দুই বোন

দুই বোন

নিরুপমা আর অনুপমা। ছোট ক’রে নিরু আর অনু। দুই বোন। বড় নিরু, ছোট অনু। বড়য়-ছোটয় তফাতটা বাইশ মাসের। তবু দুয়ের পিঠে দুয়ের মতই পিঠোপিঠি দুই বোনকে যোল আর আঠারোয় এসে তফাত করা যায় না। আর এই দুয়ে মিলে যে একুন, তার ভারে মাধববাবুর ঘাড় সর্বক্ষণ টন্‌টন্ করা উচিত।

মেয়েদের মা শৈল। আইবুড়ো ধুমসো দুই মেয়ে পাথর হয়ে বুকে বসে আছে মার। বয়স বেশি হলে যে কাজে আসত, নিরু-অনুর সেই ভাই ফটিক মাত্র ন’ বছরের। শৈলের কাছে এটা একটা প্রকাণ্ড পরিহাস। ফটিক যদি আঠারোয় পড়ত এই ভাদ্রতে, উনি বলে-কয়ে হাতে-পায়ে ধরে ঢুকিয়ে দিতে পারতেন মাল-খালাসের অফিসে। তাতে, কম করেও হোক, রেশন আর মাসকাবারি কয়লা, ঘুঁটের খরচটাও তো উঠে আসত। কিন্তু এমনই ভাগ্য শৈলর, ফটিকটাই পেটে এল শেষে।

বেশি গজ্‌গজ্‌ করলে মাধববাবুও বিগড়ে যান। বলেন, আমি কি করব? পাত্র তো আর আমাদের ম্যাক্‌কেনা সাহেবের মুখের বাক্যিতে গজিয়ে উঠবে না! তা যদি উঠত, কবেই তোমার জামাই ধরে এনে দিতাম। হ্যাঁ, চাকরিবাকরির কথা হত, বুঝতাম। হত ফট্‌কেটা বড়-সড় দেখতে, ছোঁড়াটাকে ম্যাট্রিকটাও পাস করতে হত না; বেটাকে জুতে দিতাম কবে!

নিরু-অনুর বিয়ে নিয়ে যে তাদের বাপমার দুর্ভাবনার অন্ত নেই, পয়সাও নেই ছেলে কেনার— দুই বোনই তা স্পষ্টাস্পষ্টি বোঝে, জানে। এ নিয়ে হয়তো বেফাঁস একটা কথাও বলে বসে নিরু, অনুর তুমি বিয়ে দাও, মা— দেখতেও ও ভাল। আমার বাবা বিয়ে-ফিয়ের দরকার নেই।

অনু বলে, বয়ে গেছে আমার বিয়ে করতে। তুই না আমার দিদি! তোর আগে বিয়ে হোক্! আমার জন্যে তোর কপাল-ব্যথা রাখ।

দুই বোনের তর্কাতর্কি আরও একটু চড়ায় উঠলে শৈল ধমক দেয়, থাম তো তোরা! আর ক্যাচ্‌ম্যাচ্‌ করিস না বাপু। ঝালাপালা হয়ে গেল কান। কে দিচ্ছে তোদের বিয়ে? কার গরজ পড়েছে?

ইঙ্গিতটা মাধববাবুকে। কারণ, মাধববাবু তখনই বাজারের থলি হাতে বাড়ি ঢুকলেন এবং রান্নাঘরের সামনেই দাঁড়িয়ে। শৈল বলছে তখনও, সকালে একবার বাজারটা ঘুরে এলেন, এর পর অফিস, অফিস থেকে ফিরে তাসের আড্ডা, রাত্রে ঘুম।

—ভাদ্র মাসে বিয়ের বায়না কে ধরল?

মাধববাবু বাজারের থলিটা হাত বাড়িয়ে এগিয়ে দিতেই অনু গিয়ে ধরে ফেলল। নিরু ঢুকল ভাঁড়ার-ঘরে আনাজের ঝুড়ি আর বঁটি বের করতে।

ডাল সাঁতলাতে সাঁতলাতে শৈল চোখ-মুখ কুঁচকে তুলেছিল এমনিতেই, ফোড়নের ছিটেতে ফুঁসে উঠল, কে আবার! আমি—আমি!

—তুমি? মাধববাবুর এমনিতেই রসিক মেজাজ। ফোড়নের ঝাঁজে কাশতে কাশতেও রস-নেংড়ানো মন্তব্য করলেন, গেরস্তর অকল্যাণ করে ভাদ্র মাসেই তোমার পাত্র খুঁজতে পারব না আমি।

শৈল শব্দ ক’রে ডালের কড়াইটা নামিয়েছে— তার আগেই মাধববাবু সরে গেলেন। ফলাফলটা তাঁর তো অজানা নয়।

—ঢং। শৈল পলাতক স্বামীর দিকে তাকিয়ে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি হানল।

ঘরে ঢুকতে ঢুকতে মাধববাবু হাঁকলেন, নিরু, একটু চা দে। চান্‌টান করা যাক।

নিরুকে বলতে হয় না। চায়ের কেটলিটা উনুনে বসিয়েছে আগেই। সকালের চা আবার সেদ্ধ হচ্ছে। এমনিই হয় এই বাড়িতে।

চায়ের ভাঙা কাপ হাতে শৈলই গেল। রান্নাঘরের একপাশে আনাজ কুটতে কুটতে, একই কাচের গ্লাসে চুমুক-ভাগ ক’রে চা খেতে খেতে দুই বোনে গা টেপাটেপি করে, হাসে, ফিসফাস করে।

—মা এতক্ষণে বাবাকে—

অনু বাক্যটা শেষ না ক’রে উহ্য রাখে।

—বাবার কোনো কাণ্ডাকাণ্ড জ্ঞান নেই। নিরু কড়াইটা উনুনে বসিয়ে দেয়, আর তুইও মার সামনে অমন বিয়ে-বিয়ে করিস না তো। বড় বদ অভ্যেস তোর। হাজার হোক, মা গুরুজন।

—গুরুজন তো তুইও। পাল্টা জবাব অনুর, বিলুদার গল্পও তা হলে আমার কাছে তুই করবি না।

নিরুর মুখে আঁচ লাগে হঠাৎ।

—আহা, নিজে যেন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না। অশোক ছোঁড়াটার অত কি রোজ বই দিয়ে যাওয়া রে? লাইব্রেরিটা যেন ওঁর। নিরু এবার উল্টো চাপ দেয়।

—চুপ্‌ মা আসছে।

দুই বোনই চুপ করে যায়। দুজনেই একটু হেসে হঠাৎ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শৈল রান্নাঘরে এসে দাঁড়ায়। বড় মেয়েকে সরিয়ে নিজেই খুন্তি ধরে। মুখের কোথাও আর ঝাঁজ নেই মার। দু বোনেই আড়চোখে সেটা দেখে এবং চোখাচোখি করে হাসে। অনুমান করে নিয়েছে দুজনেই অদৃশ্য দৃশ্যটা।

এমনি অদ্ভুত তাদের সংসার। সব রকম দুঃখ-কষ্ট, মালিন্য আছে। তবু সব থাকার ওপর আছে তাদের বাবা-মা। বড় নরম, বড় ভাল— আর অনেক ভালবাসা যাদের ছেলেমেয়েদের জন্যে।

দুপুরে শৈল কখন একটু ঘুমিয়ে পড়ে। ফটিক স্কুলে। চোখে চোখে বাক্য বিনিময়। হয় দুই বোনে। নিরু ওঠে। আস্তে আস্তে একটা দেওয়াল খোপের আড়াল থেকে এক টুকরো পেন্সিল তুলে নেয়— হাতড়ে হাতড়ে এক ফালি কাগজও। তারপর পা টিপে টিপে বাইরে চলে যায়। মার পাশে শুয়ে শুয়ে অনু এক চোখ বইয়ের পাতায় আর এক চোখ মার দিকে রেখে কি ভাবে যেন। আচ্ছা অশোকদা তাকে যে বই এনে দেয়, তাতে ওই এক ভালবাসাবাসির গল্প কেন? পড়তে পড়তে সারা গা কেমন করে ওঠে, মনটাও ফাঁকা ফাঁকা লাগে। দু-একদিন স্বপ্নও দেখেছে-অনু।

শৈল পাশ ফিরলেই ধড়াস করে ওঠে অনুর বুক। দিদিটাও যেন কি? লেখা আর হয় না ওঁর! ঠিক একদিন হাতে-নাতে ধরা পড়বে। দেওয়ালে টিকটিকিটাও ঠিক এ সময়ে টিক্ টিক্ করে ওঠে। ইস্!

শেষ পর্যন্ত ধৈর্য রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে অনুর। উঠে পড়ে সেও।

—কি রে, হাঁ ক’রে কাক দেখছিস যে! হল তোর?

নিরু চমকে ওঠে। অনু দেখে, নিরুর হাতের কাগজ পেন্সিল উধাও।

নিরুর বুকের দিকে তাকিয়ে অনু ফিসফিস করে বলে, দিয়েছিস?

মাথা নাড়ে নিরু। হ্যাঁ, দিয়েছে।

—ও দিয়েছে? অনু জানতে চায়।

—হ্যাঁ।

—কই, দেখি!

—যা। নিরু লজ্জা পায়।

—দিবি না দেখতে? আচ্ছা। অনু শাসায়; একটু অভিমানও আছে তার সঙ্গে।

—তুই যেন কি। নিরু বুকের মধ্যে থেকে ভাঁজ-করা এক টুকরো কাগজ বের করে দেয় অনুর হাতে, এখানে দাঁড়িয়ে পড়িস না। কলঘরে যা। মা এসে পড়বে।

কলঘর থেকে ফিরে এসে চিঠির টুকরোটা নিরুর হাতে গুঁজে দেয় অনু।

—ধোপায় কাপড় দিয়ে গেছে কাল। আমার সেই খয়েরি শাড়িটা তুই পরিস দিদি- বিকেলে গা ধুয়ে। আমি তোর চুল বেঁধে দেব’খন।

—কি হবে শাড়ি পরে, চুল বেঁধে?

—আহা, শাড়িটা তোকে ভাল মানায় কিনা, তাই আদিখ্যেতা হচ্ছে। বেশ তো মার কাছেই চুল বাঁধিস, ঝুঁটি টেনে বেঁধে দেবে!

—শাড়ি পরে চুল বেঁধে বসে থাকব, আমায় কি দেখতে আসছে? নিরু আনমনা।

—আসতেও তো পারে তোর বিলুদা! ফিক্‌ ক’রে হেসে ফেলে অনু, একট ভাল ক’রে সেজে-গুজে থাকলিই বা! আজ তো বিকেলবেলায় ও আসবে লিখেছে মার কাছে। সেই ফাঁকে না হয়—

—বয়েই গেছে আমায় দেখতে! ও আসবে ওর কাজে আমার কি তাতে?

—বলা কি যায়? অনু একটা চিমটি কেটে দেয় নিরুর গায়ে। ঘুম ভেঙেছে মার।

বই দিতে এসে অশোক সদর থেকেই চলে যায়। নিরু এই সময়টুকু মাকে আটকে রাখে বাবার ঘরে নানা ফন্দি-ফিকির করে।

অশোক চলে গেলে নিরু ফাঁক পেয়ে অনুকে বলে, ওই কট্‌কী ছোঁড়াটা অত ঘটা করে সেজে এসেছিল কেন রে, অনু?

—কট্‌কী ছোঁড়া মানে?

—তা ছাড়া কি? কট্‌কী শুঁড়-তোলা চটি পায়ে, ফিন্‌ফিনে পাঞ্জাবি।

—আছে, তাই পরে।

—ও! আর, আছে বলেই বুঝি তোকে একা-একা মুঠোয় গুঁজে—

—দিদি! অনু ভয় পেয়ে এদিক-ওদিক তাকায়।

—দে তবে। নিরুও এবার শাসায়।

—শকুনির চোখ তোর। অনু নিরুকে একটু আড়ালে টেনে আনে; বুকের মধ্যে থেকে টফি বের ক’রে ওর হাতে দেয়।

—কি করে জানলি তুই? অনু শুধোয়, আমি কিন্তু তোকে না দিয়ে খেতাম না!

পরমানন্দে টফিটাকে জিবের ডগা দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে নিরু হাসে, তা কি আর জানি না!

দুই বোনেই জানে দুজনকে, দুজনেরই নাড়ি-নক্ষত্র। ওদের খাওয়া, বসা, শোওয়া একসাথে। এর ছায়ায় ওর ছায়া। এর শাড়ি ওর গায়ে, ওর ব্লাউজ এর। নিরুর চুলের কাঁটা অনুর মাথায়, অনুর ফিতে নিরুর খোঁপায়। কালেভদ্রে কোথাও বেড়াতে যেতে হলে দুই বোনে ঘোঁট পাকায় বসে বসে। নিরুর একটা ঢাকাই শাড়ি আছে, গোলাপি রঙের। অনুকে সেটা পরলে মন্দ মানায় না। নিরু সেটা অনুকে পরতে দেয়। আর অনুর কাছে আকাশি রঙের সিল্কের এক শাড়ি, হাতে-বোনা লেসের কাজ-করা ব্লাউজ। অনু দেয় সেটা নিরুকে পরতে। দু জোড়া জুতো আছে দুই বোনের। তাও অদল-বদল হয়। অদল-বদল হয় তাদের যৎসামান্য গায়ের গহনাগুলোও! কানপাশা অনুর কানে মানায়, রিং মানায় নিরুর— অতএব বদলাবদলি করে নেয় দুজনেই।

ষোলয় আর আঠারোয় যে কোনও তফাত থাকতে পারে না, অন্তত নিরু-অনুর মধ্যে নেই, তা ওরা নিজেরাই ভাল করে জানে। কারুর কাছে অন্যের গোপন কিছু, লুকানো থাকে না। যেন থাকতে নেই। সেটা দোষের। কথা যাই হোক, অনুকে না বললে, তার পরামর্শ না নিলে নিরুর শান্তি নেই। অনুরও তাই। অশোক অনুর কাছে কি একটা খেতে চেয়েছিল, অনু বোকার মত সেটাও নিরুকে বলে দিলে।

শুনে নিরুর বুক ধুক্‌পুক্‌ করে উঠল। বড় বড় চোখ করে নিরু বললে, খেয়েছে?

—না। অনু দিদির দিকে তাকিয়ে বললে, অমন করছিস কেন?

—ছি, ছি,! নিরু লজ্জায় অসাড়, খবরদার, অনু! ওসব খেতে দিস না। অনু মাথা নাড়ল। না, না।

সেদিন বিকেলেও শরতের আশ্চর্য একটা সোনালী রোদ ছিল আকাশে। বাতাসটাও মিহি। ঝাঁক বেঁধে চড়ুই নেমেছিল উঠনে।

মাধববাবু বাড়ি ঢুকেই হাঁক দিলেন, কই গো, শুনছ?

শৈল এল। মাধববাবু হাসি-খুশি হয়ে বললেন, এবার নাও, সানাই বায়না দাও!

সানাই বায়না দেবার কথা জড়িয়ে আরও যত কথা ছিল, দুই বোনই তা শুনে। ফেললে। বাবার অফিসের বড়বাবু চাটুজ্যেমশাই তাঁর ছোট শালার বিয়ে দিচ্ছেন। শালাকে নিয়ে চাটুজ্যেমশাই নিজেই আসবেন কাল মেয়ে দেখতে। দেনা-পাওনার কথাটা আগেই হয়ে গেছে। চাটুজ্যেমশাই বলেছেন, টাকাপত্রে আটকাবে না; মেয়ে পছন্দ হলেই আমি তাকে ঘরে নিয়ে আসব। তোমার তো দুই মেয়ে আছে, মাধব! দুজনকেই দেখিয়ে দিও। যাকে পছন্দ হয়!

শুনে পর্যন্ত শৈল মেয়েদের কাছে আপন মনে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কথাটা অনেকবার বললে, এখন আমার কপাল! ছেলে নিজেই আসছে, চোখে ধরলে বাঁচি!

সব কথা শোনার পর নিরুর মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। অনুর দিকে কয়েকবারই আড়চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছে নিরু।

শৈল বলেছিল, সাজগোজটা তোরা দুই বোনে মিলে সেরে নিস বাপু! আমার মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে! একটু শুয়ে নি। দেখিস, বিকেল গড়িয়ে বসে থাকিস না যেন!

শৈল ঘুমুতে গেল তার নিজের ঘরে। শেষ দুপুরটুকু যেন ঘড়ির কাঁটায় টাইফয়েড-জ্বরের মত জুড়ে বসে থাকল। যায়-যায় করেও যায় না।

অনেক কালের রং ওঠা, বেঢপ আলমারিটা খুলে বসে আছে দু’ বোন। শাড়ি-ব্লাউজ ছড়ানো।

—আর দেরি করলে কিন্তু মা উঠে বকাবকি করবে, দিদি! নে, চুলটা আগে বেঁধে নে, বাপু!

ফিতে-কাঁটা সাজিয়ে চুল বাঁধতে বসল নিরু আর অনু।

নিরুর চুল বাঁধা শেষ হল।

—তুই বড় ঝুলিয়ে দিস খোঁপাটাকে, অনু! ঘাড়ের কাছে বিচ্ছিরি লাগে। নিরু ঠোঁট কুঁচকে বললে ডান হাত খোঁপায় দিয়ে।

—আহা, ঝুলিয়ে দি? দেখ না একবার ঘাড় বেঁকিয়ে আয়নায়? দেখল বটে নিরু আয়নায়, তবে বিশেষ খুশি হল না।

এবার অনুর চুল বাঁধছে নিরু।

—কত তেল দিয়েছিস চুলে রে— চট্‌চট্‌ করছে হাত! নিরু গা-বিড়োনা ভাব করল।

—কোথায় আর তেল দিলাম! তেলই ফুরিয়েছিল শিশিতে। বললে অনু।

চুল বাঁধা শেষ হলে অনুও বিরক্তি প্রকাশ করে, এটা কি করলি? ঝুটিবাঁধা উড়ে নাকি আমি?

—বাজে বকিস না, অনু! অত কষ্ট ক’রে বেঁধে দিলাম, পছন্দ হয় না মেয়ের।

—ভাল ক’রে না, ছাই। অনু নিজে নিজেই খোঁপাটা একটু এদিক-ওদিক করে মানিয়ে নিলে মনোমত।

—অতর দরকার নেই বাপু! তোকেই পছন্দ করবে? নিরু ছোট বোনের দিকে তাকিয়ে ঠাট্টা করবার চেষ্টা করলে; ঠোঁটের কোণে কোঁচকানো হাসি জমল।

—বয়েই গেছে! অনু দিদির দিকে না চেয়েই বললে, দরকার নেই আমায় পছন্দ করে। তোকে করলেই বাঁচি।

—কাল মেয়েকে কি পছন্দ হয়?

—কেন হয় না! কত লোকই তো করছে! তুই তো কত কাজ জানিস, গান পর্যন্ত। অনুর গলায় যেন বেশ একটু ক্ষোভ।

দু-পাঁচ মিনিট চুপচাপ। অনু বললে হঠাৎ, স্নো-পাউডার মাখবি না? চল, মুখটা সাবান দিয়ে ধুয়ে আসি।

নাক কোঁচকালো নিরু। বললে, ওসব ছাইভস্ম মাখতে পারব না! যা আছি, তাই আছি।

একটু পরে নিরু বললে, অনু, একটা কাজ করবি, ভাই?

—কি?

—বড্ড মাথা ধরেছে। যা না, একটু চা করে নিয়ে আয় চুপি চুপি। উনুনে মা আঁচ রেখেছে আজ।

অনু কি একটু ভেবে চা করতে চলে গেল। ওই ফাঁকে মুখটাও একবার সাবান দিয়ে ধুয়ে আসবে ও।

অনু চলে গেলে নিরু দরজাটা বন্ধ করে দিলে। সাবান দিয়ে মুখ ধোওয়ার পাট ও আগেই সেরে এসেছে। ছেলে নিজেই আসছে দেখতে। পছন্দ হলেই বিয়ে করে ফেলবে। এই কাল মুখ নিয়ে নিরু দাঁড়ায় কি করে ছেলের সামনে! পাশেই তো থাকবে অনু, রংটা ফর্সাই তার!

মেয়ে-দেখানোর প্রথম দফায় শৈলই কয়েক শিশি হোয়াইটেক্স আনিয়েছিল। পর পর মাখিয়েছে মেয়েদের— কনে দেখবার সময়। তাতেও যখন মেয়ে পছন্দ হল না, শৈল ও পাট তুলে দিলে। তারই একটা শিশিতে এখনও খানিকটা রং আছে গোলা। নিরুই রেখে দিয়েছে লুকিয়ে। কেন যে কে জানে! অনুর পাশে নিরুকে দাঁড়াতে হবে, আর পাত্র আসছে নিজেই, পছন্দ করবে তার চোখে—এতগুলো কথা ভাবলে নিরু অসাড় হয়ে আসে। কেমন করে দাঁড়াবে নিরু অনুর পাশে কাল কুট্‌কুটে মুখ নিয়ে! রঙের জন্যই হয়তো নিরুর দিকে চোখ তুলে তাকাবে না একবার ছেলে!

হোয়াইটেক্স থেকে সবটুকু রং হাতের চেটোয় ঢেলে তাড়াতাড়ি মেখে নেয় নিরু। পাছে অনু এসে পড়ে, পাছে দেখে ফেলে।

খালি শিশিটা লুকতে-না-লুকতে অনু এসে পড়ল চা নিয়ে। ঘরে ঢুকে দিদির দিকে তাকিয়ে অনু অবাক। অমন ধব্‌ধব্‌ করছে কেন দিদির মুখ? পরীক্ষকের চোখ নিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে অনু বলে, এই না বললি, স্নো-পাউডার মাখব না? এদিকে তো ধব্‌ধবে দেখছি তোর মুখ!

চায়ের গেলাসটা অনুর হাত থেকে নিয়ে নিরু একটা নিরুপায় ভঙ্গি করে বললে, বলিস না। যত রাজ্যের সং সাজা। ভাবলুম, কি জানি, মা আবার উঠে বকাবকি না। করে।

অনু আর কোন কথা বলল না।

একটু পরে নিরু বললে, আমার এই ভোলা কানের ঝুম্‌কো দুটো তুই পর।

—না। মাথা নাড়লে অনু, কানে আমার ভীষণ ব্যথা হয়েছে কাল থেকে।

—বলিস নি তো আগে। নিরু খোঁচা দিল।

অনু খোঁচাটা হজম করে নিল চুপ ক’রেই। সত্যিই তো আর তার কানে ব্যথা হয়নি। আসলে, ঝুম্‌কো দুটোই পুরনো আর ম্যাড়মেড়ে। অনুর কানে একদম মানায় না। নিরুরও নয়। কানপাশাটা অনুকে ভালই মানায়, আর ঝুম্‌কো দিয়ে নিরু কানপাশাটা বাগাতে চায়। কেন দেবে ও? ছেলে কি একলা ওকেই দেখতে আসছে?

দিদিকে আজ অনুর বিশ্বাস হচ্ছে না। দিদির সেই ঢাকাই শাড়িটা আজ কি আর দিদি পরতে দেবে তাকে? কখনই নয়। অথচ ওই শাড়িটায় অনুকে সত্যিই খুব সুন্দর দেখায়।

স্নো-পাউডার মাখা শেষ করে অনু একটু বসল। আর তো দেরি করা যায় না। মা এখুনি উঠল বলে। বিকেলও হয়ে গেছে।

—ওই যাঃ। সর্বনাশ হয়েছে রে! অনু চোখ কপালে তুললে। নিরু বিস্ময়-ভরা চোখে তাকাল অনুর দিকে।

—দিদি, লক্ষ্মীটি ভাই— একটা কাজ কর না। উনুনে কয়লা দিয়ে আসতে একদম ভুলে গেছি! আগুন পড়ে গেলে মা আর আস্ত রাখবে না। একটু কয়লা দিয়ে উনুনটা ঠিক করে আয়, লক্ষ্মীটি। আমি ততক্ষণে ঘরটা গুছিয়ে নি।

নিরুরও যেন কি একটা দরকার ছিল। চায়ের গেলাস তুলে নিয়ে নিরু চলে গেল।

খানিক পরে ফিরে এসে দেখে, দরজা বন্ধ ভেতর থেকে। অনু কি ঘর ঝাঁট দিচ্ছে? নিরু ধাক্কা দিল, দরজা খোল, অনু।

—খুলি। উত্তর এল অনুর।

একটু পরে দরজা খুলল অনু। নিরু ঘরে পা দিয়েই দপ্ করে জ্বলে উঠল। অনু সেই ঢাকাই শাড়িটা দিব্যি পরে নিয়েছে; এমন কি, শাড়ির সঙ্গে মিশখাওয়া ব্লাউজটা পর্যন্ত। সেজে-গুজে ফিট্‌ফাট বিবি।

নিরু হঠাৎ হিংস্র হয়ে উঠে ছোট বোনের শাড়ির আঁচলটা খপ করে ধরে ফেলে।

—নিজের শাড়ি নেই তোর? আমার শাড়ি কেন পরেছিস? খোল, খোল শিগ্‌গির। নিরু টানাটানি করতে থাকে বেপরোয়া হয়ে।

—ছিঁড়ে যাবে, দিদি। টানিস না।

—যাক ছিঁড়ে। খোল তুই আমার শাড়ি।

অনুও ক্ষেপে যায়। শাড়ি সে দেবে না; কিছুতেই না। ক্ষিপ্ত স্বরে অনু বলে আমার-আমার করছিস কি। তোর বিলুদা তোকে কিনে দিয়েছে গাঁটের পয়সায়? আমার বাবা কিনে দিয়েছে। বেশ করব, আমি পরব। পেত্নীর আবার কত সাজার সাধ।

দুই বোনের টানাটানি, খেমচা-খেমচি, ফোঁস-ফোঁস, আর চিৎকারে শৈল এসে দাঁড়ায়। কাণ্ড দেখে তার চক্ষুস্থির। জীবনে শৈল এই প্রথম দেখল, পিঠোপিঠি দই বোনে প্রলয়ঙ্কর কাণ্ড বাধিয়েছে। কি হয়েছে, শৈল আর তা জানতে চাইল না। অনেক কথাই তার কানে গেছে। শুধু বললৈ, যে যার নিজের জিনিস পর। অনু, তুমি নিরুর শাড়ি খুলে দাও!

অনু শাড়ি-ব্লাউজ দুই-ই খুলে দিলে। আর মনে মনে এই প্রথম বুঝল, দিদি তার শয়তানী। আচ্ছা, সেও দেখে নেবে। এক মাঘে শীত যায় না।

নিরুও তাই ভাবলে, অনুটা সাংঘাতিক মেয়ে। এমনিতে মার কাছে কত লম্বা-চওড়া কথা। মা, দিদির বিয়ে আগে দাও! এ দিকে তো, বাপু ঠিক সময়ে উর্বশী সেজে বসে আছে।

চাটুজ্যেমশাইয়ের শালার মেয়ে পছন্দ হয়নি। কথাটা রাস্তায় বেরিয়েই চাটুজ্যেমশাই সোজাসুজি বলে দিলেন।

বাড়ি ফিরে এসে মাধববাবুও সোজাসুজি কথাটা স্ত্রীকে জানিয়ে দিলে।

শৈল সব শুনল। এই তো প্রথম নয়। কতবারই তো শুনেছে শৈল। শুনে শুনে সয়ে গেছে সব। মুখ গম্ভীর করে মেয়েদের শুধু একবার দেখে নিলে শৈল। বড় করুণা হল আজ মার মেয়েদের জন্যে। বললে, পছন্দ হয়নি তো হয়নি— কি হয়েছে তাতে?

দুই বোনে কথা বন্ধ ছিল এতক্ষণ। রাত্রে ওদের ঘরে বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে দুজনে দুদিকে মুখ করে ছিল। দুপুর আর বিকেলের ঘটনাটাই ভাবছে দুজনে। ছি, ছি! কি কাণ্ডটা করল ওরা! কেন এমন করল।

এমন সময় কানে এল মার গলা। মা বলছেন বাবাকে পাশের ঘরে শুতে এসে, এর পর যখন সম্বন্ধ আনবে, তোমায় বলে দিলুম— দু মেয়ে একসঙ্গে আমি দেখাব না। কখ্‌খনো না।

—অনু! নিরু ফিসফিস করে ডাকল।

কোনো সাড়া নেই। অনু কি ঘুমিয়ে পড়ল?

—অনু! নিরু পাশ ফিরে অনুর গায়ে হাত রাখে, রাগ করেছিস আমার ওপর, না?

—না। অনু বললে, রাগ করিনি। মনটা বড় খারাপ লাগছে।

নিরুরও মন খারাপ লাগছিল।

একটু পরে নিরু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে, আমার ঢাকাই শাড়িটা আমি তোকে দিলাম। বরাবরের জন্যে। তুই পরিস।

—আর তুই? অনু জানতে চায়।

—যা হয় পরব’খন।

—আমার কমলালেবুটা তুই নে। বরাবরের জন্যই নে, দিদি।

দুই বোন পাশাপাশি গলা-জড়াজড়ি করে আবার শুয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে পড়ল বোধ হয়। কিংবা হয়তো ভাবছিল, বিলু-অশোককে নিয়ে তো এমন রেষারেষি কই হয় না! হয়তো এও ভাবতে পারে, ষোলয়-আঠারোয় এসে যে তফাতটুকু হয়ে গেল আজ দুই বোনে, আর কি তা ঘুচে যাবে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *