শীতের মাঠ

শীতের মাঠ

সারাটা দিন মাঠ মুখে করে বসে থাকা। গ্রীষ্ম কেটেছে, তখন তেমন করে যেন মাঠটা দেখেনি নবেন্দু। বর্ষার দিনে অতসী জলের ঝাপটার ভয়ে প্রায়ই জানলাটা বন্ধ করে দিয়ে যেত। তারপর ধীরে ধীরে বাইরের ওই রুক্ষ নুড়ি-ছড়ানো আদিগন্ত মাঠটার সঙ্গে নবেন্দুর পরিচয়। এখন শীত। পৌষের শীতে কিছু লালচে ধুলো, কিছু নুড়ি, বিক্ষিপ্ত বুনো ঝোপ, দু-পাঁচটা গাছ আর ধু ধু মাঠখানা চোখের সামনে নিয়ে সারা দিন বসে আছে নবেন্দু।

সকালটা প্রায় প্রত্যহই, সকালটা বেশ লাগে। কোনো কোনো দিন কুয়াশা থাকে, খুব হালকা কুয়াশা, মিহি সাদা, রেশমের মতনই; দূরের জঙ্গলটা ধোঁয়া ধোঁয়া দেখায়, রোদ হয়ত একটু ভিজে থাকে। বেলা বাড়লে নবেন্দু মাঠটা স্পষ্ট দেখতে পায়! কুয়াশা শুকিয়ে গেছে, শীতল গন্ধটাও আর নাকে আসছে না, নুড়িগুলো খটখট করছে। আরও বেলায় সমস্ত মাঠটা উজ্জ্বল, শীতের গাঢ় তপ্ত রোদ টলটল করছে। আমলকির ঝোপটার দিকে চেয়ে চেয়ে নবেন্দুর মনে হয়, এখন মাঠটা যেন এক ধরনের জীবনের মধ্যে গলে গেছে। কটা পাখি মাঠে বসে, সাঁতার কাটে হাওয়ায়, জঙ্গলের দিকে ডানা মেলে উড়ে যায়।

অতসীর এবার অফিস বেরোবার সময়। তার চলা বলা কাজকর্মে এখন দ্রুততা এসেছে। গলার স্বরও সামান্য অন্যরকম মোটা হ্রস্ব পুরুষালি ধরনের। দৃষ্টিটাও সকালের আলস্য ও পরিতৃপ্তিমাখা নয়, ঈষৎ বিরক্তি মাখানো, হয়ত তিক্ত খানিকটা।…ভাতের পাত থেকে উঠে দু কুচি সুপুরি মুখে অতসী কাজ চুকোবার তাড়া নিয়ে বিছানার পাশে এসে দাঁড়ায়। কাঁধের উপর ময়লা তোয়ালে, দুপাট করা ধুতি, এক হাতে তেলের শিশি। অতসীর নিজের শাড়িটাও এখন ময়লা। ব্লাউজ রঙিন বলে চট করে কিছু ধরা যায় না, কিন্তু মুখটা নরম, ভিজে মাথার খোঁপা সুন্দর আঁট করে বাঁধা, কপালের আগায় কোঁকড়া চুলগুলোতে জল ছুঁয়ে আছে।

অভ্যস্ত, প্রায় এক সুন্দর যন্ত্রের মতন, পরিমিত সময়ের মধ্যে অতসী তার কাজ সেরে ফেলে। লছমির মা জলের বালতি আর জল-পড়ার গামলা, মস্ত অয়েলক্লথটা দিয়ে যায়। অতসী ঘরের দরজায় ছিটকিনি তুলে দেয় ভেতর থেকে, ভেতরদিকের জানলাটাও বন্ধ করে। এরই মধ্যে ঘরের কোণা থেকে চড়া গন্ধের পাউডারের টিনটা এনে বিছানার এক পাশে রাখে।

বাইরের জানলাটাও অতসী বন্ধ করে দিতে চায়। নবেন্দুর ভাল লাগে না, অনেকক্ষণ থেকেই লাগছে না, কেমন একটা আকস্মিক অবাধ্যতার বশে নবেন্দু বাধা দেয়। “ওটা খোলা থাক—”

“একেবারে…হাট…?” অতসী ব্যাপারটা পছন্দ করছে না।

“থাক না—”

“সরে এস একটু।” অতসী হয়ত অপ্রসন্ন, কিন্তু জানলা নিয়ে তর্ক করার সময় এখন নেই। সময় একেবারেই নেই। স্বামীর তেলঘষা মাথাটার দিকে চেয়ে অতসী জলের বালতিতে হাত ডোবায়, মেঝের ওপর জল পড়ায় গামলটা পায়ে করে ঠেলে ঠিক করে নেয়।

অতসী নার্স হলেও হতে পারত। ওর হাত পাকা। সুন্দর যন্ত্রের মতন কাজ। দেখতে দেখতে সব হয়ে গেল, মাথা ধোয়ানো মোছানো গলা বুক (অর্থাৎ কন্ঠাটুকু) মোছানো, গা মোছানো, পাউডার ছড়ানো, এমন কি পেটে জড়ানো বাসি কাপড়টা কেমন অদ্ভুতভাবে আলগা করে ছাড়িয়ে নিয়ে কাচা দুপাট করা কাপড়টা জড়িয়ে দিল, ঢিলে ঢালা বুককাটা সুতির জামাটাও। নবেন্দু নিজেই চুল আঁচড়ে নেবে।

অতসী ঘরের দিকের জানলা খুলে ফেলল, দরজার ছিটকিনি নামাল, জলের বালতির মধ্যে বাসি কাপড় গেঞ্জি ও দুমড়োনো অয়েলক্লথটা নিয়ে চলে গেল।

জানলার বাইরে মাঠটা শীতের রোদে পিঠ দিয়ে পড়ে আছে। একটু ধুলো বুঝি উড়ছে ও-পাশটায়—মাঠের উত্তর। নবেন্দু চুল আঁচড়ে ছোট চারিহাতি খয়েরি র‍্যাপারটা বুক পিঠের ওপর আলতো করে ফেলে রেখেছে, বুকের তলা থেকে লেপটা এলোমেলো, অগুছোলো, পা পর্যন্ত মেলা। সারা মাঠে একটি উড়ো পাতা এবার নেচে বেড়াচ্ছে। নবেন্দু পাতাটার রঙ দেখতে পাচ্ছে না। শুকনো খসা পাতা বোধ হয়। পাশের ঘরে অতসীর শব্দ।

অতসী হল। অফিস যাবার জন্যে তৈরি অতসী, অফিস যাবার মতন করে তৈরি। শাড়িটা পরিষ্কার, মাড় ধরা, সাদা, পার গাঢ় নীল, বুটি তোলা বাসন্তী রঙের ব্লাউজ, হতে ঘড়ি, ভারি বালা এক হাতে, গলায় মুখে পুরু করে পাউডার দিয়ে খুব সতর্কভাবে মুছে ফেলা। সিঁথির সিঁদুর মেটে হয়ে গেছে, ছোট হয়ে গেছে। হয়ত আজকাল অতসী রোজ রোজ আর সিঁদুর পরে না।

“আমি চলি—” অতসী সরাসরি স্বামীর দিকে না তাকিয়ে ব্যস্ততার মধ্যে বলল। বলার সময় ধনুকের মতন বেঁকে কোমর ভেঙে হাঁটুর কাছে শাড়ির কেঁপে ফুলে ওঠা। কোঁচ ঠিক করে নিচ্ছিল।

অতসী আজকাল সিঁদুর পরার সময় পায় না…অতসী আজকাল বড্ড মাড় দেওয়া শাড়ি পরে। নবেন্দুর দৃষ্টি আচমকা রূঢ় হয়ে উঠতে লাগল। অতসীর বুটি তোলা বাসন্তী রঙের ব্লাউজটা সখী সখী সাজের মতন বিরক্তিকর লাগছিল।

“লছমির মাকে বলে যাচ্ছি, আর একটু পরেই ভাত দেবে।” অতসী সোজা হয়ে দাঁড়াল, ডান হাতে ঘাড়ের কাছে খোঁপাটা একটু ঠিক করে নিল, কোমরের কাছে ব্যাগটা সামান্য দুলল। “তাড়াতাড়ি খেয়ে নিও, লছমির মাকে বেশিক্ষণ আটকে রেখ না হেঁসেলে, আজ ওর ধোয়াধুয়ির কাজ আছে অনেক।” অতসী ত্রস্ততার মধ্যে এবার স্বামীর দিকে তাকাবার সুযোগ পেল। নবেন্দুর দৃষ্টি দেখে থমকে গেল এক পলক। রোজ-রোজ অফিস যাবার সময় এই রকম অসন্তুষ্ট ক্ষুব্ধ দৃষ্টি দেখতে হয়। অতসীর এখন তাড়াতাড়ি; এখন ভাল করে কিছু দেখা কিছু বোঝার সময় নয়। কাঁধে ঝোলানো ছোট চামড়ার ব্যাগের মুখটা হাঁ করে একটা টাকা বের করে নিল অতসী। স্বামীর দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ক্ষুন্ন গলায় বলল, “তুমি ডাক্তারদের বারণ-টারন যদি না মানো..সত্যি, কথা না শোনো, অসুখ কী করে সারবে।” স্বামীর অনড় হাতের মুঠোয় টাকাটা গুঁজে দিল অতসী।

লছমির মাকে দিয়ে ভাল সিগারেট আনাবে, ভাত খেয়ে একটা আর বিকেলে চা খেয়ে একটা খাবে—তার বেশি নয়, আমি ফিরে এসে কিন্তু গুণে দেখব…” স্বামীর চোখে চোখ রেখে একটু হাসল অতসী। একবার ইচ্ছে হল নবেন্দুর কপালে ছেলে-ভুলোনো গোছের একটা চুমু খায়। দরজা জানলা খোলা, নবেন্দুর গায়ে রোগশয্যার বাসি গভীর গন্ধ…অতসী জানলার দিকে তাকায়, ওখানে মাঠে বেলা যেন অফিসের জানান দিচ্ছে। “আমি চলি……।”

অতসী তার ঘরে গিয়ে দাঁড়াল কয়েক মুহূর্ত, টুকিটাকি গুছিয়ে নিল। যেন অতসী এখনও আছে, বা আবার ঘরে আসবে।

মনে মনে অতসীকে ঘরের সদর পেরিয়ে পায়ে চলা পথে নামতে দেখল নবেন্দু, খানিকটা হেঁটে বাতাবিলেবুর গাছতলা ডিঙিয়ে রাস্তায় উঠতেও দেখল। পিছন থেকে অতসীকে কেমন দেখাচ্ছে, নবেন্দু তাও পরখ করে দেখল। ও যদি জোরে হাঁটে রাস্তার লোক নজর করে দেখবে, যদি ধীরে হাঁটে……

হাতের টাকাটা বুড়ো আঙুলে কেমন গ্লানির সঙ্গে বিতৃষ্ণায় আহত মনে আস্তে আস্তে ঘষতে লাগল নবেন্দু। দুটো বরাদ্দ সিগারেট যেন নেহাত দায়ে পড়ে মঞ্জুর করে গেল অতসী। ডাক্তারের বারণ। তা ঠিক, বারণই। শুধু সিগারেটটাই কি বারণ? যদিও অতসী নেই, তবু অতসীকে যেন মুখোমুখি পেয়ে নবেন্দু থরথরে গলায় জ্বালা-জ্বালা চোখে বলল, শুধু কি সিগারেট খেতেই বারণ করেছে আমায় ডাক্তার সেন? কি কি বারণ করেছে, কি কি করতে বলেছে, তুমি কি সবই মানছ? আমায় তুমি সকালে মুরগির ডিম দুটো করে দাও, আধ সের দুধ? আমায় তুমি ভাল মাছ কি মাংস খাওয়াতে পার? কমলালেবু? আমার নড়াচড়া একেবারে কি বারণ নয়, তুমি কি আমায় বিছানায় পুতুলের মতন চব্বিশঘণ্টা শুইয়ে রেখেছ? আমি যে নিজের হাতে খাই, কাঠের পুতুলের মতন আধ-পাশ হয়ে ফিরি, আমি যে…….

মাঠের বুক দিয়ে মস্ত এক ছায়া হু হু করে ভেসে যাচ্ছিল। রোদ একটু চাপা চাপা। নবেন্দু ছায়া দেখতে লাগল। অল্পক্ষণের মধ্যেই ছায়া কোথায় চলে গেল, নবেন্দু দেখতে পেল না।

ওরা এসে গেছে ওদিকে। নবেন্দু দেখেত পাচ্ছিল, গাছ কাটার দলটা দূরে এসে গেছে। মাঠের পুব দিকের গাছটা পরশু কাটা শেষ হল। আজ আবার একটা শুরু হবে। ক’টাই বা গাছ, ছ’ না সাতটা যেন। এত বড় মাঠের মাত্র ওই ক’টা গাছ তাও রাখবে না। কার গাছ? কি গাছ? জামরুল, কাঁঠাল, জাম? নবেন্দুর পক্ষে জানা সম্ভব নয়। অনেকটা দূরে গাছগুলো। একটা গাছই যা সামনে, নবেন্দুর চোখে পড়ে, পাতাগুলো পর্যন্ত চেনা যায়, কাঠচাঁপা। কাঠচাঁপার কাঠ বেচা যায় না। ওটা থাকবে। বাকিগুলো এখন কাটা হবে, কাঠ বেচা হবে।

হাতের টাকাটা বালিশের তলায় রাখল নবেন্দু। মাঠের রোদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে অতসী কতদূর চলে গেছে এতক্ষণে ভাবল একবার। এখনও বেশি দূর যেতে পারেনি। অতসী কি একটা সাইকেল রিকশা নেবে? নিতে পারে। স্টেশন অনেকটা দূর। অন্তত, অতসী হেঁটে এতক্ষণে যদি গির্জের কাছাকাছিও গিয়ে থাকে তবু আরও পনের বিশ মিনিটের রাস্তা। এতখানি রাস্তা কি হাঁটবে অতসী?

রেলের মেয়ে টিকেট কালেক্টাররা কি গরম জামা গায়ে দেয় না? তাদের কি শীত নেই?

নবেন্দুর নিজেরই এখন শীত শীত করছিল। মাঠটার শীত নেই, দিগন্ত মেলা গরম রোদের মধ্যে পড়ে আছে। নবেন্দুকে কেউ যদি ওই রোদে খানিকক্ষণ শুইয়ে দিয়ে আসে!…আলতো করে ডান হাতের আঙুল দিয়ে কপাল ঘষতে লাগল, নিজের আঙুলের ডগার ঠাণ্ডা কপালের শুকনো খসখসে চামড়ায় অনুভব করতে পারছিল নবেন্দু। মাথাটা ঠাণ্ডা। অতসী আজ ভাল করে মাথা ধুইয়ে দেয়নি, আজ তার তাড়া ছিল, তবু মাথা ঠাণ্ডা। নবেন্দু আঙুলের ডগায় চুল টানল, টিপে টিপে জল দেখল, চুলে জল আছে, অতসী ভাল করে মাথা মুছিয়ে দিতে পারেনি। অফিসের তাড়ায় অতসী দায়সারা কাজ সেরেছে।

নবেন্দু মাঠের দিকে চেয়ে মনে মনে অতসীকে দেখল। সাইকেল রিকশায় বসে আছে অতসী। ডি এস অফিসের সামনে দিয়ে সোঁ-সোঁ করে ছুটে চলেছে সাইকেল রিকশাটা। ছবিটা প্রায় স্পষ্ট নির্ভুল করে দেখবার জন্যে নবেন্দু চোখ বুজল। দেখতে পেল: পিচ বাঁধানো চওড়া মসৃণ রাস্তা, দু পাশে গাছের সার, ছায়া বেশি রোদ কম, সাইকেল রিকশার ওপর অতসী বসে, রিকশাটা কাঁপছে দুলছে টাল খাচ্ছে, উড়ে চলেছে রিকশাটা, রিকশাঅলা হ্যাণ্ডেলে বুক প্রায় লেপটে দিয়ে প্যাডেল মারছে; বাতাসের দাপটে অতসীর পায়ের কাছে কাপড় আরও ফুলে ফেঁপে উঠেছে, আঁচল উড়ছে।

ওর কি শীত করে না? ডি এস অফিসের ঠাণ্ডা কনকনে হাওয়া যেন এতদূরে এসে নবেন্দুকে কাঁপিয়ে দিয়ে গেল। র‍্যাপার গলার কাছে আরও ঘন করে রাখল নবেন্দু। মাঠের রোদ, গভীর ঘন দয়ালু সুন্দর রোদ দেখতে লাগল করুণ অসহায় চোখে।

নবেন্দু অনুভব করতে পারছিল, রোদের—সামান্য একটু শীতের রোদের জন্যে ওর মন ছটফট করছে। নিজেকে বড্ড ঠাণ্ডা লাগছে, চোখ ঠাণ্ডা, ঠোঁট ঠাণ্ডা, হাত ঠাণ্ডা। নিজের হাতের চামড়া দেখতে ইচ্ছে করছিল নবেন্দুর। দেখল না; দেখতে সাহস হল না। হাত দুটো আগের মতন মোলায়েম মসৃণ নেই, কেমন খসখসে খড়ি ওঠা ওঠা, ছিট ছিট সাদা দাগ ধরতে শুরু করেছে হাতে, নবেন্দু সাহস করে এক পলক দেখে নিল, কত যেন বয়েস হয়ে যাচ্ছে হাত দুটোর, বয়েস হচ্ছে, বেজুত হচ্ছে, রক্তমাংসর গন্ধ হারাচ্ছে …।

মাঠে গাছ কাটা শুরু হল। না, এখনও শুরু হয়নি। হবে। দুটো লোক জামা খুলল। নবেন্দু দু চোখ তীব্র করে মাঠের মানুষ দুটিকে দেখবার চেষ্টা করল: এদের জামা খোলা সবল গা, বুক পিঠ কোমর মেরুদণ্ড…

আস্তে করে, নিজের অজান্তে, নবেন্দু ডান হাতটা তার নিজের গায়ে রাখল। কাঠের মতন শক্ত বস্তুটা অনুভব করতে পারল নবেন্দু। ওর বুক নেই, পিঠ নেই, চামড়ার স্পর্শ নেই, হাড় ছোঁয়া যায় না। প্লাস্টারের খাঁচার মধ্যে একটি মানুষের বুক পিঠ পেট মুড়ে রেখে শরীর বিজ্ঞানের ক্রিয়াটুকু চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। বুকের কোথায় হৃৎপিণ্ড বাজছে, কোথায় যে ফুসফুস এই মুহূর্তে ভারি হয়ে এল, বেদনায় অসাড় হয়ে গেল, নবেন্দু হাত রেখে অনুভব করতে পারবে না।

এতক্ষণে স্টেশনে পৌঁছে গেছে অতসী। তার পৌঁছনোর পর প্লাটফর্মের টিকিট কালেক্টারদের ঘরখানা একটু এলোমেলো হয়ে যাবে। একজন চা খেতে খেতে ওর ফোলানো ফাঁপানো মাড়-খসখসে শাড়ি দেখবে, সিগারেট টানবে, চোখ বুজবে আর মাঝে মাঝে খুলবে, অন্যজন ওর বাসন্তী রঙের ব্লাউজের দিকে হাঁ-করে চেয়ে থাকবে; গলা ঘাড় মুখ আর-আর কিছু দেখার মতন লোকও ওখানে স্টেশন প্লাটফর্মে অঢেল।

একটুক্ষণ অন্যমনস্ক থেকে শেষে মাঠের দিকে তাকাল নবেন্দু। গাছ কাটা শুরু হয়ে গেছে। দূর থেকে নিয়মিত ছন্দ রেখে জোড়া কুড়ুলের শব্দ ক্ষীণ হয়ে ভেসে আসছে। নবেন্দু গাছ কাটার শব্দ শুনতে লাগল। অস্পষ্টভাবে দুটি গা-খোলা মানুষের কালো কালো চেহারা মাঠে ভাসছিল।

নবেন্দু নিজের গোটা চেহারাটার কথা ভাববার কথা চেষ্টা করছিল। এখন ঠিক ঠিক ভাবা যায় না। অনেক দিন আগে দেখা কোনো স্বপ্ন মনে করার মতন, মনে পড়ে না, একটু-বা পড়ে। অথচ এ অনেক পুরনো কিছু নয়। গত শীতেও নবেন্দু রোদে তেল কুয়ার জলে প্রাণভরে স্নান করেছে। ওর বুক ছিল, পিঠ ছিল, মেরুদণ্ড ছিল…আজ এই বুক পিঠ মেরুদণ্ড গাঁথা শারীরিক আকারটা মনে করা মুশকিল, তবু নবেন্দু অনুভব করতে পারে, আকারটা বিসদৃশ ক্ষীণ অথবা জন্তুর মতন ছিল না। মানুষের, স্বাভাবিক সুস্থ মানুষের মতন ছিল। অতসী এই বুকে মাথা রেখেছে, বিছানায় শুয়ে এই পিঠে মুখ ঘষেছে…।

অতসী, আমার কি নিজের বুক আছে, সেই পিঠ, মেরুদণ্ড…? আমি কি মাঠে খোলা গায়ে রোদ মেখে দাঁড়িয়ে থাকতে পারব? তুমি কি আর কখনও আমার বুকে মাথা রাখবে, তোমার মাথার কাঁটার আঁচড় লেগে বুকটা ছড়ে যাবে?

মাঠে হরিয়াল নেমেছে। এ দেশে বুঝি এই একটা হরিয়ালই আছে। মাঝে মাঝে মাঠটায় আসে। নবেন্দু হরিয়াল দেখছিল। গাছ কাটার শব্দ ভেসে আসছে। রোদটা যেন এইবার আড়মোড়া ভাঙল।

“দাদাবাবু।” লছমির মা ঘরে এসেছে।

নবেন্দু বালিশ থেকে মাথা সরাল এ-পাশে। দরজা ডিঙিয়ে লছমির মা দাঁড়িয়ে আছে। বেঁটে গোলগাল সবল চেহারা। রঙ কালো। মুখে তৎপরতা। নবেন্দু এক পলক সুস্থ সবল মেয়েটার বুকের দিকে তাকাল। অপটু কুমোরের হাতে তৈরি প্রতিমার মতন কেমন যেন ভোঁ ভোঁ তাল তাল সব, কিন্তু খুব কঠিন জীবন্ত। ওর—লছমির মার বেশ শক্ত কঠিন পিঠ এবং মেরুদণ্ড আছে: নবেন্দু প্রায় নিশ্চিতভাবে ভেবে নিল।

“ভাত আনব?” লছমির মার বাংলা কথা বলতে অসুবিধে হয় না। জিবের জড়তা তার অল্প। অনেককাল এদেশে বাঙালীবাবুদের বাড়িতে কাজকর্ম ছেলেবেলা থেকেই।

“আনো।” নবেন্দু দরজার মাথার ওপর টাঙানো ক্যালেন্ডারটা দেখছিল। বাংলা তারিখের ফালতু ক্যালেন্ডার। পা-মুড়ে হাঁটু-ভেঙে বসা এক মেয়ের ছবি গলবস্ত্র হয়ে প্রণাম করছে, সামনে বুঝি শ্রীকৃষ্ণ মূর্তি।

নবেন্দুর নিজের মার কথা মনে পড়ল। মার ভীষণ পুজো-আর্চার বাই ছিল। মা অনেকটা ওইভাবে বসত। মার বসা এমনিতেই সুন্দর ছিল। মার বসায় কেমন একটা নিবেদনের ভাব ফুটে উঠত। চোখ বুজে নবেন্দু মার সেই বসার ছবি মনে করতে লাগল।

লছমির মা ঘরে এল। ঘরের এক কোণ থেকে উঁচু হালকা তেপায়াটা নবেন্দুর বিছানার পাশে একেবারে খাট ছুঁইয়ে মাথার কাছে রাখল। বাইরে গেল। খাবার জলের গ্লাস এনে রাখল, আবার গেল, ভাতের থালা এনে রাখল।

নবেন্দু যখন চোখ খুলল, চোখের তলায়, পাতায় বেদনার গাঢ়তা, সাদা জমিটা আরও সাদা, স্বচ্ছ।

লছমির মাকে এবারে একটু সাহায্য করতে হয়। নবেন্দুকে একটা ভারি কাঠের পুতুলের মতন সামান্য মাথার দিকে তুলে সরাসরি পাশ ফিরিয়ে দিতে হয়, বালিশগুলো পিঠের দিকে প্রয়োজন মতন ঠেকা দিয়ে দিতেও হয়। নবেন্দুও দু হাতের ভরে নিজেকে খানিকটা সামলে নেয়।

লছমির মার গায়ের গন্ধ, হাতের ছোঁয়া, নবেন্দুকে আরও বিষণ্ণ করে। নোংরা কাপড়, ময়লা চামড়ার তলায় লছমির মার বুকে যে গন্ধটা আছে সেটা মার মতন, ঠিক মার মতন। এমন কি ওর হাতের ছোঁয়াতেও ঠিক এই মুহূর্তে নবেন্দু মাকে অনুভব করতে পারে।

ভাতের থালায় চোখ রেখে একটু অপেক্ষা করল নবেন্দু। ভাতের চালগুলো কেমন হলুদ হলুদ রঙ। অতসী কি ভাতের হাঁড়িতে হলুদ ফেলে দিয়েছে? ওটা কি? পেঁপে সেদ্ধ। পালংশাকের তরকারিটাও দেখল নবেন্দু। আজ ছোট ছোট মাছ।

“কি মাছ?” নবেন্দু ডান হাত বাড়াল।

“নদীর।” লছমির মা দাদাবাবুর হাতে সন্তর্পণে একটু জল ঢেলে দিল।

“বড় মাছ বাজারে ছিল না?” নবেন্দু ভাত ভাঙতে লাগল।

“তিন টাকা সের।”

লছমির মা চলে গেল। নবেন্দু পেঁপে সেদ্ধগুলো পাতের এক পাশে ঠেলে রাখল। একটু ডাল তুললো আঙুলের আঁজলায়। জঘন্য পালংশাকের তরকারিটা কালো। বাঙালদের মতন লঙ্কা খেতে শুরু করেছে অতসী।… তুমি কার মুখের স্বাদের মতন রান্না কর অতসী, তোমার না আমার? মাছের বাটিটা ভাতের ওপর। উলটে দিল নবেন্দু। কড়ে আঙুলের মতন ক্ষুদে ক্ষুদে মাছ, কাঁটায় ভর্তি। কয়েক গাল ভাতের পর গ্রাসটা গলায় আটকে গেল নবেন্দুর। যেন ভীষণ শক্ত একটা ইটের টুকরো কেউ তার গলার মধ্যে পুরে দিয়েছে। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের কষ্ট হচ্ছিল তার। গলার কাছটা ফুলে উঠেছে, টনটন করছে।

জল খেল নবেন্দু। ভাতের গ্রাস গলা থেকে নেমে গেল, ব্যথা গেল না। মাঠের দিকে তাকাল। মাঠ ফাঁকা। গাছ কাটা বন্ধ, ওরা জিরোচ্ছে, রোদ পাশ ফিরেছে, আঁচের মতন রঙটা গাঢ় ঘন হয়ে আসছে। হরিয়ালটা কখন উড়ে গেছে কে জানে।

নবেন্দু তার বুকের ভার এবার অনুভব করতে পারল। গলার নালীতে যে আবেগ এতক্ষণ ধরে পুঁটলি পাকাচ্ছিল, শক্ত করুণ কষ্টকর হয়ে শেষে অসহ্য হয়ে উঠল, নবেন্দু সে-আবেগকেও অনুভব করতে পারল। চোখে জল জমছে বোধ হয়, রোদের গায়ে ঝাপসাটে ভাবটা ফুটে উঠল।

আজ যদি মা থাকত…! নবেন্দুর মা যেন ওই ফাঁকা রোদভরা মাঠে দাঁড়িয়ে আছে, নবেন্দু কেমন প্রত্যাশার চোখে মাঠের দিকে তাকিয়ে মনে মনে তার এই অসহায় অবস্থার কথা বলতে চাইছিল। তুমি বেঁচে থাকলে আজ আমার কাছে সারাক্ষণ থাকতে, সারা সকাল, সারা দুপুর, সারা বিকেল।

দুধের বাটিটা এক চুমুকে শেষ করে গ্লাসের পুরো জলটাই খেয়ে ফেলল নবেন্দু। দুধ এবং অতটা জল পেটে পড়ার পরও নবেন্দু বুঝতে পারল, সে ক্ষুধার্ত রয়েছে। প্রায়ই তাকে এই রকম ক্ষুধার্ত থাকতে হয়।

অতসী এখন কি করছে? প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে পান খাচ্ছে বোধ হয়। মেল ট্রেনটার অপেক্ষা করছে। অতসীর পাশে নন্দী দাঁড়িয়ে আছে। হাসাহাসি হচ্ছে। নন্দী নাকি ফুর্তিবাজ খুব। ফুর্তির চোটে দিন দিন মোটা হচ্ছে। ঘুষের পয়সায় ওজন বাড়াচ্ছে।

লছমির মা এক ঘটি জল হাতে ঘরে এল। নবেন্দু হাত ধুল, ভাতের থালার ওপর। ভাত ডাল তরকারি মাছ মাখা গ্রাস নোংরা হয়ে সমস্ত থালায় ছড়িয়ে গেল। বিশ্রী দেখাচ্ছিল থালাটা। নবেন্দু দেখছিল, অদ্ভুত একরকম আক্রোশ হচ্ছিল, কুলকুচোর মুখ ভর্তি জল থালার ওপর ফেলে দিল, ছুড়ে দিয়ে নিষ্ঠুর সুখ পাচ্ছিল নবেন্দু। মনে হচ্ছিল, সে যা খেয়েছে সবটা বমি করে ফেরত দিয়ে দিয়েছে। থালার চেহারাটা বমির মতনই দেখাচ্ছিল।

লছমির মা কিছু বলল না। এ-বাড়িতে কাজ করে সে অনেক কিছু জেনেছে, শিখেছে। থালাটা উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল। আবার এল, যেন গেল আর এল, এসে, টেবিলটা মাথার দিকে সামান্য সরিয়ে রাখল। জলের কেটলি। বার বার তেষ্টা পায় নবেন্দুর। অন্য একটা বেতের পা-ভাঙা টেবিল বিছানার কাছে এনে দিল। টেবিলটার ওপর গোটা চারেক গোল গোল বোতল। নবেন্দুর হাতের নাগালের মধ্যে এ-সবই রাখতে হবে। অতসী ফিরে এসে বোতলগুলো ধুয়ে এনে আবার রেখে দেবে।

নবেন্দুকে আবার ধরতে হল। বালিশটা ব্যবস্থা মতন উঁচু করে নিয়ে সে আবার শোবে।

লছমির মার হাত থেকে নবেন্দু এবার সোডা সাবানের গন্ধ পেল। উগ্র ক্ষার গন্ধ।

লছমির মা চলে গেল। যাবার সময় ঘরের দরজাটা বাইরে থেকে টেনে দিল।

বালিশে মাথা রেখে নবেন্দু নিজেকে গুছিয়ে নিল। র‍্যাপারটা গলার পাশে বুকের দিকটায় মেলে দিল। লেপ পেটের ওপর পর্যন্ত টেনে নিল।

মাঠের দিকে চেয়ে থাকল নবেন্দু। রোদ ক্রমশই গাঢ় ঘন হচ্ছে, ঝকঝকে ভাবটা আর নেই। কাঠচাঁপার গুঁড়ির কাছে ছোট্ট ছায়া। একটা ধুনুরি মাঠ পেরিয়ে চলে যাচ্ছে। গাছ কাটা লোক দুটো এখনও বসে আছে। দুটো মোষ চরছে এক পাশে। মাঝে মাঝে ধুলো উড়তে শুরু হয়েছে।

অতসীদের স্টেশনে মেল ট্রেন এতক্ষণে চলে এসেছে। অতসী লেডিজ কম্পার্টমেন্টে উঠে টিকিট দেখে নিচ্ছে যাত্রীদের। অতসীদের হাতে সেই টিকিটকাটা যন্ত্র, অতসীর হাতে একটা ছোট খাতা। মেল ট্রেন চলে গেলে অতসী চা খাবে।

নবেন্দুর সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছিল। বালিশের তলায় অতসীর দিয়ে যাওয়া টাকাটা আছে। …না, অতসীর টাকা খরচ করবে না নবেন্দু। বড্ড পরিশ্রমের পয়সা, অনেক ঘামের পয়সা তোমার, আমি সিগারেট খেয়ে নষ্ট করব না। তা ছাড়া ডাক্তারের বারণ—।

প্লাটফর্মে অতসীর ভারিক্কি চালে ঘুরে বেড়ানোর ছবিটা নবেন্দুর চোখে পড়ল। গায়ে হাওয়া এবং রোদ লাগিয়ে অতসী ঘুরছে, এক সময় মেল ট্রেন ছেড়ে দিল। অতসী নন্দীকে একটা ডবলু-টি দিয়েছে। এবারে নন্দীর খপ্পর। মেয়ে ডবলু-টি, খুব বেশিক্ষণ দর কষাকষি চলবে না। হয়ত মেয়েটির রুমালে বাঁধা থার্ড ক্লাসের টিকিটও আছে বর্ধমান পর্যন্ত। বাড়তি পথটুকুর জন্যে আর কত? আপার ক্লাসে আসার জন্যেই বা আর কত? অতসী ওয়েইং-মেশিনটার কাছে দাঁড়িয়ে আড়চোখে-চোখে নন্দীর কাজ গুছোনো দেখছে। এই মেল ট্রেনটা আজকের দুপুরে দেড় দু টাকা দেবে অতসীকে। নিজের হাতে এত সব পারে না অতসী। পারে না।

বালিশের তলা হাতড়ে প্যাকেটটা পেল নবেন্দু। কাল সন্ধ্যাবেলা যামিনী দেখা করতে এসেছিল। যাবার সময় প্যাকেটটা ফেলে গিয়েছে। রাত্রে এবং আজ সকালে তিনটে সিগারেট মোট খেয়েছে নবেন্দু, আরও গোটা তিনেক আছে।

একটা সিগারেট ধরাল নবেন্দু। দেশলাইয়ের জন্যে হাঁক দিতে হল না। বালিশের তলাতেই আছে।

মাথার চারপাশে নবেন্দুর সমস্ত সংসার। এর কোথায় যে রুমাল আছে, মাফলার আছে, দেশলাই আছে, কার কার চিঠি, দু একখানা উপন্যাস, আইসোপ্যাসকেলের শিশি, ইনহেলার, মাথা ধরার মলম—নবেন্দুই জানে।

সিগারেট ধরিয়ে নবেন্দু আস্তে আস্তে টান দিল। মাঠের দিকে তাকাল। একটানা ঘাস থাকলে মাঠটা বেশ সবুজ দেখাত। মাঠের মধ্যে সবুজ রঙটা ছিটিয়ে রয়েছে। যেখানে সবুজ সেখানে রোদ কটকট করছে না, বৃক্ষ তৃণহীন লাল মাটিতে রোদ কেমন শুকনো শুকনো। কটা কাক এসেছে। আবার এক সময় চলে যাবে। গাছ কাটা আবার শুরু হল।

নবেন্দু বা হাত মাথার উপর দিয়ে বালিশের পেছনে নিয়ে গেল। মোটা বইটা টেনে নিল অক্লেশে। তিনশো একুশ পাতা পর্যন্ত পড়া হয়েছে। বইটা শুরু করার আগে সিগারেট শেষ করবে নবেন্দু।

অতসীর এতক্ষণে চা খাওয়া শেষ হল। প্লাটফর্মের ঠাণ্ডা ঘরটায় কতক্ষণ ও বসে থাকবে কে জানে! কেন যে বসে থাকে তাই বা কে বলবে। ওর কি শীত করে না? পৌষের এই শীতে একটা গরম কিছু গায়ে না দিয়ে অতসী কি করে যে বাইরে বেরুল?

সিগারেট শেষ হল নবেন্দুর। টুকরোটা জানলার দিকে ছুড়ে দিল। ডান হাত বাড়িয়ে জলের কেটলিটা তুলে নিল, জল খেল সামান্য, কেটলি রেখে এবার বইয়ের পাতা খুলল। তিনশ পঁচিশ পাতার তলার দিকটায় একবার চোখ বুলিয়ে পাতা উলটে চব্বিশে চলে গেল।

‘ঘরে রুমা বৌদি নেই, দরজায় তালা ঝুলছে।’ তিনশ পঞ্চাশ পাতার মাঝখানে নবেন্দুর চোখ থামল। মন এলোমেলো হল। লছমির মা কাপড় টাপড় কাচছে। আছড়ে আছড়ে। শব্দ কানে লাগছে। কেমন যেন ক্লান্তিকর এই শব্দটা। মাঠ থেকে গাছ কাটার শব্দও ভেসে আসছে। নবেন্দুর মনে হল তার দুপাশে ঘরে বাইরে—ক্রমাগত ক্লান্তিকর প্রাণহীন দুই শব্দ তাকে আরও ক্লান্তি আরও শূন্যতার মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে।…অতসী তাকে প্রত্যহ এই রকম এক শূন্যতার মধ্যে রেখে দিয়ে চলে যায়। সারাটা দুপুর সে একা—একা। তুমিও আমার ঘরে তালা ঝুলিয়ে চলে যাও অতসী। একদিন আমি এবাড়ির দরজায় তালা ঝুলিয়ে চলে যাব, অফিস থেকে ফিরে এসে তুমি দেখবে আমি নেই, দরজায় তালা ঝুলছে।

চোখের সামনে থেকে বই সরিয়ে খাঁ খাঁ মাঠের দিকে চেয়ে থাকল নবেন্দু। রোদ হলুদ হয়ে আসছে। বাতাস নেমেছে মাঠে। এই দুপুরে মাঝে মাঝে পাতা খসে পড়ে, উড়ে উড়ে চলে যায়। দুপুরে মাঠটাকে বড় একঘেয়ে লাগে। যেন এই মাঠের ঘরেও কোথাও কেউ তালা ঝুলিয়ে চলে গেছে।

চোখ জড়িয়ে আসছিল। মাথার তলায় কোথায় একটা অবশ অনুভব ক্রমেই গভীর হয়ে চোখের পাতা ভারি করে তুলেছে। নবেন্দু বুঝতে পারল, তার ঘুম আসছে। বই পাশে রেখে দিল। ঘুমের কাছে এই মনটাকে এখন পুরোপুরি তুলে দেবার জন্যে নবেন্দু তৈরি। এখন তার ঘুমোবার ইচ্ছে করছে ভীষণ, ঘুমিয়ে এই ক্লান্তি—বিরক্তিকর ক্লান্তি সে ভুলে থাকতে চায়। চোখ বুজল নবেন্দু, একটা হাত চোখের পাশ দিয়ে টেনে নিল, আলো আড়াল করে পড়ে থাকল। অতসীকে স্টেশনে রিফ্রেশমেন্টরুমে একবার দেখতে পেল নবেন্দু, পরিমল মুখুজ্যেকে দেখল; বেনারস এক্সপ্রেস এল, তারপর সমস্ত কেমন বিশৃঙ্খল আবছা হয়ে এক সময় ঘুম এল। নবেন্দু ঘুমিয়ে পড়ল।

তন্দ্রার মধ্যে চড়াইগুলো কিচমিচ করে উঠতে নবেন্দু বিরক্ত হল। দুরে কোথায় যেন কাকও ডাকছে। সাইকেল রিকশা থেকে নামছিল নবেন্দু, হঠাৎ এই ঘুম এবং স্বপ্নের দরজাটা কেউ দু হাতে ধাক্কা দিয়ে পুরোপুরি খুলে দিল। নবেন্দু চোখ খুলে জানলার দিকে তাকাল। একটুক্ষণ আচ্ছন্নতার মধ্যে ঠিক বুঝল না, সকাল না বিকেল; পর মুহূর্তেই বুঝতে পারল বিকেল হয়ে গেছে, নবেন্দু বিছানায় শুয়ে।

বিকেল হয়ে গেছে। নবেন্দু মাঠের দিকে তাকাল। শীতের রোদ মরে এল। মাঠের রঙ ফিকে হয়ে এসেছে। কাঠচাঁপার ওপাশে ছায়া গড়িয়ে যাচ্ছে। হাত বাড়িয়ে জলের কেটলিটা নিতে গেল নবেন্দু। লছমির মা নিয়ে গেছে। তার বদলে জল রেখে গেছে এক গ্লাস। জল খেয়ে গ্লাস রেখে দিল নবেন্দু। টেবিল থেকে শিশি টেনে নিল।

নবেন্দু এবার আস্তে আস্তে অন্য কাজগুলো সেরে ফেলল। ওষুধ খেল, বিছানার এক পাশ থেকে রুমালটা হাতড়ে নিয়ে মুখ মুছল, বই বালিশের পাশে রেখে দিল। লছমির মা বিস্কুটে মাখন লাগিয়ে গোটা চারেক বিস্কুট আর চা দিয়ে গেল। অদ্ভুত এক ধরনের অন্যমনস্কতার মধ্যে একে একে প্রত্যেকটি কাজ সারতে লাগল নবেন্দু, যেন সব সেরে তৈরি হয়ে সে কারও অপেক্ষায় বসে থাকবে।

শীতের পড়ন্ত বিকেল প্রতি পলকে ফুরিয়ে যাচ্ছে। মাঠের কোল থেকে ফিরে প্রায় অন্তঃসারশূন্য রোদটুকু উঠে যাচ্ছে। গাছ কাটার শব্দ থেমেছে। উলটো পালটা হাওয়ার দমকা আর নেই। মাঠটা এখন ভীষণ নিস্তব্ধ, রিক্ত, শূন্য; একটিও পাতা উড়ছে না, একটিও পাখি নেই কোথাও।

নবেন্দু এই মুমুর্ষূ রিক্ত মাঠের দিকে চেয়ে আছে। এখন বাইরের ছায়ার সঙ্গে পা মিলিয়ে তার মনে আস্তে আস্তে অদ্ভুত এক বিষণ্ণতা, অধৈর্য, বেদনা নামবে, ছায়া যত ঘন হবে শীতের সন্ধের অন্ধকারে ডুবে যারে, নবেন্দুর মনের এই শূন্যতা আকুলতা ততই আশ্চর্য এক হাহাকারে অসাড় হয়ে আসবে।

এই বিকেল-যায় সন্ধে-হয় সময়টা নবেন্দুর কাছে অসহ্য। এই সময়টা তাকে শুকনো পাতার মতন তুলে নিয়ে কোথায় না উড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়! অতীতে নিয়ে যায়, বর্তমানে ফিরিয়ে আনে, ভবিষ্যতের দিগন্তে ছুড়ে দেয়। এই সময়টা তাকে কিসের এক জালে জড়িয়ে ফেলে। নবেন্দু মনকে মুক্ত করতে পারে না।

রক্ত ওঠা অবসন্ন মুমুর্ষূর মতন শেষবার রক্ত তুলে মাঠটা যেন মরে গেল। আলো নেই। আয়নার কাচের রঙের মতন কেমন জলো রঙ ছড়িয়ে আছে চার পাশে। দূরের জঙ্গল দূরান্তে কালো মেঘ হয়ে গেছে। বিক্ষিপ্ত চিকণ স্বরে মাঠটা ভরে গেছে। ঝাঁক বেঁধে পাখিরা ফিরছে।

অতসী ফিরছে না। অতসী এখনও স্টেশনে। ও-পাশে বাতাবি লেবুর কাছে রাস্তাটা এখন ভরে গেছে। কত লোক ফিরছে। সাইকেল রিকশা ঘন্টি বাজিয়ে আসছে, যাচ্ছে, আসছে। মিউনিসিপালিটির বাতিগুলো জ্বলে উঠেছে বোধ হয়।…আমায় পাশের ঘরে বিছানা করে দাও না কেন, অতসী? ও পাশের ঘরে জানলার কাছে বিছানাটা থাকলে আমি শুয়ে শুয়ে রাস্তাটা দেখতাম। দেখতাম, সারাদিনের কাজ চুকিয়ে যারা ফিরছে তাদের ভিড় ফাঁকা হয়ে গেলে কতক্ষণ পরে তুমি ফের!…আমি অফিস থেকে ঠিক এই সময় ফিরতাম। এই সন্ধে হয়-হয় মুখে। তুমি কেন ফের না?

গাঢ় ছায়ায় মাঠ ভরে গেল। অন্ধকার নামল। নবেন্দু চোখের সামনে আর কিছু দেখতে পাচ্ছিল না। অন্ধকার যেন কুয়াশার মতন চার পাশ থেকে ভরে আসছিল। একটা বুনো পাখি কান্নার মতন ককিয়ে ককিয়ে ডাকছিল। পৌষের শীত হঠাৎ গা কাঁপিয়ে দিয়ে গেল।

এখনও তুমি স্টেশনে বসে আছ, অতসী। তোমার কি সন্ধে হয় না? তোমার কি ডিউটি ফুরোয় না? তোমার অবস্থা বুঝে যারা এত সাহায্য করছে চাকরিতে, ডিউটিতে আসা-যাওয়ার, তারা কি তোমায় দানাপুর এক্সপ্রেসের আগে ছেড়ে দিতে পারে না? তোমার নন্দী, পরিমল, সিং, এরা তোমায় এই সন্ধেটুকু ধরে রেখে দিয়ে কী পায়? তুমিই বা কী পাও?

সন্ধে হল। নবেন্দুর চোখের সামনে থেকে সারা-দিনের মাঠ হারিয়ে গেল। নবেন্দু জানলার বাইরে শুধু অন্ধকার আর শূন্যতা অনুভব করছিল। এবং পৌষের শীত।

লছমির মা বাতি জ্বালিয়ে টেবিলের উপর রেখে গেল। নবেন্দু যেন এই মুহূর্তে মরে ছিল। তার সাড়া ছিল না, শব্দ ছিল না, সমস্ত শরীরটা সোজা কাঠ অনড় হয়ে পড়েছিল।

অতসী ফিরল। বারান্দায় গলার শব্দ পাওয়া গেল লছমির মাকে কী যেন বলল অতসী। জুতো খুলছে ঘরের বাইরে। জুতো খুলে ঘরে এল। পাশের ঘরে। ও-ঘর অতসীর। নবেন্দু বুঝতে পারল না, অফিস থেকে ফিরে এসে ঘরে একা একা কি করে অতসী। হয়ত স্টেশনের সারাদিনের নানান সঞ্চয়ের হিসেব করে, কোথাও কিছু রাখার হলে সযত্নে রাখে। …আমি তোমার ঘরে যাচ্ছি না অতসী, আমার ক্ষমতা নেই, তুমি যেখানে খুশি যেমন খুশি তোমার সঞ্চয় মেলে রেখো, আমি দেখতে পাব না।

অতসী আবার বারান্দায়। লছমির মার সঙ্গে কথা বলছে, হাত মুখ ধুচ্ছে।

না, না আমি কিছু মনে করছি না, অতসী। হাজার হোক, এই ঘরে শুয়ে থাকার জন্যে আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ, এই যে বাতিটুকু জ্বলছে এ-বাতিও জ্বলত না যদি-না তোমার পয়সায় লছমির মা কেরোসিন কিনে আনত। তুমি আমায় ন’ মাস বাঁচিয়ে রেখেছ। কে জানে আরও কত কাল রাখবে। আমার প্রতিটি দিনের বাঁচা আজ তোমার মুঠোয়। তুমি ঈশ্বরের মতন আমার আয়ু নিয়ে বসে আছ পাশের ঘরে।

অতসী এ-ঘরে এল। এক হাতে চায়ের কাপ, অন্য হাতে নবেন্দুর দুধের গ্লাস। সকালের মতনই ময়লা শাড়ি, ময়লা জামা। নবেন্দুর মাথার কাছে তে-পায়ায় দুধের গ্লাসটা রাখল অতসী। বিছানার এক পাশে বসল।

“তোমার প্লাসটার আগামী রবিবারে পালটাবে।” অতসী চা খেতে খেতে বলল।

নবেন্দু স্ত্রীর মুখের দিকে চেয়ে থাকল। এত মিটমিটে আলোয় ভাল করে কিছু দেখা যায় না।

“তুমি কি সেনের কাছে গিয়েছিলে?” নবেন্দু শুধলো।

“না।…স্টেশনে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল, ছোট বোনকে নামাতে এসেছিলেন।” অতসী কি যেন ভাবতে ভাবতে বলল। চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে মাথা ওঠাল আবার, স্বামীর বুক এবং পেটের দিকে তাকাল, ‘আবার আড়াইশো টাকা—’

আবার আড়াইশো টাকা। মনে মনে নবেন্দু টাকাটার হিসেব করল। আগেও দু দফা আড়াইশো করে গেছে।

“এক্সরে আছে, রক্ত পরীক্ষা আছে…” অতসী যেন বুকের তলা থেকে ঘুমের ঘোরে দুঃস্বপ্নের মতন কথা বলছে।

নবেন্দুর কে জানে কেন, চোখে জল আসছিল। বুকের তলায় কে যেন ফুসফুস দুটো ফুলিয়ে ফুলিয়ে ভীষণ ভারি করে তুলছে। যন্ত্রণা হচ্ছিল খুব।… তোমায় বাঁচাবার জন্যে অতসী আবার এক দমকা আড়াইশো তিনশো খরচ করবে, নবেন্দু। নিজেকেই যেন মনে মনে বলল নবেন্দু।

ঘর চুপচাপ। দেওয়ালগুলো প্রায় অন্ধকার। কড়ি-কাঠের দিকে চোখ তুলে অপলকে চেয়ে থাকল নবেন্দু।

“ভাবছি বালা জোড়া এবার বেচব।” অতসী বলল, খাটো গলায়।

“আমায় বাঁচাতে গিয়ে তোমার অনেক কিছু যাচ্ছে…” নবেন্দুর গলার স্বর মদ ভারি।

নবেন্দুর কথা অতসী শুনল না বোঝা গেল না। আগের মতনই হতাশ গলায় বলল, “কিছু ধারও করতে হবে। দেখি—। পরিমলবাবুকে বলব … গোটা পঞ্চাশ টাকা দিতে পারবেন বোধ হয়—”

আবার চুপচাপ। নবেন্দু পরিমলকে ভাবছিল। সুন্দর দেখতে ছোকরাকে। চমৎকার স্বাস্থ্য। ইনস্টিটিউটের থিয়েটারে নায়ক সাজে। “ভদ্রলোকের সঙ্গে তোমার। দেখা হয়েছিল বুঝি আজ?” নবেন্দু জানলার দিকে চেয়ে আচমকা শুধলো।

“হয়েছিল।”

পর পর এবার অনেকগুলো প্রশ্ন নবেন্দুর গলায় এল: তোমরা আজ রিফ্রেশমেন্ট রুমে চা খেয়েছ বুঝি? তোমায় ইনস্টিটিউশনের থিয়েটারে ওরা বুঝি নামাতে চায়? পরিমল তোমায় আজ সন্ধের পর আটকে রেখেছিল, না? ওর সঙ্গে স্টেশন থেকে রিকশা করে এক সঙ্গে ফিরলে—?

নবেন্দু সমস্ত প্রশ্নগুলোকে জানলা দিয়ে মাঠের ঘন অন্ধকারে যেন ভাসিয়ে দিল। না, এ-সব প্রশ্ন করা তার অনুচিত। আগামী রবিবার আড়াইশো টাকা গুণে দিয়ে তার মেরুদণ্ডের চার পাশ পিঠ বুক জড়িয়ে পাকে পাকে নূতন প্লাসটার হবে। এখন বুকের তলায় কি জমছে না জমছে দেখা উচিত নয়। উচিত না।

“দুধটা খেয়ে ফেল।” অতসী বিছানা থেকে উঠল। দুধের গ্লাস তুলে স্বামীর হাতে দিল। জানলার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল অতসী, জানলা আড়াল করে। হঠাৎ বুঝি পৌষের কনকনে শীত জানলা দিয়ে মুখ গলিয়ে অতসীর পিঠ ঠাণ্ডা অসাড় করে দিল। অতসী শীতে কাঁপল। “আ—, সারাদিন—সারাদিন এই জানলা খুলে রাখা। তোমার না ঠাণ্ডা লাগানো বারণ।” জানলার পাল্লা দুটো রূঢ় নির্মম হাতে বন্ধ করে দিল অতসী। স্বামীর দিকে তাকাল। “তোমার শীতও করে না?”

আ, অতসী, আমিও সারা সকাল সারা দুপুর সারা বিকেল তোমায় ওই প্রশ্নটাই করছি, তোমার শীত করে না!

অতসী বেতের মচকানো টেবিল থেকে দুটো আধ-ভর্তি বোতল নিয়ে চলে গেল। এখন সে আসবে না। এরপরে রান্নাঘরে।

নবেন্দু বন্ধ জানলার দিকে তাকাল। চোখের সামনে মাঠটা আর মেলা নেই। তবু এখন মাঠ ভরে যে-শীত অন্ধকার শূন্যতা, নবেন্দু পরিপূর্ণভাবে তা অনুভব করতে পারছিল। এই ঘরে এই আদিগন্ত মাঠটা সন্ধের পর চুপি চুপি রোজ এসে দাঁড়ায়। সারা রাত ধরে কারা যেন গাছ কাটে। নবেন্দু তবু চুপ করে পড়ে থাকে। একাদিনে অবশিষ্ট গাছ কটাও কাটা হয়ে যাবে—তখন নবেন্দু আর বিকেলের জন্যে কাঁদবে না। আমি কাঁদব না, অতসী; তোমার অপেক্ষা করব না। মাঠ আমায় নির্বাক নিশ্চল অনড় হতে শিখিয়েছে: মাঠের মতন আমি অন্ধ হব। আমি অন্ধ হয়ে মনে মনে। তোমার সিঁথির সিঁদুর দেখব, তুমি আমায় বাঁচিয়ে রেখেছ।

নবেন্দু দুধের গ্লাস মুখে তুলল।

1 Comment
Collapse Comments

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *