করোস্তেলিওভ আর অন্যরা
বড়রা কিন্তু মাঝে মাঝে বড় আজেবাজে কথা বলে! এই ধর-না, সেরিওজা একদিন ওর চায়ের কাপ উল্টে ফেলল; খালা বকবকানি শুরু করল, ‘কী তড়বড়ে ছেলে! তোমার জন্য ধোয়া-কাচা করতে করতে মরলাম বাপু। এখনও কি ছোটটি আছ নাকি?’
সেরিওজার মতে এসব কথা একেবারেই নিরর্থক আর অকারণ। এসব কথা সে একশ বার শুনেছে, আর কত শুনতে ভালো লাগে বল? তাছাড়া, চায়ের কাপ উল্টে ফেলেই সে বুঝতে পেরেছে কাজটা মোটেই ভালো হয় নি আর সেজন্য তক্ষুনি মনে মনে দুঃখিত ও হয়েছে। লজ্জিত হয়ে কেবল ভাবছে অন্যরা দেখবার আগেই খালা টেবিলক্লথটা তাড়াতাড়ি সরিয়ে ফেলছে না কেন? কিন্তু খালা বক্বক্ করেই চলেছে।
‘তুমি একবার ভেবেও দেখ না যে টেবিলক্লথটা কেউ কষ্ট করে কাচে, ধোয়, ইস্ত্রি করে আর এসব কাজে কী কষ্টই-না করতে হয়…’
‘আমি ইচ্ছে করে ফেলি নি। কাপটা কেমন পিছলে পড়ে গেল যে।’ সেরিওজা একবারে বলে ফেলল।
খালা তার কথায় কান না দিয়ে বলতেই থাকে, ‘জান, টেবিলক্লথটা পুরনো হয়ে গেছে। রিফুর উপরে রিফু করছি ওটাকে। একদিন সারা দুপুর বসে রিফু করেছি।’
যেন নতুন টেবিলক্লথের উপরেই কাপ উল্টে ফেললে ভালো হত।
খালা আবার বলছে, ‘ইচ্ছে করে ফেল নি বলেই তো মনে হচ্ছে। ইচ্ছে করে ফেললে মজাটা টের পেতে!
হাঁ, সেরিওজা যদি কোনো বাসনপত্তর কখনো ভেঙে ফেলে তা হলে ঠিক এমনই কথা শুনতে হয় ওকে। ওরা নিজেরা গ্লাস বা প্লেট ভাঙলে কোনো দোষ নেই কিন্তু।
আর মায়ের কথাগুলো তো কী অদ্ভুত! কোনো কথা বলতে গেলেই মা তাকে কথার আগে ‘দয়া করে’ কথাটা বলতে বলে। এই শব্দটার কোনো অর্থ আছে নাকি?
মা বলবে, ‘এ কথাটার অর্থ তুমি ভদ্রভাবে কিছু চাইছ। আমার কাছে যদি একটা পেন্সিল চাও তাহলে তোমাকে ‘দয়া করে’ কথাটা বলতেই হবে। ওটা বললে বুঝব তুমি আমাকে অনুরোধ করছ আর এটাই সত্যিকারের ভদ্রতা, বুঝলে?’
‘কিন্তু আমি যদি শুধু পেন্সিলটা চাই, তাহলে কি তুমি বুঝতে পারবে না?’ সেরিওজা প্রশ্ন করল এবার
‘আমাকে একটা পেন্সিল দাও, শুধু এ কথা বলতে নেই। লোকে তাহলে অসভ্য বলবে। দয়া করে আমায় একটা পেন্সিল দাও—দেখ তো কথাটা কত মিষ্টি আর সুন্দর শোনাচ্ছে। আর এমন করে বললে আমিও খুশি হয়ে তোমাকে পেন্সিলটা দেব, বুঝলে?’
‘আর আমি যদি ওকথাটা না বলি তাহলে কি পেন্সিলটা দিতে তোমার কষ্ট হবে?’
‘দেবই-না পেন্সিলটা!’
আচ্ছা, তাহলে এখন থেকে ও মায়ের কথামতোই না হয় সব কথার আগে অদ্ভুত অনর্থক ঐ কথাটা বসাবে। ওদের ধারণাগুলো বড্ড অদ্ভুত কিন্তু। ওরা বড়, তাই বাচ্চাদের ওরা শাসন করবেই। পেন্সিল দেওয়া না দেওয়া ওদের ইচ্ছের ওপর নির্ভর করে।
কিন্তু করোস্তেলিওভের কথা আলাদা; সে এসব ছোটখাটো ব্যাপারে একটুও মাথা ঘামায় না। সেরিওজা ‘দয়া করে’ বলল কি বলল না এসব ব্যাপার নিয়ে ও কোনোদিন একটি কথাও বলে নি তাকে।
ঘরের এক কোণে বসে সে যখন একমনে খেলা করে করোস্তেলিওভ তখন কখনো তাকে বিরক্ত করবে না বা অন্যদের মতো, ‘এদিকে এস তো, একটা চুমু খাব!’ এমন ধরনের বোকা বোকা কোনো কথা বলবে না। কিন্তু লুকিয়ানিচ কাজ থেকে ফিরে এসেই ওকে এ কথাটা বলবেই বলবে, তা সে তখন খেলা করুক আর নাই করুক। তারপর তার খোঁচা খোঁচা দাড়ি ঘষে দিয়ে ওকে চুমু খাবে, আর হয়তো একটা চকোলেট বা আপেল দেবে। এটা অবশ্য খুবই ভালো কিন্তু একমনে খেলা করবার সময় এভাবে গোলমাল করাটা ওর একদম পছন্দ হয় না। আপেল তো সে অন্য সময়েও খেতে পারে।
করোস্তেলিওভের কাছে সারাদিন কত রকম লোক আসছে, যাচ্ছে। তোলিয়া কাকু তো প্রায় রোজই আসে। কাকু দেখতে ভারি সুন্দর, বয়সও কত অল্প, লম্বা লম্বা চোখের পাতাগুলো কী কালো কুচকুচে! দাঁতগুলো সাদা ধবধবে আর হাসিটা কী মিষ্টি! সেরিওজা ওর দিকে অবাক বিস্ময়ে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, কারণ কাকু নাকি আবার কবিতাও লিখতে পারে। ওকে কবিতা আবৃত্তি করতে বললেই প্রথম লজ্জিতভাবে মাথা নাড়বে, একটু পরেই এক পাশে দাঁড়িয়ে কবিতা আবৃত্তি করতে শুরু করবে। সব রকম কবিতাই ও লিখতে পারে, —যুদ্ধ, শান্তি, যৌথখামার, নাৎসি, বসন্তকাল—রকমারি সমস্ত বিষয় নিয়েই ও কবিতা লেখে। নীলনয়না কোনো মেয়ের কথাও কবিতায় লেখে যার জন্য ও নাকি আজীবন ধরে প্রতীক্ষা করছে। কিন্তু কই, তবু তো সেই মেয়েটির আজ অবধি দেখা নেই! কবিতাগুলো সত্যই কী সুন্দর আর অপূর্ব! ঠিক যেন বইয়ের কবিতার মতোই সুরেলা আর মধুর। কবিতা আবৃত্তি করবার আগে তোলিয়া কাকু তার কালো ঝাঁকড়া চুলের গুচ্ছ কপাল থেকে একপাশে সরিয়ে দিয়ে একটুখানি কেশে নিয়ে ছাদের কার্নিশের দিকে চোখ তুলে গম্ভীর সুরে কবিতা আবৃত্তি করতে আরম্ভ করবে। সবাই ওকে এই আবৃত্তির জন্য অকুণ্ঠ প্রশংসা করবে আর মা ওকে এক কাপ চা তৈরি করে দেবে। তারপর সবাই মিলে চা খেতে খেতে অসুস্থ গরুর কথা আলোচনা করবে হয়তো, ‘ইয়াসি বেরেগ’ রাষ্ট্রীয় খামারের গরুগুলোর অসুখ করলে তোলিয়া কাকুই তাদের চিকিৎসা করে আবার সুস্থ সবল করে তোলে।
কিন্তু সবাই তো আর কাকুর মতো সুন্দর আর ভালো নয়। যেমন ধরো না, পেতিয়া কাকার কথা। সেরিওজা তো সব সময় তাকে এড়িয়েই চলতে চায়। লোকটা দেখতে কী বিশ্রী আর মাথাটা তো একটা সেলুলয়েডের চকচকে বলের মতো, একদম ন্যাড়া। হাসবেও কী বিশ্রীভাবে : ‘হি-হি-হি-হি!’ একদিন সে মায়ের পাশে বারান্দায় বসে আছে, করোস্তেলিওভ কোথায় বেরিয়েছে, এমন সময় পেতিয়া কাকা এসে তাকে ডেকে সুন্দর কাগজে মোড়ান একটা বড়সড় চকোলেট হাতে দিল। সেরিওজা ভদ্রভাবে ‘ধন্যবাদ’ বলে মোড়কটা খুলে দেখে ভেতরে চকোলেট-টকোলেট কিছুই নেই। পেতিয়া কাকা এভাবে তাকে ঠকাল আর নিজেও এত আশা করে ঠকল বলে সে লজ্জায় অপমানে দুঃখে এতটুকু হয়ে গেল। মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে মা-ও যেন লজ্জা পেয়েছে…
পেতিয়া কাকা হাসছে, ‘হি-হি-হি!’
এবার সেরিওজা একটুও না রেগে গম্ভীর ভাবে বলে বসল, ‘পেতিয়া কাকা, তুমি বোকা।
মা-ও নিশ্চয় তাই ভেবেছে, কিন্তু মা তক্ষুনি চেঁচিয়ে উঠল, ‘কী বললে? এক্ষুনি ক্ষমা চাও কাকার কাছে।
সেরিওজা মায়ের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
মা আবার বলল, ‘শুনতে পাচ্ছ না কী বলছি?’
এবারও সে কোনো উত্তর দিল না। মা তার হাত ধরে বাড়ির মধ্যে নিয়ে গেল।
তারপর বলল, ‘আমার কাছে আর আসবে না তুমি, বুঝলে। এমন অবাধ্য দুষ্টু ছেলের সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই না।’
তারপরও মা খানিকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে রইল যদি সে ক্ষমা চায় এই আশায় হয়তো। কিন্তু ঠোঁট চেপে অনেক কষ্টে কান্না রোধ করে সে কালো মুখ করে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শুধু। সে কোনো অন্যায় করেছে বলে ভাবতে পারছে না। তাহলে কেন ক্ষমা চাইতে যাবে? যা সত্যি ভেবেছে সে তাই তো বলেছে শুধু।
মা এবার চলে গেল। একপা দুপা করে সে খালার ঘরে গিয়ে খেলনাগুলো আনমনে নাড়াচাড়া করতে করতে ব্যাপরেটা ভুলে থাকবার চেষ্টা করল। তার ছোট্ট হাত দু-খানির আঙুলগুলো অভিমানে আর রাগে কাঁপছে থরথর করে। পুরনো তাস থেকে কাটা ছবিগুলো উদাস মনে নাড়তে নাড়তে সে হঠাৎ ইস্কাপনের কালো বিবিটার মাথা পটাস করে ছিঁড়ে ফেলল…মা কেন ঐ পাজি পেতিয়া কাকাটার পক্ষ টেনে কথা বলে? ঐ তো মা এখনও ওরই সঙ্গে কথা বলছে, হাসছেও। কিন্তু শুধু শুধু তার সঙ্গেই আড়ি দিয়ে গেল…
সন্ধ্যাবেলায় সে শুনতে পেল মা করোস্তেলিওভকে সমস্ত ঘটনা বলছে।
করোস্তেলিওভ বলছে, ‘ও ঠিকই করেছে। একেই আমি সত্যিকারের সমালোচনা বলব।
মা আপত্তির সুরে বলল, ‘কিন্তু তাই বলে একটা বাচ্চা গুরুজনদের সমালোচনা করবে? তাহলে ওদের শিক্ষা দেব কী করে? ছোটরা সম্মান দেখাবে না?’
‘কিন্তু ঐ গাধাটাকে ও কিসের জন্য সম্মান দেখাবে বল তো?’
‘নিশ্চয়ই দেখাবে। বড়রা বোকা বা গাধা একথাটাই ওর মনে হওয়া উচিত হয় নি, বুঝলে? পিওতর ইলিচের মতো বড় হলে তবে বড়দের সমালোচনা করতে পারবে।
‘আমার মতে যদি সাধারণ বিচার বুদ্ধি বিবেচনার কথা বল, তাহলে কিন্তু আমাদের সেরিওজা এখনই পিওতর ইলিচের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে। আমার তো তাই ধারণা। আর তাছাড়া শিক্ষাদানের এমন কোনো বাঁধাধরা নিয়ম রীতি নেই যার জন্য সত্যিকারের গাধাকে কোনো ছোট্ট ছেলে গাধা বলে ভাবতে পারবে না, আর তা ভাবলেই তাকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে।’
ওদের সব কথা সেরিওজা ঠিক বুঝতে না পারলেও এ-কথাটা ঠিকই বুঝল যে পেতিয়া কাকাকে গাধা বলায় করোস্তেলিওভ খুশি হয়েছে। সত্যি, করোস্তেলিওভের কাছে সে কৃতজ্ঞ থাকবে।
সত্যি কথা বলতে কি, করোস্তেলিওভ বেশ ভালো মানুষ। এতদিন সে ওদের সঙ্গে না-থেকে নানি আর বড় মা’র সঙ্গে থাকত আর মাঝে মাঝে ওদের এখানে শুধু বেড়াতে আসত এ-কথা যেন আজ আর ভাবাই যায় না।
সেরিওজাকে সে নদীতে স্নান করতে নিয়ে যায়, সাঁতার শেখায়। মা তো ভয়েই অস্থির, সেরিওজা বুঝি ডুবেই যাবে। কিন্তু করোস্তেলিওভ মায়ের কথায় কান না দিয়ে শুধু হাসে। সেরিওজার খাটের দু-ধারের রেলিং উঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা সে করল। মা আপত্তি তুলে বলল, সে নাকি তাহলে রাত্রিতে মেঝেয় গড়িয়ে পড়ে যাবে আর ব্যথা পাবে। কিন্তু করোস্তেলিওভ দৃঢ় স্বরে বলল, ‘ধর আমরা ট্রেনে কোথাও যাচ্ছি। তখন সে উপরের বার্থে শুলো। তাহলে? বড়দের মতো শুতে অভ্যাস করতে হবে না বুঝি?
তাই এখন আর সকাল-বিকাল ওকে খাটের রেলিং টপকে বিছানায় যেতে আসতে হয় না। বড়দের মতোই খোলা বিছানায় মজা করে ঘুমায়।
একবার অবশ্য সে নাকি রাত্রিবেলা বিছানা থেকে ধুপ করে মেঝেয় পড়ে গিয়েছিল। শব্দ শুনতে পেয়ে ওরা তাকে কোলে করে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়। সকালবেলা সেকথা বললে সে অবাক হয়ে ভাবল, ওর তো কই কিছুই মনে পড়ছে না! শরীরের কোথাও এতটুকু ব্যথাও লাগে নি। তাহলে খোলা খাটে শোয়ার কী আপত্তি থাকতে পারে?
একদিন উঠানে সে একটা আছাড় খেল। হাঁটুর চামড়া ছিঁড়ে গিয়ে অনেকটা রক্তও ঝরল। কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরলে খালা ব্যস্ত হয়ে উঠল ব্যান্ডেজের জন্য। কিন্তু করোস্তেলিওভ বলল :
‘কেঁদ না সোনা। ছি, কাঁদতে নেই। এখনই সব ঠিক হয়ে যাবে। ধর তুমি একজন সৈন্য, যুদ্ধে আহত হয়েছ। কী করবে তখন, কাঁদবে?…’
সেরিওজা প্রশ্ন করল, ‘তোমার কেটে গেলে, কাঁদতে না?’
‘না। কেমন করে কাঁদব বল? অন্য ছেলেরা তাহলে বেজায় খেপাবে যে! আমরা পুরুষ, এটাই তো আমাদের কর্তব্য।
সেরিওজা এবার চোখের জল মুছে ফেলল। ওদের মতো সে-ও বীরপুরুষ এ কথা প্রমাণ করবার জন্য হা-হা করে হাসতে চেষ্টা করল। খালা ব্যান্ডেজ নিয়ে এলে সে হাসি নিয়ে বলল, ‘দাও, বেঁধে দাও! ভয় নেই! একটুও ব্যথা লাগছে না কিন্তু!’
তারপর করোস্তেলিওভ ওকে যুদ্ধের গল্প বলতে লাগল। যুদ্ধের কত কাহিনী শুনে করোস্তেলিওভের পাশে এক টেবিলে বসে বিচিত্র এক গর্বে তার বুকখানি ভরে উঠল। আবার যদি শুরু হয় তাহলে যুদ্ধে কে যাবে? কেন, আমি আর করোস্তেলিওভ তো যাবই! এটাই তো আমাদের কর্তব্য। কিন্তু মা, খালা আর লুকিয়ানিচ এখানেই থাকবে, আমাদের বিজয়ের জন্য অপেক্ষা করবে, সেটাই ওদের কর্তব্য।