যযাতি

যযাতি

বায়না করতে নয়, আগেভাগে একটা আঁচ নিতে এসেছিল ওরা। খুব একটা ভরসা নিয়ে আসে নি। পাঁচজনের মুখে যা শোনা গিয়েছিল, তাতে ভরসা পাবার কথা নয়। এই বয়সে বউ মরলে এমনিই হয় ; সব ব্যাপারেই ছাড়ো-ছাড়ো আড়াল-আড়াল ভাব। মন বসে না আর—সে সংসারেই হোক কি কাজকর্মে। নেশা, শখটখ, আমোদ-আহ্লাদ তো পরের কথা।

ফটিক আঘোরী দু-দশটা কথার পর খুব সাবধানে, সসংকোচে আসল কথাটা তুললে। “বাসনা তো খুবই ছিল গো ঠাকুরমশাই—ই বারে মায়ের থানে আসরটা দি।” ফটিক এমন একটা হতাশার সুর টানল যেন অত সাধ-বাসনার সবটাই বিফলে গেল।

ফটিক আঘোরী আর তার দলবলের দিকে তাকিয়ে নীলকণ্ঠ ভট্টাচার্য বললে, “বাঁধছে কিসে তুমাদের?”

বাধছে আসল জায়গায়। মূর্তি না থাকলে যেমন পুজোয় বাধে, পিঁড়িতে বর না বসলে যেমন বিয়েতে—তেমনি। আসরটা তো ফটিক অঘোরীরা বসাবে, কিন্তু সে মরা-আসর জমাবে কে ছাই, যদি না নীলকণ্ঠ ভট্টাচার্য একটা যাত্রার পালা গায়। ফটিক আঘোরী বেশ গুছিয়ে কথাটা পুরোপুরি বলে ফেললে।

নীলকণ্ঠ মনে মনে অবাক হচ্ছিল। এই কথা, এর জন্যে আঘোরীর অত ইজল-বিজল কেন?

নীলকণ্ঠর গোল, ভরাট, তামাটে মুখের গোড়ায় বেশ একটু কৌতুক আর হাসির ছোঁয়া লাগল। ঈষৎ লালচে চোখ আর ধূসর মণি দুটো ফটিক আঘোরীর রোগাসোগা মুখের উপর রেখে নীলকণ্ঠ বললে, “আমি পালা গাইব না, এটা তুমি ঠাওরালে কী করে হে আঘোরী?”

“আমি কিছু ঠাওরাই নাই ঠাকুরমশায়।” ফটিক মাথা নেড়ে দু-হাত প্রায় করজোড়ের ভঙ্গিতে বুকের উপর তুলে ধরে তাড়াতাড়ি জবাব দিল, “ই ছোঁড়াদের বিশ্বাস আসছিল না।” সঙ্গীদের দেখিয়ে দিল ইশারায়, “দোষ নাই উদেরও, যা শোকতাপ গেল আপনার, পালাটালা ফিরে আবার গাইবেন বিশ্বাস লাগে না। হ্যাঁ, তবে কি-না—”

নীলকণ্ঠ বাধা দিল ফটিকের কথায়। বললে, “যতদিন গলা আছে, বুঝলে আঘোরী, পালা আমি গাইব ; আর হাতে খাগের কলমটা যতদিন আছে, পালাও আমি লিখব জেনে রাখ তুমি।”

ফটিক তাড়াতাড়ি আসল কথাটা শুধল, “নতুন পালা কিছু লিখলেন নাকি ঠাকুরমশায়?”

নীলকণ্ঠ মাথা নাড়ল। না লেখে নি।

ফটিক সুযোগটা হারাতে চায় না। মুখের হাসিটা আরও বিনীত করে বলল, “যদি অন্তরের কথাটা শোনেন ঠাকুরমশায়, তবে বলি, আমাদের ইচ্ছাই ছিল এবার মার থানে একটা নতুন পালা জমাই, তাই তো এলাম আপনার কাছে।” অল্প একটু থামল ফটিক, নীলকণ্ঠর মনোভাবটা বোঝবার চেষ্টা করল ; তারপর বলল, “তা বাসনাটা আমাদের পূর্ণ করেই দেন না হয়!”

নীলকণ্ঠ আধশোওয়া ভঙ্গিতে বসে ছিল। ফটিক আঘোরীর দেওয়া সিগারেটে টান দিতে দিতে চোখ দুটি একটুক্ষণের জন্যে বুজল। চোখ বুজে বলল, “হবে গো আঘোরী, তোমাদের আসরের জন্যে নতুন পালা একটা লিখব। কাজকর্ম তো আজকাল ছেড়েই দিচ্ছি। বেটার ঘাড়ে চাপাইছি সব। সময় আছে হাতে। হবেখন।”

“তাহলে আমি নিশ্চিন্ত হই?” ফটিক কথার জন্যে নীলকণ্ঠের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল।

মাথা নাড়ল নীলকণ্ঠ। হ্যাঁ, ফটিক নিশ্চিন্ত হতে পারে।

সঙ্গের দলবলের দিকে কৃতিত্বের একটা কটাক্ষ ছুঁড়ে দিয়ে ফটিক উঠে দাঁড়াল, “বায়নাটা তবে চটপট করেই যাব ঠাকুরমশায়?”

নীলকণ্ঠ ঘাড় নাড়ল। করে যেও বায়না; যবে খুশি, যখন খুশি।

ফটিক চলে যাওয়ার পর নীলকণ্ঠ খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল, তেমনি আধশোয়ার ভঙ্গিতেই। পশ্চিমের জানলাটা ভোলা। ঢেঁড়স আর কলাগাছের ঝোপটা বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। যদিও ডোবাটা দেখতে পাচ্ছিল না নীলকণ্ঠ, তবু ডোবার ওপারে ধুঁধুল গাছের একটু যেন চোখে পড়ছিল। বিকেলে বৃষ্টি হয়েছিল। ভিজে লতাপাতার একটা গন্ধ ঢুকছিল ঘরে। আর ময়না, চড়ুই কাকের কিচিরমিচির।

নতুন একটা পালা লিখতে হবে। এবার কী পালা লেখা যায়, নীলকণ্ঠ শূন্যচোখে তাকিয়ে সেটা যেন ভাবছিল। এর আগে অন্তত আট-দশটা পালা লিখেছে। রাম-লক্ষ্মণের পালা থেকে শুরু করে সিংহল বিজয়ের পালা পর্যন্ত। দু-চারটে বেশ ভালই উতরে গেছে। সেইসব পালা শুধু ধুনুরি গ্রামে নীলকণ্ঠর কালী অপেরাই নয়, আশপাশের অনেক গাঁয়ে অন্য দলও গেয়েছে। যেগুলো উৎরায়নি, নীলকণ্ঠ নিজেও আর সেগুলোর নামোচ্চারণ করে না। করতে লজ্জা পায় যত না, তার চেয়ে বেশি বিরক্ত হয়। কেমন একটা আক্রোশে গরগর করে। নিজের উপরেই। নিজের অক্ষমতা এবং ব্যর্থতার উপরেই যেন এই বিরক্তি, ঘৃণা।

নীলকণ্ঠ ভাবছিল, নতুন পালা কী নিয়ে লেখা যায়। একবার আচমকাই মনে হল, দক্ষযজ্ঞের ঘটনা নিয়ে লেখা যেতে পারে। সতীর দেহত্যাগ। বিষয়টা ভাল। নীলকণ্ঠ নিজেই মহাদেবের পার্টটা করতে পারবে। আর এই সময়—সদ্য সদ্য নারায়ণীর মৃত্যুর পর—নীলকণ্ঠ বোধহয় দু-চারটে জায়গায় বেশ লিখতে পারবে, চুটিয়ে পার্ট করতেও হটবে না। সতীর দেহত্যাগের পর মহাদেবের অবস্থাটা মনে মনে কিছুক্ষণ কল্পনা করে নিল নীলকণ্ঠ। একটা দৃশ্যই যেন ছকে ফেলল। সতীর মৃত্যু-সংবাদ শুনে মহাদেবের বিচলিত অবস্থা ; শোকের স্বগতোক্তি আর রোষ। দুটি ছত্র মুখেই এসে গিয়েছিল।

নীলকণ্ঠের মনের সুতো হঠাৎ ছিঁড়ে গেল। অন্দরমহল থেকে সন্ধে দেবার শাঁখ বেজে উঠেছে। বেজে বেজে থামল। নীলকণ্ঠ খোলা দরজা দিয়ে তাকিয়ে থাকল। দাওয়ার অন্ধকারে এখুনি একটু আলোর ছিটে পড়বে।

কুসুম তবে এসে গেছে। না হলে শাঁখ বাজাবে কে? ললিত বাইরে। গাঁয়ে দু-ঘর আর ক্যাশিয়ারবাবুর বাসা, তিন ঘরে সত্যনারায়ণ পুজো সারতে হবে তাকে। বিকেল থাকতেই বেরিয়ে গেছে বৃষ্টিতেই। মাধু শ্বশুরবাড়ি। সেই যে তার মা-র শ্রাদ্ধর পর গেছে, দেড় মাসের মধ্যে আর এ-বাড়ি আসে নি। বলাইটা বাচ্চা, বছর আষ্টেক বয়েস ; এখনো হয়ত চট্টরাজের বাসায় খেলছে। তাছাড়া সে তো আর শাঁখ বাজাতে পারে না। কুসুমই এসেছে তাহলে। মাসখানেক ধরে ঘরে সন্ধে দেওয়ার কাজটা সেই সেরে দিচ্ছে।

নীলকণ্ঠ দাওয়ার অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ছিল। আলোর ছিটের আশায়। একটু আলো পড়ল। দাওয়া দিয়ে কুসুম হাত আড়াল দিয়ে প্রদীপ ধরে সদরে গেল, সদর থেকে রান্নাঘরে, এদিক-ওদিক। আবার অন্ধকার। অল্পক্ষণ পরে টিমটিমে একটা কুপি এনে কোথায় বুঝি ঝুলিয়ে দিল। দাওয়ার একটা এবড়ো-খেবড়ো জায়গা এক খাবলা ম্লান আলোয় টিমটিম করতে লাগল। নীলকণ্ঠর মনে হচ্ছিল, পিঠের কুঁজের মতো দাওয়ার ওখানটায় যেন কুঁজ গজিয়েছে।

গলার কাশির শব্দ তুলে সাড়া দিল নীলকণ্ঠ। সাড়া না দিয়ে পারছিল না। ছোট লণ্ঠনটা জ্বালিয়ে নিয়ে কুসুম এল। চৌকাঠের ওপাশ থেকে হাত বাড়িয়ে লণ্ঠনটা ঘরের মধ্যে দিয়ে চলে যাচ্ছিল।

নীলকণ্ঠ শুধল, “বলাইটা ফিরেছে নাকি?”

মৃদু গলায় জবাব দিল কুসুম, “হ্যাঁ ফিরেছে।” সরে যাবার মতন একটু নড়ে চড়ে উঠলেও কুসুম সরে গেল না। নীলকণ্ঠ আর কী বলে, যেন তা শোনার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকল।

নীলকণ্ঠ বললে, “পাক ঘরে আগুন-টাগুন আছে নাকি? টুকুন চা খেতাম।”

কুসুম মাথা-ঘাড় আস্তে একটু নোয়াল। আগুন থাক না থাক, চা সে তৈরি করে দিচ্ছে।

কুসুম চলে গেল। নীলকণ্ঠ জ্বলন্ত লণ্ঠনটার দিকে চেয়ে থাকল ক’পলক। কুসুমের চেহারাটা চোখের সামনে ভাসছিল। বেশ ডাগর-ডোগর মেয়েটা। সুশ্রী। খুঁত আছে একটু, অন্ধকারে ধরা পড়ে না। চিবুকের নিচ থেকে গলা বেয়ে কন্ঠার কাছাকাছি পর্যন্ত মস্তবড় একটা দাগ। ডান দিকে। গলার মধ্যে ঘা হয়ে নাকি বিষিয়ে গিয়েছিল, কাটাকুটি সেলাই-ফোঁড়াই করতে হয়েছিল। তারই দাগ। কুসুম গায়ের কাপড়টা সব সময়ে গলার উপর দিয়ে টেনে দাগটা চাপা দিয়ে রাখবার চেষ্টা করে। পারে না। এই খুঁতের জন্যে বিয়েও হচ্ছে না মেয়েটার।

নীলকণ্ঠ বেশ ঠাওর করে দাগটা দেখাবার চেষ্টা করেছিল আজ, একটু আগেই ; দেখতে পায় নি। অতটা দূরে আর অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকলে কিছুই ভাল করে দেখা যায় না।

নীলকণ্ঠ খানিকটা চুপচাপ বসে থেকে একটা বিড়ি ধরাল। বলাইটা ফিরেছে খানিক আগেই, তার গলার স্বর শোনা যাচ্ছে। কুসুমের কাছে দাপাদাপি করছে। ছোঁড়াটা। পালা লেখার কথাটা আবার মনে এল। কী যে লেখা যায়। দক্ষযজ্ঞের পালাটাই কি লিখবে নাকি?

চা নিয়ে এল কুসুম। নীলকণ্ঠ আঠার বছরের এই সু-গড়ন মেয়েটাকে আরও একবার ভাল করে দেখবার চেষ্টা করলে।

“বুঝলে কুসুম, কড়িগাঁ থেকে ফটিক আঘোরীরা এসেছিল।” কুসুম চলে যেতে যেতে দাঁড়াল নীলকণ্ঠর কথায়। ফিরে তাকাল। নীলকণ্ঠ হাসি হাসি মুখে বললে, “পালা গাইতে চায়। বলে একটা নতুন পালা লেখেন ঠাকুরমশায়।” নীলকণ্ঠ কথাটা যেন শুনিয়ে শুনিয়ে বলছিল। ঈষৎ গর্বভরে।

কুসুম চৌকাঠের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে এই দিকেই তাকিয়ে ছিল, নিচু মুখে চুপচাপ। গালের আর গলার একটা পাশে খানিকটা অন্ধকার ভরাট হয়ে ছিল।

নীলকণ্ঠ আর কোনো কথা বলছে না দেখে কুসুম আস্তে আস্তে চলে গেল।

চা খেতে খেতে নীলকণ্ঠ কুসুমের সরে যাওয়া লক্ষ করলে। পালা লেখার কথাটাও ভাবতে লাগল। দক্ষযজ্ঞের বিষয়টা একবার মনে হয়েছিল মাত্র, কিন্তু বিষয়টার তেমন কোনো আকর্ষণ পাচ্ছিল না। বড় পুরনো, আর সেই এক সতী, সতী। কোনো রস নেই। বউ মরল তো খ্যাপামি। না, নীলকণ্ঠর এ-সব ভাল লাগে না। মরণ—মরণ ; তার জন্যে এত হই হই করার কী আছে! ধুলোয় গড়াগড়ি দেবার লুটোপুটি খাবার কী মানে!

না, নীলকণ্ঠর এ-সব পছন্দ নয়। এ-পৃথিবীতে যে-কদিন আছ, আনন্দ করে থাক। যার যেমন সামর্থ্য, তেমনি। সুখ পাওয়াটাই বড় কথা, শোকতাপ পাওয়াটা নয়। তা যদি পেতে চাও, তবে ভিখিরি হও, ভদ্রলোক হওয়া কেন? কেন এই জমিদারী আগলানো, সংসার পাতা, বাড়ি-বাড়ি চাল-কলা গামছাটার জন্যে হাঁটাহাঁটি!

নীলকণ্ঠ বোধহয় ব্যাপারটা ভাল করে বুঝেসুঝে সব ছেড়ে দিয়েছে। বৃত্তিটা পর্যন্ত। এই গাঁয়ের একমাত্র যাজক বলতে গেলে, পুজো-পার্বণ তো লেগেই ছিল। আজ শনি, কাল সত্যনারায়ণ, পরশু দুর্গা, তরশু কালী, বার মাসে তেরো কেন, তেইশ পার্বণ। উপবাসের পর উপবাস কর, দিন নেই রাত্রি নেই, বর্ষা-বাদল নেই। আজ এর উপনয়ন তো কাল ওর শ্রাদ্ধ, শুভ দিনের নির্ঘণ্ট খুঁজতে খুঁজতে চোখে ছানি পড়ার জোগাড়, পুজোর মন্ত্র পড়তে পড়তে ফুসফুসটা ফুটো হয়ে যাবার অবস্থা। ভাল লাগে নি আর। ভাল লাগত না মোটেই নীলকণ্ঠর। ছেলেটাকে সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে ঘুরত। এখন তার হাতেই আস্তে আস্তে সব ছেড়ে দিয়েছে। তা বছর বাইশ বয়েস হতে চলল ললিতের। বেশ কাজের ছেলে। ধর্মেকর্মে মতি আছে, হিসেবপত্তরেও। যজমানদের বাড়ি যায় যেমন তেমনি জমি-জায়গা ফলন-টলনের সবটাই দেখাশোনা করে। নীলকণ্ঠ এ-সব ব্যাপার থেকে হাত ধুয়ে ফেলেছে। এই পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সেই।

বয়সটা যে যথেষ্ট, নীলকণ্ঠ নিজের দিকে তাকিয়ে তা কোনোদিনই মেনে নেয় না। বেঁচে থাকতে নারায়ণী যদি কখনো বয়সের কথা তুলে খোঁটা দিয়েছে, নীলকণ্ঠ ভীষণ চটে উঠত। বলত, “বয়স আবার কী? যতদিন শরীরে ক্ষুধা আছে, কাম আছে, ভোগের ক্ষমতা আছে, ততদিন মানুষ জোয়ান। যখন থাকবে না, তখন সে জরাগ্রস্ত, অক্ষম, অচল। আমার আবার বয়স কী! নেহাত বামুনের ছেলে, গাঁয়ে গ্রামে মানুষ, তাই ফচকে বয়সে বিয়ে হয়েছিল। বাইশ বছর বয়সে তো বেটার বাপ। শহর-টহরে আজকাল তিরিশ পঁয়ত্রিশের আগে বিয়ের কথাই কেউ ভাবে না। তবু তো ওই খড়কে-কাঠি স্বাস্থ্য! আর আমার—?”

নীলকণ্ঠ স্ত্রীকে তার স্বাস্থ্যটা দেখাত। তা স্বাস্থ্যটা ওর বেশ ভালই। না বেঁটে, না লম্বা। মাঝারি। জলফুলো চেহারা নয় ; গড়ন-পেটন মজবুত। মুখটা গোল, ছোট কপাল, লম্বা নাক, পাটি-সাজান দাঁত। শরীরের কোথাও এখনো টোল পড়ে নি।

শরীরকে নীলকণ্ঠ ভালবাসত, শরীরকে সে রাখবার চেষ্টা করত। কলা-আতপচালের ভক্ত ছিল না নীলকণ্ঠ ; মাংস মদটাও খেত, দিশী মদ । ধর্ম-পুজোর মাঠটার এক কোণে যে ইটবারকরা ভাঙা নাটমন্দিরটা রয়েছে, সেখানে কালী অপেরার মহড়া হতো বছরে তিন কি চার মাস, কিন্তু বারমাসই নীলকণ্ঠ ভট্টাচার্জি, মদন চট্টরাজ, কেষ্ট চক্রবর্তী আর দু-একজন মিলে আসরটা জমাত। ইটের ঠেকা দেওয়া তক্তপোশের উপর ধুলো-ভর্তি সতরঞ্চি বিছিয়ে দাবার সঙ্গে দিশী-টিশী চলত ।

নীলকণ্ঠ পঁয়তাল্লিশে পৌঁছেও পরিশ্রান্ত হয় নি কেন, এর জবাব সে দিতে পারত । বলত, “আমি তো গঙ্গাজল ঠোঁটে ঠেকানো বামুন নই, সোমরস পান করা বামুন। বুঝলে হেঁ চট্টরাজ, এখনো বসলে একসের চালের ভাত খেতে পারি—একটা ছোটখাটো পাঁঠা। আর যদি বলি বিয়ে-থা, কিরে কেটে বলছি রে চট্টরাজ, দুটো বউ তো হেসেখেলে সামলাতে পারি।”

নীলকণ্ঠ পারলেও নারায়ণী পারে নি। পনের বছর বয়স থেকে ছেলে বিয়োতে শুরু করেছিল। প্রথমটা বেঁচে গিয়েছিল কী ভাগ্যে। তারপর তো বছরে বছরে বিয়োয় আর সেগুলো মেরে। এরই মধ্যে মাধুটা রক্ষে পেল, এবং শেষ বলতে বলাইটা। বলাইয়ের পর নারায়ণীর আরও তিনটে মরেছে। নিজেও সে মরল বাচ্চা বিয়োতে গিয়েই। সেপ্টিক, তারপর ধনুষ্টঙ্কার।

নীলকণ্ঠ চা-টুকু অনেকক্ষণ আগেই শেষ করে কখন যেন বিড়ি ধরিয়ে কথাগুলো ভাবতে ভাবতে তন্ময় হয়ে পড়েছিল। বলাইয়ের বিশ্রী একটা চিৎকারে চমকে উঠে নিজেকে ফিরে পেল। আ—ছাই, বাইরে যে বেশ সন্ধে হয়ে গেছে। এখন মুখ হাত ধুয়ে জামাটা চড়িয়ে ধর্মপুজোর মাঠে গিয়ে পৌঁছতে তো রাতই হয়ে যাবে।

নীলকণ্ঠ তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল। যেতে তাকে হবেই। চট্টরাজদের কাছে আজ ফটিক আঘোরীদের কথাটা বলতে হবে। নতুন পালা লেখার কথা।

নীলকণ্ঠ এলোমেলো ভাবছিল, কী পালা লেখা যায়, কোন্ পালা। ভাবতে ভাবতে বাইরে বেরিয়ে এল। গামছাটা তুলে নিল দড়ি থেকে। দাওয়ায় নেমে যাচ্ছিল হাতমুখ ধুতে। হঠাৎ রান্নাঘরের কাছাকাছি আসতেই থমকে দাঁড়াল। উনুনটা কাঠ দিয়ে দিয়ে গনগনে করে জ্বালিয়ে নিয়েছে কুসুম। সেই আঁচের মুখোমুখি পিঁড়ি পেতে বসে রয়েছে। গায়ের কাপড়টা একটু আলগা। ওই তাপ যেন সহ্য করতে না পেরে শাড়ি-জামা ঢিলেঢালা করেছে।

গামছাটা বুকের কাছে অন্যমনস্কভাবে চেপে ধরে নীলকণ্ঠ তাকিয়ে থাকল।

এমনি হয় মাঝে মাঝে। সব থাকে, তবু হয় না। নীলকণ্ঠর তেমনিই হচ্ছিল। পালা লেখার জন্যে গল্পের কি অভাব আছে ! কাশীরাম আর কৃত্তিবাসের বড় ভক্ত নীলকণ্ঠ। উপাখ্যান তার মুখস্থ। ঋতুপর্ণ, নল-দময়ন্তী, সাবিত্রী-সত্যবান, যে-কোনো একটা আখ্যান নিলেই হয়। শুধু কাঠামোটা। প্রাণটা তো নীলকণ্ঠের হাতে। লাল খেরো-বাঁধানো খাতায় শরের অথবা পালকের কলমের টানে টানে নীলকণ্ঠ তার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করবে। সে ক্ষমতা তার আছে।

কিন্তু আশ্চর্য, কোনোটাই নীলকণ্ঠর মনোমত হয় না। কোনো উপাখ্যানই নয়। আজ হয়ত মনে মনে একটা পছন্দ করে, কাল ভাবতে বসে সেটা বাতিল করে দেয়। বিদুরকে নিয়ে একটা পালা প্রায় ছকে ফেলেছিল নীলকন্ঠ, কিন্তু কি মনে করে আর লিখল না। না, অত ধর্মটর্ম-করা মানুষ নিয়ে তার চলবে না। মানুষটার কোনো তেজ নেই, বীর্য নেই, ক্রোধ নেই। যেন গাছ কিংবা পাথর। নীলকণ্ঠর আবার এ-সব পছন্দ হয় না। কটা পালা লিখেছে আগে, এদের মতন মানুষ নিয়ে কিন্তু দেখাই গেছে, ভাল জমাতে পারে নি। তেমন কোনো প্রাণের টানই পায় না নীলকণ্ঠ এইসব সরল সাদামাটা মানুষের কথা লিখতে বসে।

নীলকণ্ঠ পছন্দর ধরনটা অন্যরকম। “মন্দ যদি না থাকল তবে মানুষ কী হে” চট্টরাজ, রায়—এদের বোঝাত নীলকণ্ঠ, “আমরা স্বর্গে থাকি না হে, মর্তে থাকি। এখানে মায়ে-মেয়েতে সতীন-মতন হয়, বাপে ছেলেতে লাঠালাঠি করে, ভাইয়ে-ভাইয়ে মামলা লড়ে—বুঝলে ! উ সব যুধিষ্ঠির-টুধিষ্ঠির নয়, উরা কি মানুষ নাকি ! হ্যাঁ লেখ দিকি একটা পালা দুর্যোধনকে লিয়ে, কি দুঃশাসনকে—জমে যাবে। কেনে, আমি যে কৈকেয়ী পালাটা লিখেছিলাম গো, দেখলে তো কতবার গাইলাম পালাটা।”

মুশকিল এই যে, নীলকণ্ঠর পছন্দমতো চরিত্র কি আখ্যান যা ছিল আগেই ফুরিয়েছে। এখন আর নতুন করে কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। অথচ ফটিক আঘোরীরা সময় মতন বায়না করে গেছে। নীলকণ্ঠ টাকাটা নিয়েছে কাগজে সইও দিয়েছে। ফটিক আঘোরীকে এ-কথাটা বলতে পারে নি নীলকণ্ঠ যে, তার মাথায় আর নতুন পালা আসছে না। বলা মানে তো নিজের অক্ষমতা স্বীকার করে নেওয়া। আঘোরীকে বুঝিয়ে দেওয়া যে, নীলকণ্ঠর ক্ষমতা সত্যিই গেছে।

নীলকণ্ঠ তা পারে না। ভাবতেও তার আপত্তি। এটা নিছকই ভাগ্য যে, বামুনের ঘরে জন্ম নিয়েছিল নীলকণ্ঠ, তার সাত পুরুষের বৃত্তিটাই ছিল যাজকের, গামছায় শালগ্রাম বেঁধে ঘরে ঘরে ঘণ্টা নাড়াতে আর চাল কলার সিধে আনতে যাওয়া। নয়ত আসলে ও অন্য মানুষ। স্বভাবে খানিকটা নাস্তিক, খানিকটা অবিশ্বাসী, আত্মপ্রত্যয়ী, সুখ আর ভোগের প্রত্যাশী। আর মনে মনে মানুষটা শিল্পী। শিল্পী ছাড়া কী-ই বা হতে পারে। কৈশোর থেকে যাত্রাগানে তার মন মজে গিয়েছিল। তখন থেকেই গাঁয়ের যাত্রায় পার্টটার্ট করত। তারপর দিনে দিনে এটা তার নেশা হয়ে দাঁড়াল। সাংঘাতিক নেশা। নিজের একটা দলই গড়ে ফেলল নীলকণ্ঠ—‘কালী অপেরা’। এ কালী মা-কালী নয়, কালীপদ ঘাঁটি। টাকা দিয়েছিল প্রথমটায় যাত্রার দল গড়তে, তাই তার নামে নাম।

নীলকণ্ঠ দল গড়েছে, দল বজায় রেখেছে ; কাছাকাছি শুধু নয়, দূর দূর গ্রামে পাল্লা দিয়ে সুনাম লুঠে নিয়ে এসেছে। পালাও লিখেছে নতুন নতুন। একটা পালা তো চিৎপুরের তরুণ অপেরা কিনে নিল। সেটার ছাপা বই পাওয়া যায় কলকাতায়। পাঁজিতে তার বিজ্ঞাপন ছাপা হয়।

এ-হেন নীলকণ্ঠ আজ আর নতুন পালা লেখার বিষয় খুঁজে পাচ্ছে না। মনে মনে যাও বা একটা বাছে, কিছুক্ষণ পরেই সেটা মনে হয় পুরনো, অচল। খুঁতখুঁত করে মন। নীলকণ্ঠ বাতিল করে দেয়।

ফটিক আঘোরীর কাছ থেকে বায়না নেবার পর বিশটা দিন কেটে গেল, নীলকণ্ঠ কিছু ঠিক করতে পারল না, একটা লাইনও লিখতে পারল না।

ছটফট করছিল নীলকণ্ঠ। মনে মনে ভীষণ একটা অস্বস্তি আর অক্ষমতার রোষে পুড়ছিল। সময় তো আর বেশি নেই। পালা লিখতে হবে, মহড়া বসাতে হবে, দরকার হলে নাচের মাস্টারকে দিয়ে ছোঁড়াগুলোকে আরও নতুন নতুন নাচ শেখাতে হবে। নীলকণ্ঠ তার ঘরে সারাদিন বসে বসে কাশীরাম দাসের মহাভারতটার পাতা উল্টে যায়। মাঝে মাঝে কোনো একটা পাতায় চোখ রেখে অনেকক্ষণ বসে থাকে। তারপর বইটা বন্ধ করে দেয়। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে, জানলা দিয়ে ঢেঁড়স আর কলাগাছের ঝোপটার দিকে চেয়ে থাকে।

চট্টরাজ সেদিন শুধল, “কী হে, ভট্‌চায্যি লিখলে নাকি কিছু ?”

“না।” আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল নীলকণ্ঠ।

নীলকণ্ঠর মুখের দিকে খানিকক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে থেকে চট্টরাজ বললে, “হল কী তুমার, অ্যাঁ—!” একটু থেমে আবার বললে, “পরিবারটা মরে তুমার মাথাটাই গণ্ডগোল হয়ে গেল যে হে! এটা ছাড়লে, সেটা ছাড়লে—পালা লেখাটাও ছাড়লে তুমি!”

নীলকণ্ঠ কোনো জবাব দিল না। অনেকক্ষণ বন্ধুর দিকে হলছল চোখে তাকিয়ে থেকে শেষে অবশিষ্ট তাড়িটুকু এক চুমুকে গলায় ঢেলে নিল।

পরের দিন নীলকণ্ঠ ভীষণ একটা গোঁ নিয়ে সকাল থেকেই নূতন একটা খাতা খুলে বসেছিল। সস্তা একটা কাঠের ডেস্ক। শরের আর পালকের কলম। এক দোয়াত কালি, কাশীরাম দাসের মহাভারত আর কৃত্তিবাসের রামায়ণটা পাশে। এক বান্ডিল বিড়ি। দেশলাই।

সকালটা কেটে গেল। একটা অক্ষরও লিখতে পারল না নীলকণ্ঠ। দুপুরে স্নান-খাওয়া করে আবার বসল। নতুন এক বান্ডিল বিড়ি আর এক কৌটো পান নিয়ে। পানের সঙ্গে বিড়ির ধোঁয়া এমন একটা আচ্ছন্ন তন্দ্রা আনল যে, নীলকণ্ঠ ঘুমিয়ে পড়ল।

ঘুম ভাঙল যখন, তখন বিকেল শেষ হতে চলেছে। ডোবার ওপারের ধুঁধুল-ঝোপে ফুরনো বিকেলের ম্লান একটু আলো। একটা ঘুঘু ডেকে চলেছে। ধড়মড় করে উঠে বসে নীলকণ্ঠ ডেস্কের দিকে তাকাল। খেয়োয় বাঁধানো খাতাটাও তেমনি পড়ে আছে। রামায়ণ মহাভারতটাও পাশাপাশি সাজানো।

মুখেচোখে জল দেবার জন্য খড়মটা পায়ে লাগিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল নীলকণ্ঠ। পূবদিকের দাওয়ায় দড়ির খাটিয়াটায় ললিত বসে আছে। খুব অন্যমনস্ক। খেয়াল নেই কিছু। নয়ত নীলকণ্ঠর খড়মের শব্দে চোখ ফিরিয়ে তাকাত অন্তত একবার। কলাইটা এক বাটি মুড়ি নিয়ে সদরের কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আপন মনে ছড়া কাটছে।

নীলকণ্ঠর খড়মের শব্দ তুলে মুখ-হাত ধোবার জায়গাটার কাছে গিয়ে উবু হয়ে বসল। মুখ-চোখে জল দিতে গিয়ে যেন চোখে পড়ল হঠাৎ। তাকাল নীলকণ্ঠ। গোয়ালঘরের পাশটায় দোপাটি আর মোরগফুলের ঝোপটার কাছে কুসুম। এই অসময়ে কেন ? মুখটাও দেখা যাচ্ছিল না কুসুমের। পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে শশাগাছের মাচাটা যেন ঠিক করছে। অথচ ও-মাচা ঠিক করার কিছুই নেই।

নীলকণ্ঠ উঠে পড়ল। ঘরের দিকে এগুতে গিয়ে একবার একটু দাঁড়িয়ে ললিতের দিকে তাকাল। না, এখন আর বেঘোরে নেই ছেলেটা। বাপের দিকেই তাকিয়ে আছে।

কী ভেবে নীলকণ্ঠ ছেলেকে কাছে ডাকল। সামনে এসে দাঁড়াল ললিত। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছেলের মুখটা দেখল নীলকণ্ঠ। কেমন যেন বোকা-বোকা নিরীহ ভালমানুষ গোছের মুখ। গোলগাল । নীলকণ্ঠর হাসি পায়। পুরুত-বংশের উপযুক্ত উত্তরাধিকারীর মুখই বটে। অর্থহীন, দুর্বোধ্য কতকগুলো মন্ত্র আউড়ে যেতে ওর কোথাও বাধবে না। ছেলের সঙ্গে বন্ধুর মতন একটু যেন রসিকতা করে বসল নীলকণ্ঠ, “কী হে বাপ, আজ ঘণ্টা নাড়াতে যাবে নাই কুথাও ?”

মাথা নাড়ল ললিত। হ্যাঁ, যাবে। লক্ষ্মীপুজো আছে সিংহীদের বাড়িতে।

ঠিক, ঠিক। আজ লক্ষ্মীবার। নীলকণ্ঠ ভুলেই গিয়েছিল।

“আর উটার কী হল ? আলটার? হারু গোমস্তার কাছে গিয়েছিলে নাকি?”

ললিত এবার মাথা নাড়ল। গিয়েছিল গোমস্তার কাছে। মিটমাট হয়ে গেছে সব।

“বেশ, বেশ।” ছেলেকে বাহবা দেবার মতো ক’রে শব্দটা উচ্চারণ করলে নীলকণ্ঠ। একটু থেমে বললে, “রাতে একবার আমার কাছে এস হে, কথা আছে কটা।” নীলকণ্ঠ আর দাঁড়াল না। খড়মের শব্দ তুলে নিজের ঘরে চলে গেল।

ঘরে এসে আবার চুপচাপ। কটা বিড়ি পর পর শেষ করল নীলকণ্ঠ। খেরোয় বাঁধান খাতার সাদা পাতাগুলো অনর্থক উল্টে গেল। নামল তক্তপোশ থেকে। পায়চারি করল ক’বার। জানলায় এসে দাঁড়াল। ডোবার কালো জলের একপাশে একটা হাঁস এখনো খাবার খুঁটছে। ডাবগাছের লম্বা ছায়া ভোবা ডিঙিয়ে কোথায় যেন অন্ধকারে মিশে গেছে। সন্ধে হয়ে গেল। শাঁখের শব্দ শোনা যাচ্ছে।

নীলকণ্ঠ নিজের অস্থিরতা নিজেই বুঝতে পারছিল। মনের মধ্যে অনেককাল পরে সেই বিশ্রী চাঞ্চল্য আবার এসেছে। আবার সেই তুষের জ্বলন। একটা কথা যেন ভয়ংকর অন্ধকার থেকে খানিকটা মুখ বার করে নিজেকে চিনিয়ে দিয়েছে। ছটফট করছিল নীলকণ্ঠ। কপালে একটু একটু ঘাম জমছিল। নিশ্বাস দ্রুত পড়ছিল মাঝে মাঝে।

সন্ধ্যা দিয়ে, শাঁখ বাজিয়ে রোজকার মতন আজও লন্ঠন রাখতে কুসুম ঘরে এল।

নীলকণ্ঠ বললে, “একটু জল খাওয়াও তো।”

জল দিয়ে গেল কুসুম। নীলকণ্ঠ যে কী ভীষণ তৃষ্ণার্ত ছিল, জলের ঘটিটা শেষ করে তা যেন বুঝতে পারল।

লণ্ঠনটা ডেস্কের উপর চাপিয়ে হঠাৎ খেরোয়-বাঁধানো খাতাটা খুলে ফেলল নীলকণ্ঠ। সাদা পাতাগুলো যদিও সাদা-নীরব ছিল, তবু নীলকণ্ঠ এখন যেন ওই সাদা পাতার মধ্যে অনেক অনেক কালো রেখা দেখতে পাচ্ছিল। অজস্র কথা। চমকে উঠল নীলকণ্ঠ। হাতটা সরিয়ে নিল খাত থেকে। ঘরের চারপাশে তাকাল। না, কেউ নেই। লণ্ঠনের শিষটা আরও খানিক বাড়িয়ে দিল।

নীলকণ্ঠ মনে মনে সত্যিই তবে নতুন একটা পালা তৈরি করে ফেলেছে, এতদিন চুপচাপ থাকে নি। অবশ্য পালাটা শেষ হয় নি, অর্ধেকও নয়, তবু অনেকটাই হয়েছে।

নিজের মুখ নিজে দেখতে পাচ্ছিল না নীলকণ্ঠ। কিন্তু অনুভব করতে পারছিল, পঁয়তাল্লিশ বছরের কঠিন তামাটে মুখটা এখন আঁচে ঝলসে যাচ্ছে। নিশ্বাস তপ্ত। চোখের মধ্যে সাঙ্ঘাতিক জ্বালা, বুকের মধ্যে যন্ত্রণা। অসহ্য। নীলকণ্ঠ ঘামছিল দরদর করে।

সাড়াশব্দ নয়, কিন্তু নীলকণ্ঠ বুঝতে পারল। পাথরের গেলাসে চা নিয়ে কুসুম সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

দৃষ্টিটা স্বচ্ছ নয়, একটু ঘোলাটে, খানিকটা হয়ত বিকারের রোগীর মতন। লণ্ঠনের শিষটা আচমকা শেষ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়ে নীলকণ্ঠ কুসুমকে দেখতে লাগল । চুপ করে দাঁড়িয়ে কুসুম। ভয় না, শুধু অবাক চোখেই সে তাকিয়ে ছিল । চায়ের গেলাসটা হাতে ধরেই।

লণ্ঠনের বাড়ান পলতের শিষ উঠে কাচটা কালো হয়ে এল। ঝাপসা আর অন্ধকার দেখাচ্ছিল কুসুমের গোটা শরীরটাই। নীলকণ্ঠ চোখের দৃষ্টিকে হয়ত আরও তীক্ষ, আরও উজ্জ্বল করবার চেষ্টা করল। পারল না। তার আগেই শিষের কালোয়-কালোয় লণ্ঠনের সমস্ত কাচটা ভরে গেছে। চিড় খাওয়ার শব্দ করে কাচটা ফেটে গেল।

এতক্ষণে যেন নিজেকে ফিরে পেল নীলকণ্ঠ। তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে লণ্ঠনের শিষটা কমাতে গেল। বেকায়দায় হাত লেগে লণ্ঠন ডেস্ক থেকে উল্টে তক্তপোশে পড়ল। নিভে গেল কয়েকটা লিকলিকে বাঁকা বাঁকা ফণা তুলে। অন্ধকারে কুসুমকে আর দেখা যাচ্ছিল না।

নতুন করে বাতি জ্বালিয়ে সত্যি সত্যি নীলকণ্ঠ এতদিন পরে আজ আবার লিখতে বসে গেল। কী সহজে এবং অক্লেশে এখন কথাগুলো মনে হল। এতদিন কোথায় ছিল এই কথা, কোন্ অন্ধকারে লুকিয়ে ছিল।

আবার ছত্র করে লেখে নীলকণ্ঠ আর থেমে গিয়ে আবেগ-কাঁপা গলায় জোরে জোরে পড়ে। যেন অভিনয় করছে। গলার পর্দা কোথাও জোরে কোথাও আস্তে করে ; কোথাও ব্যাকুলতা, কোথাও মিনতির সুর ফুটিয়ে পড়ে যায়।

খেয়াল ছিল না নীলকণ্ঠর, রাত হয়ে গেছে। ললিত এসে দাঁড়িয়েছে ঘরের মধ্যে, বাবার মুখোমুখি। নীলকণ্ঠ তন্ময়। কিছু দেখি নি, কাউকে নয়। দীর্ঘ একটা অংশ লিখে মুখ তুলল। সেই তন্ময়তার মধ্যে উচ্চকণ্ঠে পড়ে যেতে লাগল সদ্য-লেখা অংশটা।

নীলকণ্ঠর স্বরে অদ্ভুত এক বেদনা এবং বিষন্নতা আর ব্যাকুলতা। কী কাতর কণ্ঠস্বর। মনে হচ্ছিল না, এটা নাটকের অভিনয়। বুক থেকে প্রত্যেকটি কথা যেন স্বাভাবিকভাবেই বেরিয়ে আসছিল। শাপগ্রস্ত, জরাভীত, ভোগী এক পুরুষ কাতরকণ্ঠে যৌবন ভিক্ষা করছে। আমি সুখের অভিলাষী, আমি ভোগের ভিক্ষুক, আমি বিলাসে ক্লান্ত হই নি, আমার দেহ এই অকালে শ্লথচর্ম, লোল হয়ে যাবে—; না, না—এ আমি সহ্য করতে পারব না। এখনো যে আমার ভোগ্য ধেনু আছে, সুরা আছে, ফল আছে, পুষ্প আছে, নারী আছে, শত সহস্র মুখ আছে এই বসুন্ধরায়। তুমি আমায় প্রত্যাখ্যান কোরো না। “তৃপ্ত নহি, ক্লান্ত নহি ॥; আসঙ্গ জ্বালায় জ্বলে এ-দেহ নিয়ত। প্রার্থনা আমার পুত্র পূর্ণ কর তুমি। আমি তো তোমার পিতা, নৃপতি যযাতি— !”

নীলকণ্ঠ নয়, রাজা যযাতি যেন পুত্র পুরুর কাছে করজোড়ে ভিক্ষুকের মতন অশ্রুসজল কণ্ঠে ভীষণ একটা আবেদন জানিয়ে কাতর প্রত্যাশী চোখে চেয়ে থাকল।

ললিত কথা বলতে পারছিল না। বিমূঢ় ভাবটা কাটাতে সময় লাগল তার। কিন্তু লণ্ঠনের আলোয় যযাতিকে সে চিনত পারল সহজেই।

‘বাবা—” ললিত আচমকা ডাকল।

চমকে উঠল নীলকণ্ঠ। ললিত সামনে দাঁড়িয়ে। একেবারে মুখের কাছটিতে। আর কেউ নেই। লণ্ঠনের একটু আলো—আর পিতা পুত্র।

নীলকণ্ঠ যেন কিছু একটা বলবার চেষ্টা করছিল। পারছিল না।

ললিত খুব মৃদু, কিন্তু স্পষ্ট গলায় বললে, “মেয়েছেলে বাসায় না থাকায় বড় অসুবিধা ঘটছে। একটা বিয়া করুন আপনি। কুসুমকেই করুন। ভাল মেয়ে ।”

ললিত আস্তে আস্তে ঘর ছেড়ে চলে গেল ।

নীলকণ্ঠ চুপ। ইচ্ছে হচ্ছিল চিৎকার করে ললিতকে একবার ডাকে। ডাকতে পারছিল না। লণ্ঠনের শিখাটা যযাতির চোখের মতন জ্বলছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *