সত্যদাস

সত্যদাস

সেই কোন ব্রাহ্মভোরে কচি রোদ উঠেছিল একটু। মুখ দেখিয়েই পালাল। আবার মেঘলা। তার পর বৃষ্টি ; ভরা বর্ষার মতন। আসে যায়, যায় আসে। অথচ এখন পৌষ পড়ছে। শীত এল। শীতের মুখেই আজ ক’দিন এই রকমই চলছে। সূর্য মুখ দেখায় না; রোদ নেই, আলো নেই ঝলমলে। এমন কি রাতের অন্ধকারও ভেজা-ভেজা, স্যাঁতসেঁতে।

ভোরের রোদ দেখে রঘুনাথ ভেবেছিল, দিন পাঁচেক পরে আজই বোধ হয় অসময়ের বৃষ্টি-বাদলা কাটল। আবার সব শুকনো-শাকনা হয়ে উঠবে। মাটি শুকোবে শীতের রোদে; গাছপালার গায়ের রঙ ফোটাবে উত্তরের হাওয়া। তা আর হল কই ! আবার বৃষ্টি !

আজ ক’দিন রঘুনাথের দোকানে বিক্রি—বাটা কম। দায়ে না পড়লে কেউ আর আসতে চায় না।

রঘুনাথের মুদির দোকান। চাল ডাল তেল নুন । মুড়ি বাতাসা থেকে আলু পেঁয়াজও পাওয়া যায়। মায় বিড়ি পর্যন্ত। দোকান খুব ছোটই। সাত আট বছরেও দোকানটাকে মোটামুটি বড় করতে পারল না রঘুনাথ। হলধরবাবুদের দোকানের তুলনায় তার দোকান টিমটিমে টেমি। তাতে অবশ্য রঘুনাথের চোখ টাটিয়ে নেই, কিন্তু তার দোকান গদাই কুণ্ডুর দোকানের মতন তো হতে পারত ! হল কই !

হলধরবাবুদের সঙ্গে তুলনা চলে না। দু-পুরুষের দোকান। সবচেয়ে পুরনো, সবার চেয়ে বড়। সেখানে না পাওয়া যায় কী ! মুদি তো আছেই, তার বেশিও আছে: টর্চের ব্যাটারি থেকে গুঁড়ো-দুধের টিন, জোয়ানের আরক থেকে বাচ্চা শোয়াবার অয়েল ক্লথ, ছাতা মশারি। বড়বাবুর ব্যাবহারও ভাল। পুরনো খদ্দের এলে বিড়ি দেশলাই এগিয়ে দেন।

হলধরবাবু হবার কথা রঘুনাথ কোনোদিন ভাবেনি। স্বপ্নেও নয়। কিন্তু গদাই কুণ্ডু, নীলু ঘাঁটি কিংবা প্রসাদ—এদের মতনও হতে পারল কই ! এরা মাঝারি মাপের ব্যবসাদার, উনিশ বিশ ছোটবড় মুদির দোকান খুলে বসে আছে। ভালই চলে তাদের। গদাই হয়ত একটু পুরনো, কিন্তু প্রসাদ ? পাঁচ বছরেই সে চেহারা পালটে দিল দোকানের। এখন কেমন জাঁক করে কালীপুজো করে !

রঘুনাথের সাত বছরের দোকান কোনোরকমে টিকে আছে। চলে যাচ্ছে এই পর্যন্ত। মাঝে মাঝে বড় দুঃখ হয় রঘুনাথের। সে কিছুই প্রায় করতে পারল না। হয়ত গোড়াতেই ভুল করেছিল রঘুনাথ। একেবারে শেষপ্রান্তে তার দোকান, নিশিপুরের সাইডিং লাইন যেখানে মাটির তলায় চাপা পড়ে গিয়েছে। এত একটেরেতে দোকান করা ঠিক হয়নি।

রঘুনাথ মানুষ খারাপ নয়। তার ব্যবহারও ভাল। সে লোভী নয়, দু’ পয়সার জিনিস চার পয়সায় বেচে না, ওজনে মারে না, পচা ডাল, ছাতা-পড়া বেসন বিক্রি করে না। সব মানুষের মতন রঘুনাথেরও পেট আছে, পেট চালাতে কে না দু’ পয়সা চায়। রঘুনাথেরও তাই। দোকানের রোজগার থেকে তাদের দুটি মানুষের খাওয়া-পরা। বাড়তিও আছে একজন, একটা খোঁড়া মতন ছেলে—বিশু। রঘুনাথের সঙ্গে দোকানে হাত লাগায়, অন্য সময় যমুনার সংসারের কাজেকর্মে খেটে দেয়। বিশু অবশ্য এ-বাড়িতে থাকে না। সকালে আসে সন্ধেবেলায় চলে যায়। তবে তার সকাল দুপুরের খাওয়া-দাওয়া এখানেই।

বৃষ্টির ক’দিন রঘুনাথ যত না খদ্দেরের মুখ দেখল, তার দশগুন বেশি দেখল মেঘলা দিন, বৃষ্টি। কখনো ঝমঝমিয়ে আসছে বৃষ্টি; কখনো ঝিরঝিরে, কখনো বা তুলোর আঁশের মতন জলকণা উড়ছে বাতাস ভিজিয়ে। আকাশ এই যদি ঘন ঘোর, আবার কখন একটু আরশি-রঙ হল, দেখতে দেখতে কালো। মেঘও ডাকে। বিজলি চমকায়।

রঘুনাথ দোকানে বসে বসে বৃষ্টি দেখে। সামনে কত কী গাছপালা। আগাছা। জারুল বকুল, ধুঁধুল লতা, গুঁড়ি খেজুর, বুনো কাঁটা ঝোপ। ডালপাতায় গা বাঁচিয়ে ভিজে কাক-পাখি কখনো ডাকে কখনো পাখা গুটিয়ে বসে থাকে।

চুপচাপ কতক্ষণ আর বসে থাকা যায়। কেউ এল তো ডালটা তেলটা বিক্রি করল। এ নুন লঙ্কা জিরে হলুদ নিল তো অন্য কেউ আলু পিঁয়াজ বিড়ি। তাদের সঙ্গে দু’ দশটা কথা। এ কী বেয়াড়া বাদলায় ধরল গো নগেন, বলো তো ! চোখ খুলে রোদ দেখি না ক’দিন ! দিনকাল পালটে যাচ্ছে বাপু, শীত বর্ষাও পালটে গেল।

যখন কেউ নেই, সামনে দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভেজা গাছপালা, ধুঁধুল ঝোপ, জল-কাদায় ভরা সরু পথটুকু আর একঘেয়ে বৃষ্টিও দেখা সম্ভব হয় না—তখন রঘুনাথ অন্য পাঁচটা কাজ নিয়ে সময় কাটাবার চেষ্টা করে। আধ বস্তা আলুর বাছাবাছি সারছে, জলে স্যাঁতানিতে আলুতে দাগ ধরছে—আলু পচছে, পিঁয়াজ পচছে—পচা জিনিসগুলো ঝুড়িতে তুলে রাখছে আলাদা করে। বেশি পচলে আর বিক্রি করা যাবে না। অল্পস্বল্প দাগী আর নষ্টগুলো কম পয়সায় কিনে নিয়ে যায় অনেকে। সস্তা পড়ে।

পাঁচ সাতটা ছোট বড় টিনে ডাল মুড়ি চিঁড়ে রাখে রঘুনাথ। বিশুকে দিয়ে ডাল পরিষ্কার করিয়ে নিচ্ছে, চিঁড়ে মুড়ির টিনের ওপর পলিথিনের টুকরো চাপা দিচ্ছে এ-বেলা ও-বেলা। তাও কি আর থাকছে ওগুলো ? নেতিয়ে গেল।

মাঝে মাঝে ভেতরে যায় রঘুনাথ। যমুনার সঙ্গে দু’ পাঁচটা কথা বলে আসে ! হয়ত একটু চা খেতে চাইল, না হয় বিক্রিবাটার হাল শুনিয়ে আসল, কিংবা খোঁজ নিল যমুনার গা-ভারি ভাবটা কমেছে কিনা !

সারাদিন তো এই রকম। সন্ধেবেলায় দোকানের ঝাঁপ ফেলার পর রঘুনাথ হাতমুখ ধুয়ে কাপড় বদলে নিয়ে কিছুক্ষণ পুজোপাঠ করে। তার পর দুটো মুড়ি আর চা খেয়ে হাত ধুয়ে রামায়ণ নিয়ে বসে। মাঝে মাঝে মহাভারত। লণ্ঠনের আলোয় পিঠ নুইয়ে বসে রামায়ণ পড়ে সুর করে করে। ঘরের অন্য পাশে বিছানায় বসে যমুনা অন্যমনস্কভাবে সেলাই-ফোঁড়াইয়ের কাজ করে কিংবা শুয়ে থাকে চুপ করে। …খাওয়া-দাওয়া সারতে সারতে রাত হয় সামান্য।

দুই

আজ একটু অন্যরকম ঘটনা ঘটল।

বিকেলের মুখে জোরে বৃষ্টি এসে গেল। একেবারে যেন শ্রাবণ-ধারা। অবশ্য বেশিক্ষণ থাকল না। আঁধারও ঘনিয়ে এল তাড়াতাড়ি। একে মেঘ বৃষ্টি বাদলা, তার ওপর শীতের দিন।

বিশুকে ছেড়ে দিল রঘুনাথ। তুই যা রে ছোঁড়া। অবস্থা ভাল নয়। ভিজিস না। মাথা ঢেকে যাস।

বিশু চলে গেল একটা ছেঁড়াখোঁড়া পলিথিনের চাদরে মাথা পিঠ ঢেকে।

খানিকটা পরে রঘুনাথ যখন দোকানঘরে সন্ধে জ্বালিয়ে লক্ষ্মীর পটের নিচে ধূপ জ্বেলে দিচ্ছে—ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে একটা লোক এসে দাঁড়াল।

রঘুনাথ দেখল মানুষটাকে। চেনাজানা কেউ নয়। এ-পাড়ার লোক তো নয়ই, এমন কি এই পাঁচপুকুরিয়ায় কোনোদিন তাকে দেখেনি।

লোকটা রঘুনাথেরই সমবয়সী হবে হয়ত। কিন্তু বুড়োটে দেখায়। মুখে পাঁচ সাত দিনের দাড়ি, মাথায় রুক্ষ চুল। ওর একহাতে ছেঁড়াফাটা ছাতা। অন্য হাতে এক কাঠের বাক্স। বাক্সটা ছোট। দড়ি দিয়ে বাঁধা। ডান কাঁধে এক পুঁটলি ঝোলানো। পরনে ওর ময়লা, পেঁজাপাটা ধুতি। গায়ে কামিজ। তার ওপর এক কালো কোট। বোতাম দু’ একটা আছে কি নেই। মেরামতির সেলাই এখানে ওখানে। পায়ে জলকাদায় ভেজা ছেঁড়া চটি।

রঘুনাথ বলল, “কী চাই ?”

লোকটা বাক্স নামাতে নামাতে বলল, “দুটো চিঁড়ে মুড়ি পাওয়া যাবে, বাবু ?”

মাথা নাড়ল রঘুনাথ, পাওয়া যাবে। “মুড়ি ভাল হবে না গো ! বর্ষায় ল্যেতা। আছে চাট্টিখানি।”

“চিঁড়েই দিন তবে ! গুড় আছে ?”

“ভেলি গুড়।”

“তবে তাই দিন।”

লোকটা তার ছাতা পোঁটলা একে একে নামিয়ে রাখতে লাগল দোকানের দু-হাতি নড়বড়ে বেঞ্চিতে।

রঘুনাথ কৌতূহল বোধ করছিল। “কোথ্ থেকে আসা হচ্ছে ?”

“সে ধরুন ধর্মপুর থেকে।”

রঘুনাথ কাছাকাছি কোথাও ধর্মপুর আছে বলে জানে না। তবে তার আর কতটুকু জানা ! এখানকার পাঁচ দশ মাইল এলাকার মধ্যে কত না জায়গা আছে, গাঁ-গ্রাম, কয়লাখনি, ছোট শহর, বসত বসতি। কত রকম নাম তার, রতিবাটি মনসাতলা শ্রীপুর বাদামবাগান…গণ্ডায় গণ্ডায় নাম।

“বাবু, হাত ধোবো একটু। এক ঘটি জল পাব ?”

রঘুনাথের মনে হল, লোকটার পায়ে যা ময়লা, কাদাজল—তাতে এক ঘটি জলে ওর হাত পা মুখ ধোওয়া হবে না। অচেনা মানুষকে হুট করে অন্দরে নিয়ে যাওয়াও ঠিক নয়।

কী মনে করে রঘুনাথ বলল, “দাঁড়াও একটু, দেখি !” বলে সে ভেতরে চলে গেল।

ফিরল সামান্য পরে। ছোট বালতিতে জল, আর টিনের মগ। দোকানের বাইরের দিকে বালতি নামিয়ে দিয়ে বলল, “নাও, হাত-পা ধুয়ে নাও। পাতকুয়ার জল।”

লোকটা দেখল রঘুনাথকে। যেন তার কুণ্ঠাই হচ্ছিল। “এক ঘটি জল হলেই হত বাবু !”

“কাদায় মাখামাখি হয়ে আছ ! কেমন করে হত !…নাও ধুয়ে নাও।”

লোকটা তফাতে সরে গিয়ে হাতমুখ ধুতে লাগল।

“তা তোমার নাম কী হে ?”

“আজ্ঞা, নাম তো আছে। সত্যদাস।”

“জাত কী ?”

“জলটি চলে বাবু। গরিব মানুষের জাত আস্তাকুঁড়ের পাত… !”

সত্যদাস বালতির জলে পা ধোওয়া শেষ করে মুখ ধুতে ধুতে নিজেই বলল, “জলটি ভাল, বাবু; মুখে সোয়াদ লাগছে।”

রঘুনাথ লোকটিকে দেখছিল। সাদামাটা সরল বলেই মনে হচ্ছে; কথা বলার ধরনটিও নরম। “তুমি এই বাদলার দিনে যাচ্ছিলে কোথয় ?”

মুখ ধুয়ে সত্যদাস বলল, “যাবার কী ঠিক আছে ! যাচ্ছিলাম। পায়ে চাকা বাঁধা। যখন যেদিকে চাকা গড়ায় চলে যাই…।”

রঘুনাথ একটু হাসল। বলল, “তা বলে কোথাও গিয়ে রাতটুকু তো কাটাতে ?”

“আজ্ঞা তা ঠিক। কোথাও মাথা গোঁজার চালা পেলে রাতটুকু কাটিয়ে দিতাম।”

সত্যদাসের মুখ ধোওয়া শেষ। বালতি মগ গুছিয়ে রাখল।

রঘুনাথ বলল, “দাঁড়াও হে ! চিঁড়ে গুড় খাবে কিসে ? ভিজিয়ে খাবে তো ?”

“বাটি আছে !” বলে সত্যদাস তার ঝুলি খুলতে যাচ্ছিল।

রঘুনাথ বলল, “থাক, আমি এনি দিচ্ছি।”

ভেতরে চলে গেল রঘুনাথ।

সত্যদাস তার ঝোলা খুলে গামছা বার করতে লাগল। হাত মুখ মাথা মুছবে।

রঘুনাথ ফিরে এল। এক-হাতে কলাইকরা কানা-উঁচু থালা, অন্য হাতে একঘটি খাবার জল। “নাও ধরো, এটিতে খেয়ে নাও মেখেমুখে; পরে ধুয়ে দিও।”

চিঁড়ের অবস্থাও ভাল নয়। নরম হয়ে গেছে। তাতে অবশ্য ক্ষতি নেই; ভিজিয়েই তো খেতে হবে। কতটা ছিঁড়ে দেবে—রঘুনাথ জানতে চাইল না। পেটে খিদে আছে মানুষটার। দু মুঠো বেশি হলেই বা কী !

থালায় চিঁড়ে নিয়ে জল ঢেলে ভিজিয়ে নিতে লাগল সত্যদাস। গুড় নিল। বসল বেঞ্চিতে।

“তুমি কী কর হে, সত্যদাস ?”

সত্যদাস যেন হাসল একটু। বলল, “শেকড়বাকড় নিয়ে ঘুরি বাবু !”

“শেকড়বাকড় !”

“তা দশ বারো রকম শেকড় আছে আজ্ঞা। ধরুন বিছার কামড়, সর্পদংশন, বিষক্ষত, শূলবেদনা, অজীর্ণ, বাতব্যথা…” সত্যদাস ধীরে ধীরে বলছিল। ওর বলার মধ্যে পেশাদারি লোক-ভোলানো ভাবটা নেই, এমনভাবে বলছে যেন সত্যি সত্যি এইসব শেকড়বাকড়গুলো রোগহর।

রঘুনাথ কৌতুক ও কৌতূহল বোধ করছিল। তার মনে হচ্ছিল, এত রকম জ্বালা যন্ত্রণা অসুখবিসুখের শেকড়ের কথা যখন বলছে সত্যদাস হয়ত এর পর বাচ্চাকাচ্চা হবার মতন কোনো শেকড়ের কথাও বলবে। এরা এ-রকম বলেই থাকে। রঘুনাথদের কোনো সন্তান নেই। যমুনা আজ এগারো বছর তাগা তাবিজ মাদুলি অনেক করেছে, ওষুধপত্র খেয়েছে, কবিরাজী, টোটকা, শেকড়ও বাদ যায়নি। সবই বিফলে গেছে। এখন আর যমুনা ওসব নিয়ে পাগলামি করে না। বাইরে বাইরে অন্তত নয়।

সত্যদাস খাওয়া শুরু করেছিল। মানুষটা যে উপোসী ছিল বোঝাই যায়। মন দিয়ে খাচ্ছে। তাড়াতাড়ি।

রঘুনাথ সরাসরি কিছু বলল না। ঘুরিয়ে, যেন কৌতুক করেই বলল, “সর্পদংশনের শেকড় কি কাজে লাগে সত্যদাস ? আমাদের এদিকে দু’ একটা দেখলাম বাপু। ও তোমার শেকড় কিচ্ছুটি করতে পারল না।”

সত্যদাস খেতে খেতে বলল, “বাবু, সত্য কথাটা হল কী জানেন, সাপের বিষভেদ আছে। বড় বিষ এই গাছগাছালির শেকড়লতায় কাটে না। ছোট বিষ দূর হয়।”

“বাতব্যথার কথা কী বলল ?”

“আছে। পাকা বাত যায় না। কাঁচা-বাত বর্ষা-বাতে ভাল আরাম দেয়।”

“না, আমার পরিবারের ওটি দেখা দিয়েছে কিনা তাই বলছি।”

সত্যদাস ঘটি তুলে জল খেল।

“আর কী রাখো গো ?” রঘুনাথ বলল।

“শিরঘূর্ণন, বাধক…”

“তুমি যে ধন্বন্তরী দেখি…” রঘুনাথ হেসে ফেলল। “বলি বাধকের শেকড় রাখো, বাঁজার রাখো না ?”

মাথা নাড়ল সত্যদাস। “না বাবু !”

খাওয়া শেষ করে জল খেল সত্যদাস। ঢেঁকুর তুলল। তার পর দোকানের বাইরে গিয়ে বালতির জলে তার খাবার পাত্রগুলো ধুয়ে দিল।

ফিরে এসে থালা, ঘটি রাখল।

“বিড়ি খাবে একটা ?”

“দিন !”

বিড়ি দেশলাই এগিয়ে দিল রঘুনাথ। “তা তোমার ঘরে আছে কে কে ? সংসার… !”

সত্যদাস বিড়ি ধরাল। “কেউ নাই। একা আমি ঘুরিফিরি মাথায় থাকেন শঙ্করী।” বলে নিজের মনেই যেন হাসল।

রঘুনাথ কয়েক মুহূর্ত দেখল সত্যদাসকে। বাউণ্ডুলে মানুষ নাকি। আগুটান পিছুটান কিচ্ছুই নেই মানুষটার !

এদিকে আবার বৃষ্টি নেমে গেল। সন্ধেও হয়ে এল। দোকানের ঝাঁপ ফেলার সময়। রঘুনাথ দোকান বন্ধ করে ভেতরে যাবে, হাতমুখ ধুয়ে কাপড় বদলে পুজোপাঠে বসবে। সত্যদাস তাহলে এখন যাবে কোথায় ? বৃষ্টির মধ্যে তো বেচারিকে বলা যায় না, এবার বাপু তুমি এসো; আমার দোকান বন্ধের সময় উতরে গেছে।

বৃষ্টিটাও কেমন এল দেখেছ ! আবার যেন ঝাঁপিয়ে এসেছে।

সত্যদাস আমেজ করে বিড়ি টানছিল। চোখ সামান্য বোজা। মানুষটা সারাদিন এই বৃষ্টিবাদলার মধ্যে জলকাদা ঘেঁটে হেঁটেছে কোথায় কোথায় ! ক্লান্ত পরিশ্রান্ত। সারাদিন পরে হাতমুখ ধুয়ে দুটি চিঁড়েগুড় খেয়েছে। পেট ভরেছে খানিকটা । বিড়ির তামাকের আমেজে তার চোখ দুটিও বুজে এল।

রঘুনাথ কী করবে বুঝতে পারছিল না। লোকটাকে তাড়িয়ে দেওয়া যায় না, আবার তার নিজের পক্ষে বৃষ্টি না-থামা পর্যন্ত বসে থাকাও সম্ভব নয়। তাহলে ?

“সত্যদাস !.…তুমি বাপু একটা কাজ করো। আবার তো জল নামল। যেতে তো পারবে না। বরং তুমি বোসো হে ওখানে। আমি ভেতরে যাই। সন্ধে ঘনিয়ে গিয়েছে, হাত মুখ ধুয়ে পুজোটা সেরে আসি।”

সত্যদাসের যেন আমেজ ভাঙল। ব্যস্তভাবে বলল, “আজ্ঞা সেকি কথা ! আপনার পুজোপাঠের সময়… আমি আপনাকে আটকে রাখছি। আমি যাই বাবু— !”

“আরে না না, এ জলে যাবে কোথায় ! বসো তুমি ! জল থামলে যেও। আমি ভেতরে আছি। যাবার সময় ডেকে দিও।”

“আজ্ঞা আপনি পুজোয় বসবেন !”

“ও কিছু না। ডাকলেই সাড়া পাবে।”

“বাবু, তবে দামটা নিয়ে নিন।”

রঘুনাথ কেমন কুণ্ঠিত হল। এই বাউণ্ডুলে আধ-ভিখিরি মানুষটার কাছ থেকে সে চিঁড়েগুঁড়ের কীই বা দাম নেবে ! মানুষটা ভাল, সরল। মায়া হয় ওকে দেখলে। কতই বা ওর পুঁজি ! দু পাঁচটা শেকড়বাকড়। বিক্রি হয় কি না-হয় কে জানে !

রঘুনাথের ইচ্ছে হল না পয়সা নিতে। দুর্যোগের মধ্যে বেচারি এসে পড়েছে এখানে—দুটো চিঁড়েগুড় খেয়েছে বড়জোর ! পঞ্চাশ আশিটা পয়সায়, কী বড়জোর একটা টাকাই হল—ও নিয়ে আর কী লাভ হবে রঘুনাথের। সে তো না খেতে পেয়ে মরে যাচ্ছে না !

রঘুনাথ বলল, “দাম থাক হে ! তোমায় দিতে হবে না !”

সত্যদাস অল্পক্ষণ অবাক হয়ে দেখল রঘুনাথকে। তার পর বলল, “না বাবু, ওটি হয় না।”

“কেন হে ?”

“আমি মুখ্যুসুখ্যু মানুষ, মশায়—শাস্ত্র আপনি বেশি জানেন। শাস্ত্রে বলেছে—মূল্যটি না দিলে অধর্ম হয়। সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণাও কাঞ্চন দিয়ে…”

রঘুনাথ হেসে ফেলল। “থাক, ধর্মকথা থাক্। …দাও পঞ্চাশটি পয়সা দাও।”

“যথার্থ মূল্যটি আপনি নিচ্ছেন না বাবু ?”

“আমার ধর্ম আমাতে থাক। তোমারটি তুমি রাখো।”

সত্যদাস প্রথমে তার কোটের পকেট হাতড়াল। তার পর কী মনে করে দড়িবাঁধা কাঠের বাক্সটি খুলতে লাগল ।

রঘুনাথ বলল, “তুমি না হয় পরে দিও।”

“না না, আপনি নিয়ে যান।”

দডির গিঁট খুলে বাক্সটির ডালা তুলল সত্যদাস। নানান ছোটখাট সামগ্রী, কাগজে মোড়া শেকড়বাকড়, কাচের বাটি দু তিনটি, কাচের ছোট ছোট গ্লাস একজোড়া, কয়েকটা কালো কালো বল—জামের মতন, একটি একহাতি সরু লাঠি, কয়েকটা লাল সবুজ নীল রুমাল। ওরই মধ্যে থেকে সত্যদাস একটি কাপড়ের টেঁক-থলি বার করল। কাপড়ের রঙটি কালো।

রঘুনাথ এই বিচিত্র বাক্সটির সঞ্চয় দেখছিল।

থলি খুলে পয়সা বার করার সময় কী যেন একটি পড়ে গেল বাক্সর মধ্যে। সত্যদাস হয়ত খেয়াল করেনি। রঘুনাথের চোখে পড়েছিল। সে অবাক। বিশ্বাস করতে বাধছিল। এই আধ-ভিখিরি লোকটার টেঁক-থলির মধ্যে মোহর এল কেমন করে ? সোনা পেল কোথায় ?

“এই নিন বাবু” সত্যদাস পয়সা এগিয়ে দিল।

রঘুনাথের যেন ঘোর কাটেনি। অন্যমনস্ক।

“একটা টাকা আপনি নিলে পারতেন, মশায়।”

রঘুনাথ নিজেকে সামলে নিল। “পঞ্চাশটি পয়সাই দাও।”

পয়সা নিয়ে বাক্সর দিকে তাকিয়ে রঘুনাথ হালকা ভাবে বলল, “এত কী জড়ো করে রেখেছ হে সত্যদাস !”।

“আজ্ঞা, এ আমার ইন্দ্রজালের বাক্সও বটে।”

“ইন্দ্রজাল !”

“হাটেমাঠে যখন ঘুরি বাবু, বসতে তো হয় দু-চার ঘণ্টা। লোক যদি না আসে কাছে শেকড়বাকড় কিনবে কে ? তখন দু চারটি হাত সাফাইয়ের খেলা দেখাই। তাসের খেলা, রুমালের খেলা, বলের খেলা। জলের রঙ পালটাই। …পেট চালাতে কত কী করতে হয়, বাবু !”

“ও ! তুমি ভোজবিদ্যাও জান ?” বলে রঘুনাথ হেসে উঠল। “বড় গুণী মানুষ হে তুমি সত্যদাস !”

সত্যদাস লজ্জা পেয়ে গেল যেন। বলল, “না মশায়, আমি গরিব তুচ্ছ মানুষ ; অমন কথা বলবেন না।”

“তুমি বসো। বৃষ্টি ধরল না। আমি ভেতরে যাই। যাবার আগে ডাক দিও।”

অন্দরে যাবার আগে রঘুনাথ দোকানের বাইরের ঝাঁপ আরও খানিকটা নামিয়ে দিল।

তিন

বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল।

রঘুনাথ সন্ধের পুজোপাঠ সেরে বাইরে এসে দেখে—সত্যদাস দু-হাতি বেঞ্চির ওপর কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে। গায়ে একটা ছেঁড়া চাদর। তার ঝোলাটি আর কাঠের বাক্স পড়ে আছে নিচে। ঝোলাটি আধখোলা। বোধ হয় চাদর বার করেছিল ।

সত্যদাসকে ডাকতে গিয়ে রঘুনাথ দেখল, লোকটা কাঁপছে। হল কী ওর ?

“সত্যদাস !… ওহে সত্যদাস ?”

কানগালের পাশ থেকে চাদর সরাল সত্যদাস সামান্য। “বাবু ?”

“তোমার হল কী ?”

“কম্প জ্বর !”

“ম্যালারু ?”

“পালাজ্বরে ধরেছে আমায়। তিনটি বছর ভুগছি। হয়, যায়। আবার হয়। আপনি চিন্তা করবেন না। খানিকটা পরে জ্বর ছেড়ে যাবে। …জ্বর গেলেই আমি চলে যাব। নিশ্চিন্ত থাকুন।”

রঘুনাথ যেন আহত হল। বলল, “যাবার কথা আমি বলিনি, বাপু ! জ্বরের কথা বলছি। এত কম্প হচ্ছে !”

“কম্পের দোষ কী ! জলে জলে ঘোরা… ! ও চলে যাবে।”

“গেলে ভাল। … তা আমি বলি কী, জ্বর গেলেও তুমি যেয়ো না। অসুখ নিয়ে এই রাতের বেলায় বৃষ্টি বাদলায় কোথায় ঘুরে বেড়াবে। বরং আজকের রাতটি এখানেই থেকে যাও। দোকানঘরেই থেকো।”

“সে কী হয় বাবু ! আপনার বাড়িতে আমি অসুখ নিয়ে পড়ে থাকব !”

“হয়, খুবই হয়। …থাকো তুমি ; আমি যাই। পরে এসে খোঁজ নেব।”

রঘুনাথ দোকানের ঝাঁপ পুরোটাই নামিয়ে দিল। ছোট লণ্ঠন সরিয়ে রাখল অন্যপাশে।

চার

নিজের ঘরে বসে রঘুনাথ লণ্ঠনের আলোয় ‘রামায়ণ পড়ছিল সুর করে। যমুনা বিছানার দিকে মাটিতে আসন পেতে বসে কাঁথা সেলাই করছিল। বড় কাঁথা। তার হাতের কাজ ভাল । এর ওর আবদারও রাখতে হয়। এই কাঁথাটা দত্তবাড়ির ছোট বউয়ের ফরমাশ । ছোট বউ ঈশানী তার বন্ধুর মতন।

রঘুনাথ পড়ছিল :

রামেরে বলেন সীতা মধর বচন।

অনুমতি যদি হয়, করি নিবেদন ॥

এই মৃগচর্ম যদি দাও ভালবাসি।

কুটিরে কৌতুকে নাথ বিছাইয়া বসি ॥

আদরে শুনিয়া রাম সীতার বচন।

ডাক দিয়া লক্ষ্মণেরে বলেন তখন ॥

অদ্ভুত হরিণ দেখ ভাই বিদ্যমান ।…

যমুনার কান বোধ হয় রামায়ণ-পড়ায় ছিল না। দোকানঘরের দিকে কোনো শব্দ পেয়েছিল। বলল, “উঠেছে বোধ হয়।”

পড়া থামিয়ে রঘুনাথ স্ত্রীর দিকে তাকাল। কিছু বলল না। অন্য দিনের মতন আজ তার মন বসছে না পড়ায় ।

“যাও গিয়ে দেখো একবার”, যমুনা বলল।

“যাই… !” রামায়ণ বন্ধ করতে করতে বলল রঘুনাথ। পড়া শেষ হল না আর। “আমি ওকে থেকে যেতে বলেছি।”

“থাকবে !”

“যাবে কোথায় এত রাতে, বৃষ্টিবাদলায়। গায়ে জ্বর ।” রঘুনাথ উঠে দাঁড়াল । বলল, “লোকটা বড় অদ্ভুত ! শেকড়বাকড়ের এটি উটি বেচে পেট ভরায়। ওর কাছে সোনাটি এল কোত্থেকে ?”

“সোনা না তামা ?”

“সোনা।”

“গিলটি হবে।”

“না—মনে তো হয় না। সোনা আমি চিনি। আমার বাপ সেকরার দোকানে কাজ করত গো ! সোনা দেখিনি বলছ !…দেখেছি। তার পর তোমায় দেখলুম—ওটি ভুলে এটি নিলুম। না কিগো যমুনাপুলিনে !” রঘুনাথ হাসতে লাগল রসিকতা করে। কিন্তু সোহাগটুকু মিশে থাকল হাসির সঙ্গে।

“এ সোনায় তো কিছু হল না,” যমুনা বলল, “যে কে সেই ! কপাল ফিরল তোমার ? ছিলাম এক কোঠায়, সাত বছরে দুটি ভাঙা কোঠা। সোনা নয়, তামাও নয়—এ হল টিনের পাতি।”

“ভাগ্য যার যেমন ! তোমার দোষ কী ! রাজা হরিশচন্দর চণ্ডালের কর্ম করেছিল। …ও কথা থাক। আমি ভাবছি ওই আধ-ভিখিরির কাছে সোনা থাকে কেমন করে ?”

“ছিল হয়ত একটা। কেউ দিয়েছিল। বাপ-মা !”

“কেউ তো নেই ওর !”

“তবে জিজ্ঞেস করো !”

“না না, তা হয় না। ভাববে, লোকটার তো নজর বেশ, একলহমায় দেখে নিয়েছে সোনাটি ।”

“চোর ছ্যাঁচড়া নয় তো !”

“ছিছি ! চোর কেন হবে। মানুষটি ভাল। তাছাড়া আজ সে আমাদের অতিথি। মন্দ কথা বলতে নেই।”

“বেশ, না বললুম। যাও দেখা গিয়ে এবার…”

রামায়ণ তুলে রেখে রঘুনাথ দোকানঘরে গেল।

সত্যদাস উঠে বসেছে। চাদর দিয়ে ঘাম মুছছিল কপালের গলার। হাওয়ায় নিশ্বাস নিচ্ছে মাঝে মাঝে। হেসে বলল, “জ্বর ছেড়ে গেছে বাবু। আমার এই রকমই হয়। হুট করে জ্বর এল কম্প দিয়ে, আবার চলেও গেল। বড় জোর একবেলা ভুগলাম।”

রঘুনাথ ঠাট্টার গলায় বলল, “ভালুক জ্বর হে !”

“তা আজ্ঞা ঠিক কথা। পুরাতন কম্পজ্বরের ধর্মই এই।”

“রাতটুকু তুমি এখানেই থাকো,” বলে রঘুনাথ দোকানের টিন-দেওয়া ঝাঁপটা দেখাল। বলল, “উটি তলার দিকে একটু খোলা আছে। বন্ধ করে দি। আর উই পিছনের দরজাটি আমরা বন্ধ করে দেব। তোমার কোনো অসুবিধে হবে না।”

মাথা নাড়ল সত্যদাস। “যথেষ্ট।”

রঘুনাথ জানে যথেষ্ট নয়। বেঞ্চিটা সরু, ছোট। হাত-পা গুটিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুতে হবে। কষ্টই হবে সত্যদাসের।

সত্যদাস হঠাৎ বলল, “আপনি মশায় মানুষটি বড় ভাল । অজানা-অচেনা মানুষকে লোকে ঘরে ঢুকতেই দিতে চায় না, আপনি আমায় আশ্রয় দিলেন। …যিনি দেখার তিনি কিন্তু সব দেখেন, বাবু ! ঠিক কিনা বলুন !”

রঘুনাথ হাসল। বলল, “দেখেন বলেই তো এই অবস্থা গো সত্যদাস। এই দোকানটি দিয়েছিলাম দেশভুঁই ছেড়ে এসে। তা সাত আট বছর হয়ে গেল। লতা বাড়ে পাতা বাড়ে মানুষের সাধও তো বাড়ে হে ! আমার কপালে কোনটি বাড়ল বলো ! একটি চালা মাথায় নিয়ে বসেছিলাম—সাত বছরে মাথা গোঁজার মতন দুটি চালা ; আর ওই দু চার হাত এদিক ওদিক। দেখার মানুষটি আর দেখলেন কোথায় ! ওই মানুষটির ঘাড় বেঁকা। পুবে মুখ থাকলে পশ্চিমে চোখ ফেরে না।”

সত্যদাস তাকিয়ে থাকল। দেখছিল রঘুনাথকে। চোখের পাতা পড়ল না সত্যদাসের কিছুক্ষণ। তার পর কেমন এক সরল আশ্চর্য হাসি ফুটে উঠল তার মুখে।

“হাসলে যে !”

“আজ্ঞা না। আমি বোকাসোকা মানুষ বাবু। মুখ্যু লোক। আমার কথায় দোষ ধরবেন না। যেমনটি মুখে আসে বলে ফেলি, বুঝি না মশায় !”

রঘুনাথ আর কথা বাড়াল না। বলল, “জ্বর যদি না থাকে দুটি রুটি আর আলুবেগুনের ঘেঁট খেয়ে শুয়ে পড়তে পার। কাল সকালে অন্য কথা।”

সত্যদাস কিছু বলল না। ঘাড় হেলিয়ে বসে থাকল।

পাঁচ

পরের দিন সকালে কুয়াশা-জড়ানো রোদ উঠল প্রথমে। বৃষ্টি নেই। আকাশ অনেক পরিষ্কার। সামান্য পরেই কুয়াশা কাটল। গাছপালা মাঠঘাটে রোদ ছড়িয়ে পড়েছে।

সত্যদাস মাঠ ঘুরে এসে হাতমুখ ধুয়ে নিয়েছে ভেতরে কুয়াতলায় গিয়ে। যমুনা তখন ঘরদোর ঝাঁট দিচ্ছে। দেখল সত্যদাসকে। সত্যদাসও তফাত থেকে দু হাত জোড় করে পিঠ নুইয়ে নমস্কার জানিয়ে হাসল একটু।

নিজের ঝোলাটি বেঁধে, কাঠের বাক্সটি গুছিয়ে নিয়ে সত্যদাস যখন যাব-যাব করছে। রঘুনাথ বলল, “বাসীমুখে যেতে নেই গো। দাঁড়াও, একটু চা খেয়ে যাও। চা আসছে।”

“তা খেয়েই যাই, আপনি ভাল কথা বললেন। চায়ের অভ্যাসটি অল্পস্বল্প আছে আমার।”

“তুমি এখন যাবে কোথায় ?”

“পা যেদিকে যায়, সত্যদাস হাসল ; “রতিবাটি হয়ে চলে যাব।”

যমুনা দু গ্লাস চা এনে ভেতর দরজার কাছে দাঁড়াল। শব্দ করল।

রঘুনাথ উঠে গেল চা আনতে।

সত্যদাস তার গায়ের কোটটি পরে নিল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।

চা এনে দিল রঘুনাথ। “ধরো হে ! দাঁড়াও, একটা হাত-বিস্কুট দিই।”

রঘুনাথের দোকানে প্লাস্টিকের বয়ামে কয়েকটা হাত-বিস্কুট ছিল। বর্ষায় নেতিয়ে গেছে।

“নাও ; নরম হয়ে গেছে, মুখে দিয়ে স্বাদ পাবে না।”

সত্যদাস বিস্কুট নিতে নিতে বলল, “দিনটি আজ ভালই এল, বাবু ! সুয্যিদেব উঠলেন। ঝলমলিয়ে গেল ধরিত্রী ।”

রঘুনাথেরও মনে হল, আজকের দিনটি যেন এ-কদিনের মেঘলা-বাদলা, ভিজে স্যাঁতসেঁতে নির্জীব ভাব কাটিয়ে নতুন করে জেগে উঠল। সকালের কাক ডাকছে, শালিক নেমেছে, ধুঁধুল ঝোপের কাছে কুকুরটিও এসে বসল।

সত্যদাস গ্লাসটি ধুয়ে রেখে দিল। “বাবু, এবার তবে আসি।”

“এসো।”

“মনটি বড় তৃপ্ত হয়েছে মশায়। খেপা-পাগলা মানুষ, ভিখিরি লোক। দয়া করে আপনি আশ্রয় দিলেন, দুটি খেতে দিলেন। আজকাল আর কে দেয়, বাবু ! ভগবান আপনার ভাল করুন।”

সত্যদাস তার দড়িবাঁধা বাক্সটা হাতে তুলে নিল। কাঁধের ঝোলাটা আগেই ঝুলিয়ে নিয়েছে।

রঘুনাথ বলল, “এদিক পানে ফিরবে কবে ?”

“তার কি ঠিক আছে। সাতদিন পরে পারি, আবার মাস দু মাস কাটিয়েও পারি।”

“তা এদিকে এলে, দেখা করে যেও।”

“অবশ্যই মশায়।” সত্যদাস দু হাত তুলে জোড় করে নমস্কার করল। “আসি।”

“এসো।”

সত্যদাস চলে গেল।

রঘুনাথ তাকিয়ে থাকল। কাঁচা পথ, ঝোপঝাড়, বনতুলসীর জঙ্গল, ধুঁধুল ঝোপ, তার পর মাঠ। সত্যদাস চলে যাচ্ছে। এক কাঁধে ঝোলা, অন্য হাতে দড়িবাঁধা কাঠের বাক্স। ছাতাটি বগলে। তার কালো কোটটিতে রোদ পড়েছে।

বিশু এল খানিকটা পরে।

রঘুনাথ বলল, “দে ঝাঁটপাট দিয়ে নে। ভাল করে দিবি। দিয়ে সামনেটা ধুয়ে দিবি জল দিয়ে, কাদায় কাদায় ভরে গেছে।” বলতে বলতে সে একটা বিড়ি ধরিয়ে নিল, নিয়ে দোকানের বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। “বেঞ্চিটা বার করে দিবি রোদে। ক’টি জিনিস শুকোতে দেব। নে হাত লাগা। সাফসুফের কাজ শেষ করে মায়ের কাছে যাবি । চা মুড়ি খেয়ে নিয়ে অন্য ক’টি কাজ আছে মায়ের, সেরে দিবি ।”

বিশু জানে তার নিত্যকার কাজ কী কী করতে হয়। দোকান ঝাঁটপাটটা তার প্রথম কাজ। দোকান সাফ হবার পর বাবু দু দশ ফোঁটা জল ছিটোবেন। মালক্ষ্মীর পটের কাছে রাখা ধূপদানে ধূপ দেবেন। প্রণাম করবেন ভক্তিভরে। তারপর একটি সরায় দুটি চাল আর একটি হলুদ রেখে শুরু করবেন বেচাকেনা ।

বিশু ঘর ঝাঁট দিচ্ছিল। রঘুনাথ বাইরে দাঁড়িয়ে।

দূরে কোলিয়ারির ভোঁ বাজছে। অনেকটা তফাতে কাক ডাকছিল। কোথা থেকে যেন কাঠ কাটার মতন একটি শব্দ ভেসে আসছে।

হঠাৎ বিশু ডাকল। “বাবু ?”

তাকাল রঘুনাথ।

“এটি কী পড়ে রয়েছে !” বিশু বাইরে এসে জিনিসটি এগিয়ে দিল।

রঘুনাথ দেখল। দেখেই চিনতে পারল। সত্যদাসের সেই টেঁক-থলি। কাল রাতে এটাই দেখেছিল রঘুনাথ। সত্যদাস পয়সা বার করছিল ওর মধ্যে থেকে।

হাত বাড়িয়ে জিনিসটা নিল রঘুনাথ। মোটা কাপড়ে তৈরি জিনিসটা। কাপড় ময়লা। কিন্তু পুরু কাপড়। মুখের কাছে গিঁট। ভারিই লাগছিল থলিটি।

দেখেছ কাণ্ড সত্যদাসের। আসলটি নিতে ভুলে গেল কেমন করে। তাছাড়া এটি তো ওর কাঠের বাক্সর মধ্যে ছিল। বার করেছিল কেন ? করল তো আবার রাখতে ভুলে গেল কেমন করে ! এমন বেখেয়ালে মানুষ বড় দেখা যায় না। ওর পকেটে পয়সাকড়ি তেমন থাকে বলে তো মনে হয় না। লোকটা বিপদে পড়বে। আবার ফিরে আসতে হবে ওকে।

রঘুনাথ থলির মুখটি খুলব কি খুলব না করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। তার দ্বিধা হচ্ছিল। এই থলির ভেতর থেকে কাল একটি মোহর পড়ে গিয়েছিল বাক্সের মধ্যে ! হয়ত পরে সেটা নজরে এসেছিল সত্যদাসের। যদি নজরে নাও এসে থাকে—তার বাক্সর মধ্যেই আছে—পেয়ে যাবে। কিন্তু… !

রঘুনাথ খানিকটা দ্বিধার পর থলির দড়িটি আলগা করল। দেখল।

আচমকা যেন এমন কিছু হয়ে গেল—যাতে রঘুনাথ চমকে উঠল ভীষণ ভাবে। তার চক্ষু স্থির। গলার কাছে শ্বাস আটকে গিয়েছে। বিশ্বাস হচ্ছিল না রঘুনাথের। সে কী কোনো স্বপ্ন দেখছে ! তার কি মতিভ্রম হল ! নাকি সে পাগল হয়ে গেছে।

রঘুনাথ থলির মুখ আরও খানিকটা হাঁ করল।

ভয়ে ভয়ে হাত ডোবালো, আঙুল দিয়ে ছুঁলো, ঘাঁটল। না, এ তো সোনা ; সোনাই। মোহর !

বিশু দোকান সাফ করছে।

রঘুনাথ একবার বিশুকে দেখে নিল। না ছেলেটা তার নিজের কাজে ব্যস্ত।

একটি মোহর তুলে নিল রঘুনাথ। ভয়ে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বিধা নিয়ে।

সকালের আলোয় রঘুনাথের আর ভুল হল না। সেকরার ছেলে। সোনা চেনায় তার ভুল হবার কথা নয়।

মোহর ঠিকই। তবে কবেকার মোহর বোঝা যাচ্ছে না। পুরনো তো বটেই। রানীর আমলের।

রঘুনাথ আর দাঁড়াল না, অন্দরের দিকে পা বাড়াল।

বাসী শাড়িজামা ছাড়া হয়ে গিয়েছিল যমুনার। কুয়াতলার পাশেই জামাকাপড় মেলে দেবার দড়ি টাঙানো। যমুনা ভিজে কাপড়চোপড় মেলে দিচ্ছিল রোদে।

রঘুনাথ ডাকল, “শোনো।”

অনেক দিন পরে রোদ উঠেছে। এ ক’দিন ঘরবাড়ি যেমন সেঁতিয়ে গিয়েছিল—জামাকাপড়ের সেই অবস্থা। রোদে সবই মেলে দিতে হবে। যমুনা যেন খানিকটা আরাম করে রোদ গায়ে লাগিয়ে জামাকাপড় মেলে দিচ্ছিল। এখন এগুলো, পরে আরও দেবে।

সাড়া না দিলেও সামান্য পরে ঘরে এল যমুনা।

ঘরের মাঝমধ্যিখানে কেমন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রঘুনাথ। তার হাতে যেন কী একটা রয়েছে।

এগিয়ে গিয়ে যমুনা বলল, “কী ?”

কী বলবে, কেমন করে বোঝাবে ঠিক করতে না পেরে সামান্য থতমত খেয়ে রঘুনাথ বলল, “এই দেখো !”

যমুনা দেখছিল।

রঘুনাথ বলল, “মোহর। লোকটা ফেলে গিয়েছে। তার টেঁক-থলির মধ্যে এই গিনি মোহরগুলো ছিল।”

“মোহর !” যমুনা ভীষণ অবাক। আরও দু পা এগিয়ে এল।

রঘুনাথের হাতের তালুতে কয়েকটা মোহর। দুটো আঙটি।

যমুনা কোনোদিন মোহর দেখেনি। গরিব ঘরের মেয়ে, বিধবা মায়ের সঙ্গে মামার বাড়িতে মানুষ হয়েছে। দুটো খেতে পরতে পেত—এই না যথেষ্ট ছিল। পরে অবশ্য মামার বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল। সে অন্য কথা।

হাত বাড়াল যমুনা। “দেখি।”

রঘুনাথ একটা মোহর এগিয়ে দিল। “আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আশ্চর্য ব্যাপার ! লোকটা…লোকটা তার টেঁকের থলি ফেলে গেল কেমন করে ? আর মোহরই বা পেল কোথায় ?”

যমুনা খুব মন দিয়ে মোহর দেখল। মোহর সে না দেখুক—শুনেছে তো কানে। আসল সোনা। “মোহর তুমি জান ?”

“জানব না। বলছ কী ! সেকরার ছেলে…।”

“মোহর কেউ ফেলে যায় ?”

“পাগল না হলে যায় না। …তাও ছ’ছটা মোহর।”

“ছ’টা ?”

“ছ’টা মোহর, দুটো আঙটি।”

“আঙটিও ?” যমুনা যেন থমকে গেল। বড় বড় চোখ করে স্বামীকে দেখছিল। তার পর রঘুনাথের হাতের দিকে তাকাল।

কী মনে করে রঘুনাথ বলল, “দরজাটা একটু ভেজিয়ে দিয়ে এসো।”

যমুনা এগিয়ে গিয়ে বারান্দার দিকের দরজা ভেজিয়ে দিল। বিশু এখনই এসে ডাকাডাকি শুরু করবে।

রঘুনাথ একটু আড়ালে সরে গেল। এ-পাশে জানলা রয়েছে। আলোও আছে। জানলার ওপারে ফাঁকা জমি। বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই। তবু পুরোপুরি খোলা জানলার কাছে দাঁড়াল না রঘুনাথ।

নিজের হাতের মুঠো খুলে মোহরগুলো দেখাতে দেখাতে রঘুনাথ বলল, “এগুলো পুরনো মোহর। রানী-মুখো । …আমি কিছুই বুঝতে পারছি না—এতগুলো মোহর লোকটা ফেলে গেল কেমন করে ? ভুল করে ? এমন ভুল মানুষের হয়। তাছাড়া সত্যদাস একটা দুটো নয়—ছ’ ছটা গিনি মোহর পাবেই বা কেমন করে ? আধ-ভিখিরি লোক। শেকড়বাকড় বেচে খায়… !”

“আঙটির পাথর দুটো কিসের ?”

রঘুনাথ আঙটি দেখতে দেখতে বলল, “পাথর আমি ভাল চিনি না। তবে দেখে মনে হচ্ছে দামী পাথর।”

“হীরে ?”

একটা আঙটি ওঠাল রঘুনাথ। দেখাল স্ত্রীকে। বলল, “এটা কেমন সাদা আর ঝকঝক করছে দেখেছো। হতে পারে হীরে। ঝলসে উঠছে—” বলে আলোর মধ্যে আঙটির পাথরটা দেখতে লাগল।

“হীরে না কাচ ?”

“না কাচ নয়।”

“আর-একটা আঙটি ?”

অন্য আঙটিটাও দেখাল রঘুনাথ । কালচে। বলল, “এটি কী—আমি জানি না। নীলাটিলা হতে পারে।”

“নীলা ?”

“কী জানি ?”

রঘুনাথ হাত বাড়িয়ে স্ত্রীকে আঙটি দুটো দেখতে দিল।

যমুনা দেখল। সে পলা-পাথরছাড়া পাথরই দেখেনি জীবনে। আর দেখেছে মুক্তো। ঈশানীর কানের ফুলে ছোট ছোট দুটি মুক্তো বসানো আছে।

রঘুনাথ হাত বাড়িয়ে আঙটি দুটো ফেরত নিল। মোহর আর আঙটি কাপড়ের টেঁক-থলির মধ্যে রাখতে রাখতে বলল, “সত্যদাস কেমন মানুষ বুঝতে পারছি না। ওর কাছে এসব জিনিস থাকার কথা নয়। দু পাঁচটা টাকাও যার কাছে থাকার কথা নয় সে ছ’ ছটা মোহর, দুটো আঙটি কেমন করে রাখে !”

“থলির মধ্যে পয়সাকড়ি নেই ?”

“না।”

“কাল তো তোমাকে থলির মধ্যে থেকে পয়সা বার করে দেবার সময় একটা মোহর পড়ে গিয়েছিল বলছিলে !”

মাথা নাড়ল রঘুনাথ। সে ঠিকই বলেছে।

“তবে আজ পয়সাকড়ি নয়, শুধু মোহর এল কেমন করে ?”

কেমন করে এল—তা আর রঘুনাথ কেমন করে জানবে ! কথাটা সে না ভাবছে—এমন নয়। ধাঁধা লাগছে। সবই ধাঁধা। ধোঁকা খেয়ে গিয়েছে রঘুনাথ। বলল, “কী জানি এটা বোধহয় আর-একটা থলি। সত্যদাস লুকিয়ে রাখত।”

যমুনা বলল, “লুকনো থলি তোমার বাড়িতে ফেলে গেল ! তাই হয় নাকি ?”

“হবার কথা নয়। কিন্তু…”

“লোকটা চোরটোর নয় তো ?…চুরিটুরি করেছিল কোথাও….ধরা পড়ার ভয়ে ফেলে রেখে পালিয়ে গেল— !”

রঘুনাথের মাথায় কিছু আসছিল না। সত্যদাসকে দেখলে চোর বলে মনে হয় না। হাটেমাঠে যারা শেকড়বাকড়, ওষুধ-তেল মালিশ, হজমি, কৃমির ওষুধ বিক্রি করে—সেই রকমই মনে হয়। অবশ্য লোকটা নাকি ভিড় জমাতে ভোজবাজিও দেখায়।

রঘুনাথ বলল, “সত্যদাস বলছিল ও ভোজবিদ্যা জানে অল্পস্বল্প ।”

“তবে এ তোমার কিছুই নয়। ওর ভেলকি দেখাবার জিনিস। খেলা গো, খেলা। নকল সোনা, নকল হীরে !”

রঘুনাথ মাথা নাড়ল। তার মনে হচ্ছিল না—সোনা নকল। পাথর হতে পারে—সে জানে না। তবু এখন দ্বিধার সঙ্গে বলল, “কী জানি।”

“এখন কী করবে ?”

“দেখি ! সত্যদাস যদি আসে। খেয়াল তার পড়বেই। হয়ত আজই ফিরে আসবে। এ তো আর দশ বিশটা পয়সা কি টাকা নয় যে হারিয়ে গিয়েছে বলে মাথা খুঁড়তে যাবে না। সে আসবে।”

“আসার কথা কি বলে গিয়েছে কিছু ?”

“না, তেমন ভাবে বলেনি। আমি জিজ্ঞেস করলুম। তা বলল, এ-পথে ফিরবে যখন—তখন দেখা করবে। সে সাতদিন একমাস হতে পারে, আবার দু চার মাসও হতে পারে।”

বিশুর গলা পাওয়া গেল। ডাকাডাকি করছে।

যমুনা বলল, “তা এখন করবে কী ?”

“তোমার বাক্সর তলায় রেখে দাও। …কাউকে কিছু বলো না। একটু নজর রেখো। দিনকাল ভাল নয়।”

যমুনা বলল, “বিছানার তোশকের তলায় চাবি আছে। বাক্স খুলে তুমিই রেখে দাও।”

ছয়

সেদিন নয়, তার পরের দিন নয়, হপ্তাও পার হল সত্যদাস এল না।

রঘুনাথ প্রথম প্রথম ভাবত, এই বুঝি সত্যদাস এসে পড়বে। সে সকাল দুপর বিকেল অপেক্ষা করত। সন্ধে কি রাত্রেও তার কান পড়ে থাকত দোকানঘরের দিকে। এই বুঝি সত্যদাস এসে ডাকবে, ‘বাবু ?’ কিন্তু কোথায় সেই লোকটা ? দোকানে বসে ডাল তেল গুড় বেচতে বেচতে রঘুনাথ সামনের দিকে তাকিয়ে থাকত, ভাবত—হাঁটু পর্যন্ত ধুলো, এক কাঁধে ঝোলা, অন্য হাতে কাঠের বাক্স, রুক্ষুসুক্ষু চেহারায় সত্যদাস এসে হাজির হবে জারুল গাছ আর ধুঁধুল ঝোপের পাশ দিয়ে। সত্যদাস আসত না।

এমন করেই হপ্তা গেল। মাস গেল। শীতের বাতাস ছুটল সনসন করে, পাতা ঝরতে লাগল গাছের, মাঠের ঘাস শুকোতে শুকোতে খয়েরি হল। মাঘও এল শীত পড়ল হাড়-কাঁপানো ; বিদায়ও নিল । তার পর ফাল্গুন।

রঘুনাথ ধৈর্য হারিয়ে ফেলছিল। লোকটার হল কী ! এমন বে-আক্কেলে কাণ্ডজ্ঞানহীন মানুষ আর দেখেনি সে। তোর সোনাদানা ফেলে তুই চলে গেলি—খেয়াল পড়ল না তোর ! কার না খেয়াল পড়ে ! আর খেয়াল যদি পড়বে—একবার তো আসবি !

মানুষটা মরে গেল নাকি ? মরে গেল, না, ধরা পড়ে গেল ! বাইরে থেকে মানুষকে দেখে চেনা যায় না। যদি এমনই হয় সত্যদাস বাইরে যত সরল ভেতরে তা নয়, তাহলে ! মানুষটা কী কোনো মতলব নিয়ে মোহরগুলো এখানে ফেলে গেল ? সত্যিই কি ওগুলো চোরাই মাল ! ধরা পড়ার ভয়ে ফেলে গিয়েছে ? কিন্তু সত্যদাসকে দেখে। তো চোর-ছ্যাঁচড় মনে হয় না।

অপেক্ষা করতে করতে অধৈর্য, তার পর অস্বস্তি আর বিরক্তি। দিনের মধ্যে সারাক্ষণই যদি সত্যদাসের কথা ভাবতে হয় রাগ হওয়াই স্বাভাবিক।

“কী হল বলো তো ? মানুষটা মরে গেল নাকি ?”

যমুনা বলল, “মরতেই পারে। মানুষের মরণের কি ঠিক আছে !…ও আর আসবে না।”

যমুনার ধারণা সত্যদাস আর ফিরবে না ।

রঘুনাথ তবু অপেক্ষা করে করে ফাঙ্গুন-চৈত্রও কাটিয়ে দিল। বৈশাখ মাসে এদিকে এক মেলা হয়—শিব ঠাকুরের মেলা। নানা দিক থেকে লোক আসে, দোকানপত্র বসে, হরেকরকম জিনিস বিক্রি হয়। যদি সত্যদাসও আসে—তার শেকড়বাকড় বেচতে—এই আশায় বসে থাকল রঘুনাথ, লোকটা এল না, বৈশাখও ফুরলো।

সেদিন রঘুনাথ সন্ধেবেলায় স্নান করে কাপড় বদলে রামায়ণ নিয়ে বসেছে। পড়ছিল সুর করে করে, কাছেই ছিল যমুনা, হঠাৎ বলল, “তুমি কি ঘুমোচ্ছ ?”

রঘুনাথ ঘুমোয়নি। বলল, “কেন ?”

“একই জায়গা কতবার করে পড়ছ ?”

খেয়াল হল রঘুনাথের । বইয়ের দিকে তাকাল। সে পড়ছিল :

জন্মাবধি দুঃখ মোর কি কহিব আর।

তবু দুঃখ দেও দয়া না হয় তোমার ॥

ক্লেশে অবসন্ন তনু শুন গো তারিণী।

দয়া কর দয়াময়ী পতিতোদ্ধারিণী ।

রঘুনাথ বলল, “খেয়াল করতে পারছি না।”

যমুনা বলল, “তুমি আজকাল বেখেয়ালেই থাক। পড়তে বসে চুপ করে যাও। হয় কী তোমার ? ভাব কী ?”

রঘুনাথ চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ ; তার পর বলল, “ওই সত্যদাসই আমার মাথা খারাপ করে দিয়েছে। দু পাতা রামায়ণ পড়ব—তাও মন বসাতে পারি না। ওর কথা মনে পড়ে যায়।”

“ভেব না ওর কথা। —কতবার বলেছি.. !”

“কিন্তু মোহরগুলো, পাথর দুটো…”

“আমার বাপু মন বলছে, ওগুলো খাঁটি নয়। …তুমি যতই বলো সেকরার ছেলে তুমি, তোমার ভুল হবে না ; আমার কিন্তু বিশ্বাস হয় না ওগুলো খাঁটি। খাঁটি সোনা, হীরে পাথর কেউ ফেলে রেখে যায় না। তুমি ভুল করছ।”

“ভুল করার কথা তো নয়। “

“বেশ তো, একবার পরখ করিয়ে এসো না। … তবে আমি বলছি—ও-লোক আর আসবে না; তুমি দেখে নিও।”

জ্যৈষ্ঠ মাসটা আর অপেক্ষা করতে পারল না রঘুনাথ। তার ভুল হয়েছে কি হয়নি একবার দেখা দরকার। হতে পারে রঘুনাথ ভুল করেছে। সোনা-চেনার চোখ হয়ত তার আর নেই। সেই কবে বাবার আমলে সোনা দেখেছে, তার পর আর দেখল কোথায় ? এমন যদি হয়—রঘুনাথ যা সোনা বলে মনে করছে, তা নকল সোনা, সত্যদাসের ভেলকির খেলা দেখানোর মোহর—নকল, তাহলে এই দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনা অপেক্ষার কোনো মানেই হয় না। নকলের কী দাম !

শেষে রঘুনাথ যমুনাকে বলল, “আমি একবার শহরে যাই। সোনাটা যাচাই করে আসি। চাঁদুবাবুর দোকান চিনি। মানুষটি মন্দ নয়।”

“তাই যাও।”

“একটি গিনি মোহর নিয়ে যাব গো ! গরিব মানুষের পকেটে দুটি চারটি মোহর দেখলে সন্দেহ করবে। একটিই নিয়ে যাই।”

রঘুনাথ শহরে গেল। গেল বিকেল বিকেল। ফিরল রাত করে।

ফিরে এসে বলল, “যা বলেছিলাম। খাঁটি সোনা। নকল নয়।”

যমুনা আর কথা বলতে পারল না।

সাত

বর্ষার মুখে রঘুনাথ দেখল, ছ ’ছ’টি মাস শেষ। সেই পৌষ আর এই আষাঢ়। সত্যদাস এল না। সে আর আসবে না।

লোকটা যখন আর এল না, অকারণ অপেক্ষা করে কী লাভ ! রঘুনাথ তার দোকানটিকে এবার ধীরে ধীরে গুছিয়ে নিতে পারে। এতদিন তার টাকাপয়সা ছিল না। নিজেদের পেট ভরাতেই লাভের কড়ি খরচ হয়েছে। এখন সে একটু একটু করে দোকান বাড়াতে পারে। ঘরদোরের অবস্থাও ভাল নয়। মেরামতি দরকার। বর্ষা পড়েছে।

রঘুনাথ একদিন শহরে গিয়ে একটি মোহর বেচে এল।

সোনার কি এখন কম দাম !

সোনা বেচার টাকা পকেটে করে রঘুনাথ বাড়ি ফিরল। আসার সময় শাড়ি জামা কিনে আনল যমুনার জন্যে। আরও দু চারটে জিনিস সংসারের কাজে লাগবে বলে।

রাত্রে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কথা হল অনেক। আগে দোকানের কাজে হাত দেবে, না বাড়ির কাজে। দোকানটাই আগে বাড়ানো দরকার। জিনিসপত্তর আনতে হবে পাঁচ রকম, কম করে হলেও আনতে হবে ;লোকে যাতে জানে রঘুনাথের মুদির দোকানেও ডাল তেল নুন ছাড়াও অন্য পাঁচটা জিনিস পাওয়া যায়। তাছাড়া অল্পস্বল্প পালটে নিতে হবে দোকানটা, সাজিয়ে নেবে। ঘরদোরের কাজে এখনই বেশি কিছু খরচ করার দরকার নেই। রান্নাঘরের মাথার টিন আর কলঘরের আড়ালটা আপাতত সারিয়ে নিলেই চলবে।

বর্ষার মধ্যেই দোকানের কাজে হাত দিল রঘুনাথ।

অবুঝ বা বেহিসেবী নয় রঘুনাথ—তবু এখন যা দিনকাল—হাতের টাকা যেন খই মুড়ি, এক ফুঁয়ে উড়ে যায়। যা ভেবেছিল সে—তার সিকিভাগও হল না, টাকা ফুরিয়ে গেল।

চিন্তায় পড়ল রঘুনাথ।

যমুনা বলল, “নামলে যখন—তখন হাত গুটিয়ে নিয়ে লাভ কী ! আরও একটি বেচে এসো। নয়ত আগের খরচটুকুও জলে যাবে।”

ঠিক কথা। শুরু করেই থেমে যাবার অর্থ, না হল এটা না হবে ওটা।

রঘুনাথ বলল, “কিন্তু শহরে চাঁদুবাবুর কাছে আর কি যাওয়া উচিত হবে গো ? আগেরবার মিথ্যে বলেছি। তা একটা মোহর—না হয় আমাদের মতন গরিব ঘরে থাকল কোনো রকমে। বার বার মোহর আসে কেমন করে ? চাঁদুবাবু সন্দেহ করতে পারে।”

“তাহলে কী করবে ?”

“আমি ভাবছি, দরদাম তো জানা হয়েই গেল। বাইরে গেলেও ঠকাতে পারবে না। আমি বরং বর্ধমানে চলে যাই। সকালের গাড়িতে যাব—সন্ধেয় ফিরব।”

“তাই ভাল।”

দু তিনটে দিন কাটিয়ে রঘুনাথ গেল বর্ধমানে।

ফিরে এল হাসিমুখে। বলল, “গতবারের চেয়ে আরও তিরিশ টাকা বেশি পেলাম গো ! সোনার দাম নিত্য বাড়ে। দোকানের মালিকটিও ভাল। ”

রঘুনাথের হাতের পয়সা খরচ হতে লাগল তার দোকান বাড়াতে।

পুজোর আগেই রঘুনাথের তিনটি মোহর খরচ হয়ে গেল। ভালই লাগছিল তার। দোকানের বাহার কত খুলে গিয়েছে। আলকাতরা মাখানো ভাঙা টিনের ঝাঁপ ছিল দোকানের, বসতে হত একটা তিন-হাতি ঠেকো দেওয়া তক্তপোশে, জিনিসপত্র রাখার ব্যবস্থা ছিল না ভাল, কতক ময়লা টিন আর প্লাস্টিকের বয়াম। সরু একটা বেঞ্চি ছাড়া বসতে দেবার জায়গা ছিল না খরিদ্দারদের। এখন রঘুনাথ একে একে সব পালটে নিয়েছে। ঝাঁপ করেছে ভাল টিন দিয়ে, গদির তক্তপোশ পালটে নিয়েছে, গোটা দুই টিনের চেয়ার এনে রেখেছে দোকানে। আর এখন রঘুনাথের দোকানে জিনিসপত্তরও থাকে নানারকম, গুঁড়ো সাবানের প্যাকেট, টিকিয়া, দাঁতের মাজন, গায়ে-মাখা মাঝারি দামের সাবান, দুধের কৌটো, সস্তা সিগারেট, চিনি, বনস্পতি, খুচরো চা, এমনকি পেট ফাঁপার আরক, আয়না চিরুনিও।

অন্দর মহলেও এটা ওটার কাজকর্ম সারা হচ্ছে।

লোক বলত রঘুনাথ মুদির হল কী !

রঘুনাথ হেসে জবাব দিত, “ময়দা মাখলে তবেই না লুচি। আগে অতশত বুঝতাম না। দু মুঠো ময়দা মাখতাম, আপনাদের সেবা করতে পারতাম না। এখন কপাল ঠুকে মাখছি বেশি।”

কিন্তু টাকা ? টাকা আসছে কোথ্ থেকে ?

নিজের কপাল দেখাত রঘুনাথ। বলত, পরিবারের মামাটি চোখ বুজলেন হালিশহরে। ভাগ্নী ছাড়া কেউ ছিল না। মামাশ্বশুরের জমি-জায়গা ছিল সামান্য। বেচে দিলাম।।

গদাই কুণ্ডু, নীলু ঘাঁটি, প্রসাদরাও দোকান দেখল। হয়ত চোখও টাটালো।

পুজোর আগে যমুনা বলল, “এবার আমার ঘরবারান্দা সারিয়ে দাও। ভাঙা বেড়া আর রাখব না। হারু বেড়া বেঁধে দেবে নতুন। গাছপালাগুলো বাঁচাতে হবে তো !”

রঘুনাথ এখনও রামায়ণ পড়ে। বইয়ে মুখ রেখে হেসে হেসে বলল, “শোনো তবে— ! কঠিন রমণী-জাতি সৃজিলেন ধাতা। /অন্তরে পুড়িয়া মরে নাহি কয় কথা ॥/কেহ না বুঝিতে পারে স্ত্রীলোকের ছল । /পুরুষ ভোলাতে নারী ফাঁদে নানা কল ॥ ”

যমুনা বলল, “বাঃ ! আমি তোমায় ভোলাচ্ছি।”

হাসতে হাসতে রঘুনাথ বলে, “সে তো আগেই ভুলিয়েছ !… তা বলি কী। একটু সবুর করো। দোকানের জন্যে একটা বড় বাতি কিনতে যাব কলকাতায়। পেট্রম্যাক্স… !”

“কলকাতায় কেন ?”

“ঘুরে ফিরে আসব একটু। দু চার জায়গায় দেখব। হলধরবাবুদের কিছু কিছু মাল কলকাতা থেকে আসে। একটা লোক ঠিক করতে পারলে আমিও মাল আনাব কলকাতার মহাজনের কাছ থেকে।”

“টাকা ?”

“আরও তো আছে।”

যমুনা যেন খুশি হয় না। বলে, “নিঃশেষ হয়ে যাবে ?”

“মনের সাধ যখন মেটাতে শুরু করেছি, শেষ পর্যন্ত মেটাব। যমুনা, রঘুনাথ-মুদিকে লোকে বলত, নেড়াতলা। …এখন কথাটি নেই। সেদিন হলধরবাবুর বড় ছেলে শশধর এসেছিল। বলল, বাড়িতে দীননারায়ণের পুজো। বাবা একবার যেতে বলেছে। এসো একবার। আমাদের ওই একটিই পুজো বাড়িতে। পঞ্চাশ বছর হতে চলল।”

যমুনা বুঝতে পারল। হলধরবাবুরাও আজ ডাকতে আসে। হঠাৎ কী মনে হল যমুনার। বলল, “কলসির জল বাঁচিয়ে রেখে লাভ নেই। একদিন ফুরোবেই। তুমি কলকাতাতেই যাও। পড়ে পাওয়া ধন, ফুরোলেই বা কী ! তোমার-আমার সাধ-আশা তো মিটল !”

রঘুনাথ মাথা দোলালো। সত্যদাসের কথা এখন আর বড় একটা মনে পড়ে না। মানুষটা যদি নাই থাকে, মরে গিয়ে থাকে—তবে আর তার কথা ভেবে লাভ কী ! রঘুনাথ তো অন্যায় কিছু করেনি। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস সে অপেক্ষা করেছে—সত্যদাস আসেনি। রঘুনাথ চোর নয়। সে সত্যদাসের গাঁটের থলি চুরিও করেনি। তবে ? ভাগ্যবশে যা পেয়েছে তার জন্যে রঘুনাথকে দোষ দিয়ে লাভ নেই !

রঘুনাথের এখন সাধস্বপ্ন মিটতে শুরু করেছে। সে হাত সামলে বসে থাকবে নাকি ! যা আছে সবই তো এখন তার । সত্যদাস নেই।

আট

পুজো কাটল। অগ্রহায়ণও ফুরিয়ে গেল।

রঘুনাথের দোকান অনেক বেড়েছে। বাহারি হয়েছে। বিশু ছাড়াও একটা লোক দোকানে খাটছে এখন। দিনের বেলায় ভিড় থাকে। রাত্রে পেট্রম্যাক্স বাতি জ্বলে। ফটিকচাঁদ, কার্তিক রায়, মথুররা এসে বসে আড্ডা জমায় দোকানে। যাত্রাগানের গল্প করে, নাতুহাট কোলিয়ারিতে ডুলি ছিঁড়ে দুটো লোক মরেছে তার বৃত্তান্ত শোনায়, কার্তিকের মেয়ের বিয়ে মাঘ মাসে—দেনাপাওনার কথা এখনও চুকলো না—এইসব গল্পগাছা হয়।

অন্দরমহলও পালটে গিয়েছে রঘুনাথের। যমুনার অনেক সাধই মিটিয়ে দিয়েছে রঘুনাথ। ঘর সারিয়েছে, বারান্দা ঢেকেছে, রান্নাঘর ভাঁড়ারঘর তকতক করছে এখন; কলঘর তৈরি করিয়ে দিয়েছে নতুন করে। একটি মেয়ে এখন যমুনার সংসারে কাজকর্ম করছে।

রঘুনাথের অতৃপ্তি বলে আর কী থাকল ! সে সুখী !

পৌষের গোড়ায় শীত এসে পড়েছিল। এবার যেন জাঁকিয়ে শীত পড়বে। বর্ষাও কম হয়নি।

সেদিন ফটিকচাঁদরা উঠে গিয়েছে। দোকানের ছেলেগুলোও বাড়ি চলে গিয়েছে কখন। রঘুনাথ পেট্রম্যাক্স বাতিটা নিভিয়েছে সদ্য। দোকান বন্ধ করবে। এমন সময় কে যেন পা দিল দোকানে।

রঘুনাথ ঠিক বুঝতে পারেনি। জায়গাটা অন্ধকার মতন। “কে ?”

“বাবু ! আমি !”

গলার স্বরেই চমকে উঠল রঘুনাথ। লোকটাও দু পা এগিয়ে এসেছে।

“সত্যদাস !”

“হ্যাঁ বাবু ! নমস্কার !”

সত্যদাসের সেই একই চেহারা। রুক্ষ চুল, মুখে দাড়ি, এক কাঁধে তার ঝোলা, অন্য হাতে দড়িবাঁধা কাঠের বাক্স। এমনকি ছেঁড়াখোড়া ছাতাটিও তার বগলে। লোকটার গায়ে সেই কালো কোট। বাড়তির মধ্যে একটা ভুট-কম্বলের মাফলার রয়েছে গলায়।

সত্যদাস তার বাক্স নামাল। ঝোলাও নামিয়ে রাখল।

পেট্রম্যাক্স বাতি নিভে যাবার পর তফাতে একটা লণ্ঠনই শুধু জ্বলছিল।

“বাবু, আপনি ভাল আছেন ?”

রঘুনাথের গলায় তখন যেন কেউ ফাঁস পরিয়ে দিয়েছে। মুখে কথা আসছিল না। সত্যদাসকে দেখছিল। সত্যিই কি সত্যদাস এসেছে ! না, তার চোখের ভুল ! বিভ্রম ?

সত্যদাসই কথা বলল, “এই পথে ফিরছিলাম বাবু ! “আপনাকে বলেছিলাম না, এ-পথে ফিরলে আবার আসব।”

রঘুনাথ নিজেকে সামলে নিচ্ছিল। “কোথ্ থেকে আসছ ?”

“আসার কি নির্দ্দিষ্ট থান আছে বাবু ! ঘুরে ঘুরে আসা।”

“এখন কোথ্ থেকে আসছ ?”

“হৃদয়পুর থেকে। …আপনি ভাল আছেন ? মা জননী ?”

রঘুনাথ মাথা নাড়ল। ভাল আছে।

সত্যদাস তাকিয়ে তাকিয়ে দোকানটা দেখছিল। দেখতে দেখতে একটু যেন হাসল আপন মনে। “গত বছর এই সময়টিতে এসেছিলাম, বড় বৃষ্টি ছিল তখন— !”

রঘুনাথ কোনো কথা বলল না ; মাথা নাড়ল। সত্যদাসকেই দেখছিল। লোকটা কেন এল ? কী দরকার ছিল তার আসার ! চিতা থেকে মরা মানুষ উঠে আসে না, কিন্তু সত্যদাস যেন সেই ভাবেই এসে পড়েছে।

সত্যদাস বার দুই কাশল খুক খুক করে, গলা পরিষ্কার করল। তার পর বলল, “বাবু গলাটিতে ব্যথা হয়েছে। নতুন ঠাণ্ডা। একটু চা পাব ? মা জননীর সেই চায়ের কথাটি আমার মনে আছে। ভুলিনি।”

রঘুনাথ আর কী বলবে ! এগিয়ে গিয়ে লণ্ঠনটি আরও একটু জোর করে দিল। বলল, “বসো।”

অন্দরে এসে রঘুনাথ দেখল, যমুনা ঘরে। মোড়ায় বসে পায়ের সেবা করছে। শীতে তার পায়ের গোড়ালি, পাতা, আঙুল ফেটেফুটে হাঁ হয়ে যায়। ব্যথাও হয় খুব। দুধের সর আর নারকোল তেল মিশিয়ে এক মলম মতন করে পায়ে মাখে যমুনা।

রঘুনাথ স্ত্রীর কাছে এসে দাঁড়াল। দেখল যমুনাকে। পা নামিয়ে নিল যমুনা। তাঁতের শাড়ি, রঙিন জামা, সন্ধেবেলায় বাঁধা খোঁপা—যমুনাকে আজকাল ভালই দেখায়। মুখটাও কত পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। রঘুনাথ বলল, “ও এসেছে।”

যমুনা কিছু বুঝল না। তাকিয়ে থাকল। “কে ?”

“সত্যদাস।”

যমুনার যেন বিশ্বাসই হল না। দেখছিল স্বামীকে। “সত্যদাস এসেছে !”

“হ্যাঁ। এই মাত্র এল।”

উঠে দাঁড়াল যমুনা। চোখের পলক পড়ছিল না। শেষে বলল, “হঠাৎ তার আসার কী হল ? বেঁচে আছে !”

“দেখছি তো আছে !”

“কিছু বলল ?”

“না। এই তো এল। এখনও কিছু বলেনি। …একটু চা খেতে চাইছে। ঠাণ্ডা লাগিয়েছে, গলায় ব্যথা।” বলে রঘুনাথ কেমন হাসবার চেষ্টা করল সামান্য, “বলছে মা জননীর হাতের চায়ের কথা সে নাকি ভোলেনি।”

যমুনা খুশি হল না। বিরক্ত হয়েই যেন নিজের মনে মনেই বলল, “মা জননী !…এখন কী করবে লোকটাকে ?”

“দেখি। আগে তো একটু চা দাও। …কথাবার্তা বলুক ও ! তার পর দেখি—”

যমুনা চলে যাচ্ছিল। বলল, “তুমি কিছু বোলো না। …ও কি রাত্তিরে থাকবে, না, বিদেয় হবে !”

রঘুনাথ মাথা নাড়ল। “এই রাত্তিরে, ঠাণ্ডার মধ্যে আর যাবে কোথায় ! থাকতেই এসেছে। কাল হয়ত চলে যাবে।”

“তুমি কিন্তু নিজের থেকে ও-সব কথা কিছু বলবে না। …ও যদি বলে, বলবে তুমি জান না।”

যমুনা চলে গেল।

নয়

চা খাওয়া শেষ হয়ে এসেছিল সত্যদাসের। আরাম করেই চা খাচ্ছিল মাঝে মাঝে কাশছে, ঠাণ্ডা-লাগার কাশি।

রঘুনাথ হাত কয়েক তফাতে বসে।

সত্যদাস নিজেই বলল, “বুকের খাঁচাটি কমজোরি হয়ে গেছে, বাবু ! অল্পতেই কাবু করে দেয়।”

“তোমার সেই কম্পজ্বর ?”

“ও কি আর ছাড়ে, লেগে আছে।”

“তা তোমার শেকড়বাকড় নিয়ে চলছে কেমন ?”

“চলছে মশায়, আগেও যা এখনও তাই। এই দেখুন না—ক’টি শেকড়ের জন্যে পঞ্চকোটে গিয়ে একটি মাস বসে থাকলুম। যেটি চাই সেটি পাই কই ! একটি শেকড় আছে বাবু, আমরা বলি যমরিষ্টি, প্রসবকালে মা জননীদের বড় উপকারে আসে। এ আপনার পুরনো শেকড়। পাই কই ! একটি আমি যোগাড় করেছি—এত্তটুকু—” বলে সত্যদাস নিজের ডান হাতের কড়ে আঙুলটি দেখাল।

রঘুনাথ অন্যমনস্কভাবে বলল, “সারা বছরটি তবে ঘুরে ঘুরেই কাটালে ?”

“ওটি তো আমার কপালে লেখা। অশ্বমেধের ঘোড়া বাবু, কপালের লিখনটি যে ফেলতে পারি না। …দিন, একটা বিড়ি দিন।”

রঘুনাথ বিড়ির বদলে সস্তা সিগারেট দিল একটা। বলল, “কাশির মধ্যে ধোঁয়া খাবে ?”

“দু তিনটি টান…” বলে সত্যদাস সিগারেট হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। হাসল নিজের মনে। “এটি খেয়ে হাতমুখটি ধুয়ে ফেলি বাবু। রাতটুকু আপনার এখানেই কাটিয়ে যাই। গতবারে বড় সোয়াস্তিতে ছিলাম। মানুষটি আপনি বড় ভাল। মা জননীও সাক্ষাৎ লক্ষ্মী।”

রঘুনাথ সারাক্ষণই অস্বস্তি বোধ করছিল। সত্যদাসের কাছাকাছি বসে থাকতে তার অস্বস্তি হচ্ছে, বিরক্তিও লাগছিল। তার কেমন যেন ভয়ও করছে। যথাসম্ভব নিজের অস্বস্তি, বিরক্তি, বিতৃষ্ণা, ভয় সামলে রেখে সে চেষ্টা করে যাচ্ছিল স্বাভাবিক হবার।

রঘুনাথ বলল, “এসেছ যখন তখন রাতটুকু থাকবে বইকি গো ! থাকবে ! …তা আমায় বাপু এবার একবার উঠতে হবে। কাপড়-চোপড় পালটাব। একটু পুজোআর্চা… !”

“আপনি আসুন, বাবু ।

“তুমি বরং ভেতরে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে নেবে চলো। সাফসুফ হয়ে এখানে এসে বসো। আমি আমার কাজটি সেরে ফেলি।”

সত্যদাস বলল, “চলুন তবে যাই।”

পুজোপাঠে মন বসল না রঘুনাথের । রামায়ণ আর ভোলাও হল না।

বিছানায় বসে বসে রঘুনাথ সিগারেট খাচ্ছিল। যমুনা কাছাকাছি দাঁড়িয়ে। কথা বলছিল দু’জনে নিচু গলায়। ঘরের জানলা বন্ধ । দরজার একটি পাট খোলা, অন্যটি ভেজানো। বাতি জ্বলছে একপাশে।

যমুনা বলল, “তুমি কোনো কথাটি বলবে না। সাধ করে পা বাড়াতে যেও না গর্তে।… তোমার কিসের দোষ ! তুমি চোরও নও, বাটপাড়ও নও। চুরি করতে যাওনি তুমি, ছিনিয়েও নাওনি। কে কী ফেলে গেছে, তার দোষ তোমার নয়। তবে ?”

রঘুনাথ বলল, “আমি তো দিনের পর দিন—মাসের পর মাস অপেক্ষাও করেছি ওর জন্যে। ও যদি না আসে আমি কী করব !…আমি তো মানুষ ! কতদিন আর ওই সোনা বাক্সে ফেলে রেখে বসে থাকব ! ঠিক কিনা বলো ?”

যমুনা আর কী বলবে ! স্বামী তার ঠিক কথাই বলছে। সত্যদাস যা ফেলে গিয়েছে, সেটা তার দোষে। সে ফেলে-যাওয়া জিনিস নিতে আসেনি মাসের পর মাস, তার কোনো ঠিকঠিকানা ছিল না যে খোঁজ করবে লোকটার। আত্মীয়জনের কথাও তো বলে যায়নি যে খোঁজ-খবর করা যায়। বাউণ্ডুলে লোকটার কেউ তো নেই !…কোনো দোষ নেই তার স্বামীর। যমুনা বলল, “কোনো কথাই তোমায় আগ বাড়িয়ে বলতে হবে না ওকে। পথে পড়ে থাকা জিনিসের কোনো মালিকানা থাকে না। এ তো আমাদের ঘরে পেয়েছি।”

রঘুনাথ মাথা নাড়ল। বলল, “আমি নিজের থেকে কিছু বলব না।”

“লোকটা মরে গেলেই পাপ চুকতো। আবার এল কেন ?”

“আমাদের বরাত। ”

যমুনা যেন রাগে জ্বালায় জ্বলে যাচ্ছিল। বলল, “আমার যা হচ্ছে ! শয়তানি করতে এসেছে যেন লোকটা। বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করে। পাজি, নচ্ছার। কেন এসেছিস তুই ? কে তোকে আসতে বলেছে ! আসবি যদি আগে এলেই পারতিস। শয়তান। হাড় হারামজাদা।”

রঘুনাথ আর বসে থাকল না। উঠে পড়ল। সত্যদাস একা বসে আছে দোকানঘরে। বলল, “দুটি খাবার ব্যবস্থা করো তাড়াতাড়ি। ওর কাছে বসে বক বক করতে আমার ভাল লাগছে না। দুটো খাইয়ে দাও। শুয়ে পড়ুক ও। সকালে বিদেয় হবে।”

খাওয়া-দাওয়া শেষ হবার পর দোকানঘরে নিজের শোবার ব্যবস্থা করতে করতে সত্যদাস বলল, “এবার আপনার দোকানটি বেশ হয়েছে, না ?”

রঘুনাথ তাকাল। সত্যদাস কি কোনো খোঁচা দিচ্ছে ? মানুষটা মুখ নিচু করে তার ঝোলা থেকে চাদর বার করছে—মুখ দেখা গেল না ওর।

সত্যদ সই বলল, “দোকানটি বাড়িয়েছেন অনেক। মালপত্তরও রেখেছেন বড় দোকানের মতন। বেশ লাগল, বাবু।”

“ও-ই… যা পারলাম”, রঘুনাথ আমতা আমতা করে বলল। তার ভয় হচ্ছিল, সত্যদাস এখুনি বুঝি টাকার কথা তুলবে ! জিজ্ঞেস করবে—এত টাকাকড়ি পেলেন কোথায় ?

সত্যদাস অন্য কথা বলল, “আপনাদের ঘরটিও সারিয়ে-সুরিয়ে নিয়েছেন। তখন বোধ হয় আধখানা ছিল, এখন পুরো করে ফেলেছেন। ভাল কবেছেন, বাবু ! মা জননীর কষ্টটি কমেছে। লক্ষ্মীশ্ৰী আছে মা জননীর মুখে। উনি সুখী থাকলেই সংসারের সুখ। মশায়, ছোট মুখে, মুখ্যুসুখ্যু মানুষের মুখে বড় কথা মানায় না। তবু বলি—রামচন্দরকে দেখুন। সীতার কপালটি পুড়েছিল বলে বেচারি রাম সারা জীবনটিই দুঃখী থেকে গেলেন।”

রঘুনাথের মনে হচ্ছিল সে যেন কোনো নদীর ধারে ভাঙা পাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এখুনি পায়ের তলা থেকে মাটি খসে যাবে, আর অগাধ জলে ডুবে যাবে সে। সত্যদাসের সামনে আর বসে থাকতে সাহস হচ্ছিল না আর। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে উঠছিল। বুকে অস্বস্তি হচ্ছে।

“আমি উঠি গো ! সারাদিন দোকান সামলাতে হিমসিম খাই। দুটি মুখে দিয়ে শুয়ে পড়ব !” রঘুনাথ হাই তুলল তার ক্লান্তি বোঝাতে।

সত্যদাস বলল, “ছিছি, আমার জ্ঞানগম্যি কম বাবু ! আপনি আসুন।”

উঠে পড়ল রঘুনাথ। “তোমার কোনো অসুবিধে হবে না তো ?”

“না না, কিসের অসুবিধে ! এমন আরামটি পাব কোথায় ?”

“আমি তবে আসি। …কালই কি তুমি— ?”

“এক্কেবারে ভোরে ভোরে। প্রত্যুষ-ভোরেই চলে যাব, বাবু। একটি জায়গায় যেতে হবে । …আমি বড় ঘুমকাতুরে। যদি না উঠতে পারি দয়া করে আমায় ডেকে দেবেন।”

“দেব।”

বাতি নিভিয়ে বিছানায় শুতে এসে যমুনা বলল, “একটিবারও কথাটি তুলল না গো ?”

অন্ধকারেই তাকিয়ে থাকল রঘুনাথ। “না।”

“আশ্চর্য !”

জবাব দিল না রঘুনাথ।

সামান্য পরে যমুনা বলল, “তবে ও জিনিস ওর নয়।”

রঘুনাথ যেন বিরক্ত হল। “কার তবে ?”

যমুনা কী বলবে ! কথা বলল না। শেষে যেন নিজেদের ভোলাবার জন্যে বলল, “আমার কি মনে হয় জানো ! সত্যদাস হয়ত ভাবছে, জিনিসগুলো ও অন্য কোথাও হারিয়ে ফেলেছে। এখানে ফেলে গেছে ভাবলে—একবার অন্তত বলত ! ভালই হয়েছে। আমাদের সন্দেহ করল না যখন—আমরা বাঁচলুম।”

রঘুনাথ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “মুখে না বলুক ওর চোখ তো সব দেখল !”

“চোখ অনেক কিছুই দেখে ! চোখ দিয়েই কি সংসার !”

রঘুনাথ চুপ করে থাকল।

রাত বেড়ে উঠছিল। শীতও বাড়ছে। যমুনা বুঝি ঘুমিয়ে পড়ল। রঘুনাথ ঘুমোতে পারছিল না।

দশ

একেবারে সদ্য ভোরে সত্যদাস জেগে উঠেছে।

রঘুনাথই তাকে ডেকে দিয়েছে।

গোছগাছ সেরে হাতেমুখে জল দিয়ে সত্যদাস চলে যাচ্ছে দেখে রঘুনাথ বলল, “বাইরে বড় কুয়াশা হে ! রোদও এখন উঠল না। বাসী মুখেই চলে যাবে ! আর-একটু বসলে তোমার মা জননীর হাতের চা পেতে।”

সত্যদাস বলল, “না, বাবু, আজ আর উপায় নেই। মা জননীকে আমার নমস্কার জানাবেন।” বলতে বলতে সত্যদাস মাফলারটা মাথা কানে জড়িয়ে নিল। তার কপাল, কান, গালের অর্ধেকটা ঢাকা পড়ে গেল। মুখ দেখা যাচ্ছে না পুরোপুরি ।

“আসি বাবু !” বলে দু হাত তুলে নমস্কার জানাল।

দোকানের বাইরে এসে দাঁড়াল সত্যদাস। রঘুনাথ তার পেছনে। সকালের কুয়াশায় মাঠঘাট ঢেকে আছে। গাছপালা ঘাস হিমে ভেজা।

সামান্য দাঁড়িয়ে থাকল সত্যদাস। তারপর পা বাড়াল।

রঘুনাথ হঠাৎ ডাকল, “সত্যদাস ?”

ঘাড় ফেরাল সত্যদাস। তাকাল।

বলতে চাইছে, পারছে না, দ্বিধা অস্বস্তিতে কেমন যেন কথা আটকে যাচ্ছিল, তবু শেষ পর্যন্ত রঘুনাথ বলল, “তুমি কি এখানে কিছু ফেলে গিয়েছিলে আগের বার ?”

সত্যদাস তাকিয়ে থাকল। পাতা যেন আর পড়ে না চোখের। শেষে একটু আশ্চর্য হাসি ফুটলো তার ঠোঁটে। চোখ দুটিতেও হাসি লাগল। “কেন বাবু ?”

“কী ফেলে গিয়েছিলে ?”

এদিক ওদিক তাকাল সত্যদাস। তারপর আকাশের দিকে। মাথা তুলে আকাশের দিকটা দেখাল। “উনি জানেন !”

“উনি ? বিধাতা পুরুষ ?”

“উনি দিনমণি। দিনটি উনি সাথে করে নিয়ে এলেন। উনি অস্ত গেলে আঁধার। রাত্রিটি আসবে। এটি দিন, ওটি রাত। ইনি আলো, উনি আঁধার। বাবু শাস্ত্রে বলে দিন-রাতের এই মিথুন অনন্তকালের। একটি সাদায় আলোয় ভরা, অন্যটি কালোয় আঁধারে কৃষ্ণবর্ণ। এই দুটিরও চক্ষু আছে।”

রঘুনাথ চমকে উঠল। সত্যদাসের রেখে যাওয়া আঙটি দুটির কথা মনে পড়ল। সাদা অর কালো। দুটিরই মূল্য ছিল। রঘুনাথ যে বেচে দিয়েছে দুটি পাথরই। অদ্ভুত এক আতঙ্ক অনুভব করছিল রঘুনাথ। বলতে যাচ্ছিল, তুমি তো ছ’টি মোহরও ফেলে গিয়েছিলে— !

রঘুনাথের মনের কথা যেন বুঝে ফেলেছিল সত্যদাস। কিংবা নিজেই সে মোহরের কথা বলত। মুখের ওপর থেকে কুয়াশায় ভিজে ভাবটা মুছে নিতে নিতে সত্যদাস বলল, “বাবু, ওই দিন আর রাতটি অনন্তকাল ধরে মিথুন করছে। আর আমাদের ধরণীটিকে ঘিরে ধরে নৃত্য করে চলেছে ছ’টি ঋতু। দিন-রাত আর ঋতুর অগোচরে কিছু থাকে না মশায়। পাপ নয়, লোভ নয়, অন্যায় অধর্ম—কোনোটিই নয়। এরা সবই দেখে, এদের চক্ষুটির কথা আমরা যেন ভুলে থাকি বাবু। আমাদের সকল দুষ্কর্মই এঁরা দেখেন। …আমি মুখ্যুসুখ্যু মানুষ। ধর্মকথা আমার মুখে মানায় না। …আপনার দুঃখটি আমি বুঝলাম। আসি মশায় !” সত্যদাস আবার নমস্কার জানাল হাত জোড় করে। তারপর চলে গেল।

রঘুনাথ দাঁড়িয়ে থাকল স্তব্ধ হয়ে। কুয়াশার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে ধর্মপুরের সত্যদাস যেন কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল। রঘুনাথের চক্ষুদুটি জলে ভরে উঠেছে তখন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *