বিরক্তি

বিরক্তি 

সেরিওজা আবার অসুখে পড়ল। হঠাৎ কোথাও কিছু নেই, টনসিলের যন্ত্রণা শুরু হল। ডাক্তার এসে বলল, ‘গ্ল্যান্ডের অসুখ।’ আবার ডাক্তারের অত্যাচার শুরু হল। কডলিভার খাওয়া, গলায় পুলটিস লাগান, গায়ের তাপ নেওয়া, ডাক্তারের নির্দেশমতো সব চলল। 

কী একটা কালো কালো মলম এক টুকরো ন্যাকড়ায় বেশ করে লাগিয়ে ওরা তার ঘাড়ে গলায় সেঁটে দিল। পুলশিসটার উপর আড়াআড়িভাবে আঠাল একটা ফিতে লাগিয়ে তারপর তুলো দিয়ে ওর দু-কানের পাশ দিয়ে মাথায় ঘাড়ে আঁটসাঁট করে ব্যান্ডেজ জড়িয়ে দিল। মাথাটা ঠিক যেন একটা বোর্ডে ঠুকে দেওয়া পেরেকের মতো হল, আর এদিক-ওদিক ফেরান যাচ্ছে না। উঃ! এভাবে বাঁচতে হবে। 

এবার অবশ্য ওরা তাকে সবসময়ের জন্য জোর করে বিছানায় শুইয়ে রাখে নি। গায়ে জ্বর না থাকলে আর বৃষ্টি না পড়লে তাকে একটু-আধটু বাইরে বের হতে দেওয়া হত। কিন্তু তা খুব কমই। কারণ প্রায় রোজই হয় তার গায়ে একটু-একটু জ্বর থাকবে, না হয় বাইরে টিপটিপানি বৃষ্টি থাকবে! 

তার জন্য রেডিওটাকে ওরা সর্বদাই খুলে রাখে। কিন্তু কত আর রেডিও শুনতে ভালো লাগে? ওটা শুনতে শুনতে কেমন একঘেয়ে হয়ে গেছে। 

আর বড়রা এত অলস যে তুমি যখনই ওদের একটা বই পড়ে শোনাতে বলবে বা একটা গল্প বলতে বলবে তখনই ওরা বলবে ওদের নাকি অনেক কাজ আছে। কিন্তু পাশা খালা যখন রান্না করে তার হাত দুটোই তো কেবল কাজ করতে থাকে, জিভটা তো আর কাজ করে না। তবে কেন রান্না করতে করতে খালা ওকে একটা গল্প শোনাতে পারে না? মায়ের কথাই ধর-না কেন। মা স্কুলে থাকলে বা লিওনিয়ার ভিজে জাঙ্গিয়া বদলাতে থাকলে কিংবা স্কুলের খাতা দেখতে থাকলে এক কথা। কিন্তু মা যখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে থাকে, সাজতে থাকে আর আয়নার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসে তখন কি বলতে হবে যে মা খুব কাজে ব্যস্ত! 

মা’কে যদি তখন সেরিওজা আদরের সুরে বলে, ‘মা, একটা গল্প পড় না।’ 

মা বলবে, ‘একটু অপেক্ষা কর। দেখছ না আমি ব্যস্ত আছি।’ 

‘আজ অমন করে চুল আঁচড়াচ্ছ কেন, ‘মা?’ সেরিওজা মায়ের লম্বা বেণীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে। 

‘রোজ রোজ এক রকম ভালো লাগে না, তাই।’ 

‘কেন ভালো লাগে না?’ 

‘এমনিই…’ 

‘তুমি মুচকি মুচকি হাসছ কেন?’ 

‘এমনিই…’ 

‘এমনিই কেন? কোনো কারণ নেই কেন?’ 

‘ওঃ, সেরিওজা, আর জ্বালিও না বাপু।’ 

অবাক হয়ে সে ভাবল মা’কে আবার কখন জ্বালাতন করলাম! কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলল, ‘আচ্ছা, যাই হোক আমাকে একটা গল্প পড়ে শোনাও না মা।’

‘আজ সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর, তখন গল্প পড়ব।’ 

কিন্তু সেরিওজা জানে সন্ধেবেলায় মা বাড়ি ফিরে লিওনিয়াকে খাওয়াবে, করোস্তেলিওভের সঙ্গে গল্প করবে, তারপর স্কুলের একগাদা খাতা নিয়ে দেখতে বসবে। গল্প পড়া আর হবে না। 

সারাদিনের কাজকর্ম শেষ করে সন্ধেবেলায় পাশা খালা তার ঘরে গিয়ে একটু বিশ্রাম করবার জন্য চুপচাপ কোলে হাত রেখে আনমনে বসতেই সেরিওজা তার পাশ ঘেঁষে বসে পড়ে রেডিওটা বন্ধ করে দিয়ে আবদারের সুরে বলল, ‘একটা গল্প বল।’ 

‘ওমা, গল্প আর কী শুনবে? সব গল্পই তো তোমার মুখস্থ।’ 

‘তা হোকগে। তবুও একটা বল না।’ 

সত্যি, খালাটাও কী আলসে! 

যা হোক, শেষ পর্যন্ত খালা গল্প বলতে শুরু করল, ‘আচ্ছা, শোন তাহলে। অনেক, অ-নে-ক দিন আগে এক যে ছিল রাজা আর তার ছিল এক রানি। তাদের একটি মেয়েও ছিল। একদিন হয়েছে কী জান…’ 

সেরিওজা আগ্রহভরে এবার প্রশ্ন করল, ‘মেয়েটি ভারি সুন্দরী, না?’ 

ও জানে মেয়েটি খুব সুন্দরী হবেই। সবাই তাই জানে। কিন্তু খালা কেন বলবে না ও কথাটা। গল্প বলতে গেলে কোনো কথাই কিন্তু বাদ দেওয়া উচিত নয়। 

খালা আবার বলল, ‘হাঁ, খুব সুন্দরী মেয়ে…তারপর একদিন সেই রাজকুমারী ভাবল এবার বিয়ে করবে। দেশ-দেশান্তর থেকে কত রাজকুমার এল তাকে বিয়ে করতে…’ 

গল্পটা চিরন্তন ধারায় এগিয়ে চলল। সেরিওজা একমনে শুনতে লাগল, তার ডাগর সুন্দর মায়াময় চোখ দুটি কৌতূহল আর আগ্রহে ভরে উঠল। সে এই গল্পের প্রতিটি কথা জানে, কিন্তু তা বলে গল্পটি কখনো পুরনো হয়? 

যে গল্পের শেষ নেই, এ যে সেই গল্প! তাই সবসময়েই শুনতে ভালো লাগে তার। গল্পের প্রতিটি কথাই যে ও বুঝতে পারে তা নয়। তবে নিজের মতো করে সে সমস্ত গল্পটা ঠিকই বুঝে নেয়। এই যেমন ঘোড়ার পা দুটো মাটিতে গেঁথে বসল—তারপর আবার চলল লাফিয়ে। তার মানে নিশ্চয়ই তখন আর পা মাটিতে গাঁথা ছিল না। 

আস্তে আস্তে সন্ধে গড়িয়ে রাত্রির আঁধার নেমে আসে। ঘরের মধ্যেও আঁধার ঘনিয়ে এল। পাশা খালার গল্প বলার একটানা সুরেলা স্বর ছাড়া জগতে আর কিছুই শোনবার নেই যেন। সে আর খালা ছাড়া জগতে আর কেউ নেই। দানায়া স্ট্রিটের এই বাড়িটাকে ঘিরে গভীর নীরবতা নেমে এল। 

গল্প একসময় শেষ হয়ে গেল। অনেক অনুনয়-বিনয় করে বললেও পাশা খালা আর দ্বিতীয় গল্প বলতে রাজি হল না। একটা বড় রকমের নিঃশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করতে করতে খালা আবার রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল। এবার সে একেবারে একলা। এখন সে কী করবে? শরীর ভালো না থাকলে খেলনাগুলো দিয়েও খেলতে একদম ভালো লাগে না যে! ছবি আঁকতেও ভালো লাগে না। বাড়ির ভেতর বদ্ধ জায়গায় সাইকেলেও চড়া যায় না। 

অসুস্থতার চাইতে এই একেঘেয়েমিই ওকে বড্ড ক্লান্ত করে তোলে। মনটা আবার কেমন ভারি হয়ে ওঠে, চারদিকে সবকিছু কেমন বিবর্ণ মনে হয়। 

লুকিয়ানিচ একটা বান্ডিল হাতে ফিরল। কী জানি একটা কিনেছে। বান্ডিলটা খুলতেই একটা ছাইরঙের বাক্স বেরিয়ে পড়ল। সেরিওজা আগ্রহভরে ওটার দিকে তাকিয়ে রইল। ধৈর্য ধরে দেখতে লাগল লুকিয়ানিচ কখন ওটাকে খোলে। লুকিয়ানিচ সুতোটা এত আস্তে আস্তে খুলছে কেন? একটা ছুরি দিয়ে পট করে কেটে ফেললেই তো পারে। কিন্তু না, সে নিপুণ হাতে সুতোটা খুলছে, কেননা ওটা হয়তো কোনো কাজে লাগবে আবার। কেটে ফেললে তো নষ্ট হয়েই যাবে কিনা। 

সেরিওজা দু-চোখে অধীর আগ্রহ নিয়ে সুন্দর বড় বাক্সটার দিকে তাকিয়ে আছে…কিন্তু বাক্সটা খুলবার পর ওটার মধ্য থেকে বের হল রবার-সোলের একজোড়া জুতো, ঠিক এরকম না হলেও প্রায় একরকম দেখতে এমন জুতো তারও ছিল একজোড়া। সেটা তার একটুও ভালো লাগল না। কিন্তু এখন লুকিয়ানিচের জুতো-জোড়াটার দিকে তাকাতেও ভালো লাগল না। 

উদাস ও বিরক্ত স্বরে প্রশ্ন করল, ‘কী ওটা?’ 

‘দেখছ না একজোড়া বুটজুতো। ছোকরারা এরকম জুতো পরে না, বুড়োরাই শুধু পরে, বুঝলে?’ 

‘তাহলে তুমি বুঝি বুড়ো?’ 

‘এটা পরলে তাই হব বটে।’ 

জুতোটা পরে লুকিয়ানিচ বলল, ‘বাঃ! বেশ আরাম পাচ্ছি তো!’ 

তারপর পাশা খালাকে দেখাতে চলে গেল। 

সেরিওজা এবার খাবারঘরে গিয়ে একটা চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে আলো জ্বালবার জন্য সুইচ টিপল। পাত্রের মধ্যে মাছগুলো বোকার মতো সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে। .সেরিওজার ছায়াটা জলের উপর পড়তেই ওরা উপরের দিকে ভেসে উঠল আর মুখ খুলে হাঁ করতে লাগল কিছু খাবার আশায়। 

সেরিওজা অবাক হয়ে ভাবল, ‘ওরা কি ওদের গায়ের তেল খেতে পারে? 

এই ভাবনাটা মনে হতেই ও কডলিভারের শিশিটা নিয়ে ছিপি খুলে কয়েক ফোঁটা কডলিভার জলের মধ্যে ফেলে দিল। মাছগুলো লেজের ওপর ভর দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কেমন হাঁ করল কিন্তু কডলিভার গিলল না তো! আরো কয়েক ফোঁটা টপটপ করে ফেলতেই মাছগুলো অন্যদিকে পালিয়ে গেল…ওরাও তাহলে কডলিভার ভালোবাসে না! 

সত্যি, ওরও কিছু যেন আর ভালো লাগছে না। একঘেয়ে, বিরক্তিকর প্রতিটি মুহূর্ত! এই একঘেয়েমি ঘোচাবার জন্যই ওর এখন বড্ড দুষ্টুমি করতে ইচ্ছে হল। একটা ছুরি নিয়ে দরজার গায়ে যেখানটায় রঙ উঁচু উঁচু হয়ে আছে ঠিক সেখানটায় আঁচড় কাটতে লাগল। এরকম করতে যে ওর খুব ভালো লাগছে তা ঠিক নয়। তবুও কিছু একটা করা চাই তো। এবার সে খালার জাম্পার বোনার উলের বলটা নিয়ে সবটা টেনে খুলে ফেলে আবার উল জড়াতে চাইল, কিন্তু পারল না। সে জানে, সে দুষ্টুমি করছে আর পাশা খালা তা দেখতে পেলে ভীষণ বকুনিও দেবে, আর সে তখন কেঁদেও ফেলবে। সত্যি সত্যি খালার বকুনি সে খেল এবং কাঁদলও। তবু এই দুষ্টুমিতে একটু যেন ভালোই লাগছে, একঘেয়েমিটা একটু কেটে যাচ্ছে। খালা বকল, সে কাঁদল – অন্তত একটা কিছু তো হল। 

তারপর মা লিওনিয়াকে নিয়ে বাড়ি ফিরলে নীরব নিঝুম বাড়িটা আবার যেন প্রাণ ফিরে পেল। লিওনিয়া কাঁদতে লাগল, মা ওকে আদর করে ভিজে জাঙ্গিয়া বদলে দিল। তারপর তাকে গোসল করাল। এখন লিওনিয়া আর আগের মতন ছোট্টটি নেই। বেশ মানুষের মতো দেখতে হয়েছে। তবে একটু বেশি মোটা হয়ে গেছে। এখন ও দু-হাতে একটা ঝুমঝুমি ধরতে পারে আর ওটা নিয়েই আপন মনে খেলা করে। সারাটা দিন তো সেরিওজাকে ওর জন্য কিছুই করতে হয় না। 

রাত্রিবেলা সবার শেষে করোস্তেলিওভ বাড়ি ফেরে। তখন প্রত্যেকেই একটা না একটা কাজে তাকে ডাকে। সেরিওজার সঙ্গে সবে হয়তো একটু কথা বলতে শুরু করল বা একটা গল্প পড়তে রাজি হল, ব্যস ঠিক তখনই টেলিফোনটা ক্রিং ক্রিং করে বেজে উঠবে।আর মা তো প্রতিটি মুহূর্তে তাকে এটা ওটা সেটার জন্য বিরক্ত করবে, ঘুরে ফিরে একটা না একটা কথা বলবে, অন্যদের কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষাও করবে না। ঘুমোবার আগে লিওনিয়া কান্না জুড়বে, আর তখন মা আবার কাউকে নয়, করোস্তেলিওভকেই ডাকবে, বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে ওকে ঘুম পাড়াবার জন্য। তখন সেরিওজারও দু-চোখ ভরে ঘুম নেমে আসতে চাইবে। এমনি করে করোস্তেলিওভের সঙ্গে ওর গল্প করার, কথা বলার সব আশা ফুরিয়ে যায়। আবার কখন করোস্তেলিওভের সময় হবে কে জানে? 

তবুও মাঝে মাঝে এক-একটা সুন্দর সন্ধ্যায় যখন লিওনিয়া একটু তাড়াতাড়িই ‘ঘুমিয়ে পড়ে আর মা স্কুলের খাতা দেখতে ব্যস্ত থাকে তখন করোস্তেলিওভ ওর পাশে বিছানায় বসে ওকে গল্প শোনায়। প্রথম প্রথম সে তেমন ভালো করে গল্প বলতে পারত না, জানত না কেমন করে গল্প বলতে হয়। কিন্তু সেরিওজা তাকে গল্প বলতে শিখিয়ে দেওয়ার পর এখন সে চমৎকার গল্প বলতে পারে। সুন্দর গুছিয়ে বলতে শুরু করে, ‘এক যে ছিল রাজা, তার ছিল এক রানি…’ 

সেরিওজা মন দিয়ে গল্প শুনবে আর একটু ভুলচুক হলেই শুধরে দেবে। এভাবে গল্প শুনতে শুনতে কখন সে ঘুমিয়ে পড়ে। 

একঘেয়ে দিনগুলো যখন তার আর কাটতে চায় না, যখন কোনো কিছুই করতে ইচ্ছে করে না, কেবল দুষ্টুমি করতেই মন চায়, তখনো কিন্তু করোস্তেলিওভের সুন্দর হাসি-মাখা চেহারাখানি, সবল বলিষ্ঠ হাঁ আর গুরুগম্ভীর সস্নেহ স্বর, সমস্ত কিছুই ওর বড্ড ভালো লাগে। করোস্তেলিওভকে সে দিনের পর দিন আরো নিবিড় করে ভালোবাসে… লিওনিয়া আর মা-ই শুধু নয়, সেরিওজাও করোস্তেলিওভের এক আপনার জন, একথা ভাবতে তার ভালো লাগে আর একথা ভাবতে ভাবতেই ও ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *