ত্রিলোচন নন্দীর নামে ছড়া

ত্রিলোচন নন্দীর নামে ছড়া

শীতের দিনে রবিবারের হাটে একটা লোক পাখি বেচতে আসত। ত্রিলোচন নন্দীকে দেড় টাকায় এক জোড়া রঙ করা চড়ুই বেচে বলেছিল রোদে জলে রাখবেন না, ঘন জঙ্গলের পাখি, ছায়ায় থাকতে ভালবাসে।

সাতদিনের মাথায় ঘন খয়েরি পালক, সবুজ পুচ্ছ এবং আলতা লালের ছিট প্রায় উঠে গেল। পাখি জোড়া নিজের মতন চড়ুই হয়ে আসছিল। জুবিলি স্কুলের অঙ্কের মাস্টার নরেনের সঙ্গে দাবা খেলতে খেলতে ত্রিলোচন পাখির গল্পটা করে ফেলল একদিন। নরেন খুব হেসেছিল। ত্রিলোচন ঠকেছে এই আনন্দে সে অন্তঃপুর পর্যন্ত গলা পৌঁছে দিয়ে বলেছিল, দেড় টাকায় পাখি কিনতে গেলে ওইরকম হয়। পোষা জিনিসের জন্যে পয়সা খরচা করতে হয়, মশাই, পয়সা। জবাবে ত্রিলোচন শুধু বলেছিল, রঙটা পাকা নয়।

তারপর পাখি দুটো সাদামাটা চড়ুই হয়ে গেল। ত্রিলোচনের বউ ফুল্লরা বাঁশের খাঁচা খুলে উড়িয়ে দিল ও দুটো। অনেকদিন ডানা মেলতে পারে নি বলে চড়ুই দুটো এক দমকায় বেশি উড়তে পারল না, একটা ডালিমগাছের ছায়ায় গিয়ে বসল, অন্যটা কুয়োপাড়ে ; গৌরগোপাল গয়ার পেঁড়া নিয়ে তখন সবেমাত্র বাড়িতে ঢুকেছে। ফাল্গুন মাসের পড়ন্ত বিকেল, উষ্ণ দিনান্ত, সামনে মাঠ, ধুলো রোদ ঘোলা করে তুলেছে, ফুল্লরা গৌরগোপালকে দেখে হাসল । “এস ঠাকুরপো…কোথায় গিয়েছিলে ?” ফুল্লরা একবার ডালিমগাছ আর একবার কুয়োপাড়ের দিকে অন্যমনস্ক চোখে তাকাল, তারপর কত যেন অতিষ্ঠ, বিরক্ত নাক, মুখ কুঁচকে ঠোঁট উলটে বলল, “আপদ দুটোকে বিদায় করে দিলাম। চড়াই আবার পোষে নাকি কেউ ।” রুমালে বাঁধা গয়ার পেঁড়া হাতে ঝুলিয়ে চায়ের দোকানের মস্ত ইয়ার গৌরগোপাল দাঁত বের করে হাসল, “আমি হলে ময়ূর পুষতাম।” ফুল্লরা গালে টোল তুলে হাসল ; চোখ অলস, পিছু দিকে হেলিয়ে মাথা একটু ঝাঁকিয়ে নিয়ে ডান হাতে এক রাশ চুল ঘাড়ে নিয়ে সামনে টেনে নিল। হাতের চারটে আঙুল চিরুনির মতন চুলে ডুবিয়ে জট ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, “পুষতে, তারপর মাংস খেতে।” ত্রিলোচনের সাইকেলের ঘন্টি এ-সময় বেজে উঠল। দুপুরে রুগী দেখতে বেরিয়েছিল ত্রিলোচন এই ফিরল।

এইসব ঘটনার পর আস্তে আস্তে ত্রিলোচন নন্দীর নামে একটা ছড়া চালু হয়ে গেল। শহরের প্রায় সবাই শুনল কারও কারও মুখস্থ থাকল । এই ছড়া কে তৈরি করল কেউ সঠিক জানে না। কেউ বলত, হাটের পাখিঅলা ; কেউ বলত, জুবিলি স্কুলের নরেনবাবু। কেউ বা গৌরগোপালের নাম দিত। সবই অনুমানে। কারণ, সেই পাখিঅলা আর হাটে আসত না, নরেন ত্রিলোচনের দাবা খেলা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, গৌরগোপাল ও-বাড়ি যেত না আর।

ছড়াটার ঢঙ দেখে মনে হবে, এ কীর্তি কারও একার নয়, একাধিকের। তবে কোরা তাঁতের কাপড় চার-পাঁচ ধোপ ধোপর বাড়ি ঘুরে এলে যেমন খোল জমে, সুতো মাজা হয়, চেহারায় খোলে—ছড়াটা তেমনি মুখে মুখে ভাটি খেয়ে খুব মজেছিল। শুনলে শ্রবণসুখ তো বটেই, দর্শনতৃপ্তিও হত। ছড়া শুনেই ত্রিলোচন, ত্রিলোচনের বউ এবং তাদের সংসারের স্পষ্ট ছবি দেখা যেত, বিন্দুমাত্র কষ্ট হত না। কেউ কেউ বলল, ডিমের ওপর যেমন খোলা—তেমনি এই ছড়াটা ত্রিলোচনদের ওপরকার খোলা—ভাঙলে ভেতরটা টল টল করে ফুটে বেরুবে।

সেবার শহরে খুব বসন্ত লেগে গেল। ঘরে ঘরে। বাজার পাড়ার দিকে আতঙ্কটা বেশি। কিছু মরল, ভুগল প্রায় সবাই। ত্রিলোচন নন্দীর সঙ্গে এই মড়কের দিনে আমার ভাব হল। জনকল্যাণ সমিতির হয়ে আমি টিকে দিয়ে বেড়াচ্ছিলাম। বাস কম্পানীর প্রহ্লাদবাবুর বাড়ি টিকে দিতে গিয়েছি, ত্রিলোচন নন্দীর সঙ্গে দেখা প্রহ্লাদবাবুর বড় মেয়েকে হোমিওপ্যাথিগুলি খাইয়ে ফিরছে ত্রিলোচন, বসন্তের গুটি বেরিয়ে মেয়েটা জ্বরের জ্বালায় অচেতন।

ত্রিলোচন নন্দী আমায় দেখে আপনজনের মতন হেসে বলল, “আমার বাড়িতে একবার যেও ভাই।”

“টিকে নেবেন !”

“আমি নেব না, আমার বউ নেবে।”

“আপনিও নিয়ে নিতে পারেন।” ত্রিলোচনের হাতে ঝোলানো হোমিওপ্যাথি ওষুধের কালো ব্যাগটা অবজ্ঞার চোখে দেখতে দেখতে আমি বললাম।

“আমার লাগবে না।” ত্রিলোচন চোখের তলায় হাসি ফেলে নিশ্চিন্তে মাথা নাড়ল। সামান্য দাঁত দেখা যাচ্ছিল ওর।

ত্রিলোচন চলে গেলে আমি দুটো কথা তখনই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভেবে ছিলাম। ত্রিলোচনের বউ বোধহয় স্বামীর হোমিওপ্যাথিগুলি-ফুলি বিশ্বাস করে না; এমনও হতে পারে ত্রিলোচন রুগীয় বাড়িতে দাঁড়িয়ে টিকে নিতে নারাজ। হয়ত বাড়িতে গেলে ত্রিলোচনই প্রথম টিকে নেবে হাত বাড়িয়ে, বলবে, হেমিওপ্যাথি চিকিৎসা করি ভাই, আমি টিকে নিলে লোকে আমার ওষুধে বিশ্বাস করবে কেন।

আমার ধারণা ভুল। ত্রিলোচন নন্দীর বাড়ি গিয়ে বুঝতে পারলাম, লোকটা তার পেশাকে বিশ্বাস করে। নিজের বিশ্বাস বউয়ের ওপর চাপাতে পারত, চাপায় নি।

“আপনি তো ওঁকে ওষুধ দিতে পারতেন।” আমি কৌতূহল দমন করতে পারি নি।

“না। ও একবারও টিকে নেয় নি।”

“সে কি! ‘প্রাইমারী ভ্যাক্সিনেশান…।”

“না ভাই। ওটা দেওয়া উচিত।” ত্রিলোচন পরম বিশ্বাসে বলল।

ঠিক জানি না কেন, আমার মনে হয়েছিল ত্রিলোচন বিশ্বাসী এবং যুক্তিবাদী। কোনো কোনো জিনিস সে বিশ্বাস করে, কোনো কোনো জিনিসে যুক্তি মানে। অধিকাংশ মানুষই এইরকম। কিন্তু এই বিশ্বাস এবং যুক্তির মধ্যে তাদের সবটুকু ডুবে নেই। বিশ্বাসও আধখাপচা, যুক্তিও তাই। ত্রিলোচনের তা নয়। তার বিশ্বাসের ক্ষেত্রে সে সম্পূর্ণ, তার যুক্তির ক্ষেত্রে সে পূর্ণ অনুগত।

এত কিছু নিশ্চিতভাবে জানতে আমার সময় লেগেছিল। সময় এবং সুযোগ আমার জুটে গিয়েছিল। মড়কের দিনে যার সঙ্গে আমার পরিচয়, মড়ক থেমে গেল যখন তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেছে। রাস্তা-ঘাটে এবং রুগীর বাড়িতে দেখা হতে হতে শেষ পরিচয়টা ঘটল আমার বিছানায়। আমিও বসন্তের হাত এড়াতে পারি নি, যখন সারা গায়ে জলভরা গুটিগুলো অসহ্য হয়ে উঠল, তখন জ্বরে যন্ত্রণায় আচ্ছন্ন কন্ঠে মাকে বলেছিলাম ত্রিলোচন নন্দীকে ডেকে পাঠাতে ।

ত্রিলোচন নন্দীর নামে যে-ছড়া আমি বহুমুখে বহুবার শুনেছি, মজা পেয়েছি, ভাল লেগেছে—সেই ছড়া সম্পর্কে আমার মনোভাব আগেই বদলে গিয়েছিল, ঘনিষ্ঠতা যখন বন্ধুত্বের পর্যায়ে তখন ছড়াটার কথা মনে পড়লে আমার খারাপ লাগত, এই শহরের মানুষগুলোকে ধিক্কার দিতাম। আমার ধারণা হয়ে গিয়েছিল, কোনো এক ইতর তার আক্রোশ বশে এই ছড়া তৈরি করেছিল এবং আরও কয়েকজন ইতর মিলে তাকে জমকালো করেছে।

ছড়ার ত্রিলোচন আর এই ত্রিলোচনে কোনো মিল নেই। আমি যে ত্রিলোচনকে দেখলাম তার বয়স চল্লিশ। বেশ দীর্ঘ, অনুপাতে মেদহীন বলে শীর্ণ দেখায়। ওর মুখের ছাঁচ লম্বা, কপাল চওড়া, নাক সোজা এবং দৃঢ়, গালের হাড় পুরু, চিবুক সামান্য বাঁকানো। ত্রিলোচনের চোখ খুব শান্ত, স্থির, নীচের ঠোঁট একটু বেশিরকম পাতলা। মাথার চুল ছোট ছোট, কোঁকড়ানো। রঙ ঠিক কালো নয়, তামাটে। ত্রিলোচনকে দেখলে দু’পলক তাকাতে হত। তার চেহারা বেশভুষা আমাদের শহরের প্রান্তসীমাগুলো মনে করিয়ে দিত। তেমনি মেঠো, মুক্ত, রোদে জলে পোড় খাওয়া। মাঠ, ধুলো, গাছের শুকনো পাতা, অনুর্বর পতিত প্রকৃতির মতন ত্রিলোচনের চেহারায় যে নীরসতা ছিল তা অনুভব করা যেত। সাধারণ পরিপাট্যের অভাবে তাকে হয়ত একটু বুনো রুক্ষ বলে মনে হত।

ত্রিলোচনের বেশভূষার পরিবর্তন আমি কখনও দেখি নি। বাড়িতে খাটো ঝুলের মোটা কাপড়, গায়ে ফতুয়া, খালি পা। বাইরে বেরুবার সময় ধুতি মালকোঁচা মেরে পরে নিত, হাঁটুর একটু তলা পর্যন্ত সে ধুতির ঝুল, পায়ে কেডস্ জুতো, গায়ে সাদা মোটা পাঞ্জাবি, সাইকেলের কেরিয়ারে বাঁধা তার হোমিওপ্যাথি ওষুধের ব্যাগ। সাইকেলটার চেহারা ধোপার বাড়ির গাধার মতন হয়ে গিয়েছিল।

বয়সে ত্রিলোচন আমার চেয়ে বেশ বড়, অন্তত দশ বছর। আমার উচিত ছিল বয়সের এই ব্যবধান মেনে চলা, কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। ছড়া শুনে শুনে মানুষটাকে এমন মজার নজরে দেখেছিলাম যে, ওকে আপনি বলতে আমার অসুবিধে হত। পূর্বে হয়ত ত্রিলোচন বুঝতে পেরেছিল বলেই আমায় তার বন্ধুর মতন করে নিয়েছিল এবং সম্মানের সম্বোধনগুলো বাতিল করে দিতে বলেছিল।

ত্রিলোচনকে আমি দাদা বলতাম—ত্রিলোচনদা। তার বউ—ফুল্লরাকে বউদি বলতে মুখে বাধত। ফুল্লরা আমার সমবয়সী, সামান্য ছোটই হবে। ওকে কদাচিৎ বউদি বলেছি, নয়ত সম্বোধন বাদ দিয়ে কথা বলতাম।

আমার শোনা ছড়ায় ফুল্লরাকে ত্রিলোচনের পোষা পাখির মতন বর্ণনা করা হয়েছিল। যেন ত্রিলোচন দিনের পর দিন ছোলা জল খাইয়ে একটা হৃষ্টপুষ্ট পাখিকে ভোলাবার চেষ্টা করছে, ভোলাতে পারছে না, যে-মুহূর্তে পাখিটা ধরতে হাত বাড়ায়, তীক্ষ্ণ চঞ্চুর আঘাত খেয়ে হাত সরিয়ে নেয়। ত্রিলোচনের শয়তানি এবং জ্বালা দুইই বেশ ফুটেছিল ছড়ায়, ফুল্লরার বেদনা অসহয়তা আর আত্মরক্ষার প্রাণান্ত চেষ্টাও।

ফুল্লরাকে দেখে, অনেক দিন মেলামেশার পরও আমার মনে হল না, ফুল্লরা বাস্তবিক ত্রিলোচনের পোষা পাখি। ওদের স্বামী স্ত্রীর মধ্যে একটা দূরত্ব আছে ঠিকই, সে দূরত্ব ওই রকম হাড়মাংসের নয়, অন্যরকম। কেমন তা আমার চোখে ধরা পড়ে নি।

ফুল্লরাকে সুন্দরী বলা যায় কিনা আমি জানি না, তবে তার শরীর সুশোভিত ছিল। তার গায়ের রঙ ফরসা, অনেকটা যেন পাকা বেলের মতো রং। গোলগাল, মাথায় খাটো। মালসার ছাঁচে মুখ, নাক ছোট, স্ফুরিত ডগা, গাল ফোলা ফোলা, আঠার মতো কেমন চকচক করত, ঠোঁট পুরু, সিক্ত, চোখ দুটি চওড়া, মনে হয় এই মুখের পক্ষে অতিরিক্ত। খুব উজ্জ্বল দৃষ্টি, হাসলে বাঁ গালে টোল ওঠে। দাঁত ধবধবে সাদা, শক্ত। চুলের ভারে মাথা যেন একটু হেলিয়ে রাখে ফুল্লরা, অফুরন্ত ঘন জানুছোঁয়া চুল। কন্ঠের কাছ থেকে বুক যেন প্রসারিত হয়ে গেছে হঠাৎ, ভারি বুক, কোমল শিথিল, নিম্নাংশ স্ফীত। ফুল্লরার চেহারায় পীড়িত হওয়া হয়ত স্বাভাবিক। ফুল্লরাকে আমার বঞ্চিত অথবা ব্যথিত মনে হত না, বরং কখনও কখনও তাকে প্রগ্‌লভা, চতুর বলে মনে হত। ত্রিলোচন স্ত্রীর কী পছন্দ করত আর কী পছন্দ করত না আমি বুঝতে পারি নি।

ফুল্লরাকে আমি যে টিকে দিয়েছিলাম, কপালদোষে সেই সামান্য ছুরির আঁচড় এবং কয়েক বিন্দু তরল পদার্থ তাকে কিছুদিন ভুগিয়েছিল। ওকে এক রকম বিষাক্ত হয়ে যাওয়া বলে। পেকে ঘা হয়ে অনেকটা ছড়িয়ে গিয়েছিল। পরে শুকিয়ে গেলে কালো দাগ হয়ে গিয়েছিল, একটু গর্ত গর্ত দেখাত।

মাঝে মাঝে ফুল্লরা তার ফরসা হাতের সেই দাগ আমায় দেখাত, কৃত্রিম কুপিত কণ্ঠে বলত, “কী টিকেই দিয়েছিলে। আনাড়ি…।”

আমি জানতাম এ দোষ আমার নয়, আমি জানতাম না এ-দোষ কার। বলতাম, “রক্ত অপরিষ্কার থাকলে এ-রকম হয়।”

ফুল্লরা চোখের পালক ঝাপটা মেরে বলত, “আমার রক্ত তোমার চেয়ে পরিষ্কার।”

একদিন তারের খোঁচা লেগে ফুল্লরার আঙুল কেটে গিয়েছিল। ফুল্লরা তার রক্ত আমার চোখের সামনে মেলে ধরেছিল। আমি লক্ষ করে দেখেছিলাম, খুব ঘন এবং গাঢ় লাল। আমার মনে হয়েছিল, এই রক্ত স্বাভাবিক।

ত্রিলোচন আমায় কখনো কখনো ফুল্লরার চোখের দোষের কথা বলত। আমি বুঝতাম না, কি দোষ। ফুল্লরার চোখের দৃষ্টি উজ্জ্বল এবং তীব্র। মাঝে মাঝে তার চোখ গরুর গাড়ির চাকার মতন খুব পুরনো এবং মেঠো দেখাত, কিন্তু তেমন দৃষ্টি খুবই অল্প দেখেছি। ত্রিলোচন বলত, রোগটা ঠিক মণির নয়, আরও ভেতরের।

আমার মনে হত ত্রিলোচন তার স্ত্রীর চোখের চিকিৎসা করেছে নিজের মতে। অবশ্য কোনোদিন সে-কথা ও আমায় খোলাখুলি বলে নি।

একদিন শেষ বর্ষায়, বিকেলের দিকে ত্রিলোচন আমার সঙ্গে মতিবাগানে কিছু ফুলগাছের চারা নিতে গিয়েছিল। বৃষ্টি এসে পড়ল পথে, আমরা তেলির দোকানের খাপরার তলায় মাথা গুঁজে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম, বৃষ্টি ধরল না। সামনের খোয়া ও পাথর-পেটা রাস্তাটা কাদা হয়ে গেল, নীচু মাঠে জল জমে গেল, দু পাশের আম জাম হরীতকী গাছগুলো ভিজে কাতর হয়ে বাতাসে কাঁপছিল। এক সময় বৃষ্টি সামান্য ধরল। আকাশ তখনও অপরিষ্কার, জলের মেঘ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, বাতাস ঠাণ্ডা, ঝিরঝিরে বৃষ্টির আঁশ উড়ছে। বিকেল ফুরিয়ে যাচ্ছে তাড়াতাড়ি আলো মরে গেছে। চারপাশ থেকে অস্ত্র ব্যাঙ ডাকছিল।

ত্রিলোচন বলল, “আজ আর হল না, চল বাড়ি ফিরে যাই।”

তেলির দোকান থেকে বেরিয়ে আমরা জলকাদা ভেঙে বাড়ি ফিরছি আবার যেন বৃষ্টি তার ক্লান্তি কাটিয়ে ছুটে এলো। পুরু সাদা চিকের মতন জল আমাদের পথ দেখতে দিচ্ছিল না, মেঘ ডাকছিল ভয়ঙ্কর গলায়, গাছের মাথা বাতাসের দাপটে নুয়ে নুয়ে পড়ছিল।

ত্রিলোচন বৃষ্টির জল খেতে খেতে বলল, “আমার বাড়িতে চল…তবু কাছে আছে।”

ত্রিলোচনের বাড়িতে পৌঁছে মনে হল, এই বৃষ্টির ঠিক-ঠিকানা নেই, হয়ত রাত পর্যন্ত টানা চলবে। ত্রিলোচন আমার কাপড় জামা ছেড়ে ফেলতে বলে ফুল্লরাকে ডাকতে গেল।

জলে ভিজে আমার শীত করছিল। জামাকাপড় পায়ের সঙ্গে জাপটে কেমন বন্ধনের মতন লাগছিল, সারা গা মাথা পা বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে, কয়েকটা কাক কোথা থেকে আতঙ্কিত কর্কশ স্বরে চেঁচাচ্ছিল, গুরু মেঘের ধ্বনি সামনের মাঠ ছাড়িয়ে দূরান্তে ভেসে যাচ্ছে।

জলে ভিজে আমার শীত করছিল। জামাকাপড় পায়ের সঙ্গে জাপটে কেমন বন্ধনের মতন লাগছিল, সারা গা মাথা পা বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে, কয়েকটা কাক কোথা থেকে আতঙ্কিত কর্কশ স্বরে চেঁচাচ্ছিল, গুরু মেঘের ধ্বনি সামনের মাঠ ছাড়িয়ে দূরান্তে ভেসে যাচ্ছে।

ফুল্লরা এলো। হাতে গামছা, কাপড়, ত্রিলোচনের গেঞ্জি, শুকনো একটা বিছানার চাদরও। বলল, “ইস, কাক ভেজা ভিজেছ যে। নাও, নাও—ও ঘরে গিয়ে তাড়াতাড়ি সব বদলে নাও।” ফুল্লরা ত্রিলোচন নন্দীর ভেতর দিকের ঘরটা দেখিয়ে দিল ।

বারান্দা লাগানো এই ঘরটা ছোট, ত্রিলোচনের বসার ঘর। তার রুগী দেখার জন্যে সামনে একটা কুঠরি মতন আছে। জামাকাপড় বদলাবার সময় ঘর অন্ধকার ছিল, শুকনো কাপড় পরে গেঞ্জিটা গায়ে দিয়ে, চাদর জড়াবার সময় জানলা খুলে দিলাম । বাইরে ধোয়া কালির মতন অন্ধকার। শূন্যতা যেন আর্দ্র হয়ে আছে। সামান্য দূরে কদম গাছটা অবিশ্রান্ত বৃষ্টির জলে কেমন ঘন ছায়ার প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ফুল্লরা এলো। হাতে লুণ্ঠন। এইমাত্র জ্বালিয়ে এনেছে। অন্য হাতে চিরুনি। বলল, “বাতিটা জ্বালিয়ে আনলাম, বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে। …এই নাও চিরুনি।” চিরুনি বাড়িয়ে দেবার সময় ফুল্লরা আমার মাথার চুল ঘেঁটে দেখে নিল। “এই কি মাথা মোছা, জল রয়েছে এক গাদা, ভাল করে মুছে নাও।”

মাথা থেকে হাত সরিয়ে নেবার সময় ফুল্লরার আবরিত ত্বকের গন্ধ আমার নিশ্বাসে প্রবেশ করল। আমার খুব নিকটে ঘন হয়ে সে দাঁড়িয়েছিল। সাপুড়ের বাঁশীর মতন তার ফোলা বুকের ওপর আমার বিব্রত দৃষ্টিকে আমি স্থির হতে দিচ্ছিলাম না।

“মাথায় এত চুল রাখ কেন ?” ফুল্লরা বলল, বলে জানলার গায়ে রাখা গামছাটা। আমার হাতে এনে দিল।

কখনও কখনও মানুষের মাথার খুলি তাকে বাঁচাতে পারে না। আমার চুল ভেজা, মাথার খুলি ঠাণ্ডা, তবু রক্ত অনেক লঘু বলে অগ্নিকণিকায় উত্তপ্ত হয়ে উঠল।

“দাও, আমি মুছিয়ে দি”—ফুল্লরা আমার মাথায় অর্ধসিক্ত গামছা ফেলে দিল।

আমি নিরুপায় দাঁড়িয়ে থাকলাম। লজ্জা এবং অস্বস্তির প্রবাহ আমার শরীরে যথারীতি কিছু জড়তা সৃষ্টি করেছিল এবং মন কয়েকটি বিগত স্মৃতি দ্রুত নিপুণ হাতে তুলে নিচ্ছিল। যে কোনো কারণেই হোক ঘটনাগুলি আমার স্মৃতিবদ্ধ হয়ে আছে।

ফুল্লরার চঞ্চল হাত আমায় স্থির থাকতে দিচ্ছিল না। এক সময় আমার মনে হল, শিরার মতো দুটি চক্ষু আমার অসহায়তা লক্ষ করছে, পর মুহূর্তে ধারণা হল ফুল্লরার কম্পিত মেদস্তরে আমার দুর্লভ্য বস্তুগুলি কেউ দুহাতে ছড়িয়ে দিচ্ছে।

অবশেষে ফুল্লরা আমার সমস্ত সিক্ততা শুষ্ক করে একটু সরে দাঁড়াল। ওকে লক্ষ করার জন্যে ভীত নেত্রে মুখের দিকে তাকালাম এবং সবিস্ময়ে দেখলাম, ফুল্লরার হাতে গভীর দাগ। সেই টিকের দাগ ! কিন্তু ক্ষতটি আর কালো নয়, কিঞ্চিৎ শ্বেত। যেন এই ক্ষত যে-কোনো মুহূর্তে আবার রক্তপাত করতে পারে।

“নাও এবার চুল আঁচড়ে নাও।” ফুল্লরা বলল।

ফুল্লরা চলে গেলে আমার মনে কামভাব জেগেছিল।

ভিজে জামাকাপড় সবই স্তূপীকৃতভাবে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ফুল্লরা। আমি জানলা দিয়ে তাকিয়ে কদমগাছের পাতায় ঘনীভূত অন্ধকারের বিশালতা অনুভব করবার চেষ্টা করছিলাম।

ত্রিলোচন এলো। বাতি উজ্জ্বল করল। বলল, “আর বাদলা হাওয়া খেও না, তক্তপোশে এসে বস।”

“প্রচণ্ড বৃষ্টি হল আজ—”

“ভালোই হল। ক্ষেতে একটু জল দাঁড়াবে।”

জানলার কাছ থেকে সরে এলাম। এই ঘর বেশ ছোট। একটি জামকাঠের তক্তপোশ, ওপরে সতরঞ্চি পাতা। কোণের দিকে কালো রঙ করা একটা বেঁটে আলমারি, তালা ঝুলছে আঙটায় ; দেওয়ালে বাংলা তারিখের ক্যালেন্ডার। একপাশে একটা টেবিল, দেওয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা, তার ওপর কিছু ছেঁড়া খোঁড়া বইপত্র, চিনেমাটির ভাঙা ফুলদানিতে ক’টা কাগজের ছেঁড়া ফুল।

ত্রিলোচন তক্তপোশের ওপর আরাম করে বসল। বলল, “বস। গরম চা আসছে, মুড়ি ভেজে গোলমরিচ আর আদার কুঁচি দিয়ে আনতে বলেছি। ব্যস্, শরীর চাঙ্গা হয়ে উঠবে।”

বসলাম ! বাইরে বৃষ্টির মৃদু শব্দ। খুব দূরে কোনো দিকভ্ৰম পাখি করুণ কণ্ঠে ডাকছিল। মেঘের ডাকে মুখ চাপা পড়েছে, ঝিঁঝিঁর স্বর প্রখর হল।

ঘরের আলো অন্ধকার পেয়ে ক্রমশ তার উজ্জ্বলতা বাড়িয়েছে। এই আলো যেন আমার চোখে এই প্রথম অনুভূত হল স্পষ্ট করে।

“তুমি আজ এখানে থেকে যাও মুরারি।” ত্রিলোচন বলল।

“যা অবস্থা…” আমি বাইরের দিকে না তাকিয়েও আমার বাড়ির পথঘাটের অবস্থা কল্পনা করতে বললাম, “যা অবস্থা তাতে শেষ পর্যন্ত তাই থাকতে হয় বোধ হয়।”

“বৃষ্টি হয়ত থেমে যাবে!” ত্রিলোচন যেন আকাশ কল্পনা করতে পারছে এমনভাবে বলল ।

“বলা যায় না। …না ফিরলে আর কিছু না, মা ভাববে।” আমি যেন অপ্রয়োজনে অপ্রসন্ন হয়ে উঠেছিলাম।

“আমার বাড়ির সহদেব খানিক পরেই বাড়ি ফিরবে, তোমার বাড়িতে বলে দেবে।” ত্রিলোচন’ শান্ত গলায় বলল।

সহদেব ত্রিলোচনের ছোকরা চাকর। আমাদের বাড়ির দিকেই থাকে। একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, হঠাৎ হেসে বললাম, “আমি দাবা খেলা জানি না।”

ত্রিলোচন শুনল। তারপর হেসে উঠল। “আমি জানি তুমি নরেন মাস্টার নও।” দাবা খেলা প্রসঙ্গে নরেন মাস্টারের নাম উঠতে আমি কেমন বিব্রত বোধ করলাম। ত্রিলোচন কি আমার কথার মধ্যে কোনো উদ্দেশ্য খুঁজে পেয়েছে! অন্তত দাবার উল্লেখ করার সময় আমার জ্ঞানত কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। এমনি বলেছিলাম, আমার হয়ত ধারণা হয়ে থাকবে, এই বাদলার রাতে ত্রিলোচন সময় কাটাবার জন্যে আমায় দাবা খেলতে বলবে।

ত্রিলোচনের কথার মধ্যে কোনো উদ্দেশ্য ছিল কিনা আমি বুঝতে পারলাম না। তার মুখের দিকে তাকাতে আমার সঙ্কোচ হচ্ছিল হঠাৎ। তবু কথাটা সরল করে নেবার জন্যে বললাম, “নরেন মাস্টার দাবায় খুব পাকা বুঝি ?”

“কাঁচা।”

“হারত রোজ ?”

ত্রিলোচন প্রশান্তমুখে হাসল, “তার হাত কাঁচা।”

অল্প চুপচাপ। মনে হল ফুল্লরার সহদেবকে কিছু বলছে উঠোনে দাঁড়িয়ে। তার গলার স্বর ঝিল্লিরবের ওপরে চিকন হয়ে ভাসছিল।

“আচ্ছা আমি তো তোমার হাত দেখি নি। আজ দেখব।” ত্রিলোচন বলল শান্ত স্বাভাবিক গলায় ।

“হাত…”

“আমি কিছু কিছু চর্চা করেছি। তুমি শোন নি, আমি হাত দেখতে পারি ?”

ত্রিলোচন চোখের হাসি সমানভাবে জ্বালিয়ে রেখে আমার দিকে চেয়ে থাকল।

“শুনেছি।” আমি ঘাড় হেলালাম ; “লোকে বলে।” আমার ঠোঁটের গোড়ায় উপহাসের ঈষৎ হাসি ফুটে উঠল বোধহয়।

ফুল্লরা ঘরে এলো। কাচের গ্লাস ভর্তি করে চা, কলাই করা বাটিতে ভাজা মুড়ি। এখন লক্ষ করলাম, ফুল্লরার মাথায়, মস্ত গোল খোঁপা। পুষ্ট বিনুনি চাকার মতন গোল করে, পাকে পাকে জড়িয়ে বেঁধেছে। শক্ত স্ফীত খোঁপাটা লণ্ঠনের আলোয় চকচক। করছিল। আমি ঠিক জানি না ত্রিলোচন আমায় লক্ষ করছিল কিনা, কিন্তু সহসা সেই খোঁপার দিকে তাকিয়ে আমার স্নায়ু পীড়িত হয়ে উঠছিল।

“মুরারি আজ থাকবে।” ত্রিলোচন বলল, তার কথা আমার কানে গেল, আমি চায়ের গ্লাস নিতে হাত বাড়ালাম, অত্যন্ত তাত লাগছিল হাতে। “আজ রাত্রে তুমি বরং বেশ করে খিচুড়ি রাঁধ।”

“মুসুর না মুগ ?” ফুল্লরা স্বামীর দিকে তাকাল।

“যা ভাল হয়।” ত্রিলোচন বলল, একটু চুপ করে থাকল। “সহদেব চলে গেছে ?”

“না। যাবে এবার।”

“ওকে বল, মুরারির বাড়িতে একটা খবর দিয়ে যাবে।”

ত্রিলোচনকে আমি দেখছিলাম। সংসারে তার আসক্তি কতটা আমি জানি না। আমার মনে হচ্ছিল, আমি ত্রিলোচন হলে আজ ফুল্লরাকে কাছে বসিয়ে রাখতাম মুরারিকে নয়।

ফুল্লরা আমার চোখে চোখ রেখে তাকাল। বোধহয় কিছু বলবে ভেবেছিল, বলল না, মানুষ যেমন ভিড়ের মধ্যে চেনা লোক দেখলে একটু হাসে, তেমনি করে হাসল জোড়া ঠোঁটে।

ফুল্লরা চলে গেল। আমরা মুড়ি তুলছিলাম মুঠো করে, মুখে দিচ্ছিলাম, চর্বনের শব্দ হচ্ছিল, চা খাচ্ছিলাম এবং বাইরে বৃষ্টি থেমে যাওয়ায় অগোচর কীট পতঙ্গ সমস্বরে যে অদ্ভুত তান তুলেছিল আমরা সেই শব্দে কান ডুবিয়ে বসেছিলাম।

ত্রিলোচনই এক সময়ে আমাদের নির্বাক সম্পর্কহীন উপস্থিতিকে আবার যুক্ত করল।

“মতি বাগানে আবার একদিন যাওয়া যাবে, কি বল—”

“যে দিন হোক, কাল পরশু…”

“কাল পরশু হবে না। আমার কিছু কাজকর্ম আছে।”

“রবিবার— ?”

“হাটের দিন ! না ভাই হাটের দিন আমার দেহাতী রুগীগুলো সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত বাড়িতে ভিড় করে।” ত্রিলোচন কেমন স্নেহের গলায় বলল।

হাটের কথায় আমার কেন যেন সেই পুরোনো ছড়া এবং পাখি-অলার কথা মনে পড়ছিল। হয়ত নরেন মাস্টারের কথা অল্প আগে উঠেছিল বলেই পাখিঅলার কথা স্বাভাবিকভাবে মনে এলো। ত্রিলোচনের নিশ্চয় তার কথা মনে আছে। প্রবল ইচ্ছে হচ্ছিল কথাটা একবার জিজ্ঞেস করি।

“তুমি হাটে যাও ?” ত্রিলোচন শুধল ।

“যাই, মাঝে মাঝে ।”

“আমার আর যাওয়া হয় না। সহদেবই যায়।”

“হাটে আজকাল কিছু আসে না তেমন…হাট পড়ে যাচ্ছে। “ আমি বলছিলাম, বলার মুখে গলার কাছ পর্যন্ত গরম বাতাসের দলা অনুভব করছিলাম এবং পাখিঅলার কথা আমার জিভে অসহিষ্ণু হয়ে অপেক্ষা করছিল।

“শীতে আবার জমবে। এখন বর্ষা…”

“শীতে অনেক নতুন জিনিস আসে।” আমি সম্পূর্ণ অজ্ঞাতে পাখিঅলার কথাটা যেন ত্রিলোচনকে ইশারা করে বোঝাবার চেষ্টা করলাম। শীতে পাখিঅলা এসেছিল। ত্রিলোচন বুঝল না। হয়ত কিছু প্রকাশ করল না।

আমাদের চা খাওয়া শেষ হয়েছিল। ত্রিলোচন উঠল। টেবিলের ছেঁড়া-খোঁড়া বই ঘেঁটে কি খুঁজছিল।

ফুল্লরা এখন বারান্দায়। তার ভারি পায়ের শব্দ আমি শুনতে পাচ্ছিলাম। হয়ত বারান্দায় ঝোলানো তারে আমাদের ভেজা জামাকাপড় শুকোতে দিচ্ছে। হয়ত বিকেলের কাপড় ছাড়ার সময় হল তার এতক্ষণে, নিজেরই কাচা কাপড় মেলে দিচ্ছে। কিংবা অন্য কোনো কাজে বারান্দায় ঘোঘারাঘুরি করছে।

“এখানটায় বড় জঞ্জাল হয়ে রয়েছে।” ত্রিলোচন বলল। তারপর কালো হাড়ের হাতল লাগানো বড় মোটা একটা আতস কাচ নিয়ে আমার সামনে এসে বসল।

লণ্ঠন সামনের দিকে টেনে নিচ্ছিল ত্রিলোচন। হাঁটুর ওপর আতস কাচটা পড়েছিল। আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম, ত্রিলোচনের আতস কাঁচ এক বৃহৎ ভয়ঙ্কর চক্ষুর মতো পড়ে আছে।

মানুষ অকারণে কোনো কোনো সময় ভয় পায়। আমি ঈষৎ অস্বস্তি বোধ করছিলাম এবং অস্বস্তিকে ভয় বলে ভ্রম করছিলাম।

“তুমি হাত দেখায় বিশ্বাস কর না?” ত্রিলোচন আমার কোলের কাছে লণ্ঠন ঠেলে দিয়ে একটু সামনের দিকে সরে এলো।

“না। …এ-সব গাঁজাখুরি।”

“সব জিনিসই কিছু সত্যি, কিছু মিথ্যে।”

“হাতটা পুরোপুরি মিথ্যে।”

“না, মুরারি—” ত্রিলোচন আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল, “হাত মিথ্যে নয়।”

আমার ইচ্ছে হচ্ছিল উপহাসের অট্টহাসি হেসে উঠতে। কিন্তু হাসতে পারলাম না। হাসতে পারায় মানসিক গ্লানি অনুভব করছিলাম। আমার মনে হল, এই আতস কাচের বৃহৎ চক্ষু আমার মধ্যে অদ্ভুত এক জটিল অনুভব জাগিয়ে তুলছে।

“ত্রিলোচনদা, তুমি সত্যি সত্যি এই সব বাজে জিনিস বিশ্বাস করো, না নেহাত শখ বলে চর্চা করেছ ?”

“আমি হাত বিশ্বাস করি।” ত্রিলোচন শান্ত স্থির গলায় বলল।

“আমার মাথায় তোমার বিশ্বাস ফিশ্বাস ভাল ঢোকে না।” আমি হাসবার চেষ্টা করলাম। “তোমার কোথাও কোথাও গোঁড়া বিশ্বাস—কোথাও কোথাও জোর যুক্তি।”

ত্রিলোচন যেন কথাটা শোনে নি, বা শুনলেও জবাব দেবার প্রয়োজন অনুভব করল না । হাঁটুর ওপর থেকে আতস কাচ তুলে নিল, আমায় ডান হাত বাড়াতে ইশারা করল চোখে। তারপর আমার ডান হাত তার বাঁ হাতে টেনে নিয়ে মৃদু ভারি শান্ত গলায় বলল, “সংসারে তোমায় কিছু কিছু বিশ্বাস করতেই হবে।”

ওর গলায় প্রত্যয় এত দৃঢ় সংযত হয়ে ফুটে উঠল যে আমি বিশ্বাস শব্দটির গভীরতর অর্থ ধরতে পারছিলাম।

“তুমি নিশ্চয় কর না ?” ত্রিলোচন আমার হাতের তালুর ওপর সামান্য ঝুঁকে পড়ে কি যেন দেখছিল।

“না।”

“ভূতেও বিশ্বাস কর না নিশ্চয় ?”

“ছেলেবেলায় করতাম।” আমি হাসলাম।

ত্রিলোচন আতস কাচ উঠিয়ে আমার মুখের দিকে তাকাল। “ভগবানের বিশ্বাস আর ভূতে বিশ্বাস কি এক, মুরারি ?”

“প্রায় এক।”

“প্রায় বললে কেন ?”

কেন বলেছিলাম জানি না। মানুষের তাৎক্ষণিক অনুভূতি সব সময় কৈফিয়ত দেয় । আমার মনে হয়েছিল, ভগবানে বিশ্বাস করি না করি সে বিশ্বাস ভূতের বিশ্বাসের মতন উপহাস্য নয়। আমরা কোনো কোনো জিনিসের মূল্য অজ্ঞাতে দিয়ে থাকি। হয়ত ভগবানকে আমার ভূতের চেয়ে উন্নত বস্তু বলে মনে হয়েছিল।

কিছুটা বিব্রত বোধ করছিলাম। তবু আমার লঘু এবং হাস্য ভাব আমি গুটিয়ে নিতে রাজি হলাম না। “ওটা সম্মান করে বললাম, ভগবানের সম্মান।”

ত্রিলোচন আর কোনো কথা বলল না। আমার হাতের তালুর ওপর তার আতস কাচ রাখল। লণ্ঠনের আলো আমাদের হাতে সরাসরি এসে পড়ছে, আলোটা অনুজ্জ্বল, ঘোলাটে। কেরাসিনের অতি সামান্য গন্ধও যেন পাচ্ছিলাম। ত্রিলোচন পিঠ নুইয়ে আতস কাচ আমার করতলে স্থিরভাবে ধরে রেখেছে। আমি নীচু চোখে তাকালাম। আমার কয়েকটি ভগ্ন রেখা স্পষ্ট এবং বৃহৎ হয়ে আমার চোখে ধরা পড়ল। আশ্চর্য, আমি আমার হাত কোনো দিন লক্ষ করি নি বলে মনে হল। অদ্ভুত এবং অর্থহীন কতক বেয়াড়া বিশ্রী রেখা আমায় যেন তাদের স্থূলতা এবং কদর্যতা দেখাতে লাগল। এবং কয়েক মুহূর্ত পরে আমার মনে হল, আমার দেহের অধিকাংশ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতন এই রেখাগুলি সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা অথবা উৎসাহ নেই।

“তোমার হাত মন্দ না—” ত্রিলোচন বলল, আমি ঈষৎ অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, পুনরায় চোখ নীচু করে আতস কাচের দিকে তাকালাম। এবং সহসা আমার কেমন ভয় হল। ত্রিলোচনের আতস কাচ ভয়ঙ্কর চক্ষু হয়ে আমার করতলের কতকগুলি দুর্বোধ্য ভাঙা বিচ্ছিন্ন রুগ্ন রেখাকে স্পষ্ট করে তুলেছে। আমার ভাল লাগছিল না। ঘৃণা হচ্ছিল। ওই রেখার জাল যেন অকস্মাৎ আমার হৃদয়কে শঙ্কিত, আর্ত করে তুলছিল।

ত্রিলোচনের হাত থেকে টান মেরে আমি আমার হাত ছাড়িয়ে নিলাম। আমার ব্যবহারে বিস্মিত হবার মতন উপাদান ত্রিলোচন নিশ্চয় খুঁজে পেল । কিন্তু আমি তার চোখের দিকে তাকাবার জন্যে বিন্দুমাত্র আগ্রহ অনুভব করছিলাম না। অপ্রসন্নতা, বিরক্তি এবং তস্করের ভয় আমায় গ্রাস করছিল ।

ত্রিলোচন নন্দী স্বাভাবিক গলায় বলল, “তুমি ভয় পাচ্ছ ?”

“না”

“তবে ! এ-সব তোমার ভাল লাগছে না ! আচ্ছা, তবে থাক্‌…” ত্রিলোচন তার হাতের আতস কাচ একবার মুহূর্তের জন্যে নিজের চোখের ওপর আড়াল করে ধরল । আমার মনে হল—তার একটি চোখ ভৌতিক হয়ে গেছে। আমি কখনও এমন চোখ দেখি নি, বিশাল, বীভৎস। পরক্ষণেই কাচটা পাশে রেখে দিল ত্রিলোচন, শতরঞ্জির ওপর। হাসল সামান্য। বলল, “তুমি তোমার হাতে ধরা আছ। আমায় বিশ্বাস করো না করো কথাটা সত্যি।”

বাইরে বৃষ্টির শব্দ ছিল না। দূরান্তে কোনো বিশাল মেঘ বিদ্যুতের শিখা ছুঁড়ে দিয়ে গেল সামনে, অনুমানে মনে হল কদমগাছের মাথার ওপর দিয়ে ঘন তমসায় একটি আলোর ছটা ওই অসাড় মৃত জগতে আমায় আকর্ষণ করল ।

ত্রিলোচন নীরব।

আমি শিহরিত, কম্পিত ।

ফুল্লরার পায়ের শব্দ ঘরের দরজায় এসে থেমেছে।

“লোকে বলে তুমি নাকি হাটের পাখিঅলার কাছ থেকে পাখি কিনেছিলে এক জোড়া ?” ত্রিলোচনকে আমি অযথা অকারণে হঠাৎ এই প্রশ্ন করে বসলাম।

“কিনেছিলাম।” ত্রিলোচন মাথা নোয়াল আস্তে করে।

“রঙ করা চড়ুই ?”

“…রঙটা পাকা ছিল না।”

“লোকটা তোমায় ঠকিয়েছিল।”

“না—না, না।” ত্রিলোচন আস্তে আস্তে ওষ্ঠের কোলে সামান্য হাসি ফেলল, “পাখিঅলা রঙ পাকা করতে পারে নি, পারলে তার জিত হত ।”

“আর তোমার হার হত।”

“অবশ্য । … কিন্তু কি জানো মুরারি, পাখিঅলা নয় ।” ত্রিলোচন ডান হাতের আঙুল মুড়ে নিজের নখ দেখল দু মুহূর্তে। “ফুল্লরা জানে আমি পশু পাখি মোটামুটি চিনি ।”

পশু শব্দটা আমার কাছে এই মুহূর্তে অপমানকর লাগল । ত্রিলোচনের চোখের দিকে তাকালাম। বোঝা গেল না, ত্রিলোচনের মনে কি আছে কি নেই।

সেদিন গভীর রাত থেকে আবার বৃষ্টি নেমেছিল। আমি জানতাম, এই বর্ষণ একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন জগৎ তৈরি করে আমায় প্রলুব্ধ করছে। আমি আমার ঘরের মৃদু আলোটুক এই মুহুর্তে নিবিয়ে দিতে পারি ।

অন্ধকার অনায়াসে বিস্তৃত প্রসারিত তমসায় একাকার হয়ে যাবে। ত্রিলোচনের ভগবান পাখির গায়ে পাকা রঙ দেবার আগে আমাদের ইন্দ্রিয়ে কাঁচা মালমশলা ঢেলেছে। আমার ইন্দ্রিয় তার রসনা লালায়িত করে এই সংসারে পাখিঅলা সাজতে চাইছিল।

সারা রাত বাইরে অন্ধকার অপেক্ষা করে থাকল, আমার ঘরে মৃদু আলো প্রতি মুহুর্তে আমার উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করছিল। কখনও কখনও নিজেকে আমি স্টার্ট দেওয়া মটরগাড়ির সঙ্গে তুলনা করে দেখছিলাম—যেন কেউ তার গাড়ির এঞ্জিন চালু করে কোথাও চলে গেছে এবং এক স্থানে স্থির থেকে গাড়িটা তার অপ্রতিরোধ্য যন্ত্রগুলোকে খাটিয়ে মারছে, চাপা গর্জনে কাঁপছে অবিরত।

এবং শেষরাতে তিলোচন নন্দীর আতস কাচ এই সংসারের কোনও অদৃশ্য পুরুষের বিশাল তীব্র চক্ষু হয়ে আমায় দেখতে লাগল। এই চক্ষু যেন ত্রিকাল দর্শক। আমি ভীত ঘর্মাক্ত তৃষিত হয়ে সেই চক্ষুকে বলেছিলাম, “তোমায় আমি বিশ্বাস করি ।”

ভোরের ক্লান্ত বিশৃঙ্খল ঘুমে আমি মড়কের স্বপ্ন দেখেছিলাম। ভয়ঙ্কর মড়ক। ত্রিলোচন নন্দী সেই পথে তার কিছু পরম বিশ্বাস, কিছু সরল যুক্তি নিয়ে পথ হাঁটছে। তার হাতে আমার আয়ুকে আমি সমর্পণ করে দিলাম। এই বীভৎস মড়কে না হলে বাঁচার উপায় ছিল না।

এবং রৌদ্র ঘরে এলে আমি ঘুম থেকে উঠে জানলার বাইরে কদমগাছ দেখলাম । ত্রিলোচন গাছতলায় দাঁড়িয়েছিল। ত্রিলোচনকে দেখে আমার হাতের কথা মনে পড়ল। বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমি আমার করতল লক্ষ করলাম। ত্রিলোচন নন্দীর কথা এই মুহূর্তে আমায় স্বীকার করতে হল, আমার হাতে আমি ধরা আছি ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *