মাতুলদর্শনের খেসারত

মাতুলদর্শনের খেসারত 

কালিনিন স্ট্রিট আর দানায়া স্ট্রিটের মধ্যে একটা গোপন সম্পর্ক গড়ে উঠল। গোপনে কথাবার্তা চলতে লাগল। শুরিক ও-দিকে যাতায়াত শুরু করেছে আর সর্বদাই ব্যস্ত ভাব, সেরিওজাকে সব খবরাখবর এনে দিচ্ছে। রোদে পোড়া মোটাসোটা দুটি পা ক্ষিপ্র গতিতে চালিয়ে ওর কালো কালো দুটি চোখের দৃষ্টি চারদিকে চকিত দৃষ্টি হানছে। একটা নতুন বুদ্ধি মাথায় ঢুকলেই শুরিকের চোখ দুটো কেবল ডাইনে-বাঁয়ে সচকিত দৃষ্টি ফেলবে আর ঠিক তখনই ওর বাবা তিমোখিন আর মা বুঝতে পারবে ছেলের মাথায় আবার কোনো দুষ্ট অভিসন্ধি ঢুকেছে। মা ভাবনায় পড়ে, বাবা চাবুক মারবার ভয় দেখায়। শুরিকের ভাবনাচিন্তাগুলো বরাবরই অনিষ্টকর কিনা। তাই ওর জন্য ওর বাবা-মা’র বড় দুশ্চিন্তা। তাদের সবেধন নীলমণি ছেলেটাকে তারা সুস্থ সবল দেখতে চায়, বাঁচিয়ে রাখতে চায়। 

কিন্তু শুরিক কি আর ওসব গ্রাহ্য করে নাকি? কালিনিন স্ট্রিটের ছেলেরা উল্কি ফোটাবে আর এ সময় চাবুকের ভয় পায় কে? গোপনে গোপনে ওরা দু-দল ছেলে এ জন্য সমস্ত ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে করে চলল। শুরিক আর সেরিওজার কাছ থেকেই ওরা ভাস্কার মামার উল্কির বিষয়ে খুঁটিনাটি সব কথা জেনে নিয়েছে। শরীরের কোথায় কেমন সব ছবি, সব কথা জেনে ওরা প্রথমে ছবির নক্সা এঁকে নিল তারপর শুরিক আর সেরিওজাকে এসবের মধ্যে আর রাখতে চাইল না। তাই ওদের বলল, ‘তোমাদের মতো বাচ্চাদের জন্য এসব নয়, বুঝলে?’ উঃ! কী ধড়িবাজ ছেলে ওরা। এটা অত্যন্ত অন্যায়। 

কিন্তু ওরাই-বা কী করবে বল? কাউকে তো একথা বলেও দিতে পারে না। তা-ছাড়া, জাতের কাউকে অর্থাৎ কিনা দানায়া স্ট্রিটের কাউকে এ বিষয়ে কিছু বলবে না ওরা, এই প্রতিজ্ঞাও সে করে ফেলেছে। কারণ দানায়া স্ট্রিটেই সেই বিখ্যাত মুখরা মেয়ে লিদা রয়েছে, যার পেটে কোনো কথা থাকবে না, চারধারে রসাল করে বলে বলে বেড়াবে। লিদা শুনলেই বড়দের কানে কথাটা যাবে আর তারপর যে কী হবে তা না ভাবাই ভালো। স্কুলে খবরটা রটে গেলে মাস্টারমশায়দের সভা, বাবা-মাদের জরুরি সভা, সব জায়গায় হাজির হতে হতে প্রাণান্ত করবে। হৈ হৈ শুরু হবে আর চারদিক থেকে একটা গোলমালের সৃষ্টি হবে। 

তাই কালিনিন স্ট্রিটের ছেলেরা দানায়া স্ট্রিটের ছেলেদের সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখতে চাইল না। কিন্তু শুরিককে তাড়িয়ে দেওয়া অত সহজ নয়। ওদের আঁকা ছবিগুলো সব সে দেখেছে। 

শুরিক সেরিওজাকে বলল, ‘ওরা অনেকগুলো নতুন ছবিও এঁকেছে। এরোপ্লেন, ঝরনাওয়ালা তিমি এঁকেছে। আবার কতগুলো উপদেশবাণীও লিখে নিয়েছে … আঁকা সেই কাগজের টুকরো তোমার গায়ের উপর রেখে একটা পিন দিয়ে আঁকার উপর ফুটিয়ে ফুটিয়ে গেলেই ছবিগুলো তোমার গায়ে চমৎকার ফুটে উঠবে।’ 

শুরিকের কথায় সেরিওজা চমকে উঠল। পিন দিয়ে ফোটাবে? পিন!… 

কিন্তু শুরিক যদি পিন ফোটানো সহ্য করতে পারে তাহলে সে পারবে না কেন? তাকেও সহ্য করতেই হবে। তাই কিছু যেন হয় নি এমনি নির্ভীক ভাব দেখিয়ে সে বলল, ‘হাঁ, চমৎকার হবে কিন্তু!’ 

কিন্তু কালিনিন স্ট্রিটের ওস্তাদ ছেলেরা ওদের দু-জনকে উল্কি দিতে কিছুতেই রাজি হল না। ওরা কত কাকুতি মিনতি করল, কিন্তু ওদের কথা কে শোনে? শুধু বলল : 

‘বিরক্ত কর না। তোমরা তো ছেলেমানুষ, এসব দিয়ে কী হবে? যাও, বাড়ি যাও।’ ওরা দু-জনকেই ধমকে তাড়িয়ে দিল। 

ওরা এবার একেবারেই মুষড়ে পড়ল। আর বুঝি কোনো আশাই নেই। শুরিক মরিয়া হয়ে অনেক চেষ্টার পর ওদের দলের আর্সেন্তিকে ওর পক্ষে টানল। 

আর্সেন্তি সব বাপ-মায়ের কাছেই বড় আদর্শ ছেলে। পড়াশোনায় বেশ ভালো, ক্লাসে সবচেয়ে বেশি নম্বর পায়, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে। সবাই ওকে ভালোবাসে। ওর সবচেয়ে বড় গুণ সে ন্যায়-অন্যায় ভালোমন্দ বেশ বুঝতে পারে। খানিকটা হাসি-ঠাট্টার পর ওদের দু-জনকে দলের কাছে নিয়ে গিয়ে আর্সেন্তি বলল, ‘ওদেরও তো একটা দাবি আছে। ওদের হাতে এক একটা অক্ষর অর্থাৎ ওদের নামের প্রথম অক্ষরটি লিখে দাও। তুমি কী বল শুরিক?’ 

শুরিক বলল, ‘না, শুধু একটা অক্ষর হলে চলবে না।’ 

পঞ্চম শ্রেণীর শক্তসমর্থ ভালেরি বলে উঠল, ‘তা হলে ভাগো এখান থেকে। একটা অক্ষর কেন, কিছুই লিখে দেওয়া হবে না তোমাদের হাতে।’ 

শুরিক রাগ করে চলে গেল কিন্তু একটু পরেই আবার ফিরে এসে বলল, ‘আচ্ছা, একটা অক্ষরেই আমরা রাজি আছি। অক্ষরটা বেশ সুন্দর করে আধুনিক পদ্ধতিতে লিখে দিতে হবে কিন্তু। যাচ্ছেতাই করে লিখলে কিন্তু চলবে না।’ ঠিক হল ভালেরির বাড়িতে পরের দিন ব্যাপারটা হবে, কারণ ভালেরির মা বাড়িতে নেই। 

শুরিক আর সেরিওজা ওদের কথামতো পরের দিন ভালেরির বাড়িতে এল। ভালেরির বোন লারিস্কা সেলাই হাতে দরজার সামনে বসেছিল। কেউ এলে ‘বাড়িতে কেউ নেই’ বলার জন্যই লারিস্কা এভাবে বসেছে। ওদের স্নানঘরের পাশে একফালি উঠানে ছেলের দল জমায়েত হয়েছে। পঞ্চম শ্রেণী, এমনকি ষষ্ঠ শ্রেণীর ছেলেরাও আছে। গোমড়ামুখো ফর্সা বলিষ্ঠ একটি মেয়েও ওদের মধ্যে আছে। ওর নিচের ঠোঁটটা কেমন যেন বিবর্ণ, পুরু আর একটু বৈশিষ্ট্য মাখানো। অনেকে বলে ঐ ঠোঁটের জন্য নাকি ওকে বেশ ভারিক্কি মনে হয়…মেয়েটির নাম কাপা। ও একটা কাঁচি নিয়ে ব্যান্ডেজ কেটে কেটে টুলের উপর রাখছে। কাপা নাকি ওদের স্কুলের স্বাস্থ্য কমিটির একজন সভ্য। টুলের উপর একটা ধবধবে শাদা কাপড় পেতে পরিপাটি করে সব ব্যবস্থা সে করে রাখছে। 

ছোট স্নানঘরটির দরজার ওদিকে একটা বেঞ্চের উপর সেই রকমারি ছবিগুলো রাখা হয়েছে। ছেলেরা সেই ছবিগুলো একে একে দেখছে, কে কোনটা নেবে ঠিক করছে। ঝগড়া করার কোনো প্রয়োজন নেই, কারণ একটা ছবি যতবার খুশি ব্যবহার করা যাবে। শুরিক আর সেরিওজা দূর থেকেই ছবিগুলো দেখে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। ইচ্ছে হলেও কাছে গিয়ে ওগুলো ধরতে পারছে না, কেননা ঐ ছেলেরা ওদের চাইতে কত বড়, আর ওদের গায়ের জোরও অনেক বেশি। 

আর্সেন্তি স্কুল থেকে বই-এর থলে হাতে নিয়েই বরাবর এখানে চলে এসেছে। বাড়ি ফিরেই ওকে রচনা লিখতে হবে, ভূগোল পড়া শিখতে হবে বলে ওকে সবার আগে ছেড়ে দেবার জন্য বলল ও। পড়ার আগ্রহ দেখে অন্যরা তাতে রাজি হল। আর্সেন্তি এবার থলেটা রেখে দিয়ে একটু হেসে বেঞ্চের উপর বসে শার্ট উঠিয়ে পিঠ খালি করে দিল। 

বড় ছেলেরা সবাই ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে সেরিওজা আর শুরিককে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। এত পেছন থেকে অনেক লাফ ঝাঁপ মেরেও ওরা কিছু দেখতে পাচ্ছে না। ছেলেরা এতক্ষণ বকবক করছিল। এবার ওদের কথা আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে আসছে। কেমন একটা নীরব থমথমে ভাব। শুধু কাগজের খসখস শব্দ শোনা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর ভালেরির গলা শোনা গেল। ভালেরি বলছে, ‘কাপা, লারিস্কার কাছ থেকে একটা পরিষ্কার তোয়ালে চেয়ে নিয়ে এস তো।’ 

কাপা ছুটে গিয়ে তক্ষুনি একটা তোয়ালে নিয়ে এসে সবার মাথার উপর দিয়ে ভালেরির দিকে ছুড়ে দিল। 

সেরিওজা এবার একটু লাফিয়ে ওদিকে কিছু দেখবার চেষ্টা করে শুরিককে প্রশ্ন করল, ‘তোয়ালে দিয়ে কী করবে ওরা।’ 

সামনের দু-একটি ছেলের মধ্য দিয়ে মাথা গলিয়ে একটু দেখবার আপ্রাণ চেষ্টা করে শুরিক বলল, ‘হয়তো রক্ত ঝরছে, তাই।’ একটা লম্বা ছেলে কঠিন দৃষ্টিতে শুরিকের দিকে তাকিয়ে ধমকে উঠল, ‘এই দুষ্টুমি কর না।’ 

তারপর আবার সব চুপচাপ। কী হচ্ছে, কী করছে ওরা, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। এই অসহ্য নীরবতার যেন শেষ হবে না আজ। সেরিওজা এবার যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আর ভালো লাগছে না ওর। বাইরে গিয়ে একটা ফড়িং ধরল, ভালেরির উঠানের দিকে, লারিস্কার দিকে চেয়ে রইল। যাক …শেষ পর্যন্ত ওরা কথা বলতে শুরু করল। একটু পরেই ভিড় ঠেলে আর্সেন্তি এদিকে এগিয়ে এল। উঃ! এ আবার কী? ওকে যে চেনাই যাচ্ছে না! কাঁধ থেকে কোমর পর্যন্ত বেগুনি হয়ে গেছে আর কী ভয়ানক দেখাচ্ছে। ওর শাদা বুক, শাদা ধবধবে পিঠ সব কোথায় গেল? ওর কোমর সেই তোয়ালেটা দিয়ে জড়ানো রয়েছে। তোয়ালেটার জায়গার জায়গায় কালি আর রক্তের দাগ দেখা যাচ্ছে কেন? আর ওকে কী অদ্ভুত ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে! তবুও মৃদু হাসছে। সত্যি আর্সেন্তি একজন মস্ত বড় বীর! ও এবার কাপার কাছে হেঁটে এসে তোয়ালেটা খুলে ফেলে বলল, ‘শক্ত করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দাও।’ 

কে একজন বলে উঠল, ‘এই বাচ্চা দুটোকে আগে দিয়ে দিই, না হলে ওদের নিয়ে বিপদে পড়তে হবে।’ 

ভালেরি এবার এগিয়ে এসে ওদের দু-জনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কোথায় বাচ্চারা? কীগো, তোমরা মত বদলাও নি তো?… আচ্ছা, তাড়াতাড়ি এস তাহলে। 

কেমন করেই-বা মত বদলান যায়? আর্সেন্তি রক্তাক্ত আর কালি-মাখা হয়েও কেমন হাসছে, তা দেখেও কি পিছু হটা যায়? 

সেরিওজা ভাবল, ‘একটা তো মাত্র অক্ষর; তেমন সময় লাগবে না নিশ্চয়ই।’

শুরিকের সঙ্গে সঙ্গে সে এগিয়ে গেল। বড় ছেলেরা সবাই আর্সেন্তিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে কাপার ব্যান্ডেজ-বাঁধা মনোযোগ দিয়ে দেখছে। ভালেরি বেঞ্চে গম্ভীর মুখে বসে আছে। 

শুরিক তাকে প্রশ্ন করল, ‘আমারও কি তোয়ালে লাগবে নাকি?’ 

‘না, তোয়ালে ছাড়াই তোমার চলবে। দেখি, হাতটা এগিয়ে দাও তো।’

শুরিকের হাতটা টেনে নিয়ে ভালেরি একটা পিন দিয়ে ফোটাতে শুরু করল।

‘উঃ!’ 

‘যদি উঃ করে তাহলে করব না, চলে যাও,’ ভালেরি ধমকে উঠে আবার পিন ফোটাতে ফোটাতে বলল, ‘মনে কর একটা কাঁটা বের করে দিচ্ছি। তাহলে আর ব্যথা লাগবে না। 

শুরিক দাঁতে দাঁত চেপে বিকৃত মুখভঙ্গি করতে লাগল, কিন্তু মুখ দিয়ে আর টু শব্দটি বের হল না। মাঝে মাঝে কেবল অস্থিরভাবে লাফাতে লাগল আর হাতের উপর ফুঁ দিতে লাগল। শুরিকের হাতের উপর একটার পর একটা গোলাপি ফুটকি ফুটে উঠতে লাগল কেমন। ভালেরি হাতটা আরো শক্ত করে জাপটে ধরে পিনের ছুঁচলো মুখ দিয়ে ফুটকিগুলোকে আরো টেনে দিল। শুরিক নিঃশব্দে লাফিয়ে উঠল আর প্রাণপণে হাতের উপর ফুঁ দিয়ে চলল। লাল রক্তের ধারা একটু একটু করে সেই ফুটকিগুলো দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে এবার…উঃ! শুরিক কী সাহসী! 

বিবর্ণ সেরিওজা অবাক হয়ে ভাবছে, ‘শুরিক তো একটুও কাতরাচ্ছে না! আমিও উঃ-আঃ কিছু করব না। হায়, হায়, আমার আর পালাবার উপায় নেই। ওরা যে হাসবে, ঠাট্টা করবে আর শুরিকও আমাকে ভীরু বলবে।’ 

ভালেরি এবার টেবিলের উপর থেকে একটা কালির শিশি নিয়ে তাতে তুলি ডুবিয়ে সেই রক্তাক্ত ফুটকিগুলোর উপর কালির তুলিটা বুলিয়ে দিতে লাগল। 

একটু পরে বলল, ‘যাও, হয়ে গেছে। এবার কে আসবে?’ 

সেরিওজা বীরের মতো পা ফেলে এগিয়ে এসে হাতটা বাড়িয়ে দিল। 

…গ্রীষ্মের শেষে এ ব্যাপারটা ঘটেছিল। তখন সবে স্কুল খুলেছে। সূর্যালোকে দিনগুলো তখন ছিল উষ্ণ। এখন হেমন্ত। নীল আকাশ একটু একটু করে কেমন ঘোলাটে হয়ে এসেছে। শীতের হাওয়া কোনো ফাঁক দিয়ে যাতে ঘরে ঢুকতে না পারে সে জন্য পাশা খালা জানালার ফুটোগুলোতে পর্যন্ত কাগজ সেঁটে দিল… 

সেরিওজা বিছানায় শুয়ে আছে। বিছানার পাশে দুটি চেয়ার। একটিতে একগাদা খেলনা, আর একটিতে খেলনা দিয়ে মাঝে মাঝে খেলা করে সে। কিন্তু চেয়ারে কী খেলা যায় নাকি? ট্যাঙ্ক কোথা দিয়ে ঘুরবে, শত্রুপক্ষের পেছন ফেরার জায়গা নেই, চেয়ারের পেছনে পর্যন্ত গিয়েই তো থেমে যাবে। ঐ পর্যন্তই সীমানা যে! আর সেখানেই যুদ্ধেরও শেষ। 

ভালেরির স্নানঘর থেকে সেদিন বের হয়ে আসার পর থেকেই সেরিওজার অসুখ শুরু হল। কালি-মাখা বাঁ হাতখানি ফুলে গেছে, ভীষণ জ্বালা করছে; আলোতে বেরিয়ে আসতেই চোখে অন্ধকার দেখল। আর, সিগারেটের ধোঁয়া নাকে ঢুকতেই বমি করল খানিকটা…বাইরে ঘাসের উপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল এবার। বাঁ হাতে অসহ্য জ্বালা ও যন্ত্রণা। শুরিক আর অন্য একটি ছেলে ওকে বাড়ি পৌঁছে দিল। লম্বা-হাতে শার্ট পরা ছিল বলে পাশা খালা প্রথমে কিছু লক্ষ করে নি। কোনো কথা না বলে ঘরে ঢুকে বিছানায় শুয়ে পড়ল সে। 

তারপর বমির সঙ্গে বেদম জ্বর এল। পাশা খালা ভয় পেয়ে স্কুলে মা’কে ফোন করল। মা তক্ষুনি এসে ডাক্তারকে ডেকে পাঠাল। তারপর জামা-প্যান্ট বদলে ওর হাতের ব্যান্ডেজ খুলে ফেলে হাতটা দেখে ওরা আঁতকে উঠল। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করেও সেরিওজার কাছ থেকে জবাব এল না। জ্বরের ঘোরে তখন সে কী সব অদ্ভুত উৎকট স্বপ্ন দেখতে লাগল। ভয়ঙ্কর সে স্বপ্ন—একটা বিরাট কী যেন লাল জামা পরা, খোলা বেগুনি দুটো হাত, তাতে কালির বিদ্ঘুটে গন্ধ; কাঠের একটা বড় টুকরো, তার উপর একটা কসাই মাংস কাটছে, আর তার চারপাশে রক্তে মাখা সব ছেলেরা খারাপ কথা বলছে…স্বপ্নের ঘোরে সে কত কী বলে চলল, সে নিজেও জানল না সে কী বলছে। বড়রা তার প্রলাপ শুনে সব ব্যাপারটা বুঝে নিল। 

সেরিওজাকে ওরা সবাই ভালোবাসে এ কথা সত্যি, কিন্তু ভালেরির চাইতেও ওরাই এখন তাকে অনেক অনেক বেশি যন্ত্রণা দিতে শুরু করল। বিশেষ করে ডাক্তার তো ওর হাত দুটোকে পেনিসিলিনের ছুঁচ ফুটিয়ে ফুটিয়ে একেবারে ঝাঁজরা করে দিল। ডাক্তারের এই অত্যাচারের জন্য ব্যথায় যত না হোক, অপমানে অভিমানে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে সে কাঁদতে লাগল… ডাক্তার তাকে এভাবে শুধু যন্ত্রণা দিয়েই ছাড়ল না। একদিন শাদা পোশাক-পরা একটি মেয়েকে, তাকে নাকি নার্স না কী বলে, তার কাছে পাঠিয়ে দিল। ও এসে অদ্ভুত একটা যন্ত্রণা দিয়ে তার আঙুল ফুঁড়ে অনেকটা রক্ত বের করে নিল। তার ওপর বিষফোঁড়ার মতো ডাক্তারটি তাকে ঠাট্টা-তামাশা করে, মাঝে মাঝে তার মাথায় চাঁটি মারে। এটাই কিন্তু সবচেয়ে অসহ্য পরিহাস। 

…এভাবে দিনের পর দিন সেরিওজাকে ওদের অত্যাচার সহ্য করতে হল। খেলতেও আর ভালো লাগে না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে তার দুর্ভাগ্যের কথা ভাবতে থাকে। এসব দুঃখের প্রথম ও মূল কারণটাই সে বার করতে চায়। 

সে ভাবল, ‘ওরকম উল্কি দেওয়ার জন্যই তো আমি অসুস্থ হয়েছি। ভাস্কার মামা ওদের বাড়িতে বেড়াতে না এলে এসব অদ্ভুত জিনিসও আমি জীবনে দেখতে পেতাম না। হাঁ, সত্যিই তো উনি এখানে না এলে এসব বিতিকিচ্ছি ব্যাপার একদম ঘটত না, আমারও অসুখ করত না।’ 

না, ভাস্কার মামার ওপর তো তেমন রাগও হচ্ছে না! কী ভাবে একটা ঘটনা থেকে আর একটা ঘটনা ঘটে, এটা তারই একটা নমুনা মাত্র। দুঃখ যে কোথা থেকে আসবে কেউ বলতে পারে না। 

ওরা সবাই মিলে তাকে খুশি রাখতে চায়। মা তাকে খেলবার জন্য ছোট লাল মাছ-ভরা একটা পাত্র উপহার দিল। সেই পাত্রের মধ্যে ছোট ছোট সবুজ গাছও আছে। একটা ছোট বাক্স থেকে এক রকম গুঁড়ো মাঝে মাঝে মাছটাকে খেতে দিতে হয়। 

মা বলল, ‘ও পশুপাখি খুব ভালোবাসে। এই মাছটাও ওকে আনন্দ দেবে।’

মা অবশ্য সত্যি কথাই বলেছে। সে তার পোষা পশুপাখিদের বড় ভালোবাসে। পুষি জাইকা আর দাঁড়কাকটা তো তার কত প্রিয়। কিন্তু তা বলে মাছ তো আর পোষা যায় না! 

জাইকার গা কেমন নরম তুলতুলে আর পশুমের মতো গরম। ওকে নিয়ে খেলা করতে কেমন মজা লাগে। ও বুড়ো আর গোমড়ামুখো না হওয়া পর্যন্ত ওকে নিয়ে বেশ খেলা করা যাবে। আর দাঁড়কাকটাও ভারি মজার, সব সময়েই কেমন খুশি খুশি ভাব। সেরিওজাকে ওটা বড্ড ভালোবাসে। ঘরময় ওটা এদিক-ওদিক উড়ে বেড়াবে, কখনো-বা চামচ ঠোঁটে নিয়ে পালাবে। আবার সেরিওজা ডাকলেই তার কাছে চলে আসবে। কিন্তু মাছ ওর লেজ দোলানো ছাড়া আর কী করতে পারে? পুষি আর দাঁড়কাকের মতো অত মজার হবে কী করে? মাছ তো ভারি বোকা…মা কেন এসব বোঝে না? 

এখন সেরিওজা সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে তার খেলার সঙ্গীদের কাছে পেতে চাইছে। শুরিককে বড্ড কাছে পেতে ইচ্ছে করে। জানালা খোলা থাকতে থাকতেই শুরিক একবার জানালার ওদিকে দাঁড়িয়ে ওকে ডাক দিল 

‘সেরিওজা, কেমন আছ?’ 

সেরিওজা তড়াক করে উঠে বসে বলল, ‘এস, ভেতরে এস।’ 

শুরিকের মাথাটা শুধু জানালার তাকের উপর দিয়ে দেখা গেল। ‘ওরা আমাকে ঢুকতে দেয় না যে! তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে বাইরে এস।’ 

সেরিওজা আগ্রহভরা স্বরে প্রশ্ন করে আবার, ‘এতদিন ধরে কী করছ তুমি?’ 

‘বাবা আমাকে একটা ব্যাগ কিনে দিয়েছে। ওটা নিয়ে এবার স্কুলে যেতে হবে। আমাকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। জান, আর্সেন্তিও তোমার মতো অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আর কেউ অসুস্থ হয় নি কিন্তু। আমারও কিছু হয় নি। আর ভালেরিকে অনেক দূরে অন্য একটা স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। এখন ওকে অনেকটা পথ হেঁটে যেতে হয়।’ 

এত সব খবর জমা হয়ে আছে! 

শুরিক আবার বলে ওঠে, ‘আচ্ছা, আজ চলি। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে বাইরে এস তো!’ শেষ কথাটা শোনা গেল অনেক দূরের থেকে, নিশ্চয়ই পাশা খালা উঠানে এসে গেছে… 

ওর মতো সেরিওজাও যদি অমনি করে বাইরে দৌড়ে চলে যেতে পারত, শুরিকের সঙ্গে পথে পথে ঘুরতে পারত! অসুখে পড়ার আগের দিনগুলো সত্যি কী আনন্দেরই-না ছিল! আর এখন…তার কী কী ছিল…আর এখন সে কী হারিয়েছে, কী নেই তার, মনে পড়ছে এমনি একলা শুয়ে শুয়ে…! 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *