গগনের অসুখ

গগনের অসুখ

“এই নে, ছবিটা দেখ। আলোর জন্যে মুখগুলো ফরসা ফরসা হয়ে গেছে বেশি। মেজদিকে দেখতে পাচ্ছিস ? জানলার দিকটায় দাঁড়িয়ে আছে। ফুলদানির পাশে আমাদের লতু, কেমন বড়সড় হয়ে গেছে দেখেছিস ! শাড়ি পরে খোঁপা বেঁধে ফুল গুঁজে একটা লেডী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নতুনবউ মুখ আর-একটু তুলে রাখলে তুই পুরোপুরি দেখতে পেতিস। ভালোই দেখতে বুঝলি, গায়ের রঙটঙ চলনসই, কিন্তু বড্ড কচি মুখখানা, সুন্দর। নয়নটাকে দেখ, রাস্কেলটা বিয়ের মালা গলায় দুলিয়ে ফিলমের হিরোর মতন পোজ দিয়েছে। ওটা যে কী ফাজিল হয়েছে, একেবারে ডেঁপো হয়ে গেছে। অ, তুই জানিস, বিয়ের পর নয়ন আর একটা লিফট পেয়েছে ; ওদের ফ্যাক্টরি নিউ স্কীমে অনেকটা এক্সটেনশন করেছে। নয়ন গ্লাসগো যাবার একটা চান্স পাবে বোধহয়। যাই বলিস, নতুনবউ খুব ভাগ্যমন্ত। তোর বাবা তো আদর করে বউকে দু বেলা দুধের সর খাইয়ে দিচ্ছে। আমি তার কাণ্ড দেখে অবাক। জামাইবাবু আমার দিদির বেলায় একটা স্নো ক্রীমের শিশিও কোনোদিন হাতে করে কিনে আনে। নি। চান্স পেয়ে তোর বাবাকে এবার খুব শুনিয়ে দিয়েছি। আজকাল ওই ওলড ম্যান হাসে, কি বলে জানিস ? বলে, দেখ হে ছোটশালা—তোমার মেজদি এমনিতেই ননী ছিল, তাকে আরও দুধ সর খাওয়ালে স্নো ক্রীম মাখালে জিনিসটি গলে। যেত। …শুনলি তোর বাপের কথা। … যাই বলিস গগন, অনেক দিন পরে তোদের সংসারে বেশ একটা হাসি-খুশি দেখলাম। সবাই আনন্দ পেয়েছে। আমার এত ভাল লেগেছে রে, বিয়ে থা চুকে গেলে আর বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছিল না। …ও হো, ভাল কথা ; নয়ন বলেছে তোর কাছে চিঠি লিখেছে দুটো, জবাব পায় নি—”

গগন ফটোর দিকে তাকিয়ে নয়নকে আবার দেখল। ফুলশয্যার দিন নয়নদের শোবার ঘরে পরিবারের যাদের যাদের পাওয়া গেছে সবাইকে এক সঙ্গে জড়ো করে ফটো তুলে রেখেছে ছোটমামা। গগন আত্মীয়-স্বজনদের সকলকেই চিনতে পারছে! লতু বেশ বড় হয়ে গেছে। নয়ন মোটা হয়েছে আগের চেয়ে। নয়নের বউ—কি যেন নাম নতুন বউটির !

“নয়নের বউয়ের কি নাম, ছোটমামা?” গগন জিজ্ঞেস করল।

“সবিতা।” ছোটমামা গগনের বিছানায় আরও একটু ঝুঁকে যেন ঢিলে ঢালা হয়ে বসল। “বি-এ পর্যন্ত পড়েছে রে, গগন। কোয়াইট এনাফ ফর আওয়ার ফ্যামিলি, কি বলিস!”

গগনের জানলার ওপাশে, বাইরে, বাগানে নতুন সার ঢেলেছে। সারের গন্ধ আসছিল। কিছু মাছিও জমেছে সারের গোড়ায়। মাঝে মাঝে নীল মাছি ডুকছিল ঘরে। গগন যখন আবার ছবিতে নয়নের বউকে দেখছে তখন একটা মাছি তার মুখের পাশ দিয়ে উড়ে গেল।

ছবিটা চোখের কাছ থেকে সরিয়ে গগন দু মুহূর্ত সামনে তাকিয়ে থাকল, দেওয়ালের দিকে। দেওয়ালে তার আলনা। জামা ঝুলছে, পাজামা রাখা আছে।

“ছোটমামা—”

“বল।”

“আমায় কবে নিয়ে যাচ্ছ ?”

“তোকে—! …এবার তোকে নিয়ে যাব।” ছোটমামা যেন সামান্য ভেবে নিচ্ছে। চোখে ভাবনা, কপালে হিসেবের দাগ ; ছোটমামা বলল, “তোকে পরের বার নিয়ে যাব। আমার সঙ্গে কথা হয়ে গেছে। আর মাস দু’তিন। এবারের শীতটা এখানে কাটিয়ে নে, এত ভাল ক্লাইমেট।”

গগন জানলার দিকে তাকিয়ে, পায়ের দিকের জানলা। জানলার বাইরে সরু টানা বারান্দা, মাথায় টালির চাল গড়ানো। ঘর থেকে বাইরে তাকালে বারান্দার গড়ানো চালা দৃষ্টিকে ভূমির দিকে নত করে রাখে। দূরে একটা কুঞ্জ। গগন কুঞ্জ দেখছিল । একটি বড় ঝাউকে মাঝে রেখে চারপাশের পাঁচ ছটি ছোট ছোট পাতাবাহার, জাফরিকাটা বেড়া ধরে লতানো গাছ আলপনা বুনে রেখেছে, কিছু মরশুমি ফুল । এখান থেকে ছবিটা স্পষ্ট নয়, তবু মোটামুটি স্নিগ্ধ ।

“গগন।” ছোটমামা পায়ের কাছে নামানো বেতের টুকরি থেকে বড় বড় দুটো কমলালেবু বার করল। এবং ইতস্তত তাকিয়ে মিটশেফের মাথায় কলাই করা জাগে জল দেখতে পেয়ে উঠল। মাথার দিকের জানলায় দাঁড়িয়ে ছোটমামা লেবু দুটো ধুয়ে নিচ্ছিল।

এখন দুপুর। সূর্য হেলে পড়েছে। অগ্রহায়ণের রোদে পাকা হরীতকীর রঙ ধরেছে। পাখিরা দানা খুঁটে নিয়ে আলস্য উপভোগ করছে ও-পাশটায়, এদিকে পাখি নেই, ফাঁকা।

“নে গগন, লেবু খা—” ছোটমামা টুকরির ওপর থেকে বাসি খবরের কাগজটা বিছানার পায়ের দিকে রেখে লেবুর খোসা ছাড়াতে বসল।

“মেজদি তোর জন্যে যে জিনিসগুলো দিয়েছে, সেগুলো ওই কাপড়ের ব্যাগের মধ্যে আছে। কি কি যেন বলে দিল…ফুলহাতা সোয়েটার, গরম জামা, পাজামা, গেঞ্জি…” গগনের হাতে লেবুর কোয়া দিতে দিতে ছোটমামা একটু থেমে আবার বলল, “ওহো গগন, নয়নের বিয়েতে তুই একটা ধুতি পেয়েছিস, নয়নই কিনেছিল। ধুতিটাও আছে ব্যাগে।” ।

“ধুতি আমি কি করব!”

“পরিস মাঝে মাঝে ।”

“এখানে কোথায় ধুতি পরব !” গগন লেবুর রসে স্বাদ পাচ্ছিল না। মিষ্টি নয়, টকও নয় ; বিস্বাদ। জোলো।

“এই টুকরির মধ্যে তোর জন্যে ফলটল আছে সামান্য। তলায় বিস্কুটের টিন মাখন সব আছে।”

মাথার জানলা দিয়ে মাছি ঢুকে বিছানায় এসে বসছিল। গগন হাত নেড়ে মাছি তাড়াল। “মা কেমন আছে, ছোটমামা ?”

“শরীরের কথা বলছিস ? ভালই। তবে বাড়িতে বিয়ে থা গেল—কাজেকর্মে অনিয়মে একটু গোলমাল তো হবেই।”

“বাবা ?”

“জামাইবাবু ভালই আছে ! ডান চোখের ছানিটা এখনও কাটানোর মতন হয় নি, ওটা কাটাবার জন্যে বড় ব্যস্ত।”

মাছিটা উড়ে জানলার কাছে গিয়ে বসল। গগন দেখল একবার। নতুন সারের গন্ধ এলো বাতাসে।

“দেখ গগন, এই বিয়েটা দরকার ছিল।” ছোটমামা একটা লেবু শেষ করে ফেলল। দ্বিতীয়টায় হাত দিতেই গগন হাত নেড়ে বারণ করল, আর নয়।

“খা না। দুটো তো মাত্র লেবু।”

“না, এখন আর ভাল লাগছে না। “ মাথা নাড়ল গগন, “তুমি কি বলছিলে, ছোটমামা !”

“আমি! …ও হ্যাঁ, বলছিলাম এই বিয়েটা দরকার ছিল।” ছোটমামা কাগজ সমেত লেবুর ছিবড়েগুলো তুলে ঘরের কোণে চুন ভরতি গামলাটার ওপর রেখে দিল। “তোদের বাড়িটা কেমন একটা মেলাংকলিতে ভুগছিল। মেজদি একেবারে ভেঙে পড়েছিল প্রথম দিকে, সেটা সামলে নিল বটে, তবে মায়ের মন তো রে, যতই সংসার নিয়ে পড়ে থাকুক, মনে মনে সর্বক্ষণ একটা দুশ্চিন্তা। হাসিমুখ দেখতাম না। জামাইবাবু অবশ্য খুব রিজার্ভড, তবু বুঝতে পারতাম মনে মনে বড় দুর্ভাবনায় থাকেন। গোটা বাড়িটাই কেমন চুপচাপ থাকত, রান্নাবান্না খাওয়া স্কুল অফিস কাছারি সবই চলছে—তবু মরার মতন যেন। …নয়নের বিয়েতে এই মনমরা ভাবটা কাটল। অনেকটাই কাটল।” ছোটমামা গগনের হাত টেনে নিয়ে আদর করে নিজের করতলে চেপে রাখল। বলল, “গোটা একটা সংসার যদি বিছানায় পড়ে থাকে গগন, অসুখ আরও পেয়ে বসে। আমি জানি, তোকে বাদ দিয়ে তোদের বাড়ির কারুর কিছু ভাল লাগে না, লাগবে না। তবু, ওরা সবাই তোর বিছানার চারপাশে বসে থাকলেই কি সব সমস্যা মিটে যাবে!”

গগন মামার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল আস্তে করে। নয়ন তাকে বিয়ের আগে চিঠি লিখেছিল, বিয়ের পরও দুটো লিখেছে। নয়ন তার ছোট। ছোট হলেও পিঠোপিঠি, দেড় বছরের তফাৎ। দাদা বলে না, নাম ধরে ডাকে।

(গগন, আমি বিয়ে করছি রে। আমাদের ফ্যাক্টরির এক ভদ্রলোকের মেয়ে। তুই তাকে দেখেছিস। পালিত লেনে আমরা যখন থাকতুম তখন সেই পাড়াতে তারাও থাকত। তখন ছোট ছিল ; এখন পাঁচ পাঁচ হাইট। গগন, আমি কেন বিয়ে করছি তোকে পরে বলব, তুই যখন ফিরে আসবি তখন।)

“আমি সে-দিনও মেজদিকে বলছিলাম—” ছোটমামা গগনের বিছানার ওপর পা তুলে উঠে বসল, “বুঝলি গগন, আমি মেজদিকে বললাম, তোমাদের সংসার দেখে এখন মনে হচ্ছে মেজদি, বেয়াড়া বাদলাটা টুটেছে। দেখো বাবা, রোদটা যেন থাকে।”

গগন নয়নের কথা ভাবছিল। নয়নের চিঠি তার চোখের ওপর—নয়নের গলায় কথা বলছে।

(গগন, আজ আমার বিয়ে। বিকেলে বর বেশে যাত্রা করব। বাড়িতে শাঁখ বাজছে, তত্ত্ব গিয়েছে গায়ে হলুদের। মা ঠাকুর ঘরে ঢুকে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদছে, বাবাকে দেখতে পাচ্ছি না, হয়ত নিচেতে। লতু একটু আগে এসে আমায় বলছিল, ছোড়দা, মা বলছিল, বড়দার ছবিটা পরিষ্কার করে একটা মালা পরিয়ে রাখতে। …গগন, আমার কিছু ভাল লাগছে না। আমি তোর আগে আগে কখনও কোথাও যেতে চাই নি, যাই নি। এই ব্যাপারটায় এগিয়ে গেলাম। কেন, তা তোকে পরে বলব, তুই ফিরে এলে।)

“দেখ গগন, আমি একটা কথা বুঝি—” ছোটমামা বলল, “শোক দুঃখ দুশ্চিন্তা এ-সব তো আছেই। সংসারে জন্মাবে আর বগল বাজিয়ে দিন কাটিয়ে দেবে এ বাবু হয় না। রাজারও দুঃখ আছে। শোক দুঃখ আছে বলে সবাই মিলে গলা জড়াজড়ি করে বসে মরার মতন কাঁদব ।এতে কোনো লাভ হয় না, অ্যাটমসফেয়ারটাই যা বিশ্রী হয়ে ওঠে। নয়নের বিয়ের সময় আমি মেজদিকে বুঝিয়েছিলাম, গগন তত ভাল হয়ে উঠছে, ফিরেও আসবে, অযথা, তোমাদের নয়নের বিয়ে নিয়ে অত কিন্তু কিন্তু করার কি আছে। সংসারের দিকে তো তোমায় তাকাতে হবে।” ছোটমামা হাতের ঘড়িটা খুলে দম দিয়ে নিল।

নয়নের বিয়ের পরের চিঠিটা যেন বাতাসে উড়ে গগনের চোখের সামনে এসে পড়েছে দেখতে পেল। খুব পাতলা নীলচে কাগজে লেখা চিঠি। বউয়ের লেখার কাগজ, থেকে নিয়েছে নিশ্চয় নয়ন।

(গগন, বিয়ের ঝামেলা চুকে গেছে। তুই কিরে, একটা চিঠিও তো দিবি ! আমার কথা না হয় বাদ দে, কিন্তু সবিতাকে একটা আশীর্বাদ করবি তো চিঠিতে। তোর কোনো জ্ঞানবুদ্ধি নেই, গগন। …তুই ফিরে আয়, তোকে আমি অনেক কিছু বলব। গগন, সবিতা তোকে চেনে। বলছিল, একবার সাইকেল চড়া শিখতে গিয়ে তুই পড়ে গিয়েছিলি। সত্যি না কি রে !)

“গগন— ?” ছোটমামা গায়ে ঠেলা দিল গগনের আলতো করে।

“উ।”

“তুই কোনো কথা বলছিস না ।”

“বলছি।” গগন ছোটমামার দিকে তাকাল । ছোটমামার মুখ গোল, রঙ ফরসা। মার মুখের সঙ্গে অনেকটা মিল আছে। কপাল আর চোখ নাক অবিকল মার মতনই। তবে ছোটমামার চোখ খুব দপদপে, কেমন যেন চাঞ্চল্য দৃষ্টিতে ; মার চোখ শান্ত, মার চোখে ক্লান্তি। গগন মাকে দেখছে এমন চোখ করে কয়েক পলক ছোটমামাকে দেখে নিল।

“গগন—” ছোটমামা ডাকল।

“বলল।” গগন চোখে চোখে আর তাকাতে পারল না ছোটমামার, বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকল।

“তোর এখন শরীর কেমন ?”

“ভালো।”

“কোনো কষ্ট হয় ?”

“না।” গগন বলল। বলে ডাবল, তার কষ্ট হয় না বললে ছোটমামা খুশি হবে। পরে আবার ভাবল, শরীরের কথা জিজ্ঞেস করেছে ছোটমামা, শরীরে তার কোনো কষ্ট হয় কি না! হয় না।

ফটোটা বিছানা থেকে উঠিয়ে গগন আবার দেখতে লাগল। ঘরটা তার বড় চেনা। ওই ঘরে তারা দুজনে থাকত—গগন আর নয়ন। জানলার দিক করে তাদের বিছানা ছিল, পশ্চিম দেওয়ালের দিকে টেবিল, আলমারি ছিল একটা দরজার দিকে ; নয়ন টেনিস খেলা শিখছিল, তার র‍্যাকেটটা কাপড় পরিয়ে টিকিতে বেঁধে দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখত।

“ছোটমামা, লতুটা সত্যিই বেশ বড় হয়ে গেছে।” গগন অন্যমনস্ক গলায় বলল।

“বড় কি রে, বললাম না তোকে একটা লেডী হয়ে গেছে।”

“ওর কত বয়স হল ?”

“কত— ! দাঁড়া বলছি—” ছোটমামা হিসেব করে নিচ্ছিল, “লতু হয়েছে মা মারা যাবার আগের বছর। তার মানে লতু এখন পনের।”

“আমি যখন আসি তখন লতু ফ্রক পরত—” গগন কেমন হেসে বলল, “ওর একবার চুলে জট পড়েছিল, আমি কাঁচি দিয়ে অনেক চুল কেটে দিয়েছিলাম। তারপর যা অবস্থা হল ছোটমামা, লতু আর বিনুনি বাঁধতে পারে না।” গগন আপন মনেই হাসল, লতুর মুখ দেখতে লাগল ছবিতে, মস্ত একটা খোঁপা বেঁধেছে বোধহয়।

“দেখ গগন—” গগন আর অন্যমনস্ক নেই দেখে ছোটমামা আবার কথা শুরু করার উদ্যম পেল। “আমি ঠিক করেছি, এবার একবার মেজদিকে নিয়ে হরিদ্বার বেড়িয়ে আসব। জামাইবাবুর এখন আর কোনো অসুবিধে নেই, নয়নের বউ রইল।”

“নয়ন কবে গ্লাসগো যাবে, ছোটমামা ?”

“এখনও কিছু ঠিক নেই। একটা কথা চলছে। …তবে নাইন্টি পার্সেন্ট চান্স রয়েছে। আরে, গরু দুধ দিতে না পারলে কি মানুষ তাকে গোয়ালে রেখে খাওয়ায় ! নয়নটা যে খুব কাজের ছেলে, ফ্যাক্টরিতে ওর খুব সুনাম।”

“এখন কত মাইনে পাচ্ছে ?” গগন শুধলো।

“ছশো পাচ্ছিল। নতুন লিফট পেয়ে আরও বেড়েছে কিছু।” ছোটমামা বলল। বলে কি ভাবল। হঠাৎ যেন কোনো কথা মনে পড়ে গেছে, মজার কথা, ছোটমামা হাসি মুখ করে বলল, “নয়নের একটা কীর্তি শুনবি ! …বেটা যেদিন লিফট পাবার খবর পেল সেদিন বাড়ি আসার সময় একটা শাড়ি কিনে এনেছে। এনে নতুনবউয়ের হাতে দিয়েছে, কোনো কথা বলে নি। …রাত্রে খাবার সময়, তুই ভেবে দেখ গগন, জামাইবাবু এক পাশে বসে খাচ্ছে, লতু রয়েছে, নয়ন নিজে, মেজদি বসে, নতুনবউ খেতে দিচ্ছে—নয়ন খেতে খেতে লিফট পাবার খবরটা দিল। দিয়ে মেজদিকে বলল, তোমার জন্যে একটা শাড়ি এনেছি মা, পাও নি ? মেজদি অবাক। শাড়ি, কই না—কিছু তো দেখে নি মেজদি। নয়নটা সঙ্গে সঙ্গে তার বউয়ের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ওর হাতেই দিয়েছি, ও তোমায় দেয় নি তবে, নিজে মেরে দিয়েছে। বউ বেচারি তো লজ্জায় অপ্রস্তুত…” ছোটমামা হা হা করে হাসতে লাগল। যেন রগড়টা এইমাত্র করা হয়েছে, নয়ন সামনে বসে আছে।

গগনও একটু হাসল। শব্দ করে নয়। তার মনে হল নয়ন বউকে এমনি করেই জ্বালাচ্ছে বোধহয়। নয়ন ওই রকমই। লতুকে, যখন লতু বেশ ছোট, নয়ন বলত, হ্যাঁরে লতু, তোদের সেলাইদিদিমণিটা শালকরের দোকানে রিপুর কাজ করে কেন রে ? লতু বুঝতে পারত না প্রথমে, পরে ভীষণ চটে যেত, চেঁচাত, রাগের দমকে কেঁদেই ফেলত। নয়ন তবু ছোট বোনের পিছনে লাগত।

“লতু আমার কথা কিছু বলে না, ছোটমামা ?” গগন বলল। ছোটমামার দিকে না তাকিয়ে, ছবিটা দেখতে দেখতে।

“বলে না রে কিরে, প্রায়ই জিজ্ঞেস করে।” ছোটমামা পকেট হাতড়ে লবঙ্গর কৌটো বের করল, একটা দুটো তুলে নিল, “এই যে এখান থেকে ফিরে যাব, তারপর লতর কত কি প্রশ্ন। …বুঝলি গগন, লতুর খুব জানতে ইচ্ছে করে তুই কোথায় আছিস।”

“ও জানে না ?”

“জানে, তবে ঠিক বুঝতে পারে না।”

গগন কেমন অন্যমনস্ক হল। এ রকম অন্যমনস্ক মানুষ খুব ঘনঘোর বাদলার দিনে হয়, কিংবা কোনো নদী বা বনের ধারে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যে বেলা। গগন অন্যমনস্ক হয়ে ভাবল সে কোথায় আছে, তার চারপাশে কি কি আছে!

দুপুরের রোদ দেখে মনে হচ্ছে, যে বিরাট চৌবাচ্চায় সারা সকাল দুপুর ভরে রোদ জমা হয়েছিল যেন তার জল বেরোবার মুখটা খুলে গেছে হঠাৎ—আর কল কল করে রোদ বেরিয়ে চৌবাচ্চা খালি হয়ে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে রোদ ফিকে হয়ে আসছিল। গগন কাতর হল। বাড়িতে ফিরে গিয়ে ছোটমামা লতুকে কি কি বলে গগনের জানতে ইচ্ছে হল।

ছোটমামা মাথার দিকের জনলা দিয়ে বাইরে ক দণ্ড তাকিয়ে থাকল। বাতাস এলোমেলো হয়ে বয়ে যাচ্ছে, নতুন সারের গন্ধ আসছে ঘরে। বার কয়েক নাক টানল ছোটমামা। “কিসের গন্ধ রে, গগন ?”

“সারের। বাগানে নতুন সার দিয়েছে।”

“তোদের এখানে বিনি সারেই যা ভেজিটেবলস্‌ হয়…”

“আমায় তুমি কবে নিয়ে যাবে ঠিক করে বলল, ছোটমামা ?” গগন কাতর ক্ষুব্ধ চোখে ছোটমামার দিকে তাকাল।

“বললাম যে, এই শীতটা শেষ হলেই।”

“তুমি যখনই আস এই গরম এই বরষা এই শীত কর। এবারেও ঠিক তেমনি বলছ।”

“আরে না। না—না—না।” ছোটমামা প্রবল ভাবে মাথা নাড়ল। “আমি ইচ্ছে করলে তোকে এখনও নিয়ে যেতে পারি। নিয়ে যাচ্ছি না কেন জানিস ? এই শীতটা এখানে কাটিয়ে দিলে তোর হেলথ্‌ আরও ইমপ্রুভ করবে। …দেখ গগন, ভাল জিনিস একটু বেশি হলেই ভাল। লাভ বই ক্ষতি নেই তাতে।”

গগন বিছানা থেকে উঠল। জল খেল। ছোটমামার আনা ব্যাগটা তুলল, নামিয়ে রাখল আবার। উবু হয়ে বসে ব্যাগ খুলে জিনিসপত্র বের করতে লাগল। মার চিঠি ছিল ব্যাগের মধ্যে।

সোয়েটারটা নতুন। উলের গন্ধ শুঁকল গগন। পাজামা গেঞ্জি সব নতুন। কোরা গন্ধ। সমস্ত নতুনের মধ্যে মার চিঠিটাই যা পুরোনো। গগন মার চিঠি হাতে করে উঠে দাঁড়াল। “মার চিঠি, ছোটমামা ।”

“মেজদির চিঠি !…আমায় কিছু বলে দেয় নি। ভুলে গেছে বোধহয়।”

গগন খামের মুখ ছিঁড়ে ভাঁজ করা দুটো চিঠি পেল। মা আর লতুর।

মার চিঠি পড়তে পড়তে গগনের মন বিষণ্ণ হল। মার মনে বড় অশান্তি। গগনের জন্যে মার দুর্ভাবনা এক তিলও কমে নি, আগে যেমন ছিল এখনও তেমনি রয়েছে। বাবার কথাও লিখেছে মা। বাবা আজকাল প্রায়ই গগনের নাম করে বলে, ও বাড়িতে ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি নতুন বাড়ির কিছু করব না।

(শীতটা খুব সাবধানে থাকিস, বাবা। ফুলহাতা নতুন সোয়েটারটা ঢিলে করে করেছি, সারাক্ষণ পরে থাকবি। নয়নের বউ তাড়াতাড়ি করে মোজা বুনেছে, যদি পায়ে ছোট লাগে ফেলে দিস না, দুচার দিন পরলেই ঠিক হয়ে যাবে। তোর বাবা আর নয়ন আগামী মাসে যেতে পারে তোর কাছে। যা যা দরকার চিঠিতে লিখিস পাঠিয়ে দেবো।)

বাইরে পাখি এসেছে। কাকলি শোনা যাচ্ছিল। শিরীষগাছের ডালে বসে পাখিরা যেন খেলা করতে নামার আগে দু দলে ভাগ হয়ে যাচ্ছিল।

“গগন!” ছোটমামা ডাকল।

“উ—” গগন চিঠি পড়তে পড়তে সাড়া দিল ।

“তোর গলার কাছে ওটা কিসের দাগ রে ?”

গগন জবাব দিল না। লতুর চিঠি পড়তে পড়তে মুখে তার হাসির ছোঁয়া লাগছিল। লতুটা একেবারে সেই রকম আছে, পাগলী । এক কথা লিখতে লিখতে অন্যকথা লেখে। লতু কখনও কথা পুরো করে বলতে পারত না, অর্ধেকটা বলে বাকিটা বলার গরজ পেত না। নয়ন হেসে বলত, দেখ লতু তোর সবই যখন আদ্ধেক তখন আমরা তোর বিয়ের সময় শুধু একবার তোর বরটাকে দেখিয়ে দেব, ব্যাস ; তারপর আর তোর কোনো কিছুর দরকার নেই।

গগন হেসে ফেলল। চিঠি শেষ করে নয়নের সেই কথা ভাবতে লাগল । লতু তার বরের কথা শুনে নয়নের গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত, আঁচড়াত নয়নকে ।

বাইরে বাগানে পাখিরা দু দলে ভাগ হয়ে যেন খেলা শুরু করে দিয়েছে। গগন সুখ অনুভব করল, গগন দুঃখ অনুভব করল।

“তোর গলায় ওটা কিসের দাগ রে, গগন ?” ছোটমামা আবার বলল।

গগন অন্যমনস্ক। বাইরে রোদের চৌবাচ্চা ফুরিয়ে এলো। এখন তরল করে রোদ পড়ছে, রঙ নেই। বাগানে দুটো মালি কাজ করছে। সার পড়ে আছে স্তূপ হয়ে। ঝারিতে করে জল দিচ্ছে বুড়ো মালি। বিকেল হয়ে এসেছে বলে দু একজন করে লোক দেখা যাচ্ছিল।

ছোটমামা এবার যেন অবাক হয়েই বলল, “এই গগন ? কি হল রে তোর ?”

গগন ছোটমামার দিকে তাকাল।

“কথা বলছিস না কেন ?” ছোটমামা বলল।

“বলছি—”

“কোথায় বলছিস। আমি চেঁচিয়ে যাচ্ছি, তুই চুপ করে আছিস। …এদিকে তো সময় হয়ে এলো, এবার আমি উঠব।”

“তুমি আজ ফিরবে?”

“সন্ধের ট্রেন ধরব।”

“এখনও দেরি আছে।”

“কোথায় আর দেরী । দেখতে দেখতে বেলা পড়ে আসছে দেখছিস না। …আমায় একবার তোদের সুপারিন্‌টেনডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে হবে তাঁর বাড়ি গিয়ে।” বিকেল বাস্তবিকই পড়ে আসছিল। গগন দেখছিল, যাবার আগে যেন দিনের আলো তার শুকোতে দেওয়া টুকরো জিনিসগুলো কুড়িয়ে নিচ্ছে। শিরীষ গাছের তলা থেকে আলো চলে গেছে, ছায়াগুলো কালচে হয়ে এসেছে, পাখিরা পালাচ্ছে একে একে, জল দেওয়া ঝারি নিয়ে বুড়ো মালি চলে যাচ্ছে ।

“এবারে তুমি আমায় সত্যি নিয়ে যাবে, ছোটমামা ?” গগন বলল ।

“হ্যাঁ রে বাবা, হ্যাঁ। তোকে আমি বলছি তো এই শীতের পরই নিয়ে যাব।”

“নয়ন গ্লাসগো যাবার আগে আমি বাড়ি যেতে পারলে খুব ভাল হয় ছোটমামা।”

“নয়ন মার্চের আগে যাচ্ছে না।”

“নয়ন আর বাবা নাকি আগামী মাসে আসছে এখানে ? মা লিখেছে ।” গগন জানলার বাইরে হাত বাড়িয়ে দিল।

“ইচ্ছে আছে ওদের। তবে এতটা আসা জামাইবাবুর পক্ষে কষ্টের। আসতে পারলে ভালই।” ছোটমামা হাই তুলল।

বিছানার ওপর লেবুটা পড়ে আছে। বিকেলের জলখাবার নিয়ে চাকর এল, মিটশেফের ভেতর থেকে কাচের ডিশ বার করে দুটো মিষ্টি রাখল, এক গ্লাস দুধ । রেখে চলে গেল। গগন দেখল। কিছু বলল না।

“তোর গলার দাগটা কিসের রে গগন ?” ছোটমামা আবার বলল।

গগন গলায় হাত দিল। দাগ ঢেকে নেবার মতন করে হাত রাখল গলায়। “কি জানি। কালশিরে বোধহয়।”

“আঙুলের দাগের মতন দেখাচ্ছে।”

চুপচাপ। গগন ধীরে ধীরে নিশ্বাস নিচ্ছিল। ছোটমামা যেন অবেলায় ঘুম পাওয়ায় বার বার হাই তুলছিল। সমস্ত ক্লান্তি এতক্ষণে ছোটমামাকে অবশ করে ফেলেছে। ছোটমামার চোখ ছোট হয়ে আসছিল, গগনকে যেন আর ভাল করে দেখতে পাচ্ছে না।

গগন বিকেলকে পুরোপুরি ফুরিয়ে যেতে দেখল । আলোর রেখা আশপাশে কোথাও নেই। নিমের ডাল তার দৃষ্টিকে আড়াল করে ফেলেছে, সেই আড়ালের ওপাশ থেকে একটি মেয়েলী গলা শুনতে পেল গগন। “আসব—তাড়াতাড়ি আসব আবার। “

পাশের ঘরে একবার ললিতবাবুর বউ এসেছিল। চলে যাবার সময় ললিতবাবুর কি মনে পড়ায় বউকে ডাকছিল। ডেকে কি বলছিল । ললিতবাবুর বউ নিম গাছের আড়ালে গিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছিল, “আসব—তাড়াতাড়ি আসব আবার।”

ললিতবাবু চলে গেছে। অপারেশন থিয়েটার থেকেই চলে গেছে। গগন এখনও মাঝে মাঝে ললিতবাবুর বউয়ের গলা শোনে। “আসব—তাড়াতাড়ি আসব আবার।”

গগন দেখল ছোটমামা উঠে দাঁড়িয়েছে। ছোটমামার যাবার সময় হয়ে গেছে।

“ছোটমামা, এই শীতের পর কিন্তু আর নয়”—গগন বলল।

“পাগল নাকি! আবার কি ! অনেক দিন হয়ে গেল। এবার বাড়ির ছেলে বাড়ি যাবি।”

“জানুয়ারিতে কিন্তু ।”

“বেশ, জানুয়ারিতেই।”

“মাকে বলল আমি ভাল আছি। বাবাকেও বলো।”

“নয়নকে তাহলে চিঠি দিস তুই।”

“দেবো। … জানো ছোটমামা, নয়নের বউ আমায় চেনে।”

“তোকে?”

“আমায় দেখেছে আর কি। পালিত লেনে যখন থাকতাম আমরা, তখন।”

“আ-চ্ছা।” ছোটমামা মাথা নাড়ল। নয়ন-বেটা বুঝি তখন থেকেই বড় পছন্দ করে রেখেছিল।” ছোটমামা হাসতে লাগল।

হাসি থামল একসময়। যেতে যেতে ছোটমামা ললিতবাবুর বউয়ের মতনই বলল, “আসব আবার—তাড়াতাড়ি আসব।” তারপর অন্ধকার। এই ঘর অন্ধকার হয়ে গেল।

অন্ধকারে গগন চোখের পাতা খুলল। বাইরে অন্ধকার নেমেছে। কাঁঠাল গাছের মাথার মতন বেশ ঘন বুনন্ত অন্ধকার। বাতাস আসছিল, অগ্রহায়ণের ঠাণ্ডা বাতাস। মিহি কুয়াশার মতন ধোঁয়ার রেখা দেখা যাচ্ছে অদূরে। গগনের শীত করছিল। কাছাকাছি একটা দেবালয় আছে, ঘন্টা বাজছিল। গগন আকাশে কয়েকটি তারা দেখতে দেখতে দেবালয়ের ঘন্টা শুনল। প্রতিটি ঘন্টা এমন করে বাজে যেন পায়ে পায়ে শব্দটা ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে। গগন ভাবল, তার মনে হল, সে বোধহয় প্রত্যহ দূর থেকে দূরান্তে সরে যাচ্ছে ।

চাকরটা এসেছে। হাতে লণ্ঠন। গগনের ঘরে পায়ের দিকে ছোট টেবিল-বাতি, কেরোসিন নাড়তে নাড়তে বাতিটা জ্বেলে দিল চাকরটা। বাতি জ্বলল, ছোট্ট ফোঁটার মতন হলুদ বাতি। চাকরটা চলে গেল। আসার সময় সে গলায় একটা ভজনের গুনগুন নিয়ে এসেছিল, যাবার সময় ঘরে সেই ভজনের সুর ফেলে গেল।

বিছানার ওপর উঠে বসল গগন। বাইরে নতুন সার দেওয়া বাগান। বাতাসে গন্ধ আসছে। শীত আসছে। অন্ধকারও এ-ঘরে গগনকে রোজকার মতন দেখতে এসেছে। দেখার সময় হয়ে গেলে, এরাই তাকে দেখতে আসে। অত্যন্ত নিকট আত্মীয়ের মতন—ওই শীত, বাতাস, ওই অন্ধকার এবং বিষণ্ণতা তার ঘরে বিছানার পাশে এসে বসে।

বাইরে থেকে আরও একজন এ-সময় তাকে দেখতে আসেন, ছোট ডাক্তারবাবু। তাঁর সাইকেলের ঘন্টি বাজলেই গগন তৈরি হয়ে থাকে। আজ এখনও তিনি আসেন নি। আসবেন।

গগন কপালে বুকে হাত দিল। তার জ্বর এসেছে। জ্বরটাও গগনকে বিকেলের ঝোঁকে রোজ দেখতে আসে। দেখতে এসে পাশে বসে থাকে। মাঝ রাতে গগনের ঘুমের মধ্যে চলে যায়।

চোখ জ্বালা করছিল গগনের। জিব বিস্বাদ লাগছিল। মাথা ধরেছে। জানলার বাইরে হাত বাড়াতে ইচ্ছে করল গগনের, ব্যথা ব্যথা লাগছিল সর্বাঙ্গ ,শীত করছিল বলে গগন আর হাত বাড়াল না।

বাইরে হাত বাড়ানো গেল না বলেই গগন ভেতরে হাত রাখল। কম্বলের তলায় জামার ওপর হাত রেখে বুকের তাপ ও কষ্ট অনুভব করতে লাগল। মাটিতে যেমন গাছ, মাটির তলায় যেমন শেকড়, গগনের মনে হল, তার বুকের তলায় সেই রকম কষ্টের বহু পদার্থ মিশ্রিত হয়ে আছে, এই বোধ একটা বৃক্ষের মতন অজস্র অদৃশ্য শিকড় দিয়ে সেই কষ্টকে শুষে বর্ধিত হচ্ছে। কেন ? গগন বুঝতে পারল না, কেন হৃদয়ে এত কষ্ট থাকে, এত অভাব ? বেদনা কেন অধিক, সুখ কম ? পৃথিবীতে জলভাগ বেশির মতন পযাপ্ত দুঃখ এবং অপর্যাপ্ত সুখ ঈশ্বর কেন সৃষ্টি করেছিলেন!

গগন তার এই চিন্তাকে বেশ শিথিল এবং জ্বরে আচ্ছন্ন বলে মনে করা সত্ত্বেও ভাবতে লাগল, তার দুঃখকে সে কেমন করে সহনীয় করতে পারে। তার মনে হল, প্রত্যহ গগন এই চিন্তা করেছে। প্রত্যহ। সে বড় শূন্য, তার গগনে সূর্য অথবা চন্দ্র অথবা নক্ষত্রদল নেই।

ছোট ডাক্তারবাবুর সাইকেলের ঘন্টি বাজল। গগন বুঝতে পারল, এবার ছোট ডাক্তারবাবু ঘরে ঘরে একবার ঘুরে যাবেন। বড় ভাল লোক, বড় সুন্দর মানুষ, কখনও নিরাশ করেন না। বলেন, বাঃ—চমৎকার, আজ তো বেশ ভালই দেখছি। খুব তাড়াতাড়ি ইম্প্রুভ করছ তুমি।

গগন বিছানায় শুয়ে পড়ল। কম্বলটা গলা পর্যন্ত টেনে নিল। সাইকেলের ঘন্টি শুনতে পেল আবার। শুনে গগন নয়নের বউয়ের কথা মনে করতে পারল । নয়নের বউ গগনকে পালিত লেনে সাইকেল চড়া শিখতে গিয়ে পড়ে যেতে দেখেছে। লজ্জা পেয়ে গগন যেন নয়নের বউকে দেখাচ্ছে এমনভাবে কল্পনায় সাইকেলের পিঠে লাফ মেরে চেপে বসল। তারপর প্যাডেল ঘুরোতে লাগল।

না। গগন পারল না। গগন বালিশের মাথার পাশে হাত বাড়াতে গিয়ে তার রুমাল স্পর্শ করতে পারল। রুমালের পাশে কবেকার একটা পুরোনো মাসিক পত্রিকা। গগন পত্রিকাটা কতবার জানলার বাইরে ফেলে দিতে চেয়েছে, পারে নি। ওর মধ্যে নয়নরা আছে, নয়ন, নয়নের বউ, বাবা, মা, লতু, ছোটমামা। শুধু গগন নেই।

গগন এ-ঘরে আছে। এখানেই থাকবে গগন। শীত আসবে, শীত যাবে ; আবার শীত আসবে। গগন জানে তার ছোটমামা নেই, তার ছোটমামা তাকে শীতের পর নিয়ে যেতে আসবে না।

গগন চোখ বুজতে বুজতে নয়নদের কথা ভাবল। নয়নরা থাকলে, গগন পরম দুঃখীর মতন ভাবল, তার গগন এত শূন্য হত না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *