ভাস্কার মামা

ভাস্কার মামা 

ভাস্কার নাকি এক মামা আছে। লিদা অবশ্য ওদের কারও কথাই বিশ্বাস করতে চায় না। কিছু বললেই বলে ওসব বাজে কথা। কিন্তু ভাস্কার মামার ব্যাপারে ও বিশেষ কিছু টীকা-টিপ্পনী করে না। কারণ ভাস্কার মামার একখানি ছবি ওদের বসবার ঘরের আলমারির উপর দুটো ফুলদানির মাঝখানটিতে রাখা হয়েছে। ছবিতে একটা পামগাছের তলায় মামা বসে আছে। তার পরনে শাদা ধবধবে পোশাক, রোদের কড়া ঝাঁজে ছবিতে মামার মুখ বা পোশাক কিছুই ঠিক বোঝা যায় না। ছবির মধ্যে কেবল পামগাছটা আর দুটো কালো ছায়া, একটা গাছের আর অন্যটা মামার, বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। 

মুখটা দেখা না যাক ক্ষতি নেই কিছু। কিন্তু মামার পোশাকটা কেমন তা যে বোঝা যাচ্ছে না, সেটাই বড় দুঃখের কথা। উনি তো কেবল মামাই নন, উনি যে সমুদ্র পাড়ি দেওয়া জাহাজের একজন ক্যাপ্টেন। ক্যাপ্টেনরা কেমন পোশাক পরে সেটাই তো দেখবার মতো। ভাস্কা বলেছে ওআখু দ্বীপের হনলুলুতে নাকি মামার এই ছবিটা তোলা হয়েছে। মাঝে মাঝে ওখান থেকে মামা ওদের কত কী পার্সেল করে পাঠায়। ভাস্কার মা বলবে, ‘কোস্তিয়া আমায় এই পাঠিয়েছে, সেই পাঠিয়েছে।’ 

জামা-কাপড় ছাড়াও মাঝে মাঝে ভারি সুন্দর সুন্দর মজার জিনিস আসে। যেমন ধর, স্পিরিটের মধ্যে ডোবান কুমিরের বাচ্চা। মাছের মতো ছোট দেখতে, তবুও তো কুমির! শ’খানেক বছর ওটা ঐ স্পিরিটের মধ্যে ঠিক এমনই থাকবে, পচে গলে নষ্ট হবে না। ভাস্কা যে এসব কারণে নিজেকে বেশ কেউকাটা ভাবে তাতে আর আশ্চর্য হবার কী আছে? আর সবার যত খেলনা বা শখের জিনিস আছে, ভাস্কার এই কুমিরের বাচ্চাটা তাদের সবগুলোকে হার মানিয়েছে… 

একবার এক পার্সেলে একটা ভারি সুন্দর উপহার এল—ইয়া বড় একটা শাঁখ। তার ওপরটা ছাই রঙের, ভেতরটা গোলাপি। গোলাপি ধারটা খোলা বড় ঠোঁটের মতো। ওটার ওপর কান পেতে রাখলে শুনতে পাবে যেন বহু দূর থেকে একটা মৃদু গুঞ্জন ভেসে আসছে। মন ভালো থাকলে ভাস্কা মাঝে মাঝে সেরিওজাকে এই গুঞ্জন শুনতে দেয়। তখন সেরিওজা ওটাকে কানের কাছে চেপে ধরে বড় বড় চোখ করে নীরবে রুদ্ধশ্বাসে ওর ভেতর থেকে গুমরে ওঠা সেই একটানা গুঞ্জন একমনে শুনতে থাকে। ওটা কিসের গুঞ্জন? কোথায় থেকে ভেসে আসছে? আর ওটা শুনলেই-বা কেন তার মন এত চঞ্চল হয়ে ওঠে? তার তখন মনে হয় কেবলই যেন সেই একটানা গুঞ্জনটা সে শোনে আর শোনে… 

সেই মামাটি, ভাস্কার সেই আশ্চর্য মামাটি হনলুলু এবং আরো দেশ-দেশান্তর দেখেশুনে এখন নাকি ভাস্কার সঙ্গে এসে থাকবেন। ভাস্কা এক মনে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে যেন এটা তেমন একটা বিশেষ কোনো খবরই নয়, ঠিক এমনি উদাস স্বরে খবরটা বলে ফেলল একদিন। শুরিক অবাক হয়ে কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘কোন মামা? সেই ক্যাপ্টেন-মামা?’ 

ভাস্কা উত্তর দিল, ‘কোন মামা আবার? উনি ছাড়া আর কোনো মামা আমার নেই তো।’ কথাটা এমনভাবে বলল যেন আর সকলের ক্যাপ্টেন-মামা ছাড়া অন্য আজেবাজে মামার দল হয়তো থাকতে পারে, কিন্তু ওর কথা আলাদা। সবাই অবশ্য নীরবে তা স্বীকার করতে বাধ্য হল। 

সেরিওজা প্রশ্ন করল, ‘শিগগিরই আসছেন উনি?’ 

ভাস্কা বলল, ‘আর দু-এক হপ্তার মধ্যেই এসে যাবেন। আচ্ছা, এখন তা হলে আমি খড়িমাটি কিনতে বাজারে যাচ্ছি।’ 

‘খড়িমাটি দিয়ে কী হবে?’ 

‘মা ঘরদোর সব চুনকাম করবেন?’ 

হাঁ, তা সত্যি বটে! অমন মামা এলে ঘরেরও রঙ ফেরাতে হবে বৈকি! 

লিদা এবার যেন আর মুখ বুজে থাকতে পারল না, বলেই ফেলল, ‘চাল মারছে কেমন। মামা আসছেন, না, হাতি!’ 

কথাটা ছুড়ে দিয়েই তড়াক করে ও পেছনে দাঁড়াল ভাস্কা ওকে মারতে যাবে আশঙ্কায়। কিন্তু ভাস্কা কোনো কথাই বলল না। এমনকি ‘বোকা’ বলেও কোনো গালাগাল দিল না। নীরবে ব্যাগটা দোলাতে দোলাতে লিদাকে যেন একেবারে অগ্রাহ্য করেই ও হাঁটতে শুরু করল। আর লিদা এবার বোকার মতো অপ্রস্তুত হয়ে তাকিয়ে রইল শুধু। 

…তারপর ভাস্কার বাড়ির রঙ ফেরান হল। দেয়ালে নতুন করে কাগজ লাগান হল। ভাস্কা কাগজে আঠা মাখিয়ে দিত আর তার মা সেগুলো দেয়ালে সেঁটে দিত। ছেলের দল বাইরে থেকে ঘরের ভেতর উঁকিঝুঁকি মারতে লাগল। ভাস্কা ওদের ধমকে বাইরে থাকতে আদেশ করল। 

বলল, ‘খবরদার! ঘরে ঢুকো-না যেন। সব নষ্ট করে দেবে 

ভাস্কার মা ঘরের মেঝে ধুয়ে-মুছে চাঁচ বিছিয়ে দিল এবার। মেঝে পরিষ্কার রাখার জন্য ওরা এখন চাঁচের উপর দিয়েই যাওয়া-আসা করবে। 

ভাস্কার মা ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘জাহাজীরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা খুব ভালোবাসে কিনা।’ 

এলার্ম ঘড়িটা মামা যে ঘরে শোবে সেখানে টেবিলের উপর রাখা হল।

ভাস্কার মা আবার বলল, ‘জাহাজীরা সবকিছু ঘড়ির কাঁটা ধরে করে।’ 

তারপর ওরা সবাই মিলে ভাস্কার মামার পথ চেয়ে অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করতে লাগল। একটা গাড়ি রাস্তার বাঁক ঘুরলেই ওরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে ভাবত এই বুঝি স্টেশন থেকে মামা এলেন। কিন্তু যথারীতি গাড়িটা চলে যেত, মামা আসতেন না আর লিদা বেশ খুশি হত। লিদা মেয়েটা অদ্ভুত হিংসুটে কিন্তু। অন্যেরা যাতে আনন্দ পায় তার উল্টোটা হলেই ও খুশি। 

ভাস্কার মা সন্ধেবেলায় কাজ থেকে ফিরে সংসারের কাজকর্ম সেরে সামনের ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাড়াপড়শিদের সঙ্গে তার ক্যাপ্টেন-ভাই সম্বন্ধে আলোচনা করে। বাচ্চারা তার পাশে দাঁড়িয়ে তাই মন দিয়ে শোনে। 

ভাস্কার মা বলল, ‘এখন হাওয়া বদলাবার জন্য ও একটা স্বাস্থ্যকর জায়গায় আছে, ওর শরীরটা তেমন ভালো নেই কিনা। বুকের দোষ আছে আবার। সেরা স্যানাটোরিয়ামে ওকে পাঠানো হয়েছিল অবশ্য। চিকিৎসা শেষ হলেই ও এখানে চলে আসবে।’ 

আর-একদিন ভাস্কার মা বলল, ‘আমার ভাই খুব সুন্দর গান গাইতে পারত। আমাদের ক্লাবে যে কী সুন্দর গাইত…কোজলোভস্কির থেকেও ভালো। কিন্তু মোটা হয়ে গিয়ে এখন আর দম রাখতে পারে না বেচারা। তাছাড়া সংসারের নানা ঝামেলায় পড়ে ওসব গান-বাজনা আর আসে না। 

তারপর আচমকা স্বরটা খুব নিচু করে বাচ্চারা যাতে শুনতে না পায় সেরকম ফিস ফিস করে এবার বলতে লাগল, ‘সব ক-টিই মেয়ে। বড়টি দেখতে ফর্সা, মেজটি কালো, সেজটির লাল চুল। বড় মেয়েটা কোস্তিয়ার মতোই সুশ্রী। ভাই আমার সমুদ্রে গিয়েও কি শান্তিতে থাকতে পারে নাকি? বৌদির কপাল ভালো বলতে হবে, সবই মেয়ে। একটা ছেলেকে মানুষ করে তোলার চেয়ে দশটা মেয়েকে বড় করে তোলা অনেক সহজ। 

পড়শিরা এবার আড়চোখ ভাস্কার দিকে তাকাল। 

ভাস্কার মা-ও ভাস্কাকে একপলক দেখে নিয়ে বলল, ‘আমার ভাই এবার আমাকে এ বিষয়ে একটা বুদ্ধি-পরামর্শ দিতে পারবে। ছেলেটাকে কী করে মানুষ করব ভেবে ভেবে এক-এক সময় পাগল হয়ে যাবার জোগাড় হয়। 

জেঙ্কার খালা একটা বড় রকমের নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘ছেলেরা নিজের পায়ে নিজে না দাঁড়ানো পর্যন্ত ওদের নিয়ে বড়ই মুশকিল।’ 

পাশা খালা এবার তার মন্তব্য পেশ করল, ‘তা ছেলেটি কেমন, তার ওপরেই সব নির্ভর করে কিন্তু। আমাদের ছেলেটির কথাই ধর না। সত্যি খুব ভালো ছেলে। ওকে নিয়ে কোনোদিন ভুগতে হবে না।’ 

ভাস্কার মা বলে উঠল, ‘ও তো এখনো খুব ছোট। ওর কথা আলাদা। ছোটবেলায় সব ছেলেরাই এমন লক্ষ্মী থাকে। একটু বড় হতে না হতেই যত বাঁদরামো শুরু হয়।’ 

তারপর ক্যাপ্টেন-মামা একদিন অনেক রাত্রে এসে পৌঁছলেন। সকালবেলায় ওরা ঘুম থেকে উঠে ভাস্কার বাগানের দিকে তাকিয়ে দেখে মামা রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেমন একটু নাকি সুরে আস্তে আস্তে কথা বলছিলেন দম টেনে টেনে। মামাকে ওরা বলতে শুনল, ‘বাঃ কী সুন্দর জায়গাটা! চমৎকার! গরমের দেশ থেকে এসে বিশ্রাম নেবার উপযুক্ত জায়গা বটে। পোলিয়া, এমন সুন্দর জায়গায় আছ তুমি? সত্যি, তোমার ভাগ্য ভালো।’ 

ভাস্কার মা উত্তর দিল, ‘হাঁ, জায়গাটা মন্দ নয়।’ 

মামা এদিক-ওদিক তাকিয়ে বিস্ময়ভরা সুরে চেঁচিয়ে উঠলেন এবার, ‘বাঃ! এটা কী? এ যে দেখছি পাখির বাসা। বার্চগাছের ডালে পাখির বাসা! পোলিয়া, তোমার মনে আছে আমাদের স্কুলের পড়ার বইয়ে ঠিক এরকম একটা ছবি ছিল? বার্চগাচের ডালে পাখির বাসা ঝুলছে!’ 

ভাস্কার মা বলল, ‘হাঁ, মনে আছে। এটা কিন্তু ভাস্কা ওখানে রেখেছে।’ 

‘তাই নাকি? চমৎকার ছেলে তোমার ভাস্কা। ভাস্কা সেজেগুজে মা আর মামার একপাশে চুপটি করে দাঁড়িয়েছিল এতক্ষণ। ওর সাজসজ্জা দেখে মনে হচ্ছিল আজ যেন ‘মে দিবস’। 

ভাস্কার মা মামাকে এবার বলল, ‘এস, খাবে এস।’ 

মামা বললেন, ‘বাইরের এই তাজা বাতাসটা ভারি ভালো লাগছে। আরো একটু থাকি না এখানে?’ কিন্তু ভাস্কার মা একরকম জোর করেই ডাকে বাড়ির ভেতর নিয়ে চলল। মামা তার লম্বাচওড়া দশাসই শরীরখানাকে টেনে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলেন। মামার চেহারাটা কিন্তু বেশ ভালোই দেখতে। মুখখানিতে কেমন একটু কোমলতা মাখান। চিবুকে ভাঁজ পড়েছে। মুখের নিচের দিকটা রোদে পুড়ে বাদামি হয়ে গিয়েছে, কিন্তু উপরের দিকটা ধবধবে ফর্সা। বাদামি রঙটা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে… 

ভাস্কা এবার বেড়ার ধারে গিয়ে দাঁড়াল। সেরিওজা আর শুরিক ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি মারছিল কেবল। 

ভাস্কা গুরুগম্ভীর স্বরে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এই বাচ্চারা, কী চাও তোমরা?’ ওর কথা শুনে ওরা মুখ বাঁকাল শুধু। 

ভাস্কা বলেই চলল, ‘জান, মামা আমার জন্য একটা ঘড়ি এনেছে।’ তাই তো, ভাস্কার বাঁ হাতের কব্জিতে একটা ঘড়ি দেখতে পেল ওরা। আর সত্যিকারের ঘড়িই। ভাস্কা ওর হাতখানি কানের কাছে তুলে ধরে ঘড়ির টিকটিক শব্দ শুনল কয়েক মিনিট। তারপর ঘড়ির চাবিটা কয়েকবার ঘুরিয়ে দিল… 

সেরিওজা এবার বলে উঠল, ‘ঘরের ভেতর যাই, কেমন?’ 

ভাস্কা উদার ভঙ্গিতে আদেশের সুরে বলল, ‘আচ্ছা, এস। কিন্তু গোলমাল কর না যেন। মামা যখন বিশ্রাম করবে, সবাই যখন আসবে কথা বলতে তখন কিন্তু চলে যেও। আজ ওদের একটা বৈঠক বসবে এখানে।’ 

সেরিওজা অবাক হয়ে বলল, ‘কেন?’ 

‘আমাকে নিয়ে কী করা, ওরা সবাই মিলে তাই আলোচনা করবে।’ 

ভাস্কা এবার বাড়ির মধ্যে ঢুকল। ওরা দু-জনে ওকে নীরবে অনুসরণ করল। ক্যাপ্টেন-মামা যে ঘরে খেতে বসেছেন সেই ঘরের দরজার একপাশে ওরা দুটিতে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। আর মাঝে মাঝে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখতে লাগল। 

ক্যাপ্টেন-মামা এক টুকরো রুটিতে মাখন মাখিয়ে নিলেন। একটা ডিম রাখলেন ডিমের পাত্রে, তারপর চামচের মাথা দিয়ে ডিমের মাথাটা আস্তে ভেঙে ছুরির ছুঁচলো মাথা দিয়ে নুনের পাত্র থেকে নুন তুলে নিয়ে সেই ডিমটার ওপরে একটু একটু করে ছড়িয়ে দিলেন। তারপর হঠাৎ এদিক-ওদিক তাকিয়ে তিনি কী যেন খুঁজতে লাগলেন আর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ভুরু কুঁচকে উঠল। একটু কুণ্ঠাজড়ানো স্বরে আস্তে আস্তে বললেন, ‘পোলিয়া, একটা ন্যাপকিন দেবে আমায়?’ 

ভাস্কার মা ব্যস্তসমস্ত হয়ে পাশের ঘরে ছুটে গিয়ে তক্ষুনি তার জন্য একখানি পরিষ্কার তোয়ালে নিয়ে এল। তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে মামা তাঁর দু-হাঁটুর উপর তোয়ালেটা সন্তর্পণে পেতে এবার খাওয়া আরম্ভ করলেন। রুটিটা উনি খুব ছোট ছোট টুকরো করে খাচ্ছেন। ঠিক যেন বোঝাই যাচ্ছে না। তিনি চিবোচ্ছেন কি গিলছেন। ভাস্কার মুখের ভাব এমন হল যেন ওর কেউকেটা সভ্যভব্য মামাটি ন্যাপকিন অভাবে খেতে পারছেন না এটাই ওর মস্তবড় গর্ব। 

ভাস্কার মা কত রকমারি খাবারই-না টেবিলের উপর রেখেছে। মামা কিন্তু সব রকম খাবার থেকেই একটু-একটু করে তুলে মুখে দিচ্ছেন। কিন্তু উনি এত ধীরে চিবোচ্ছেন যে কিছু খাচ্ছেন বলেই মনে হচ্ছে না। ভাস্কার মা কেবলই অভিযোগের সুরে বলছে, ‘খাচ্ছ না তো কিছুই। ভালো লাগছে না বুঝি?’ 

মামা বললেন, ‘চমৎকার সব খাবার করেছ। আমাকে তো মাপা খাবার খেতে হয় কিনা, তাই মনে কষ্ট নিও না বোন।’ 

মামা ভদকা খেলেন না। বললেন, ‘ও আমার খাওয়া বারণ। দিনে একটিবার, ছোট এক গ্লাস ব্র্যান্ডি খেতে পারি শুধু।’ 

তর্জনী আর বুড়ো আঙুল দিয়ে চমৎকার ভঙ্গিতে গ্লাসের ছোট্ট একটা পরিমাণ দেখিয়ে মামা বললেন আবার, তা-ও ঠিক দুপুরবেলা খেতে বসবার আগে খেয়ে নিই যাতে সহজে হজম হয়ে যায়। তার বেশি আমার খাওয়া নিষেধ কিনা।’ 

খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে মামা ভাস্কাকে তাঁর সঙ্গে বেড়াতে যাবার জন্য ডাকলেন। মামা তাঁর শাদা আর সোনালি রঙের টুপিটা মাথায় চাপিয়ে তৈরি হলেন। 

ভাস্কা এবার ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এবার তোমরা বাড়ি যাও তো।’ 

মামা বলে উঠলেন, ‘ওরাও আমাদের সঙ্গে আসুক-না কেন? বাঃ, বেশ সুন্দর ছেলে দুটি তো! দু-ভাই বুঝি? 

শুরিক বলল, ‘না, আমরা ভাই নই।’ 

ভাস্কাও বলল, ‘ওরা ভাই নয়।’ 

মামা বললেন, ‘তাই নাকি? আমি তো ভেবেছিলাম ওরা দু-জনে ভাই না হয়ে যায় না। কোথায় যেন মিল আছে ওদের। একজন কালো, একজন ফর্সা… আচ্ছা, ভাই না-হয় না-ই হলে! তাতে কী, এস, তোমরাও এস বেড়াতে!’ 

ওদের পথ দিয়ে যাবার সময় লিদা দেখল। ও হয়তো দৌড়ে ওদের সঙ্গে বেড়াতে আসত। কিন্তু ভাস্কা আড়চোখে ওর দিকে এমন একটা বাঁকা দৃষ্টি হানল যে লিদা মুখ ঘুরিয়ে লাফাতে লাফাতে অন্যদিকে চলে গেল। 

তারপর ওরা বনের মধ্যে ঢুকল। গাছপালা ঝোপঝাড় দেখে মামা তো আনন্দে আত্মহারা। ক্ষেতের মধ্যে আল-পথ দিয়ে চলতে চলতে চারধারে সোনার ফসল দেখে মামার সে কী স্ফূর্তি! সত্যি কথা বলতে কী, মামার এই উল্লাস দেখে ওরা কিছুটা বিরক্ত হয়ে পড়ছিল। মামার কাছ থেকে ওরা যে সাগর আর দ্বীপের গল্প শুনতে চায়। কিন্তু তবুও মামা ভারি অদ্ভুত ও বিচিত্র লোক! তাঁর বুকের ওপর দোলান সোনার ব্যাজগুলো রোদের আলোয় কেমন ঝিকমিক করে জ্বলছে! মামার পাশে পাশে ভাস্কা চলেছে। সেরিওজা আর শুরিক কখনো আগে কখনো-বা তাঁর পেছনে দৌড়ে দৌড়ে চলেছে আর মামার আপাদমস্তক অবাক বিস্ময়ে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখছে। এভাবে ওরা নদীর ধারে এল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মামা এবার বললেন, ‘এস, স্নান করে নেওয়া যাক। ভাস্কাও তার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিজ্ঞের মতো বলল, ‘হাঁ, সময় আছে। তাই ভালো।’ তারপর ওরা পরিষ্কার গরম বালির উপর পোশাক খুলে রাখল। 

মামা তার কোটটি খুললে সেরিওজা আর শুরিক নিরাশ হয়ে দেখল মামা তাঁর নাবিকের ডোরাকাটা শার্ট না পরে সাধারণ একটা শার্ট পরে আছেন। সেই শাদা শার্টটা দু-হাত তুলে খুলে ফেললে ওরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইল। এ কী… 

কাঁধ থেকে কোমর পর্যন্ত মামার সর্বাঙ্গে নীল রঙের অদ্ভুত কত কী নক্সা কাটা রয়েছে কেন? মামা সোজা হয়ে দাঁড়ালে ওরা বড় বড় চোখ মেলে দেখল ওগুলো শুধু আজেবাজে নক্সা নয়, ছবি আর কতগুলো গোটা গোটা অক্ষর। মামার বুকের উপর একটা মাছের মতো লেজওয়ালা আর লম্বা চুলওয়ালা মৎস্যকন্যার ছবি আঁকা। বাঁ কাঁধের দিক থেকে একটা অক্টোপাস হামাগুড়ি দিয়ে যেন মেয়েটির দিকে এগিয়ে আসছে। অক্টোপাসের ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া ঝুঁটি আর মানুষের মতো দুটো চোখে কী ভয়ানক জ্বলন্ত, হিংস্র দৃষ্টি! মৎস্যকন্যাটি অক্টোপাসের দিকে দু-হাত মেলে মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে যেন আকুতি জানাচ্ছে। উঃ! কী সাংঘাতিক ছবি! মামার ডান কাঁধে কী সব লম্বা লম্বা লেখা! কাঁধ থেকে হাতের ওদিকটায় নীল লেখায় লেখায় আর গা দেখা যাচ্ছে না যেন। বাঁ হাতের উপরটায় দুটো পায়রা মুখোমুখি বসে আছে ঠোঁটে ঠোঁটে লাগিয়ে আর তাদের মাথার উপর মালা আর একটা মুকুট এঁকে দেওয়া হয়েছে। হাতের নিচে একটা তীর-ধনুকের ছবি আর তারও নিচে বড় বড় অক্ষরে ‘মুসিয়া’ লেখা রয়েছে। 

শুরিক সেরিওজার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওঃ! কী চমৎকার বল তো?’ 

সেরিওজা একটা বড় রকমের নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘হাঁ ভারি চমৎকার!’ 

মামা এবার জলে ঝাঁপিয়ে সাঁতার দিতে শুরু করলেন। পায়ের মৃদু সঞ্চালনে তিনি জলের উপরে ভেসে রয়েছেন, ভিজা চুলে হাসিমুখে একবার দাঁড়িয়ে নাক ঝাড়লেন। আবার স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কাটতে লাগলেন। ওরা একেবারে মন্ত্রমুগ্ধের মতো মামাকে অনুসরণ করতে লাগল। 

ওঃ! মামা কী চমৎকার সাঁতার কাটছেন! জলের সঙ্গে তার গুরুভার শরীরটাকে নিয়ে একান্ত সহজভাবে খেলা করছেন যেন। পুলের কাছ পর্যন্ত সাঁতরে চলে গেলেন, তারপর চিৎ সাঁতার দিয়ে কতক্ষণ জলের উপর কেমন হালকা হয়ে ভেসে রইলেন। জলের ভেতরে শুধু তাঁর পা দুটো একটু একটু করে নড়ছে। আর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বুকের উপরকার মৎস্যকন্যাটিও কেমন নড়ছে দেখ! মনে হচ্ছে যেন জীবন্ত হয়ে নাচতে শুরু করেছে। 

কিছুক্ষণ পর পাড়ে উঠে বালির উপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লেন। তার ঠোঁটের কোণে কেমন একটু তৃপ্তির হাসি। ওরা এবার অবাক হয়ে দেখল মামার পিঠের উপর মড়ার মাথা, হাড়, চাঁদ, তারা, আকাশ কত কী ছবির সমারোহ। মেঘের কোলে লম্বা পোশাক-পরা চোখ বাঁধা অপরূপ সুন্দরী এক মেয়ে বসে আছে। এমনি সব বিচিত্র ছবি তাঁর সারা পিঠে ছড়িয়ে রয়েছে। শুরিক এবার সাহসে ভর করে প্রশ্ন করল : 

‘তোমার পিঠে ওসব কী?’ 

মামা একটু হেসে উঠে বসলেন এবার। দু-হাত দিয়ে গায়ের বালি ঝেড়ে বললেন, ‘এ সেই সব পুরনো দিনের ব্যাপার, যখন আমি খুব ছোট ছিলাম আর বোকা ছিলাম। দেখছ তো, এক সময় এত বোকা ছিলাম যে সারা শরীরটা এসব ছাইভস্ম ছবি দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় এগুলো আর এ জীবনে মুছে যাবে না!’ 

শুরিক আবার প্রশ্ন করল, ‘ওসব কী লেখা রয়েছে?’ 

‘তা জেনে আর কী হবে বল? ওসবের কোনো বিশেষ মানে নেই তো। মানুষের অনুভূতি আর কাজই হল আসল। ভাস্কা কী বল? তাই না?’ 

‘হাঁ!’ 

সেরিওজা এবার প্রশ্ন করে ফেলল, ‘আচ্ছা, সাগর? সাগরটা দেখতে কেমন?’ 

মামা বললেন, ‘সাগর? সাগরের কথা বলছ? সাগরের কথা আমি আর কী বলব বল? সাগর সাগরই। সাগরের মতো সুন্দর আর কিছু নেই। তবে কেমন সুন্দর তা বুঝতে হলে নিজ চোখে তাকে দেখতে হয়। 

শুরিক বলল, ‘আচ্ছা, সাগরে ঝড় উঠলে নাকি তার রূপ হয় ভয়ানক?’ 

মামা আনমনে উত্তর দিলেন এবার, ‘সাগরে ঝড়ও ভারি সুন্দর! সাগরে সমস্ত কিছুই সুন্দর।’ 

সাগর সম্বন্ধে কী একটা কবিতা আবৃত্তি করতে করতে মামা পায়জামা পরতে লাগলেন।

তারপর বাড়ি ফিরে উনি বিশ্রাম করতে গেলেন আর ওরা ভাস্কার গলিতে গিয়ে মামার শরীরের সেই অদ্ভুত উল্কিগুলোর কথা আলোচনা করতে বসল। 

কালিনিন স্ট্রিটের একটি ছেলে বলল, ‘বারুদ দিয়ে ওরা ওসব করে। প্রথমে নক্সাটা এঁকে তার উপর বারুদ ঘষে দিতে থাকে। আমি একটা বইয়ে পড়েছি।’ 

আরেকটি ছেলে বলল, ‘কিন্তু বারুদ কোথায় পাওয়া যায় বল তো?’ 

‘দোকানেই পাবে।’ 

‘তোমাকে দিলে তো! ষোল বছরের কম বয়স হলে দোকানে তোমাকে একটা সিগারেটই দেবে না, তা আবার বারুদ!’ 

‘শিকারিদের কাছ থেকে তা হলে জোগাড় করা যায়।’ 

‘না, তারাও তোমাকে দেবে না।’ 

‘যদি দেয়?’ 

‘আর যদি না দেয়?’ 

এবার আর-একজন বলে উঠল, ‘আগেকার দিনে বারুদ দিয়ে ওসব করা হত। এখন সাধারণ নীল কালি বা চাইনিজ ইঙ্ক দিয়েই করা যায়।’ 

‘কালি দিয়ে করলে কি বরাবর থাকবে?’ 

‘হ্যাঁ, থাকবে, চাইনিজ ইঙ্ক দিয়েই বেশি দিন থাকবে।’ 

সেরিওজা ওদের কথাবার্তা শুনতে শুনতে ওআখু দ্বীপের হনলুলুর ছবি মনে মনে কল্পনা করবার চেষ্টা করল। পামগাছের সারি দিয়ে ঘেরা সোনালি রোদে উজ্জ্বল সেই ছবি! আর সেই পামগাছের তলায় শাদা ধবধবে পোশাক পরে জাহাজের ক্যাপ্টেনরা ছবি তুলবার জন্য দাঁড়িয়েছে, ও যেন দিব্যদৃষ্টিতে স্পষ্ট সব দেখতে পাচ্ছে। ‘একদিন আমিও অমন ভঙ্গিতে ছবি তুলব’, সেরিওজা ভাবতে থাকে। ওরা ওদিকে বারুদ আর নীল কালির গুণাগুণ নিয়ে আলোচনায় মত্ত হয়ে আছে। আর সেরিওজা ভাবতে লাগল জগতের সবকিছুই যেন তার আয়ত্তে, হনলুলুতে ক্যাপ্টেন হয়েছে সে—এটা বিশ্বাস করল ঠিক যেমন বিশ্বাস করেছিল কখনো মরবে না সে। সবকিছুই করবার চেষ্টা করবে, সবকিছুই দেখবে এই জীবনে যা কখনো ফুরিয়ে যাবে না। 

সন্ধেবেলায় ভাস্কার মামাকে আর-একটিবার দেখবার জন্য তার মন বড্ড উতলা হয়ে উঠল। কিন্তু মা সেই থেকে কেবল বিশ্রামই করছেন। সারারাত জেগে এসেছেন কিনা। ভাস্কার মা ব্যস্তসমস্ত হয়ে ব্র্যান্ডি কিনতে যাবার সময় পাশা খালাকে দেখতে পেয়ে বলল, ‘আমার ভাই ব্র্যান্ডি ছাড়া আর কিছু খায় না। তাই ব্র্যান্ডি আনতে যাচ্ছি।’ রাত্রির আঁধার ঘন হয়ে এল। 

ভাস্কার আত্মীয়-পরিজন একজনের পর একজন বেড়াতে আসছে। ঘরে ঘরে বিজলি আলো জ্বলে উঠল। রাস্তা থেকে জানালার পর্দা ছাড়া ভাস্কার বাড়ির ভেতরটার কিছুই আর দেখা যাচ্ছে না। শুরিক এসে সেরিওজাকে ডাকতেই সে খুব খুশি হল। শুরিকের বাগানে একটা লাইমগাছ আছে। সেটার উপর উঠলে ভাস্কার বাড়ির ভেতরটা নাকি সব দেখা যাবে। 

সেরিওজাকে সঙ্গে করে যেতে যেতে শুরিক বলল, ‘জান, উনি ঘুম থেকে উঠেই ব্যায়াম করেন। তারপর গোঁফ-দাড়ি কামিয়ে একটা স্প্রে দিয়ে কী একটা সুগন্ধী সমস্ত গায়ে ছড়িয়ে দেন। ওদের কখন খাওয়া হয়ে গিয়েছে…এস, এই গলিটা দিয়ে যাই। না হয় লিদা আবার দেখতে পেয়ে পিছু নেবে।’ 

তিমোখিনের তরকারি বাগান আর ভাস্কার বাগানকে আলাদা করে বুড়ো লাইমগাছটা বেড়ার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। ভাস্কার বাড়ির একেবারে গা ঘেঁষেই এই বেড়াটা, কিন্তু বেড়ার কাঠ এত পচা যে ওরা তাতে উঠবার চেষ্টা করলেই তা মড়মড় করে ভেঙে যাবে…লাইমগাছটায় একটা কোটর আছে, একটা হুপু পাখি গরমকালে সেখানটায় বাসা বেঁধেছিল। আর আজকাল শুরিক বড়দের চোখে ধুলো দিয়ে কার্তুজের বাক্স, আতশি কাচ আরো কত কী টুকিটাকি জিনিস এই কোটরের গহ্বরে লুকিয়ে রাখে। আতশি কাচটা দিয়ে ও প্রায়ই গাছের গা বা বেড়ার গা পুড়িয়ে দিয়ে মজা দেখে… 

ওরা দু-জনে এবার লাইমগাছটার খসখসে গা বেয়ে একটা বাঁকা ডালের উপর উঠে বসল। শুরিক গাছের গুঁড়িটা দু-হাতে শক্ত করে আঁকড়ে আর সেরিওজা শুরিককে জড়িয়ে ধরে বসল। 

গাছের সবুজ সতেজ নরম ফুরফুরে ঝিরিঝিরি পাতাগুলো ওদের মাথার উপরে দুলছে। সূয্যিমামা কখন ডুবে গেছে, তবু তারই সোনালি আভায় উপর দিকটা এখনও কেমন রাঙা হয়ে আছে আর গাছের নিচে সন্ধ্যার আঁধার ঘন হয়ে জমাট বেঁধেছে যেন। সেরিওজার চোখের সামনে একটা ডাল ওর সবজে-কালো পাতাগুলো নিয়ে অনবরত দুলছে। ভাস্কার বাড়ির ভেতরটা সবই বেশ দেখা যাচ্ছে কিন্তু। ইলেকট্রিক আলো জ্বলছে। পরিবারের সবার মাঝখানে মধ্যমণি হয়ে ক্যাপ্টেন-মামা বসে আছেন। সেরিওজা এখান থেকেই ওদের কথাবার্তা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। 

ভাস্কার মা দু-হাত নেড়ে বলছে, ‘রাস্তায় ওর সেই অপকর্মের জন্য ওরা আমার কাছ থেকে পঁচিশ টাকা জরিমানা নিয়ে তবে ছাড়ল।’ 

একজন ভদ্রমহিলা হেসে উঠলে ভাস্কার মা বিরক্তিভরা সুরে বলল, ‘এতে হাসবার কিছু নেই তো! আবার মাস দু’য়েক পর সিনেমা হলের শো-কেস ভাঙার জন্য আমাকে পঞ্চাশ টাকা জরিমানা দিতে হল।’ 

একজন মহিলা বলল, ‘বড়দের সঙ্গেও ও প্রায়ই মারামারি করে শুনতে পাই। সিগারেটের আগুন দিয়ে লেপ পুড়িয়ে একবার তো বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল আর কি। 

ক্যাপ্টেন-মামা এবার বলছেন, ‘সিগারেট কেনবার পয়সা ও পায় কোথা থেকে?

ভাস্কা দু-হাতের মধ্যে মুখটি গুঁজে চুপচাপ বসে আছে। মামা ওর দিকে তাকিয়ে নরম সুরে বললেন, ‘এই দুষ্টু ছেলে, বল, কোথা থেকে সিগারেট কিনবার পয়সা পাও তুমি?’ 

ভাস্কা এবার নিঃশ্বাস ফেলে উত্তর দিল, ‘কেন, মা দেয়।’ 

মামা ভাস্কার মা’র দিকে চেয়ে বললেন, ‘কী ব্যাপার পোলিয়া? আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না। 

ভাস্কার মা কাঁদতে শুরু করল। 

মামা আবার ভাস্কাকে বললেন, ‘আচ্ছা তোমার স্কুলের রিপোর্ট-বইটা আন তো দেখি।’

 ভাস্কা উঠে গিয়ে একটা খাতা এনে মামার হাতে দিল। পাতার পর পাতা উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে মামার ভুরু দুটো বিরক্তিতে কুঁচকে উঠল। তারপর নিচু স্বরে বললেন, ‘পাজি ছেলে! একেবারেই অকর্মার ধাড়ি দেখছি।’ 

তারপর রিপোর্ট-বইটা টেবিলের উপর ছুড়ে ফেলে পকেট থেকে রুমাল বের করে রুমালটা দুলিয়ে নিজেকে হাওয়া করতে শুরু করলেন। 

কিছুক্ষণ নীরব থেকে আবার বলতে লাগলেন, ‘হাঁ, সত্যি ছেলেটা একেবারেই বখে গেছে দেখছি। যদি ওর ভালো করতে চাও তাহলে তোমাকে শক্ত হবে হবে পোলিয়া ওকে কড়া শাসন করতে হবে। আমার নিনার কথাই ধর না কেন… আমাদের মেয়েগুলোকে ও চমৎকারভাবে শিক্ষা দিয়েছে। ভারি বাধ্য, কেমন সুন্দর পিয়ানো বাজনা শেখে…আর তার একমাত্র কারণ নিনা ওদের কড়া নজর রাখে।’ 

সবাই এবার সমস্বরে বলে উঠল, ‘মেয়েদের কথা আলাদা! ছেলেদের চাইতে মেয়েদের শিক্ষা দেওয়া অনেক সহজ!’ 

লেপের গল্পটা যে বলেছিল সেই মহিলা মামার দিকে তাকিয়ে বলল এবার, জান কোস্তিয়া, ওর মা যদি ওকে পয়সা না দেয় তাহলে না-বলে মায়ের ব্যাগ থেকে সে পয়সা নেয়। 

ভাস্কার মা এবার আরো জোরে কাঁদতে লাগল। 

ভাস্কা বলল, ‘মা’র ব্যাগ থেকে পয়সা নেব না তো কার ব্যাগ থেকে নেব? অন্যের ব্যাগ থেকে?’ 

মামা এবার বেদম রেগে দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, ‘যাও, বেরিয়ে যাও চোখের সামনে থেকে! ‘ 

এদিকে শুরিক ফিসফিস করে সেরিওজাকে বলল, ‘দেখ, দেখ, ওকে এখন মামা মারবেন নিশ্চয়ই।’ ওরা যে ডালটিতে বসেছিল মড়মড় শব্দ করে সেই ডালটা ভেঙে পড়ল এবার। সেরিওজা আর শুরিক জড়াজড়ি করে হুমড়ি খেয়ে মাটির উপর আছড়ে পড়ল। 

শুরিক মাটিতে শুয়ে থেকেই বলে উঠল, ‘এই, কেঁদ না যেন!’ 

তারপর দু-জনে উঠে বসে গায়ের ধুলো ঝাড়তে লাগল। ডাল ভেঙে পড়ার হুড়মুড় শব্দে ভাস্কা এদিকে তাকিয়ে ওদের দেখতে পেয়ে ব্যাপারটা সব বুঝতে পারল। সে বলল : 

‘দাঁড়াও, মজা দেখাচ্ছি তোমাদের!’ 

এবার জানালার আলোতে দেখা গেল একটা শাদা ছায়া, ভাস্কার পেছনে আস্তে আস্তে দাঁড়িয়ে বলল, ‘দেখি সিগারেটগুলো আমায় দাও তো বোকা ছেলে।’ 

সেরিওজা আর শুরিক খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাগান ছেড়ে পালাবার সময় পেছন ফিরে দেখতে পেল ভাস্কা তার মামার হাতে সিগারেটের প্যাকেটটা তুলে দিচ্ছে আর মামা সেটাকে ছিঁড়ে গুঁড়ো করে ফেলে দিয়ে ভাস্কাকে কলার ধরে টেনে-হিঁচড়ে ঘরের মধ্যে নিয়ে চলেছে… 

পরদিন সকালবেলা ভাস্কার বাড়ির দরজায় তালা ঝুলতে দেখা গেল। লিদা বলল ওরা সবাই ভোর হতেই চকালভ যৌথখামারে কোনো আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে গেছে। সারাদিন কেউ ফিরল না। পরদিন সকালবেলা ভাস্কার মা একা ফিরল। কাঁদতে কাঁদতে দরজায় আবার তালা লাগিয়ে কাজে বেরিয়ে গেল। ভাস্কা সে রাত্রেই ওর মামার সঙ্গে চলে গেছে, আর ফিরবে না। মামা ওকে মানুষ করবার জন্য নাখিমোভ নৌ-স্কুলে ভর্তি করে দেবে। মায়ের ব্যাগ থেকে না-বলে পয়সা নিয়ে আর সিনেমার শো-কেস ভেঙে দিয়ে ভাস্কার কেমন লাভ হয়ে গেল। 

পাশা খালার সঙ্গে দেখা হলে ভাস্কার মা বলল, ‘ঐ সব আত্মীয়স্বজনই যত নষ্টের গোড়া। ওরা সেদিন ভাস্কার বিরুদ্ধে এমনভাবে কথা বলেছে যেন ও একটা পাকা বদমাশ হয়ে গেছে। আসলে ও আমার সত্যিই তো আর এত খারাপ ছেলে নয়। একটু-আধটু দুষ্টুমি করে শুধু। আমাকে তো কত সময় কত সাহায্যও করেছে। পাঁজা পাঁজা কাঠ কেটে আনত। বাড়ির দেওয়ালে কাগজ সাঁটবার সময় ও আমাকে সাহায্য না করলে আমি একা কি করতে পারতাম? আর এখন ছেলেটা আমার একেলা কোথায় পড়ে রইল! আমাকে ছেড়ে বেচারি কী করছে, কেমন আছে কে জানে?… ‘ 

ভাস্কার মা নাকি সুরে কাঁদতে শুরু করল আবার। 

কাঁদতে কাঁদতেই বলতে লাগল, ‘ওদের ছেলে তো নয়, তাই ওদের আর কী? শরৎকালে গলায় ফোড়া হবেই, কে আর তখন ওকে দেখাশুনা করবে, যত্নআত্তি করবে?’ 

তারপর থেকে টুপি মাথায় কোনো ছেলেকে দেখলেই ভাস্কার মা কাঁদতে শুরু করে। সেরিওজা আর শুরিককে ডেকে ডেকে ভাস্কার কত গল্প বলে, ভাস্কার ছেলেবেলার ছবি দেখায়। মামা তাকে যে সমস্ত ছবিগুলো দিয়েছে সেগুলোও ওদের দেখতে দেয়। সাগর-পারের কত বন্দর, কলাবাগান, পুরনো প্রাসাদোপম কত বাড়ি, জাহাজের ডেকের উপর দাঁড়ানো কত নাবিক, হাতির পিঠে আরোহী, সাগরের ঢেউ কেটে কেটে চলা মোটরবোট, মলপরা কালো নাচনেওয়ালি; পুরু ঠোঁট আর কোঁকড়ানো চুলওয়ালা কালো কালো ছেলেমেয়ের দল। এমনি কত রকমারি ছবি ওরা দু-চোখ ভরে দেখে আর অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। প্রতিটি ছবিই কী সুন্দর আর বিচিত্র! প্রায় প্রত্যেকটি ছবিতেই সাগরকে দেখতে পাবে তুমি, অসীম সেই নীল সাগর নীল আকাশের কোলে এক হয়ে মিশে গেছে। সাগরের ঢেউগুলো আনন্দে নাচছে আর মাতামাতি করছে ফেনা নিয়ে। শাদা শাদা ফেনাগুলো ঝিকমিক করছে মণিমুক্তার মতো, গোলাপি রঙের সেই শাঁখটায় কান পাতলে একটানা যে মধুর সুরগুঞ্জন শোনা যায়, অপরূপ রূপকথার দেশ থেকে তেমনি মৃদু ঘুমপাড়ানি গান ভেসে আসছে যেন… 

কিন্তু ভাস্কার বাগান এখন একেবারে শূন্য, নীরব। রাজাহীন রাজত্ব যেন। যে কেউ এখন সেখানে গিয়ে সারাটা দিন খেলা করুক না, কেউ কিছু বলবার নেই, কেউ তাড়িয়ে দেবার নেই…বাগানের মালিক আজ কতদূরে সেই অজানা রূপকথার রাজ্যে চলে গেছে। সেরিওজাও একদিন যাবে, নিশ্চয়ই যাবে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *