সাইকেল কেনা হল

সাইকেল কেনা হল 

রবিবার আবার সেই কাঁধে চড়ে সে সাইকেল কিনতে চলল। 

রবিবারটাও হঠাৎ যেন এসে পড়ল। আর এসে পড়তেই সে আনন্দে উত্তেজনায় পাগল হয়ে উঠল। 

করোস্তেলিওভকে প্রশ্ন করল, ‘আজকের কথা মনে আছে তো?’ 

‘নিশ্চয়ই মনে আছে, অতবড় দরকারি কথা ভুলতে পারি নাকি? দু-একটা হাতের কাজ সেরেই আমরা যাব।’ 

এই কাজের কথাটা একেবারেই কিন্তু বাজে। শুধু মায়ের সঙ্গে বসে বসে গল্প করা ছাড়া তার কোনো কাজই করবার নেই। আর এই কথা বা গল্পও কেমন যেন একঘেয়ে আর বোকা বোকা। কিন্তু ওরা দু-জনেই এরকম কথা বলতেই বেশ ভালোবাসে তা বোঝা যায়। কারণ ওরা কথা বলতে আরম্ভ করলে আর শেষ করতে চায় না। বিশেষ করে মা তো একই কথা বার বার বলবেই। ক’বার সেরিওজা ওদের দু-জনের এপাশ-ওপাশ থেকে নীরবে লক্ষ করেছে, ওরা দু-জনে চুপি চুপি একটা কথাই কেবল বলে যাচ্ছে। সে শুধু অবাক হয়ে ভাবে কখন ওরা ক্লান্ত হয়ে এরকম বকানি বন্ধ করবে। 

মা ফিস ফিস করে বলছে, ‘তুমি এত দরদি, তোমার সমস্ত বুক দিয়ে সবকিছু বুঝতে পার বলেই আমি এত সুখী হয়েছি।’ 

করোস্তেলিওভও বলছে, ‘সত্যি কথা বলতে কি, তোমাকে দেখবার আগে এসব বিষয় আমি অন্তর দিয়ে ঠিক বুঝতে পারি নি। কত জিনিসই বুঝতে পারতাম না আগে—কবে থেকে বুঝতে পারলাম বল দেখি? ঠিকই বুঝতে পারছ তো?’ 

তারপর ওরা দু-জন দু-জনের হাত ধরল। 

মা বলল, ‘তখন আমি ছিলাম ছোট। ভাবতাম আমি খুব সুখে আছি। তারও পর মনে হত দুঃখে একেবারে মরে যাব। আজ কিন্তু সে সব স্বপ্ন মনে হচ্ছে…’ 

করোস্তেলিওভের দুই হাতের মধ্যে নিজের মুখখানি লুকিয়ে মা কেবলই একটা কথা বিড়বিড় করে বলছে এবার : 

‘আমি যেন মধুর একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম, ঘুমের আবেশে শুধু যেন একটা সুখস্বপ্ন। তারপর যেন হঠাৎ সেই ঘুম ভেঙে জেগে দেখি তুমি-তুমি রয়েছ আমার পাশে… 

করোস্তেলিওভ মা’কে কথা বলতে না দিয়ে বলে উঠল, ‘আমি তোমায় ভালোবাসি।’

মা কিন্তু তার কথায় এতটুকুও বিশ্বাস করতে পারছে না। বার বার কেবল বলছে, ‘সত্যি বলছ?’ 

‘ভালোবাসি, প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি…’ 

‘সত্যি ভালোবাস?’ 

মা যেন কী! বার বার একটা কথাই বলছে কেন? 

করোস্তেলিওভই-বা দিব্যি করে কিংবা ভয়ানক একটা শপথ করে কথাটা বলছে না কেন? তাহলে তো মা আর অবিশ্বাস করতে পারবে না। 

এবার করোস্তেলিওভ কোনো কথা না বলে মা’র দিকে অপলকে তাকিয়ে আছে শুধু। বোধহয় তার আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। মা-ও কেমন তার দিকে একভাবে তাকিয়ে আছে। উঃ, ওরা দু-জন দু-জনের দিকে এমনি করে আর কতক্ষণ তাকিয়ে থাকবে? অনেকক্ষণ পর মা আবার বলল, ‘আমি তোমায় ভালোবাসি।’ (এ যেন একটা খেলা। একই কথা কতবার কতভাবে বলা।) 

সে ভাবতে লাগল, ওরা কখন এসব একঘেয়ে বাজে কথা বন্ধ করবে? 

কিন্তু সে জানে বড়রা যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলে তখন তাদের কোনোমতেই বিরক্ত করা চলে না। ওটা ওরা কিছুতেই সহ্য করতে পারে না। 

সে যদি এখন ওদের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ায় তাহলে না-জানি ওরা রেগে কী করবে! একপাশে চুপটি করে এমনি দাঁড়িয়ে থেকে মাঝে মাঝে ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে সে যে ওখানে দাঁড়িয়ে আছে সে কথাটা ওদের বুঝিয়ে দেওয়া ছাড়া কিছুই তো সে করতে পারে না। 

কিন্তু আর কিছুক্ষণ পর তার কষ্টের শেষ হল মনে হয়। করোস্তেলিওভ শেষ পর্যন্ত মাকে বলল, ‘আমাকে একঘণ্টার জন্য একটু বাইরে যেতে দাও মারিয়াশা! সেরিওজা আর আমি একটা জরুরি কাজে যাচ্ছি।’ 

তারপর করোস্তেলিওভের কাঁধে চড়ে ভালো করে চারদিকে তাকাবার আগেই সে খেলনার দোকানে পৌঁছে গেল। করোস্তেলিওভের পা দুটো কী লম্বা আর কী তাড়াতাড়িই-না চলে! আশ্চর্য! দোকানের দরজায় পৌঁছে করোস্তেলিওভ তাকে কাঁধ থেকে নামিয়ে দিয়ে দু-জনে ভেতরে ঢুকল। 

ওঃ! কত রকমারি সুন্দর সুন্দর খেলনা চারদিকে! ফোলা ফোলা গালের ঐ যে একটা ডল পুতুল তার দিকে তাকিয়ে হাসছে যেন! ওটার ছোট্ট পা দুখানিতে আবার চামড়ার জুতোও পরান রয়েছে যে। একটা লাল রঙের ড্রামের উপর নীল ভালুকের গোটা একটা পরিবার আরামে বসে আছে। একটা পাইওনিয়র শিঙা সোনার মতন ঝিকমিক করছে। আরো কত কী খেলনা ছড়ানো রয়েছে এদিকে-ওদিকে। কোনদিকে তাকাবে, কোনটা দেখবে! আশায় আনন্দে সে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে যেন… ভেতর থেকে একটা বাজনার সুর ভেসে আসছে। উকি মেরে দেখে একটা লোক একটা একর্ডিয়ান খেয়ালখুশিমতো প্যাঁ পোঁ করে টানছে আর বন্ধ করছে। ওটার ভিতর থেকে কান্নার মতো একটা যন্ত্রণার সুর বেজে উঠছে শুধু। তারপরেই আবার থেমে যাচ্ছে। এবার মিষ্টি গানের হালকা সুর শুনতে পেল সে। রবিবারের পোশাকপরা কতকগুলো লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গান শুনছে। কাউন্টারের ওপাশে এক বুড়ো দোকানি দাঁড়িয়ে আছে। করোস্তেলিওভকে দেখে সেই লোকটা এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল, ‘কী দেখবেন? 

‘এই বাচ্চার জন্য একটা সাইকেল দেখান। 

লোকটা ঝুঁকে পড়ে সেরিওজাকে এক পলক দেখে নিয়ে বলল, ‘তিন চাকার সাইকেল তো?’ 

সেরিওজা তক্ষুনি কাঁপা গলায় বলে উঠল, ‘না, না, তিন চাকার সাইকেল আমি নেব না।’ 

লোকটা এবার হাঁক দিল, ‘ভারিয়া!’ 

কিন্তু কেউ এল না, আর বুড়োটাও তার কথা ভুলে গিয়ে ঐ লোকগুলোর কাছে গিয়ে এটা-ওটা কী করতে লাগল। মিষ্টি মজার গানের সুর বন্ধ হয়ে গেছে। তার বদলে কেমন একটা দুঃখের গান বাজতে লাগল। একি, ওরা কেন এখানে এসেছে সে কথা নিঃশেষে ভুলে গিয়ে করোস্তেলিওভও যে লোকগুলোর কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ওরা সবাই এক মনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী করছে কে জানে…সেরিওজা এবার অধৈর্য হয়ে করোস্তেলিওভের জ্যাকেট ধরে টান দিল সে যেন ঘুম থেকে জেগে উঠল। তারপর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘আঃ! কী সুন্দর গান!’ 

সেরিওজা চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমাদের সাইকেল দেবে নাকি?’ 

বুড়ো আবার চিৎকার করল, ‘ভারিয়া!’ 

এখন তাহলে ভারিয়া নামে লোকটার ওপরেই নির্ভর করছে সে সাইকেল পাবে কি পাবে না। যাক, শেষ পর্যন্ত কাউন্টারের পেছনে তাকের পাশের ছোট্ট দরজাটি দিয়ে একটি মেয়ে ঘরে ঢুকল। বোঝা গেল ওরই নাম ভারিয়া। ভারিয়া একটা পাউরুটি চিবোতে চিবোতে এগিয়ে এল। বুড়ো সেরিওজাকে দেখিয়ে তাকে এবার বলল, ‘গুদাম ঘর থেকে এই ভদ্রলোকটির জন্য একটা সাইকেল নিয়ে এস তো।’ হাঁ, ওকে বাচ্চাছেলে না বলে এরকম ভদ্রলোক বলাটাই তো সত্যিকারের ভদ্রতা। 

গুদামঘরটা মনে হচ্ছে পৃথিবীর অপর প্রান্তে! ভারিয়া যে গেল আর আসার নাম নেই। বাজনাটা নিয়ে টুং টাং করছিল যে লোকটা তার ওটা কেনা হয়ে গেল। করোস্তেলিওভ একটা গ্রামোফোন কিনল। গ্রামোফোন যন্ত্রটা কী অদ্ভুত! একটা বাক্সের উপর কালো একটা প্লেটের মতো কী বসিয়ে দিলেই প্লেটটা ঘুরতে ঘুরতে তোমার খুশিমতো মজার বা দুঃখের যে কোনো একটা গান বাজতে শুরু হয়ে যাবে। কাউন্টারের উপর ওরকম একটা বাক্সেই এতক্ষণ গানটা বাজছিল। করোস্তেলিওভ কাগজ মোড়ানো এক গাদা প্লেটের মতো ঐ জিনিসগুলো কিনল। দু-বাক্স ছুঁচের মতো পিন নাকি বলে ওগুলোকে, তা-ও নিল। 

সেরিওজার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল, ‘তোমার মা’র জন্য এই উপহারটা কিনলাম।’ 

সবাই বুড়োর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে দেখছে কেমন করে সে জিনিসগুলো সব বেঁধে ছেঁদে দিচ্ছে। তারপর ভারিয়া যেন পৃথিবীর ওপার থেকে সাইকেল নিয়ে এসে উপস্থিত হল। স্পোক, বেল, দুটো হাতল, পাদানি, বসবার জন্য চামড়ার গদি আর একটা ছোট্ট লাল আলোও আছে তাতে! সাইকেলটার পেছনে হলদে রঙের টিনের প্লেটের ওপর একটা নম্বর লেখা রয়েছে যে! 

বুড়ো এবার সাইকেলটা হাতে নিয়ে বলতে শুরু করল, ‘দেখুন, জিনিসটা কী চমৎকার! এমন জিনিস আর অন্য জায়গায় পাবেন না। এই যে, সামনের চাকাটা ঘোরান, ঘণ্টিটা বাজান, পাদানিতে চাপ দিন, দেখুন, ভালো করে দেখুন-না সব। সত্যি জিনিসটা খুব সুন্দর আর মজবুত। ব্যবহার করলেই বুঝতে পারবেন, জীবনভর আমাকে ধন্যবাদ জানাবেন। 

করোস্তেলিওভ সাইকেলটা হাতে নিয়ে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখতে লাগল। সেরিওজা অবাক বিস্ময়ে শুধু হাঁ করে দেখছে আর ভাবছে—এই অপূর্ব সুন্দর জিনিসটা তাহলে ওরই জন্য কেনা হল? এ যেন ঠিক বিশ্বাস করা যায় না। 

তারপর সে সেই সাইকেলে চেপেই বাড়ি ফিরল। অর্থাৎ চামড়ার নরম গদিতে বসে ছোট্ট দু-হাতে হাতল দুটি আঁকড়ে ধরে, বেয়াড়া পাদানিতে পা দেবার আপ্রাণ চেষ্টা করে সে খুশি মনে সাইকেলের উপর বসে আছে আর করোস্তেলিওভ প্রায় কুঁজো হয়ে সাইকেলশুদ্ধ ওকে টেনে নিয়ে চলেছে। বাড়ির দরজা পর্যন্ত সে ওকে এনে সাইকেলটাকে বেঞ্চের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে বলল : 

‘এবার নিজে নিজে চড়বার চেষ্টা কর, আমি তো ঘেমে গিয়েছি।’ 

করোস্তেলিওভ এবার বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। জেঙ্কা লিদা আর শুরিক ওদিক থেকে সেরিওজাকে দেখতে পেয়েই দৌড়ে এল। 

সেরিওজা ওদের দিকে তাকিয়ে গর্বভরা সুরে বলল এবার, ‘আমি এরই মধ্যে এটা চালাতে শিখে গেছি! সরে যাও, সরে যাও তোমরা। না হয় চাপা দেব কিন্তু!’ 

সেরিওজা সাইকেলটায় চেপে একটু চালাবার চেষ্টা করতেই ধপাস্ করে মাটিতে পড়ে গেল। 

‘ওঃ! বলেই সে তাড়াতাড়ি গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ে হাসতে চেষ্টা করল। যেন এতে ওর কিছুই হয় নি। কৈফিয়তের ভঙ্গিতে বলল, ‘হাতলটা উল্টো দিকে ঘুরিয়েছি কিনা তাই এমনটি হল। আর পাদানিতে পা দেওয়া তো মুশকিল!’ 

জেঙ্কা উপদেশ দিল, ‘জুতো খুলে ফেল। খালি পায়ে বেশ সুবিধে হবে। তাহলে পায়ের আঙুল দিয়ে পাদানি চেপে ধরতে পারবে। দেখি, একটু আমি চড়ি, শক্ত করে ধরে রাখ দেখি—আরও শক্ত করে।’ জেঙ্কা এবর সাইকেলের উপর উঠে বসল। 

সবাই মিলে সাইকেলটাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলেও জেঙ্কা ওটা চালাতে চেষ্টা করতেই শুধু একা নয়, সেরিওজাকে নিয়েই আছাড় খেল। 

লিদা এবার চেঁচিয়ে উঠল, ‘এবার আমি চড়ব!’ 

শুরিক বলল, ‘না, না, আমি?’ 

জেঙ্কা গা ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, ‘এখানটায় কী ধুলো। তাই এখানে চালান শেখা যাবে না। এসো, আমরা ভাস্কার গলিতে গিয়ে শিখি।’ 

ভাস্কার বাগানের পেছনে একটুখানি খালি সবুজ জমি, তারই গায়ে একটা কানাগলিকে ওরা বলত ভাস্কার গলি। তার একদিকে উঁচু বেড়া-দেওয়া কাঠের গুদাম। নরম সবুজ ঘাসে মনে হয় জায়গাটায় যেন সুন্দর গালিচা বিছানো রয়েছে। খেলাধুলোর পক্ষে জায়গাটা ভারি চমৎকার, কারণ বড়রা কেউ এখানে বিরক্ত করে না। তিমোখিনের বাড়ির সীমানায় বেড়া পর্যন্ত এসে জায়গাটা শেষ হয়ে গেছে। ভাস্কার মা আর শুরিকের মা দু-জনেই তাদের বেড়া ডিঙিয়ে গোবর মাটি নোংরা সমস্ত কিছু এদিকটায় ফেললেও জায়গাটার মালিকানাস্বত্ব নিয়ে তারা কেউ কখনো বাদানুবাদ করে নি। সবাই একবাক্যে মেনে নিয়েছে এটা ভাস্কারই গলি। 

জেঙ্কা, লিদা, শুরিক সবাই মিলে সাইকেলটাকে টানতে টানতে ভাস্কার গলিতে নিয়ে চলল। সেরিওজা ওদের পেছন পেছন ছুটতে লাগল। চলতে চলতে ওরা কে আগে শিখবে সেই নিয়ে তুমুল তর্ক শুরু করল। জেঙ্কা বলল, সে ওদের মধ্যে বয়সে বড়, তাই  আগে শিখবার অধিকারটা একমাত্র তারই। তারপর লিদা, তারপর শুরিক। সবশেষে সেরিওজাকে দিল চড়তে। কিন্তু একটু পরেই জেঙ্কা চেঁচিয়ে উঠল আবার, ‘নাও, হয়েছে! এবার আমার পালা!’ 

এত তাড়াতাড়ি সাইকেলটা ছেড়ে দিতে সেরিওজার মন চায় না, ছোট্ট ছোট্ট হাত-পা দিয়ে সে সাইকেলটাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘না, না, আমি আরো একটু চড়ব! এটা তো আমার সাইকেল!’ 

শুরিক তখনই বলে উঠল, ‘কী ছোটলোক!’ 

লিদাও বিশ্রী মুখভঙ্গি করে ওকে ভেংচাতে লাগল, ‘কী কিপ্টে বাবা, কী ছোটলোক! কৃপণ, নিজের জিনিস আঁকড়ে ছোটলোকি! ছি, ছি, লজ্জাও হয় না!’ 

আর একটিও কথা না বলে সেরিওজা সাইকেলটা ছেড়ে দিল। তারপর তিমোখিনের বাড়ির বেড়ার সামনে গিয়ে ওদের দিকে পেছন ফিরে কাঁদতে লাগল। সে এখন সমস্ত প্রাণমন দিয়ে সাইকেলটাকে নিজের করে পেতে চাইছে আর ওরা বয়সে বড় বলে, ওদের গায়ের জোর তার চেয়ে অনেক বেশি বলে তাকে তারা আমলই দিতে চাইছে না, এটা কিন্তু ভারি অন্যায়। তাই সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। 

কিন্তু ওরা কেউ তার দিকে একবার ফিরেও তাকাল না। ওদের মাতামাতি চিৎকার আর সাইকেলটার ঝনঝনানি শব্দ সে পেছনে না ফিরেও ঠিক শুনতে পাচ্ছে। কেউ তাকে ডাকল না, বলল না তো, ‘এবার তোমার পালা, এস। ওদের তৃতীয় পালা চলছে এবার! আর সে কেঁদেই চলেছে। এমন সময় হঠাৎ ভাস্কা বেড়ার ওদিক থেকে দেখা দিল। 

কোমর পর্যন্ত খালি গা, বড় ট্রাউজার পরা, আঁটসাঁট করে কোমরে বেল্ট বাঁধা, টুপি মাথায় ভাস্কাকে বেশ চটপটে দেখাচ্ছে। এদিকে এক পলক তাকিয়েই ও ব্যাপারটা যেন এক মুহূর্তে বুঝে নিল। 

তারপর চিৎকার করে উঠল, ‘এই, কী করছ তোমরা? এটা তোমাদের সাইকেল, নাকি, ওর? সেরিওজা, এদিকে এস তো!’ 

ভাস্কা বেড়া ডিঙিয়ে এদিকটায় এসে ওদের হাত থেকে সাইকেলটা তক্ষুনি ছিনিয়ে নিয়ে নিল। জেঙ্কা লিদা আর শুরিক কথাটি না বলে একপাশে সরে দাঁড়াল। সেরিওজা দু-হাতে চোখ কচলাতে কচলাতে এদিকে এগিয়ে এল এবার। লিদা গোমড়া মুখে বলল, ‘তোমরা দুটিতেই বড় ছোটলোক!’ 

ভাস্কা ধমকে উঠল, ‘আর তুমি? স্বার্থপর, পাজি!’ আরো কী গালাগালি দিয়ে শেষে বলল, ‘সবার ছোট যে তাকেই আগে শিখতে দিতে হয় তা-ও জান না বুঝি? এস, সেরিওজা, এস তো।’ 

সেরিওজা এবার সাইকেলটায় চড়ে বসল। লিদা ছাড়া আর সবাই ওকে শিখতে সাহায্য করল। লিদা ঘাসের উপর লেপটে বসে একমনে ঘাসফুল ছিঁড়ে ছিঁড়ে মালা গাঁথতে লাগল যেন ঐ সাইকেল চড়ার থেকে এতেই আনন্দ বেশি। তারপর কিছুক্ষণ পর ভাস্কা বলল, ‘এখন আমি চড়ব, কেমন!’ সেরিওজা খুশিমনেই ওকে সাইকেলটা ছেড়ে দিল। ভাস্কার জন্য সে এখন সব কিছু ছাড়তে পারে। তারপর আবার সে চড়ল। এখন সে একা একা চড়তে বেশ শিখে গেছে। মাটিতে না পড়ে কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক ঘুরল। এদিক-ওদিক হেলেদুলে পড়ি পড়ি করে শেষ পর্যন্ত না-পড়ে সে খানিকটা চড়তে শিখল। ওর পা চাকার মধ্যে ঢুকে যাওয়ায় চারটে স্পোক খুলে এল। কিন্তু হলে কী হবে, সাইকেলটা এত চমৎকার যে তবুও সেটা ঠিকই চলছে। এবার অন্য ছেলেদের জন্য সেরিওজার কষ্ট হল।

‘ওরাও চড়ুক, আমি আবার না-হয় চড়ব’, বলে সে ওদের হাতে সাইকেলটা দিয়ে দিল।

কিছুক্ষণ পর খালা বাগানে কী কাজে এসে কান্নার শব্দ শুনতে পেয়ে তাকিয়ে দেখে সেরিওজা ভেউ ভেউ করে কাঁদছে। একটু এগিয়ে এসে দেখে একটা বিচিত্র শোভাযাত্রা এদিকেই আসছে। প্রথমে সেরিওজা হাতলটি হাতে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আসছে। তারপর ভাস্কা সাইকেলের কাঠামোটা হাতে নিয়ে, তার পেছনে জেঙ্কার দু-কাঁধে দুটো চাকা ঝুলছে। লিদার হাতে ঘণ্টিটা আর শুরিক সবার শেষে এক বান্ডিল স্পোক হাতে নিয়ে চলেছে। 

খালা বলে উঠল, ‘কী সর্বনাশ!’ 

শুরিক বলল, ‘আমরা কিছু করি নি কিন্তু। ও নিজেই এই কাণ্ডটা করেছে। চাকার মধ্যে ওর পা ঢুকে গিয়েছিল কিনা।’ 

করোস্তেলিওভ এতক্ষণে বাইরে এসে দেখতে লাগল, ব্যাপারটা কী। তারপর বলল, ‘বাঃ! জিনিসটার বেশ সদ্ব্যবহার করেছ তো!’ 

সেরিওজা এবার চিৎকার করে কেঁদে উঠল। 

করোস্তেলিওভ ওর কাছে এসে বলল, ‘না, আর কেঁদ না! ওটা সারিয়ে আনব দেখ। কারখানায় নিয়ে গেলেই ওরা আবার ওটাকে একেবারে নতুন করে দেবে।’ 

কিন্তু সেরিওজা মাথা নিচু করে খালার ঘরে ঢুকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতেই লাগল। করোস্তেলিওভ ওকথা শুধু তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্যই বলেছে। ভাঙা টুকরোগুলোকে জোড়া লাগিয়ে দিলেই আবার কি ওটা আগের মতো সুন্দর চকচকে সাইকেল হবে? কেউ ওটাকে সারাতে পারবে না। সে কি তা বোঝে না? তাকে শুধু শুধু ভাঁওতা দেওয়া হচ্ছে কেন? আবার নরম গদিতে বসে ঘণ্টি বাজিয়ে ওটাকে আর সে চালাতে পারবে না কোনোদিন। সোনালি রোদ ওটার চাকার ঝকঝকে স্পোকগুলোর গায়ে পড়ে আবার ঝিকমিক করে উঠবে কোনোদিন? অসম্ভব! একেবারেই গিয়েছে ওটা। —সারাটা দিন সেরিওজা কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ ফুলিয়ে গোমড়া হয়ে রইল। করোস্তেলিওভ ওর গ্রামোফোনটা বাজাতে আরম্ভ করলেও সে তাতে একটুও আনন্দ পেল না, একটুও হাসল না। 

কত মজার মজার হাসির গান পাড়ার সবাই একমনে শুনল। কিন্তু তার কিছুই ভালো লাগছে না। নিজের দুঃখের ভাবনা ভাবতে ভাবতে সে সারাটা দিন মনমরা হয়ে রইল।

…কিন্তু তারপর কী হল বল দেখি? সাইকেলটাকে কয়েক দিনের মধ্যেই সারিয়ে আনা হল। করোস্তেলিওভ তাহলে বাড়িয়ে বলে নি! সে ওটাকে ‘ইয়াসি বেরেগ’ ফার্মে নিয়ে গিয়ে মিস্ত্রি দিয়ে সুন্দর করে সারিয়ে নিয়ে এল। মিস্ত্রি বলে দিল বড়রা যেন আর না চড়ে, তাহলে কিন্তু আবার সেই কাণ্ড হবে। ভাস্কা আর জেঙ্কা একথা শুনল, তারপর থেকে শুধু সেরিওজা আর শুরিক মজা করে চড়তে লাগল। বড়রা কেউ ধারেকাছে না থাকলে লিদাও কখনো কখনো চড়ে বসত। তা, লিদা তো রোগা আর হালকা, তাই ও চড়লে ক্ষতি কিছু হবে না ভেবে সেরিওজা ওকে খুশিমনেই চড়তে দিত। 

কিছুদিনের মধ্যেই সেরিওজা সাইকেল চালানোয় পাকা ওস্তাদ হয়ে উঠল। দু-হাত বুকে গুটিয়েও ঢালু রাস্তায় সে বেশ চালাতে পারত। কিন্তু কী আশ্চর্য, সেই প্রথম দিনটির মতো যেন আর সেই রোমাঞ্চকর মজা নেই এতে… 

তারপর একদিন সাইকেল চড়তে আর ভালো লাগল না। রান্নাঘরের এককোণে লাল আলো আর রুপোর মতো ঝকঝকে ঘণ্টিটা বুকে নিয়ে মজবুত সুন্দর সাইকেলটা দাঁড়িয়ে রইল দিনের পর দিন। সেরিওজা পায়ে হেঁটেই এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা শুরু করল আবার। সাইকেলটার কথা যেন সে ভুলেই যেতে লাগল। আর ওটাকে আগের মতো ভালো লাগে না। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *