিকেল পড়ে গেছে। স্যানাটোরিয়ামের বাগানে মোরগফুল ঝুঁটি নাড়ছিল, মালি জল দিচ্ছিল গাছে, বন বাসন্তী রঙের গাঁদার ঝোপে একটা বাতাসের ঘূর্ণি পাক খাচ্ছিল।

সুধাময় অফিসঘরের দিকে চলে গেল—আস্তে আস্তে। ফিরল খানিক পরে। সি ব্লকের পশ্চিমের জানলায় মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। সুধাময় কেমন যেন আচ্ছন্নের মতন তাকিয়ে থাকল। সন্ধে হয়ে আসছে। পশ্চিমের আকাশ-পটে সূর্যডোবার শেষ আভাটুকু নিভু নিভু। পাখির কাকলি হঠাৎ সব স্তব্ধ হয়ে গেল কিছুক্ষণ যেন। সুধাময়ের মনে হল, বিহঙ্গহীন আকাশের দিকে সে তাকিয়ে আছে—সমুদ্রের ধূসরতা নেমেছে সামনে একটি নিঃসঙ্গ স্নান নক্ষত্র পশ্চিমের আকাশে। এ যেন এক অনন্ত বিচ্ছেদের অথচ কী এক আনন্দের মিলনমুহূর্ত । ও কত দূর, কত অস্পষ্ট তবু যেমন করে অন্ধকার বাতাসে ঝরে পড়ছে, তেমনি হৈমন্তী তার নরম দৃষ্টি, ক্লান্ত কালো ভুরু চলের গন্ধ নিয়ে এই নির্জনতার মধ্যে সুধাময়ের সত্তার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।

সুধাময় নিজেও প্রথমে বিস্ময় এবং বিচলিত বোধ করেছিল। ভেবেছিল, এ-এক গভীরতম করুণা, অস্বাভাবিক মমতা মায়া, কিংবা ভ্রম। জীবনের এতটা পথ দক্ষ নাবিকের মতন সে অতিক্রম করে এসেছে—ঝড়ে ঝাপটায় আকর্ষণে মোহে তার আত্মা লক্ষ্যহারা হয় নি। হঠাৎ তবে কেন একটি ক্লান্ত নিভু নিভু নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে আজ মনে হচ্ছে, হালের মুখ ফেরাতে হবে—ওই নক্ষত্রের তলায় কোনো অপূর্ব আলো আছে, কোনো মাটি—ফলফুল ভরা কোনো আশ্চর্য শান্তির দেশ।….ভুল, এ আমার ভুল ; আমি ভুল করছি—সুধাময় ভাবছিল, নিজেকে নিজে সহস্রবার বলছিল আর নিজেকে নিয়ে অসংখ্যবার অঙ্ক কষে দেখছিল।

ওর অঙ্কের ফল বার বার মিলে যাচ্ছিল। কোনো ভৌতিক রহস্যে কিছুই ঝাপসা দেখাচ্ছিল না। এ ভালবাসা ; আমি ভাল বেসেছি হৈমন্তীকে—সুধাময় স্পষ্ট অনুভব করছিল ; সমগ্র চেতনায় এই বোধ ঝঙ্কার দিয়ে উঠল।

সুধাময় অনুভব করত, হৈমন্তীকে সে ভালবাসে এই চিন্তাতেই আশ্চর্য এক আনন্দ আছে। হৈমন্তীর কাছে গেলে তার সঙ্গে কথা বললে, ওর পাশে দাঁড়ালে তাকে ভাবলে এক আনন্দের আস্বাদে সমস্ত মন অনির্বচনীয় মাধুর্যে ভরে ওঠে। তুমি আমায় তোমার কোন্ শিখা দিয়ে যে জ্বালিয়ে দাও হৈমন্তী, আমি জানি না। আমি শুধু আমার আলোকে দেখি। সুধাময় মনে মনে বলত। হৈমন্তীকে উদ্দেশ করে।

আর সুধাময় বুঝেছিল, অঙ্গে প্রত্যঙ্গে রূপে যে হৈমন্তী অত্যন্ত সীমিত—সেই হৈমন্তীই অন্য এক অদৃশ্য অথচ অখণ্ড অস্তিত্ব নিয়ে সমগ্রভাবে অরণ্যের মতন তাকে অধিকার করে রয়েছে। প্রদীপ যখন জ্বলে তখন তার শিখাটুকু চোখে পড়ে, পড়ে না তার আলোর ভূবন—অথচ এর চেয়ে সত্য আর কি ! যাকে ভালবাসি সে তো অমনই, সে তার দেহ নিয়ে যতটুকু আছে তার চারপাশের অদৃশ্য অস্তিত্ব নিয়ে যে তারও বেশি আছে । হৈমন্তীর শীর্ণ পাণ্ডুর মুখ, কীটক্ষত ফুসফুসের নিশ্বাস—তার সমগ্র অস্তিত্ব নয়, সামান্য অস্তিত্ব-—ওর সত্তা চাঁদের আলোর মতন। খণ্ড দৃশ্য রূপের মধ্যে যতটুকু অখণ্ড বিভায় তার চেয়ে অনেক বেশি, অনেক পূর্ণ।

পরিমলকে সুধাময় তার জীবনের এই নব অনুভুতি এবং আনন্দের কথা জানিয়েছিল। সগৌরবে। লিখেছিল : ‘মানুষকে পূর্ণতার পথে যেতে হয় এক একটা পথ দিয়ে। এই রকম পথকেই গুণীজনে বলেছেন আনন্দ। সত্তার পূর্ণতার পথে এগিয়ে যাচ্ছি আমি—আমার এই প্রেম সেই পূর্ণতাকে অনুভব করা—আনন্দ তাকে পথ চিনিয়ে দিচ্ছে। আমার সব দ্বন্দ্ব মিটেছে। আর কোনো সংশয় নেই।’

এ এক মর্মান্তিক এবং নিষ্ঠুর পরিহাস যে, নিঃসংশয় মন মাত্র চার মাস পরে আবার সংশয়ে পীড়িত হয়ে উঠবে। এবার আরও তীব্র, আরও দুঃসহ, আরও করুণতম।

হৈমন্তী প্রথম যখন এসেছিল—মনে হত ওর আয়ুর প্রদীপ ক্ষীণ হয়ে এসেছে। মিহিরপুর স্যানেটোরিয়ামের মুখার্জি ডাক্তারের হাতযশ বলতে হবে, অল্প দিনেই এই নিভন্ত অবস্থাটা আশ্চর্যভাবে সামলে নিয়ে হৈমন্তী ক্রমশই উজ্জ্বল হয়ে উঠতে লাগল । ও যে বাঁচবে, এই কুৎসিত ব্যাধি থেকে মুক্ত হবে—এ-আশা প্রায় সত্য বলেই মনে হয়েছিল।

হৈমন্তী সুধাময়কে বলত, “আমার এত ভীষণ বাঁচার ইচ্ছে—এ আমি নিজেই জানতুম না।”

“ছিল ; তবে ঝিমধরা পাখির মতন পাখি গুটিয়ে।” সুধাময় স্নিগ্ধ হেসে বলত, “তোমার সে-জড়তা এখন কেটে গেছে।”

হৈমন্তীর চোখে নরম হাসির আভা উঠত। তাকাত, যেন সুধাময়কে বলছে, কি করে কাটল তা আমি জানি। তুমিও জানো ।

“আমার নিজের কাছে সবই আশ্চর্য মনে হয়।” হৈমন্তী আস্তে আস্তে জবাব দিত। তারপর চুপ করে দূরের আমলকি গাছের দিকে তাকিয়ে থাকত অনেকক্ষণ । শেষে বাতাস চলার সুরে বলত, “এখন কোনোদিন শরীর একটু খারাপ হলে এত কষ্ট হয়, ভয় হয়।” বাকিটা আর বলতে পারত না। স্পষ্টই অনুমান করা যেত বাকি কথা এই : এখন যদি চলে যাই, যা হারাবো, তা অমূল্য।

সুধাময় আনন্দে অধীর হয়ে উঠত। কিছু বলত না।

কিন্তু এ কি হল ? যে-প্রদীপ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল—হঠাৎ যেন একটা ঝড়ের ঝাপটা তার ওপর আছড়ে পড়ল। ওকে নিভিয়ে না দিয়ে নিরস্ত হবে না। হৈমন্তী আবার জীবনমৃত্যুর সীমানায় গিয়ে পড়ল।

সুধাময়ও কাতর হয়ে উঠল। হৈমন্তী চলে যাবে। সে আর থাকবে না। এই স্যানেটোরিয়ামে নয়, এই জগতে নয় ? ওই ছোট শীর্ণ শান্ত স্নিগ্ধ দেহটি শূন্যে মিশে একাকার হয়ে যাবে !

চিন্তাটা দুঃসহ। সুধাময় ভাবে আর ভাবে। তার শরীর কত যেন ক্লান্ত মনে হয়, মন বিষণ্ণ ; ভীষণ এক বেদনা এবং শূন্যতার বোধ তাকে সারাদিনমান আর রাত্রিতে তাড়া করে বেড়ায়।

সুধাময় তখন নিজেকে প্রশ্ন করল—এ-রকম কেন হয় ? কেন হবে? হৈমন্তী আমার কাছে শুধু তো দেহবন্ধ সত্য নয়—সে যে দেহবিহীন এক বিরাট অস্তিত্বও। ও আমার আলোর ভুবন, আমার আনন্দের জ্বলনকাঠি। যতক্ষণ তার দেহটুকু আছে ততক্ষণ কি আমার আনন্দ সত্য হয়ে আছে, যে-মুহূর্তে ওর দেহকে মৃত্যু চুরি করে নেবে—আমার আনন্দ অসত্য হয়ে দাঁড়াবে। ভালবাসা তো তা নয়, হৈমন্তীর নিশ্বাস গুণে ভালবাসার আয়ু যে নয়। তবে ?

তবে কেন এই অসহ্য দুঃখ, ভয়, বেদনা, হাহাকার। হৈমন্তী চলে যাবে—যেতে পারে—এই চিন্তায় আমি কেন শঙ্কিত, বেদনার্ত, শুন্য হয়ে যাচ্ছি।

‘আমার আনন্দ শতখান হয়ে ভেঙে গেল। পরিমল, আমি বৃথাই বলেছিলাম, আর আমার সংশয় নেই—! বিরাট সংশয় আমাকে কাঁটার মতো সর্বক্ষণ বিঁধছে। রাজেশ্বরীর মধ্যে তার দেহের বাইরে আলোর ভুবন খুঁজেছিলাম, পাইনি। হৈমন্তীর মধ্যে তার মনের আলোময় অস্তিত্ব অনুভব করে সারবস্তু পেয়েছি ভেবেছিলাম ; কে জানত—তার দেহের সঙ্গে এত গভীরভাবে সে-অস্তিত্ব জড়িয়ে আছে । আমার ভালবাসা অন্ধকারের মতন, প্রদীপের কাছে যতক্ষণ আছে ততক্ষণ আলোকিত। একে ভালবাসা বলি না। যে আনন্দ এত চঞ্চল, ভঙ্গুর—সে আনন্দ মিথ্যে।’ পরিমলের কাছে শেষ চিঠিতে লিখেছিল সুধাময়।

তারপর— ?

সুধাময় তারপর মিহিরপুর টি বি স্যানেটোরিয়াম ছেড়ে চলে গেল । কেন—কে জানে ? হয়ত এত সংশয়, দুঃসহ বেদনা তার সহ্য হয়নি। সে নতুন করে তার বিশ্বাসকে খুঁজতে বেরিয়েছে কিংবা তার সেই অদ্ভুত আনন্দকে।

সুধাময়ের গল্প এখানে শেষ । আমি, পরিমল, তার কথা আর কিছু জানি না। যদি আপনাদের কেউ এ-গল্প পড়েন এবং সুধাময়ের দেখা পান তাঁকেও এখানে শেষ করতে হবে কাহিনী । কিন্তু কে জানে, হয়ত, আপনার এত কথা মনে থাকবে না, কিংবা থাকলেও সময় থাকবে না, এত কথা বলার। খুবই স্বাভাবিক অবশ্য। তবে, হ্যাঁ, যদি কোনোদিন সুধাময়ের সঙ্গে দেখা হয়, তাকে বলবেন, তার লেখক বন্ধু পরিমলের বড় ইচ্ছে, সুধাময় যেন জানায়, সে কি তার সমস্ত জীবনে সেই সুধাকে পেয়েছে, যার জন্যে ওর এত আকুলতা, এত ঘাট ছেড়ে ঘাটে যাওয়া ? এত তন্ন তন্ন করে আঁতিপাতি করে খুঁজে, এক বন্দর ছেড়ে আর এক বন্দর—এমনি করে চলতে চলতে সে কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে !

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *