ছোটখাট দুঃখকষ্ট

ছোটখাট দুঃখকষ্ট 

ফিমা খুব সত্যি কথাই বলেছে। সেরিওজা অনেক কিছুই লক্ষ করে না। চারদিকে এত কিছু রয়েছে দেখবার, সব কি দেখা যায় নাকি? তোমার চারপাশ ঘিরে তো অফুরন্ত দেখবার জিনিস। পৃথিবীটা যেন হাজার জিনিসে বোঝাই হয়ে আছে। তাই, সমস্ত কিছু লক্ষ করা যে একেবারেই অসম্ভব! তাছাড়া, সব জিনিসগুলোই কেমন বড় বড়। দরজাগুলো কী ভয়ানক উঁচু আর মানুষগুলো তো (অবশ্য বাচ্চারা ছাড়া) ইয়া লম্বা চওড়া, এক-একটা দৈত্য যেন! গাড়ি, কম্বাইন, লরি, রেলগাড়ির ইঞ্জিন, এসবের কথা না-হয় ছেড়েই দেওয়া গেল। ইঞ্জিনের বাঁশি তো কানে তালা লাগিয়ে দেবে, তখন তুমি আর অন্য কিছু শুনতে পাবে না। 

তবুও ওরা সবাই কিছু ভয়ানক নয় কিন্তু! সকলেই সেরিওজাকে কত ভালোবাসে, ও যদি চায় তা হলে মাথা নিচু করে ওর কথা মন দিয়ে শোনে, হাসে। কই, ওদের বিরাট পাগুলো দিয়ে ওকে একবারও তো মাড়িয়ে দেয় না। লরি আর গাড়িগুলোও তো ওকে কখনো ধাক্কা দেয় না। অবশ্য ওদের একেবারে মুখোমুখি হয়ে পড়লে সে আলাদা কথা। রেলের ইঞ্জিনগুলো অনেক দূরে, ঐ স্টেশনে থাকে। সেরিওজা দু-একবার তিমোখিনের সঙ্গে ওখানে গিয়েছে। উঠানে আবার কী ভীষণ একটা জন্তুকে ও পড়ে থাকতে দেখেছে। ওর ভীষণ দুটো চোখ রাগে আর সন্দেহে কটমট করে তাকিয়ে আছে! একটা বিরাট নাক ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছে। গাড়ির চাকার মতো বুকটা আর লোহার মতো শক্ত ঠোঁটও আছে ওর। দুটো কঠিন থাবা দিয়ে ও মাটির বুকে আঁচড়ায় সব সময়। যখন ও গলাটা বাড়িয়ে চলতে আরম্ভ করে তখন সেরিওজার মতোই লম্বা দেখতে হয়। একদিন একটা মোরগছানা ওদিক থেকে দৌড়ে এসে ওর সামনে পড়তেই ঐ বিশ্রী জন্তুটা তাকে মেরে ফেলল। সেরিওজাকেও বুঝি এমনি করে একদিন ও মেরে ফেলবে! সেরিওজা জন্তুটার চারদিকে ঘুরে ঘুরে ওটাকে আড়চোখে দেখতে থাকে। জন্তুটাও যেন ওর লাল ঝুঁটিটা বার করে সারাক্ষণই কিছু একটা খাচ্ছে। ওকে ওর হিংসুটে দুটো চোখ দিয়ে একদৃষ্টিতে কেবল দেখছে আর দেখছেই। এই জন্তুটাকে দেখলেই ওর ছোট্ট বুকটা ভয়ে দুর্ভাবনায় কেমন ছম্‌ছম্ করে ওঠে… 

মোরগ ঠোকরায়, বিড়াল আঁচড়ায়, বিছুটি হুল ফোটায়, দামাল ছেলের দল মারামারি করে আর ধপাস্ করে আছাড় খেলে মাটি হাঁটু ঘষে দিয়ে তোমার পায়ের চামড়া ছিঁড়ে দেয়। তাই সেরিওজার গায়ে হাতে পায়ে সব সময় কাটা-ছেঁড়া-আঁচড়ের একটা না একটা দাগ দেখা যাবেই। ওর ছোট্ট শরীরের যে কোনো একটা জায়গা ফুলে থাকবেই। আর প্রায় প্রতিদিনই শরীরের কোনো না কোনো অংশ থেকে রক্ত ঝরবে। কারণ একটা না একটা ব্যাপার রোজই তো ঘটছে কিনা! ভাস্কা হয়তো কোনো উঁচু বেড়া বেয়ে বেয়ে উঠল, তাই দেখে সেরিওজাও উঠতে গেল। কিন্তু খানিকটা উঠতে না পেরে বেচারা ধপাস্ করে আছাড় খেয়ে পড়ল। লিদার বাগানে একটা নালা কাটা হল, সেটার উপর দিয়ে ছেলেরা লাফাতে লাগল। সেরিওজা লাফাতে গিয়েই পড়বি তো পড় একেবারে সেই নালার ভেতরে। পা-টা ওর তক্ষুনি ফুলে ব্যথা হয়ে গেল আর তারপরই বেশ কয়েক দিনের জন্য বিছানায় বন্দী। আবার ভালো হয়ে প্রথম যেদিন বল খেলতে বের হল, বল তো ছাদের ওপর লাফিয়ে উঠে চিমনিতে আটকে গেল। ভাস্কা বলটা নিয়ে না আসা পর্যন্ত সেরিওজাকে বোকার মতো উপর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে হল। আর একবার তো ও প্রায় ডুবেই গিয়েছিল আর কি! লুকিয়ানিচ ওদের একদিন নদীতে নৌকো করে বেড়াতে নিয়ে গেল। ছিল সেরিওজা, ভাস্কা, ফিমা, নাদিয়া এই কয়জন। কিন্তু লুকিয়ানিচের নৌকোটা এত বিশ্রী যে ছেলেরা এদিক-ওদিক একটু নড়াচড়া করতেই নৌকোটা ভীষণ হেলেদুলে একেবারে কাত হয়ে গেল, ওরা একে একে ঝুপ ঝুপ করে জলের মধ্যে পড়ল। কেবল লুকিয়ানিচ নৌকো থেকে জলে পড়ে যায় নি। উঃ! জলটা কী ঠাণ্ডা, একেবারে যেন বরফ! সেরিওজার নাকে, কানে, মুখে এমন কি পেটের মধ্যেও সেই ঠাণ্ডা জল হুড়মুড় করে ঢুকে যেতে লাগল, সে চেঁচাতেও পারল না। নিজেকে হঠাৎ খুব ভারি মনে হতে লাগল। মনে হল কেউ যেন ওকে টেনে-হিঁচড়ে কোথায় নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এত ভয় ও জীবনে আর কোনোদিন পায় নি। চারদিক অন্ধকার হয়ে এল। এভাবে কতক্ষণ ও নামছিল কে জানে! আচমকা কে যেন ওকে উপরের দিকে টেনে তুলল। অনেক কষ্টে চোখ খুলে দেখল নদীটা এবার ওর মুখের নিচে, আর একটু দূরেই পার দেখা যাচ্ছে, এবার আর অন্ধকার নয়, সোনার রোদে চারদিক ঝিকমিক করছে। ওর ভেতরকার জল গড়গড় করে এবার বেরিয়ে এল, সে নিঃশ্বাস নিতে পারল। পার ক্রমেই ওর কাছটিতে এগিয়ে এল যেন। তারপর পারের নাগাল পেয়ে সে শীতে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে হামাগুড়ি দিয়ে উঠে শক্ত জমিতে বসল। ভাস্কা ওকে জলের ভেতর থেকে চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলেছে। কিন্তু ওর এত লম্বা চুল না থাকলে কী হত? 

ফিমা সাঁতার জানে, তাই সাঁতরে পারে উঠতে পেরেছে আর লুকিয়ানিচ নাদিয়াকে বাঁচিয়েছে। কিন্তু লুকিয়ানিচ নাদিয়াকে টেনে টেনে তোলবার সময় নৌকোটা খেয়ালখুশিমতো কোথায় ভেসে চলে গেল। ঢালুর দিকে যৌথখামারের কয়েকজন লোক নৌকোটা পেয়ে লুকিয়ানিচের অফিসে টেলিফোন করে খবর দিয়েছিল। তারপর থেকে আর কোনোদিন লুকিয়ানিচ ওদের নৌকো করে বেড়াতে নিয়ে যায় নি। বললেই বলে, ‘ওরে বাপরে, আবার তোমাদের নিয়ে যাব? যথেষ্ট আক্কেল হয়েছে আমার।’ 

সারাটা দিন এমনি কত কাণ্ডকারখানা করে, এত জিনিস দেখেশুনে সেরিওজা দিনের শেষে ঝিমিয়ে পড়ে। সন্ধে হলেই আর কথা নেই, চোখ দুটো ওর বুজে আসে, কথা কেমন জড়িয়ে যায়। হাত-পা ধুইয়ে, খাইয়ে তারপর রাত্রির লম্বা জামাটা গায়ে গলিয়ে দিয়ে ওরা ওকে শুইয়ে দেয়। সে বুঝতেই পারে না, তার দম ফুরিয়ে গিয়েছে। 

নরম বালিশে আরামে মাথাটি রেখে ছোট্ট দুটি হাত দু পাশে ছড়িয়ে এক পা গুটিয়ে অন্য পা-টা ছড়িয়ে ও ঘুমিয়ে পড়ে। নরম ফুরফুরে লম্বা চুলগুলো ওর সুন্দর মুখখানির দু-পাশে আলতো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। তরুণ ষাঁড়ের মতো ওরও দু’ভুরুর পাশে উঁচু হয়ে থাকে। ফুলের পাপড়ির মতো ডাগর চোখের পাতা দুটি বোজা। ঠোঁট দুটির মাঝখানটি একটু ফাঁক, কোণায় ঘুমের আমেজ জড়ান। নিঃশ্বাস পড়ছে কি পড়ছে না তা-ও বোঝা যায় না। নিঃসাড় হয়ে ছোট্ট ছেলেটি ঘুমিয়ে আছে ঠিক যেন একটি ফুলের মতো। 

এখন তুমি ওর কানের কাছে একটা ঢাক নিয়ে জোরে বাজাও, বন্দুক ছোড়, কিন্তু ও আর জাগবে না। ও কিছুই জানতে পারবে না। আসলে কাল ভোর হতেই আবার ওকে করতে হবে বাঁচার জন্য সংগ্রাম, তাই তো এখন ও প্রাণভরে ঘুমিয়ে নিচ্ছে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *