বিদায়-বেলা

বিদায়-বেলা 

তারপর একদিন কতকগুলো লোক এসে খাবারঘর আর মায়ের ঘরের সব আসবাবপত্তর সরিয়ে গুছিয়ে বাঁধাছাঁদা করতে লেগে গেল। মা পর্দা আর ছবিগুলো সব নামিয়ে নিল। কিছুক্ষণ পর একটু-আধটু দড়িদড়া, টুকটাক এটা-ওটা ঘরের মেঝের উপর এদিক-ওদিক ছড়িয়ে রইল শুধু। শূন্য ঘরগুলো কী বিশ্রী না লাগছে দেখতে! শুধু খালার ঘর আর রান্নাঘরটাই আগের মতো সুন্দর আর গোছানো রইল। সমস্ত বাড়িটাকেই যেন এই মুহূর্তে কেমন ছন্নছাড়া দেখাচ্ছে। চেয়ারগুলোকে একটার উপর আর একটা ছাদের দিকে পা তুলে উল্টে রাখা হয়েছে। 

অন্য সময়ে এমনটি হলে কেমন মজা করে লুকোচুরি খেলা যেত। কিন্তু আজ আর সে প্রশ্ন নেই… 

লোকগুলো কাজ সেরে অনেক রাত্রে চলে গেল। সবাই তারপর ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ল। লিওনিয়াও রোজকার মতো কাঁদাকাটি করে ঘুমিয়ে পড়েছে। পাশা খালা আর লুকিয়ানিচ শুয়ে শুয়ে অনেক রাত অবধি ফিসফিস করে কী বলল আর সাথে সাথে নাক ঝাড়তে লাগল। তারপর তারাও এক সময় নীরব হয়ে গেল। একটু পরেই লুকিয়ানিচের নাক থেকে ঘর্ঘর শব্দ আর খালার নাক থেকে মৃদু শিসের মতো শব্দ শোনা যেতে লাগল। 

করোস্তেলিওভ খাবারঘরের টেবিলে বসে কী লিখে চলেছে একমনে। আচমকা তার পেছনে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পেয়ে পেছন ফিরে দেখে সেরিওজা তার লম্বা রাত্রিবাস পরে খালি পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার গলায় ব্যান্ডেজ বাঁধা। 

করোস্তেলিওভ অবাক হয়ে মৃদু স্বরে প্রশ্ন করল, ‘এখানে কী করছ সোনা?’

সেরিওজা করুণ স্বরে বলে উঠল, ‘তুমি আমায় নিয়ে চল। সঙ্গে নিয়ে চল আমাকে। আমাকে ফেলে রেখে যেও না, ফেলে রেখে যেও না!’ 

এবার সে অঝোরে কাঁদতে লাগল। অন্যরা জেগে না যায় এজন্য অনেক কষ্টে কান্নার শব্দ চাপতে চেষ্টা করল। 

করোস্তেলিওভ তাকে কাছে টেনে এনে দু-হাতে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘দেখ দেখি সোনা, এই ঠাণ্ডা মেঝের উপর খালি পায়ে হাঁটা তোমার বারণ তুমি তো তা জান… তুমি আমাকে কথাও দিয়েছিলে এমনটি আর করবে না কোনোদিন, তাই না?…’ 

সেরিওজা তেমনি কাঁদতে কাঁদতে শুধু বলল, ‘আমি হোল্‌মোগোরি যাব!’ 

করোগুলিওভ বলল, ‘উঃ! পা দুটো কী ঠাণ্ডা তোমার!’ লম্বা রাত্রিবাস দিয়ে তার ছোট্ট পা দুটিকে ঢেকে বুকে চেপে ধরল। এবার সে শীতে থর থর করে কাঁপছে। ‘আর কোনো উপায় না থাকলে কী করা যায় বল তো, সোনা? তুমি সুস্থ নও…’ 

‘আমি আর কোনোদিন অসুস্থ হব না!’ 

‘তুমি একেবারে ভালো হয়ে গেলেই আমি এসে তোমায় নিয়ে যাব সোনা।’

‘সত্যি নেবে?’ 

‘তোমার কাছে কোনোদিন আমি মিথ্যে কথা বলেছি খোকন?’ 

সত্যি করোস্তেলিওভ এতদিন একটিও মিথ্যে কথা বলে নি তাকে। কিন্তু সব বড়দের মতো সেও যদি কখনো কখনো মিথ্যে কথা বলে?… হয়তো এবার তাকে মিথ্যে বলে ভোলাতে চেষ্টা করছে। 

সেরিওজা করোস্তেলিওভের সবল গলাখানিকে ছোট্ট দু-হাতের সমস্ত শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরে মুখ লুকিয়ে রইল। ওর প্রশস্ত সুন্দর বুকখানিই যেন তার সবচেয়ে বড় আর নিরাপদ আশ্রয়। এই লোকটিই তার একমাত্র আশা, ভরসা। সমস্ত অন্তর ঢেলে এই একজনই তাকে ভালোবাসে, আদর করে। করোস্তেলিওভ তাকে কোলে নিয়ে ঘরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পায়চারি করতে করতে আদর-মাখানো মৃদু স্বরে কত কথা বলে যাচ্ছে ওর কানে কানে : 

‘…আমি এসে তোমায় নিয়ে যাব। আমার খোকন আর আমি ট্রেনে করে যাব…ট্রেনটা হুসহুস করে ঝড়ের বেগে আমাদের নিয়ে উধাও হয়ে যাবে… কত লোক থাকবে সেই ট্রেনে…একটু পরেই দেখব মা আমাদের জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে স্টেশনে… ইঞ্জিনটা বাঁশি বাজিয়ে ঝিকঝিক করে চলতে থাকবে…’ 

সেরিওজা করোস্তেলিওভের বুকে মুখ লুকিয়ে তখন ভেবে চলেছে, আমাকে নিতে আসবার সময় ওর থাকবে না। মা-ও সময় পাবে না। কত লোক করোস্তেলিওভের কাছে আসবে, যাবে। টেলিফোন করে তাকে অনবরত বিরক্ত করবে। করোস্তেলিওভের কাজের কি অন্ত থাকবে নাকি? তাছাড়া, তাকে পরীক্ষা দিতে হবে। রোজ লিওনিয়াকে ঘুম পাড়াতে হবে। অত কাজের মাঝে ওরা আমাকে একেবারেই ভুলে যাবে। আর আমি এখানে শুধু অপেক্ষা করব কবে আমায় নিয়ে যাবে বলে… এই অপেক্ষার শেষ নেই বুঝি… 

করোস্তেলিওভ তখনো বলে চলেছে, ‘জান, ওখানে সত্যিকারের বন আছে… আর সেই বনে নাকি অজস্র বেরিফল ও বেঙের ছাতা আছে…’ 

‘সে বনে নেকড়ে থাকে? 

‘তা তো ঠিক জানি না। নেকড়ে আছে কিনা জেনে নিয়ে তোমায় চিঠি লিখে জানাব, কেমন?’… ওখানে একটা নদী আছে। আমরা দু-জনে স্নান করতে যাব… তোমাকে সাঁতার শিখিয়ে দেব।…’ 

সত্যিই যদি তাই হয় তাহলে ভারি মজা হয় কিন্তু। মনটা ওর যেন সন্দেহে, দ্বিধায় ক্লান্ত হয়ে উঠল। 

‘আমরা দু-জনের নদীতে মাছ ধরব…বাঃ, দেখ, দেখ, বাইরে কেমন সুন্দর বরফ পড়ছে!’ 

এবার সে সেরিওজাকে কোলে নিয়ে জানালার ধারে এসে দাঁড়াল। পেঁজা তুলোর মতো বরফ পড়ছে বাইরে। মৃদু হাওয়ায় হালকা পালকের মতো ভেসে ভেসে বেড়িয়ে জানালার কাছে এসে আস্তে ধাক্কা খাচ্ছে। 

সেরিওজা সেদিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারপর তার বিষণ্ণ রুগ্‌ণ মুখখানির বিবর্ণ নরম গালটি করোস্তেলিওভের গালে চেপে ধরল। 

করোস্তেলিওভ বলতে লাগল, ‘শীত তো এসেই গেল এখন তুমি সারাটা দিন বাইরে খেলা করতে পারবে, স্লেজগাড়িতে চড়ে বরফের উপর দিয়ে ছুটোছুটি করতে পারবে। আর দেখবে কত তাড়াতাড়ি তোমার সময় কেটে যাবে…’ 

‘হাঁ… কিন্তু।’ সেরিওজা ক্লান্ত স্বরে এবার বলল, ‘আমার স্লেজের দড়িটা বড্ড পুরনো হয়ে গেছে। একটা নতুন দড়ি লাগিয়ে দেবে?’ 

‘ঠিক কথা মনে করিয়ে দিয়েছ। কালই নতুন দড়ি লাগিয়ে দেব। কিন্তু তুমি আমায় একটা কথা দেবে বল? বল, আর কাঁদবে না? কাঁদলে তোমার খারাপ হয়, তোমার মা-ও অস্থির হয়ে যায় বোঝ তো? তাছাড়া, পুরুষমানুষরা কি কাঁদে নাকি? তুমি কাঁদলে আমার ভালো লাগে না… বল আর কাঁদবে না? 

‘হুঁ’, সেরিওজা বলল। 

‘কথা দিলে তো?’ 

‘হুঁ…’ 

‘বেশ, মনে থাকে যেন। ভদ্রলোকের এক কথা। পুরুষের কথার কখনো নড়চড় হয় না, জান তো?’ 

করোস্তিলিওভ এবার তার ক্লান্ত ছোট দেহখানি কোলে করে পাশা খালার ঘরে আস্তে নিয়ে এসে তার বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বিছানাটা ভালো করে গুঁজে দিল। সেরিওজা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল। করোস্তলিওভ কিছুক্ষণ তার ঘুমন্ত সুন্দর মুখখানির দিকে তাকিয়ে রইল। খাবারঘরের আবছা আলোর ছটায় দেখা গেল তার মুখখানি কেমন বিবর্ণ, বিষণ্ন দেখাচ্ছে… একটু পরে পা টিপে সে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *