তুচ্ছ

তুচ্ছ

পাতলা করে সিগারেট পাকাচ্ছিলেন বরদা। পায়ের সাড়া পেলেন। বুঝলেন, কানন এসেছে। মুখ তুললেন না। বাড়তি তামাক দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে ছড়িয়ে দিতে লাগলেন কাগজের ওপর সমান করে। বরদা যা করেন যথাসম্ভব পরিপাটি ভাবেই করতে চান।

কানন ঘরের চারপাশে একবার দেখে নিলেন। দরজা জানলা বন্ধ করে দিয়েছে ফাগুয়া। শীতের গোড়া থেকেই মশা বাড়তে শুরু করেছে। ধুনো দেওয়া উচিত ছিল। হয়ে ওঠেনি এতদিন। এইবার হবে। আজ মাসখানেক কানন এসব দিকে নজর দিতে পারেননি। খেয়ালও হত না অত। কাল থেকে ফাগুয়াকে ধুনো দিতে বলবেন।

স্বামীর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলেন কানন। কেমন মনমরা, উদাস হয়ে বসে আছে চুপচাপ। “খুব ফাঁকা লাগছে, না?”

বরদার সিগারেট পাকানো শেষ হয়েছিল। আঙুল দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সিগারেটটা একবার দেখে নিলেন। “হ্যাঁ, সাড়াশব্দ নেই, চুপচাপ।”

কানন বসবেন বলে মনে হল না। বড় সোফার মাথার দিকে কট্‌স উলের মাফলারটা পড়েছিল। আজ আর কর্তা বাইরে পায়চারি করতে বেরোননি। বাড়ির বাগানে সামান্য হাঁটাচলা করছেন। মাফলার নেননি।

মাফলারটা তুলে নিয়ে কানন স্বামীর দিকে এগিয়ে গেলেন। “তোমার কাঁধের ব্যথাটা গিয়েছে?”

“ব্যথা!” বরদাকে যেন দু মুহূর্ত ভাবতে হল। “ও ওই একটু ঝাঁকুনি লেগেছিল। ঠিক হয়ে যাবে।”

“রণ্টুটা ডাকাত। …নাও, মাফলারটা গলায় দিয়ে রাখো।”

“আবার মাফলার কেন?”

“সকালে গলা খুসখুস করছিল বলছিলে। অত সকালে ট্রেন, শীত পড়েছে, ঠাণ্ডা লাগিয়ে স্টেশনে না গেলেও পারতে।” কানন স্বামীর গলায় আলগা করে মাফলারটা জড়িয়ে দিলেন।

বরদা জবাব দিলেন না। চোখে নরম হাসির ছোঁয়া লেগে থাকল। অন্যমনস্কভাবে দেয়ালে টাঙানো বড় ছবিটার দিকে তাকালেন। হিন্দু মিশনের ছাপানো শ্রীকৃষ্ণের ছবি। কাচে চিড় ধরে গিয়েছে। রণ্টু টেনিস বল ছুঁড়েছিল।

“তুমি একটু বসো, আমি চা নিয়ে আসি। ক’টা কচুরি বেলে রেখে এসেছি। ভেজে আনব। খাবে তো?”

“আবার কচুরি?” বরদার গলা সামান্য খুঁতখুঁতে শোনাল।

“খাও না। এখন তো সবে সন্ধে।”

কানন চলে গেলেন।

বরদা সিগারেট ধরালেন। নরম তামাক ছাড়া তিনি খেতে পারেন না। বরাবরের অভ্যেস। বড় জামাই দুটো গোল টিন এনেছিল তামাকের। বিলিতি জিনিস। প্লেয়ার্স নেভিকাট। গোয়া বেড়াতে গিয়ে পেয়ে গিয়েছিল। শ্বশুরমশাইয়ের জন্যে নিয়ে এসেছিল দু’টিন। তামাকটা কড়া। বরদা ঠিক সহ্য করতে পারেননি প্রথমটায়। পরে ধাতস্থ হয়েছেন খানিকটা। তবু গলায় লাগে। তামাকের জন্যেই হোক কিংবা অন্য কোনো কারণে গলার কাছটায় লাগল।

অন্যমনস্কভাবে বরদা টেবিল হারমোনিয়ামটার দিকে তাকালেন। সেকেলে ডোয়ার্কিনের হারমোনিয়াম। নিজের এমন কিছু গান-বাজনার নেশা ছিল না। একটু আধটু ধর্মসঙ্গীত গাইতেন। জগদীশ বলত, বেহ্মদের গান। জগদীশ দূর সম্পর্কে ছোট ভাই। সে গান-বাজনা, ব্রাহ্মদের খবর রাখত। বরদা ব্রাহ্ম নন, ষোল আনা হিন্দু। কাননের কিছুটা চর্চা ছিল গানের। গলাও ছিল সরু, সুরেলা। কাননের জন্যেও যে হারমোনিয়ামটা কেনা হয়েছিল তাও নয়। ভাগা কোলিয়ারিতে থাকার সময় জগদীশ আসত মাঝে মাঝে কলকাতা থেকে। তার খানিকটা জেদাজেদিতে কেনা। জগদীশই ওটা জুটিয়ে দিল। কানন গাইত। ততদিনে নিন্‌নি—মানে নয়ন, বরদাদের বড় মেয়ে, সাত কি আট বছরের। কানন বড় মেয়েকে গান শেখাত ওই হারমোনিয়াম বাজিয়ে। পরে অবশ্য নিন্‌নির গানের মাস্টার, ডুগি-তবলা হাত হারমোনিয়াম সবই হয়েছিল। কিন্তু সেসব আজ কোথায়। কিছুই নেই। নিন্‌নি গান-টান ভুলে গেছে। গলা মোটা হয়েছে, গিন্নি বান্নির মতন। তার মেয়েরও গলা আছে গানের। তবে নিন্‌নিদের টেবিল হারমোনিয়ামটা পাঁচ ঘাটের জল খেয়ে এখনও টিকে আছে। এখনও তাতে ভাঙাচোরা সুর বাজে। কদাচিৎ কাননের হাত পড়লে সেটা বোঝা যায়।

তবে জীবনে এই ভাবেই তো কিছু থাকে, কিছু আর থাকে না। বরদার দুই মেয়ে, দুই ছেলে। নিন্‌নি বড় মেয়ে। বাচ্চা বেলায় নিজের ‘নয়ন’-নাম সহজ করে নিয়েছিল। তখন থেকেই ‘নিন্‌নি’। মেয়ের পর ছেলে জয়, জয়ন্ত। জয়ের পর আবার তিন্‌নি, মানে তনু। তিন্‌নির পর ছোট ছেলে গগা, গগন। চার ছেলেমেয়ে, তবু বরদাদের কাছে আর আজ কেউ নেই। বড় মেয়েরা এখন থাকে বোম্বাইয়ে। জামাই টেক্সটাইল ডিজাইনার। ভালই কাজকর্ম করে। দুটি ছেলেমেয়ে। দুটিই একরকম বড়সড়। মেয়ে বড়, ছেলে ছোট। মেয়ে কিশোরী। বড় ছেলে জয়ন্ত রয়েছে পারাসিয়ায়, মধ্যপ্রদেশে। বাবার মতন সেও কোলিয়ারির ম্যানেজারি করে জীবন কাটাচ্ছে। একটি মাত্র ছেলে। ছোট মেয়ে তিন্‌নি আর জামাই রয়েছে আগ্রায়। ওরা আবার আর্মিতে। ডাক্তার। ছোট জামাইকে এখনও ছোকরা ছোকরা দেখায়। দুই বাচ্চা, দুটোই ছেলে। তাদেরও আট দশ করে বয়েস হল।

চার ছেলেমেয়ের তিনজনই কতকাল থেকে বাইরে। দূরে দূরে ছড়িয়ে রয়েছে। একমাত্র ছোট ছেলে গগা, বাহারি করে গগন, মা-বাবার কাছে ছিল। কাছে থাকা মানে গায়ে গায়ে লেপ্টে ছিল না, রাঁচিতে পড়াশোনা করছিল হস্টেলে থেকে। বছরের মধ্যে মাস চার মা-বাবার কাছেই কেটে যেত। তা ছাড়াও ছুটকো-ছাটকা আসা-যাওয়া ছিল বাড়িতে। সেই গগা পড়াশোনা শেষ করে ডালমিয়া নগরে কাজকর্ম জুটিয়ে নিয়েছিল। ছুটি-ছাটায় মা-বাবার কাছে আসত। বছর খানেক হল রুরকেল্লায় চলে গিয়েছে গগা। এখন হুট করে আসতে পারে না। তবু এবার এসেছিল।

এবার সকলেই এসেছিল। কতকাল পরে সবাই এক জায়গায় জড় হয়েছিল, অন্তত বছর বারো পরে। সবাইকে একই সময়ে এক জায়গায় পাওয়া ভাগ্য। এবার সে-সৌভাগ্য হয়েছিল। তবু কিছু খুঁত থেকেই গেল। বড় মেয়ে জামাই গোয়া বেড়িয়ে এখানে পৌঁছতে পৌঁছতে গগার ফেরার সময় হয়ে গেল। আবার বড় ছেলে চলে যাবার মাত্র দিন চার আগে এল ছোট মেয়ে।

তবে এরকম খুঁত হয়েই থাকে। বরদা সবাইকে চাইছিলেন বলেই একসঙ্গে সকলকে টানা এক মাস কাছে পাবেন—তা তো হয় না। কাজকর্ম, অফিস, ছুটি, নিজের সুবিধে অসুবিধে সকলেরই আছে। যে যার সুবিধে মতন আসবে, যাবে। জোর করার কিছুই নেই।

বরদার বয়স পঁয়ষট্টি ছাড়িয়ে গেল। বার্ধক্য গায়ে লেগেছে। মনেও। বরদার বাবা ঠিক ছেষট্টিতে চলে গিয়েছিলেন। ঠাকুরদা চৌষট্টিতে। ষাটের পর থেকেই বরদা চৌষট্টি আর ছেষট্টির হিসেব করতে শুরু করেছিলেন। তখন থেকেই তাঁর বড় ইচ্ছে ছিল, আলাদা আলাদা ভাবে নয়—সবাই একসঙ্গে এসে কিছুদিন থাকুক, মাসখানেক বা পনেরো দিন। কাননকে বলতেন প্রায়ই। কানন স্বামীর হিসেবে বাড়াবাড়িটা পছন্দ করতেন না, কিন্তু চাইতেন ছেলেমেয়ে নাতি-নাতনিরা সবাই একবার একসঙ্গে এসে হাজির হোক, থাকুক কিছুদিন।

চিঠি লেখালেখি, ডাকাডাকি করেও এই পারিবারিক মিলনটা ঘটে উঠছিল না। বাধা পড়ে যাচ্ছিল। বড় মেয়ের সময় হয় তো ছোটর হয় না। ছেলের হয় তো জামাইদের হয় না। চার বছর অপেক্ষার পর এবার হল। হবার আরও বিশেষ কারণ, বরদা ছোট ছেলের বিয়ের ব্যাপারটা সকলের মতামত নিয়ে মিটিয়ে দিতে চান। বিয়ে দু চার মাস পরে হোক ক্ষতি নেই, কিন্তু পাটনার গৌরীবাবুকে অনর্থক বসিয়ে রাখা যায় না। গৌরীবাবুর মেয়েকে বরদার বেশ পছন্দ। এখন বাড়িতে যে যা বলে।

কথা ছিল পুজোর মুখে সবাই চলে আসবে। পরে ঘটনা যা গড়াল—তাতে পুজো থেকে শুরু হল আসা, আর কালীপুজোর মুখোমুখি সবাই একত্র হতে পারল। আর তার পরই যাবার পালা। প্রথমে চলে গেল ছোট ছেলে গগা। বড় মেয়ে-জামাই গেলে দেওয়ালি পার করে। বড় ছেলে জয়ন্ত গিয়েছে গত হপ্তায়, আর আজ গেল ছোট মেয়ে-জামাই। একেবারে ভোরের দিকে ট্রেন: ছ’টা পাঁচ। রোদ ফোটেনি, নতুন শীতের ঠাণ্ডা, মাঠঘাট গাছপালা জড়িয়ে কুয়াশা; তবু বরদা স্টেশনে তুলে দিতে গিয়েছিলেন মেয়ে-জামাই নাতিদের। কানন আর যেতে পারেননি। মাসখানেক ধরে বাড়িটা গমগমে ছিল, কখনও খুব বেড়েছে গমগমানি, কখনও কমেছে। আজ সকাল থেকে একেবারে শান্ত, চুপচাপ, যেমন থাকত সেরকম: বাড়িতে এখন বরদা আর কানন। অন্য যারা, তারা হল ফাগুয়া আর গোপালি। ফাগুয়া এ-বাড়ির হাফ-কর্তা, আর গোপালি থাকে গিন্নির সঙ্গে রান্নাঘরে।

পায়ের শব্দ খেয়াল করেননি বরদা, কাননের গলা পেলেন।

“নাও, খুব খাস্তা হয়েছে, ধীরেসুস্থে খাও। আমি চা নিয়ে আসছি।” কানন কাচের ডিশটা স্বামীর দিকে এগিয়ে দিলেন।

হাত বাড়ালেন বরদা। “এত?”

“এত কোথায়! মত্তর চারটে। তাও ছোট ছোট।”

“অম্বল হবে। রাত্তিরে কিছু মুখে দিতে পারব না।”

“নাও তো, আগে থেকেই অম্বল! কিচ্ছু হবে না। সোডা আছে ময়দার সঙ্গে। হয় যদি—ওষুধ খেয়ে নিও।”

কানন ছোট টি-পয়টা টেনে স্বামীর সোফার পাশে রাখলেন।

বরদা কচুরির গন্ধ শুঁকলেন যেন। তাতটা অনুভব করতে পারছিলেন হাতে।

“খাও, আমি আসছি চা নিয়ে।”

কানন চলে গেলেন।

বরদা আঙুল দিয়ে গরমটা পরখ করলেন। আর একটু না জুড়োলে মখে দিতে পারবেন না। ডিশটা টিপয়ের ওপর নামিয়ে রাখলেন। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, এক সময়ে কে কত গরম জিবে সহ্য করতে পারে এই নিয়ে কাননের সঙ্গে তামাসা হত। বরদা জিততেন। গরম বেগুনভাজা মুখে পুরে দিয়েও তিনি ফেলে দিতেন না। কানন পারতেন না। আবার কানন হাতে যতটা গরম সহ্য করতে পারতেন বরদা পারতেন না। তুমি মেয়ে, রান্নাবান্না করো, তোমার গরম সওয়া অভ্যেস হয়ে গিয়েছে, ও আর বাহাদুরির কী! কাননও পালটা জবাব দিতেন। অবশ্য সে-জবাব মনে পড়লে বরদা এখন যেন সামান্য লজ্জা পান। ভালও লাগে। ঝরাপাতা আর তো গাছের ডালে জুড়ে দেওয়া যায় না!

নিন্‌নির মেয়ে পুসি একেবারে দাদুর গুণ পেয়েছে। গরম খেতে খুব ওস্তাদ। বরদা তাঁর নাতনির শরীরের গড়ন এবার যা দেখলেন তাতে খুব খুশি হয়েছেন। কিশোরী মেয়ে—ছিপছিপে গড়ন, লম্বা মুখ, রঙ একটু মাজা, কিন্তু বেশ দেখায়। তবে চেহারায় চলনে কেমন অ-বাঙালি ভাব।

কানন এলেন। চা নিয়ে এসেছেন দুজনের জন্যেই। বরদার জন্যে কাপ; নিজের জন্যে কাচের গ্লাস। কানন গল্পগুজবের সময় একগ্লাস চা হাতে নিয়ে বসেন।

“কী! খাচ্ছ না যে?” কানন চায়ের কাপ নামাতে নামাতে বললেন।

“খুব গরম। একটু ঠাণ্ডা হোক।”

“হয়ে গেছে এতক্ষণে। খাও।”

কানন সরে এসে অন্য সোফায় বসলেন।

বরদা আবার কাচের ডিশ উঠিয়ে নিলেন। “তুমি নাও না দুটো।”

“আমি! আমার কি এই খাবার সময়! রাত্তিরে একটা মুখে দেব।”

“তা দিয়ে। এখন নাও একটা।”

“না না,” মাথা নাড়লেন কানন, “তুমি খাও। অত খাস্তা আমি খেতে পারি না। তুমি ভালবাস বলে করেছি।’

বরদা হাসির মুখ করলেন। কচুরি মুখে দিলেন। “কড়াইশুঁটি?”

“হ্যাঁ।”

বরদার ভাল লাগছিল খেতে। আয়াস করে খাচ্ছিলেন।

“কেমন হয়েছে গো?” কানন জিজ্ঞেস করলেন।

“চমৎকার।”

কানন হাসলেন। চা খেলেন এক ঢোক। তারপর হঠাৎ কী মনে করে বললেন, “তিন্‌নিরা এখন তিনদিন বেনারসে কাটাবে। ননদাই হা-হা করছে।”

“হ্যাঁ। এই সময়টা বেনারসে ভাল।”

দুজনেই চুপচাপ হয়ে গেলেন। বরদা খাচ্ছিলেন। কানন চায়ে চুমুক দিচ্ছেন।

কানন স্বামীকে দেখছিলেন। উনি বয়েস বয়েস করে মুষড়ে পড়েন, কিন্তু কে বলবে বয়েস ওঁকে চার পাশ থেকে জড়িয়ে ধরেছে? এখনও কেমন মোলায়েম গায়ের রঙ! আঠাশ তিরিশ বছর কয়লা ঘেঁটেও রঙে কতটুকু আর ময়লা পড়েছে! তবে হ্যাঁ, কয়লার দেশে জীবনের অর্ধেক কাটাবার দরুন ওঁকে এক ধরনের ব্রংকাইটিস রোগে ধরেছে। ভোগায় বেশ। এত করেও তা আর গেল না। তবু এই ফাঁকা শুকনো জায়গায় ঘরবাড়ি করেছিলেন বলে খিদে, শরীর-স্বাস্থ্য অনেকটা ভাল আছে। জলবাতাসের গুণ।

কাননের হঠাৎ চোখে পড়ল, কর্তার গালের আঁচিলটা আলোয় কেমন মাছির মতন দেখাচ্ছে। আর সঙ্গে সঙ্গে সেই কথাটা মনে এসে গেল। কানন একবার, নতুন বউ যখন, স্বামীর গালের আঁচিল তোলার জন্যে পায়ের কড়া তোলার ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছিলেন। দিয়ে সে এক কেলেঙ্কারি। যদিও ব্যাপারটা ভুল করে হয়ে গিয়েছিল, তবু শ্বশুর-শ্বাশুড়ির কাছে বড় লজ্জায় পড়েছিলেন কনন। বরদার খোঁচা তো ছিলই।

কথাটা মনে পড়ায় কাননের কেমন হাসি পেল। হেসেই ফেললেন।

বরদা তাকালেন। “খাব না খাব না করেও তিনটে খেয়ে ফেললাম। হাসছ ?” বরদাও হাসলেন।

“না, তাঁর জন্যে হাসিনি।”

চা মুখে তুললেন বরদা। ময়ানে মুখ মেরে দিয়েছে। কয়েক চুমুক চা খেয়ে বললেন, “সেদিন তিন্‌নি কী একটা করেছিল আগ্রাই খানা। ডালপুরির মতন…। ভালই করেছিল।”

কানন স্বামীকে দেখলেন। বলতে চাননি তবু মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, “ওই খেয়ে তো তোমার শরীর খারাপ করল সেদিন।”

“না না, ওটা খেয়ে কেন করবে! এমনিতেই আজকাল তেল ঘি আর সহ্য হয় না।”

কানন কিছু বললেন না। সেদিন তাঁর বেশ রাগ হয়েছিল। মুখ ফুটে এক-কথা বার বার বলা যায় না। মেয়ে তার বাপকে ডালপুরি গোছের কিসের এক খাদ্য করে খাওয়াবে, তাতে বলার কিছু নেই। তবু কানন ছোট মেয়েকে বলে দিয়েছিলেন, শুকনো লঙ্কা, হিং কম দিতে। মেয়ে ঠিক উলটোটাই করল। ছোট জামাই আবার ঝাল হিং নুন বেশি পছন্দ করে। মেয়ে বাবার নাম করে করল সেই খাদ্য, কিন্তু স্বাদে এমন করল যেন তার স্বামীর মুখে রোচে। হিমাংশুর মুখে রুচলো, অন্যদিকে কানন তার কর্তাকে নিয়ে রাত্রে ঘণ্টাখানেক ভুগলেন। বুক জ্বলতে লাগল কর্তার, গ্যাস হল, হেঁচকি উঠতে লাগল মিনিটে মিনিটে। কাননের ভীষণ রাগ হয়েছিল ছোট মেয়ের ওপর। মুখে বলিস বাবা, নজর রাখিস বরের দিকে। বেহায়া।

বরদা শেষ কচুরিটা মুখে দিলেন। “রণ্টু বেশ লায়েক হয়ে গিয়েছে, কী বলো?”

রণ্টু ছোট মেয়ের বড় ছেলে। রন্টু আর লেণ্টু। লেণ্টু ছোট। আজই সকালে সব চলে গেল। যাবার আগে রণ্টু এমন ভাবে তার দাদুর ডান হাত টেনে বারান্দার সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামাল যে সেই ঝটকা বরদা সামলাতে পারলেন না। তাঁর লেগেছিল। খানিকটা বাতের ধাতও তো রয়েছে। বয়েস হল। রণ্টু খুব খারাপ কাজ করেছিল। বরদা পড়ে যেতে পারতেন মুখ থুবড়ে। ছোট ছেলে, বাচ্চা, যাবার মুখ তখন, কানন দুর্গা দুর্গা করে বিদায় দিচ্ছেন মেয়ে-জামাইকে, চোখে জল—তবু রণ্টুর কাণ্ড দেখে তাঁর মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। অন্য সময় হলে হয়ত ধমক দিতেন। যাবার মুখে নাতিকে কিছু বলতে পারলেন না। শুধু কড়া গলায় বললেন, ‘কী হচ্ছে’। মেয়ে-জামাই ব্যাপারটায় গা করল না, তিন্‌নি শুধু বলল, ‘আ রণ্টু, দাদুকে অমন করো না।’

স্ত্রীর কাছে জবাব না পেয়ে বরদা নিজেই বললেন, “মিলিটারির ছেলে তো, বেটা এখন থেসেই দস্যু।” বলে হাসলেন।

কানন এবারও কিছু বললেন না। রণ্টু লেণ্টু দুটোই ডাকাত। তবে রণ্টুর দস্যিপনার শেষ নেই। কানন পাগল হয়ে গিয়েছেন। এ-বাড়ির কত জিনিস যে তার হাতে পড়ে নষ্ট হয়েছে, কত কী ভেঙেছে—তার শেষ নেই। কর্তার শখের একটা বায়নোকুলার ছিল, সেটাও গুঁড়িয়ে রেখে গিয়েছে।

চায়ে আবার মুখ দিলেন কর্তা। কচুরি শেষ। ঢেঁকুর তুললেন। ঘরের চারপাশে তাকালেন। অন্যমনস্ক। কিছুক্ষণ পরে চা শেষ করে বললেন, “তোমার নাতি-নাতনিদের মধ্যে সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট কে বলো তো?”

কানন তখনও চায়ের গ্লাস নামাননি। স্বামীর দিকে তাকালেন। মানুষটা সারাদিনই মেয়ে-জামাই, ছেলে, নাতি-নাতনির কথা ভেবেছে। অন্য চিন্তা নেই। কথা না বললে ভাল দেখায় না যেন, নিস্পৃহ গলায় বললেন, “জানি না। কেন?”

বরদা স্ত্রীর অজ্ঞানতায় যেন মজা পেলেন। হাসি মুখে বললেন, “বুঁচুবাবু।” বলে সামান্য শব্দ করে হেসে ফেললেন।

বুঁচু—মানে জয়ন্তর ছেলে। বড় ছেলের ছেলেকে কাননেরও পছন্দ। গোলমাল, নাক ঘেঁদা ছেলে। ঠাট্টা করে বরদা ডাকতেন বুঁচুবাবু বলে। ছেলেটা শান্ত ধাতের। ভীষণ মাথা। আকাশের তারা চেনে অনেকগুলো। কানন বললেন, “হ্যাঁ, তা মাথা আছে।”

“শুধু আছে কি গো! তার বাপ ঠাকুরদারও এই বয়সে অত মাথা ছিল না। বুঁচুবাবু আমাকে একদিন গান্ধির ঠিকুজি শুনিয়ে দিল।”

“লেখাপড়া তো শুরু করেছে।”

“খুব ইনটেলিজেন্ট। তবে তোমার নাতনির মাথা তেমন পরিষ্কার নয়। হোস্টেলে থেকে পড়ছে শুনলাম, কিন্তু নলেজ বড় পুয়োর। ছোটখাট ইংরেজির মানে জানে না। জেনারেল নলেজ একেবারেই নেই। বিবেকানন্দকে বলল সাউথ ইন্ডিয়ান।”

“তা কী হবে! বাঙালির ছেলেমেয়ে বাংলাদেশের বাইরে থাকলে এই রকমই হয়। ওর আর দোষ কি! তার ওপর মা-বাবার আদরে গোবরে ফ্যাশান শিখছে। থাকে হোস্টেলে, সেখানে যত রাজ্যের পাঁচমেশালি মেয়ে। মাথার চুল, স্কার্ট, ব্লাউজ, সালোয়ার কামিজ নিয়ে ব্যস্ত। অত বড় মেয়ে প্যাণ্ট পরে আদিখ্যেতা করে। মেয়েদের গা পা হলে ভাল দেখায় এসব! কী বিচ্ছিরি লাগে দেখতে! বলতে তো পারি না। ওর মা-বাপ আবার কিছু মনে করবে।”

বরদা স্ত্রীর বিরক্তি ধরতে পারলেন। মনে হল, বড় নাতনির নিন্দে যেন বেশি হয়ে যাচ্ছে। সেটা পুষিয়ে দেবার জন্যে সামান্য গলা তুলে বললেন, “তবে যাই বলো, পুসি দেখতে বেশ সুন্দর হয়ে উঠেছে। কাটা-কাটা চেহারা, চোখা নাক-মুখ। দাঁতগুলো দেখেছ? ধবধবে, ওয়েল-সেট।” বলে বরদা যেন নাতনির রূপের সমঝদার হয়ে হাসলেন খোলামেলা ভাবে।

কানন চায়ের গ্লাস নামিয়ে রেখেছিলেন। বললেন, “হ্যাঁ, মেয়েরও সেই দেমাক, তার মায়েরও ওটা মুখের বুলি।” কানন মাথার কাপড় ঠিক করে নিলেন। সামান্য শীত লাগছে। গায়ের চাদরটা এনে বসলে হত। “মেয়ে আবার রঙ্গ করে আমায় বলে, আমি সিনেমায় নামব, দাদি।”

বরদা হেসে ফেললেন। তারপর খোলা গলায় বললেন, “গানের গলাও ভাল।”

“হ্যাঁ”, কানন কেমন উপেক্ষার ভাব করে প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেলেন। স্বামীর পায়ের দিকে চোখ পড়ল। “মোজা পরোনি?”

বরদা নিজের পায়ের দিকে নজর করলেন অকারণে। “না। বাড়িতেই ছিলাম…পরিনি।”

“মোজা এনে দি। পরো। পায়ে ঠাণ্ডা লাগবে।”

মোজার প্রয়োজন ছিল না বরদার। ঠাণ্ডা তেমন লাগছে না, পায়ের তলায় চটি রয়েছে। তবে দু একটা মশা কামড়াচ্ছিল।

কানন উঠলেন। ওঠার সময় কাচের গ্লাসটা তুলে নিলেন।

বরদা বললেন, “আসার সময় একটা দেশলাই নিয়ে এসো তো।”

কানন চলে গেলেন।

পায়ের দিকটা একবার চুলকে নিলেন বরদা। মশা বাড়তে শুরু করেছে। ছোটাখাট কটা কাজ করব করব করে করা হয়নি। কালই একবার ফাগুয়াকে দীনদয়ালবাবুর কাছে পাঠাতে হবে। অবশ্য তার আগে বাগানের পাতা-টাতা জঞ্জাল সাফ করে পুড়িয়ে নেওয়া দরকার, ড্রেনটাও পরিষ্কার করতে হবে। খানিকটা সাফসুফ করানোর পর দীনদয়ালের লোকেরা তেল ছড়িয়ে দিয়ে গেলে মশা একটু কমতে পারে। আসলে বাড়িতে লোকজন ছিল বলে এইসব কাজে নজর পড়েনি।

ফাগুয়া কাপ ডিশ নিতে এসেছিল। বরদা তাকে বাগান পরিষ্কারের কথা বলে দিলেন।

চলে গেল ফাগুয়া।

অন্যমনস্কভাবে বরদা আবার সিগারেটের তামাক তুলে নিলেন। আজ বাড়িটা সত্যিই ফাঁকা লাগছে। একেবারে চুপচাপ নিঝুম। এখনও হয়ত সাড়ে সাতটা বাজেনি, বাজলে পাটনা এক্সপ্রেসের শব্দটা শুনতে পেতেন। কই, কানে যায়নি গাড়ির শব্দ, অথচ এই চুপচাপ ফাঁকার জন্যে মনে হচ্ছে কতটা যেন রাত হয়ে এসেছে।

কাল এই সময় রণ্টু ভূত সেজে নাচছিল, লেণ্টু ক্যারামের গুটি ঘরময় ছড়িয়ে তারস্বরে চেঁচাচ্ছিল। ওদিকে তিন্‌নি গোছগাছ নিয়ে ব্যস্ত। এক আধবার ছোট জামাইয়ের গলা পাচ্ছিলেন বরদা। আজ কারও গলা শোনা যাচ্ছে না। যাবেও না। বরদার মাঝে মাঝে ভয় হয়, তিনি যাবার সময় হয়ত ছেলেমেয়েদের কাউকেই কাছে পাবেন না, কারও গলা শোনা হবে না, মুখ দেখা ঘটে উঠবে না। হতে পারে, এবার যা দেখলেন—এই শেষ। বুক ভারি হয়ে নিশ্বাস পড়ল বরদার।

অথচ এ বড় আশ্চর্য, কিছুদিন আগে সবাই যখন এ-বাড়িতে, ছেলেমেয়ে জামাই নাতি নাতনি—তখন এ-সব কথা মনে আসত না তেমন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বাড়ি গমগম করত। একদিকে বড় মেয়ে, বউমা, ছোট মেয়ে; অন্যদিকে ছেলে জামাইরা; নানান কথাবার্তা, গল্পগুজব, হইহই, তর্কাতর্কি—কান পাতলেই কত রকমের গলা, কলরোল । এর ওপর নাতি-নাতনিরা। বাড়ি ভরাট হয়ে ছিল। তখন সময় যে কোথা দিয়ে পালিয়ে যেত কে জানে! সময় পালাত, আর মনও খাঁখাঁ করত না। আজ আর কেউ নেই, শেষ পর্যন্ত যারা ছিল তারাও চলে গেল। সত্যিই বাড়ি বড় ফাঁকা লাগছে।

কানন এলেন। অনেক কিছু এনেছেন। স্বামীর মোজা আর নতুন দেশলাই। নিজের গায়ে পাতলা চাদর উঠেছে। হাতে পশমের গোলার কাঁটা। মুখে পান।

স্বামীকে মোজা আর দেশলাই দিলেন। দিয়ে নিজের জায়গাটিতে বসলেন।

বরদা মোজা পরে নিলেন। তারপর হঠাৎ বললেন, “তোমার বড় ছেলে মন্দ কথা বলত না।”

কানন তাকালেন। কথাটা ধরতে পারেননি। “কী বলত?”

“এই ঘরবাড়ি বেচে দিয়ে চলে যেতে।”

“কোথায়?”

“কেন, তোমার অভাব কী! চার ছেলেমেয়ে…। দু চার মাস করে এক একজনের কাছে কাটালেও বছর কেটে যাবে।”

কানন স্বামীকে লক্ষ করতে করতে বললেন, “শুধু আমার কাটবে? না তোমারও?”

“ওই হল—!” বরদা হাসিমুখ করলেন। “তোমার বলতে এই বুড়ো গাধাবোটটাও রয়েছে।”

কানন হাসলেন না। বুড়ো গাধাবোটকেই দেখছিলেন। স্বাস্থ্য তো তেমন ভাঙা নয়, গালে-গলায় দাগ পড়েছে অনেক—তবু তা ঢিলে কোঁচকানো চামড়া হয়ে ওঠেনি। মাথার চুল সব সাদা। এটা শুধু বার্ধক্যের জন্যে কেন হবে, চল্লিশেই কর্তার চুল পাকতে শুরু করেছিল। এখন তো সাদা হবেই। নিজেকে এত অথর্ব অক্ষম ভাবার কিছু নেই ওঁর। যৌবনে যত সতেজ, সক্ষম, পরিশ্রমী ছিলেন—এ-বয়সে মানুষ তা থাকে না। থাকার কথাও নয়। বয়েসের হাতে যতটা ছেড়ে দেবার সব ছেড়ে দিলেও স্বামীকে কোথাও তো বিশ্রী দেখায় না। বরং কানন তো ভালই দেখেন।

বরদা নতুন করে সিগারেট পাকাতে লাগলেন। বললেন, “শেষ পর্যন্ত তাই করতে হবে। তোমার ছোট ছেলের বিয়েটা দিয়ে নি…। তারপর…”

“তারপর ঘরবাড়ি বেচে দেবে?”

বরদা তাকালেন। স্ত্রীর গলা সামান্য রুক্ষ লাগল।

“দেব বললেই দেওয়া যায় না,” বরদা বললেন, “তবু আর কী করার আছে! গগার বিয়ে দিয়ে তার বউকে তো তুমি এখানে রাখতে পারবে না। ছেলে তার বউ নিয়ে চলে যাবে। না নিয়ে গেলে তারই বা চলবে কেন!”

“আমি কি নিয়ে যেতে দিচ্ছি না?” কানন একই ভাবে বললেন, অপ্রসন্ন গলায়।

“কথা তা নয়,” বরদা স্ত্রীর দিকে সরাসরি তাকালেন, “আমি বলছি, শেষ পর্যন্ত কী হবে! সেই আমরা দু জন, আর এই ঘর বাড়ি। আর আমি যদি চলে যাই—তুমি একলা। থাকতে পারবে কেন?”

কানন রীতিমত অসন্তুষ্ট হলেন বিরক্তির গাম্ভীর্য মুখ গুমট করে তুলল। উলের গোলা কোলের ওপর ফেলে রেখে হাতের বোনাটা একবার দেখলেন। মনে মনে হিসেব করলেন যেন, কোথায় থেমে গিয়েছিলেন।

“আমার কথা তোমায় ভাবতে হবে না।” কানন শক্তভাবে বললেন, “নিজের কথা ভাব। যা ভাল লাগে করো।”

বরদা বুঝতে পারছিলেন স্ত্রী রেগে উঠেছেন। তাঁর কেমন মজা লাগছিল। কানন কোনো কালেই মাথা গরমের মানুষ ছিল না। তবে তার চটে ওঠার ধরন অনেকটা এই রকমই। কারণে যত না চটে ওঠে, অকারণে তার চেয়ে বেশি। ঠাট্টা করে বরদা বললেন, “তোমার ভাবনা কে ভাববে?”

“দড়ি কলসি!” বলে কানন গলায় কলসি বাঁধার ভঙ্গি করলেন।

বরদা হেসে ফেললেন। খানিকটা জোরেই।

সিগারেট পাকানো হয়ে গিয়েছিল বরদার। “তোমার আজ মন-মেজাজ খুব খারাপ, তাই না?”

কানন কোনো রকম জবাব দিলেন না।

পাকানো সিগারেটের মুখের দিকটা দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে গুঁজে নিতে নিতে বরদা বললেন, “ভরতি বাড়ি ফাঁকা হয়ে গেলে মন-মেজাজ খারাপ হয়। তাই না?”

কানন বলব না বলব না করেও হঠাৎ বললেন, “তোমার হচ্ছে হোক, আমার নাই বা হল।”

বরদা স্ত্রীর চোখের দিকে তাকালেন। কাননকে গম্ভীর জেদী দেখাচ্ছিল।

বরদার কিছু যেন খেয়াল হল। চোখ সরিয়ে নিলেন। সিগারেট ধরালেন অন্যমনস্কভাবে। মাথার ওপর চোখ তুলে দু মুহূর্ত ছাদ দেখলেন। মুখ ফিরিয়ে নিলেন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। কানন কোনো কালেই তেমন অসহিষ্ণু নয়। সংসারের হাজার ধকল স্বাভাবিকভাবেই সয়েছে বরাবর। চার-চারজন ছেলেমেয়ে মানুষ করা তো সোজা কথা নয়। তার ওপর স্বামী আছে, এসো-জন বসো-জন আছে। বরদা অবাক হয়ে লক্ষ করেছেন, কানন এই কিছুদিন কেন যেন অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিল। বাড়ি ভরতি লোকজন, হই হট্টগোল, হাট-বাজার, রান্না; ঘরদোর তদারকি—এটা বোধ হয় কাননের এই বয়সের শরীরে পোষাচ্ছিল না। হতেই পারে। ছেলেমেয়েরা সবাই আসার পর প্রথম প্রথম কাননের যত মন-ভরা, উৎফুল্ল ভাব ছিল, ক্রমশই সেটা কমে আসতে লাগল। বরদা এটা ধরতে পারতেন। রাত্রে স্ত্রীকে এক-আধবার জিজ্ঞেসও করেছেন—“তোমার কী হয়েছে? শরীর খারাপ?” কানন মাথা নেড়েছেন—“না।” কিন্তু বরদা বুঝতে পারতেন কাননের কিছু হয়েছে। আড়ালে গজগজ করে, বিরক্ত, হয়, অভিমান ধরা পড়ে তার।

বরদা আবার স্ত্রীর দিকে তাকালেন। কানন বোনা শুরু করেননি। ঘর-ভুল-করা বুনন খুলে ফেলছেন। যেন রাগ করেই খুলছেন।

ছোট করে কাশলেন বরদা। গলা পরিষ্কার করলেন। “তোমার কী হয়েছে বলো তো?”

কানন মুখ তুললেন না, জবাব দিলেন না কথার।

“কই গো, কী হয়েছে বলছ না যে!” বরদা নরম, খানিকটা হাসিহাসি গলায় বললেন।

এবারও কানন চুপ।

কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বরদা আবার বললেন, “আহা, একবার তাকাও না। উল বোনা পালিয়ে যাচ্ছে না!”

“তোমার জন্যেই বোনা হচ্ছে।” কাঠ-কাঠ জবাব কাননের।

“আমার আবার কী!”

“হাত-কাটা সোয়েটার।”

“আবার কটা হাতকাটা লাগবে । দু তিনটে রয়েছে।”

“ছিল। এখন নেই। একটা ফাগুকে দিয়েছি। একটা কাঁধ পিঠ ছিঁড়ে গিয়েছে। বাড়িতে পরার জন্যে একটা বুনছি।”

“ও, আচ্ছা!”

“তোমার ছেলের বউ ভাল বুনতে জানে, ছোট মেয়ে জানে। অনেক বড় বড় কথা শুনলাম। ক্ষেত্ৰবাবুকে দিয়ে উল আনিয়ে দিলাম ধানবাদ থেকে। তা তাঁরা দু জন তো বদলা-বদলি করে একমাস ধরে একটা পাশ শেষ করলেন। কত ছুতোনাতা ওদের।”

বরদা বললেন, “সময় পায়নি। সারা দিন তো গল্পগুজব, রান্নাবান্না, ছেলেমেয়ে সামলে কেটে যেত। পাঁচজন একসঙ্গে হলে এরকম হয়।”

কানন স্বামীর দিকে তাকালেন না, শ্লেষের গলায় বললেন, “তা ঠিক, কোলে দুটো চারটে কচি নিয়ে বসে আছে সব, বুড়ো শ্বশুরের একটা সোয়েটার বুনতে সময় হয় না। অথচ নিজের স্বামী ছেলেমেয়ের এটা সেটা বুনতে তো সময় হয়।” কাননের গলায় ক্ষোভ ছিল। রাগও।

বরদা সামান্য অপ্রতিভ হলেন। মনে হল, ছেলের বউ আর মেয়েকে তিনি সমর্থন করেছেন বলে অসন্তুষ্ট হচ্ছে। কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ থেকে বরদা বললেন, “তুমি আবার মিছেমিছি রাগ করছ। সত্যি বলো, কতদিন পরে এক সঙ্গে হল, কোথায় দুটো কলকল খলখল করবে, বেড়াবে—না সব ফেলে আমার সোয়েটার বুনবে! সব জিনিসই একটু ইয়ে-কী বলে ছেড়েছুড়ে দেখতে হয়।”

কানন তাকালেন। ক্ষুব্ধ। হয়ত রাগও হয়েছে। “ও, তুমি ভাবছ, আমি খুঁজে খুঁজে খুঁত বার করছি তোমার ছেলের বউ আর মেয়েদের?”

বরদা সিগারেটে টান দিচ্ছিলেন। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকলেন। কানন যে ক্ষুণ্ণ এটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। কানন খুঁত বার করছে—তিনি ঠিক বলতে চাননি। তিনি বলতে চাইছিলেন, অত খুঁটিয়ে সব ব্যাপার না দেখলেই চলে।

“দূর বাপু”, বরদা ব্যাপারটা লঘু করার জন্যে হেসে বললেন, “আমি কি উকিল হয়ে ওদের ওকালতি করছি! আমি শুধু তোমায় বলছি, কে, কোনটা করেনি পারেনি—ও-সব ভুলে যাও।”

কানন দপ করে চটে উঠলেন। জেদের গলায় বললেন, “তুমি যাও। তোমার ছেলেমেয়ে, বউমা, আদরের নাতিনাতনি…।”

“তোমার নয়?”

কানন প্রথমে পুরোপুরি মাথা নাড়লেন রাগের বশে। দু দণ্ড পরে বললেন, “হ্যাঁ, আমারও। কিন্তু যা দেখলাম তাতে আমার ঘেন্না ধরে গিয়েছে।”

“ঘেন্না?”

“ঘেন্না ছাড়া আবার কী! ঘেন্না, রাগ, যা বলো—সবই।”

বরদা কেমন যেন দুঃখ পেলেন। তিনি সব বোঝেন। কানন কি সত্যিই ঘেন্না করতে পারে নিজের ছেলেমেয়েদের?

“তোমার মাথা গরম হয়ে আছে,” বরদা হালকা গলায় বললেন, “ক’দিন বাড়িতে একটানা হইচই গেল। কাজকর্মের তাড়া। সময় মতন নাওয়া-খাওয়া ঘুম নেই। শরীরটা ভাল যাচ্ছে না তোমার। কাল একবার গুপ্তকে ডেকে প্রেসারটা দেখিয়ে নাও।”

কানন রুক্ষভাবে বললেন, “তুমি দেখাও। আমিই কাল গুপ্তকে ডেকে পাঠাব। তোমায় দেখে যাবে।”

“আমায়! কেন?”

“কেন? চেহারাটা আয়নায় দেখেছ?

“বাঃ, দেখছি না। রোজ দাড়ি কামাচ্ছি, চুল আঁচড়াচ্ছি…।”

“আমায় রাগিও না।” কানন উলের বোনাটা কোলের ওপর ঝপ করে ফেলে দিলেন। উলের গোলা মাটিতে লুটোলো। তুলে নিলেন না। তাঁর মুখভরা রাগ, বিতৃষ্ণা। “তোমার সেবা যত্ন আজ একমাস ধরে যা দেখলাম, এমন আমি জীবনেও দেখিনি।”

বরদা বুঝতে পারলেন। কাননের সমস্ত রাগ তা হলে…..। “আমার অযত্ন তুমি দেখলে কোথায়? ওরা কি আমার পর যে অযত্ন করবে?”

“না, ওরা তোমার আপন! আপন বলে কোনোদিন ভাত পেয়েছ বেলা একটায়, কোনোদিন দেড়টায়; আর রাত্তিরে চারখানা রুটি জুটেছে কোনোরকমে!”

অবাক হলেন বরদা। কাননের কি মাথা খারাপ হয়ে গেল। কী বলছে কী কানন? স্ত্রীর মুখ লক্ষ করেছিলেন। গলার ঝাঁঝ চোখেমুখে ফুটে রয়েছে। বরং আরও উগ্র হয়ে। ভাল লাগছিল না বরদার। বললেন, “ছি ছি, তুমি বলছ কী! এসব কি কেউ ধরে! বাড়িতে পনের-বিশ জন লোক হলে এ-রকম হয়। সব কি সময়ে করা যায় ঘড়ি ধরে!”

কানন বিদ্রূপের গলায় বললেন, “না, ঘড়ি ধরে হয় না। তোমার বেলায় হয় না। অন্যদের বেলায় তো দেখলাম ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে কাজ হচ্ছে! তোমার বড় মেয়ে তার স্বামীকে ঘড়ি দেখে বেলা আটটায় ডিম সেদ্ধ রুটি দিতে বাদ দেয়নি তো? ভুল করেও একদিন মেয়েকে লেবুর রস না খাইয়ে পেরেছে!”

বরদা কেমন অপ্রস্তুত হয়ে মুখ নিচু করলেন। কানন কখনো এরকম ছিল না। কেন হল? কেন এই সব ছোটখাট ব্যাপারগুলো তার মনে লেগেছে? হ্যাঁ, এটা ঠিকই যে বরদা একেবারে সময়ে সময়ে সব কিছু পাননি। খেতে খেতে বেলা হয়ে গিয়েছে, চারবার ‘দাও দাও’ করে স্নানের গরম জল পেয়েছেন, গায়ের গেঞ্জিটা প্রায় অন্য ঘরে চলে গিয়েছে। পাজামা খুঁজে পাননি। কাননকেই খুঁজে-পেতে এনে দিতে হয়েছে সব। কিন্তু এসব তো হয়ই। অত লোকজন, কে ঘড়ি ধরে চলবে, কার না ভুল হবে। তা বলে কানন সব কিছু ধরবে কেন? এতে মন ছোট হয়।

কানন নিজেই বললেন, “দেখলাম তো সবই। তোমার বড় মেয়ে, ছোট মেয়ে, বড় ছেলের বউ সকলকেই দেখলাম। একদিন টাটকা রুটি আনতে ভুলে গিয়েছিল ফাগু। টাউন বাস আসেনি। বাসি রুটি এনেছিল। তোমার বড় মেয়ে জামাইকে খেতে দেবার সময় কত গজগজ করল। কী অপরাধ, না, যে জায়গায় রুটির এত অসুবিধে সে জায়গায় মানুষ থাকে কেমন করে!”

“কানন!” বরদা এবার বিরক্ত হলেন। “তুমি মা, তোমার এসব সাজে না! ছি!”

স্বামীর চাপা উঁচু গলা শুনে কানন কয়েক পলক বরদার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। চোখের পাতা পড়ল না। মুখ কালো হয়ে এল। থমথমে। ছেলেমানুষ ধমক খেয়ে যেমন অভিমান করে—কানন অনেকটা সেই রকম অভিমানের মুখ করে বসে থাকলেন। আর কথা বললেন না। পিঠ নুইয়ে মেঝে থেকে উলের গোলাটা তুলে নিতে নিতে শব্দ করে নিশ্বাস ফেললেন। দীর্ঘ নিশ্বাস। শব্দটা বরদার কানে গেল বোধ হয়।

ঘরে সাড়াশব্দ নেই। কানন মুখ নিচু করে উলের কাঁটা নাড়তে লাগলেন। বরদা নিবে যাওয়া সিগারেটের পোড়া কাগজ আঙুলে করে ছিঁড়তে শুরু করলেন। একেবারে চুপচাপ। বাড়ির মধ্যেও কোনো শব্দ হচ্ছিল না। নীরবতা গভীর হয়ে জমে উঠেছিল ঘরময়।

কানন অন্যমনস্কভাবে ক’ঘর পশম বুনলেন। এই হল সংসার, যার জন্যে চুরি করি সেই বলে চোর। কাননের কপাল। তা বলে তিনি মিথ্যে করে বানিয়ে কিছু বলেননি। কেন বলবেন? ছেলেমেয়ে বউ নাতি-নাতনি যেমন তোমার, তারা আমারও। তুমি চোখ চেয়ে দেখোনি, বা দেখে থাকলে বুঝেসুঝেও ঢোক গিলছ। হজম করে নিচ্ছ। আমি নিচ্ছি না। কেন নেব? আমি কি এদের খাই পরি? আমার কিসের তোয়াক্কা। যা দেখেছি তাই বলছি। কেন বলব না? মুখে বাবা-বাবা। আদিখ্যেতার অন্ত নেই। কিন্তু কাজের বেলা কী দেখলাম? সবাই যে যার নিজেরটির সুখ-সুবিধে নিয়ে ব্যস্ত। বড় মেয়ে তার স্বামীর পান থেকে চুন খসতে দেবে না, ছেলেমেয়েদের যখন যেমনটি তখন তেমনটি হওয়া চাই। একটু ঊনিশ-বিশ হলে মুখ ভার। কথা। ঝুনুর টনসিলের দোষ, মা। ওর খাবার জল ঠাণ্ডা হলে গলা বন্ধ হয়ে আসে। গোপালীকে বলো ওর জন্য আলদা করে গরম জল রাখতে। তোর মেয়ের গলা ধরে যায় ঠাণ্ডা জল খেলে তা মনে রেখেছিস, কিন্তু তোর বাবা এই বুড়ো বয়সে ক’দিন মিনমিনে জলে চান করল তার হিসেব রাখিস! তোর বাবা না ব্রংকাইটিসের রোগী! তবে! তোর বরকে ঘি-ভাত খাওয়াবি, বাবা-বাবা ধুয়ো তুললি। রাঁধলি যখন তখন বরের মন জুগিয়ে রাঁধলি। ওই জিনিস ও-মানুষ মুখে দিতে পারে? দু মুঠোও খেতে পারল না, ঘিয়ের নদী বইছে। সব জানি। তোর বাবার একটা শখের মখমল কাঁথা মতন ছিল—পাতলা, অল্প শীতে গায়ে দিত, সেটা তুলে নিয়ে গিয়ে বরকে দিলি? কেন, তোর বাবার হালকা কাঁথা লাগে না? জানি, সব জানি। সব দেখেছি। মায়ের সঙ্গে তোর অত আহ্লাদিপনা কেন তাও তো দেখলাম। মা-মেয়ে কথা বলতে বসলেই শুধু গয়নার কথা। মা, আমি কিন্তু এই মফ্‌চেনটা চেয়ে গেলাম। আর তোমার নাতনিকে কিছু তো দেবেই—তার বিয়ের জন্যে। জড়োয়ার বালাটা দিও বাপু। আমার খুব পছন্দ।

কানন শুধু বড় মেয়েকে বলছেন না, ছেলের বউকেও বলছেন। বউমার বড় শ্বশুরভক্তি। শ্বশুরের জন্যে এটা এনেছি ওটা এনেছি। যা এনেছ তা তো দেখলাম মা । ভেলভেট কাপড়ের জুতোটা পায়ে হল না, দাড়ি কামিয়ে মাখার লোশনটা বাপু তোমার স্বামীর গালেই ঘষলে। এক জোড়া চাদর আর কেমন ইনিয়েবিনিয়ে বলে শ্বশুরের কাছ থেকে পাঁচশোটা টাকা নিয়ে গেলে ছেলের গরম সাজপোশাকের জন্যে। শ্বশুরভক্তি জানা আছে তোমার। দুদিন শ্বশুরের রুটি সেঁকতে হয়েছিল—দেখলাম তো, তোমার শ্বশুর তা কষ্ট করে চিবোচ্ছেন। এক-কাপ চা করে দিতে বললে অন্যকে হুকুম করতে। ফাগু হাটে গিয়েছিল বলে একদিন জামা কেচেছিলি শ্বশুরের—তাতে ময়লাই ছিল বেশি। জানি মা, সব জানি।

“কানন,” বরদা ডাকলেন।

কানন মুখ তুললেন না।

ইতস্তত করে বরদা বললেন, “রাগ করলে?”

এবারও কোনো সাড়া দিলেন না কানন।

বরদা বিব্রত বোধ করছিলেন। “আহা, তা কথা বলছ না কেন?”

কানন অপেক্ষা করে বললেন, “বলো।”

“আমি তোমার দোষ ধরছি না,” বরদা নরম গলায় বললেন, “তুমি ঠিকই বলেছ, আমার মাঝে-সাঝে অসুবিধা হত। খানিকটা বেনিয়ম, বাড়াবাড়ি হয়েছে। কিন্তু লোকজন বেশি থাকলে এ-সব হয়। কি, শুনছ ?”

“শুনছি।”

“হ্যাঁ, বলছিলাম—ওরা তো আমাদের কাছে থাকে না। আমাদের ধাত অত বুঝবে কেমন করে। ধরো, তোমার ছোট মেয়ের কথা। তোমার ছোট মেয়ে সেদিন আমার খাওয়া-দাওয়া দেখছিল। তুমি জ্বর গায়ে শুয়ে। …তা—এখন—মানে দেখলাম, ডালটায় মাছি পড়েছে। দুধ বড় পাতলা, ভাল করে জ্বাল দেওয়া হয়নি। এতে ওর দোষ কী! নিজের হাতে ও কি তার বাবার দুধ জ্বাল দিয়েছে?”

“না, তার বাবার জন্যে তো এই বাঁদি রয়েছে।”

“আবার রাগ! বাঁদি বলছ কেন! বলো বউ। স্ত্রী।”

কানন বোধ হয় লজ্জা পেলেন সামান্য। চড়া মেজাজ সামলে নিলেন খানিকটা। বললেন, “তোমার ছেলের বউ, মেয়ে—যখনই যাকে দুধ দেখতে বলেছি, হয় পাতলা রেখেছে, না হয় পুড়িয়েছে। তোমার বড় মেয়ে আবার একদিন বলল, বুড়োমানুষের রোজ রোজ ক্ষীর খাওয়া কেন।”

বরদা কেমন হতাশ হয়ে পড়লেন। কাননকে তিনি বোঝাতে পারছেন না। নাকি বোঝানোর কিছু নেই ? “কানন।”

“শুনছি।”

“তুমি বেশি চাইছ।”

“বেশি ?” কানন চোখ তুলে এতক্ষণে তাকালেন।

“বেশি—মানে আমি বলছি, ছেলেমেয়ে বউ নাতি-নাতনি ওদের কাছে আশা করার একটা সীমা আছে। তুমি যদি ভেবে থাকো, যেমনটি করে তুমি আমায় রাখছ, দেখছ—তেমন করে ছেলের বউ মেয়ে দেখবে—তবে সেটা ভুল করছ। তাদেরও নিজের সংসার আছে। নিজেদের টান আছে…।”

“আছে যে তা তো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেল।”

কাননকে বোঝাবার মতন আর কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলেন না বরদা। চুপ করে থাকলেন।

রাত ধীরে ধীরে বাড়ছিল কোথাও, বসার ঘরে ঘড়ি নেই। এই বাড়ি বড় চুপচাপ। ফাগুয়ারা বোধহয় রান্নাঘরে বসে গল্প করছে। বাইরে শীত বাড়ছে। ঘরের মধ্যে আরও একটু ঠাণ্ডা বাড়ল। বরদা খানিকটা গুটিয়ে বসলেন। হাতের আঙুল, নাকের ডগায় ঠাণ্ডা লাগছে। কানন হাতের বোনা পুরোপুরি থামাননি। মাঝে মাঝে অভ্যাসবশে কাঁটা নাড়ছেন। মন নেই। মন অন্য কোথাও।

বরদা বার দুই কাশলেন। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকলেন ক’পলক। মৃদু গলায় বললেন, “সংসারে কত তুচ্ছ জিনিস থাকে—তার দিকে নজর দিতে নেই।”

কানন চোখ তুলে তাকালেন। “তুচ্ছ?”

“হ্যাঁ, ওই ব্যাপারগুলো তুচ্ছ।”

কাননের চোখমুখ কেমন ঘন বিষন্ন ও থমথমে দেখাচ্ছিল। স্বামীর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলেন কানন অপলক দৃষ্টিতে। তারপর বললেন, “বেশ, তোমার কাছে তুচ্ছই হোক। ওরা তোমার আপন।”

কথাটা এমন গলায় বললেন কানন, যেন অভিমানে তাঁর বুক ভেঙে যাচ্ছে। গলার স্বর ধরাধরা অস্পষ্ট। শোনাও যায় না।

বরদা চুপ। স্ত্রীকে দেখছিলেন।

হঠাৎ বরদার নজরে পড়ল, কাননের ঠোঁট দুটো ফুলে উঠেছে, কাঁপছে। তারপর দু চোখ দিয়ে জলের ফোঁটা গড়িয়ে গালে পড়ল। অবাক হলেন বরদা। অস্বস্তি বোধ করলেন। কানন কাঁদছে কেন? তিনি তো কিছু বলেননি।

কিছু বলতে পারছিলেন না বরদা। অস্বস্তি হচ্ছিল। স্ত্রীকে বোকার মতন দেখছিলেন। কাননের গোলগাল মুখ এখনও কত টলটলে দেখায়। কপাল ছাড়া দাগ পড়েনি কোথাও। গালের তলায় অবশ্য খাঁজ পড়েছে। মাথার চুল অনেক পেকেছে। সিঁথি মোটা হয়েছে, মোটা করে ছোয়ানো সিঁদুর। সেই চাপা নাক, একটু ফোলাফোলা ঠোঁট। এই মুখ তিরিশ-বত্রিশ বছরের চেনা, থুতনির তলায় পাশাপাশি দুটো তিলের মাঝখানে পাতলা একটা সাদা বড় রোমও তিনি চিনে নিতে পারেন। অথচ, বরদা আজ, এই মুহূর্তে বুঝতে পারছিলেন না—কানন অমন করে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে কেন।

বরদা উঠলেন না। ডাকলেন, “কানন!”

কাননের গাল ভিজে গিয়েছিল।

“কানন তুমি কি ছেলেমানুষ হয়ে গেলে? চোখ মোছো।”

কানন, একটু সময় নিয়ে চোখ মুছলেন।

বরদা বললেন, “ওরা আমার আপন। কিন্তু তুমি যে আরও বেশি আপন।”

কানন দু পলক স্বামীর চোখে চোখে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন।

দুজনেই চুপ। বরদা নিশ্বাস ফেললেন। শব্দ শোনা গেল। কাননের বুকভরা নিশ্বাসের শব্দও কানে এল বরদার।

স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকলেন বরদা। মনের চারপাশ থেকে কত কী যেন ঘন হয়ে তাঁকে আচ্ছন্ন করছিল। বুক টনটন করে উঠল। এতগুলো বছরের সঙ্গ, সাহচর্য, স্মৃতি সব যেন কেমন এক ভুবন সৃষ্টি করেছে। বরদা মুগ্ধ মধুর চোখে তাকিয়ে থাকলেন কাননের দিকে। তাঁর মনে হল, এ-রকমও হয় সংসারে, হয়; আপনজনের মধ্যেও একজন কেমন করে যেন আরও আপন হয়ে ওঠে, নিজের হৃদয়ের সবটুকু জায়গা জুড়ে নেয়, মিশে যায় সর্বাঙ্গে। কখনও কখনও মনে হয়, অন্য মানুষটির নিশ্বাস নিজের বুকের মধ্যে থেকে উঠে এল।

বরদা অনুভব করলেন কাননের চোখের ভেজা পাতার আর্দ্রতা তাঁরও পাতায় লেগেছে।

অনেকক্ষণ পরে গাঢ় গলায় বরদা বললেন, “কানন, তখন কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। এখন কই লাগছে না।”

কানন কেমন অবশ, পরিতৃপ্ত চোখ করে স্বামীকে দেখছিলেন।

অনেকক্ষণ পরে হুঁশ হল কাননের। বললেন, “ওঠো, রাত হচ্ছে।” বলে গায়ের চাদর, পশমের গোলা গুছিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *