করোস্তেলিওভের ক্ষমতা

করোস্তেলিওভের ক্ষমতা 

কতগুলো লোক এসে মাটিতে এক গর্ত খুঁড়ল। লম্বা থাম সেই গর্তের মধ্যে পুঁতে দিয়ে তার মাথায় তার বেঁধে দিয়ে গেল। সেরিওজার বাড়ির উঠানের উপর দিয়ে সেই তার আড়াআড়িভাবে চলে গিয়ে বাড়ির দেয়ালে চলল। তারপর কালো রঙের একটা টেলিফোন ওদের খাবারঘরের ছোট টেবিলের উপরে রাখা হল। দালনায়া স্ট্রিটে এটাই নাকি প্রথম এবং একমাত্র টেলিফোন আর এটা হল করোস্তেলিওভের। করোস্তেলিওভের জন্যই ঐ লোকগুলো মাটিতে গর্ত খুঁড়ল, থাম বসাল, তারপর তার বেঁধে দিয়ে এত কাণ্ড করল। অন্য লোকদের টেলিফোন না হলেও চলে, কিন্তু করোস্তেলিওভের টেলিফোন না হলে চলে কী করে? 

রিসিভারটা হাতে তুলে নিলেই একটা মেয়ে যাকে দেখতে পাচ্ছ না, অনেক দূর থেকে বলবে, ‘একচেঞ্জ।’ তারপর করোস্তেলিওভ অফিসারের মতো আদেশের সুরে বলবে, ‘ইয়াসি বেরেগ’ অথবা ‘পার্টি কমিটি’ অথবা বলবে ‘রিজিওন্যাল স্টেট ফার্ম অফিস।’ তারপর সে চেয়ারে বসে লম্বা পা দুলিয়ে দুলিয়ে টেলিফোনে কথা বলতে থাকবে। আর এই কথা বলার সময় কেউ তাকে বিরক্ত করতে পারে না, এমনকি মা-ও না। 

কখনো কখনো টেলিফোন ক্রিং ক্রিং করে বেজে উঠলে সেরিওজা দৌড়ে গিয়ে ওর ছোট্ট দুই হাতে রিসিভার তুলে নিয়ে বলে : 

‘হ্যালো!’ 

আর ওদিক থেকে তক্ষুনি একটা স্বর করোস্তেলিওভকে ডেকে দিতে বলবে। করোস্তেলিওভকে কত লোক চায়! আশ্চর্য! কিন্তু কই, লুকিয়ানিচ, মা অথবা পাশা খালাকে তো কেউ একবার ডেকে দিতে বলে না! আর তাকে তো কেউ চায় না কোনোদিন। 

প্রতিদিন খুব ভোরবেলা করোস্তেলিওভ ‘ইয়াসি বেরেগ’-এ চলে যায়। তোসিয়া খালা মাঝে মাঝে দুপুরে খাবার জন্য তাকে বাড়িতে নিয়ে আসে। কিন্তু প্রায়ই সে দুপুরে খেতে আসবার সময় পায় না। মা হয়তো ‘ইয়াসি বেরেগ’-এ ফোন করে ওকে খেতে আসবার জন্য ডাকে; কিন্তু ওখান থেকে বলে দেয় করোস্তেলিওভ কোথায় কী কাজে গেছে, ফিরতে দেরি হবে। 

‘ইয়াসি বেরেগ’ ফার্মটা সত্যি কী বিরাট! সেদিন করোস্তেলিওভের কী কাজে করোস্তেলিওভ আর তোসিয়া খালার সঙ্গে গাড়িতে চড়ে ওখানে বেড়াতে না গেলে সে তা বুঝতেই পারত না কোনোদিন। সেদিন ওরা গাড়ি করে চলেছে তো চলেছেই। ফার্মের ভেতরে পথের যেন আর শেষ নেই। গাড়ির দু-পাশে বিরাট জমি এসে আছড়ে পড়ছে যেন। পথের দু-ধারে বিরাট বিরাট খড়ের গাদা উঁচু পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে মিশেছে দিগন্তে ছড়ানো লাইলাক ঝোপের গায়ে। মাঠের পর মাঠ গমক্ষেত। কচি সবুজ শীষগুলো মাথা দুলিয়ে নাচছে যেন। অন্তহীন ফিতের মতো পথ এসে গাড়ির সামনে লুটিয়ে পড়ছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে পিছনে। দৈত্যকার লরি আর ট্রাক্টরগুলো ট্রেইলারগুলোকে টেনে টেনে সেই রাস্তার বুক দিয়ে হুকহুক করে যাচ্ছে আসছে। সেরিওজা ‘এটা কোন জায়গা’ প্রশ্ন করতেই বার বার একই উত্তর শুনছিল ‘ইয়াসি বেরেগ, ইয়াসি বেরেগ ফার্ম। 

ফার্মের তিনটে প্রকাণ্ড বাড়ি আলাদাভাবে এই বিরাট বিস্তৃত জায়গায় এদিক-ওদিক দাঁড়িয়ে আছে। একটা বাড়ির মাথার উপর বিরাট একটা গম্বুজ। অন্যবাড়িটায় যন্ত্রপাতির কারখানা। সেই কারখানায় রাতদিন ঝনঝনাত শব্দে কাজ চলছে। গনগনে ফারনেস থেকে আগুনের ফুলকি বার হচ্ছে। হাতুড়ি পেটাবার একঘেয়ে বিকট শব্দ শোনা যাচ্ছে। যেখানেই ওরা গাড়ি থামাচ্ছিল সেখান থেকেই লোক বেরিয়ে এসে করোস্তেলিওভের সঙ্গে কথা বলছিল। করোস্তেলিওভ কারখানায় সব দেখাশুনা করছিল, নানা প্রশ্ন করছিল, কীভাবে কী করতে হবে না হবে নির্দেশ দিয়ে গাড়িতে আবার চলছিল। তখনই সেরিওজা ঠিক বুঝতে পারল কেন সে এত তাড়াতাড়ি রোজ সকালবেলা ফার্মে চলে যায়। করোস্তেলিওভের নির্দেশ ছাড়া কোনো কাজ করা যে ওদের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। 

তারপর ফার্মের ভেতরে কত রকম পশুপাখিই-না রয়েছে! শুকর, ভেড়া, মুরগি, হাঁস, গরুই বেশি। গরম পড়লে গরুগুলো বাইরের মাঠে চরে খায়। বর্ষার দিনে থাকবার অস্থায়ী আস্তানাগুলো তখনো ছিল। কিন্তু এখন গরুগুলো গোয়ালঘরেই যার যার জায়গা মতো দাঁড়িয়ে আছে। এক-একটা কাঠের গুঁড়ির সঙ্গে ওদের শিং লোহার শিকল দিয়ে বাঁধা। সামনে লম্বা চৌবাচ্চা থেকে ওরা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আনন্দে লেজ নেড়ে নেড়ে খাবার খাচ্ছে। কিন্তু বড্ড অসভ্য আর অভদ্র। একটু পরে পরেই ওরা পায়খানা করছে আর কেউ না কেউ দৌড়ে এসে তক্ষুনি গোবরগুলো পরিষ্কার করে নিচ্ছে। ওদের এই বিশ্রী অভদ্র কাণ্ডকারখানা দেখেশুনে সেরিওজার কিন্তু বড্ড লজ্জা করছিল। পিছল মেঝের উপর দিয়ে করোস্তেলিওভের হাত ধরে পা টিপে টিপে চলতে চলতে সে লজ্জায় মরে গিয়ে ওদের দিকে তাকাতেও পারছে না যেন। কিন্তু করোস্তেলিওভ ওদের গায়ে বেশ হাত চাপড়ে আদর করে লোকদের কী সব নির্দেশ দিচ্ছে, এসব কাণ্ডকারখানা যেন দেখেও দেখছে না। 

একটি মেয়ে এসে করোস্তেলিওভের সঙ্গে কী একটা বিষয়ে তর্ক শুরু করে দিল। করোস্তেলিওভ গম্ভীর স্বরে শুধু বলল, 

‘ঠিক আছে, আর একটিও কথা নয়, যা করছ করো গিয়ে। 

মেয়েটি তক্ষুনি নীরবে কাজে চলে গেল। 

নীল টুপি মাথায় আর-একটি মেয়ের কাছে এসে করোস্তেলিওভ এবার বলল, ‘এ জন্য দায়ী কে? আমাকে কি এসব ছোটখাট ব্যাপার নিয়েও মাথা ঘামাতে হবে নাকি?’ 

মেয়েটি থতমত খেয়ে ক্ষীণ স্বরে উত্তর করল : 

‘ভুলে গিয়েছিলাম। কেন যে এমন ভুল হল বুঝতে পারছি না। 

এমন সময় লুকিয়ানিচ কোথা থেকে একটা কাগজ হাতে নিয়ে তাদের সামনে এসে উপস্থিত হল। করোস্তেলিওভের হাতে একটা পেন দিয়ে সে কাগজটা তার সামনে ধরে বলল, 

‘এই যে সই করে দিন দয়া করে। করোস্তেলিওভ তখনো সেই মেয়েটাকে ধমকাচ্ছে, তাই লুকিয়ানিচের দিকে চেয়ে বলল, ‘পরে হবে।’ কিন্তু লুকিয়ানিচ বলল, ‘না, পরে হলে চলবে না। আপনার সই ছাড়া ওরা আমায় মাইনে দেবে কেন? আর টাকা না পেলে তো আর লোকের চলে না!’ 

সেরিওজা অবাক হয়ে ভাবল, তাহলে করোস্তেলিওভের সই ছাড়া কেউ মাইনে পাবে না! 

তারপর সেরিওজা আর করোস্তেলিওভ হলদে ছোট ডোবাগুলোর মাঝ দিয়ে গাড়িতে উঠতে যাচ্ছে ঠিক তখন একটি যুবক ওদের সামনে দৌড়ে এল। তার গায়ে পরিপাটি সাজসজ্জা, পায়ে চকচকে বুট জুতো, গায়ে ঝকঝকে সুন্দর বোতাম লাগানো জ্যাকেট। 

করোস্তেলিওভের দিকে তাকিয়ে ছেলেটি আকুল স্বরে বলল, ‘দমিত্রি কর্নেয়েভিচ, 

আমি এখন কী করি? ওরা আমাকে থাকবার জায়গা দিচ্ছে না। 

করোস্তেলিওভ গম্ভীরভাবে বলল, 

‘কেন, তুমি বুঝি ভেবেছিলে তোমার জন্য ওরা নতুন বাড়ি তৈরি করে রেখেছে?’

ছেলেটি আবার বলল, 

‘তা হলে আমার কী হবে? আমি যে বিয়ে করেছি। থাকবার জায়গা না পেলে তো সর্বনাশ। আপনি আপনার আদেশ ফিরিয়ে নিয়ে দয়া করে আমাকে আবার এখানে নিয়ে নিন। 

করোস্তেলিওভ আরো গম্ভীর হয়ে বলল, 

‘সে কথা তোমার আগেই ভাবা উচিত ছিল। কাঁধের উপর মাথাটা আছে কী করতে?’

‘আপনার কাছে মানুষ হিসেবে অনুরোধ জানাচ্ছি দমিত্রি কর্নেয়েভিচ। আপনি কি আমার অবস্থাটা অন্তর দিয়ে বুঝবেন না? আমি একেবারেই আনাড়ি। নতুন জীবন সম্বন্ধে কোনো অভিজ্ঞতাই আমার ছিল না। তাই ব্যাপারটার গুরুত্ব আমি বুঝতেই পারি নি। 

‘নিজের কাজটি ছেড়ে একেবারে অন্য লাইনে চলে গেছ আরো অনেক টাকা রোজগার করবে বলে, সেদিক থেকে তো অনেক অভিজ্ঞতা আছে।…’ 

কারোস্তেলিওভ এবার মুখ ঘুরিয়ে পা বাড়াল। 

কিন্তু ছেলেটি কী নাছোড়বান্দা! ‘না, না, আপনি আমায় দয়া করুন। আমি ভুল করেছি, সেজন্য এখন অনুতপ্ত, আমাকে কাজে নিয়ে নিন!’ 

‘আচ্ছা বেশ, তাই না হয় হবে। কিন্তু মনে রেখ আবার যদি এমনটি কর তাহলে আর কোনো কথাই শুনব না; এই তোমার শেষ সুযোগ!… ‘ 

‘ওদের কথা শুনে এই কাজটি ছেড়েই আমি ভুল করেছি। ওরা আমাকে হোস্টেলে শোবার ব্যবস্থা করে দেবে বলেছিল, তা-ও কখন হবে ভগবানই জানেন…আমি কিছু না ভেবে, না বুঝে তাতেই রাজি হয়ে গেলাম, এখন তো বুঝতে পারছি বোকার মতো কী ভুলই-না করেছি!’ 

‘স্বার্থপর, বুদ্ধু ছেলে, কেবল নিজের কথাটাই তো ভেবেছ! যাও, এই শেষবারের মতো ক্ষমা করলাম। কাল থেকে কাজে আসবে। যাও, এখন চোখের সামনে থেকে চলে যাও বলছি!’ 

ছেলেটি এবার হাসিমুখে বলে উঠল, ‘আচ্ছা, যাচ্ছি!’ একটু দূরে দাঁড়ানো রুমাল মাথায় একটি মেয়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে ছেলেটি খুশিভরা চোখে কী ইঙ্গিত করল। 

করোস্তেলিওভ এতক্ষণে মেয়েটিকে দেখতে পেলে জোরে বলে উঠল, ‘তোমার জন্য নয়, ঐ তানিয়ার কথা ভেবেই আমি তোমাকে ক্ষমা করলাম মনে রেখ। ও তোমায় ভালোবাসে, এটা তোমার মতো ছেলের পক্ষে মস্তবড় সৌভাগ্য জেনো। করোস্তেলিওভ মেয়েটির দিকে হাসিভরা চোখে তাকাল। ওরা দু-জনে এবার হাত ধরাধরি করে যেতে যেতে করোস্তলিওভের দিকে সকৃতজ্ঞ চোখে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে তাকাল…. 

করোস্তেলিওভ সত্যিই কী আশ্চর্য লোক! ইচ্ছে করলে তো সে ওদের কষ্ট দিতেও পারত। 

করোস্তেলিওভ শুধু যে মস্ত বড় ক্ষমতাবান লোক তাই নয়, সে কত দয়ালুও বটে। মনটা তার কত নরম, তাই তো ওদের মুখে আবার হাসি ফুটল। 

সেরিওজা অবাক হয়ে ভাবল এমন সুন্দর লোকটির জন্য মন গর্বে আনন্দে ভরে উঠবে না তো কী? এটা তার কাছে এখন জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, অন্য সবার চেয়ে করোস্তেলিওভ অনেক বেশি জ্ঞানী এবং ভালো। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *