পালকের পা

পালকের পা

সেই দুঃসহ দিনে, মধ্যবৈশাখে, যখন আকাশ গলানো-তামার মতন উজ্জ্বল, গাছ লতাপাতা ঝলসে যাচ্ছে, ফুল নেই, পাখিও ডাকে না—তখন সে এল। একটি সারস পাখি যেন। তেমনি দুগ্ধধবল, নরম, উষ্ণ এবং আশ্চর্য সুন্দর। কেউ ভাল করে দেখেনি, কেউ বলতে পারছিল না, মহিলা বাঙালি অথবা বোম্বাইবাসিনী, পাঞ্জাবি, পার্শি বা আর কিছু, অন্য কিছু। শুধু একটা গুঞ্জন উঠেছিল। পাণ্ডববর্জিত এই জায়গায়, এই জঙ্গলে শাল পলাশ উপড়ে রেসকিউ অফিসের আর-একটা ব্লক, আর-একটা কোয়ার্টারের পত্তনই এখানে সম্ভব ছিল এবং সেই অজুহাতে চুন, সুরকি, সিমেন্টের গুঁড়ো উড়বে, উড়তে শুরু করবে, এটাই ছিল প্রত্যাশিত। অথচ ওসব আদপেই কিছু না-হয়ে এই মধ্যবৈশাখে বসন্তের হাওয়া বইবে আচমকা মন-আনমনা গন্ধ নিয়ে, কে ভেবেছিল, কেমন করেই বা আশা করা যেতে পারত!

কানাকানি করছিল এরা, রেসকিউ অফিসের কজন ছোকরা নিজেদের মধ্যে এবং তিনজন প্রৌঢ় তাদের মধ্যে। আট-দশটা বেয়ারা চাপরাসিও আড়ালে আড়ালে। শুধু দুই অফিসারের মধ্যে কোনো চঞ্চলতা লক্ষ করা গেল না। তাঁদের মধ্যে একজনের এখন বিচলিত হবার মতন তাপ রক্তে নেই, এবং কোনো বিশেষ ঋতুর বাতাস কী পাখি কী ফুলের ওপর স্বাভাবিক আকর্ষণ বোধ করার অনুভূতিও লোপ পেয়েছে। মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণ ইনি, অফিসের আরাম কেদারায় বসে অবসর সময়ে মৃত্যুর পর আত্মার গতিবিধি পাঠ করেন।

আর অপর জন সেই সারস পাখির আত্মাকে আত্মসাৎ করে বসে আছেন। অতএব তাঁর কোনো চঞ্চলতা নেই, বিচলিত হবার কারণ ঘটছে না।

ইনি বাঙালি, উপাধি মিত্র। নৃপেন্দ্র মিত্র। অফিসে মিত্রসাহেব। এখনো যুবক, আটত্রিশের ওপারে বয়স যায়নি। মাংসল পুরুষ, কিন্তু সুপুরুষ নন। রঙ কালো, মুখটা গোল, চওড়া কাঁধ, চোখ দুটো কন্য পশুর মতন। অবশ্য সে-চোখ ভয়ঙ্কর বা ভীতিজনক নয়, দুরন্ত, তীক্ষ্ণ, চঞ্চল। যেন সব সময় উন্মাদনা খুঁজছে। মিত্ৰসাহেব কাজর লোক, অধ্যবসায়ী পুরুষ। শোনা যায়, লেখাপড়া ভাল শেখেননি, শুধুই দক্ষতা, চেষ্টা, উৎসাহ সম্বল ছিল। বিত্তহীন হয়েও সাগরপারের হাওয়ায় ক-বছর কাটিয়ে আসতে তাই বেগ পেতে হয়নি তাঁকে। এবং এখন একটি উচ্চপদে জাঁকিয়ে বসেছেন। অনলস কর্মঠ এই ব্যক্তিটির জন্যে ভবিষ্যতে আরও কিছু রাজকীয় সৌভাগ্য অপেক্ষা করছে, এ-কথা বোঝা যেত। কথাটা বিশ্বাস করত রেসকিউ অফিসের ছোকরারা, বলাবলি করত। কিন্তু বিশ্বাস করতে পারেনি, মিত্ৰসাহেবের অমন স্ত্রী আছে, অমন সুন্দরী স্ত্রী এবং সেই স্ত্রী এখানে আসবে—এই জঙ্গলে, এই দুঃসহ দিনে মধ্যবৈশাখে যখন সব ঝলসে যাচ্ছে, ফুল নেই, পাখিও না।

কিন্তু এল। কখন এল কেউ জানল না। যাওয়া-আসা, ঘোরা-ফেরার পথে ওয়াটার ট্যাঙ্কের উঁচু টিলার কাছে মিত্রসাহেবের ছোট বাংলোটায় কেউ কেউ তাকে দেখল আচমকা দূর থেকে। এবং বর্ণনা দিল, এক সারসী উড়ে এসেছে।

সেই সারসীকে প্রথম ভাল করে দেখল মৃণাল, মিত্রসাহেবের স্টেনো টাইপিস্ট। আর দেখে দারুণ এক বিস্ময় এবং অভূতপূর্ব কেমন এক উত্তেজনা নিয়ে নিজের মধ্যে ছটফট করতে লাগল।

বুধবারের এক বিকেলে অফিস শেষ করে উঠব উঠব করছে মৃণাল, হঠাৎ জরুরি তলব এল মিত্রসাহেবের। চল্লিশ মাইল দূরে বসে হেড কোয়ার্টার থেকে তলব করেছে সেক্রেটারি। চাপরাসিকে কটা ফাইল অফিসের গাড়িতে তুলতে বলে মিত্রসাহেব শুধু একটা সিগার ধরিয়ে নিলেন। কয়েক মুহূর্ত সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে কী ভাবলেন যেন, তারপর উঠে পড়লেন। ঘর ছেড়ে চলেই গিয়েছিলেন প্রায়, হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন মৃণালকে, আঙুল দিয়ে ঘরের এক কোণে রাখা ছোট্ট একটা বেতের টুকরি দেখিয়ে, “ওটা আমার বাংলোয় পৌঁছে দেবার একটা ব্যবস্থা কর তো চ্যাটার্জি।” কী ভেবে একটু থেমে আবার, “বেটার হয় তুমি যদি নিজেই যেতে পার। মিসেস মিত্রকে দুটো খবর দেবার আছে। ওই ফলের টুকরিটা ওঁর বান্ধবী পাঠিয়েছেন কলকাতা থেকে; আর আমি হেড কোয়ার্টারে যাচ্ছি, ফিরতে দেরি হবে।”

ফলের টুকরিটা ছোটই। গড়নটাও বাহারি। মৃণাল বেরিয়ে পড়ল। হাতে টুকরি। আর যেতে যেতে খুশি হচ্ছিল এই ভেবে, একটু সুযোগ তার ঘটে গেছে। পরে হয়ত এ-সুযোগ সকলেরই ঘটবে, কিন্তু উপস্থিত সে প্রথম যে, আর-খানিক পরে সহ সারসীকে দেখতে পাবে সামনাসামনি। যাকে নিয়ে এত কানাকানি, ফিসফাস, রূপকথা।

বনতুলসী আর ঝোপঝাডের পাশ কাটিয়ে মন্থর পায়েই হাঁটছিল মৃণাল। হাঁটার তালে তালে টুকরিটাও দুলছে। বেতের বুননির ফাঁকে কমলালেবু আর নাশপাতি উঁকি দিচ্ছিল। কলকাতা থেকে আসছে। মিসেস মিত্রের নিশ্চয় খাবার টেবিলে কমলালেবু দরকার হয়। দামটাও নেহাত কম হবে না, এই গরমে কমলালেবুও কলকাতার বাজারে ঝুড়ি ঝুড়ি আসে না নিশ্চয়। কিন্তু দামে কি যায় আসে। কমলালেবু খেতে তিনি ভালোবাসেন। তাঁকেই মানায়, তাঁর মতন অবস্থায়।

এসব কথা সিঁড়ির মতন ধাপে ধাপে সাজিয়ে বড়ো একটা ভাবছিল না মৃণাল। মনের মধ্যে আসছিল, যাচ্ছিল। এবং বেশ হালকা মনেই ভাবতে পারছিল। যদিও আড়ালে একটু তুলনা যে একেবারেই না-ছিল এমন নয়। আর সেরকম তুলনা আশি টাকা মাইনের টাইপস্ট কী কেরানী হামেশাই করে থাকে।

কিন্তু ওসব আর ভাবতে ভাল লাগছিল না। বরং কী দেখবে, কেমন করে কথাগুলো বলবে এবং প্রথমে হাত তুলে নমস্কার করবে কিনা, মৃণাল তাই ভাববার চেষ্টা করল। পাছে হাস্যকর কিছু করে বসে তাই মনে মনে এ-মহড়া।

গেটের কাছে এসে থামল মৃণাল। একবার চোখ তুলল আকাশে। পশ্চিম কোণে এক জায়গায় কুমকুমের রঙ লেগেছে। শিশুগাছের ডালে কিচির মিচির করছে কটা পাখি। একটু হাওয়া দিয়েছে।

বুকটা অযথাই একবার ধুকধুক করে উঠল। তাকাল মৃণাল। কেউ কোথাও নেই। বাংলোর বারান্দায় দুটো চেয়ার মুখোমুখি করে সাজানো, একটা নিচু গোল টেবিল। ঘরের দরজা খোলা, শার্সি গুটানো, পর্দা ঝুলছে। কোথাও বাতি জ্বলছে না। কেউ নেই।

বারান্দার নিচে এসে এদিক-ওদিক চাইল, খুঁজল মৃণাল। একটা চাকর-বাকরও চোখে পড়ছে না। কাকে ডাকবে, কি নাম ধরে ডাকবে ঠিক করতে না পেরে বারান্দায় উঠে এল।

একটু দাঁড়িয়ে এপাশ থেকে ওপাশ যাচ্ছিল, সিমেন্টের বারান্দায় ভারি জুতোর শব্দ তুলে এবং আশা করছিল এই শব্দে ঘরের ভেতর যদি কেউ থাকে, তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে।

হলও তাই। দক্ষিণের ঘরে টুক্‌ করে বাতি জ্বলে উঠল। পর্দার তলা দিয়ে, পাশ দিয়ে একটু আলো এসে পড়ল বারান্দায়। আর মৃণাল সেই ঘরের সামনে, পর্দার এপাশে দাঁড়িয়ে শুনল—অত্যন্ত মিহি, মিষ্টি একটা গলা গুনগুন করে উঠছে।

সেই গুনগুন একটু থেমেছে কি খুক্‌ করে একবার কাশল মৃণাল। আরও একটু পরে এল ; পদার্টা তখন গা ছুঁয়েছে। ওপাশ থেকে সেই মিহি গলা একটা হাসির ঢেউ তুলল এবার এবং হাসির ফাঁকে বলতে বলতে আসছিল কী একটা কথা যেন, যা মৃণাল শুনেও, বুঝতে পারছিল না। আর কথা শেষ হল যখন, তখন পর্দা সরে গেছে এবং পলকের জন্যে প্রচণ্ড এক বিস্ময় থমকে দাঁড়িয়ে আবার মিলিয়ে গেছে। পর্দাটা দুলছে একটু।

কিন্তু ততক্ষণে চোখ আর মনের ক্যামেরায় সেই কটি পলক ধরা হয়ে গেছে। স্বপ্নেও এমন ছবি দুর্লভ। সেই সারসী এসেছিল এবং ঘরের আলোয় দাঁড়িয়ে সরিয়ে নিয়েছিল পর্দা। ধক্ করে একটা গন্ধ লেগেছে নাকে, মিষ্টি গন্ধ, কোনো দামি সাবানের, সুগন্ধি স্নানবারিরও হতে পারে। তার দীর্ঘ বঙ্কিম গ্রীবায় তখনো জলের ফোঁটা লেগে রয়েছে এবং বুকে। মাঝ-বুক থেকে গোড়ালির নিচু পর্যন্ত সাদা টার্কিশ টাওয়েল। সেটা ওর মুঠোয় ধরা। চকিতে সেই শ্বেতস্বপ্ন মিলিয়ে গেছে। অথচ মনে হয় যে যায়নি, লুকনো হাওয়া থেকে আবার কখন খসে পড়বে। এখনো গন্ধ আছে ভুরভুর, এখনো একটা তুলোর শরীর যেন পর্দার ওপাশে দাঁড়িয়ে চুপ করে হাসছে।

বিমূঢ় ভাবটা কাটতে সময় লাগল মৃণালের। তারপর ভয়ঙ্কর অস্বস্তি। সঙ্কোচ। এবং কেমন একটা ভয়। ঘটনাটা আকস্মিক। অপ্রত্যাশিত। মৃণাল কী করে জানবে উনি সবে স্নান সেরে বাথরুম থেকে বেরিয়েছেন। আর স্পষ্টই বোঝা গেল, উনি ভাবতেই পারেননি, এ-সময় বারান্দায় মিস্টার মিত্র ছাড়া আর কেউ আসতে পারে, থাকতে পারে। যদিও এভাবে স্বামী-অভ্যর্থনা অস্বাভাবিক। এবং হতে পারে যেতে যেতে নিজেকে আধো আড়াল দিয়ে স্বামীকে কিছু রহস্য করে বলতে এসেছিলেন। আবার এ-ও হতে পারে, এই সারসীর রকম আলাদা।

কিছুই স্থির করতে পারছিল না মৃণাল। ভাবনাগুলো ধোঁয়ার মতন ভেসে উঠে একাকার হয়ে যাচ্ছিল। আর আড়ষ্ট হয়েই বসেছিল এবার চেয়ারে। কারণ ইতিমধ্যে একটা চাকর এসে বারান্দায় বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। বসতে বলেছে। বসার ইচ্ছে থাকলেও খুব একটা সাহস হচ্ছিল না। এর পর মুখোমুখি হতে বাধছিল। কিন্তু উপায় কি!

অথচ মহিলাটি এলে দেখা গেল তার মধ্যে কোনো আড়ষ্টতা নেই। কিছুই যেন ঘটেনি। ঘটলেও তা ভুলে গেছে।

প্রথমে মৃণালের সামনাসামনি চেয়ারটায় হাত দিয়ে দাঁড়াল। মৃণাল ভাল করে চোখ তুলতে পারল না। উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করল। কোনোরকমে খবর দুটো বলল। এক নিশ্বাসে। গলা কাঁপছিল এবং বুকটা ধকধক করছিল।

মৃণালের কথা শেষ হয়ে এলে এবার অন্য পক্ষ বলল, বলার মধ্যে একটু হাসি ছিল, অবাক করে দেবার রহস্য, “কে, মৃণাল না?”

নাম শুনে কেমন চমকে উঠল মৃণাল। অবাক চোখে তাকাল। এবং চিনতে দেরি হল না। “তুষার!” অস্ফুট কণ্ঠে বলল ও।

ততক্ষণে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে পড়েছে তুষারকণা।

—কী আশ্চর্য তুমি এখানে! তুষারকণা বলল হাতের বালাটা মণিবন্ধের দিকে আরো একটু ঠেলে মৃণালের মুখে চোখ রেখে।

ঠিক এই প্রাথমিক প্রশ্নটা মৃণালও করতে পারত। কিন্তু করল না। মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ।”

—চাকরি করছ তাহলে।

—করছি। তোমার স্বামীর—। বলতে গিয়ে কথাটা আটকে গেল, জিবটা হঠাৎ সতর্ক হয়ে উঠল মৃণালের। একটু থেমে বাক্য-বিন্যাসটাকে পাল্টে নিয়ে বলল, “মিস্টার মিত্রর আমি স্টেনো টাইপিস্ট। ”

কেমন মেয়ে তুষার, এ-কথা শুনে মৃণালের অবস্থাটা একটুও বুঝল না, বোঝার চেষ্টা করলে না। উল্টে কলহাস্যে এই ফাঁকা বারান্দা ভরিয়ে দিল।

—নৃপেন তোমার বস্। স্বামীর নাম ধরল তুষার। কানে একটু লাগল মৃণালের। পরক্ষণেই মনে হল, এটা আজকাল চলতি হচ্ছে। ভালই লাগে শুনতে। তুষার থামেনি, বলে যাচ্ছিল, “তাতে কি, আমি তোমার বসের বউ হয়েছি পরে, তার অনেক আগেই আমরা ক্লাসমেট ছিলাম। সেই পুরনো সম্পর্কটাই তো ভাল। তুমি এত সঙ্কোচ করছ কেন?”

তাহলে মৃণাল যা ভেবেছিল তা নয়, তুষার তার অবস্থাটা বুঝতে পেরেছে এবং বুঝেছে বলেই সহজ করতে চাইছে।

—তুমি এখানে আছ জানলে আগেই খবর দিয়ে পাঠাতাম। তুষার বলল, “সারাদিন একা আছি। কথা বলার লোক নেই।”

—কেন মিস্টার মিত্র?

—তিনি কথার চেয়ে কাজ বেশি পছন্দ করেন। বলে কেমন এক রহস্যপূর্ণ হাসি হাসল তুষার ঠোঁট টিপে।

—আর তোমাকে! অত্যন্ত অসতর্কভাবেই এই পরিহাসটুকু করে ফেলল মৃণাল।

—বললাম তো। এবার তুষার ঊর্ধ্ব অঙ্গে বিচিত্র এক হাসির ঢেউ তুলে উঠে দাঁড়াল, “বসো, চা খেয়ে যাও, আসছি। ”

চা খেতে খেতে এতক্ষণে অনেকটা স্বাভাবিক চোখে তুষারকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল মৃণাল। আরো সুন্দর হয়েছে তুষার। আগে দীর্ঘাঙ্গী হলেও একটু কৃশ ছিল, এখন যেন তার শুক্লপক্ষের পূর্ণতা এসে গেছে। গালে, গলায়, কণ্ঠায়, বুকে, বাহুতে মসৃণ রেখা এঁকে এঁকে মাখন-কোমল মেদ লেগেছে। রঙটা যেন আরো ধবধব করছে, সারসীর ডানার মতোই। তেমনি দীর্ঘ গ্রীবা। আর কালো চোখ, কালো চুল। দুটি লালচে ঠোঁট, সাদা ঝকঝকে দাঁত।

তুষারের গায়ে যে শাড়িটা রয়েছে এখন, তার রং বেলফুলের মতন, আর ব্লাউজের রঙ পাতা-সবুজ। গলায় চিক চিক করছে হার। হাতে বালা। একটি আংটিও। অপরূপ একটি ছবি হয়ে সামনে বসে আছে তুষার। তার অঙ্গের ছন্দে পঁচিশ বছরের যৌবনস্রোত নিঃশব্দে বয়ে যাচ্ছে। আর কখনো কখনো উচ্চকিত হাসিতে এই স্রোত যেন আছড়ে পড়ছে তটে। একটি নিটোল বুক তখন থরথর করে কেঁপে যাচ্ছে।

সব দেখছে মৃণাল। কখনো সরাসরি তাকিয়ে, কখনো আড়চোখে।

—আমি যাই। বলল মৃণাল চা-খাওয়া শেষ হলে।

—যাবে? এত তাড়াতাড়ি কেন? বস না আরো খানিকটা, গল্প করি। না-হয় চল একটু বেড়াই।

অসম্মত হবার কারণ ছিল না। ওরা বেড়াল দুটিতে উঁচু টিলার ওপর খানিকক্ষণ। নিমফুলের গন্ধ তখন ভেসে আসছিল। আর উষ্ণ হাওয়া বইছিল।

যাবার সময় তুষার বলল, “যখনই তোমার ইচ্ছে হবে এস।” একটু থেমে আবার, “আর এসে নাম ধরে ডেকো। বুঝলে বোকা!” সেই অন্ধকারে ঠোঁট টিপে হেসে মৃণালের হাতে চাপ দিয়ে ছেড়ে দিল তুষার।

ফেরার পথে আর যেন পা উঠছিল না। কেমন একটা ক্লান্তি অনুভব করছিল মৃণাল। কতবার দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। অদ্ভুত এক বেদনাও আস্তে আস্তে ঠেলে উঠছিল।

আর মৃণাল ভাবছিল ওরা কী সুখী ; ওরা দুজনে—তুষার এবং তার স্বামী। জীবনটাকে খুব সহজে স্বপ্নের মতন করে নিতে পেরেছে। ফুলের বিছানায় শুয়ে জোড় বেঁধে যেন চাঁদ দেখছে আর ঘ্রাণ নিচ্ছে পরস্পরের।

কেন নেবে না? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে উত্তর দিচ্ছিল মৃণাল, হ্যাঁ, নেবে। নেওয়াই উচিত। কেননা, ওরা এর উপযুক্ত। মিত্ৰসাহেবের চেয়েও যোগ্যতাটা যে তুষারের বেশি, মৃণাল সে-সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হচ্ছিল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিচার করে দেখছিল তুষারের যোগ্যতা। আর বার বার স্বীকার করছিল তার যোগ্যতা অসাধারণ।

হ্যাঁ, সারসীর শুভ্র কোমল দেহ নিয়ে তৃষার চুপ করে নেই। তার শরীরের তাপ দিয়ে আরেকজনকে নিত্য উষ্ণ করছে। বুঝে ফেলেছে তুষার মিত্ৰসাহেবের বন্য দৃষ্টির উজ্জ্বলতা কোথায় স্তব্ধ হয়ে যায়। তাঁর উন্মাদনা কেমন করে শান্ত হয়ে আসে।

তুষারের কয়েকটা কথাই বার বার মনে পড়ছিল মৃণালের। এবং তার অর্থ যেন একটু একটু করে বুঝতে পারছিল ও। তুষার বলেছে, তার স্বামী কাজের মানুষ, কথা নয়, কাজ ভালোবাসে। কথাটা বলে তুষার হেসেছিল। মৃণাল বুঝতে পারছে এতক্ষণে এই কাজ কী, কেমন ধরনের কাজ! অর্থাৎ, এই কাজ অন্য ধরনের। প্রজাপতি তার পাখায় রং চড়াবে, বসন্ত গাছে গাছে ফুল ফোটাবে এই তার সত্যিকারের কাজ। আর তুষার তার পঁচিশ বছরের প্রতিটি অঙ্গকে যৌবনের রসে সিক্ত করে জ্বলবে প্রখর হয়ে, জ্বালাবে স্বামীকে এই কাজ তার। মিত্ৰসাহেব, অনুমান করা চলে, এমনটাই চান। চেয়েছেন। চাইছেন। আর তুষার তাই দিচ্ছে। অনেক ঘাম ফেলে, ক্লান্ত ফুসফুস নিয়ে স্বামী ফিরে এলে তুষার হয়ত তাই অমন নিরাবরণ হয়েই আসে, সাবানের গন্ধ তুলে এবং গ্রীবায় মুক্তোর মতন জলবিন্দু মেখে। প্রতিদিন সে বিচিত্র, সে বর্ণময়ী। মোহিনী। মিত্রসাহেব এ মোহ ভালবাসেন। কোন্ পুরুষই বা না বাসে। মৃণাল নিজেও কি? প্রশ্নটা মনে হতেই কেমন যেন চমকে ওঠে মৃণাল। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। আর চোখ তুলতেই দেখে তার কোয়ার্টার সামনে। অন্ধকারে ডুবে আছে।

বাইরে উঠনে মাদুরে বসে কী যেন একটা সেলাই করছিল কমলা। টিমটিমে আলোয় একতাল ছায়ার মতনই দেখাচ্ছিল তাকে। পা ছড়িয়ে ঘাড় মুখ গুঁজে বসে। মৃণালের পায়ের শব্দ তার কানে গেলেও চোখ তুলল না।

উঠোনের ফালিটুকু এগিয়ে ঢাকা বারান্দায় জুতো জোড়া খুলতে খুলতে একবার স্ত্রীর দিকে তাকাল মৃণাল। অসহ্য লাগছিল সমস্ত দৃশ্যটা। একটা পঙ্গু গরু কি ছাগল যেন আঁস্তাকুড়ের পাশে বসে জাবর কাটছে।

ঘৃণাই হচ্ছিল মৃণালের। বারান্দায় বা উঠোনে থাকলে কমলার ওই কদাকার ভঙ্গিটা পাছে চোখে দেখতে হয় তাই অসীম বিরক্তি চেপেই ঘরে গিয়ে ঢুকল। যদিও অসহ্য গরম।

অন্যদিন অফিসের জামা কাপড় ছাড়বার সময় ডাক দেয় কমলাকে। আজ আর ডাকল না। আলনা থেকে দুপাট করা ধুতিটা টেনে নিয়ে কোমরে জড়িয়ে নিল।

এতক্ষণে কমলা এল। এসেই দেখল স্বামীকে। ওর হাতে খয়েরি রঙের একটা লুঙ্গি। বলল, “ওমা কাপড় ছেড়ে নিয়েছ। আমি আবার এটা সেলাই করছিলাম; তোমার আকখুটে ধোপায় বাপু কী করে যে এত কাপড় ছেঁড়ে বুঝি না।”

মৃণাল চুপ। সস্তা দামের একটা সিগারেট পড়েছিল দেড় হাতের টেবিলটার ওপরে। ধরাল সেটা।

আলনায় লুঙ্গি রেখে কমলা এবার একটু কাছে এল।

—আজ এত দেরি যে! সামন্তবাবুদের সঙ্গে তাস খেলায় মেতেছিলে বুঝি! ঘুরতে ফিরতে ততক্ষণে এক গ্লাস জল গড়িয়ে নিয়েছে কমলা। স্বামীর দিকে হাত বাড়িয়ে ধরেছে, “তাসে মত্ত হলে বাবুদের ঘরের কথা মনেই থাকে না। আম পুড়িয়ে শরবত করে রেখেছিলুম। বিকেল বিকেল এলে দিতাম। রাত হচ্ছে দেখে খেয়ে ফেললাম নিজেই।”

জলের গ্লাসটা নিল না মৃণাল। কমলার কথার উত্তরে মনে হল বলে, ঘরে ফিরব কোন টানে, কী রূপের ধুনুচি জ্বালিয়ে রেখেছ তুমি!

মৃণালকে এত চুপচাপ দেখে কমলা খানিকটা অবাক হল।

—জল খাবে না?

মাথা নাড়ল মৃণাল। গ্লাসটা নামিয়ে রাখল কমলা।

—হল কী তোমার? কমলা শুধোল।

—কিছু না।

—তবে এত চুপচাপ গম্ভীর যে! স্বামীর আরো একটু কাছে ঘেঁষে এল কমলা।

ঘামে ঘামাচিতে গলা কণ্ঠা সব ভরে গেছে কমলার। চুলকে চুলকে লাল করে ফেলেছে। একটা ঘায়ের মতোই দগদগ করছিল। এবং চিট্‌ কাপড়ের গন্ধ আসছিল নাকে। স্ত্রীকে হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিতে দিতে বলল মৃণাল, “যাও তো, ঘ্যানঘ্যান কোরো না কানের কাছে। যাও আর একটা কিছু ছেঁড়া খোড়া টেনে নিয়ে সেলাই করতে বসো গে!”

হয়ত আহত হল কমলা। কিন্তু মুখ দেখে তা বোঝা যায় না। একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সত্যিই ও ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছিল।

—শোন। রুক্ষ গলায় হঠাৎ ডাকল মৃণাল।

ঘুরে দাঁড়াল কমলা।

—তোমার কি আর অন্য শাড়ি নেই ; ওই চিট ছেঁড়াটা গায়ে জড়িয়ে রেখেছ?

স্বামীর মুখে চোখ তুলে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল কমলা। বলল, “কেন, কী হয়েছে এতে?”

—হবে আবার কী, বলছি। তুমি যে ময়না-ঝি নও বাড়ির বউ সেটা বোঝা দায় হয়ে উঠেছে। মৃণাল কেমন এক হিংস্র সুরে বলে।

কমলার সহ্যসীমা এতক্ষণে ভেঙে পড়েছে। তিক্ত সুরে জবাব কাটল, “এনে দিও দশ-বিশখানা শাড়ি, বিবিয়ানা করব।”

কথাটা কানে যেতে রাগে দ্বিগুণ জ্বলে উঠল মৃণাল। নিষ্ঠুর ব্যঙ্গের সুরে বললে, “কী চেহারা বা তোমার যে, শাড়ি এনে দিলেই অপ্সরী হয়ে উঠবে!”

এবার কলহটা আরো একটু গড়াল। যা মুখে এল মৃণালের বলে ফেলল। কমলাও জবাব কাটল। শেষ পর্যন্ত কাঁদল।

রাত্রে পাশাপাশি শুয়েও কেউ কারুর সঙ্গে কথা বলল না। কমলা বালিশের পাশে মুখ গুঁজে কয়েকবার ফুঁপিয়ে অবশেষে ঘুমিয়ে পড়ল। আর মৃণাল একটা রক্তহীন, বিস্বাদ শরীরের পাশে শুয়ে শুয়ে বিরাগে, ঘৃণায়, জ্বালায় ছটফট করতে লাগল।

এ শেষ রাতে স্বপ্ন দেখেছে মৃণাল : কোথা থেকে একটা পালক উড়ে এসেছে, হাওয়ায়। তার গায়ে এসে পড়েছে। হাতে করে সেই পালকটা তুলতে যাচ্ছিল, ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ। পালক কোথায়! মৃণালের হাত কমলার বুকের ওপর। হাতটা সরিয়ে নিয়েছে ও। এবং চোখ বুজেছে আবার, যদি পালকের স্বপ্নটা আবার জোড়া লাগে এই ভেবে।

পুরো একটা দিন নিজের মধ্যেই তার চিন্তাগুলো চেপে রেখেছিল মৃণাল। কিন্তু আর পারল না। সামন্তকে বললে। বলল কথায় কথা টেনে এনে, তুষারের উল্লেখ না করেই।

—দেখ সামন্ত—মৃণাল অনেক যুক্তিটুক্তি দেখিয়ে বললে, “এই যুগটা অন্যরকম। ওসব হৃদয়, আত্মা, স্বর্গ শান্তি—এসবের পুঁজিটুজি কাবার হয়ে গিয়েছে। এখন, এ-সময় দুটো জিনিস আমরা বুঝি স্পষ্ট, এক সুখ আর অন্য যা তাকে বলা যায় উন্মাদনা। এ-দুটোর অনুভূতি অত্যন্ত স্পষ্ট। তোমার আমার আশি কি একশো টাকার মাইনেতে স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সুখের মুখ দেখার উপায় নেই এ-কথা আমি বিশ্বাস করি না। আসলে আমরা জানি না, অল্পের মধ্যেও কতরকমে সুখ পাওয়া যায়। না, না বাইরে নয়, ঘরের মধ্যেই এসব ছোটখাটো সুখ, উৎসাহ পাওয়া যায়। তোমার আমার স্ত্রী ইচ্ছে করলে, তাদের স্বামীদের কি আর তা দিতে পারে না। পারে।”

সামন্ত কিছু বলছিল না। শুধু অবাক হয়ে বন্ধুকে দেখছিল।

বন্ধু মৃণাল বলছিল, “ওসব সূক্ষ্ম প্রেম-টেম বাদ দাও। আমি ভদ্র সন্তান, বিবাহিত পুরুষ, আমাকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মাসান্তে গ্রাসাচ্ছাদন জোগাড় করতে হয়। আমার ফুর্তি পাবার জগৎটা খুব ছোট্ট। এবং আমাকে উদ্দীপ্ত করবার জন্যে, টু চার্জ মাই এনার্জি কী আছে, কে আছে? হ্যাঁ, এক শুধু আমাদের স্ত্রীরা আছে। তোমরা খুব বল, মেয়েরা পুরুষকে শক্তি জোগাবে, উৎসাহ দেবে। কিন্তু আমাদের মেয়েরা কী দেয়। কয়লা আর খুঁটের ধোঁয়া, হলুদের ছোপ, পানের পিচে ক্ষয়ে-যাওয়া-দাঁতের হাসি। অ্যান্ড দ্যাটস্ অল। ”

—কী করাতে চাও আমাদের বউদের দিয়ে। সামন্তর মজা লাগছিল। একটা কাঁচি সিগারেট বন্ধুকে দিয়ে নিজেও ধরাল।

—কী চাই! মৃণাল যেন অভূতপূর্ব কিছু লুকিয়ে রেখেছে এমন মুখভঙ্গি করে একটু রহস্যের হাসি হাসল। তারপর বলল চুপি চুপি তুষারদের কথা।

সামন্ত বিস্ফারিত চোখে চুপ করে বসে থাকল।

মৃণাল তার কথার উপসংহার টানল, “তুমি যাই বল, আমি বিশ্বাস করি মিত্রসাহেব জীবনের সবচেয়ে বড়ো আকর্ষণ অনুভব করেছেন স্ত্রীর মধ্যে। তুষার তার স্বামীকে ক্লান্ত হতে দিচ্ছে না। প্রতিদিন তার স্বামীর মধ্যে নতুন দিনের কাজ শুরুর আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে। লোকটা তাই আজও অত খাটে, খাটতে পারে। আমরা পারি না। আমাদের জীবনে কোনো আকর্ষণ নেই, সুখের রকমফের নেই। উৎসাহ পাব কোথায়? কার মুখ চেয়ে করব এই রুক্ষ সংগ্রাম।”

সামন্ত খানিকটা চুপ করে থেকে হঠাৎ হেসে উঠল। বেশ জোরেই।

—হাসল যে! মৃণাল প্রশ্ন করল।

—সারসী তোমায় বড়ো বিচলিত করেছে হে।

—তা করেছে। সে-ক্ষমতা তার আছে।

—নিশ্চয়, নিশ্চয়। কিন্তু তার অক্ষমতাও তো কিছু থাকতে পারে।

—না, থাকতে পারে না। নেভার। মৃণাল মাথা ঝাঁকাল কঠিন প্রত্যয়ে।

তুষারের কাছে মাঝে মাঝে যাচ্ছিল মৃণাল। আর তুষার হাসিমুখেই অভ্যর্থনা করছিল ওকে।

প্রথম প্রথম সংকোচ ছিল মৃণালের। মিত্রসাহেব হয়ত তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে তাঁরই অধস্তন আশি টাকা মাইনের এক টাইপিস্টের মেলামেশা পছন্দ করবেন না। কিন্তু মিত্রসাহেব অন্য ধরনের লোক। নিজেও যে এককালে বিত্তহীন ছিলেন এ-কথা ভুলে যাননি। তাই মনে হয়। এবং মানুষ সম্পর্কে টাকার বিচারটা তিনি যে বড় করে দেখেন না তাও বোঝা গেল।

চায়ের টেবিলে বসে মিত্ৰসাহেব গল্প করেছেন। বিদেশের গল্প, শিকারের গল্প, নিজের জীবনের নানা দুঃসাহসিকতার গল্প। ওরা শুনেছে। তুষার কখনো চোখ বড়ো বড়ো করেছে, কখনো হেসেছে, কখনো বা ভীত গলায় একটা উদ্বেগের স্বর প্রকাশ করেছে। কিন্তু সব মিলিয়ে মিশিয়ে চায়ের টেবিলটা বেশ জমে গেছে। সুন্দর হয়ে উঠেছে সেই আবহাওয়া।

এরপর কোনো দিন হয়তো মৃণাল উঠে এসেছে, কখনো মিত্ৰসাহেব কাজের কথা ভাবতে ভাবতে তাঁর ঘরে চলে গেছেন, তুষার আর মৃণাল মুখোমুখি বসে থেকেছে। বেড়াতে বেরিয়েছে কোনো দিন।

বেশ কাটছিল বিকেলগুলো। চমৎকার।

মিত্রসাহেবকে মাঝে মাঝে অফিসের কাজে ছুটতে হত বাইরে। তেমন দিনে অনেকক্ষণ, প্রায় রাত পর্যন্ত মৃণাল থেকে যেত তুষারের কাছে। অর্গান বাজিয়ে গান গাইত তুষার, টিয়াপাখি রঙের শাড়ি পরে, টুকটুকে নখের ডগা রিডে চেপে ধরে মিহি গলায়। সোফার মধ্যে ডুবে গিয়ে স্পন্দনহীন হয়ে শুনত মৃণাল সেই গলা। আর দেখত তুষারকে।

এমনই একদিন মিত্রসাহেব যখন অন্যত্র, মৃণাল এল, আর কাল-বৈশাখীও ছুটে আসছিল তখন আকাশ ডিঙিয়ে। গাছপালা লুটোপুটি খাচ্ছিল।

ঘরের দরজা বন্ধ করে বাতি জ্বালিয়ে বসেছিল তুষার। হাতে একটা বই। ফুলের ছবি।

লাল টকটকে শাড়ি পরেছে সেদিন তুষার। সেই রঙেরই ব্লাউজ। হাতে জরির পাড় বসানো। মনে হচ্ছিল এই ঘরের মধ্যে একটা আগুন বঙ্কিম শিখায় জ্বলছে।

মৃণাল এল, বসল।

—বাইরে ঝড় কি উঠেছে? প্রশ্ন করল তুষার।

—বোধ হয় এতক্ষণে এসে গেছে। শব্দ তো শুনছি।

হ্যাঁ, বাইরে তখন ঝড় উঠেছিল। সোঁ-সোঁ হাওয়া বইছে, গোঁ-গোঁ করছে গাছপালা। মেঘ ডাকছিল। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল আকাশে।

—বসে বসে ছবি দেখছ? হেসে বলল মৃণাল।

মাথা নাড়ল তুষার। ঠোঁটের আগায় বিচিত্র হাসি টানল ; বলল, “বাইরে যখন ঝড় তখন আমি ফুলের ছবি দেখছি,” একটু থেমে, “আর এই ফুলটার নাম কি জান, ব্লিডিং হার্ট। বিলিতি ফুল।” বইটা এগিয়ে দিল তুষার।

হাতে নিয়ে দেখল মৃণাল। হাসল। বলল, “বেশ নাম। তা তোমার হৃদয় তো রক্তাক্ত নয়, তবে ও-ফুল কেন, অন্য ফুলে চোখ দাও।”

—আমার হৃদয় কি তুমি দেখেছ? তুষার সরাসরি চেয়ে থাকল মৃণালের চোখে।

—না দেখলেও বুঝতে পারি।

—পার! আশ্চর্য তো! তুষার তার আপেলের মত গালে হাসির একটি-দুটি কুঞ্চনও গুটিয়ে নিল।

—না পারার কী আছে! মৃণাল বান্ধবীর সঙ্গে পরিহাস করছিল, “ঈশ্বর তোমার হৃদয়টাকে ফুল দিয়ে গড়েছেন, দুঃখের বিষয় সেখানে রক্ত নেই, রঙ আছে।”

তুষার হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। মুখ ফিরিয়ে নিল অন্যদিকে, দেওয়ালে। একটা ছবিই যেন দেখছিল। নিজের ছবি।

মৃণাল চুপ করে গেছে। বাইরের ঝড়ের দাপট ঘরের দরজাকে থরথরিয়ে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। বাজ পড়েছে কাছাকাছি কোথাও। শব্দে চমকে উঠল মৃণাল।

সে-চমক ভাঙতেই দ্বিতীয়বার চমকে উঠল মৃণাল যখন তুষার তার পাশে এসে হাতটা টেনে নিয়েছে আচমকা।

—তুমি কিছু জান না, মৃণাল। কিছুই বুঝতে পার না। তুষারের গলা কাঁপছিল, বুক কাঁপছিল, নিশ্বাস উষ্ণ, চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে।

ধকধকে করছিল মৃণালের হৃৎপিণ্ড। এবং জ্বালা করতে শুরু করেছিল চোখ, নাক।

—আমার বুকের মধ্যেও রক্ত ঝরছে। আর তোমাদের মিত্রসাহেব ওই ঝড়ের মতন কালো কুশ্রী ভয়ঙ্কর চেহারা আর আক্রোশ নিয়ে দাপাদাপি করছে। বিস্ট, বিস্ট! ও একটা বিস্ট।

ভয় করছিল মৃণালের। ঘাম জমছিল কপালে। তুষারের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে চাপা গলায়, ভয় ভয় সুরে ও বলল, “কী বলছ যা-তা!”

—বলব। একশোবার বলব। সে-অধিকার আমার কাছে। তুমিই বল, এত করলাম, তবু ও পারল না, পারছে না কেন!

তুষারের চোখ দিয়ে বড়ো বড়ো ফোঁটা পড়ছিল। গাল বেয়ে নামছিল।

কিন্তু চমকে উঠেছে মৃণাল। ভীষণভাবে চমকে উঠেছে। ধক্ করে একটা সন্দেহ বুকের ওপর উঠে এসেছে।

মৃণালকে কিছু বলতে হল না। তুষার বলল নিজে থেকেই। যদিও বলতে তার কষ্ট হচ্ছিল। তবু ভাঙা গলায় থেমে থেমে বললে, “ও দাম দিতে পারে না, দেবার ক্ষমতা নেই। সহজ কথাটা বুঝবে না। ভাবে আমার চামড়া আর মাংসগুলো আরো, আরো সুন্দর হলে ও পারবে। কিন্তু যা লোহা নয়, লোহার ছিঁটে ফোঁটাও যাতে নেই, চুম্বক তাকে টানবে কেমন করে।”

তুষার একটা বৃহৎ লাল প্রজাপতির মতন মৃণালের বুকে কোলে পড়ে ধড়ফড় করল যেন কয়েকবার।

তারপর এই ঘর এবং যেন অন্যান্য ঘর, জানলা পর্দা সব কেউ দমকা হাওয়ায় উড়িয়ে দিল। বাতি নিভল। আবার জ্বলল অন্য কোথাও। সোনালী সাপের মতন একটা দেহ সেখানে ঢেউ খেলে খেলে যাচ্ছিল, স্ফুলিঙ্গের মতন জ্বলছিল দুটো চোখ। পাতা, গাছ, ছায়া কোথাও কি একটু আচ্ছাদন ছিল, একটু স্নিগ্ধতা বা লুকোচুরি রহস্য, আলো-আঁধারের ঝিলিমিলি! না। অসহ্য রুক্ষ এবং নিষ্ঠুর। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল মৃণাল। অদ্ভুত একটা অসাড়তায় তার সর্বাঙ্গ স্তব্ধ হয়ে গেল। মিত্রসাহেবের মতনই হয়ত।

যেন ছোবল খেয়ে ছিটকে বেরিয়ে এল মৃণাল। একেবারে পথে।

ঝড় থেমেছে। মেঘ কেটে গেছে। মাটি ভিজে। জোনাকি উড়ছিল। পাতা থেকে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছিল হাওয়ায়। কেমন এক গন্ধ। আর ক্ষীণ আলো চাঁদের। আমলকি-ডালে একটা ঝড়ো কাক পাখা ঝাড়ছিল।

মৃণালের হুঁশ ফিরে এল নিজের কোয়ার্টারে পা দিয়ে। দরজাটা বন্ধ ছিল। কড়া নাড়ল।।

হ্যাঁ, দরজা কমলাই খুলে দিয়েছে। কিন্তু মৃণাল বিশ্বাস করতে পারছিল না।

ঘরে ঢুকে মৃণাল আলোয় আর-একবার দেখল কমলাকে। ফিনফিনে এক শাড়ি পরেছে ফিরোজা রঙের। গায়ে যেন জামাটা থেকেও নেই। চোখে কাজল। পাউডারে ধবধব করছে গাল দুটো। আর খোঁপা ভেঙে বিনুনি দুলছে।

অত্যন্ত কুৎসিত একটা উপমা মনে পড়ছিল সেদিকে তাকিয়ে।

—বাঈজি সেজে বসে আছ কেন? অসম্ভব তিক্ত রুক্ষ গলায় চিৎকার করে উঠল মৃণাল।

কিন্তু আজ আর কমলা কাঁদল না। গলার পর্দা চড়াল না। অত্যন্ত কঠিন কিন্তু মৃদু গলায় বলল, “তোমার জন্যে। এতেও যদি না হয়, আরও পারি।” কমলা আঁচলটা খুলে ফেলল গা থেকে।

হাত ধরে ফেলল মৃণাল খপ্‌ করে। আশ্চর্য এক ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে ওর গা। গলা দিয়ে স্বর ফুটছিল না। তবু বলল, “না, না। লক্ষ্মীটি না।”

স্বপ্নটা আবার দেখল মৃণাল। মনে হচ্ছিল একটা পাখি উড়ছে মাথার ওপর। ঘুরে ঘুরে উড়ছিল। হঠাৎ পাখি থামল। একটা পালক খসে পড়ল। একটা নয় ; এক, দুই, তিন। অনেক পালক। আর সেই পালক যেন দমকা হাওয়ায় একটা গাছের গুঁড়িতে গিয়ে আটকে গেল। পরক্ষণেই স্পষ্ট হল দৃশ্যটা, গাছের গুঁড়ি নয়। পালকের পা—পায়ের মতোই। আর সেই পা-র ঊর্ধ্বে একটি মানুষী অবয়বের নাভি, উদর, বুক পাথরের মূর্তিরমতন। স্পন্দনহীন, লালিত্যহীন ; হ্যাঁ, পাথরই। মৃণাল হাত দিয়ে ধরতে গিয়েছিল। ঘুম ভেঙে গেল।

ভোরের আবছা আলোয় মৃণাল দেখে ওর হাতটা কমলার গলার পাশে।

একবার এপাশ-ওপাশ তাকাল মৃণাল। হয়ত পালকই খুঁজছিল। কিন্তু খুঁজল না। কমলার গলা সোহাগে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ল আবার। এবং এই ভেবে খুশি হচ্ছিল যে, এখানে সে বা তারা ব্যর্থ নয়, একটা আবরণ থাকলেও এখন ওর পাশে পাতায় ঢাকা পদ্মকুঁড়ির মতন একটি হৃৎপিণ্ড ধুকধুক করছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *