সেরিওজা কোথায় থাকে
সবাই বলে ও নাকি দেখতে ঠিক মেয়েদের মতো। সত্যি, কী বোকা ওরা! মেয়েরা তো ফ্রক পরে, কিন্তু ও তো ফ্রক পরে নি কতকাল। তাছাড়া, মেয়েদের কি গুলতি থাকে? কিন্তু সেরিওজার তো একটা গুলতি আছে, আর সেটা দিয়ে ও একের পর এক কত পাথর ছোঁড়ে! শুরিক ওকে ওটা বানিয়ে দিয়েছে। তার বদলে অবশ্য জীবনভর যে সুতোর কাটিমগুলো জমিয়েছিল শুরিককে সেগুলো সব দিয়ে দিতে হয়েছে।
তবে হাঁ, ওর চুলগুলো ঠিক মেয়েদের চুলের মতোই বড় বড়। কতবার তো ওর চুল কল দিয়ে ছেঁটে দেওয়া হল, কত কষ্টই-না সে সহ্য করেছে। কিন্তু হলে কী হবে, কয়েক দিনের মধ্যেই ওর চুল আবার আগের মতোই যেমন ছিল তেমনটি হয়ে যায়।
একটা বিষয়ে কিন্তু সবাই একমত : ওর বয়সের তুলনায় ও নাকি অনেক বেশি চালাক। একবার কি দু-বার একটা বই ওকে পড়ে শোনালেই ওর সেটা পুরো মুখস্থ হয়ে যায়। অক্ষরগুলো ও ঠিকই চিনতে পারে, কিন্তু নিজে নিজে পড়তে বড্ড সময় লাগে যে! বইয়ের ভেতরে ছবিগুলোকে ও রঙিন পেন্সিল দিয়ে রাঙিয়ে দেয়। রঙিন ছবিগুলোকে আবার খেয়ালখুশিমতো অন্য রঙে সাজায়। এমনি করে ছবি রঙ করতে সেরিওজার বড্ড ভালো লাগে। কয়েক দিনের মধ্যেই কিন্তু বইগুলো আর নতুন, ঝকঝকে থাকে না। পাতাগুলো একটা একটা করে ঝরতে থাকে। পাশা খালা সেগুলোকে আবার সেলাই করে দেয়।
বইয়ের পাতা হারিয়ে গেলে সেরিওজার আর সেটা খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত এতটুকুও শান্তি নেই। বই ও সত্যি ভালোবাসে। তবে বইয়ের সব কথাগুলো ও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে না। পশুপাখি কি কথা বলতে পারে নাকি? কার্পেট কখনো উড়তে পারে না, ইঞ্জিন নেই যে। এসব আজগুবি কথা বিশ্বাস করবে এমন বোকা আর কে আছে?
তাছাড়া, বড়রা ভূত পেত্নী ডাইনির গল্প পড়ে যখন বলে, ‘সত্যিই কিছু আর ভূত পেত্নী ডাইনি নেই’, তখন বইয়ের এই আজব গল্পগুলোকেই-বা কেমন করে বিশ্বাস করা যায়?
তা হলেও সেই যে গল্পটা, যারা ছেলেমেয়েগুলোকে বনে নিয়ে গিয়ে হারিয়ে ফেলতে চেয়েছিল, বুড়ো আংলা ওদের বাঁচিয়েছিল অবশ্য; ওসব গল্প শুনতে সেরিওজা মোটেই ভালোবাসে না, ও বই তাকে পড়ে শোনাতে এলে সেরিওজা বারণ করে।
সেরিওজা ওর মা, পাশা খালা আর খালু লুকিয়ানিচের সঙ্গে থাকে। ওদের ছোট্ট বাড়ির তিনখানি ঘরের একখানিতে ও আর ওর মা ঘুমোয়। খালা আর খালু আর-একটি ঘরে থাকে। তৃতীয় ঘরটি ওদের খাবারঘর। কেউ অতিথি এলে ওরা খাবারঘরে খায়, নইলে রান্নাঘরেই খায়। বাড়ির সামনে একটানা লম্বা বারান্দা আর একফালি উঠানও আছে। উঠানে আছে একপাল মুরগি আর একপাশে পেঁয়াজ আর মুলোর বাগান। দুষ্টু মুরগিগুলো যাতে সব খেয়ে ফেলতে না পারে সেজন্য কাঁটাগাছের বেড়া দিয়ে বাগানটা ঘেরাও করে দেওয়া হয়েছে।
আর সেরিওজা মুলো তুলতে গেলেই সেই কাঁটার আঁচড়ে ওর পা দুটো ছড়ে যাবেই যাবে।
লোকে বলে ওদের শহরটা নাকি বেশ ছোট্ট। এ কথাটা কিন্তু একেবারেই বাজে। আর ওর বন্ধুরা সবাই জানে ওদের শহরটা বেশ বড়। কত দোকানপাট, বাড়িঘর, মনুমেন্ট, সিনেমা হল। কী নেই ওদের শহরে? মা ওকে মাঝে মাঝে ছবি দেখাতে নিয়ে যায়। আলো নিভে ছবি আরম্ভ হলে ও চুপিচুপি মাকে বলে, ‘মা, তুমি বুঝতে পারলে আমাকেও একটু বুঝিয়ে দিও, কেমন?’
ওদের বাড়ির সামনে বড় রাস্তার ওপর দিয়ে কত লরি আসছে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে তিমোখিনের বিরাট লরিতে চড়ে ওরা বাচ্চা ছেলেমেয়ের দল এদিক ওদিক বেড়িয়ে আসে। কিন্তু ভদ্কা খেলেই তিমোখিন আর কাউকে লরিতে চড়তে দেবে না। তখন ছেলেরা ওকে ডাকলেও হাত নেড়ে বলবে, ‘এখন তোমাদের নেব না। দেখছ না আমি মাতাল হয়েছি!’
সেরিওজার রাস্তার নামটা কী অদ্ভুত! দানায়া স্ট্রিট, অর্থাৎ কিনা দূরের রাস্তা। কিন্তু এটা তো শুধুই একটা নাম, কেননা সব কিছুই তো এই রাস্তার কাছাকাছিই রয়েছে। খেলার মাঠ, বাজার, সিনেমা হল আর ‘ইয়াসি বেরেগ’ রাষ্ট্রীয় খামার তো কত কাছে!
আর এই ফার্মের মতো নামকরা জায়গাই-বা এখানে আর ক’টা আছে? ওখানেই তো লুকিয়ানিচ কাজ করে। খালা ওখান থেকেই নোনা হেরিং মাছ আর কাপড় কিনে আনে। মা-র স্কুল তো ঐ খামারের ভেতরেই। ছুটির দিনে মা ওকে স্কুলের আনন্দমেলায় নিয়ে যায়। সেখানেই ও লাল চুলওয়ালা মেয়ে ফিমাকে দেখেছে। ফিমার বয়স আট বছর, কিন্তু কত বড় দেখতে! কানের দু-পাশ দিয়ে বিনুনি করা চুলের ডগায় লাল, নীল, শাদা, হলদে, বেগুনি কত রকমারি রিবনের বাহার। রিবনের যেন আর শেষ নেই। সেরিওজা ওসব কিছু লক্ষ করত না। কিন্তু ফিমাই একদিন ওকে ডেকে বলেছে, ‘এই, দেখতে পাও নাকি? দেখেছ, আমার কত ফিতে?’
এই বইটা কত খুঁজেছি। অনেক বছর আগে পড়েছিলাম। ছোট্ট একটা বই ছিল।