করোস্তেলিওভের সঙ্গে প্রথম দিন

করোস্তেলিওভের সঙ্গে প্রথম দিন 

বাগানের দিকে লোহার ঝনঝনানি শব্দ শুনে পেয়ে সেরিওজা ওদিকে তাকাল। করোস্তেলিওভ বাগানের ভেতর দাঁড়িয়ে ছিটকিনি টেনে টেনে খড়খড়ি খুলছিল। তার পরনে ডোরাকাটা শার্ট, গলায় নীল টাই, ভিজা চুল পরিপাটি করে সাজান। সে খড়খড়ি খুলতেই মা ভেতর থেকে ধাক্কা দিয়ে জানালাটা খুলতে খুলতে কী যেন বলল। জানালার তাকে কনুই রেখে করোস্তেলিওভ তার জবাব দিল। জানালা দিয়ে নিজেকে বেশ খানিকটা বাইরে বের করে দু-হাত দিয়ে মা তার মাথাটাকে জড়িয়ে ধরল। ওরা দেখতে পেল না যে ছেলেরা রাস্তা থেকে ওদের দেখতে পাচ্ছে। 

সেরিওজা এবার উঠানে গিয়ে বলল, ‘করোস্তেলিওভ, আমার কোদালিটা দাও না?’

‘কোদালি?’ 

‘হাঁ, আমার সব খেলনাও আমি নিয়ে যাব। 

মা এবার ভেতর থেকে উত্তর দিল, ‘ভেতরে এসে তোমার খেলনাগুলো নিয়ে যাও।’

সেরিওজা এবার ঘরে ঢুকল, কেমন অদ্ভুত তামাকের গন্ধ ঘরের চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে যেন আর অপরজনের নিঃশ্বাসের গন্ধ। কত কী জিনিস ঘরের এদিক-ওদিক পড়ে রয়েছে, ব্রাশ, জামাকাপড়, সিগারেট, আরো কত কী… মা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলের বিনুনী খুলছে। একটু পরেই মায়ের একরাশ চুল পিঠ ছাড়িয়ে কোমরের নিচে অবধি ছড়িয়ে পড়ল। সত্যি, মায়ের চুল কী সুন্দর দেখতে! ওকে দেখে মা বলল, ‘সুপ্রভাত, সেরিওজা।’ 

ও কোনো কথাটা না বলে অবাক হয়ে সিগারেটের বাক্সগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। বাক্সগুলো কী চকচকে আর সুন্দর! একটা বাক্স হাতে নিয়ে ও নাড়াচাড়া করতে লাগল কাগজের মোড়কে ওটা একেবারে বন্ধ, তাই খোলা যাচ্ছে না। 

ও কী করছে মা আয়নার ভিতর দিয়ে দেখতে পেয়ে বলল, ‘ওটা রেখে দাও সেরিওজা। তুমি তোমার খেলনাগুলো নেবে না?’ 

বাড়ি তৈরি করবার ব্লকটা তো আলমারির দেরাজের পেছন দিকটায় রয়েছে। উঁকিঝুঁকি মেরে ও সেটাকে একটু একটু দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু দেরাজটা আরো টেনে না সরাতে পারলে তার ছোট্ট হাত যে নাগাল পাচ্ছে না। 

মা আবার বলে উঠল, ‘কী হচ্ছে? কী খুঁজছ বল তো।’ 

‘ওটা আনতে পারছি না যে’, সেরিওজা বলল। 

এমন সময় করোস্তেলিওভ ঘরে ঢুকল। সেরিওজা এবার তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ঐ বাক্সগুলো খালি হলে আমায় দেবে?’ 

(ও জানে ঐ বাক্সগুলোর মধ্যে যে জিনিসগুলো থাকে বড়রা সেগুলো বাচ্চাদের দিয়ে দেয়।) 

করোস্তেলিওভ একটা বাক্স থেকে সব সিগারেট বার করে নিয়ে তক্ষুনি ওটা ওর হাতে দিয়ে বলল, ‘এই যে নাও। কেমন খুশি তো?’ 

মা বলে উঠল, ‘ঐ দেরাজের পেছনে ওর কী খেলনা আছে, বের করে দাও তো।’

করোস্তেলিওভ তার বড় বড় হাত দুটো দিয়ে দেরাজটায় টান দিতেই শব্দ করে পুরানো দেরাজটা সরে গেল। সেরিওজা এবার দু-হাত বাড়িয়ে অনায়াসে ব্লকটা বার করে নিল। 

‘বেশ ভালো!’ করোস্তেলিওভের দিকে তাকিয়ে সেরিওজা খুশিভরা গলায় বলে উঠল।

তারপর সেরিওজা ওর সমস্ত খেলনা আর ব্লকের বাক্সটা দু-হাতে বুকে চেপে ধরে খালার ঘরের মেঝেতে ওর খাট আর আলমারির মাঝখানে এনে ফেলল। 

মা ও-ঘর থেকে ডেকে বলল, ‘কোদালিটা নিয়ে গেলে না? ওটার জন্যে এলে আর ওটাই ফেলে গেলে?’ 

সেরিওজা নীরবে আবার ও-ঘরে ঢুকে কোদালিটা হাতে নিয়ে বাগানে বেরিয়ে এল। না, এখন আর মাটি খুঁড়তে ইচ্ছে হচ্ছে না তার। চকোলেটের উপরকার রাংতাগুলোকে নতুন সেই চকচকে বাক্সটায় গুছিয়ে রাখতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু মা একথা বলার পরে বাগানে একটুখানি মাটি না খুঁড়লেও যে নয়! 

আপেল গাছটার নিচে মাটিটা বেশ নরম আর ভিজে। সে এখানটার মাটির বুকেই কোদালিটা যত জোরে সম্ভব গেঁথে দিল। তারপর ছোট্ট হাত দিয়ে মাটির বুকে কোদালি চালাতে লাগল। রোদে পুড়ে পুড়ে ওর তামাটে রঙের রোগা পিঠের এক দিকটা আর হাতের মাংসপেশীগুলো কোদালির চাপে ফুলে ফুলে উঠছে। করোস্তেলিওভ সিগারেট খেতে খেতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে। 

লিদা ভিক্তরকে কোলে নিয়ে ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সে বলল, ‘এস, ফুলের গাছ লাগিয়ে দিই এখানে। বেশ চমৎকার দেখাবে।’ 

আপেল গাছের গায়ে হেলান দিয়ে ভিক্তরকে সে এবার মাটির উপর বসিয়ে দিল। কিন্তু ছেলেটা একপাশে কাত হয়ে পড়ে গেল। 

লিদা এবার বিরক্ত হয়ে ভিক্তরকে এক ঝাঁকানি দিয়ে তুলে নিয়ে আবার সোজা করে গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিয়ে পাকা গিন্নীর মতো বলল, ‘আর একটু ভালো হয়ে বসতেও পার না বোকা ছেলে? তোমার বয়সী সব বাচ্চারা কেমন সুন্দর বসতে পারে। তুমি একটা আস্ত হাঁদারাম!’ 

করোস্তেলিওভ বারান্দা থেকে যাতে ওর কথা শুনতে পায় লিদা এমনভাবেই চেঁচিয়ে কথাগুলো বলল। তারপর আড়চোখে একটিবার করোস্তেলিওভের দিকে তাকিয়ে ওধার থেকে কয়েকটি গাঁদা ফুলের চারা এনে সেই নরম মাটির বুকে পুঁতে দিতে লাগল। 

‘বাঃ! কী সুন্দর দেখাচ্ছে দেখ!’ লিদা আনন্দের বলে উঠল। 

তারপর লাল সাদা কতগুলো পাথরের নুড়ি কুড়িয়ে এনে ফুলগুলোর চারপাশে সাজিয়ে দিল। হাত দিয়ে চাপড়ে চাপড়ে সমান করে দিল এবড়োখেবড়ো মাটি। লিদার হাত দুখানি কাদা মাটিতে একেবারে কালো হয়ে গেছে। 

সেরিওজার দিকে তাকিয়ে ও আবার বলল, ‘দেখ তো, এবার কেমন সুন্দর দেখাচ্ছে!’ সেরিওজা মাথা নেড়ে বলল। 

‘তা হলে? আমি ছাড়া কোন কাজটা তুমি অত সুন্দর করতে পার শুনি? 

সেই মুহূর্তে ভিক্তর আবার ধপাস্ করে চিৎ হয়ে পড়ে গেল। 

লিদা সেদিকে তাকিয়ে বলল, ‘বেশ হয়েছে। ওভাবেই শুয়ে থাক বোকা ছেলে।’

ভিক্তর কিন্তু একটুও কাঁদে নি। বুড়ো আঙুলটা মুখে পুরে দিয়ে চুষতে চুষতে উপরের দিকে তাকিয়ে অবাক দৃষ্টিতে গাছের পাতাগুলোকে দেখছে শুধু। লিদা এবার কোমর থেকে বেল্টের মতো বাঁধা রশিটা খুলে নিয়ে বারান্দার সামনে এসে লাফাতে শুরু করল। ‘এক, দুই, তিন…’ জোরে জোরে বলতে বলতে ও লাফিয়েই চলল। করোস্তেলিওভ ওর কাণ্ড দেখে হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকল। 

সেরিওজা এবার লিদার দিকে চেয়ে বলে উঠল, ‘দেখ, দেখ, বাচ্চাটার গায়ে কেমন পিঁপড়ে উঠেছে।’ 

লিদা লাফানো ছেড়ে এক দৌড়ে ভিক্তরের কাছে এসে ওকে টেনে তুলে গায়ের পিঁপড়ে ঝাড়তে ঝাড়তে বিরক্তির সুরে বলল, ‘আঃ! জ্বালিয়ে খেল ছেলেটা! সারাক্ষণ ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করলেও এটার গায়ে নোংরা লেগে থাকবেই দেখছি।’ পরিষ্কার করার পর ভিক্তরের জামা আর পাদুটো সত্যি কালো হয়ে উঠল। 

মা বারান্দা থেকে হাঁক দিল, ‘সেরিওজা, এদিকে এস এবার। পোশাক বদলে নাও। আমরা বেড়াতে বার হব।’ 

সেরিওজা এক লাফে উঠে দৌড়ে গেল। বেড়াতে যেতে ওর বড্ড ভালো লাগে। কারও বাড়ি বেড়াতে গেলে কী মজাটাই-না হয়! ওরা কত খাবার, মিষ্টি আর খেলনা দেয় ওকে! 

মা বলল, ‘আমরা তোমার নাস্তিয়া নানিকে দেখতে যাচ্ছি, বুঝলে?’ কোথায় কার কাছে যাচ্ছে তা জেনে ওর কী লাভ! যে কোনো এক জায়গায় বেড়াতে গেলেই হল। 

এই নানিটিকে আগে সে এখানে-সেখানে কয়েকবার দেখেছে। উনি দেখতে বড্ড গম্ভীর আর রাশভারি। একটা শাদা বুটিদার রুমাল তাঁর থুতনি থেকে মাথা পর্যন্ত আঁটসাঁট করে বাঁধা থাকে সর্বদা। তার আবার একটা অর্ডারও আছে। অর্ডারটার ওপর লেনিনের ছবি খোদাই করা আছে। নানির হাতে সর্বদা একটা কালো বড় ব্যাগ থাকবেই। সেটা থেকে চকোলেট বার করে উনি ওকে কতদিন দিয়েছেন। কিন্তু এর আগে কোনোদিন তারা নানির বাড়ি বেড়াতে যায় নি 

আজ ওরা তিনজনেই সবচেয়ে সুন্দর পোশাক পরে নিল। পথে বেরিয়ে মা আর করোস্তেলিওভ দু-দিক থেকে দু-জনে ওর হাত ধরেছিল বটে, কিন্তু তা ছাড়িয়ে নিয়ে নিজে নিজে পথ চলতে শুরু করল সে। নিজে নিজে হাঁটা কী মজা! পথের এধারে ওধারে কত কী দেখতে দেখতে চলা যায়। পরের বেড়ার ওধারে দেখা যায় ভীষণ কুকুর আর হাঁসগুলো। ইচ্ছে হলে অনেকটা এগিয়ে যাওয়া যায় আবার ওদের থেকে পিছিয়ে পড়া যায়। একটা ইঞ্জিনের মতো হুস্ হুস্ শব্দ করতে করতে বা পথের ধারের ঘাসের শীষ তুলে মুখে ঢুকিয়ে শিস্ দিতে দিতে যেমন খুশি চল। পথের উপরে হঠাৎ হয়তো কারও হারিয়ে যাওয়া পয়সাও কুড়িয়ে পেলে। বড়দের হাত ধরে চললে কি এসব করা চলে নাকি? না, তাতে কোনো মজা থাকে? ওদের হাত ধরে চললে হাত তো কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘেমে ভিজে উঠবে আর পথ চলবার কোনো আনন্দই যে থাকবে না তখন। 

তারপর ওরা একটা ছোট্ট দু-জানালাওয়ালা বাড়ির মধ্যে ঢুকল। বাড়িটা যেমন ছোট, উঠানটাও তেমনই ছোট। রান্নাঘরের ভেতর দিয়ে ওরা বাড়ির মধ্যে ঢুকতেই নানি এগিয়ে এসে অভ্যর্থনা জানালেন। নানি বললেন, ‘এস, এস সুখে থাক, অভিনন্দন নাও। 

সেরিওজা শুনে ভাবল তাহলে আজ নিশ্চয়ই উৎসবের দিন। পাশা খালার মতো সেরিওজাও বলল, ‘তুমিও অভিনন্দন নাও।’ 

সেরিওজা বসবার ঘরে ঢুকে চারদিকে তাকিয়ে দেখল কোথাও কোনো খেলনা নেই; এমনকি ঘর সাজাবার পুতুলও নেই, সুন্দর জিনিস নেই; শুধু খাবার আর শোবার জন্য একঘেয়ে প্রাণহীন কতগুলো আজেবাজে সরঞ্জাম এদিক ওদিক ছড়ানো রয়েছে। নানির দিকে তাকিয়ে ও বলল, ‘তোমার কোনো খেলনা নেই?’ 

(হয়তো খেলনা বা পুতুল অন্য কোথাও তুলে রেখেছে।) 

নানি বলল, ‘না, খেলনা-টেলনা আমার এখানে কিছু নেই বাছা। তোমার মতো কোনো বাচ্চা নেই তো। এস, তোমার জন্য এই যে টফি রেখেছি, খাও।’ 

টেবিলের উপর একরাশ পিঠে আর কেকের সঙ্গে একটা লাল কাচের পাত্রে কতগুলো টফিও রয়েছে। সবাই এবার টেবিলের পাশে চেয়ার টেনে বসে পড়ল। করোস্তেলিওভ বসেই একটা বোতলের ছিপি খুলে গ্লাসে গাঢ় লাল রঙের মদ ঢেলে নিল। 

মা বলল, ‘সেরিওজা কিন্তু ওসব খাবে না।’ 

এটা অবশ্য জানা কথা। ওরা সবসময় নিজেরা যখন-তখন ঐ রঙিন জল বেশ মজা করে খাবে কিন্তু তাকে কখনো দেবে না। কোনোরকম ভালো একটা কিছু বাড়িতে এলেই তার সেটা খাওয়া বারণ, এতো সে বরাবর দেখে আসছে। 

কিন্তু আজ করোস্তেলিওভ বলল, ‘ওকে একটুখানি দেব ভাবছি। তাহলে ও আমাদের স্বাস্থ্যপান করতে পারবে।’ 

ছোট্ট একটা গ্লাসে এবার সে বোতল থেকে সামান্য একটুখানি ঢেলে ওর হাতে দিল। সেরিওজার মনে হল করোস্তেলিওভের সঙ্গে ভালোভাবেই থাকা যাবে তাহলে। 

সবাই এবার পরস্পর গ্লাসগুলো একটা আরেকটার সঙ্গে ঠুং করে ঠেকাতে সেরিওজাও তার ছোট্ট গ্লাসটিকে ওদের গ্লাসের সঙ্গে ঠেকিয়ে নিল। 

ওদের সঙ্গে আজ আর এক বুড়িও আছেন। ওকে বড়-মা বলে ডাকতে বলে দিয়েছে ওরা। করোস্তেলিওভ ওকে নানি বলেই ডাকছে, সেরিওজার কিন্তু ওকে একটুও ভালো লাগছে না। লাল জলের গ্লাসটা তাকে দেওয়া হলে এই বড় মা’ই বলেছিল, ‘টেবিল ক্লথের উপর ফেলল বলে।’ 

ওদের গ্লাসের সঙ্গে তার গ্লাসটা ঠেকাতে গিয়ে সত্যি কিন্তু কয়েক ফোঁটা উপচে টেবিলক্লথের উপর পড়ে গেল। তখন বড় মা বলে উঠল, ‘দেখলে তো? আমি ঠিক বলেছি কিনা।’ 

তারপর নুনের পাত্র থেকে কিছুটা নুন নিয়ে সেই ভিজে জায়গায় দিয়ে রাগে গরগর করতে লাগল যেন। তার পর থেকে বড় মা একদৃষ্টে তাকেই দেখছে কেবল। ওর চোখে একজোড়া চশমাও রয়েছে আবার, বুড়ি কিন্তু একেবারেই বুড়ো থুড়থুড়ে। তামাটে রঙের হাত দু-খানি কুঁচকে এবড়োখেবড়ো হয়ে গেছে। লম্বা টিকালো নাকটা একটু নিচে হেলে আছে। থুতনিটা এককালে বোধহয় বেশ ভরাট ছিল। এখন কেমন চিমসে চুপসে গেছে যেন। 

লাল জলটা সত্যি কী মিষ্টি খেতে! এক চুমুকে সে সবটা গিলে ফেলল। তাকে একটা প্লেটে করে পিঠেও দেওয়া হয়েছে। পিঠেটা চটকে চটকে সে খেতে আরম্ভ করল। বড় মা আবার বলে উঠল, ‘কেমন করে খেতে হয় তা-ও জান না বুঝি?’ 

এ কথায় ভীষণ অস্বস্তি বোধ করে সে চেয়ারটাকেই বেদম নাড়াতে আরম্ভ করল।

বুড়ি আবার ধমকে উঠল, ‘এই দুষ্টু ছেলে, ঠিক হয়ে ভদ্রভাবে বসতেও জান না?’

এদিকে তার পেটে গরম লাগছে। চিৎকার করে গান গাইতে ইচ্ছে করছে তার, তাই হঠাৎ সে গান শুরু করল। 

বড় মা বলে উঠল, ‘আঃ! শিক্ষাসহবত এতটুকুও নেই নাকি?’ 

করোস্তেলিওভ সেরিওজার পক্ষ নিয়ে বলল, ‘ওকে খেপাচ্ছ কেন বল তো? বেচারিকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও।’ 

বড় মা আবার বলল, ‘একটু সবুর কর না, দেখ ও ছেলে আরো কী করে!’

বুড়িও কিন্তু ঐ রঙিন জল খেয়েছে, চোখ দুটো তার চশমার ভিতর দিয়ে কী জ্বলজ্বল করছে। 

সেরিওজা এবার চেঁচিয়ে উঠল, ‘যাও, তোমাকে আমি একটুও ভয় পাই না!’

মা-কে সে বলতে শুনল, ‘কী কাণ্ড করছে ছেলেটা!’ 

করোস্তেলিওভকে বলতে শুনল, ‘তোমরা বড্ড বাজে বক্ কর কিন্তু, খেয়েছে তো এই একফোঁটা। এক্ষনি সব ঠিক হয়ে যাবে। 

‘হাঁ, আমি আরো খাব, খাবই তো!’ সেরিওজা চেঁচিয়ে উঠল, নিজের গ্লাসটির দিকে হাত বাড়াল, আর এমন সময় খালি বোতলটা পড়ে গেল। বাসনগুলো সব ঝনঝন করে উঠল। মা-র দিকে চোখ পড়তেই সে দেখল, মা কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। আর বড় মা টেবিলে কিল মেরে চিৎকার করছে, ‘কেমন, হয়েছে তো? কী কাণ্ডটাই-না করছে!’ 

কিন্তু সেরিওজার যে এখন দোলানি খেতে ইচ্ছে করছে। তাই সে এদিক-ওদিক দুলতে শুরু করল। টেবিলের উপর পিঠে, কেক, মিষ্টি, গ্লাস, প্লেট সমস্ত কিছু কেমন তার চোখের সামনে দুলছে। বাঃ! বেশ মজা তো! মা, করোস্তেলিওভ, নানি, এমনকি বড় মা’টাও যেন দোলান-চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছে। সেরিওজার এবার হাসি পাচ্ছে কিন্তু, হো হো করে কেবলই হাসতে ইচ্ছে করছে। হঠাৎ সে শুনতে পেল কে যেন গান করছে। একি, বড় মা গান করছে যেন! তোবড়ানো হাতে চশমাটি রেখে দুহাত নেড়ে নেড়ে অদ্ভুত ভঙ্গি করে বুড়ি কেমন গান গেয়ে চলেছে দেখ! নদীর তীরে গিয়ে কাতিউশা যে গান গেয়েছিল এ সেই গান। শুনতে শুনতে কখন সে একটা পিঠের উপর মাথাটি রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। 

…ঘুম যখন ভাঙল তখন দেখল বড় মা ওখানে নেই, অন্য সবাই চা খাচ্ছে। ওরা সেরিওজার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। মা প্রশ্ন করল, ‘কেমন? একটু ভালো বোধ করছ তো? আর চেঁচামেচি করবে না তো? ওঃ! কী কাণ্ডটাই করছিলে!’ 

সেরিওজা এবার অবাক হয়ে ভাবল : সে কী! আমি আবার চেঁচালাম কখন? মা কী বলছে যা তা? 

মা এবার ব্যাগ থেকে একটা চিরুনি বের করে ওর চুল আঁচড়ে দিতে লাগল। নাস্তিয়া নানি বলল, ‘এই যে, মিষ্টিটা খাও।’ 

রঙ-ওঠা পর্দাটার পিছনদিকে পাশের ঘরে কে যেন ভোঁস ভোঁস করে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। সেরিওজা এবার আস্তে পর্দাটা সরিয়ে উঁকি মেরে দেখল, ওমা, এ যে বড় মা বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে আর এমন বিদ্‌ঘুটে ভাবে নাক ডাকছে। সে এবার এ ঘরে এসে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাড়ি যাব। আর ভালো লাগছে না আমার 

বিদায় নেবার সময় সে শুনল করোস্তেলিওভ নানিকে ‘মা’ বলে ডাকছে। করোস্তেলিওভের আবার মা আছে তা তো সে এতদিন জানত না! সে ভেবেছে ওরা এমনিতেই দু-জন দু-জনকে চেনে শুধু। 

এবার তারা বাড়ি ফিরে চলল। কিন্তু পথটা বড় লম্বা আর একঘেয়ে মনে হচ্ছে এখন। একটুও হাঁটতে ইচ্ছে করছে না কিন্তু। করোস্তেলিওভ তো এখন ওর বাবা, তবে কেন ওকে কোলে করে নিচ্ছে না? অন্য সকলের বাবারা তো তাদের ছেলেদের কত সময় কাঁধে করে নিয়ে যায়। বাবার কাঁধে চড়ে ছেলেদের কতই-না আনন্দ হয়, আবার গর্বেও বুক ভরে ওঠে। বাবার কাঁধে উঠলে পথের এদিক-ওদিক সমস্ত কিছু সুন্দর স্পষ্ট দেখাও যায়। তাই সে বলেই ফেলল, ‘আমার পা ব্যথা করছে যে!’ 

মা বলল, ‘আর একটুখানি পথ আছে, আমরা প্রায় এসেই পড়েছি। এটুকু পথ বেশ হাঁটতে পারবে।’ 

কিন্তু সেরিওজা করোস্তেলিওভের সামনে গিয়ে তার হাঁটু দুটো জড়িয়ে ধরল ওর ছোট্ট দু-খানি হাত দিয়ে। 

মা ধমকে বলে উঠল এবার, ‘এত বড় ছেলে কোলে উঠতে চাও? ছি ছি, কী লজ্জার কথা!’ করোস্তেলিওভ কিন্তু তক্ষুনি দু-হাতে তুলে নিয়ে তার চওড়া কাঁধের ওপর ওকে বসিয়ে দিল। 

উঃ! নিজেকে কী উঁচু মনে হচ্ছে এবার! কিন্তু সে এতটুকুও ভয় পাচ্ছে না। একটা পুরনো শক্ত দেরাজকে এক হেঁচকা টানে যে এক মুহূর্তে সরিয়ে আনতে পারে সে কি কখনো তাকে কাঁধ থেকে ফেলে দেবে? সে নির্ভয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে আর রাস্তার এধারে-ওধারে লোকের বাড়ির উঠানে, এমনকি বাড়ির ছাদে কী হচ্ছে না হচ্ছে সব দেখতে পাচ্ছে। ভারি মজার ব্যাপার কিন্তু! সারাটা পথ এভাবে কত কী মজার জিনিস দেখতে দেখতে সে মনের আনন্দে, কাঁধে চড়ে চলেছে। তার বয়সী কত ছেলেরা হেঁটে যাচ্ছে। ওদের দেখে তার যে ওদের জন্য একটু কষ্ট না হচ্ছে তা-ও নয়, আবার অহংকারেও বুকটা ভরে উঠছে। বাবার কাঁধে চড়ে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে এমনি করে বাড়ি ফেরার মধ্যে কী যে মজা আজই যেন সে প্রথম বুঝতে পারল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *