আমরা তিন প্রেমিক ও ভুবন

আমরা তিন প্রেমিক ও ভুবন

নদীর চরায় শিবানীর চিতা জ্বলছিল।

আমরা তিন বিগতযৌবন বন্ধু শিমুলগাছের তলায় বসেছিলাম। ফাল্গুনের শেষ, উলটো টান ধরে গিয়েছিল দুপুরে। রোদ পাখা গুটিয়ে নিতে শুরু করেছে, নদীর বাঁকের মাথায় আকাশে সূর্য হেলে পড়ছিল।

ভুবন গরুর গাড়ির ওপর বসে, গাড়িটা অর্জুনগাছের ছায়ায় দাঁড় করানো, গরু দুটো গাছগাছালির ফাঁকে শুয়ে ছিল। শিবানীর মুখাগ্নি শেষ করে ভুবন খানিকক্ষণ চিতার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল, রোদ আর আগুনের ঝলসানি গায়ে মাখেনি, তারপর গাড়িতে গিয়ে বসেছে। হাঁটুর ওপর মাথা রেখে মুখ আড়াল করে সে বসে ছিল, কদাচিৎ মুখ তুলছিল, তুলে শিবানীর চিতা দেখছিল।

চিতার কাছাকাছি, নদীর ভাঙা পাড়ের আড়ালে চার-পাঁচটি ছেলেছোকরা আর নিত্যানন্দ। তারা মাথায় গামছা বেঁধে, ভিজে তোয়ালে মুখে ঘাড়ে বুকে বুলিয়ে শবদাহের তদারকি করছিল। পুরুতমশাই আর ছোটকিলাল অনেকটা তফাতে, মাটির কয়েকটি সরা ও কলসি সামনে নিয়ে গাছের ছায়াতেও ছাতা খুলে বসে আছে।

আমরা মাঝদুপুরে এসেছি। তখন চতুর্দিক ধুধু করছিল। গরম বাতাস গায়ে মুখে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছিল। এতক্ষণে যেন সব ক্রমশ জুড়িয়ে আসার মতন ভাব হয়েছে। বালিভরা নদীর তাপ মরে আসছিল, শীর্ণ জলের ধারাটি শিবানীর চিতার পাশ দিয়ে বয়ে যেতে যেতে কদাচিৎ বাতাসে কিছু শীতলতা ছড়িয়ে দিচ্ছিল।

আমরা তিন বিগতযৌবন বন্ধু শিমুলতলায় বসে শিবানীর সৎকার প্রত্যক্ষ করছিলাম।

সিগারেটের টুকরোটা দূরে ছুঁড়ে দিয়ে অনাদি বলল, “শেষ হতে হতে বিকেল পড়ে যাবে।” বলে সে শিবানীর চিতার দিকে তাকিয়ে থাকল।

কমলেন্দু পা ছড়িয়ে আধশোয়া হয়ে বসে ছিল, সে আস্তে আস্তে মাটিতে শুয়ে পড়ল, আকাশমুখো হয়ে বোধহয় শিমুলের ফুল দেখবে।

আমি আর-একবার ভুবনের দিকে তাকালাম। ভুবন কুঁজো হয়ে বসে, হাঁটুর ওপর মাথা, দু’ হাতে মুখ আড়াল করা। অনেকক্ষণ সে ওই একইভাবে বসে আছে। তার পক্ষে এটা স্বাভাবিক: শিবানী ওর স্ত্রী। তবু আমার মনে হল, ভুবনের এতটা শোকাভিভূত ভাব ভাল দেখাচ্ছে না। সে জোর করে তার শোকের মাত্রার গভীরতা দেখাতে চাইছে। এতটা শোক পাবার কারণ তার নেই। তবু এই শোক কেন? সে কি আমাকে ঈর্ষান্বিত করতে চায়? কিংবা আমাদের তিনজনকেই?

কথাটা আমার এখন বলা উচিত নয় বুঝতে পেরেও যেন ভুবনের শোকে খুঁত ধরাতে বললাম, “শিবানীর সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছে মাসখানেক আগে। ভুবনের ওপর কী জন্যে যেন রেগে ছিল। ওর শরীর স্বাস্থ্যের কথায় দুঃখ করছিল…”

আমার কথায় অনাদি মুখ ফিরিয়ে দূরে ভুবনের দিকে তাকাল। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে শেষে অন্যমনস্কভাবে বলল, “আমরা বোধ হয় না এলেই ভাল করতাম।”

আমরা চুপচাপ, অনাদির কথাটা ভাবছিলাম। সবুজ একটা বুনো পাখি চিকির-চিক করে ডাকতে ডাকতে চোখের পলকে আমাদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে চলে গেল। কমলেন্দু সব জেনেশুনে বুঝেও হঠাৎ বলল, “কেন? আমরা না এলে কি ভাল হতো?”

অনাদির ধীরস্থির প্রকৃতির, আস্তে আস্তে নিচু গলায় সে কথা বলে। সামান্য অপেক্ষা করে সে বলল, “ভুবন হয়তো অস্বস্তি বোধ করছে। ঠিক এ সময়ে সে বোধহয় আমাদের বাদ দিয়েই তার স্ত্রীকে ভাবতে চেয়েছিল।”

“ভাবুক; কে তাকে বারণ করেছে—” খানিকটা অবহেলা, খানিকটা উপহাসের গলায় আমি বললাম।

অনাদি আমার দিকে তাকাল। “আমরা ওর চোখের সামনে বসে থাকলে ভুবনের পক্ষে আমাদের বাদ দিয়ে শিবানীকে ভাবা মুশকিল।”

কমলেন্দু শুয়ে শুয়ে বলল, “বেশ তো, তা হলে সাত-সকালে লোক দিয়ে আমাদের বাড়িতে শিবানীর মারা যাবার খবর পাঠানো কেন! না পাঠালেই পারত।”

“কিংবা বলে দিলেই পারত আমরা যেন না আসি,” আমি বললাম।

“খবর না দিলে খারাপ দেখাত, বোধহয় ভদ্রতা করে…”

“আমরাও ভদ্রতা রক্ষা করেছি। শিবানী আমাদের বন্ধুর স্ত্রী, তার সৎসারে না আসাই কি ভাল দেখাত!” কমলেন্দু বলল।

“বন্ধুর স্ত্রী শুধু কেন, শিবানী আমাদের…কি বলব…বান্ধবী, যাই বলো…সেও তো আমাদের কিছু একটা ছিল। সে মারা গেছে, আমরা শ্মশানে আসব না?” আমি বললাম।

অনাদি আর কথা বাড়াল না। পকেট হাতড়ে আবার সিগারেট বের করল। আমাদের দিল। নিত্যানন্দ চিতার কাছে গিয়ে খোঁচাখুঁচি করতে কাঠ ফেটে শব্দ হল। চেঁচিয়ে কি যেন বলল, তার সহচর দুটি ছেলে তার কাছে গেল। ভুবন মুখ তুলে চিতার দিকে তাকিয়ে আছে। চিতার ওপর কয়েকটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ যেন আতস বাজির মতন বাতাসে উড়ে ফেটে গেল, সামান্য ছাই উড়ল। একটি ছেলে কয়েকটি কাঠের টুকরো ফেলল চিতায়।

ভুবন চিতার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে উদাসভাবে নদী আকাশ আর জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর এক সময় আমাদের দিকে মুখ ফেরাল। আমাদের মধ্যে দূরত্ব সত্ত্বেও আমার সঙ্গে তার চোখাচোখি হল। ভুবন মুখ ফিরিয়ে নিল; নিয়ে হাঁটুর ওপর কনুই রেখে গালে হাত দিয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকল। ওর এই ভঙ্গি আমার ভাল লাগছিল না। মনে হল, আমাদের যেন সে আর দেখতে পারছে না; বা দেখেও দেখতে চাইছে না—উপেক্ষা করছে।

বাড়াবাড়ি দেখলে আমার রাগ হয়, ভুবনের এতটা বাড়াবাড়ি দেখে আমার কেমন রাগ আর বিরক্তি হচ্ছিল। আতিশয্য কেন? আমরা কি জানি না শিবানীর সঙ্গে সম্পর্ক কি ছিল। তবে? তবু ভুবন এখন ভাব দেখাচ্ছে যেন আমরা কিছু জানি না, যেন শিবানী তার সর্বস্ব ছিল, শিবানীর মৃত্যুতে তার বিশ্বভুবন অন্ধকার হয়ে গেছে!

দুঃখের মধ্যেও আমার হাসি পাচ্ছিল। ভুবনের বোকামির শেষ নেই। তুমি যে কাকে এত শোক দেখাচ্ছ, ভুবন, তবু যদি শিবানীর ভালবাসা পেতে! শিবানী তোমায় ভালবাসেনি, যদিও শেষ পর্যন্ত তোমায় বিয়ে করেছিল। তুমি স্বামী হয়েছিলে বলেই যা পাবার পেয়ে গেছ, তা ভেব না। বরং শিবানীর ভালবাসা বলতে যা, তা আমি পেয়েছিলাম।

ফাল্গুনের দমকা বাতাস এল দক্ষিণ থেকে, নদীর তপ্ত বালির ওপর দিয়ে ঘূর্ণি তুলে ঘোলাটে বাতাস নাচতে নাচতে জঙ্গলের দিকে চলে গেল। ভুবন আবার হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে হাত আড়াল করে বসল। যেন সে কাঁদছে।

ভুবনের এত আতিশয্য আর আমার সহ্য হচ্ছিল না। অনাদি আর কমলেন্দুকে বললাম, “আমরা একটু আড়ালে গিয়ে বসি না হয়—” বলে উপহাসের গলায় মন্তব্য করলাম, “ভুবনবাবুর আমাদের হয়তো সহ্য হচ্ছে না, অনাদি যা বলল।”

কমলেন্দু শিমুলফুল দেখছিল, নাকি আকাশ, কে জানে! সে বলল, “তাতে যদি ভুবন শান্তি পায় আমার আপত্তি নেই। …আমার বরং শিবানীর চিতার কাছে বসে ওদিকে তাকিয়ে থাকতে খুব খারাপ লাগছে

“তাই বুঝি শুয়ে আছ, আকাশ দেখছ?”

কমলেন্দু কথার জবাব দিল না।

অনাদি এবার বলল, “আমারও কেমন অস্বস্তি লাগছে। …একটু আড়ালে দূরে গিয়ে বসাই ভাল। তাছাড়া এবার এদিকে রোদ ঘুরে গেছে, বসে থাকা যাবে না।”

আমরা আরও অল্পক্ষণ বসে থেকে শিমুলতলা ছেড়ে উঠে পড়লাম। তারপর তিন বন্ধু শিবানীর চিতা এবং ভুবনের দৃষ্টি থেকে সরে অন্য দিকে চলে যেতে লাগলাম।

খানিকটা দূরে এসে আমরা বসলাম। এখানে ঘন ঝোপঝাড় আর ছায়া, মাথার ওপর নিমগাছ, সামনে কুলঝোপের ওপর দিয়ে নদী দেখা যায়। মাঝে মাঝে পাখির ডাক ছাড়া আর কিছু কানে যাচ্ছে না, নদীর বালি ছাড়া অন্য কিছু চোখেও পড়ছে না। এখানে যে যার মতন আরাম করে বসলাম, বসে নিশ্চিন্ত হলাম।

কিছুক্ষণ আমাদের মধ্যে ছোটখাটো দু-চারটি কথার বিনিময় হল; শিবানী এভাবে, আচমকা একটা অসুখে মারা যাওয়ায় আমরা দুঃখিত। শেষে আমরা একে একে কেমন নীরব হয়ে গেলাম। নদীর দিকে অপরাহ্ণের স্তিমিত ভাব নামছিল। আমরা তিনজনেই কখনো নদী, কখনো শূন্যতা, কখনো গাছপালা, কখনো পায়ের তলায় ঘাস-মাটি দেখছিলাম। এবং পরিপূর্ণ নীরব হয়ে গিয়েছিলাম।

অনেকক্ষণ এইভাবে বসে থাকার পর হঠাৎ কমলেন্দু কেমন করে যেন নিশ্বাস ফেলল। দীর্ঘ নিশ্বাস নয়, তার চেয়েও যেন গভীরতাপূর্ণ ছিল; তার নিশ্বাসের শব্দে আমরা ওর দিকে সচকিত হয়ে তাকালাম।

কমলেন্দু সুপুরুষ। তার মুখ এখনো দু’ মুহূর্ত তাকিয়ে দেখার মতন। লম্বা ধরনের কাটাকাটা মুখ, রঙ ফরসা, নাক এবং চোখ বেশ তীক্ষ্ণ। তার ফরসা সুন্দর মুখে আমরা কোথায় যেন এক বেদনা দেখতে পেলাম।

অনাদি বলল, “কি হল?”

কমলেন্দু অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে থাকল কয়েক মুহূর্ত, তারপর আমাদের দিকে তাকাল। শেষে বলল, “না, কিছু নয়…কই, দেখি একটা সিগারেট…”

পকেট থেকে আমার সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে ওকে দিলাম। নিজে একটা সিগারেট নিয়ে ও আমাদের দু’জনকে দুটো সিগারেট দিল। দেশলাই জ্বেলে সিগারেট ধরিয়ে অনেকটা ধোঁয়া গলায় নিল। তারপর আমাদের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “এ দিকটায় পালিয়ে এসে ভালই হয়েছে। …সাম হাউ, আমার শিবানীর চিতার সামনে বসে থাকতে ভাল লাগছিল না। …হতে পারে, তখন আমি বোকা ছিলুম, বয়স কম ছিল; তবু এ কথা তো ঠিক, শিবানী আমাকে ভালবেসেছিল। …আমার চেয়ে বেশি সে আর কাউকে কখনো ভালবাসেনি।”

আমরা তিন বিগতযৌবন বন্ধু পরস্পরের কথা জানতাম, এবং ভুবন, আমাদের চতুর্থ বন্ধুও, সব জানত। কমলেন্দুর সঙ্গে শিবানীর মেলামেশা ভালবাসার কথা আমার অজানা নয়; কিন্তু এই মুহূর্তে সে যে দাবীটুকু জানাল তাতে আমার আপত্তি হল। সবচেয়ে বেশি ভালবাসার কথা উঠলে শিবানীর কাছে আমার চেয়ে আর কেউ বেশি পেয়েছে এ আমি বিশ্বাস করি না। একেবারে সরাসরি না হলেও, কমলেন্দুকে শোনাবার জন্যে, একটু ঠাট্টার গলা করে বললাম, “আমার তো মনে হয়, ওটা আমিই এক সময়ে পেয়েছি।”

ধীরস্থির শান্তশিষ্ঠ মানুষ হলেও অনাদি এখন হঠাৎ কেমন অসন্তুষ্ট ও বিরক্ত হল। ঠোঁট থেকে সিগারেট সরিয়ে বলল, “এ-সব তোমাদের মনের ধারণা, কল্পনা। আমার সঙ্গে শিবানীর ঘনিষ্ঠতা এমন সময়ে যখন আমরা দু’জনে কেউই বাচ্চা ছিলাম না। সিরিয়াসলি যদি কাউকে সে ভালবেসে থাকে, আমি সে দাবী সবচেয়ে বেশি করতে পারি।”

অনাদির কথায় আমি বা কমলেন্দু, আমরা কেউই খুশি হলাম না। আমাদের কথায় অনাদিও হয়নি। তিনজনে আজ আমরা যে দাবী করছি সে দাবী ছেড়ে দেওয়া কেন যেন আমাদের সাধ্যাতীত বলে আমার মনে হল। আমাদের তিনজনেরই বয়েস হয়েছে, চল্লিশের এপারে চলে এসেছি। আমাদের তিনজনেরই স্ত্রী আছে, সন্তান আছে। আজ শিবানীর সঙ্গে আমাদের প্রেম নিয়ে অকারণ গল্প করার বা মনোমালিন্য সৃষ্টি করার কোনো অর্থ ছিল না। তবু, আমরা তিনজনেই এমন এক দাবী জানাচ্ছিলাম যেন সেই দাবী প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে আমাদের কোনো বিশেষ সুখ ও অহংকার প্রকাশ করা যায় না।

কমলেন্দু ঘন ঘন কয়েকটা টান দিল সিগারেটে, সে অনাদির দিকে এবং আমার দিকে বার বার তাকাল, তারপর সিগারেটের টুকরোটা ফেলে দিয়ে বলল, “আমার সঙ্গে শিবানীর ওপর-ওপর মেলামেশা তোমরা দেখেছ; আমি তোমাদের সে-সব গল্পও বলতাম; চিঠিপত্রও দেখিয়েছি; কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমাদের কি হয়েছিল তোমরা কি করে জানবে?”

“ভেতরে ভেতরে যা হয়েছে তাও তো পরে তুই বলেছিস,” আমি বললাম।

“না, আমি সব বলিনি। কিছু না-বলা আছে, সামথিং সিকরেট…”

“সে-রকম গোপনীয়তা আমারও আছে, কমল।” অনাদি বলল।

আমারও গোপনীয়তা ছিল। আমরা তিন বাল্যবন্ধু পরস্পরের কাছে জীবনের কোনো কিছুই বড় একটা অগোচর রাখতাম না। শিবানীর বেলায়ও কিছু রাখিনি—রাখতে চাইনি, তবু শেষ পর্যন্ত নিশ্চয় কিছু রেখেছিলাম, নয়তো আজ এ-কথা উঠত না। শিবানীর সঙ্গে মেলামেশার সময়ও আমরা কেউ কারুর প্রতি ঈর্ষান্বিত হইনি। কেন না—কমলেন্দু শিবানীর সঙ্গে কৈশোরে ও প্রথম যৌবনে মেলামেশা করেছিল, করে শিবানীর কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিল; শিবানীর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা একেবারে যৌবনবেলায়; আমার সঙ্গে শিবানীর ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার পর অনাদির সঙ্গে শিবানীর সম্বন্ধ গড়ে উঠেছিল। শিবানীও আমাদের বাল্যকালের বান্ধবী। তার সঙ্গে আমাদের যা যা হয়েছে তা পরস্পরকে আমরা জানিয়েছি।স্বভাবতই কোনো ইতর ঈর্ষা আমাদের থাকার কথা নয়, তবু যদি কোনো ঈর্ষা থেকে থাকে বা হয়ে থাকে তা তেমন কিছু নয়। নয়তো আমাদের মধ্যে মনোমালিন্য ঘটত এবং আমাদের এই বন্ধুত্ব বজায় থাকত না। এতকাল যা হয়নি আজ তা হওয়া সম্ভব নয়, উচিতও নয়। শিবানীকে নিয়ে কোনো বিরোধ আমাদের মধ্যে হয়নি; সে জীবিত থাকতে যা হল না, আজ যখন সে আমাদের মধ্যে আর নেই—তখন তা হবার কোনো সঙ্গত কারণ থাকতে পারে না।

আমার কী রকম যেন মনে হল। কমলেন্দুর দিকে তাকালাম, তারপর অনাদির দিকে। আমার মনে হল, ওরা নিজেদের গোপনীয়তাকে তাদের প্রতি শিবানীর চরম ভালবাসার নিদর্শন হিসেবে মনে করছে। আমি নিজেও প্রায় সেইরকম মনে করছিলাম। যদিও আমার আরও কিছু মনে হচ্ছিল।

কেমন এক অস্বস্তি এবং কাতরতাবশে আমি বললাম, “একটা কথা বলব?”

ওরা আমাকে দেখল।

“আমাদের সব কথাই সকলের জানা।” ধীরে ধীরে আমি বললাম, “আমরা কিছুই লুকোচুরি রাখিনি; তবু আমাদের তিনজনের কিছু গোপনীয়তা আছে। আজ সেটা বলে ফেলা কি ভাল নয়?”

কমলেন্দু অপলকে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল! অনাদি চোখের চশমাটা ঠিক করে নিল। আমার মনে হল ওরা অনিচ্ছুক নয়।

কমলেন্দু বলল, ‘বেশ। তাই হোক। কথাটা আজ বলে ফেলাই ভাল।”

অনাদি বলল, “আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু শিবানীর চিতা এখনো জ্বলছে, আমরা শ্মশানে। এই সময় সে-সব কথা বলা কি ভাল দেখাবে!”

“খারাপই বা কি!” আমি বললাম, “আমার বরং মনে হচ্ছে, বলে ফেললেই স্বস্তি পাব।”

অনাদি আস্তে মাথা নাড়ল। সে সম্মত।

কমলেন্দুর দিকে আমি তাকালাম। সে-ই বলুক প্রথমে। শিবানীর জীবনে সেই প্রথম প্রেমিক।

সব কথা বলার কোনো দরকার নেই কমল, আমরা জানি। আমরা যা জানি না তুমি শুধু সেইটুকুই বলো।”

কমলেন্দু আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল, “তাই বলব।”

কমলেন্দু বলল:

“তোমাদের নিশ্চয় মনে নেই, আমি একবার মাস দেড়েক কি দুয়েকের জন্যে মোতিহারিতে ছোটকাকার বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম। ফিরে এলাম যখন, তখন বর্ষার শুরু, আমাদের মাট্রিকের রেজাল্ট আউট হয়ে গেছে। বাবা পাটনায় মেসোমশাইকে আমার কলেজে ঢোকার সব ব্যবস্থা করতে চিঠি লিখে দিয়েছিলেন। পরীক্ষায় আমার রেজাল্ট কি হয়েছিল তোমরা জানো। কলেজে পড়তে যাবার আনন্দে তখন খুব মশগুল হয়ে আছি, বাড়িতে চব্বিশ ঘণ্টা আদরের ঘটা চলছে। শিবানীর সঙ্গে আমার তখন গলায়-গলায় । মোতিহারিতে সে আমায় চিঠি লিখত। তার মা-বাবার কথা তোমরা জান, পয়সাকড়ি থাকার জন্যে, আর তার বাবা মনোজকাকা বেভিন-স্কীমে বিলেত ঘুরে আসার পর আরও একটু সাহেবী হয়ে গিয়েছিলেন। শিবানীকে শাড়ি ধরাতে ওঁরা দেরি করেছিলেন। আমি যখন মোতিহারিতে তখন শিবানী শাড়ি ধরেছে। চিঠিতে আমায় লিখেছিল। ফিরে এসে দেখলাম, ছিপছিপে শিবানীকে শাড়ি পরে একেবারে অন্যরকম দেখাচ্ছে—বেশ বড় হয়ে গেছে—বেশ বড়। …কই, আর একটা সিগারেট দাও…।”

অনাদি কমলেন্দুকে সিগারেট দিল। সিগারেট ধরিয়ে কমলেন্দু কেমন অন্যমনস্ক হয়ে থাকল সামান্য, তারপর বলল:

“একদিন বিকেলবেলা নাগাদ সাংঘাতিক বৃষ্টি নেমেছিল। যেমন ঝড়, তেমনি বৃষ্টি। এক একটা বাজ পড়ছিল—যেন মনে হচ্ছিল ঘরবাড়ি গাছপালায় আগুন ধরিয়ে ছাই করে দেবে। আর তেমনি আকাশ, পাকা জামের মতন কালো। …দেখতে দেখতে যেন সন্ধে। দোতলায় আমার ঘরে আমি দরজা-জানলা বন্ধ করে বসে। একটা জানালা, যেটা দিয়ে ছাট আসছিল না জলের, খুলে রেখেছিলাম। উলটো দিকে শিবানীদের বাড়ি। শিবানীর মা—লতিকা-কাকিমার শোবার ঘরের গায়ে শিবানীর ঘর। আমার ঘর থেকে শিবানীর ঘর দেখা যায়—কিন্তু খানিকটা দূর। আমরা আমাদের ঘরে বসে বসে জানালায় দাঁড়িয়ে হাতটাত নেড়ে হাসি-তামাশা করছিলাম। কখনও কখনও ঝড়বৃষ্টির মধ্যে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কিছু বলছিলাম, শব্দ বড় একটা পৌঁছচ্ছিল না।

আমি অনেকক্ষণ ধরে শিবানীকে ডাকছিলাম। ইয়ার্কি করেই। তাকে ইশারা করে বলছিলাম শাড়ি পরে মাথায় ঘোমটা দিয়ে চলে আসতে। শিবানী আমায় বুড়ো আঙুল দিয়ে কাঁচকলা দেখাচ্ছিল। এইরকম করতে করতে একেবারে সন্ধে হয়ে এল। পেয়ারাগাছের ডালের পাশ দিয়ে শিবানীর ঘরের অনেকটাই চোখে পড়ে আমার। সে আমায় দেখিয়ে দেখিয়ে জানালায় বসে চুল বেঁধেছে, একটা শাড়িও আলনা থেকে এনে দেখিয়েছে, দূর থেকে রঙটা বুঝতে পারিনি। …সন্ধের মুখে সব যখন অন্ধকার, আমি নীচে থেকে বাতি আনতে যাব, দরজায় দুমদুম শব্দ। খুলে দেখি শিবানী, হাতে বাতি। সে ওই বৃষ্টির মধ্যে এ বাড়ি চলে এসেছে, নীচে থেকে আসার সময় মা তার হাতে বাতি দিয়ে দিয়েছে। শিবানী এইটুকু আসতেই খানিকটা ভিজে গিয়েছিল; হাত পা মাথা শাড়ির আঁচল বেশ ভিজেছে। লণ্ঠনটা আমার হাতে দিয়ে শিবানী তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দিল। জলের ছাট আসছিল। আমি আলনায় ঝুলোনো আমার একটা জামা এনে ওর ভিজে হাত মাথা ঘাড় মুছিয়ে দিতে লাগলাম। ওর মাথার চুল অনেকটা ভিজে গিয়েছিল বলে শিবানী তার লম্বা বিনুনি খুলে ফেলেছিল। ওকে আমি আমার পড়ার টেবিলের সামনে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে ভিজে পা দুটি মুছিয়ে দিতে গেলাম, ইয়ার্কি করেই। ও পা দুলোতে লাগল, হাসতে লাগল। শিবানী ততক্ষণে মাথার চুল খুলে ঘাড়ে পিঠে ছড়িয়ে দিয়েছে। তারপর আমরা লণ্ঠনের আলোয় বসে গল্প করতে লাগলাম। শিবানীর গানের মাস্টার ছিল, সে যে এক সময়ে মোটামুটি ভাল গাইত তা তোমরাও জানো। শিবানীকে একটা গান গাইতে বললাম। শিবানী যে গানটা গাইল তা আমার এখনো মনে আছে, আমি অনেকবার সে গান শুনেছি, কিন্তু সেদিনের মতন কখনো আর নয়। ঝড়বৃষ্টি, বাইরের দুর্যোগ আর অন্ধকারের মধ্যে আমার ঘরে বসে মিটমিটে লন্ঠনের আলোয় সে গাইল: ‘উতল ধারা বাদল ঝরে…।’ ওই গানেরই একটা জায়গায় ছিল, ‘ওগো বঁধু দিনের শেষে এলে তুমি কেমন বেশে, আঁচল দিয়ে শুকাব জল, মুছাব পা আকুল কেশে…।” বার বার শিবানী ওই চরণ দুটি গাইছিল, আর আমার দিকে তাকিয়ে দুষ্টু করে হাসছিল। অর্থটা আমি বুঝতে পারছিলাম। …গান শেষ হলে আমরা গল্প করতে লাগলাম। এ-গল্প সে-গল্প। শেষে আমরা ছেলেমানুষের মতন হাতের রেখা, কপালের রেখা, ভাগ্য, ভবিষ্যৎ এইসব কথা নিয়ে মেতে উঠলাম। একে অন্যজনকে সৌভাগ্যের চিহ্ন দেখাতে ব্যস্ত। হঠাৎ শিবানী বলল, তার বুকে নীল শিরার একটা ক্রস আছে। আমি বললাম, তা হলে সে মস্ত পুণ্যবতী। বলে আমি হাসছিলাম। এরকম যে হয় না, হতে পারে না, তা আমি জানতাম। আমার হাসি দেখে শিবানী বুঝতে পারল আমি তাকে অবিশ্বাস করছি। সে বলল, ‘হাসছ কেন? বিশ্বাস হচ্ছে না?’ আমি মাথা নাড়লাম, ‘তুমি কি যীশু?’ …শিবানীর অভিমানে লাগল। বলল, ‘আহা, যীশু না হলে বুঝি কিছু থাকতে পারে না?’ আমি তাকে আরও রাগিয়ে দিয়ে বললাম, ‘যার কোথাও পাপ নেই তার থাকতে পারে…। মানুষের নয়। যীশুর মতন তুমি মরতে পারবে?’ …শিবানী কি ভাবল জানি না, হঠাৎ সে তার বুকের জামার ওপরের বোতাম খুলে—জামা অনেকটা সরিয়ে আমায় বলল, ‘আলো এনে দেখ।’…আমি দেখলাম। কি দেখলাম তা তোমাদের কাছে বলে লাভ নেই। …বুঝতেই পারছ। তবে শিবানীর বুকে শিরা ছিল, নীলচে রঙের। সেটা ক্রশ কি না আমি দেখিনি। আমি অন্য জিনিস দেখেছিলাম। …আজ আমার স্বীকার করতে দোষ নেই, সেই বয়সে শিবানীর সেই ইনোসেন্স ছিল। আমার হাতে সেটা মরে গেল।”

কমলেন্দু নীরব হল। তাকে খুব অন্যমনস্ক ও অপরাধীর মতন দেখাচ্ছিল।

নদীর চরের ওপারে রোদ সরে যাচ্ছে, তাপ অনেকটা কমে এসেছে, কোথাও একটা কাক ডাকছিল, গাছের পাতায় বাতাসে সরসর শব্দ হচ্ছিল। কেমন যেন একটা নিঃঝুম ভাব।

আমরা তিন বন্ধুই নিশ্বাস ফেললাম। কমলেন্দু রুমালে মুখ মুছে নিল। অনাদি আমার দিকে তাকাল। “শিশির, তোমার যা বলার…”

আমার বলার পালা কমলেন্দুর পর। শিবানীর জীবনে আমি দ্বিতীয় প্রেমিক, তার যৌবনের প্রেমিক। আমারও তখন যৌবন। আমাদের তখনকার ঘনিষ্ঠতার কথা কমলেন্দুদের অজানা নয়। ওরা যা জানে না, ওদের কাছ থেকে যা আমি গোপন রেখেছিলাম, এবার তা বলার জন্যে আমি তৈরি হলাম। কুলঝোপের মাথা ডিঙিয়ে অপরাহ্ণের রোদ এবং নদী দেখতে দেখতে আমি গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বললাম “আমি খুব সংক্ষেপে সারতে চাই।”

“শুনি…” কমলেন্দু বলল।

“বলছি…। তোমাদের কাছে কোনো ভূমিকার দরকার নেই। তবে তোমাদের জানা দরকার যে, তিন-চার বছর শিবানীর সঙ্গে আমার খুব মাখামাখি ছিল, এটা তার শেষের দিকের ঘটনা—” আমি ধীরে ধীরে বললাম। “শিবানীর বাবা তখন মারা গেছেন, লতিকাকাকিমারা তাঁদের নতুন বাড়িতে থাকেন। আমি আমার ইলেট্রিক্যাল আপ্রেনটিসশিপ শেষ করে পাওয়ার হাউসের চার্জে রয়েছি। শিবানীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক তখন এমন অবস্থায় যে, তোমরাও ভাবতে, আমি তাকে বিয়ে করব। লতিকাকাকিমাও ভাবতেন। শিবানীরও তাতে সন্দেহ ছিল না। সন্ধেবেলা ওদের বাড়ি গিয়ে আমাকে তখন বাইরে বারান্দায় অপেক্ষা করতে হতো না, সোজা ড্রয়িংরুমের পরদা সরিয়ে বাঁদিকের দরজা দিয়ে শিবানীর শোয়ার ঘরে চলে যেতে পারতাম। গল্পগুজব, গানবাজনা, খাওয়া-দাওয়া সেরে যখন বাড়ি ফিরতাম তখন রাত হয়ে গেছে। শিবানী আমার ফটক পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যেত। আর প্রায় রোজই ফেরার সময়, ফটকের কাছে করবীঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে সে আমায় চুমু খেত…শিবানীকে যে দেখতে খুব সুন্দর ছিল, তা আমার কখনো মনে হয়নি। তার গায়ের রঙ চোখমুখের ছাঁদ আমার পছন্দ ছিল না। কিন্তু তার শরীর আমার ভীষণ পছন্দ ছিল, তাদের বাড়ির আবহাওয়ায় যে স্বাধীনতা, সপ্রতিভভাব খোলামেলা আচরণ ছিল, তাও আমার খুব পছন্দ ছিল। নতুন ধরনের রুচি, পরিচ্ছন্নতা, বেশবাসের সৌন্দর্য…এ-সবের জন্যে, আর শিবানীর তখনকার শরীরের জন্যে তাকে আমার ভাল লাগত। শিবানীর সেই যৌবন বয়সে তোমরা জানো, মনে হতো তার সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেন ফেটে পড়ছে। …একদিন, সেটা শীতকাল, লতিকাকাকিমা তাঁদের মহিলাসমিতির মিটিঙে গিয়েছিলেন। বাড়িতে চাকর আর ঝি ছিল। ঝি-টার ঠাণ্ডা লেগে অসুখ করেছে, সে শুয়ে আছে। শিবানীর শোবার ঘরে বসে আমরা গল্প করছিলাম। জানুয়ারি মাস, প্রচণ্ড শীত। ঘরে জানলা-টানলা সবই বন্ধ ছিল। …সাধারণ একটা কথা নিয়ে আমরা দু’জনেই হাসছিলাম, হাসতে হাসতে শিবানী বিছানায় গিয়ে লুটিয়ে পড়ল। সে এমনভাবে লুটিয়ে পড়েছিল যে তার একটা হাত মাথার ওপর দিয়ে বালিশে পড়েছে, অন্য হাতটা তার কোমরের কাছে বিছানায় অলসভাবে পড়ে আছে, তার মুখ সিলিংয়ের দিকে, মাথার ওপর হাত থাকার জন্যে তার বুকের একটা পাশ আরও স্ফীত হয়ে উঠেছে। শিবানীর কোমরের তলা থেকে পা পর্যন্ত বিছানা থেকে মাটিতে ধনুকের মতন বেঁকে—কিংবা বলা ভাল—ঢেউয়ের মতন ভেঙে পড়েছে। বিছানার ওপর সুজনিটা ছিল কালচে-লাল, তাতে গোলাপের মতন নকশা; শিবানীর পরনের শাড়িটা ছিল সিল্কের, তার রঙ ছিল সাদাটে। ওর ভাঙা শরীরে বা আছড়ে পড়া শরীরের দিকে তাকিয়ে আমার আত্মসংযম নষ্ট হয়ে গেল। …ঘরের বাতি নিবিয়ে দিয়ে আমি যখন তার গায়ের পাশে, সে আমায় যেন কেমন করে ফিসফিস গলায় গরম নিশ্বাসের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, আমি কবে তার মাকে কথাটা বলব। …আমি তখন যে কোনো রকম ধাপ্পা দিতে রাজী। বললাম, কালই বলব, কাল পরশুর মধ্যে। শিবানী অন্ধকারের মধ্যে সুখে আনন্দে উত্তাপে সর্বাঙ্গে গলে যেতে শুরু করল। …সে কতবার করে বলল, সে আমায় ভালবাসে। আমি কতবার করে বললাম, আমি তাকে ভালবাসি। …তারপর ঘরের বাতি জ্বালা হয়ে গেলে আমি শিবানীর ময়লা রঙ, ছোট কপাল, মোটা নাক, সামনের বড় বড় দাঁত, পুরু ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে মুখ নিচু করে পালিয়ে এলাম। …তারপর থেকেই আমি পালিয়েছি…”

আমি থেমে গেলাম। আমার গলার কাছে একটা সীসের ডেলা যেন জমে গিয়েছে। চোখ ফেটে যাচ্ছিল। কী যে অনুশোচনা আজ, কেমন করে বলব!

নদীর ওপারে বনের মাথায় রোদ চলে গেছে। ছায়া পড়ে গেছে নদীর চর জুড়ে। ফাল্গুনের বাতাস দিচ্ছিল। ঝাঁক বেঁধে পাখিরা উড়ে আসতে শুরু করেছে। সমস্ত জায়গাটা অপরাহ্ণের বিষন্নতায় ক্রমশই মলিন হয়ে আসছে।

আমাদের তিন বন্ধুর নিশ্বাস পড়ল।

আমি সিগারেটের প্যাকেট বের করলাম। মুখ মুছলাম কোঁচায়। তিনজনে সিগারেট ধরিয়ে নিলাম। এবার অনাদির পালা। শিবানীর জীবনে তৃতীয় প্রেমিক। অনাদির দিকে তাকালাম আমরা।

অনাদি প্রায় আধখানা সিগারেট শেষ করল, কোনো কথা বলল না। শেষে মাটির দিকে তাকিয়ে কথা শুরু করল:

“শিবানীর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা যখন হয়েছে তখন আমরা কেউই বাচ্চা নেই। আমার বয়স তেত্রিশ পেরিয়ে গিয়েছিল, শিবানী প্রায় তিরিশ। লতিকামাসিমা তখন আর ঠিক বেঁচে থাকার মতন অবস্থায় নেই, সেই আরথ্রাইটিসের অসুখে পঙ্গু, শয্যাশায়ী। আমি ব্যাংকে অ্যাকাউন্টেন্ট হয়েছি নতুন। …তোমরা ভাই জানো, মহেশ্বরী যখন কনট্রাকটারী ব্যবসায় নামল তখন আমি তার পেছনে ছিলাম, তার সঙ্গে আমার ভেতরে ভেতরে কথা ছিল, তার লাভের একটা পার্সেন্টেজ আমায় দেবে, আমি ব্যাংকে তার সবরকম সুবিধে করে দেব। প্রথম প্রথম মহেশ্বরীর কাছ থেকে বেমক্কা দু’ চারশো পেতাম। ব্যাংকে আমি তার সুবিধেটুবিধের মাত্রাও বাড়াতে লাগলাম। মামা ম্যানেজার, যদিও নিজের মামা নয়। মামাকে আমি নানাভাবে ইনফ্লুয়েন্স করতাম। কিন্তু মহেশ্বরী শেষে আমায় ডুবিয়ে দিল। বিশ্রী এক অবস্থায় পড়লাম। ব্যাপারটা এমন ঘোরালো হয়ে দাঁড়াল যে, আমার পক্ষে কোথাও আর আইনের ফাঁক থাকল না। শিবানীর সঙ্গে আমার তখন মেলামেশা। সত্যি কথা বলতে কি, আমার তখন এমন কাউকে দরকার, যে আমায় অর্থ-সাহায্য করতে পারে। অন্তত একটা জামিন থাকলেও আমার পক্ষে একটু সুবিধে হয়। শিবানীদের নিজের বাড়িঘর, জমি, লতিকামাসিমার—আমি তাঁকে মাসিমা বলতাম—কিছু টাকা এবং অলংকার ছিল। নিজেকে বাঁচবার জন্যে শিবানীদের শরণাপন্ন হবার কথা ভাবছিলাম। লতিকামাসি মারা গেলে সমস্ত সম্পত্তিই শিবানীর হবে। তাছাড়া, লতিকামাসিমা বেঁচে থাকতেও যদি শিবানীর সঙ্গে আমার তেমন একটা সম্পর্ক দেখতে পান, তিনি আমায় বিপদ থেকে পরিত্রাণ করতে পারেন । …বেশি বলে লাভ নেই, আমি শিবানীর সঙ্গে যে-ধরনের সম্পর্ক পাতালাম—তাতে মনে হবে আমরা যেন স্বামী-স্ত্রী। আমি শিবানীর অঙ্গ স্পর্শ করিনি—মানে সেভাবে নয়, আমার তাতে আগ্রহ ছিল না। অথচ আমি শিবানীদের বাড়িতে সারাদিনও থেকেছি। তাদের বাড়িতে থেকেছি, খেয়েছি, বিছানায় শুয়েছি, লতিকামাসিমার জন্যে ডাক্তার ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করেছি, শিবানীর ও তাদের সংসারের তদারকি করেছি। আমার ওপর লতিকামাসিমার সুনজর পড়ল, শিবানী প্রথম প্রথম আমায় কি ভাবত জানি না, পরে সে আমার ওপর নির্ভর ও বিশ্বাস করতে লাগল। তখন চাকরিতে আমার গণ্ডগোল বেধে গেছে, মামার জোরে তখনও জেলে যাইনি, কিন্তু মহেশ্বরীকে মামলায় জড়িয়ে পড়তে হয়েছে। শরীর খারাপের অজুহাতে আমি ছুটি নিয়েছি, পুজোর মুখে। আমার বাড়ি বলতে এক মা, বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক তুলেই দিয়েছিলাম। ছুটি নিয়ে শিবানীদের বাড়িতে পড়ে আছি। দুশ্চিন্তায় খাওয়া নেই, ঘুম নেই, চোখমুখ শুকিয়ে হলুদ হয়ে গেছে। এমন সময় একদিন বিকেল থেকে লতিকামাসিমার খুব বাড়াবাড়ি অবস্থা হল। ডাক্তার ডেকে আনলাম, ওষুধপত্র চলতে লাগল নতুন করে। ..সেদিন সন্ধের পর লতিকামাসির অবস্থা যখন একটু ভাল হল, আমি বাইরে—শিবানীদের বাড়ীর বাগানে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, অন্ধকারে। এমন সময় কখন শিবানী পাশে এসে দাঁড়াল। দু’ চারটে কথার পর সে বলল, আমি আর কতদিন এভাবে দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনা নিয়ে বসে থাকব? …আমি তখন জামিন এবং টাকার কথা বললাম। শিবানী কিছু না ভেবেই বলল, লতিকামাসির কাছে সে সব বলবে। …আমরা দু’জনেই তখন একটা শিউলিগাছের কাছে দাঁড়িয়েছিলাম, অনেক দিন পরে হঠাৎ আমার নাকে শিউলিফুলের গন্ধ লাগল। আমি শিবানীর হাত টেনে নিয়ে কৃতজ্ঞতায় কেঁদে ফেলেছিলাম। আমার সেই কান্না কুকুরের মতন। শিবানী আমায় সান্ত্বনা দিল। পরে বলল, “এই ঘরবাড়ি, টাকা—এ-সব মা আমার ভবিষ্যৎ ভেবে রেখেছে। যার কাছে আমার আশ্রয় জুটবে, এ সবই তার। তুমি তো এ-সবই তোমার নিজের ভাবতে পার।” …আমি সেরাত্রে অনেকটা নিশ্চিত হলাম। …লতিকামাসিমা আমার তরফে জামিন দাঁড়ালেন, কিছু টাকাও আমায় তিনি দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত মহেশ্বরী মামলায় এমন এক অবস্থায় পড়ল যে তাকে সরিয়ে রাখা টাকা বের করে দিতে হল । আমার গণ্ডগোলটাও মিটে গেল। লতিকামাসি অবশ্য আরও মাস কয়েক বেঁচে ছিলেন। কিন্তু শিবানী ভবিষ্যতের জন্যে আমার ওপর নির্ভর করতে চেয়েছিল; সে-ভার আমি নিইনি, তাকে আশ্রয়ও দিইনি। শিবানীকে ঠিক বিয়ে করার মতন মেয়ে আমার কোনোদিনই মনে হয়নি।…”

অনাদি চুপ করল।

আমরা চুপচাপ। নিঃসাড় যেন। একটা সাদা ধবধবে বক নদীর ওপার দিয়ে গোধূলির আলোর সীমানা পেরিয়ে কোথায় যেন চলে গেল।

কমলেন্দু বলল, “লতিকাকাকিমার টাকাটা তুমি ফেরত দাওনি?”

“পরে মাসিমা মারা যাবার পর শিবানীকে কিছুটা দিতে গিয়েছিলাম ও নেয়নি।”

আর কোনো কথা হল না। আমরা তিন বিগতযৌবন বন্ধু, শিবানীর তিন প্রেমিকপুরুষ নীরবে বসে থাকলাম, কেউ কারও দিকে তাকালাম না। বসে বসে কখন যেন দেখলাম, আকাশ বন নদী জুড়ে আসন্ন সন্ধ্যার ছায়া। আমাদের চারপাশে সেই সীসের মতন ছায়া ক্রমশই জমতে লাগল। আমাদের নাম ধরে চিতার কাছ থেকে ওরা তখন ডাকছে।

দাহ শেষ। চিতা ধুয়ে দেওয়া হচ্ছে। ছেলেগুলোর জল ঢালা ফুরলো। এবার আমরা। নদী থেকে মাটির কলসিতে জল ভরে এনে কমলেন্দু শিবানীর ভিজে চিতায় ঢেলে দিল। তারপর আমি। কমলেন্দুর হাত থেকে কলসি নিয়ে নদী থেকে জল ভরে আনলাম। এনে শিবানীর চিতার, তার নিশ্চিহ্ণ শরীরের ছাইয়ের রাশিতে জল ঢাললাম। তারপর অনাদি জল দিল। শেষে ভূবন।

কলসিটা ভেঙে দিয়ে ভুবন ফিরল! আমরা কেউ আর পিছু ফিরে তাকাব না।

আমরা এগিয়ে চলেছি। ওরা—পুরুতমশাই আর ছেলেরা আমাদের আগে আগে, গরুর গাড়িটা চলছে, চাকার করুণ শব্দ, আমরা চার বন্ধু পাশাপাশি। ভুবনকে আমাদের পাশে পাশে হেঁটে যেতে দেখে আমাদের অস্বস্তি হচ্ছিল। ও বড় ক্লান্ত, অবসন্ন। মনে হল যেন ঠিক পা ফেলতে পারছে না। আমরা তাকে গরুর গাড়ির ওপর বসিয়ে দিলাম জোর করে । সে আমাদের দিকে মুখ করে গরুর গাড়িতে বসে থাকল উদাস দৃষ্টিতে।

এমন সময় চাঁদ উঠে গেল। শুক্লপক্ষ, আজ বুঝি ত্রয়োদশী।

নদী পিছনে, দু’পাশের জঙ্গল গুটানো পাখার মতন দু’পাশে নেমে গেছে, সামনে উঁচু-নীচু কাঁচা রাস্তা। জ্যোৎস্না ধরেছে, বনে, ঝিল্লিরব ঘন হয়ে এল, ফাল্গুনের বাতাস বইছে, গরুর গাড়ির চিকন করুণ শব্দ ছাড়া আর শব্দ নেই, আর আমাদের পায়ের শব্দ। মাথার ওপর চাঁদ।

যেতে যেতে কমলেন্দু হঠাৎ বলল ভারী গলায়, “শিবানীর চিতায় জল ঢালার সময় কেমন যেন কান্না এসে গিয়েছিল। আহা, বেচারী। …ভাই, আমি আজ তার কাছে, তার চিতায় জল দেবার সময়, মনে মনে ক্ষমা চেয়েছি।”

আমিও তো শিবানীর চিতায় কলসি করে জল ঢালার সময় আমার পাপের জন্যে মার্জনা চেয়েছিলাম। অস্ফুট গলায় আমি বললাম, “আমিও ক্ষমা চেয়েছি।”

অনাদি যে কাঁদছিল আমরা খেয়াল করিনি। সে ছেলেমানুষের মতন মুখে কান্না ও লালা জড়িয়ে বলল, “আমিও…”

চাঁদের আলোয় আমরা তিন ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তিন প্রেমিক চলেছি। আমাদের সামনে ভুবন। পিছনে শ্মশান, শিবানীর ধুয়ে যাওয়া চিতা।

যেতে যেতে সামনে ভুবনের দিকে তাকিয়ে আমি ভাবছিলাম, আমরা তিনজনে, তিন প্রেমিক শিবানীর নিষ্পপতা, কৌমার্য, নির্ভরতা তো হরণ করে নিয়েছিলাম। নিয়ে তাকে প্রত্যাখ্যান করেছি। কিন্তু তারপরও আর কি অবশিষ্ট ছিল শিবানীর, যা ভূবন পেয়েছে! কি পেয়েছে ভুবন যার জন্যে এত ব্যথা?

চাঁদের আলোয় ভুবনকে কেমন যেন দেখাচ্ছিল। তার চার পাশে নিবিড় ও নীলাভ, স্তব্ধ, মগ্ন যে চরাচর তা ক্রমশই যেন ব্যাপ্ত ও বিস্তৃত হয়ে এক অলৌকিক বিষন্ন ভুবন সৃষ্টি করছিল। এ যেন আমাদের ভুবন নয়। অথচ আমাদেরই ভুবন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *